অসম্পূর্ণ সফল অভিযান

29 4 1
                                    

ঘড়িতে রাত দেড়টা।ছিপছিপে বৃষ্টি হচ্ছে এই শহরে।সেই বৃষ্টির ভেতরেই সাইকেলে করে বাংলোর মেইন গেট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল দুই আগন্তুক।সাইকেল থেকে ঝটপট নেমে পড়ল একজন।রেইনকোর্টটা ভালোভাবে ঝেড়ে নিল সে।ডায়েনা।স্টিওফারিয়া ডায়েনা নাম তার।বাবার একমাত্র মেয়ে।ভালোই দুঃসাহসী বলা চলে তাকে।গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করার উদ্দেশ্যে প্রিন্সটনে পড়ছে সে।জীবনের লক্ষ্য আডভেঞ্চারার হওয়া।বাবা স্টিফেন গ্রে।পেশায় শহরের নামকরা ডক্টর।মা মার্টিয়া লিলি।ডায়েনার ছোটবেলায়ই মারা গেছেন।সাইকেলের চালক অবশেষে ছাতা সরিতে হুডির টুপিটা খুলে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল।ড্যানিয়েল লিও। স্বভাবে শান্তশিষ্ট। শহরের চিফ লইয়ার মার্ডেনিন ওয়াটসনের ছোট ছেলে।মা সিলেনা ফার্ডান্ডোজ বিখ্যাত ফ্যাশান ডিজাইনার,বুস্টনের।লিও সাইকেল ছেড়ে দাড়িয়ে একবার রাস্তাটার দিকে চোখ বুলিয়ে নিল।চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার।মেইন গেটটায় একটা লাইট বারবার জ্বলছে আর নিভছে বৃষ্টিরর কারনে রাস্তায় কোনো মানুষ নেই।সে এবার ঘাড় গুরিয়ে ডায়েনার দিকে তাকাল।ডায়েনা মুগ্ধ হয়ে বাংলোর দিকে তাকিয়ে আছে
---তুমি কি নিশ্চিত ডায়েনা?আমার মনে হয় তোমার আরেকবার ভাবা দরকার।
ডায়েনা এবার লিওর দিকে বিব্রত ভঙ্গিতে তাকাল।
---আমি একদমই নিশ্চিত এবং প্রস্তুত লিও।আবার ভাবার প্রশ্নেই ওঠে নাহ।
---কিন্তু জায়গাটা আমার কাছে ঠিক লাগছে না। আমরা বাড়ি ফিরে যাই নাহয়?
----তুমি কি পাগল নাকি লিও?দেড়মাস ধরে খুঁজে আমি এ বাংলোটা ভের করেছি।শুধু অপেক্ষায় ছিলাম, কবে ড্যাডি ভার্জিনিয়ার কনফারেন্সটা এটেন্ড করতে যাবে।তুমি তো সবটা জানোই।
---তবুও আমার মনে হচ্ছে দুঃসাহস দেখানো হউএ যাচ্ছে।
----একদমই না।আমার ফেভারিট ম্যাগাজিন ছিল ওটা।আর ওটারই সেল্ফ আসেসিং-এ থ্রু ছিল"তুমি কতটা সাহসী"।আর তাতে কিনা আমাকে ১০০ তে ৬৮ দিল?এটা কি যথেষ্ট হাস্যকর নয়?এবার আমি একরাত শহরের বিখ্যাত ভুতুড়ে বাংলোতে থেকে যখন সেই অভিজ্ঞতার কথা লিখে পাঠাব না?তখন এই ম্যাগাজিনই আমার সাহসীকতার প্রশংসা করবে।
----আমার মনে হয় তুমি একটা ছোট বিষয়ে বড় ডিসিশান নিয়ে ফেলছ।
----ছোট বিষয় বলে কি বোঝাতে চাচ্ছ?এটা ছোট বিষয়?আমাকে ভীতু বলা?ডায়েনা স্টিওফারিয়াকে? এটা তোমার কাছে ছোট ব্যপার হলেও আমার সম্মানের ব্যপার।তোমার এই ননসেন্স উইকিপিডিয়া বন্ধ কর আর সাইকেলটা পার্কিং লটে রেখে এস।আমি ভেতরে যাচ্ছি।
লিও অসহায়মুখে সাইকেলটা নিয়ে পার্কিং লটের দিকে এগোল।ডায়েনা কতটা দুঃসাহসী সেটা সে জানে।স্কুলের "ফ্রেশম্যান" থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত।এত বছর ধরে বেস্টফ্রেন্ড তারা।ডায়েনার সব ভয়ংকর গল্পে লিওকেই আটকে যেতে হয় কেন?ডায়েনা তো জানে লিও কতট ভীতু।সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার হওয়া ছাড়া কোনো স্বপ্ন দেখেছে নাকি ও কখনো?সাইকেলটা রেখে এসে ভিতরে ঢুকল লিও।বেশ পুরনো বাংলো।কতবছর কেউ ভেতরে ঢুকে নি,তা কেবল সৃষ্টিকর্তাই জানেন।বাংলোটার নির্মান প্রকৌশলী যথেষ্ট উন্নত মনোভাবের পরিচয় দেয়।বোঝাই যাচ্ছে বহু বছর আগে শহরের নামকরা বাংলোর মধ্যে একটি ছিল এই ভুতুড়ে বাংলো।তবে কেন যে পরিত্যক্ত হ......
