ভালোবাসি তাই

168 0 0
                                    

  এক

রাই-এর বিদায় হয়ে গেল একটু আগে। ঘন্টাখানেক হবে বা। কিন্তু মা সীমাদেবীর চোখ এখনও শুকোয়নি। একমাত্র মেয়ে কতদূর শহরে চলে গেল। চাইলেও যখন তখন আর দেখতে পাওয়া যাবে না। আর বেশি কষ্ট হচ্ছে যাবার সময় রাই একটুকুও কাঁদেনি। সীমাদেবী যখন জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করছিলেন , এত সুখের মুহূর্তেও মেয়েকে অন্যের বাড়ি চলে যেতে দেখে সীমাদেবীর বুকটা ফেটে যাচ্ছিল।
রাই বছর বাইশের মিষ্টি একটা মেয়ে । স্কুল আর কলেজ জীবনে প্রেম করেনি।প্রোপজালও পায়নি।কারণ ওর ইমেজটা অন্যরকম। অন্য বন্ধুরাও ওকে নিজের নিজের প্রেমের গল্প বলতে ভয় পেত।কারণ বললেই ফ্রিতে ভবিষ্যৎকে ওরা ঝরঝরে করে দিচ্ছে তা নিয়ে জ্ঞান দিত।দেখতে মিষ্টি হলেও খুব সিরিয়াস স্টুডেন্ট । কলেজে উঠলেই মেয়ের জন্য মা বাবা না হলেও আত্মীয়স্বজন পাত্রের খোঁজ দিতে থাকে। কথাতে থাকবেই ওখানে অমুক ছেলে , পরিবার ভালো ইত্যাদি । রাই-এরও এসেছিল।ওর মা বাবা আনেননি। এনেছিল ছোটোমাসি।তারপর কী হল তা না বলাই ভাল।শুধু রেগে গিয়ে ছোটোমাসি পাঁচ মাস ওদের সাথে কথা বলেননি।
সীমাদেবী একা আর কী করতেন! মেয়ে তো হয়েছে বাবার মতন। বাপ আর মেয়ে মিলে একদিকে। সীমাদেবী বাচাল রাইকে নিয়ে পারেন না।
রাই শুধু কম বয়স বা পড়াশোনার জন্য বিয়ে করতে চায় না , তা কিন্তু নয়। আরও একটি বড় কারণ রাই ভয় পায়। টিভি, পেপার, মোবাইল সর্বত্র মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার দেখে দেখে ও ভয় পায়। ইস্ত্রি ছেঁকা , গলায় ফাঁস, শ্বাসরোধ করে খুন ।যদিও মা বাবা ওকে বুঝিয়েছে সবাই অমন হয় না। তবুও ওর ভয়। তেমন হলে ডিভোর্স দেবে কিন্তু ততদিন যে অত্যাচার? না না না না। নো বিয়ে। সাজানো গোছানো সুখের সংসার । মিষ্টি একটা পরিবার। সুন্দর সম্পর্ক ।ঝড় এল। সত্যিকারের তান্ডব। হাসিখুশি ভালো মানুষ বিশ্বরূপবাবু। বাজারের কিছু কাজ সেরে সবার সাথে খেতে বসলেন। মেয়ের সাথে মজাও করলেন। একবার ঝালটা বেশি হয়েছে বলে অনুযোগ করলেন। তারপর ভাতঘুম।
বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হতে চলল।স্বামী উঠছে না দেখে ডাকতে গিয়ে বুঝলেন আর কোনোদিন উঠবে না। মুহূর্তের মধ্যেই রাই আর সীমাদেবীর জীবনের সব আলো মুছে গেল , পায়ের তলার মাটি সরে গেল। বাতাস বন্ধ হয়ে গেল।অকূল দরিয়ায় কেমন যেন ভয় করল সীমাদেবীর।স্বামী নেই! এটা কেমন জিনিস সীমাদেবী বুঝতে পারলেন না। একটা ঘোরের মধ্যে দুজনের দিন কাটতে লাগল।সীমাদেবী কখনও বাজারেও যাননি।সবসময় গৃহলক্ষ্মীর মত ঘরদোর সামলেছেন।আজ সব একা হাতে।রাই যতটা পারে করছে।কিন্তু পারছেনা তাও।