আপন সন্তানের হাতে খুন হয়ে যেতে কেমন লাগে সেকথা জানিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। তাই তাঁরা জানিয়েও যেতে পারেননি সেকথা। আজকের ব্রেকিং নিউজ। বাবা মা বোন ও ঠাকুমাকে খুন করে বাড়িতেই চার মাস পুঁতে রেখে দিয়ে দিব্যি স্বাধীন জীবন যাপন করছিল বাড়ির ছোট ছেলে। খবর থেকে যতটুকু জানা যাচ্ছে, বড়ো ছেলে এই চার মাস নাকি পালিয়ে ছিল ভাইয়ের হাত থেকে। তাকেও খুনের চেষ্টা করেছিল ছোট ভাই। কিন্তু গায়ের জোরে পেরে ওঠেনি নাকি। কিন্তু ঘটনার চার মাস বাদে ভাইয়ের নামে থানায় খবর দেওয়ার পিছনের আসল কারণটা এখনো পরিস্কার জানা যায়নি। কেন বড়ো ভাই ছোট ভাইয়ের বিরুদ্ধে চার মাস বাদে থানায় গেল। কেন ঘটনার পরেই যায় নি। কেন এতদিন নিশ্চুপ ছিল। এসবই এখন পুলিশি তদন্তের বিষয়। পুলিশ তার কাজ করবে। খুনের মোটিভ কি ছিল। বড়ো ভাইয়ের চারমাস নীরবতা পালনের পিছনে মোটিভ কি ছিল। কিভাবে খুন হলো। ছোটছেলের জীবনের লক্ষ্য কি ছিল। ইত্যাদি ইত্যাদি। সে সব পরের কথা। কিন্তু আপন সন্তানের হাতে কেন খুন হতে হয় বাবা মা সহ বাড়ির অন্যান্যদের। এরকম ঘটনা আজ আর খুব একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় কিন্তু। গত তিন দশকের হিসেবও যদি সঠিক ভাবে নেওয়া যায়। দেখা যাবে সন্তানের হাতে খুন হওয়ার ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এবং এও দেখা যাবে। হঠাৎ উন্মত্ত ক্রোধে দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে খুন করার ঘটনার থেকে অনেক বেশি ঘটে ঠাণ্ডা মাথায় দীর্ঘ দিনের পরিকল্পনায় সংঘটিত খুনের ঘটনা। আর সেটিই সবচেয়ে বড়ো চিন্তার কথা। রাগের মাথায় কাউকে আঘাত করায় খুনের ঘটনা একরকম বিষয়। আর ঠাণ্ডা মাথায় দিনের পর দিন ধরে কাউকে খুনের পরিকল্পনা করা ও খুন করা সম্পূর্ণ অন্য বিষয় কিন্তু। বিশেষ করে অপরাধ সংঘটিত হয় যখন আপন সন্তানের হাতে। এবং সেই সন্তানের বয়স যত কম হয় আমাদের বিস্ময়বোধ ততই বেশি হয়ে ওঠে।
আজকের সমাজ সংসারে বিশেষ করে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের সাথে বাড়িতে বাবা ও মায়ের সংযোগ দিন দিন কমতেই থাকছে। এমনটাও নয় যে আগেকার দিনে সেই সংযোগ খুব বেশি করে থাকতো। বা অনেক বেশি বলিষ্ঠ ছিল। না, চিরকালই উঠতি বয়স বাবা মায়ের কাছ থেকে একটা আড়াল খোঁজে। এই আড়াল মনের আড়াল। মানসিকতার আড়াল। এটা চিরকালের ধর্ম। কিন্তু আগেকার দিনে উঠতি বয়সের ছেলে মেয়েরা সমবয়সী প্রায় সমবয়সী ভাইবোনেদের সাথে একসাথে বেড়ে ওঠার একটা পরিবেশ পেত্। খুড়তুত মামাতুত মাসতুত পিসতুত ভাই বোনেদের সাথে মাঝে মধ্যেই কয়েকদিন একসাথে কাটানোর পরিসর ছিল আগে। বর্তমানে যেটা প্রায় ভ্যানিশ। গোদের উপরে বিষফোঁড়, অধিকাংশ সংসারেই এক সন্তান। এরপর সমাজিক বিন্যাস গিয়েছে বদলে। আগে ছেলে মেয়েরা পাড়ার সমবয়সীদের সাথে