------লিও এদিকে এসো।
এতক্ষন বাংলোটা বিশ্লেষণ করে নিচ্ছিল লিও।উপরে দোতলা থেকে ডায়েনার কন্ঠ এলে সে বিশ্লেষণ থামিয়ে উপরে ওঠার জন্যে সিড়ির দিকে পা বাড়ায়।ওপরে ওঠা মাত্রই ডায়েনা ভলে উঠল
----দেখ লিও।দুটো ঘর কি সুন্দর পরিষ্কার।একরাত আমাদের দিব্যি চলে যাবে।ডিনার তো করেই এসেছি।সকাল হতে শুধু কয়েকঘন্টা বাকি।তার পরেই তো...!এটা তোমার ঘর আর ওটা আমার। কোন প্রয়োজন পড়লে ডেকো।ঘুমুতে যাচ্ছি।শুভরাত্রি।
----ডায়েনা?
---হু?
----আরেকবার ভেবে দেখলে হয় না?
---ঘরে যাও লিওও।
ডায়েনা প্রফুল্ল চিত্তে ঘরে গিয়ে পাওলো কোয়েলহোর "দ্য এলকেমিস্ট"পড়া শুরু করল আর সকালের অপেক্ষায় রইল।অভিযান এর রাতে ঘুম হয় না ওর।
রাত ২:৩৫ মিনিটঃ ডায়েনা তার ঘরেই বই পড়ছিল তখন।এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল।ডায়েনা বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে লিওকে আবিষ্কার করল।লিওকে দেখে সে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে নিঃশ্বাস ছেড়ে ঘরের দিকে ঢুকল।
---ওহ,লিও তুমি?আমি ভাবলাম চোর-টোর হবে নাকি?কারাতের জন্যে নিজেকে রেডি করে রেখেছিলাম।কি ব্যপার?এক ঘন্টায়ই ভয়ে কুপোকাত?ঘামে পুরো গোসল করে ফেলেছ দেখছি।যাই হোক,আমরা আরো সাড়ে তিন ঘন্টা থাকব এখানে।তুমি চাইলে বাকি সময়টা এখানে আমার সাথে গল্প করে কাটাতে পারো।ডায়েনা কথা বলা শেষ করতেই ডোরফ্রেমের কাছে দাড়িয়েই লিও হাঁপাতে হাঁপাতে ঝড়ের গতিতে বলে উঠল
---তুমি কোন বাচ্চার কান্না আওয়াজ শুনেছ?
ডায়েনা ব্যগে বইটা রাখছিল।লিও কথা শুনেই ভ্রুকুটি করে ফিরে তাকাল।তারপর আবার স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ব্যাগের জিপার লাগাতে লাগাতে বলল---না,কারন কোনো বাচ্চাই কাঁদে নি।হয় তুমি ভয়ের কারনে কল্পনা করছ নয়তো তুমি আমাকে বাড়ি ফেরাতে নতুন উদ্যোগ নিয়েছ?
----না,ডায়েনা আমি সত্যিই......
