আজ মণীষার বিয়ে।শুভ পরিণয় যাকে বলে।
মণ্ডল পরিবারে আজ সুখের দিন।চারদিক খুশিতে ভরে উঠেছে।চির কৃপার পাত্রী মণীষা আজ তার গ্রামের সবার ঈর্ষার পাত্রী।মণীষা নিজের ঘরে একা বসে আছে।বাকি সবাই বিয়ের আচার অনুষ্ঠানে ব্যস্ত। চাকরি পাবার পর মণীষা কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনে সবাইকে নিয়ে চলে গিয়েছে।ওখানেই থাকে এখন ওর মা,বাবা,ভাই আর ও।কিন্তু বিয়েটা নিজেদের ভিটে থেকে দেওয়ার খুব শখ মণীষার বাবা তপনবাবুর।
মণীষা একা বসে বসে পুরানো কথা ভাবছে। বেশি পুরানো নয়।এই মাত্র দশ এগারো বছর আগের কথা।তখন মণীষার বয়স ছিল সতেরো বছর।পাখসাড়াতে বিরাট মাটির বাড়ি।দিন আনে দিন খায় অবস্থা।বাবা ভাগচাষি।নিজেদের জমি সামান্য।ভাল খাবার কিনে কখনও খায়নি।মণীষা তখন টুয়েলভে আর ওর ভাই নাইনে।টানাটানির সংসারে কতদিন যে মা বন্দনা দেবী একাদশী রেখেছেন তা তিনি আর অন্তর্যামী ছাড়া কেউ কখনও জানতেই পারেনি।
হঠাৎ এই খারাপ অবস্থা থেকে সবাইকে গাছের তলায় গিয়ে দাঁড়াতে হয়েছিল।হঠাৎই।
বাড়িটা খুব পুরানো।তবে বিরাট।মাটির দোতালা বাড়ি।তপনবাবুর দাদু বাড়িটা বানিয়েছিলেন।পরে মণীষার দাদু বাকি ভাইদের থেকে বাড়িটা কিনে নেন।বাবার সম্পত্তি হওয়ার কারণে তপনবাবু সহ সব ভাইদেরই ভাগ ছিল কিন্তু ওদের শহরে বড় বাড়ি-ব্যবসা আছে।তাই তপনবাবু ওখানে থাকতে পেত।সম্পত্তি সবার নামেই আছে।আসলে ওই বাড়িতে আসতেই সবাই ভয় পেত।পাড়া প্রতিবেশীও না।ওপর থেকে মাঝেমাঝেই ঝুরঝুর করে মাটি ঝরত।কিন্তু ওরা পরোয়া করত না।করলে থাকবে কোথায়? যাবার কোনো জায়গাই তো নেই।একদিন হঠাৎ আঙিনা আর দাওয়া ফাঁক হয়ে গেল।কী বিরাট ফাটল! আচমকা মনে হল ভূমিকম্পে সব তলিয়ে যাবে।ফাটলের ভিতরটা দেখা যাচ্ছে। পাড়া প্রতিবেশী এবার চাপ দিতে শুরু করল।বাড়িটা যে আর কিছুদিনের অতিথি সেটা দেখতেই পাওয়া যাচ্ছে।ভেতরের মানুষরা তো মরবেই সাথে চারপাশের বাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।পাশ দিয়ে পেরোতে কতবার মাথায় মাটি ঝরেছে।তপনবাবু হাতজোড় করে কেঁদে ফেললেন।কোথায় দাঁড়াবেন?কার দোরে আশ্রয় চায়বেন? বন্দনাদেবীও তাই।সমোত্ত মেয়ে ঘরে।
- দ্যাখ্ তপনা তুরা তো চাপা যাবি সাথে কি আমাদের ঘরগুলাও লষ্ট করবি? ও ঘর আর বেশিদিন নাই।আফিসে বলগে যা।গাড়ি দিয়ে ভেঙে দেবে।আর দেরি করিস না।
- ঠিক কথা।মাথায় যখন তখন মাটি ঝরছে।আগনাটা তো পুরা ফাঁক হয়ি গেছে।
- এখন আমরা কুতায় যাবো দাদা?গাছতলায় দাঁড়াতে হবে তো।
