সুহাকে বেশ যত্নসহকারে খাইয়ে দিচ্ছে উল্লাসী। রোগা পাতলা শ্যাম বর্ণের মেয়ে সুহা। দু'চোখ হরিণির মতো টানাটানা, লম্বা নাক, মাথা ভর্তি কালো কোকড়ানো চুল। অসম্ভব মায়াবী চেহারার একটি মেয়ে। অথচ এই মেয়ের উপরই কিনা দিনের পর দিন বিনা কারণে অত্যাচার চলে গেছে। কিভাবে পেরেছে? শুধুমাত্র পায়ের সমস্যা এবং কথা বলতে না পারায় কেউ এতটা অবহেলিত হয়? বুকচিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল মেসবাহর। বিষণ্ণ মনে আবারও ভাতের থালায় হাত দিতেই পাশ থেকে সিকান্দার মির্জা বললেন,
-"দ্রুত খাও নানুভাই। আবার বাসায় ফিরতে হবে।"
-"বাসায় ফিরতে হবে মানে? আপনি সুহাকেও সাথে নিয়ে যাবেন?"
-"হ্যাঁ.."
সিকান্দার মির্জার কথার পিঠে কিছু বললো না উল্লাসী। অসহায় চোখে তাকালো মেসবাহর দিকে। উল্লাসীর চাহনিতে বুকের ভেতরটা টিপটিপ করে উঠলো মেসবাহর। অনুরোধের গলায় সে সিকান্দার মির্জার উদ্দেশ্যে বললো,
-"ও কিছুদিন থাকুক উল্লাসীর কাছে।"
-"কিন্তু কাল ওর ডক্টরের কাছে এপয়েন্টমেন্ট আছে।"
-"আমি না হয় নিয়ে যাবো.."
একদন্ড ভেবে সিকান্দার মির্জা সুহার দিকে চেয়ে বললেন,
-"নানুভাই.. তুমি এখানে থাকতে চাও?"
জবাব দিল না সুহা। আঁকড়ে ধরলো তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা উল্লাসীর কোমর। বিপরীতে ঠোঁট হালকা প্রসস্থ করে হাসলেন সিকান্দার মির্জা। মুখের উচ্ছিষ্ট খাবার গিলে বললেন,
-"রান্না কে শিখিয়েছে তোকে?"
-"ওভাবে কেউ শেখায়নি। কিভাবে যেনো হয়ে গেছে!"
-"তা তো হবেই। সারাদিন হাতা খুন্তি দিয়ে ফেলে রাখলে কী সেই মেয়ে পড়াশোনায় পাকা হবে! বদমাশ ছোকড়া একটা।'
-"কে বদমাশ ছোকড়া?"
-"তোর বাপ। যত্তসব ছোটলোকী চিন্তাভাবনা দিয়ে মাথা ভর্তি!"
নিমেষেই মুখ চুপসে গেলো উল্লাসীর। বাবাকে নিয়ে কেউ বাজে কথা বললে বুকের ভেতরটায় অদ্ভুত এক কষ্ট হয় তার। যা ক্ষণিকেই দলা পাকিয়ে বুক চেপে গলা খামচে ধরে ঝরে পড়তে চায় চোখ বেয়ে।
-"ওর পড়াশোনা নিয়ে কিছু ভাবছো?"
সিকান্দার মির্জা মেসবাহর উদ্দেশ্যে প্রশ্নটি করতেই মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো মেসবাহ। স্বচ্ছ গলায় বললো,
-"হ্যাঁ.. আপাতত কোচিং-এ ভর্তি করিয়ে দিয়েছি। তবে কিছু ঝামেলার কারণে এখনো যাওয়া হয়ে উঠেনি।"
-"গ্রেট! আই লাইক ইউ। আজ তোমার জায়গায় ওই ছোটলোক নিজের মতো কারো হাতে উল্লাসীকে তুলে দিলে সে কখনোই এসব নিয়ে ভাবতো না।"
মনের ভেতর তৃপ্তি অনুভব করলেন সিকান্দার মির্জা৷ মেয়ের করা কাজে বহুবছর যে তৃপ্তির খোঁজ পায়নি সে!
-"সংসার ধর্ম বড় ধর্ম। তাহলে বোঝো এটা কত কঠিন কাজ!"
এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে গিলে লম্বা একটি দম ছাড়লেন সিকান্দার মির্জা। আবারও ভারী গলায় বললেন,
-"সংসার টিকিয়ে রাখতে ভালোবাসাটা আবশ্যক নয়, তবে ভালোবাসাহীন জীবন কিছুটা নুন ছাড়া তরকারির মতো। পেট ভরাচ্ছি তবে স্বাদ পাচ্ছি না। তোমার হাতের কাছে নুন থাকতেও তুমি ইচ্ছে করে স্বাদহীন খাদ্য গোগ্রাসে কেনো গিলবে? কথায় কি যুক্তি খুঁজে পাচ্ছো?"
পাশ থেকে মেসবাহ জবাব দিল,
-"হু.."
-"ভালো থাকার মূল মন্ত্রই হচ্ছে ভালোবাসা। জটিল এই সংসার জীবন তখনই সহজ হবে যখন তোমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসবে, সম্মান করবে। একে অপরের চাহিদার গুরুত্ব দেবে, একে অপরের দোষকে বড় করে দেখবে না। মোটকথা ভালো যদি বাসোই তাহলে নিজের সবটা দিয়েই তাকে ভালোবাসবে। তার ভালোটাকে ভালোবাসবে আর খারাপটাকে বাসবে না.. তাহলে ক্রমেই সংসার জীবন জটিলতায় ভরে উঠবে।"
-"আর দুজনের এক্সপেকটেশন?"
-"এক্সপেকটেশন.. জটিল কিছু নয়। তুমি তার কাছ থেকে নুন আশা করলে, জীবন সঙ্গী হিসেবে প্রথমে তুমি তাকে এক চিমটি নুন দাও। বিনিময়ে সে তোমাকে দু'চিমটি নুন ফিরিয়ে দেবেই দেবে।"