আমার যার সাথে বিয়ে হয়েছে সেই মানুষটা আমার চেয়ে বছর দশেক বড়। তাঁকে আমি প্রচন্ড রকমের ভয় পাই। যদিও তাঁকে ভয় পাওয়ার মতো কোনো কারণ নেই। উনি আমার সাথে সবসময় বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করেন তবুও সে সামনে আসলে আমি ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যাই।
আসলে পুরুষ মানুষকে আমি প্রচন্ড ভয় করি। তারচেয়ে বেশি ঘৃণা করি। আমার এখনো মনে আছে আমি যখন সবে স্পষ্ট কথা বলতে শিখেছি তখন রোজ দেখতাম বাবা মায়ের সাথে খুব রাগারাগি করে। প্রায়ই মায়ের সারা শরীরে রক্তিম রেখা দেখা যেতো। মা শুধু আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতো। আমি তখন কিছু বুঝতাম না। বাবা কোনোদিন কাছে না টানলেও বা বা বলে এগিয়ে যেতাম প্রতিবার। আর বাবা আমাকে বিদ্যুতের মতো ছিটকে সরিয়ে দিতো। মায়ের কাছে শুনেছিলাম আমার একটা ছোট খেলার সাথী আসবে। সারাদিন মায়ের পেটে কান রেখে খেলার সাথীকে ডাকতাম। কিন্তু সে উত্তর দিতো না বলে আমি গাল ফুলাতাম। আর তা দেখে মা খুব মিষ্টি করে হাসতো। আমি অবাক হয়ে দেখতাম। হুট করেই একদিন ঝগড়ার পর মা দৌড়ে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। আমি দরজায় টোকা দিতে দিতে কত কাঁদলাম। মা দরজা খুললোই না। বিকেলে সবাই দরজা ভেঙে দেখে মা ফ্যানের সাথে ঝুলছে। আমি নিষ্পলক মায়ের দেহটির দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
মা মারা যাওয়ার সপ্তাহ না ঘুরতেই বাবা নতুন মা ঘরে আনে। নতুন মা আসার পরেরদিনই আমাকে নিয়ে আসা হয় একটা এতিমখানায়। এতিমখানায় রেখে যাওয়ার পর আর কোনোদিনও যোগাযোগ করতে আসে নি। আমি যেই এতিমখানায় বড় হয়েছি সেখানে শুধুই মেয়েদের আশ্রয় হতো। বড় আপা থেকে শুরু করে শুধু দাড়োয়ান ছাড়া সবাই মেয়ে। কোনো এক অজানা কারণে আমি বড় আপার খুব আদুরে ছিলাম। তাই যেখানে অন্যদের মাধ্যমিক পাশ করিয়ে তারজন্য কর্মসংস্থান বা বিয়ের ব্যবস্থা করে সেখানে আমাকে নিজের কাছে রেখে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করিয়েছে। বড় আপা কখনো বিয়ে করেন নি। আমিও চেয়েছিলাম বড় আপার মতো সারাজীবন নিঃসঙ্গ থাকবো কিন্তু ভাগ্য সহায় হলো না। সংস্থাগুলো হাত গুটিয়ে নিলো আর এতিমখানায় আর্থিক সমস্যা দেখা দিলো। তখন এক ধনাঢ্য ব্যক্তি এগিয়ে আসলো কিন্তু শর্ত আমাকে বিয়ে করবে। কথাটা জানার পর আমার না করার কোনো সুযোগ ছিলো না। কারণ বড় আপা ছিলো খুবই অসুস্থ। সেদিন পুরুষের প্রতি আমার তৃতীয়বার ঘৃণা জন্মেছিলো। প্রথমবার জন্মে বাবার প্রতি। আমি এখনো শিউরে উঠি শুধুমাত্র কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ায় একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ কিভাবে এরকম পশুরূপ ধারণ করতে পারে। দ্বিতীয়বার ঘৃণা জন্মে আমাদের দাড়োয়ানের প্রতি। তার হিংস্র চোখের চাহনি দেখেছি বহুবার। ভয়ে আড়ষ্ট হয়েছি কিন্তু মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলতে পারি নি।