- তাও তো বেচে বর্তে থাকবি এমনিতে তো তুরা মারা পড়বি।
বন্দনা দেবী আর মণীষা আড়াল থেকে সব শুনল।সত্যিই।গাছতলায় বেঁচে থাকবে।এমনিতে তো চাপা পড়বে।বাড়ির অবস্থা যে কত খারাপ সেটা ওরাই জানে।প্রতিরাতে শব্দ হয়।চোখে ঘুম আসে না।নিঃশব্দে প্রহর গোনে।আজই শেষ রাত নয় তো।
মণীষা সারারাত পড়ার বাহানায় জেগে থাকতে চায়।বাড়িটা পড়লেই ডেকে দেবে।চটপট বেরিয়ে যাবে।ও বলে- তুমরা ঘুমাও মা।শব্দ হলে আমি ডেকে দেব।
সারারাত স্তব্ধ পরিবেশ, হ্যারিকেনের আলো আঁধারি আলো আর খোলা বই।পাশে ভাইটা ঘুমিয়ে কাদা।মণীষার বই-এর পাতাগুলো ভিজে যায়।
অমোঘ নিয়তি।নিয়তিঃ কেন বাধ্যতে?তাই হল।
সেদিন রাত দেড়টা বেজে গেছে।বাকি সবাই ঘুমিয়ে গেছে।মণীষা হ্যারিকেনের আলোতে পড়ছে।কিছু একটা ঝুপ করে শব্দ হল।মনে হচ্ছে কিছু পড়ল।হৃদয়ের গভীরতম স্তর আর অবচেতন মন কিছু একটা খারাপের সংকেত দিল।যে আসার খবর বহুদিন ধরে দিচ্ছে সে কি আজ এল তবে? মণীষা উঠে দেখল সত্যি তাই। মণীষারা দোতালায় ছিল।আর দোতালার সিঁড়িতে ভাঙন ধরেছে।মাটি পড়ছে।মণীষা খুব জোরে চেঁচিয়ে উঠল- বাড়িটা পড়ে যাচ্ছে বাবা!
তপনবাবু ধড়ফড় করে উঠে দেখলেন সত্যিই তাই।ততক্ষণে সবাই উঠে গেছে।তপনবাবু আগে মণীষাকে নামালেন আস্তে আস্তে। দুটো সিঁড়ি বাকি।সবার চোখের সামনে সিঁড়িটা ধসে পড়ল।বাকি সবাই তখনও উপরে।
- মৌ তুই মইটা নিয়ে আয় যা।
তপনবাবু কাঁপছেন।
মণীষা ছুটে মইটা নিয়ে এল।বাকি সবাইও নামল।অনেক প্রতীক্ষার রাত পেরিয়ে সকাল হল।তখনও ওরা ওখানেই।কোথায় যাবে রাতে? তবে সবাই দরজার কাছে বসে ছিল।একটা তক্তার নীচে জড়ো হয়ে।যেন মাথায় কিছু না পড়ে আর চট করে বেরোনো যায়।
সকালে পাশের নরহরি কাকা এল।কাকাকে দেখে তপনবাবু কেঁদে ফেললেন।
- তপনা বাড়িটা ভেঙে ফেল।যদি কাল উপরটা না ভেঙে নীচটা ভাঙত?বেরোতে পারতি?তকন কি হত বল দেকি?
বুল ডোজারের কথা বলা হল।বাড়িটা আছে সবার নামে।সবার অনুমতি চায়।বাকিদের আপত্তি নেই।মোট ত্রিশ হাজার টাকা লাগবে।তপনবাবু শেষ সম্বল নিজের জমিটা বেচে দিলেন।চোখের সামনে বাড়িটা ভাঙতে শুরু করা হল।ওরা রান্নাঘরে আশ্রয় নিল।ঘরের সব জিনিস ওখানেই রইল।দুটো দড়ির ঘাটে শোওয়া হত।
মণীষার ভাই অবুঝের মত বন্দনাদেবীর সাথে শোবার বায়না করত।মণীষা কোথায় শোবে।একটা দড়ির ঘাটে বাবার সাথে শোওয়া যায় না।তাই সারারাত পড়ত।ঘুম পেলে ঘাটের নীচে পা গলিয়ে শুয়ে পড়ত।
মণীষা খুব শক্ত থাকত সবার সামনে।একটা ছোটো রান্নাঘরে সবকিছু।রোদ জল সব ঠিক আছে।কিন্তু জামা পাল্টানো তখন?
