ভাষা ও ভালোবাসা

142 2 0
                                    

আমার বুঝ হওয়ার পর থেকেই বলে রেখেছি বিয়ে করলে বাঙালি ছেলেকেই করবো। বাঙালি বলতে যে একদম মাছে-ভাতে বাঙালি হতে হবে তা না! শুধু প্রবাসে থেকে নিজের স্বত্তাকে বিসর্জন না দিলেই হলো। মন থেকে দেশের প্রতি টান থাকতে হবে। ঠিক যেমন ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তরে। যাই হোক মা একদিন হঠাত্ করে বললো আমার জন্য নাকি ছেলে দেখেছে। যেহেতু আমি কারোর সাথে সম্পর্কে আবদ্ধ নই তাই আমার বিয়েতে কোনো আপত্তি নেই। মা জানালো ছেলে নাকি আমার মনের মতোই। কোনো একটা বিশেষ দিবস মিস করে না। ছেলেপক্ষ যখন আমাকে দেখতে আসলো তখন ছেলেকে দেখেই ভালো লেগেছে। অবশ্য ভালো লাগার ই কথা। এমন সুদর্শন পুরুষ কারোর অপছন্দ হবার কথা নয়। কিন্তু কথায় কথায় ইংরেজি বলাটা আমার ঠিক পছন্দ হচ্ছিলো না। তবুও তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালাম না। বিয়ের কথা মোটামুটি পাকা হয়ে গেছে। নিজেদের চেনার জন্য আমাদের একমাস সময় দেওয়া হলো। একমাস পর আংটি বদল হবে।
.
.
রাতুলের সাথে আমি যেদিন প্রথম দেখা করতে গেলাম সেইদিন ছিলো ফেব্রুয়ারি মাসের ২ তারিখ। টুকটাক আমরা কথা বলার মাধ্যমে আমাদের নিজেদের ভিতর যে জড়তা ছিলো তা কেটে যায়। এখন আমরা অনেকটা বন্ধুসুলভ আচরণ করতে পারি। আমাদের দ্বিতীয়বার দেখা হয় ভালোবাসা দিবসে। আমরা বসে আছি একটা পাঁচ তারকা রেস্তোরায়। সে আমার সামনে বসে জিজ্ঞাসা করলো আমি কি খাবো? আমি মৃদু হেসে জবাব দিলাম তার ইচ্ছেমতো যেকোনো কিছুই খাওয়া যায়। আমরা যখন খাবারের জন্য অপেক্ষা করছি তখন রাতুল আমার দিকে কতগুলো গোলাপ সাথে একটা শুভেচ্ছা পত্র দিলো। আর বললো, "জানো যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক প্রায় ১০০ কোটি পাউন্ড খরচ করে ফুল, চকলেট, শুভেচ্ছা কার্ড ক্রয় করে। আর প্রায় ২.৫ কোটি শুভেচ্ছা কার্ড আদান-প্রদান হয়"
"ও আমি জানতাম না।"
"জানার কথাও না। এই দেশের মানুষ শুধু ঘুরাঘুরিই শিখছে। এইজন্য যুক্তরাষ্ট্র আমার খুব পছন্দ। তিনবছর ছিলাম পড়াশোনার জন্য। সারাবছর থেকে গেলেও মন্দ হতো না"
আমি তার কথা শুনে অবাক হলাম। ভালোবাসা দিবস উদযাপনের ভিত্তিতে কারোর অন্য দেশের প্রতি নিজের দেশ থেকে বেশি ভালোবাসা কি করে আসতে পারে? আমাকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিজেই বলে উঠলো, "আরে শুধু এই কারণে না। যুক্তরাষ্ট্র সবদিক দিয়েই অনেক এগিয়ে তাই ভালো লাগে"
আমি শুধু বললাম, "ও"
তারপর দুইজনেই কিছুক্ষণ নিরব থাকলাম। আমাদের খাবার চলে এসেছে। চুপচাপ খাচ্ছি হঠাত্ রাতুল আবার বললো, "বলোতো এই ভালোবাসা দিবস আসছে কোথা থেকে?"
আমি একটু বিভ্রত হয়ে বললাম, "আমি জানি না"