টাকাপয়সা , সোমত্ত মেয়ের বিয়ে রাতের ঘুম উড়ে গেল সীমাদেবীর।সব অন্ধকার। দিন দিন শরীর কৃশ হচ্ছে।রাই না থাকলে এত চিন্তা হত না।সব যখন গেছে শরীর গেলেও কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হত না।কিন্তু তা তো না।কমবয়সী রাই। ওকে এই পৃথিবীতে একা করে তিনি যেতে পারবেন না।কাউকে রাই-এর দায়িত্ব দিয়ে যেতেই হবে যে রাইকে খুব বেশি ভালোবাসবে।রাইকে আপন করে নেবে।আগলে রাখবে।ওর অভিমান আর রাগটা বুঝবে , ওকে বুঝবে।ওর চোখ দিয়ে জল ঝরতে দেবে না।বিয়ে নিয়ে রাই-এর সমস্ত ভয় কাটিয়ে ওকে ভালোবাসার জোয়ারে ভাসিয়ে দেবে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি ভালো পাত্র, ভালো বংশ সব দেখা সম্ভব নয়।যদি ছেলে সত্যিই রাই-এর কথামত ভালো না হয়? সীমাদেবীর বুক ব্যাথা করে চিন্তায়। চোখের জলে বালিশ ভিজে যায়।ভয়ে শ্বাস নিতে পারেননা।
আত্মীয়স্বজনদের , পরিচিত প্রত্যেককে বললেন একটা সুপাত্র জোগাড় করতে। রাই জানত না। ও কলেজে পড়ে সাথে একটা কাজের সন্ধান করছে।কয়েকজনকে পড়িয়ে হচ্ছে না।
তাই খাবার টেবিলে বিয়ের কথা পাড়তে রাই একটু রেগেই গেল।
- রাই দেখ্ এখন এসবের সময় নয়। তোর বাবা বেঁচে থাকতে আমি এ নিয়ে কিছু বলিনি । কিন্তু এখন সেটা সম্ভব না। আমি একা সামান্য কটা টাকাতে .....
- মা আমি তো টিউশন করছি। আর একটা জবেরও চেষ্টা করছি।পেয়ে যাব।
- শুধু টাকার কথা হচ্ছে না।লক্ষ্মী সোনা আমার একটু তো বোঝ।আমি একা। আমার শরীর দিন দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। একা সব সামলাতে পারছি না। তোর বিয়েটা দিয়ে তোর দায়িত্ব কারো হাতে তুলে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত।
- মা!
- রাই মা আমার। লক্ষ্মীটি মা জেদ করিস না।
- মা তোমাকে ছেড়ে, সব ছেড়ে কেন মা? আমার বেশিরভাগ বন্ধুরই তো বিয়ে হয়নি।
- মা ওদের মাথার ওপর অনেক লোক মা। আমি যে নিঃস্ব।
মায়ের কাতর আবেদন রাই সহ্য করতে পারল না। সমসময় বকাঝকা করা মা। জামা অপরিষ্কার, বা ঘর গোছানো হয়নি, এখনও স্নান করিসনি? , ফোন রাখ এসব করেই অস্থির মা এখন কী আস্তে কথা বলে। কিন্তু মাকে ছেড়ে রাই যেতে চায় না, আর বিয়ের পর কী হবে?
রাতে মাকে বোঝাতে যাবে ভেবে মায়ের ঘরে গিয়ে দরজার বাইরে শুনতে পেল চাপা কান্নার শব্দ।
আহা! রাইও নিঃশব্দে কেঁদে ফেলল আর বিয়েতে হ্যাঁ করে দিল। রাই-এর মনে আশা ছিল লাখ কথায় বিয়ে।হুট করে যেমন বিয়ে হয়!
কিন্তু রাই-এর চিন্তা ভুল প্রমাণ করে অনেক সুযোগ্য পাত্র আসতে লাগল। এমন পাত্রদের বিয়ে হয়নি কেন? এরা তো চাইলেই কত ভালো ভালো মেয়ে পাবে। এরা কেউ রাইকে পছন্দ করবে না সেটা রাই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিল।