শরীর খারাপ হলে মণীষা মায়ের কাছে কেঁদে ফেলত।কী করবে? কোথায় কাপড়টা মেলবে? অন্যের বাড়িতে তো মেলা যায় না।সামনে সোমা নামে একটা বন্ধুর বাড়িতে যেত পোশাক পাল্টাতে।তাতেও ওরা কত কথা শোনাত।তবু উপায় কী? পাশ দিয়ে লোক পেরোচ্ছে।খুব ভয় করত বন্দনা দেবীর।
তারপর পরীক্ষার তিনমাস আগে সবাই মামাবাড়ি চলে গেল।এভাবে আর থাকা যাচ্ছে না আর ভাই জোরও করল।
প্রাইভেটের স্যররা মণীষার খোঁজ করে সব জানতে পারে।
- মণীষা অনেক দিন যাবৎ আসছে না।ওকে আসতে বলবি বুঝলি।
- স্যর ও মামাবাড়ি চলে গেছে।ওর বাড়ি ভেঙে গেছে।ও বোধহয় পরীক্ষা দিতে পারবে না।সম্বন্ধ দেখা হচ্ছে ওর।
- আসবে না মানে? আসতে বলবি।
মামাবাড়িতে কদিন আর থাকা যায়।তাই তাঁবু ঘাটিয়ে আবার গ্রামেই থাকতে শুরু করল।প্রাইভেটের স্যররা বিনা পয়সায় পড়াতেন।বই-রেফারেন্স দিতেন।মণীষা খুব পড়ত।এটা এখন মান সম্মান বা প্রতিষ্ঠা নয়।এটা বেঁচে থাকার লড়াই।সবাইকে বাঁচাতে হবে।হবেই।
তপনবাবু অন্যের জমিতে কাজ করছে।খেয়ে পড়ে বাঁচতে হবে।
তপনবাবু দিন দিন রুগ্ন হয়ে যাচ্ছেন।কন্ঠার হাড় বেরিয়ে গেছে।ভাল খাবার, মাছ মাংস, দুধ শেষ কবে বন্দনা দেবী মুখে তুলেছেন মনে পড়ে না।কিন্তু নিজেকে নিয়ে ভাবেন না।শুধু ভাতে এই পরিশ্রম সহ্য হলে হয়।
মণীষা একদিন বাবাকে হাঁফাতে দেখে বলল- তুমি এত কাজ কোরো না।শরীর খারাপ হবে।
তপনবাবু মাথায় হাত রেখে বললেন- তাতে খাবি কি খেপি?
- আমি যদি ছেলে হতাম তাহলে কিছু কাজ করতে পারতাম।
- পড়গা যা তো।বেশি বুজে।
কিন্তু ঐ যে বিপদ যখন আসে সবাইকে নিয়ে আসে।মণীষার ভাই-এর কদিন থেকেই খুব মাথা যন্ত্রণা।এখানের ডাক্তার ধরতে পারছে না।মায়ের মন উল্টোপাল্টা চিন্তা হচ্ছে।শেষে বন্দনাদেবীর ভাইরা হাজার পঞ্চাশ জড়ো করে বাইরে নিয়ে গেল।ওখানে বলল মাথায় একটা শিরাতে প্রবলেম।এজন্য মেন্টাল গ্রোথ কম।পড়াশোনার চাপ এ নিতে পারবে না।ওষুধ খেতে হবে।
পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেল।অবশ্য পড়াশোনা করার বিরাট ইচ্ছা কখনও ছিল না।
তাঁবুতে থাকাকালীন গ্রামতুতো এক কাকা এখন শহরে থাকে ওদের বলল- এভাবে মানুষ থাকতে পারে? তোরা কাল থেকে আমাদের বাড়িটাতে থাকবি।
তাই হল।ওদের ওরা একটা ঘর আর বারান্দাটা দিল।বাকি সব চাবি দিয়ে রাখত।গৃহহীন , নয়দুয়ারী ভাগচাষিকে এর বেশি বিশ্বাস আর কে করবে? তাও তো থাকতে দিয়েছে।রাতে শোওয়া, থাকা।রান্না করতে বন্দনাদবীকে ওধার যেতে হত আসতে হত।যাতায়াতে সাড়ে তিন কিমি তো হবেই।
তারপর ওখানে থাকতে থাকতে ওদেরকে বিশ্বাস করতে লাগল।রান্নাঘরটা খুলে দিল।ওখান থেকেই উচ্চমাধ্যমিক দিল।
তারপর থেকেই মণীষার বিয়ের কথা ভাবতে লাগলেন।মণীষা চায়না।তবু মায়ের দিকে চেয়ে।
- তোর পড়ার ইচ্ছা।আমরা তো পারব না।শ্বশুরবাড়ির লোকে পড়াবে।ঠিক আছে মা?
