সীতা নিতান্তই রামচন্দ্রের বাধ্য স্ত্রী, কদাচিৎ অভিমানী প্রেমিকা, মহাকাব্যের নায়িকা হওয়ার যোগ্যতা তাঁর নেই।
নায়িকা হতে পারেন দ্রৌপদী। ভেবে দেখুন, দুঃশাসন যখন তাঁকে টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে আনলেন উন্মত্ত কুরুসভায়, প্রথমেই যুধিষ্ঠিরকে একটা সপাটে থাপ্পড় কষাতে পারতেন, তাতে অনায্য কিছুও হত না। কৌরবদের সাথে বাকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারতেন। দয়াভিক্ষা চাইতে পারতেন শ্বশুরের পায়ে। অথচ মেয়েটা প্রশ্ন তুলল একদম ল' পয়েন্টে। "ধর্মরাজ কোন বাজি আগে হেরেছেন, নিজেকে না দ্রৌপদীকে???" শাবাশ!
পঞ্চপতি তাঁর। শাস্ত্রমতে সকলকেই সমান ভালোবাসতে হয়! কিন্তু প্রিয়তম সেই অর্জুন! মহাপ্রস্থানের পথে এই পাপেই তাঁর পতন হয়। তা হোক, প্রথম প্রেম যে অত সহজে ভোলা যায় না, তা সে পুরুষ আরো যতগুলো বিয়েই করুন না কেন। মেনে নিলেন সুভদ্রাকে, অভিমন্যু হয়ে উঠল তাঁরই সন্তান!তিনি শ্রীকৃষ্ণের প্রিয়সখী, বনবাসের ঘরে জীবনের সমস্ত যন্ত্রণার কথা বলছেন তাঁকে, হাউহাউ করে কাঁদছেন। কৃষ্ণ স্বান্তনা দিয়ে বলেন, "ভাবিণী, তুমি রাজমহিষী হবে।"
কৃষ্ণ তাঁর দুর্দিনের সহায়, সৌভাগ্যের আশ্বাস। তাঁর একমাত্র বন্ধু। কনসেপ্টেই কি অভিনবত্ব!কিংবা বিধ্বংসী যুদ্ধের সেই শেষ লগ্ন। শয়ে-শয়ে চিতা জ্বলছে চারিদিকে, হাহাকার শুধু হাহাকার। অশ্বথামা পান্ডব-ভ্রমে হত্যা করলেন দ্রৌপদীর পাঁচ সন্তানকে। তীব্র শোকে সন্তানহারা মা চিৎকার করে উঠলেন 'এনে দাও অশ্বথামার মাথার মণি, এক্ষুণি।' জেদ, সাহস, অধিকার-আগুন, এজন্যই তিনি সম্রাজ্ঞী, যাজ্ঞসেনী।
আবার নায়িকা হন রাধা, শ্রীকৃষ্ণের শরীর থেকেই সঞ্জাত, তাঁরই সমান, তাঁরই প্রাণপ্রিয়া। জগত উদ্ধারের ডাক এসেছে তাঁর প্রেমিকের। বৃন্দাবনের লীলাহাস্য পেরিয়ে কৃষ্ণ 'ঈশ্বর' হয়ে ওঠার পথে এগিয়ে গেলেন। এইমুহূর্তে রাধা একা, আর এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর জাগরণ, 'রাধা' হয়ে ওঠা।
রাধা যেন চিরবসন্তের মূর্তি কিংবা চিরবিরহের!প্রত্যেকটি বৈষ্ণব পদাবলী জুড়ে শুধুই তিনি। এমনকি বাংলার লোকগানেও 'রাই আমাদের, রাই আমাদের, আমরা রাইয়ের, শ্যাম তোমাদের, রাই আমাদের।' জগদীশ্বরকে ফিরিয়ে ভক্তহৃদয় রাধাকে খুঁজছেন, 'রাধা' হওয়ার সাধনা করছেন। বৃন্দাবন বিলাসিনী রাধা!
কালিন্দীকে কৃষ্ণ-জ্ঞানে তিনি যখন ঝাঁপিয়ে পড়েন, হয়তো সেখান থেকেই সূচনা হয় 'রাধা-তত্ত্বের'। অনন্ত এক জ্ঞান, রহস্যাবৃত, যার শুরু আছে, শেষ নেই। এ কোন ব্যর্থ প্রেমগাথা নয়, নীতিশিক্ষাও বলা চলে না, আবার নিছকই ভক্ত-ভগবানের কথাও নয়।
রাধা যেন প্রেম শেখান। অনুভব করান প্রতিমুহূর্তে।
বলা ভালো তিনি শর্তবিহীন সমর্পণের প্রতীক, যা কিন্তু প্রেমের চেয়েও কঠিন!