-"পড়াশোনা করে ডাক্তার হয়েছি কী ক্লাস এইটের মেয়ে বিয়ে করার জন্য?"
-"তা আমি কি করে বলবো! তোর মন তুই ভালো জানিস।"
-"আম্মা প্লিজ কথা ঘুরাবে না।"
ছেলের কথায় চোখমুখ কুঁচকে বিছানায় বসলেন মোরশেদা বেগম। চিন্তিত মুখে বললেন,
-"এখন এইমুহূর্তে এসব কথা কেনো উঠছে? তোর আব্বা যা ঠিক করেছে অবশ্যই তা ঠিকভুল বিবেচনা করেই করছে।"
-"এটাই তোমাদের ঠিক? আমি, যে কিনা দেশের বাইরে থেকে পড়ে এসেছি সে শুধুমাত্র তোমাদের উপর সম্মান রেখে তোমাদের পছন্দমতো গ্রামের মেয়ে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি। তাই বলে ক্লাস এইটের একটা বাচ্চা মেয়ে? আম্মা, তোমার বিবেকে বাধছে না?"
-"না, বাধছে না। বড়টার জন্য তো বেশ পড়ুয়া ভালো ঘরের মেয়েই আনা হয়েছিল। আজ কই সে? তোর ভাইয়ের কপালে পাঁচ লাথি বসিয়ে অন্য ছেলের হাত ধরে বেরিয়ে যেতে তার তো বুক কাঁপেনি। তোর ভাইয়ের কথা না হয় নাই ভাবলো.. নিজের নাড়ি ছেড়া ধনকেও ফেলে যেতে বেহায়া মেয়ে দু'বার ভাবেনি। আসলে এসব মেয়েদের বুক-পিঠ নেই। সব পারে এরা.. সব।"
-"ভাবিকে এর মাঝে কেনো টানছো? তাছাড়া দুনিয়ার সব মেয়েই তো আর ভাবির মতো হবে না।"
-"তর্ক করিস না, মেসবাহ। রেডি হয়ে নিচে আয়। অর্পা হলুদ নিয়ে অপেক্ষা করছে।"
দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার দিকে এগিয়ে গেল মেসবাহ। খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে সে, এখন আর কিছুই করার নেই তার। তার মা কোনোভাবেই তার বাবার সিদ্ধান্তের বাইরে টু শব্দ করবে না। শুধু মা নয়, এবাড়িতে কারোই সেই সাহস নেই। তবে কিছু একটা করা উচিৎ। এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থেকে অজপাড়াগাঁর বাচ্চা এক মেয়েকে বিয়ে করা তার পক্ষে অসম্ভব। তাছাড়া মেয়েদের অবস্থাও তো একবার দেখা উচিৎ। পড়াশোনার খাতিরে দেশ বিদেশে তার বন্ধুবান্ধবের অভাব নেই। বিয়ের খবর পেলেই সকলে ঘাড়ে চেঁপে বসবে তার শ্বশুরবাড়িতে দাওয়াতের জন্য। তখন কোন মুখে ওই ছোট্ট দু'ঘরের ছাপড়ায় নিয়ে যাবে তাদের? কপালের ঘাম মুছে আরও একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো মেসবাহ। চিন্তিত মনে আবারও ফিরে এল বিছানায়। মোরশেদা বেগম এ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন বেশ খানিক্ষন হলো। তবে তার সেই সুগন্ধি পানের ঘ্রাণ এখনো রয়েই গেছে। পানের এই ঘ্রাণ পেলেই মাকে খুব করে মনে পড়ে তার। পেশার খাতিরে তার নানান শ্রেণির লোকের সাথে উঠাবসা হয়। তবে তার মায়ের মত পানের ঘ্রাণ এখনো কোথাও পায়নি সে। এ যেন উপরওয়ালা শুধু তার মায়ের জন্যই বরাদ্দ করে রেখেছেন! মৃদু হেসে মেসবাহ বিছানায় শরীর মেলে দিতেই ফোন বেজে উঠলো তার। ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিনে চোখ বুলাতেই তার সামনে ভেসে উঠলো তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুর নাম। ছোট বেলা থেকেই যার কাজ নিজের সকল দোষ তার উপরে চাপিয়ে দেয়া। -"বিয়ে তাইলে করেই ফেললি!"
