বন্ধহীন

21 2 0
                                    

সাইকেলের আওয়াজ পেতেই দৌড়ে গেলাম উঠোনে। বাবা বাড়ি ফিরেছেন, একটা স্বস্তি, এতক্ষণে ভরসাযোগ্য কাউকে পাওয়া গেল। ভীত,অর্ধভঙ্গ গলায় বললাম,
- বাবা, বোনের খুব জ্বর। কথা বলতেও পারছেনা।
বাবা সাইকেল কোনোভাবে উঠানের দেওয়ালে ঠেকিয়ে প্রায় দৌড়েই ঘরে ঢুকলেন। আমার দিকে তাকিয়ে,
- অমরেশ ডাক্তারবাবু এসেছিলেন ?
- না, উনি শহরে গেছেন। ৩ দিন আসবেন না।(আমি)
- ভাত বাড়, দেখি আমি একবার  শ্যামল ডাক্তারের বাড়ি হয়ে আসি।(বাবা)
        আমরা এই ডাক্তারবাবুকে দেখাইনা, উনি ফিজ বেশি নেন। গ্রামের প্রায় সবাই অমরেশ ডাক্তারবাবু কেই দেখান।
        খাবার, সমস্ত ঢাকা রেখে বসে রইলাম; চারিদিকের নিস্তব্ধতা আর ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক কেমন যেন হতাশার আভাস দিচ্ছে। এরমধ্যে খানিক ঘুমও লেগে গেছিল। সাইকেলের শব্দে সে ঘোর কাটলে, দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ডাক্তারবাবুকে নিয়ে বাবা আসছেন। আমিও তাড়াতাড়ি বিছানার পাশের চেয়ার ফাঁকা করে এগিয়ে দিলুম। বেশ অনেকক্ষণ ডাক্তারবাবু, বোনকে দেখলেন তারপর নিজের ফাউন্টেন পেন বের করে ঘষঘষ করে কাগজে কিসব লিখলেন। বাবা, ডাক্তারবাবু কে কিছুটা এগিয়ে দিয়ে বাড়ি ঢুকে সেই কাগজটা আমাকে ধরিয়ে বললেন, অসীতদার দোকান থেকে ওষুধগুলো আনতে।
- কিন্তু, টাকা?(আমি)
- বলবি, কাল-পরশুর মধ্যে দিয়ে দেবে।(বাবা)
অসীত দা রাজি হয়নি, ওষুধ না নিয়ে ফিরেছিলাম। সুমিতের কথা ভেবে মনে একটা আশঙ্কা হল। গত মাসে সুমিতেরও এইরকম জ্বর হয়েছিল,বাঁচানো যায়নি তাকে। বোনের মায়াময় মুখটা দেখে রাগ হল অসীতদার উপর। কিন্তু আমি নিরুপায়, একজন ১২ বছরের ছেলে আর কিইবা করতে পারে।
      খেতে বসে হল আরেক কান্ড; এরকম শাক-ভাত বহুবার খেয়েছি, কই আগে তো কোনো দিনও বাবা এমন করেননি। রেগে ভাতে জল ঢেলে, আমাকে যা-ইচ্ছা বলে বেরিয়ে গেলেন।তবে রাগটা যে ঠিক কিসের বুঝলাম না, হয়তো আর্থিক অস্বচ্ছলতা। যাইহোক, সিগারেট এর গন্ধ আসার পর লক্ষ্য করলাম; উনি বাইরে পায়চারি করছেন। তারপর, আধখাওয়া সিগারেটটা ফেলে; গোয়ালঘর থেকে লাঠি নিয়ে অসীতদাকে অকথ্য গালিগালাজ করতে করতে সাইকেলে বেরোলেন। বুঝলাম, কিছু একটা অঘটন ঘটতে পারে; কিছুদুর পিছু নিয়ে আটকানোর চেষ্টা করলেও ব্যার্থ হয়ে ফিরে এলাম।
প্রায় দেড় ঘণ্টা পর বাবা এলেন ওষুধ নিয়ে। পরে জানতে পেরেছিলাম অসীতদার দোকানে ঝামেলা করে বাবা,ধারেই এনেছিলেন ওষুধগুলো।

গত পরশু হঠাৎ, দুজন অচেনা শহুরে লোক এসেছিলেন। মলিকে (আমাদের গাভী) নিয়ে আলোচনা করছিলেন, মলি কি কি পারে,বয়স ইত্যাদি।
     কাল আমরা মাঠে যাইনি। মলিকে ওরা নিয়ে গেছে; বোনের সাথে আমিও প্রাণপণে চেয়েছিলাম ওদের আটকাতে, মলিকে আটকাতে; মলিও হয়তো চেয়েছিল আমাদের সাথে থাকতে। যখন  মলিকে ওরা গাড়িতে তুলল, তখন দেখলাম মলিও কাঁদছে কিন্তু ওর এই আর্তনাদ শুনতে পায়নি ওই লোকগুলো, বাবা হয়তো‌ সব বুঝেও দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছিলেন পরিস্থিতিকে।
আজ দুদিন হল, বোনের জ্বর সেড়েছে। বোনের মান ভাঙাতে,বাবা কোথা থেকে একটা বেড়াল ছানাও এনেছেন। আমি এসেছি বাজারে; কারণ এরমধ্যে অমরেশ ডাক্তারবাবু একদিন এসে বোনকে দেখে বলেছেন খাওয়া দাওয়া ঠিক করতে হবে, এইবয়সে নাকি দরকার। আমি শুধু অপেক্ষা করছি, মলি হয়তো পথ চিনে ঠিক ফিরে আসবে।।

________

বন্ধহীনDonde viven las historias. Descúbrelo ahora