যেভাবে খেলাধুলো মেলামেশার ভিতর দিয়ে বেড়ে উঠতো। আজকাল সেই সুযোগও কমে এসেছে। স্কুল আর প্রাইভেট কোচিং সেন্টারের ভিতর কেবল হোমটাস্কের গোলকধাঁধায় বন্দি জীবন। এবং পরীক্ষায় নম্বর তোলার ইঁদুর দৌড়। এর সাথে উঠতি বয়সীদের জীবন থেকে সকাল বিকেল মাঠে ঘাটে খেলাধুলার পাট অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে শহরে নগরে। আবাসন শিল্পের কল্যাণে। আর ঠিক সেই সময়ে হাতে চলে এসেছে মোবাইল। হাতে চলে এসেছে ল্যাপটপ। হাতে চলে এসেছে দুনিয়াজোড়া ইনটারনেট। যেখানে ধারে কাছে নেই বাবা মা। ভাই বোন। ঠাকুমা দিদিমা। এমনকি পাড়াতুত বন্ধবান্ধব। এক অদ্ভুত ডিজিটাল অঁধারে ঢুকে গিয়েছে সমগ্র কৈশোর। যে আঁধারে পরিবার বিষয়টার আর বিশেষ কোন প্রাসঙ্গিকতা থাকছে না উঠতি বয়সীদের অবচেতনে। আর চেতনায় অর্থ সামর্থ্য আর প্রযুক্তির সুযোগ হাতে পাওয়াই প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।
সমস্যাটা তাই মূলত সামাজিক। সমাজ যে গতিতে যে অভিমুখে ছুঠছে। তার সাথে তাল রেখেই কিন্তু এই ঘটনাগুলি ঘটে চলেছে। পারিবারিক বাঁধন আলগা হয়ে পড়ছে। গড়ে উঠছে না সামাজিক কোন বাঁধনও। পারিবারিক বাঁধন আলগা হওয়ার নেপথ্যের মূল কারিগর অভিভাবকরা নিজেরাই। যতটা সম্ভব আত্মীয়স্বজনদের থেকে দূরবর্তী থাকার মানসিকতার বীজ তাঁরা নিজেদের অজান্তেই সন্তানদের ভিতরে বুনে দিতে থাকেন। নিজেদের জীবনশৈলীর ভিতর দিয়ে। অতিরিক্ত স্বার্থপরতার যে সংস্কৃতি আজকের পরিবারগুলিকে গ্রাস করে ফেলেছে। তার থেকে কচিকাঁচাদের মুক্ত রাখার কোন উপায় নেই আর। বাবা মায়ের সংসর্গ থেকেই সন্তানের ভিতরে সুযোগসন্ধানী আত্মসুখ সর্বস্ব প্রকৃতি সংক্রমিত হতে থাকে। এই এক ভয়াবহ সংক্রমণের শিকার আজকের প্রতিটি বাচ্চা। আর আমাদের প্রকৃতি হলো রোগের গভীর গিয়ে রোগের শিকড়ের সন্ধন করার বদলে রোগের সিম্পটম নিয়ে লাফালাফি করা। ফলে একটির পর একটি ঘটনার জন্ম হতে থাকে। কারণ মূল অসুখের বিস্তার অভিভাবক থেকে সমাজের প্রতিটি স্তরে। কচিকাঁচারা শুধু সেই অসুখের সহজ শিকার মাত্র। টিভির পর্দায় সচিত্র সমাজের অসুখ দেখেও আমাদের বুদ্ধির গোড়ায় জল ঢোকে না। সমাজ সংসার যে গতিতে যে অভিমুখে পারি দিচ্ছে। আমরাও চোখকান বুঁজে সেই দিশায় গা ভাসানোকেই সমাজ বাস্তবতা বলে নিজের পিঠ নিজেই চাপড়াচ্ছি। আর ঘরে ঘরে বিকলাঙ্গ মানসিকতার উঠতি বয়সীদের প্রজন্ম সংখ্যা বিস্তার করে চলেছে্ চলবে।
১৯শে জুন' ২০২১
কপিরাইট সংরক্ষিত।
YOU ARE READING
বিকলাঙ্গ সময়
Non-Fictionআপন সন্তানের হাতে খুন হয়ে যেতে কেমন লাগে সেকথা জানিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। তাই তাঁরা জানিয়েও যেতে পারেননি সেকথা। আজকের ব্রেকিং নিউজ। বাবা মা বোন ও ঠাকুমাকে খুন করে বাড়িতেই চার মাস পুঁতে রেখে দিয়ে দিব্যি স্বাধীন জীবন যাপন করছিল বাড়ির ছোট ছেলে। খবর থেকে য...