পরিবর্তনশীল এই সময়ের সাথে সব কিছুর পরিবর্তন যেন প্রকৃতির এক বাঁধা নিয়ম। ছোট্ট বেলার সেই চিরচেনা গ্রামেও আধুনিকতার ছোঁয়া৷ শিল্পীর আঁকা ছবির গ্রাম গুলো যেন শহর। সময়ের পরিবর্তন, নগরের পরিবর্তন, যুগের পরিবর্তন, পরিবর্তন প্রজন্মের! আচ্ছা, ভাষার কি পরিবর্তন হয় ? ভাষা কি যুগ যুগান্তরে একই রূপে বিদ্যমান থাকে নাকি সেও এই আধুনিকতায় ভেসে যায়!! অথবা আধুনিকতার এই আমরাই কি প্রিয় ভাষাকে পরিবর্তন করে ফেলি কিংবা করতে সহায়তা করি নিজের অজান্তে ই!
ভাষা পরিবর্তনশীল। যুগে যুগে, এক সভ্যতার থেকে অন্য সভ্যতায়, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মেই ভাষার মৃত্যু ঘটে৷ জন্ম হয় নতুন ভাষার, পুরাতন মৌলিক ভাষার সাথে নতুনত্বের অদ্ভুত মিলন। আমাদের মতো, ভাষারও যেন হয় জন্ম, হয় মৃত্যু, হয় রূপান্তর ।
আমাদের বর্তমান সময়ের কথাই বিবেচনা করা যাক। বাংলা আছে, বাংলার মানুষের প্রিয় ভাষাও আছে। কিন্ত, আছে কি ভাষার সঠিক চর্চা! বর্তমানে খুব কম ব্যক্তির দেখা পাওয়া যায় যারা কিনা ঠিক, সঠিক নিয়মেই কথা বলে। যে কথার মাধূর্যতায় প্রিয় বাংলা ভাষা প্রাণ ফিরে পায়। মুদ্রার অপর পিঠ যেন ইকটু ভিন্ন। যেখানে কথা বলার মধ্যে যত গুলো বাংলা ভাষার শব্দ থাকে তার থেকে ঢের ইংরেজি ভাষার শব্দ বিদ্যমান । খুব স্বাভাবিক ভাবে বিবেচনা করলেই দেখা যায় সোস্যাল মিডিয়ার প্রভাবে আমাদের কথা বলা, লেখার মাঝেও পরিবর্তন এসেছে৷ এখন আমাদের দিনে শুরুটা শুভ সকালের পরিবর্তে Good morning, কারোর সাথে দেখা হলে হয় তো কেমন আছো বা চিরায়ত সেই সব সম্বোধন মুছে গিয়ে Hi, Hey, Hello তে চলে এসেছে৷ এটাই স্বাভাবিক । আমাদের পৃথিবী নিয়মিত ই পরিবর্তিত হচ্ছে৷ আমাদের ভাষাও কিন্তু নয় স্থির। প্রবাহমান সময়ে, আমাদের সাথে সাথে ভাষা উন্নতি লাভ করে। নদী যেমন তার ইচ্ছা মতো গতিপথ পরিবর্তন করতে পারে ; তেমন করে আমাদের ভাষাও গতিপথ পরিবর্তন করে। এই পরিবর্তনের প্রভাব সর্বত্র ই বিদ্যমান হয়৷
তাই বলা যায়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে এটি প্রয়োগ করা যায়। ধ্বনিগত পরিবর্তন একটি ভাষার শব্দের ধরনের উপর প্রভাব ফেলে। শব্দগত পরিবর্তনে শব্দের অর্থ পরিবর্তন হয়। শব্দকোষ পরিবর্তন শব্দভান্ডারে পরিবর্তন ঘটায়। ব্যকরণগত পরিবর্তন ব্যকরণ কাঠামোতে পরিবর্তন আনে। ভাষাগত পরিবর্তন বিভিন্ন রকম। অর্থনৈতিক কারণ প্রায়ই মুখ্য হয়। নতুন পণ্য আবিষ্কারের সাথে ভাষার পরিবর্তন সম্পৃক্ত। নতুন পণ্যের নতুন নাম দরকার হয়, তাই নতুন শব্দের আগমন ঘটে। ভাষার পরিবর্তন হঠাৎ করে হয়, পরিকল্পনা করে নয়। এটা একটি প্রাকৃতিক ঘটনা এবং নিজে নিজেই এটা ঘটে। যেমন, আগে মানুষ সাবান বলতে ক্ষার জাতীয় পরিষ্কারক কিছু বুঝতো কিন্তু এখন সাবান বলতে বিভিন্ন ব্রান্ডের কিছু সাবানের কথা চোখে ভেসে উঠে। যাদের সুন্দর সুন্দর নাম৷ যে নামের সাথে আগেও কেউ কখনো পরিচিত ছিল না। যার ফলে ঠিক এই ভাবেই হয়তো নতুন নতুন শব্দ আমাদের চলমান ভাষার সাথে যুক্ত হয়৷ যা কিনা বিশ্বায়নের ফল মাত্র৷
