পরাজিত

483 34 18
                                    

রাত তখন পোনে দুটো। পাহারাদার পুলিশের বাঁশি ছাড়া যা কানে পৌছাচ্ছে , তা হল ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। বাগানমুখী ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা হিঁয়ার কানে তখন এইসব শব্দ ছাপিয়ে প্রবেশ করছিল নিজের বুকের উত্তাল সমুদ্রের প্রকান্ড ঢেউগুলোর গর্জন। একদৃষ্টে চাঁদের দিকে তাকিয়ে সেই ঢেউগুলোর ধাক্কা সামলানোর চেষ্টা এর আগেও করেছে হিঁয়া। কখনো পেরেছে, কখনো পারেনি। দু’চোখ ছাপিয়ে নেমে এসেছে সেই জলের ধারা। আজও ঠিক একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা । কিন্তু যেন অনেক বেশী নিশ্চুপ দেখাচ্ছে ওকে। অনেক বেশী দৃঢ়, অথচ দুখী। পরনের ধূসর ফ্রকটা যেন ওর মনকেই প্রতিফলিত করছে। গাঢ় নীল রঙে সাজানো তার নখ। বাঁ হাতে চারটে ওষুধের পাতা আর ডান হাতে একটা জলের বোতল। একটার পর একটা পাতা খুলে ওষুধগুলো এক এক করে গলায় চালান করে দিলো ও। খালি পাতাগুলো বারান্দায় ফেলে রেখে নিজের ঘরে ঢুকেই শরীর এলিয়ে দিল খাটে আর আধবোজা চোখে দেখতে থাকলো নিজের ঘরটাকে। টেবিলে জমা হয়ে আছে আগোছালোভাবে ওর খাতা, বই, আঁকার খাতা, পেন্সিল, গানের ডায়েরী, মোবাইল, হেডফোন, আর একটা থার্মোকল কাটার ছুরি। এটা দিয়ে শিরা কেটে আত্মহত্যার কথাও ও  ভেবছিল কিন্তু ও চায়নি যে ওর মৃত্যুটা এতটা কষ্টজনক হোক যাতে শেষ মুহুর্তে একবারের জন্যও জীবনকে বেশী সুন্দর বলে মনে হয়। ব্যালকনি থেকে ঝাঁপ দেওয়ার কথা ভেবেছিল, কিন্তু ওর থেঁতলে যাওয়া মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মায়ের মুখটা কল্পনা করে সেটা করতে পারেনি। সবশেষে এই অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খেয়ে চিরঘুমে যাওয়াটাই বেছে নিয়েছিল ও। ঘরের সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে এইসব ভাবছিল হিঁয়া। ওর জানা নেই আর ঠিক কতক্ষণ ওর চেতনা থাকবে, আর কতক্ষণই বা ওর এই শরীরটায় প্রাণ থাকবে।

স্মৃতিরোমন্থন করাই সবচেয়ে ভালো উপায় হতে পারে জীবনের শেষ মুহুর্তগুলো কাটানোর জন্য। টলোমলো পায়ে বিছানা ছেড়ে এগিয়ে গিয়ে একটা পুরনো হলদে হয়ে যাওয়া ডায়েরী বের করে আনলো হিঁয়া। এটা দীপের কবিতার খাতা। দীপ আর অপর্ণার একমাত্র সন্তান হিঁয়া। দীপের এই কবিতা লেখা – ছবি আঁকা এইসব নেশাকে উপদ্রব মনে হত অপর্নার। তাই হিঁয়াকে সাথে নিয়ে ঘর ভেঙে বেরিয়ে এসেছিল সে। আর এই ঘটনার দেড় বছরের মধ্যেই শুভ্রাংশুর সাথে নতুন করে সংসার পাতে। এর জন্য মাকে দোষ দেয় না হিঁয়া। কিন্তু অনেকবেশী যান্ত্রিক মনে হয় ওর মাকে। গতবছর বৈশাখে দীপ আত্মহত্যা করার পর ওর এই ডায়েরীটা নিয়ে এসেছিল হিঁয়া।  আজ যেন আবার বাবার মৃতদেহটা দেখতে পেল হিঁয়া। দুচোখ ঝাঁপসা হয়ে এলো জলে, চোখের পাতাদুটো চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল "আমি আসছি বাবা, আবার তোমার কাছেই আসছি, আর নয়, আর কেউ নাগাল পাবে না আমাদের।" সল্টলেকের আভিজাত্যপূর্ণ ফ্লাটের এই সুসজ্জিত ঘর, ডেস্কটপ, ল্যাপটপ,  আইপড,  আইফোন থেকে ওয়ার্ডোব উপচে পড়া ব্র্যান্ডেড পোশাক, এমনকি হিঁয়ার আবদারের গন্ডা গন্ডা দর্শন, সাহিত্যের বই সমস্ত কিছুই শুভ্রাংশু হাসিমুখে দিলেও বাবার এই হলদে যাওয়া ডায়েরীটাই যেন ছিল ওর একমাত্র সম্বল। অভিমানী এই মেয়েটাইকে ওর বাবা কেবলমাত্র চিনত বোধ হয়। বাবার অনেক কবিতায় নিজেকে খুঁজে পায় হিঁয়া। কত সুন্দর ভাবতে পারত বাবা। আর ত কেউ পারে না। এই ভালোমানুষটাকে কীভাবে বুঝবে এই স্বার্থাণ্বেষী যন্ত্রেরা?  কেন সে হিঁয়াকে নিজের সাথে এনেছিল তার মা, এটাই বোঝেনা হিঁয়া। সে তো চায়নি এই পার্থিব সুখ। আর তার বাবাই বা কেন হতে দিয়েছিল এমন? পারত না হিঁয়াকে নিজের কাছে আকড়ে রাখতে? সে কি জানত না যে হিঁয়া কী চায়? টালির ছাউনি দেওয়া বাড়িটার উঠোনে বাবার পাশে বসে যে চাঁদ দেখতো হিঁয়া, সেটা যেন এখন অনেক বেশী ফ্যাকাশে লাগে ওর। এই এগারো তলার বারান্দা পর্যন্ত উঠে চাঁদের কাছে তো আসতেই পারনি সে, বরং আরো যেন দুরে চলে এসেছে।

পরাজিতTahanan ng mga kuwento. Tumuklas ngayon