-"আসল আম্মু.. ও আসল আম্মু! তুমি জানো, আমার ওই আম্মুও আমাকে ছেড়ে মেজ বাবার সাথে এসে এখানে থাকে?"
-"আমি আসল আম্মু না মা। আমি তোমার আম্মু। শুধু আম্মু।"
-"তুমি আম্মু হলে ওই আম্মু কী? বাবা তো বলেছে ওটাই আম্মু।"
-"বাবা সামান্য ভুল বলেছে। আমি আম্মু, আর ওইটা ছোট আম্মু। তোমার ছোট আম্মু তোমায় আদর করে?"
মাথা নাড়িয়ে মায়ের গালে হাত বুলিয়ে দিল মৌমি। ভাঙা ভাঙা নরম স্বরে বললো,
-"অনেক করে। এখানে আসার সময় তো ছোট আম্মুই আমাকে সাজিয়ে দিয়েছে। আমাকে সুন্দর দেখাচ্ছে না?"
-"খুব সুন্দর লাগছে আমার মাটাকে। এইযে তোমার আইসক্রিম এসে পড়েছে। আমি খাইয়ে দেই?"
-"দাও.. আগে বাবা আর ফুপু খাইয়ে দিত। এখন থেকে তুমি দেবে। ও আম্মু তুমি সবসময় আমায় খাইয়ে দেবে তো?"
জবাব দিল না জ্যোতি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আইসক্রিম তুলে যত্নসহকারে মুখে পুরে দিল মৌমির। প্রায় আড়াই বছর হতে চললো নিজের সাজানো গোছানো সংসার ফেলে চলে এসেছে জ্যোতি। কম কষ্টে এ কদম উঠায়নি সে। ধৈর্যের বাঁধ যখন কোনোভাবেই বাধা মানছিল না তখন একরকম নিরুপায় হয়ে কাজটি করতে হয়েছিল তাকে। তবে সেই বাড়ি ছেড়ে আসার পর মেয়ে ছাড়া দ্বিতীয় কোনো কারণে কখনোই কোনো আফসোস হয়নি তার। স্বাধীন ভাবে চলতে হস্তক্ষেপ করা, বাজে ব্যবহার, বাড়িতে কাজের লোক থাকতেও সংসারের সকল কাজ তার উপর চাপিয়ে দেয়া.. সবটা সামলে উঠতে উঠতে হাঁপিয়ে পড়েছিল সে। তার সামনে আজ যে লোকটি নির্বিকার ভাবে বসে রয়েছে সেই দিনগুলোতেও সে নির্বিকারই ছিল। না তার ছিল আত্মসম্মানবোধ, না হৃদয়। গায়ে মাখার সাবান থেকে শুরু করে দু'টাকার জিনিস কিনতেও তাকে হাত পাততে হতো তার বাবার কাছে। যা আদৌ কোনো মেয়ের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব কিনা জানা নেই.. তবে তার পক্ষে এসব মেনে নেয়া কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। কষ্ট হতো নিজের স্বামীকে আত্মমর্যাদাহীন ভাবতে। এমন এক লোকের পাশে নিজেকে কল্পনা করতেও অস্বস্তি হতো। বাবা কেনো তাকে এমন এক ছেলের হাতে তুলে দিল যার নিজস্বতা বলতে কিছুই নেই? পায়ের পাতা থেকে মাথার চুল অব্দি যার ছিল বাবার দখলে। বাবার কথা চোখবুঁজে মেনে নেয়াই ছিল যেনো তার জীবনের প্রধান লক্ষ্য। তাই তার বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর যখন আলাউদ্দিন শেখ নানান আজেবাজে কথা রটালো, তখনও সে তা অন্ধের মতো বিশ্বাস করে নিয়েছে। কখনো খোঁজ নিয়ে দেখলোনা আদৌ সে কোনো ছেলের সঙ্গে পালিয়েছে কিনা! নির্বোধদের যেমন বুঝিয়ে লাভ নেই, তেমন সেও আর বোঝাতে যায়নি মাজহারুলকে। অবশ্য সত্যটা জেনেও কিছুই করার ছিল না তার। বাবার সিদ্ধান্তের উপর কথা বলার সাহস তার নেই। তবে লোকটি সৎ ছিল, চরিত্রবান ছিল। কিন্তু বেকুব এক লোকের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে চলা তার পক্ষে অসম্ভব ছিল।