লিওর কথা শেষ হওয়ার আগেই একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শোনা গেল।ডায়েনা লিওর দিকে তাকিয়েই বলে উঠল
----তুমি ঠিক বলেছিল।সর্বনাশ! একট বাচ্চা বাংলোতে ঢুকে পড়েছে।আমাদের ওকে বাঁচাতে হবে।
কথা শেষ করেই ডায়েনা ঘর থেকে বের হয়ে শব্দের উৎস খুজতে লাগল।সে শব্দের উৎস লক্ষ্য  করে  সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল।লিও ডায়েনার পিছনে ছুটতে লাগল।
---ডায়েনা,চলো না বাড়ি ফিরে যাই।ভূত হয়ে যদি।
----আমরা পিওর সায়েন্সএর স্টুডেন্ট হয়ে এরকম বলতেই পারি না লিও।বাচ্চাটা নিশ্চয়ই হারিয়ে গেছে।আমাদের ওকে সাহায্য করতে হবে।
নিচে নেমেই অবশেষে সোফার একপাশে একদম কোনাঘেষে থাকা একটা হাটুর ভাজের মধ্যা মাথা দিয়ে কান্নারত বাচ্চাকে পেল তারা।ডায়েনা বাচ্চাটাকে দেখে মুচকি হেসে লিওকে বলল
----দেখ,তোমার ভূত।
লিও সংকোচ নিয়ে ডায়েনার সাথে হেটে বাচ্চাটার কাছে গেল।ডায়েনা হাঁটু ভাজ করে বসে ডাক দিল
---এই যে ছোট্ট সোনামনী।কান্না করছ কেন তুমি?
ডায়েনার কথা শুনে বাচ্চাটা আস্তে করে মাথা তুলে ডায়েনা আর লিওর দিকে তাকাল।ডায়েনা আবার বলে উঠল
---বলো,কোন ভয় নেই।আমরা তোমার বন্ধু তো।তোমাকে সাহাযা করব।
বাচ্চাটা এবার বলে উঠল ---পারবে না।
---পারব তো সোনামনি পারব।তুমি বলো।
বাচ্চাটা এবার কান্না করতে করতে যা বলল তার মানে দাড়ায় এই যা,সে তার বাবা-মা এর সাথে এখানে থাকতে এসেছিল।ভুলে বাবা-মা তাকে না নিয়েই চলে গেছে।সে এখন বাবা-মায়ের কাছে যেতে চায়।
---তুমি এটা কি বলছ সোনামনি?এ বাংলোতে তো কেউ আসে না।তাহলে তোমরা কিভাবে এলে?
---তারা এসেছিল। আমি কি মিথ্যা বলছি নাকি?
---কিন্তু....
এমন সময় ডায়েনাকে থামিয়ে দিয়ে লিও প্রশন করল---সময়টা ঠিক কখন বলো তো পিচ্চি?
---১৯৮৪ এর ৭ই এপ্রিল।ওই যে,ওই ঘরটাতে আমরা ছিলাম।
সময়ের কথা শুনে চোখ কপালে তুলে বাচ্চা মেয়েটার দেখানো ঘরটার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল তারা।একটা তালাবধ রুম দেখে আবার মেয়েটার দিকে ফিরল তারা।মেয়েটা আবার মাথা গুঁজে কান্না করছে।ডায়েনা আর লিও একবার দৃষ্টি বিনিময় করে আবার মেয়েটার দিকা তাকাল।ডায়েনা কয়েক সেকেন্ড কিছু একটা ভেবে উঠে দাড়িয়ে লিওর হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠা শুরু করল।
---কি করছ ডায়েনা?মেয়েটার কথা তো শেষ হয় নি।
লিওর ঘরটার সামনে এসে ডায়েনা আদেশের সুরে বলল--যাও,ব্যাগ আর ছাতা নিয়ে এস।
লিওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ডায়েনা নিজের ঘরে গিয়ে দ্রুতবেগে রেইনকোর্টটা পড়ে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ঘর থেকে বের হলো।লিও ততক্ষনে অবাক হয়েই ছাতা আর ব্যাগ নিয়ে বের হয়েছে।লিওকে কোন প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে তার হাতটা শক্ত করে ধরে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল ডায়েনা।নিচে নেমে লিও  একবার সোফার দিকা তাকাল।অদ্ভুত! বাচ্চাটা আবার কোথায় গেল?বাচ্চাটাকে এখানে একা রেখে চলে যাওয়ার ব্যপারটা তার কাছে ঘোলাটে লাগল।এমন করার মেয়ে তো ডায়েনা নয়।যখন মুল দরজা থেকে বেরিয়ে তারা বাইরে যাবে,তখন আবার ওই বাচ্চাটার গলা শোনা গেল।
---একদিন ছুটি হবে,অনেক দূরে যাব।নীল আকাশে,সবুজ ঘাসে।খুশিতে হারাব।ডায়েনা আর লিও দুজনেই থেমে ঘুরে থাকাল।দোতলার রেলিং ধরব বাচ্চা মেয়েটা দাড়িয়ে আছে।তারা মেয়েটার দিকে ঘুরতেই সে একটা নিষ্পাপ কোমল হাসি দিয়ে তাদের দিকে হাত নেড়ে বিদায় জানাল।ডায়েনাও অপ্রস্তুত হয়ে জোর করে মুচকি হেসে বাচ্চাটার দিকে হাত নেড়ে বিদায় জানালো। লিও কিছু বুঝে ওঠার আগেই ডায়েনা দ্রুত তার হাত ধরে বাহিরে এসে সাইকেলে উঠে  পড়ল।
---সাইকেল চালানো শুরু কর লিও,দ্রুত।
লিও অবাক হয়ে সাইকেলে উঠে সাইকেল চালিয়ে বাংলোটা থেকে বেড়িয়ে রাস্তায় সাইকেল চালানো শুরু করল। রাত প্রায় সাড়ে তিনটা বাজে তখন।বৃষ্টি থেমে গেছে। এখনো চারদিকে অন্ধকার।লিও নিরবতা ভেঙে বলে উঠল
---তোমার অভিযান তো সফল হলো না।
----হলো না,তাতে কি?ভুতুড়ে বাংলোর থেকে পাহাড় বেশি সাহসীকতার পরিচয় দেয়।তাই নয় কি?
----পাহাড়???মানে??
----মানে পরের সপ্তাহে আমরা পাহাড়ে যাচ্ছি।টেন্ট বানাবো,রাতে থাকব ওখানে।আঙ্কেল আন্টিকে বলে অনুমতি নিয়ে রেখো।
লিও হকচকিয়ে একবার ঘুরে ডায়েনার দিকে তাকাল।ডায়েনা একটা চোখ টিপ্পনী দিয়ে তাকে পাহাড়ের ব্যপারে আস্বস্ত করলে সে আবার সামনে ঘুরে তাকাল।ডায়েনা স্টিওফারিয়াকে আডভেঞ্চার থেক সরানো সাপের সাত পা না না দশ পা দেখা থেকেও অসম্ভব।লিওকে আবার একটা ভয়ংকর রাতের অপেক্ষায় থাকতে হবে সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাইকেল চালানোয় মন দিল।ডায়েনা তার অভিব্যক্তি দেখে মুখ টিপে হেসে ফেলল।ভাগ্যিস! এরকম একটা ভীতু বন্ধু পেয়েছিল,জীবনটা নাহয় অসম্পূর্ণই থেকে যেত।সে শেষবারের মতন একবার পেছনে ফিরে বাংলোটার দিকে তাকালো।

"বহু বছর, বহু যুগ ধরে এ বাংলোটায় এক রহস্য চলছে।ভবিষ্যতেও চলবে। এই প্রাকৃতিক ও পুরাতন রহস্যে নাক না গলানোই শ্রেয়।ডায়েনার জন্যে আর লিওর জন্যেও।তবুও এরকম একটা আডভেঞ্চার নিজের  অভিজ্ঞতার ঝুলিতে থাকা মন্দ নয়।তাই নয় কি?"

ডায়েনা মুখ ঘুরিয়ে রাস্তার দিকে তাকাল।
আমেরিকার শিকাগো শহরের রাস্তা ধরে গভীর রাতে ছুটে চলল ডায়েনা স্টিওফারিয়া আর ড্যানিয়েল লিওর সাইকেল।দুই আগন্তুকের সাইকেল।যাঁদের মন এখনো এক অভিযানের ঘোরে সিক্ত।
            """অসম্পূর্ণ সফল অভিযান""""
                               

অসম্পূর্ণ সফল অভিযান Where stories live. Discover now