হারানো সুর

269 0 0
                                    

Graduation কমপ্লিট করলাম বেশ ভালো ভাবেই।এবার কয়েকজন মিলে ঠিক করলাম কলকাতাতে পড়তে যাব।আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম।কিন্তু রেজাল্টের ওপর নির্ভর করছিল।রেজাল্ট সবারই খুব ভাল হল।আমরা ছয়জন বন্ধু ইংরেজিতে রেগুলার M.A. তে চান্স পেলাম।
আমি আর প্রিয়াঙ্কা বাদে বাকি চারজন B.A. মেসে থেকেই করেছে।কিন্তু আমরা মেসে কখনও থাকিনি।মেসে থাকতে খুব কষ্ট হয় বলে শুনেছি।
আমি যাকে বলে সাধের আনারস।আলালের ঘরের দুলাল বললে অত্যুক্তির দায়ভার বইতে হবে না।মা এখনও আমাকে খাইয়ে দেয়।হ্যাঁ রোজ।বিয়েবাড়ি আর ফাস্ট ফুডের কথা বলছি না।না হলে রোজ মা-ই ভরসা।সন্ধ্যা থাকতে ঘুমিয়ে গেলে মা ঘুমের ঘোরে খাইয়ে দেয় - বুঝতেও পারি না।রোদ থেকে ঘরে এলে শরবত হাতের কাছে এনে দেয়।শরীর টরীর খারাপ হলে মাকে ছাড়া চলে না। এভাবে আমি ইমপোর্টেড বাঁদর হয়ে গেছি।
সেই আমি সেই মাকে ছেড়ে বাইরে পড়তে যাচ্ছি।কুটো নেড়ে দুটি করি না।জামাকাপড় কাচা, আয়রণ , থালা বাসন মাজা কীভাবে করে তা-ই জানি না।মাকে ছেড়ে যাব বলে নয় আমাকে একা কী কী করতে হবে সেটা ভেবে ঘুম উড়ে গেল।
নিয়ম মেনে সময় ধরে ভর্তি হলাম।ছয়জন একটা মেসেই থাকতাম।রুমটা আলাদা ।আমি আর ঋতু একটা রুমে।আরও কিছু সমবয়সী , সিনিয়র ছিল।অনেক কাজ নিজে করতে হচ্ছে।আমি এটা ভেবে অবাক হয়ে যাচ্ছি মা এতজনের কাজ রোজ একা করে কীভাবে।না মা হওয়া খুব মুশকিল সত্যি।তো এসব সাইডের কথা বাদ দিই।মূল স্রোতে ফিরি।
ক্লাশ শুরু হল।পড়াশোনায় ফিরলাম।সাথে সাথে নেট-এর জন্যও প্রিপারেশন নিতাম।তাই ক্লাশগুলো ছাড়া বাকি কলেজ আওয়ারে লাইব্রেরিতে পড়তাম।
বই পড়তে ভালোই লাগে।কত ধরনের বই, তাদের কত কথা।আমার তো মনে হয় যেন ওরা আমাকে ডাকে।পড়তে ভালোবাসি বলে এগুলো কোনোদিন চাপ বা পরিশ্রম বলে মনে হয়নি।

এক সপ্তাহ হবে
একদিন লাইব্রেরিতে বসে আছি।খুব মনোযোগ দিয়ে"Arms and the Man" পড়ছি।হঠাৎ ওইদিকের টেবিলে চোখ গেল।অভিমন্যুর মত দেখতে অনেকটা।অনেকটা।তবে মনে হল ও-ই।ওকে আমি শেষ দেখেছি নাইনে।তারপর ছয় বছর পেরিয়ে গেছে।
সিউর হলাম কারণ অভিমন্যুও দেখলাম আমার দিকেই তাকিয়ে আছে।আমি একটু হেসে আবার পড়াতে মন দিলাম।
অভিমন্যু চ্যাটার্জী ছিল আমার প্রথম ক্রাশ।সেভেন থেকে আমরা সবাই একটা ব্যাচে পড়তাম।আর্টস্-এর টিউশন।আমরা সবাই খুব মজা করতাম।অনেকগুলো ছেলেমেয়ে একসাথে পড়তাম।পড়া ধরা, ক্যুইজ এসবে আমরা সবাই খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড হয়ে উঠেছিলাম।
সেই সেভেন এইট-এ আমার সব বন্ধুরাই পটাপট করে প্রেমে পড়ে গেল। সিরিয়াস প্রেম নয়।করতে হবে বলে করা। আমি একটু এসব avoid করার চেষ্টা করতাম।কিন্তু ব্রিলিয়ান্ট অভিমন্যুর প্রতি একটা দুর্বলতা তৈরি হয়েছিল।
