ট্রেন আসতে এখনো আধা ঘণ্টা বাকি। ঢাকা থেকে কুমিল্লা আসতে এই ট্রেনটা সবসময় দেরি করে। কিন্তু তারপরও নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই ষ্টেশনে এসে বসে থাকে পলাশ। অপেক্ষা করে ট্রেনের। অন্যদের কাছে অপেক্ষা ক্লান্তিকর। কিন্তু তার কাছে অপেক্ষা আনন্দের। একটু একটু করে সময় অতিক্রান্ত হয় আর সে রোমন্থন করে স্মৃতি। তার আর রূপার স্মৃতি।
রূপার সাথে তার কখনোই পরিচয় হয়ার কথা ছিল না। পলাশ ছিল বারডেমের ইন্টার্ন আর রূপা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং-এর ছাত্রী। ডাক্তারি আর হিসাববিজ্ঞান। ইব্রাহীম মেডিকেল কলেজ আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এ যেন দুটি সমান্তরাল রেখা যা কখনো একসাথে মিলে না। কিন্তু জীবন সরলরেখা নয়, বৃত্তের মতো তা চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। আর সেই বৃত্তের মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে পড়ল পলাশ আর রূপা। জীবনের পথ চলতে চলতে দেখা হয়ে গেল দুজনের।
সেদিন রূপা গিয়েছিল বারডেমে চোখের ডাক্তার দেখাতে। কাউন্টারে টাকা জমা দিতে গিয়ে থমকে গিয়েছিল সে। পলাশ কি একটা কাজে গিয়েছিল সেখানে। রূপার দিকে চোখ পড়তেই অবাক হয়ে লক্ষ করতে লাগল তার কাণ্ড। ব্যাগ থেকে বই-খাতা সব বের করে কাউন্টারের উপর স্তূপ করে রেখেছিল রূপা। কি যেন খুঁজছিল। শেষে না পেয়ে কাকে যেন ফোন দিল। খাপছাড়া সেই কথোপকথন আজও পলাশের কানে বাজে। "কিন্তু তুমি টাকা দাওনি কেন- না আমার কাছে যে টাকা আছে ওটা দিয়ে হবে না- তাছাড়া ওটা দিয়ে আমি ফুচকা খাব- হ্যাঁ, আজকে আমাকে ফুচকা খেতেই হবে- না ভাই, আমি চশমা ছাড়া লেকচার বুঝতে পারছি না- আব্বু! আমি কান দিয়ে শুনি আর চোখ দিয়ে দেখি- এটা শুধু তুমি, না সবাই জানে- ভাই, এখন আমি কি করব সেটা বল- আজব! তুমি এটা একটা কাজ করলা- না! আজকে চলে যাব- না! আমি ফুচকা খাব, খাব, খাব! রাখলাম"
ফোনটা রেখে সে যখন বই-খাতাগুলো ব্যাগে ঢুকাচ্ছিল তখন পলাশ এগিয়ে গিয়েছিল। জানতে চেয়েছিল, তাকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারবে কিনা। তার প্রশ্ন শুনে রূপা সরু চোখে তাকিয়েছিল তার দিকে। পরে যখন তার গায়ে অ্যাপ্রন দেখল তখন কিছুটা সহজ হল। একনাগাড়ে গড় গড় করে কি সব বলে গেল। সেই কথা মর্মোদ্ধার করতে পলাশের পুরো এক মিনিট লাগল। কারণ সে তাকিয়েছিল রূপার চোখের দিকে। সরু চোখ যখন স্বাভাবিক হয়ে এল, তখন পলাশ হতবাক হয়ে গেল। এত মায়া সে কখনো কারো চোখে দেখেনি। তার শুধু মনে হচ্ছিল এই চোখের দিকে তাকিয়ে সারাটা জীবন পার করে দেয়া যাবে। যখন তার সম্বিত ফিরে এল, তখন সে বুঝতে পারল যে রূপা ডাক্তার দেখানোর ফি আনেনি।