কিন্তু ভালো পরিবার, বিশ্বরূপবাবুর পাড়ায় সম্মান আর আকর্ষণীয়া রূপের জন্য রাই-এর প্রচুর ভালো সম্বন্ধ আসতে লাগল। পাত্রপক্ষ চা-মিষ্টি খেয়ে খেয়ে টাকার শ্রাদ্ধ করে দিল।
অবশেষে সবার পছন্দ হল নীলকে। নীল মুখ্যার্জী। বিলেত ফেরত ডাক্তার। বড় ধনী পরিবার , ভালো বংশ। দিদির বিয়ে হয়ে গেছে। বাকি আছে নীল আর ওর মা-বাবা। রাই নাকচ করার জন্য খুঁত ধরা শুরু করেছিল। কিন্ত দূরদূরান্ত ভেবেও রূপে, গুণে, ব্যবহারে, চরিত্রে কোনো খুঁত পেল না।একবার ভাবল মাকে বলে ছেলেদের ফর্সা গায়ের রং ভালো লাগে না। কিন্তু এটা যে কোনো খুঁত না এটা রাইও জানে।
সীমাদেবী স্বপ্নেও ভাবেননি এত ভালো পাত্র এত তাড়াতাড়ি পাবেন আর রাইকে ওরা পছন্দও করবে।
রাই আর কী করে? রাজি হতে হল।ওর কষ্টের কথা, ভয়ের কথা, মাকে ছেড়ে থাকার কথা আর কী ভাবে বোঝাবে? কেই বা শুনবে?
পাত্রপক্ষের পছন্দ যখন মামা বলল তখন রাই সঙ্গে সঙ্গেই বলল- মাকে দেখো একটু মামা। অনেকদূর তো। আমি সবসময় আসতেই পারব না। মা কিচ্ছু পারে না। বাইরের কিছু জানে না।তুমি একটু দেখো মামা।আমার একমাত্র সম্পদকে তোমাদের কাছে রেখে চলে যাচ্ছি।
বিস্তর কান্নাকাটি হল।সাথে বিয়েও হল। বিয়ের আগে কিছুটা দূরত্বের কারণেই নীলের সাথে রাই দেখা করেনি। অবশ্য রাই-এর বিরাট কোনো ইচ্ছাও ছিল না। খুশিই হয়েছিল। ফোনেও বেশি কথা বলত না।
বিয়েতে আজন্ম পরিচিত ঘরবাড়ি, আত্মীয়স্বজন, কত স্মৃতি ফেলে চলে যাবার সময় মনটা কষ্টে ভরে গেলেও মায়ের সামনে এক ফোঁটা জলও ফেলল না। সবাই কাঁদছে। ওকে সবাই এত ভালোবাসে? বাবাও কি কাঁদছে ? ও বাবাকে দেখতে পারছে না বাবা তো পাচ্ছে।
সীমাদেবী নীলের হাতদুটো ধরে কেঁদে ফেললেন। রাইকে ভালো রেখো কথাটা বলতে পারলেন না। গলা দিয়ে বেরোল না। নীল বলল - রাই আজ থেকে আমার দায়িত্ব ।আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।
          নীলের গলার স্বরে , মুখে একটা বিশ্বাসের ছাপ।সীমাদেবী আর কিছু বললেন না। গুটিগুটি পায়ে রাই ফুল দিয়ে সাজানো গাড়িতে উঠে গেল। বুকের ভেতরটা কেমন একটা করছিল। খুব কষ্ট হচ্ছিল। তাও একবার পেছন ঘুরে মাকে দেখল না। কেন ও আর মা থাকতে পারত না? বেশ পারত। বাকি সবাই তো ছিলই। তা না ওকে পর করতে হবে।
চলে যাবার বেলায় কি বেশিক্ষণ অভিমান থাকে ? গাড়িটা গলিটা পেরিয়ে মেন রাস্তা ধরলেই স্থান-কাল-পাত্র ভুলে আঁচল চাপা দিয়ে কেঁদে ফেলল। যদিও গাড়িতে নীল আর ড্রাইভার ছাড়া কেউ ছিল না। তবুও।
নীল ওকে থামালো না। অনেকক্ষণ কান্না আটকে রেখেছে। একটু কাঁদুক। ভালো লাগবে।

You've reached the end of published parts.

⏰ Last updated: Jun 26, 2018 ⏰

Add this story to your Library to get notified about new parts!

ভালোবাসি তাইWhere stories live. Discover now