আমি আমার স্বামীকে ভয় পেতাম তা হয়তো উনি বুঝতেন। একদিন আমার সামনে বসে আমার হাত দু'টো নিজের দু'হাতের মধ্যে নিয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, "আমি জানি তুমি আমাকে প্রচন্ড ঘৃণা করো। তোমাকে বিয়ে করার পিছনে আমার কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নেই। তুমি জানো আমার আত্মীয়-স্বজন কিছু নেই। আমি শুধু আমার সম্পত্তি যোগ্য কারোর হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলাম যে এর অমর্যাদা করবে না। তুমি যেই এতিমখানায় থাকো ঐ এতিমখানায় দান করতে চেয়েছিলাম সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশ। কিন্তু সেখানে যাওয়ার সময় তোমাদের দাড়োয়ানের কথোপকথন আমার কানে চলে আসে। সে কারোর সাথে নিহিলা নামক কোনো মেয়ের সতীত্ব হরণের নীল নকশা তৈরি করছিলো। তখন তোমাদের বড় আপার মাধ্যমে তোমাকে চিনি। আর মনে হলো তোমাকে বাঁচানোর এটাই একমাত্র উপায়। তুমি চাইলে এখন ডিবোর্স নিতে পারো। সব তোমার নামে দলিল করা আছে শুধু তোমার স্বাক্ষর বাকি। আমি না হয় আমার অন্য কোনো ফ্ল্যাটে চলে যাবো। বিগত ছয়মাসে নিশ্চয়ই তুমি বাইরের পরিবেশের সাথে মানিয়ে চলতে শিখে গেছো। এখন আশা করি কোনো সমস্যা হবে না।"
এগুলো বলেই উনি উঠে চলে গেলেন। আমি লক্ষ্য করলাম ডিবোর্সের কথা বলার সময় উনার কথা আটকে আসছিলো। চোখ ছলছল করছিলো। আচ্ছা এই অনুভূতির নাম কি? আমার জানা নেই। সেদিনের পর আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম লোকটাকে আমার ভালো লাগতে শুরু করেছে। নিজের অজান্তেই একদিন রাতের বেলা তার বুকে মাথা রেখে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়লাম। অন্যরকম একটা প্রশান্তি অনুভব করলাম।
সে আমাকে শেখালো এই অনুভূতির নাম ভালোবাসা। আমি তাঁকে ভালোবাসতে লাগলাম আমার সর্বস্ব দিয়ে। ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা আমার মাথা থেকে একদমই চলে গেলো। বরং উনি কাছে না থাকলে আরো অস্থির লাগে। একদিন মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেলাম। জ্ঞান ফেরার পর দেখলাম আমি বিছানায় শোয়া। সে আমার মাথার পাশে বসে আছে। আর ডাক্তার আমার হাত ধরে পালস দেখছে। হাসি হাসি মুখ করে আমাকে বললো, "সুখবর। তোমাদের ঘরে ছোট্ট নতুন অতিথি আসছে" তারপর উনার দিকে তাকিয়ে বললো, "কি রাতুল সাহেব। মিষ্টিমুখ করাবেন না?"
সে ডাক্তারকে নিয়ে বের হতেই একরাশ ভয় আমাকে ঘিরে ধরলো। আমি যে মানুষটাকে বড্ড ভালোবেসে ফেলছি। এখন যদি মেয়েবাবু হওয়ার জন্য সেও বাবার মতো আচরণ করে? আমি সহ্য করতে পারবো না। একদমই পারবো না।
আমাকে আতঙ্কিত হয়ে বসে থাকতে দেখে সে এসে নিজের বাহুডোরে টেনে নিলো। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, "কি হয়েছে আমার পিচ্চি বৌটার? এইসময় এরকম করলে আমার মেয়ের সমস্যা হবে তো"
আমি মাথা তুলে বিস্ময় চোখে জিজ্ঞাসা করলাম, "মেয়ে?"
"হ্যাঁ। আমি চাই আমাদের প্রথম মেয়ে বাবু হোক। কেনো তোমার কি ছেলে পছন্দ? এটা হলেও আপত্তি নেই"
"তা না। কিন্তু আপনার মেয়ে অপছন্দ না? মেয়ে হলে আমার সাথে দুর্ব্যবহার করবেন না?"
"ধুর পাগলি। কি বলছো এইসব। মেয়ে অপছন্দ হবে কেন! মেয়ে হলো মায়ের জাত। আর মেয়েবাবু দেখতেও কি সুন্দর!"
আমি কিছু না বলে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। চোখে স্রোত বইছে। কিন্তু তা দুঃখের নয়। সুখেও মানুষ কাঁদে তা আজ বুঝলাম। আজ উপলব্ধি হলো পৃথিবীর সব পুরুষ এক নয়। যে আমায় জন্ম দিয়েছিলো সে কাপুরুষ হলেও যার জন্য আমার জন্ম হয়েছে সে সত্যিকারের পুরুষ। আমার ভালোবাসার পুরুষ।