- ঠিক আছে।
মিষ্টি মণীষাকে কারও অপছন্দ হয়নি।কিন্তু মণীষা চায়ছে না।তখন মামার হাত ধরে কেঁদে বলল আমি বিয়ে করব না মামা।
মণীষাকে ওভাবে কাঁদতে দেখে ওর মামাও কেঁদে ফেলল।তারপর বলল- তোকে আমি পড়াব যদি রেজাল্ট ভাল হয়।
যদিও এটা তার জন্যও কষ্টসাধ্য।সামান্য বেতন তো তারও।কিন্তু কন্যাসম মণীষাকে কাঁদতে দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারলেন না যে।
রাতদিন মণীষা ঠাকুরকে বলত- বাকি আমি সামলে নেব। শুধু এবার রেজাল্টটা ভাল কর।আমি পড়তে চাই।
স্কুলে কলা বিভাগে প্রথম হল।ভাই-এর অনেক অনুরোধে বিয়ে বন্ধ করা হল।তারপর জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করতে শহরে গেল।ওখানে বাংলা নিয়ে ভর্তি হল।প্রথম প্রথম ওর একটাই জামা, গেঁয়ো ধরণ দেখে অনেকেই হাসত।
- এই তোর মাত্র একটাই জামা নাকি?
পড়ে গিয়ে ওর লেগিন্সের হাঁটুর কাছটা ছিঁড়ে গিয়েছিল।তবু ওটাই পরে আসত।মেস আর প্রাইভেটের খরচ কন্যাশ্রীর টাকা দিয়ে চালাত।তারপর স্যরের সাহায্যে কিছু বাচ্চাকে ঘরে পড়াত।বাড়িতে টাকা পাঠাত।
সরকার থেকে একটা বাড়ি পেল ওরা।অন্যের বাড়িতে থাকার মেয়াদ শেষ হল।সহপাঠীরাও বন্ধু হল যখন প্রথম বর্ষে প্রথম হল।অবজ্ঞা পরিণতি পেল সম্মানে।
একে একে অনেক কিছু ঠিক হতে লাগল।বহু কষ্টের রাত পেরোতে লাগল।সামান্য বই চেয়ে পড়ার জন্য একদিন কতজনের কাছে কত অপমান সইতে হয়েছে।তাও মেনে নিয়েছে।
একদিন বন্দনাদেবী বলেছিলেন- তোর হবে দেখবি।এতদিনে যখন থামিসনি হবে।আমাদের এত পড়াশোনা কেউ করেনি ।তোর হবে বলেই তুই সুখে থাকবি বলেই তো তুই সব পেরোতে পারছিস।
মণীষার ভাই একটা গ্রামের কাপড়ের দোকানে কাজ নিল।দেড়শ টাকা মাসিক বেতন।পরে বাড়তে পারে যদি কাজ ভালো লাগে।ভাইও ম্যাচিওর হতে শুরু করল।বদলাতে লাগল।
মেসের একজন বান্ধবী ওকে একদিন কাঁদতে দেখে জিজ্ঞেস করবে তার আগেই বলল- আমার ভাই আজ আমাকে জিজ্ঞেস করেছে আমি খেয়েছি কিনা? আমি যেন নিজের খেয়াল রাখি।ওর থেকে এই কথা আশা করা যায় না।ও কত বড় হয়ে গেল।ও ঠিক হয়ে গেছে।আমার সেই ছোট্ট কচি ভাইটা!
সত্যি বাড়ি হল, ভাইটা কাপড়ের দোকানে কাজ করতে লাগল।নিজেও J.R.F. পেয়ে রিসার্চ শেষ করে অধ্যাপনা শুরু করল।তখন সবাইকে নিজের কাছে নিয়ে গেল।টাকা জমিয়ে ভাইকে একটা দোকান করে দিল।ওর বাবাও বসে।চাষ করতে দেয় না।
সেই মণীষার আজ বিয়ে।পাত্রও প্রফেসর।সেম কলেজ।মণীষাকে পছন্দ হওয়াতে বাড়িতে কথা বলে।তারপর এই বিয়ে।পুরানো কষ্টের দিনগুলোই ভাবছিল।চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরছিল।
বন্দনাদেবী কী একটা কাজে ঢুকে ওকে কাঁদতে দেখে বলল- সব ঠিক হয়ে গেছে তো।আর কেন কাঁদছিস? তুই সবাইকে সুখে রাখতে পেরেছিস।আজ এত আনন্দের দিন।ছিঃ মা জল মোছ।
মণীষা ঘাড় নাড়িয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে সম্মতি জানাল মাত্র।
অন্ধকার নিকষ কালো ভয়ঙ্কর রাতটা পেরিয়ে পুবে আলোর ঝিলিক দেখা দিয়েছে যে--:সমাপ্ত:-