"আমি বলছি শোনো। ২৬৯ সালের দিকে ইতালির রোম নগরীতে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার করা নিষিদ্ধ ছিলো। কিন্তু সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামে একজন খ্রিস্টান পাদ্রী ও চিকিৎসককে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের অভিযোগে রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্রাডিয়াস তাঁকে বন্দী করে।"
"এর সাথে ভালবাসা দিবসের কি সম্পর্ক?"
"আগে পুরোটা শুনো তো"
"আচ্ছা বলুন। শুনছি"
"তাঁকে যে কারাগারে রাখা হয়েছিলো। সেই কারারক্ষীর মেয়ে দৃষ্টিহীন ছিলো। তারপর সেন্ট ভ্যালেন্টাইন তাঁকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তুলে। আর এতে সে অনেক জনপ্রিয় হয়ে যায়। তার জনপ্রিয়তা সম্রাট সহ্য করতে না পেরে তাঁকে মৃত্যুদন্ড দেয়। যেদিন তার মৃত্যু হয় সেদিন তারিখ ছিলো ১৪ ই ফেব্রুয়ারি "
"অদ্ভুত একজন মানুষ মারা গেছে আর সেটাকে অন্যরা আনন্দ দিন হিসেবে পালন করে?"
"ভালোবাসার জন্যই তো মারা গেলো। তাই না?"
"এখানে ভালোবাসার কি আছে? একজন ডাক্তার রোগীর চিকিৎসা করবে এটাই স্বাভাবিক"
"আরে নাহ! ৪৯৬ সালে পোপ সেন্ট জেলাসিউ ১ম জুলিয়াস ভ্যালেন্টাইন'স স্মরণে ১৪ই ফেব্রুয়ারিকে ভালোবাসা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন"
"কি অদ্ভুত ইতিহাস।"
"আরো আছে শোনো"
"না আমার ভালো লাগছে না"
.
.
বাসায় আসার পরও ভাবতেছিলাম ভালোবাসার দিবসের এরকম অদ্ভুত ইতিহাস কেনো? কোনো আকর্ষণীয় ইতিহাস থাকতে পারতো। তবে এই ইতিহাস দিয়ে কি আসে যায়! লোকটা যে এতে কি এমন আনন্দ পেয়েছে উনিই জানে। যেনো আমাকে এগুলো বলে কি একটা পুণ্যের কাজ করেছে।
রাতুলের সাথে আমার তৃতীয় দেখাই ছিলো শেষদেখা। দিনটা ছিলো একুশে ফেব্রুয়ারি। সকাল সকাল ফোন দিয়ে বললো, শহীদদের স্মৃতিস্মরণে নাকি প্রভাতফেরিতে যাবে। আমিও খুশিমনে রাজি হয়ে গেলাম। কিন্তু যাওয়ার পর তার মুখে দেখলাম বিরক্তির ছাপ। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, "আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন নাকি?"
"তা তো বটেই। এইসব ঢং এর কোনো মানে হয়? নেহাত মানুষ কথা শুনাবে তাই আর কি! সমাজে আমার একটা স্ট্যাটাস আছে না?"
আমি যতই উনার কথা শুনছি ততোই আরো অবাক হচ্ছি। সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছি শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া নিয়ে আমার সাথে ঝগড়া করে আবার সেই ফুল পাড়িয়ে চলে আসা দেখে। ফুল অর্পন আমার ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ না। যেটার সম্মান দিতে পারে না সেটা অর্পন না করাই ভালো। এর থেকে শহিদদের জন্য নামায পড়ে দোয়া করলেই সবচেয়ে ভালো হয়। রাতুল ঝগড়া করে ফুল অর্পন করে এসেছে। আসার সময় অন্য ফুল পা দিয়ে মাড়িয়ে এসেছে যে তা খেয়াল ই করে নি। কি শ্রদ্ধা!

ছোটগল্প Onde histórias criam vida. Descubra agora