কিন্তু বলিনি।ওর সাথে কথাও কম হত।তাছাড়া আমি নিজেও সিওর ছিলাম না।পরে বাকি বন্ধুদের কাছ থেকে শুনেছিলাম অভিমন্যু আর সুচরিতা একটা রিলেশনে আছে।ধীরে ধীরে ভুলতে চেষ্টা করলাম।দেখলে একটু কষ্ট হত।তারপর ক্লাশ টেন থেকে আজকের আগে অব্দি দেখা হয়নি।সুচরিতার খবরও জানি না।
আমি প্রোপোজালও পাইনি, আর কাউকে ভালোও লাগেনি।পড়াশোনাতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম।
সেভেন এইটে ভাবতাম রিলেশন জিনিসটা দেবযানী আর যযাতির মত।একবার হাত ধরলেও বলবে- আপনি পাণি গ্রহণ করেছেন ।অন্য কাউকে স্বামী হিসেবে মানতে পারি না।
সব সম্পর্কই রমা- রমেশের মত।কিন্তু পরে যখন দেখলাম জামা বদলানোর মত সম্পর্ক পাল্টাচ্ছে ঘৃণা ধরে গেল।প্রতি ছয় মাসে একজন।আমি সিঙ্গেলই ভাল।
মনে পড়ে এগুলো দেখে একদিন মাকে বলেছিলাম- মা এদের বিয়ে একজনের সাথে হবে তো? না দধি মঙ্গল হবার পর ব্রেক আপ হয়ে গেল, গায়ে হলুদ আরেক জনের সাথে হল।এভাবে শুভদৃষ্টি একজনের সাথে,মালাবদল একজনের সাথে, সিঁদুরদান একজনের সাথে আর বউভাত আরেকজন।
ব্যাপারটা interesting কিন্তু।
আর আমারও সত্যি বলতে এতদিন মনেও পড়েনি ।আজ সব হঠাৎ মনে পড়ল।মন দিয়ে বেশিক্ষণ পড়তে পারলাম না।বেরিয়ে গেলাম।মাকে ফোন করলাম।মা নিয়ম করে কুড়ি বার ফোন করে।
- হ্যালো মা?
- হ্যাঁ।কোথায়।
- এই লাইব্রেরি থেকে বেরোলাম।মেসে ফিরছি ।
- খেয়েছিস?
- একটা সাধারণ মানুষ দিনে কবার খায়?
- দশটার পর আর কিছু খাসনি?
- কে বলল? কত কিছু খেলাম।
- কী?
- হাওয়া আর জল।
- কিছু খাসনি? canteen-এ খাবি কিছু যা।
- আচ্ছা।রাখছি।
- হুম্ ।
ফোনটা কেটে দিলাম।বিরাট রোদের তেজ।একা ফিরতে হবে।বাকি সবাই ক্লাশ করে হয় canteen নয় গাছের তলায় আড্ডা দিচ্ছে।এখন বিরক্ত করা ঠিক হবে না।তাছাড়া খিদেও পেয়েছে।ভাবলাম একটা আইসক্রিম আপাতত খাই।
- শাওন?
উল্টো দিকে ঘুরে আমার 440 ভোল্টের ঝটকা লাগল।অভিমন্যু! ও এখনও বাড়ি ফেরেনি?
- ও অভিমন্যু? ভাল আছ?
- হ্যাঁ।তুমি এখানে পড়।
- হ্যাঁ।মাস্টার্স করছি।
- ইংরেজিতে?
- হ্যাঁ।কীভাবে জানলে?
- সেই যে জয়ন্ত স্যরের টিউশনে বলেছিলে।
- বাবা।মনেই নেই আমার।তুমি কী করছ?
- আমি ফিজিক্স নিয়ে পড়ছি।মাস্টার্স করছি।
- আর graduation?
- এখানেই।
- ও।আর সুচরিতা কেমন আছে?এখানে পড়ে?আমার সাথে আর....
- ওয়েট ওয়েট ওয়েট সুচরিতা মানে?
- সুচরিতা।
- জয়ন্ত স্যারের কাছে পড়ত?
- না।সায়েন্স টিউশনে তোমার সাথে পড়ত।একটু লম্বা করে....
- মনে নেই।কোথায় থাক?
- একসময়ের গার্ল ফ্রেন্ডকে ভুলে গেলে?এত তাড়াতাড়ি?
- কে? কে গার্ল ফ্রেন্ড আমার? সুচরিতা না কী যেন।কে বলেছে এসব ফালতু কথা?
- এইটে অনিতা বলেছিল।আরও অনেকেই তো বলত সুচরিতার সাথে রিলেশনের কথা।
- আমি বলেছি কি?
- ও।যাইহোক আসি।দেরি হয়ে যাচ্ছে।খিদেও পেয়েছে।
- ফোন নাম্বারটা?
- কার?
- obviously তোমার।
- আমার?আমার ফোনের নাম্বার?
