শীতকালের মাঝামাঝি। এবার শীতটা খুব জাঁকিয়ে পড়েছে। পাখসাড়াতেও একই অবস্থা। বৃদ্ধরা চন্ডীমন্ডপে আড্ডা দিতে দিতে আর হুঁকো খেতে খেতে গায়ের পুরানো শালটা আরও একটু জড়িয়ে নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে আলোচনা করে এমন শীত তাদের জীবনকালে কে কবে দেখেছে।যেমন- হরি চাটুজ্জে বললেন- যেবার তাঁর ছোটোবোন ক্ষেন্তি জন্মেছিল সে বছর তিনি এমন শীত দেখেছেন।
মাধব রায় বললেন- ও আর এমন কী এই যে সেবার আমার দাদার বিয়েতে গেলাম মনে নেই কেমন শীতটা পড়েছিল।কুয়াশাতে সামনে কিছু দেখা যাচ্ছিল না।নিজের হাতটাই দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল না।
কেউ কেউ গরম চা খেতে খেতেও তাঁদের জীবনে দেখা শীতলতম বছরের কথা বলছে।শীতলতম বছর সম্বন্ধে তর্ক হলেও এবার যে হাড় কাঁপানো রক্ত হিম করা শীত পড়েছে তাতে কারো মধ্যে মতানৈক্য দেখা গেল না।
মাঘ মাস পড়েছে।আর শীতের পরিমাণ তো বললামই।প্রতিদিনই ঘন কুয়াশা।শাল জড়িয়ে পুকুর যাবার পথে সবার একটাই কথা- শীতটা বড় বেশি।
বেশিরভাগ গাছের পাতাই ঝরে গেছে।তবে শিমূল আর পলাশে গ্রামের বাইরের মেইন রাস্তার দুধারের পথটা লাল হয়ে আছে।ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা স্কুল যাবার পথে খেলার জন্য শিমূল কুড়িয়ে নিয়ে যায়।একটু বড় যারা তারা এখনই অনেক খেজুর গাছ খালি করে দিয়েছে।গা ঘরে খেজুর গাছের অভাব নেই।তাই খেজুর আর তার রস ও গুড়েরও প্রাচুর্য আছে।দুপুরে রোদে ভেজা চুলে একটা গিঁট বেঁধে গ্রামের মেয়ে বউরা চাল কোটা শুরু করে দিয়েছে।সব পাড়াতেই প্রতি দুপুরে ঢেঁকিতে পাড় দেওয়ার আর মেয়েদের মিষ্টি হাসির আওয়াজ পাওয়া যায়।
বুড়িরা সব মনসাতলায় এলো চুলে ছেঁড়া চাদর জড়িয়ে বিগত সুখের গল্প করে।দিন দিন সবাই কী হচ্ছে, তাদের ছেলেরা কেমন, মেয়েরা কত পাকা গিন্নি আর জামাইগুলো যে হীরের খনি তাই শুধু আলোচনা হয় না।কার কটা ছেলে হল? মেয়ের ভাগ কত , কার বিয়ে বাকি, কার বিয়ে হতে চলেছে, ওর অমুক আর অমুকের তমুক কেমন আছে তাও চলে।মোটের ওপর তাদের দুপুরটা ভালই কাটে।
টেঁপির শীতকাল একদম পছন্দ নয়।শীতকালের কোনোকিছুই তার ভালো লাগে না।কারণও আছে।মায়ের সাথে ছোট্ট একটা চালা ঘরে থাকে।সোয়েটারের বালাই নেই।ছেঁড়া টুপি আর ছেঁড়া কম্বলে দুজনের চলে।বাবাকে দেখেনি।মা বলে দেখেছিস।ওর মনে নেই।
ওর মা পাঁচ ঘর কাজ করে ওকে পড়ায়।ও এবার টেনে উঠল।প্রতিদিন সেই ভোরে উঠতে হয়।তারপর পুকুর যাওয়া।ছেঁড়া চটির জন্য শিশিরে পা ভিজে যায়, অল্প বালিও লাগে।উপায় কী।
তার মধ্যে কদিন চূড়ান্ত।সারাদিন মেঘলা মেঘলা ।মাঝে মাঝেই ফিটিফিটি ইলশেগুঁড়ি ঝরছে।
আটটা বাজে অথচ সূর্যের টিকিও দেখা যাচ্ছে না।চারিদিক রাঙা হয়ে অন্ধকার হয়ে এসেছে।একে ঠান্ডা তায় যখন ঠান্ডা দমকা হাওয়া দিচ্ছে ছেঁড়া চাদর ভেদ করে ছুঁয়ে যাচ্ছে।টেঁপির ঠান্ডায় দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে।কিন্তু উপায় নেই।মা দুদিন ধরে জ্বরে।দুদিন কাজ কামাই।আজ আর চলবে না।বোস গিন্নি ঘরে এসে বলে গেছে- কাল না গেলে অন্য লোগ দেখব বাপু।ঘরে ছোটো বাচ্চা।লোগ চাই তো।
মাকে অনেক বুঝিয়ে টেঁপি নিজে যাবে বলে মনস্থির করেছে।ঘরে চালের দানা নেই।দুবেলা পোড়া রুটি খাচ্ছে।ওর মায়ের পেটে ওষুধ বলতে ওদের গ্রামের নতুন বৌদির দেওয়া ট্যবলেট।জ্বর কমেনি তাতে।তেমনি দুর্বল।
এবার বোস গিন্নি ওদের পুরোনো কম্বলটা দেবে বলেছে।তাই ওই শরীরেও মা যেতে চেয়েছিল।যদি অন্য লোক রাখে তাহলে ? ওরাই সবচেয়ে বেশি দেয়।ওদেরটা বন্ধ করলে হবে না।তাই পুরানো একটা জামা পড়ে, মাথায় ছেঁড়া টুপি পরে চলেছে।ঘন কুয়াশা।তবে হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে না।
চন্ডীমন্ডপটা আসতেই টেঁপি মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করল।তারপর মনে মনে বলল-
মায়ের জ্বরটা সারিয়ে দাও।এবার যেন দত্ত কাকীমা লেপটা দেয়।আজ কিছু চাল চাইব।যেন বারণ না করে।বিমলদাদু বাগানের সব্জি দেবে বলেছে।যেন দেয়।
আরেকবার গড় করে জুতোটা গলিয়ে বাঁদিকে গেল ।
ঘন কুয়াশার মধ্যে কাঁপতে কাঁপতে টেঁপি এগিয়ে চলল আলোর খোঁজে।
-----------0-----