-"করার তো ইচ্ছে নেই। তবে ভাবসাব তো বলছে বিয়ে আমার হয়েই যাচ্ছে।"
-"শালা প্যাচাইস না। ঝেড়ে কাশ।"
ঘরের বাইরের দিকে নজর দিল মেসবাহ। তারপর হালকা কেশে বললো,
-"এসেছি কাল রাত দু'টোর পর। ভাবলাম অনেকদিন পর জব্বব একটা ঘুম দিব। কিন্তু ভোর না হতেই আব্বার চেচামেচিতে ঘুম গেল আমার আকাশে। উঠে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিংয়ে বসতেই আব্বা জানালেন, আমার মেয়েকে একবার দেখে আসতে হবে এবং তা এখনি। আমি দ্বিমত জানিয়ে বললাম, কোনো দরকার নেই। আপনি তো দেখেছেনই। তাতেই হবে। তবে কে শোনে কার কথা! যাকগে.. অবশেষে গেলাম মেয়ে দেখতে।"
-"আচ্ছা.. তারপর?"
-"তারপর তো তারপরই। আমি হতবাক! এনি আইডিয়া আমার হবু বউ কীসে পড়ে? ক্লাস এইটেরে... ক্লাস এইটে।"
খানিকক্ষণ থেমে ওপাশ থেকে লিমন বললো,
-"আর ইউ কিডিং মি?"
-"উহু.. আই অ্যাম সিরিয়াস।"
-"তাইলে তো ভালোই.. কচি মেয়ে পাচ্ছিস। একদম কচি। সেইরাম খেলা হবে।"
-"এত কচি মেয়ে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। তোর শখ হলে না হয় তুইই রাখ সেইরাম খেলার জন্য।"
মেসবাহর কথা শেষ হতেই গলা ছেড়ে হাসতে শুরু করলো লিমন। যেনো এর চেয়ে হাস্যকর কথা তার জীবনে শোনেনি সে।
-"এই তুই বন্ধু? চিন্তায় চিন্তায় আমি কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছি না। আর তুই নির্দ্বিধায় হেসেই যাচ্ছিস!"
-"কী করবো বল? তোর যে বাপ! তার উপরে কারো সাধ্য আছে কিছু বলার? বাপ তো না যেনো আগুনের গোলা। কেউ কিছু বলতে গেলে তার আগুনের গোলার মাঝে থেকে এক মুঠো আগুন ছুঁড়ে দুনিয়া ছেড়ে তাকে পরকালের রাস্তা ধরিয়ে দেবে।"
বলে আবারও সমানতালে হাসতে শুরু করলো লিমন। তার হাসির জবাবে তাকে কড়া কিছু কথা শোনানোর ইচ্ছে থাকলেও নিজেকে সামলে নিয়ে কল কেটে চোখজোড়া বুজলো মেসবাহ। আপাতত তাকে মাথা ঠান্ডা রেখে ভাবতে হবে। পাঁচ ভাই বোনের মাঝে বড় ভাই মাজহারুল এবং বড় বোন অর্পাসহ তার নিজের তাদের বাবার মুখের উপরে কিছু বলার সাহস নেই। বাদ থাকলো মুবিন এবং অনা.. মুবিনের কথা বাবা উপেক্ষা করলেও অনার কথা ফেলার মত মন এখনো হয়ে উঠেনি তার। তাহলে কী একবার অনাকে দিয়েই চেষ্টা করিয়ে দেখবে? ভাবামাত্র বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো মেসবাহ। এগুলো লম্বা বারান্দা ধরে। দোতালার দক্ষিণের একদম কোণার ঘরেটি অনার। বেশ বড়সড় সেই ঘরটিতে বইপত্রের উপস্থিতি না মিললেও সাঁজগোঁজের জিনিসের অভাব নেই।