সবাই জানত, তাদের দুজনের মেলামেশাটা ছিল শুধুই একটা পরিনতিবিহীন একটা সম্পর্ক যেহেতু সে ছিল ক্যাপ্টেন আর মারিয়া ছিল সামান্য এক ক্যাডেট । যদি তাদের পদ মর্যাদা সমান হতো তখন হয়তো সবাই এটাকে একটা ভুল বলে উড়িয়ে দিত । অন্য ক্যাডেটরা সম্ভবত তাকে এখন চরিত্রহীনা ভাবতে শুরু করেছে । নিজের কামরায় গিয়ে মুখ লুকাল সে । স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র এক কাপ চা ঢেলে দিল তাকে । জানালা দিয়ে তাকাল বাইরে, অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে পৃথিবী, গ্রহটা সেই কবে থেকে ঘুরছে তোঁ ঘুরছেই ।
এখনো সে দুঃস্বপ্ন দেখে । তাদের বাড়ির কংক্রিটের বেজমেন্টে গলা পরিমান পানি । পুরনো কাপড়ের র্যাকগুলো ডুবে গেছে পানির নীচে । বিদ্যুতের তারগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে ভাসছে পানিতে আর বিদ্যুতের ঝিলিক ক্ষুব্ধ মাকড়সার মতোঁ নেচে বেড়াচ্ছে পানির উপর । মেরামতের কোনো উপায় ছিল না । কোনো উপায়ই ছিল না । দৃশ্যগুলো কল্পনা করলেই অবিরাম রক্তক্ষরণ হতে থাকে তার মনের গভীরে ।
ঘুম থেকে উঠেই পরিস্কার, শুভ্র বাথরুমে ঢুকল, অসুস্থ বোধ করছে । পোর্সেলিনের ছোট একটা গামলায় বমি করল । তার শিফটের সময় হয়ে এসেছে প্রায়, ধুসর ইউনিফর্ম পরে তৈরি হয়ে নিল সে । আর কয়েক মাসের মধ্যেই প্রকাশ হতে শুরু করবে । এই ইউনিফর্ম আর তার গায়ে আটবে না । দরজা খুলে দ্রুত বেরিয়ে এলো কঠিন ইস্পাতের লম্বা হলে । হাটতে শুরু করল এবং এয়ার লকের কাছে এসে থেমে দাঁড়ালো ।
এয়ার লক এখানেই কেন বসানো হয়েছে, সবসময়ই সে অবাক হয়ে ভাবে কথাটা, হলের ঠিক মাঝখানে । এটা খোলার গোপন সংখ্যা সবার কাছেই আছে, যদি কখনো কোনো ভয়াবহ পরিস্থিতিতে মহাকাশযান পরিত্যাগ করার প্রয়োজন হয় । ঠিক এই জায়গাতেই এয়ার লক থাকাটা অবাক করার মতো, হলের ঠিক মাঝখানে, যেন কখনো যদি কোন ফুটো তৈরি হয় তাহলে হলটাকে তারা মহাকাশযানের বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারে । প্রতিদিন এটার সামনে দিয়েই সে হেটে যায়, তার আর বিশাল শূন্যতার মাঝে কেবল দুটো পাতলা দেয়াল ।
আজকে তার দায়িত্ব মহাকাশযানের ব্রিজে, অর্থাৎ, ক্যাপ্টেনকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই । থিয়েটারের পর্দা উঠার মতো ব্রিজের দরজা মেঝের উপর দিয়ে মসৃণ ভাবে একপাশে সড়ে গেলো, ক্যাপ্টেন চোখ তুলে তাকালো মারিয়ার দিকে, তারপর দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল, যেন মারিয়া তার সম্ভাষণ কিংবা দৃষ্টির যোগ্য নয় এবং তার দৃষ্টি মারিয়ার উপর এমন ভাবে ঘুরলো যেন সে আর দশটা কম্পিউটার অথবা চেয়ারের মতোই জরবস্ত । দ্রুত শিফট শেষ করল সে । ফিরে গেলো নিজের কামরায় । যাওয়ার পথে আবার থামল এয়ার লকের সামনে । এটা তার উদ্যান, তার মন্দির ।
প্রায়ই কল্পনা করে যে সে নিজেই মহাকাশযান, নিকষ কালো মহাকাশ ভেদ করে ছুটে চলেছে । দুর্বার গতি তাকে অসুস্থ করে তোলে । নাবিকদের সবাই তার শরীরের অভ্যন্তরে তুলোয় মোড়ানো রক্ত কণিকার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে, ঘর্মাক্ত হাতে তার রেলিঙগুলো নোংরা করছে, তাদের আঠালো আঙ্গুলের ছাপ পড়ছে তার জানালার শার্শিতে । ঘুম ভেঙ্গে যায় তার । মনে হলো কামরাটা দুলছে । লাফ দিয়ে উঠে একছুটে বাথরুমে ঢুকল । বমি করল ছোট শুভ্র পোর্সেলিনের গামলায় । নিজের ভেতরের সব বিতৃষ্ণা উগরে দিতে চায় সে ।
শুভ্র বাথরুম । ঠাণ্ডা জলে ভিজিয়ে রাখা শুভ্র শার্ট । ইউনিফর্ম গায়ে চাপিয়ে লম্বা হলে বের হয়ে আসে, যেন নিজের দেহের ভেতরের কোনো একটা অংশ থেকে আরেক অনশে বিচরন করছে সে । জানালা দিয়ে অনেক নীচে পৃথিবীর দিকে তাকালো, ছোট নিল মার্বেলের মতো দেখাচ্ছে গ্রহটাকে, যেন একটা খেলনা । হঠাৎ করেই মহাশূন্যের নিকষ অন্ধকারকে ভীষণ প্রিয় মনে হলো তার । এই অন্ধকারের কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই । এখানে নেই কোনো উষ্ণতার প্রয়োজন অথবা দায়িত্ব পালনের বাধ্যবাধকতা ।
তাকে বিচার করার কোনো অবকাশ মহাশূন্যের নেই । জীবনের সব চাওয়া-পাওয়া এখন শুন্য এবং অপ্রয়োজনীয় । যে স্থানে জীবনের সূত্রপাত সেই স্থানই আবার জীবনকে ছিঁড়ে ছিন্ন ভিন্ন করে দেয়, জন্মদায়িনি গ্রাস করে নেয় তার সন্তানদের । মারিয়া যেতে চায় ওখানে, সমর্পণ করতে চায় নিজেকে, কারণ এই অন্ধকার তাকে চায়নি কিন্তু তাকে পরম মমতায় আগলে রাখবে অনন্তকাল । এয়ার লকের সামনে দাড়িয়ে আছে সে, এবং সেটা খোলার গোপন সংখ্যাগুলো সে জানে ।
©নাজমুছ ছাকিব