আজকের দিনে প্রযুক্তি, সোশ্যাল মিডিয়া আর গণমাধ্যমের প্রভাবে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন শব্দ। আমাদের সুবিশাল এক শব্দ ভান্ডার থাকা স্বত্তেও বিদেশী শব্দ ব্যবহার করার কারন পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব৷ যদিও আমরা বর্তমানে এই সব শব্দ ব্যবহার না করি তাহলে আমরাই পিছিয়ে থাকবো সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলা হয়ে উঠবে কিনা সন্দিহান৷ এর মধ্যে থেকেই কিছু শব্দ ঝরে যাবে কিছু স্থায়ী ভাবে থেকে যাবে আমাদের মাঝে। তবে এটাই সত্য যে গ্রহন বা বর্জন যা ই হোক ভাষার ছুটে চলা নিরন্তর৷
আমাদের বাংলা ভাষার প্রচলনের জন্য পাশ করা হয় "বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭ । " গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩নং অনুচ্ছেদের বিধানকে পূর্ণরূপে কার্যকর করবার উদ্দেশ্যে ১৯৮৭ সালের ৮ই মার্চ প্রণীত হয় ৷ মূলত এই আইনের প্রয়োগ সকল আইনি ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে বিদ্যমান ৷যদিও উচ্চ আদালতের রায় গুলো ইংরেজিতে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুপ্রীম কোর্টের রায় বাংলায় লেখার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, “যে ভাষা আমরা সবাই বুঝতে পারি, সেই ভাষায় (রায়) লেখা উচিত।” সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান লিখেছেন, 'আইনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রচলনের জন্য যথাযথ আইন প্রণয়ন কেন সরকারি উদ্যোগে করা হয়নি আমি বুঝতে পারি না।' তিনি আরো লিখেছেন 'যদি ন্যায়বিচার সদগুণ হয় এবং জনগণের কল্যাণের জন্যই যদি এর কাজ হয় তবে তা জনগণের ভাষাতেই হওয়া উচিত।' তবে "আমি খোলাখুলি করে বলি 'দেশের জনগণ যদি চান তাঁদের দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সব কাজ তাঁদের ভাষায় হবে, তাঁদের প্রতিনিধিরা সংসদের যতদিন না আইন পাস করছেন ততদিন বিচারকবৃন্দ স্বেচ্ছায় বাংলায় হাতেখড়ি দিতে চাইবেন না।" আমাদের বাংলা ভাষা প্রচলন আইনের সঠিক প্রয়োগ সর্বত্র ই হওয়া সমীচীন তবেই আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষার অক্ষুণ্ণতা বজায় থাকবে৷
ভাষার পরিবর্তন হচ্ছে হবে কিন্তু আমাদের সকলের একটু লক্ষ্য রাখা জরুরি যেন এই পরিবর্তনের প্রবণতা বেশি না হয়ে যায় কিংবা কিছু টা হলেও রোধ করার প্রয়াস থাকে আমাদের মাঝে। নতুবা বাংলা ভাষাও হয়তো এক সময় পরিবর্তন হতে হতে হারিয়ে যাবে হিব্রু, ল্যাটিন, পালি ভাষার মতো৷ যদি এই বাংলা ভাষায় লেখা কোন গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস শত- হাজার বছর পরেও যদি কেউ পড়তে বা বুঝতে না পারে তাহলে এই ভাষার জন্য সংগ্রাম, রক্ত দান, জীবন দান সব বৃথা হয়ে যাবে৷ তাই সর্বদা এই কামনা ই করি "বেঁচে থাক বাংলা, থাক বাংলার ভাষা৷"
YOU ARE READING
বেঁচে থাক বাংলা, থাক বাংলার ভাষা
Non-Fictionআমাদের বাংলা ভাষা প্রিয়া ভাষা৷ যে ভাষাতেই এত সব লেখা লিখি করি৷ সেই ভাষা যদি তার মূল থেকে পরিবর্তন হয়ে যায় তাহলে কি বাংলা ভাষা তার নিজের স্বকীয়তা হারাবে ? বাবুই পাখির মতো কি নিজের গর্বের জায়গা থাকবে তাহলে !!