(১)
"আরেকটু বিলি কেটে দে না বুবু", দু'ফোটা জল নিরুর উষ্ণ ললাটে আছড়ে পড়লো। তাড়াতাড়ি তা মুছে দিয়ে অনু বলে উঠলো, " হ্যা রে নিরু,দেবাটা কি দুষ্টু হয়েছে দেখেছিস? গাছের সবকটা পাতা ছিড়ে ফেললো।" নিরু খিলখিল করে হেসে উঠলো, বললো, " ওর যা রাক্ষুসে স্বভাব হয়েছে না বুবু, তুমি কড়া গলায় না বললে আর শোনে !" দু'বোনই হেসে উঠলো।
মা চলে যাওয়ার পর এই নিরুই অনুর সব। হতভাগা যেমন তার শেষ সম্বলটা অনেক যত্নে আগলে রাখে, অনুও নিরুকে ঠিক তেমনি আগলে রাখে। ভোরের সূর্য জানলা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে, কোকিলের কুহু কুহু তান বসন্তের জানান দিয়ে যাচ্ছে, তার মধ্যেই নিরুর যন্ত্রণাকাতর মাথাটা কোলে নিয়ে অনুর চোখ বুজে আসলো।
ঘুম ভাঙলো নিরুর সুরসুরিতে।সে অনুর চুল নিয়ে খেলা করছে,বিণুনী পাকাবার চেষ্টা করছে, আবার সব ছেড়েছুড়ে এলোমেলো করে দিচ্ছে।
"কখন উঠলি? আমাকে ডেকে দিতে পারলি না? "
নিরু নিরুত্তরভাবেই তার খেলা চালিয়ে যাচ্ছে। "হ্যা রে নিরু,চল মিনুর মা'র কাছে যাই,অনেকদিন খোঁজখবর নেওয়া হয় না।"
নিরুর চোখমুখ ছলছল করে উঠলো," হ্যা বুবু,চলো যাই। "মিনুর মার কাছে গিয়ে দেখা গেলো উনি পিঠা নিয়ে মহাব্যস্ত।ক্রেতাদের ভীড় সামাল দিতে পারছেন না।তবে তার মধ্যেই দু'বোনকে দেখে খুশি হয়ে উঠলেন।মিনুর মা কথা বলতে পারেন না।তবে তার পিঠার হাত অসাধারণ। শীতের ভোরে তার ভাপা-চিতই না খেলে যেন শীতকালেরই অপমান হয়।অন্যদিন হলে দু'বোন বেশ খানিক্ষণ বসে,ইশারা-ইঙ্গিতে গল্পগুজব করে তারপর যায়।আজ বেশি সময় ব্যয় করলো না।নিজেরা খেয়ে বাবার জন্য কিছু পিঠা নিয়েই উঠে এলো। বাগানটা ঘুরে আসার সময়ই দেখা গেলো ঘাসের শিশিরবিন্দুর উপর আরো শোভা বাড়িয়ে শিউলি ফুলগুলো যেন তাদেরই ডাকছে। দুজনই ফুল কুড়াতে লেগে গেলো। নিরুর ফ্রক ভর্তি করে যখন দেখা গেলো শিউলীর নিমন্ত্রণ সাদরে গ্রহণ করে গলা অবধি ভরে গেলো, দধি খাওয়ারও আর উপায় নেই,তখন দুজন হাসতে হাসতে উঠে গেলো।
আজ ফুল কুড়াতে বেশী দেরী হওয়ায় দুজন কাচুমুচু করে যখন ঢুকছিলো,তখন দেখা গেলো বাবা বারান্দায় প্রতিদিনের মতো চা নিয়ে পত্রিকা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন। বাবা আড়চোখে তাদেরকে দেখে হাসি যথাসম্ভব গোপন করার চেষ্টা করে গম্ভীর হয়ে বলে উঠলেন, " দু'বোনের রাজ্য সফর শেষ হলো তবে ! "
" প্রজাদের খাজনা তুলতেই দেরী হয়ে গেলো যে বাবা", নিরুর কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।
"আজ কি খাবি রে নিরু?"
" ঝাল কিছু করো না বুবু! "
অনু কড়া চোখে নিরুর দিকে তাকালেও বোঝা গেলো তার আবদার গৃহীত হয়েছে।তাই আর দ্বিরুক্তি না করে সে উঠে চলে গেলো।
নিরুর খাবার তৈরি করতে করতেই তার স্কুলের সময় হয়ে গেলো। ওদিকে বাবা তাড়া দিয়ে যাচ্ছেন।প্রতিদিন এই সময়টাই অনুর সবচেয়ে ব্যস্ত কাটে। নিরুকে খাইয়ে অনু উপরে চলে গেলো। নিরু বাবার হাত ধরে রাস্তা দিয়ে দুলতে দুলতে, রাজ্যের আবদার-অভিযোগ করতে করতে যাচ্ছে। অনু যতক্ষণ পর্যন্ত রাস্তার শেষটাও চোখে পড়ে ততক্ষণই দাঁড়িয়ে রইলো। আবার নিরুর ফেরার সময় হলে ঘন্টাখানেক আগে থেকেই এই জানালার পাশে বসে থাকে। এই-ই তার নিত্যদিনকার কর্ম। বাবার হাত ধরে যখন নিরুর আইস্ক্রীম মাখানো মুখটা দেখা যায়,তখনই যেন মুখে এক চিলতে স্বস্তির হাসি ফুটে উঠে।(২)
আজ তিনমাস হলো অনুর বিয়ে ঠিক হয়েছে।আগামী সপ্তাহেই সানাই,ঢাক-ঢোল বেজে উঠবে। গলির মুখ থেকেই আলোর ঝলকানিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে,আত্মীয় স্বজনও সবে আসতে শুরু করেছে। ঘরভর্তি বিয়ের বাদ্য-বাজনা,তত্ত্ব,মিঠাই আরো কতো কি।একমাস থেকেই রাজ্যের ব্যস্ততা,তদারকিকরে যাচ্ছেন বাবা।অনুরও বসবার জো নেই। আলোয় আলোয় পরিপূর্ণ হয়েছে পুরো বাড়ি। তবে মনের কোণের এক ছলাক সুপ্ত আলোও আজ নিভে গেছে। প্রতিদিনকার মতো আজও ভোরে অনুর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে নিরু। গতকাল থেকেই মাথার তীব্র যন্ত্রণাটা চড়া দিয়ে উঠেছিলো,তবে আজ সকল যন্ত্রণাকে ছুটি দিয়ে পৃথিবীর সকল শান্তি নিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে সে।
(৩)
প্রায় দুই বছর হলো,এই দিনেই নিরুর সকল যন্ত্রণার বোঝা অনুকে ধার দিয়ে গিয়েছিল। " আর যে পারছি না রে নিরু,তবে যে বলেছিলি শিগ্ গির ফিরে আসবি, তোর ধার শোধ করার সময় হয়ে এলো যে !" জানলায় পথ চেয়ে আছে অনু, সূর্যের রক্তিম আভা চারদিকে ছড়িয়ে দিয়ে দিনান্তের জানান দিয়ে যাচ্ছে,পাখিরা দলবেধে ঘরে ফিরে যাচ্ছে,গাছেরা মৃদুমন্দ নেচে নেচে বলে যাচ্ছে, " ওই তো,নিরু না ! "
অনুর ঠোটে হাসির আভা, বলে উঠলো,
"এই তোর আসার সময় হলো ! "