- তোমাকে প্রতিটা কথা কি দুবার বলতে হয়? আগে তো এমন ছিলে না।
- আচ্ছা নাও।তবে ইউনিভার্সিটি আওয়ারে ফোন বন্ধ থাকে।লাইব্রেরিতে থাকি।
- ঠিক আছে।আসছি।
আমি মেসে ফিরলাম।সোমাদি ছাড়া আমাদের রুমের আর কেউ ফেরেনি।গা ধুয়ে জানলার ধারে বসলাম।সামনে একটা বড় নারকেল গাছ আছে।যখন পাতাগুলো দোলে বড় ভালো লাগে।বিকেলের অস্তগামী সূর্যের আলোয়, পাখির ডাকে বড় ভালো লাগছিল।
এই সময় মামাবাড়িতে আমরা সব ভাই বোন মিলে কত মজা করতাম।এখন সবাই বাইরে। ভাল লাগে।পাখি কিচকিচ করছে।
রাত বারোটা প্রায়।একটু পরেই শোব।ফোনটা switch off করতে গিয়ে দেখলাম একটা আনরিড মেসেজ।নাম্বার সেভ নেই।খুলে দেখলাম লেখা আছে- " Good night. sweet dream.- Avi."
অভিমন্যুর মেসেজ।অনেকক্ষণ আগেই এসেছে।রিপ্লাই করলাম না।
পরের দিন লাইব্রেরিতে বসে আছি। " pride and prejudice" পড়ছি। অভিমন্যুকে ঢুকতে দেখলাম। খালিই প্রায় লাইব্রেরিটা। দু চারজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে।আমার টেবিলটাতে কেউ বসেনি।অভিমন্যু একটা বই নিয়ে বসল।আমি ফর্মালিটি মেইনটেন করে একটু হেসে পড়া শুরু করলাম-" you are dancing with the only handsome girl in the room"
অভিমন্যুও দেখলাম খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছে।আমি উঠছি দেখে অভিমন্যু আস্তে বলল-" এইটা শেষ করি।একসাথেই যাব।"
আমি একটু অবাকই হলাম।- আমি? আমাকে বলছ?
- এখান থেকে এত আস্তে বললে আর কে শুনতে পাবে?
অগত্যা বসলাম।একটা সামনে রাখা বইয়ের পাতা ঘাঁটাঘাঁটি করলাম।কুড়ি মিনিট হবে প্রায় বলল- হয়ে গেছে চল।
লাইব্রেরির বাইরে এলাম।রোদের তেজ তেমন নেই।আজ আমার রাখির সাথে যাবার কথা।আমি বলেছি চারটা।চারটা বাজতে পাঁচ মিনিট দেরি আছে কিন্তু ওকে কোথাও দেখলাম।দাঁড়াতে বলে ভুলে গেল নাকি?
- চল।দাঁড়িয়ে আছ কেন?
- একজনের চারটাতে আসার কথা।ওর জন্যই।
- বয়ফ্রেন্ড্?
- না গার্লফ্রেন্ড রাখি।কারো জন্য দাঁড়িয়ে থাকলে তাকে বয়ফ্রেন্ড্ হতেই হবে?
- ও।কিছু খাবে?
- না ।
- চল কিছু খাওয়া যাক।canteen-এ চল।মেসেজে বলে দাও ওখানে আছ।
ব্যাপারটা মন্দ নয়।আমারও খিদে পেয়েছে।
- চল।
খেতে খেতে রেজাল্টের , পুরানো বন্ধুদের আর জয়ন্ত স্যরের টিউশনে কত মজা হত সেই নিয়েই গল্প করলাম।
অভিমন্যু স্ট্যান্ড করেছিল জানতাম। কলেজ টপার সেটা জানতাম না।পুরানো অনেকের খোঁজ পেলাম।আমিও কয়েকজনের খবর দিলাম।
- আচ্ছা সুচরিতা তো সায়েন্স টিউশনিতে পড়ত।টেনে আর পড়ত না?
- আবার সুচরিতা? সুচরিতা কোথা থেকে আসে বলত?
- সুচরিতা বসু। ঐ প্রিয়ার সাথে ঘুরত বেশি।
- সুচরিতা বসু হোক বা বন্দ্যোপাধ্যায় আমার কী?
- না মানে আমি শুনেছিলাম যে তোমাদের রিলেশন আছে।ও নাকি তোমাকে চিঠি আর লাল গোলাপ দিয়ে propose করেছে।
- আমাকে অনেকজন চিঠি লিখে propose করেছে।তাদের সবার সাথেই আমার রিলেশন থাকবে? রিলেশন এত সস্তা নয়।
- আচ্ছা আমি উঠি।
- শাওন বিলিভ মি সুচরিতার সাথে আমার কোনোদিন কোনো রিলেশন ছিল না। আমি কখনও সুচরিতাকে নিয়ে এসব ভাবিনি।আমি যদি জানতাম তুমি এসব উল্টোপাল্টা কথা জান আরও আগে জানাতাম।
- ঠিক আছে আসছি।
- আমার কথা বিশ্বাস করেছো তো?
- আমার বিশ্বাস বা অবিশ্বাসে কী? আমি কি character certificate দেব?
- না তা হয়তো না তবে তোমার বিশ্বাসটা জরুরী আমার জন্য।বাই।

হারানো সুরTahanan ng mga kuwento. Tumuklas ngayon