পুরো রাত পেটের ব্যথায় ছটফট করে ভোরের দিকে ঘুমিয়েছে উল্লাসী। তাই আর সকালে ঘুম থেকে উঠে তাকে ডাকলো না মেসবাহ। নাস্তা করে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। মেয়েটিকে এভাবে একা ফেলে যেতে কোনোভাবেই মন টানছে না তার। বুকের ভেতরটায় অস্থির লাগছে। তবুও তাকে যেতেই হবে। বাইরে থেকে দরজা লক করে মেসবাহ এগুলো মুন্নি সরকারের ফ্ল্যাটের দিকে। আপাতত উনি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপায়ন্তর নেই। তাছাড়া মহিলা এমনিতে খারাপও নয়। তবে তার অতিরিক্ত বকবকের কারণে একদমই সহ্য হয়না তাকে মেসবাহর।
-"কী খবর? এত সকাল সকাল আমাকে কী মনে করে মনে পড়লো?"
সৌজন্য সূচক মৃদু হেসে ফ্ল্যাটের চাবি মুন্নি সরকারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মেসবাহ বললো,
-"এটা রাখুন। খানিকক্ষণ পর পর গিয়ে উল্লাসীকে একটু দেখে আসবেন।"
-"কেনো? উল্লাসীর কিছু হয়েছে?"
-"ওই আরকি.. একটু অসুস্থ।"
-"বলো কী! কী হলো আবার ওর? গিয়ে দেখে আসি!"
মুন্নি সরকার ফ্ল্যাটের দিকে এগুতেই তাকে থামিয়ে দিল মেসবাহ। বললো,
-"এখন ও ঘুমোচ্ছে। কিছুক্ষণ ঘুমোক। আপনি একটুপর গিয়ে ওকে একটু খাইয়ে দিয়ে আসবেন। আমি টেবিলে ব্রেড রেডি করেই রেখে এসেছি। আর আমিও একটু ফ্রি হলে চলে আসবো। আপনি প্লিজ ওকে একটু দেখবেন।"
-"আরে! এভাবে আবার বলতে হবে নাকি! অবশ্যই আমি দেখবো। তুমি যাও।"
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে লিফটের দিকে পা বাড়ালো মেসবাহ। অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে তার উল্লাসীকে ফেলে যেতে। যেনো পুরো জীবনের জন্য হারিয়ে ফেলছে সে উল্লাসীকে। না চাইতেও অজ্ঞাত এক মায়াজালে সে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে উল্লাসীর সঙ্গে। তাকে নিয়ে ভাবছে। তার কষ্ট উপলব্ধি করতে পারছে। এসব কি মায়া? নাকি অন্যকিছু?কলেজের গেটে এমাদের দেখা না পেয়ে মন অসম্ভব খারাপ হয়ে এল অনার। কাঁধের ব্যাগ চৈতালির কাছে দিয়ে তাকে ভেতরে পাঠিয়ে সে পায়চারী শুরু করলো রাস্তা ধরে। দু'মাস হলো এমাদের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে সে। এই কলেজেরই ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক নুরুল ইসলামের বড় ছেলে এমাদ। পড়াশোনায় খুব একটি মনোযোগী না হলেও বাবার ইচ্ছেতে ঢাকার একটি প্রাইভেট ভার্সিটিতে অধ্যয়নরত রয়েছে সে। তবে মাসের ৭ দিন ঢাকায় কাটালেও বাদবাকি দিনগুলো গ্রামে শুয়ে-বসে কাটায় এমাদ। এভাবেও বুঝি পড়াশোনা হয়? ভেবে পায় না অনা। অবশ্য তার নিজেরই যেখানে পড়াশোনায় মন বসে না সেখানে এমাদের কী করে বসবে? দু'জনে কি দু'পথের যাত্রী? মোটেও নয়। দুজনেই তারা একই পথে গমনকারী...
-"সরি.. সরি। দেরি হয়ে গেল!"
এমাদের ক্লান্তিমাখা মুখ দেখে মৃদু হাসলো অনা। আদুরে গলায় বললো,
-"ঘুম থেকে উঠতে দেরি হওয়ায় এভাবে দৌড়ে আসতে হবে? আজ না এলে কী এমন হতো?"
-"তুমি যে অপেক্ষা করতে!"
-"ইশ! আমার প্যাঁচাটা কত ভাবে! চলো.. একটু হেটে আসি।"
-"তোমার কলেজ?"
-"কলেজের তো তোমার মতো দৌড়ানোর সাধ্যি নেই। থাকবে সে নিজের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে।"
হাসলো এমাদ। আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে অনার হাতের আঙুলের মাঝে ডুবিয়ে দিল নিজের আঙুল।
-"জানো, কাল রাতে কি স্বপ্ন দেখেছি? দেখেছি তুমি আমার ঘরে এসে আমার কাছে গামছা চাইছো। আমিও তোমায় গামছা এগিয়ে দিচ্ছি। তবে আমি তখন এইবেশে নয়.. শাড়ি পড়া অবস্থায় ছিলাম। স্বপ্নটা সুন্দর না?"
অনার প্রশ্নের জবাবে মাথা নেড়ে এমাদ বললো,
-"হ্যাঁ.. সুন্দর।"
-"বিয়ের পর কি আমি শাড়ি পড়বো?"
-"তুমি চাইলে পড়বে।"
-"তোমার কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই?"
-"উহু.. তোমার খুশিতেই আমি খুশি।"
এমাদের হাত জোরে চেপে ধরলো অনা। সাথেসাথেই এক অদ্ভুত অনুভূতি ছেয়ে গেল তার মনজুড়ে। দু'চোখ বুজে লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে সে বললো,
-"আমাদের ব্যাপারে আমরা কবে সবাইকে জানাবো?"
-"আরও কিছুদিন যেতে দাও। জানিয়ে দিব।"
-"ঠিকাছে। তবে চৈতালিকে তো জানানোই যায়। প্লিজ.. ওকে জানাই? ওর কাছে আমি কিছুই লুকিয়ে রাখতে পারিনা। দম বন্ধ বন্ধ লাগে।"
পথ চলা থামিয়ে অনার মুখোমুখি দাঁড়ালো এমাদ। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে শান্ত গলায় বললো,
-"গোপন প্রেমের গভীরতা বেশি... তাছাড়া কিছুদিন যেতে দাও। সময় হলে আমরা দু'জনেই একইসাথে সবাইকে জানাবো।"
ব্যাকুল স্বরে অনা বললো,
-"সময়টি কবে আসবে?"
-"খুব দ্রুত.. চলো। তোমার কলেজের দিকে এগোই।"
ঠোঁটে হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে সেই চিরপরিচিত রাস্তা ধরে আবারও এগুলো অনা। এমাদকে খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছে সে। যতটুকু ভালোবাসলে তার খুশির জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করতেও সে দু'বার ভাববে না।