প্রথম পর্ব

35 0 0
                                    

- "বাড়িটা কিন্তু চমৎকার! বলো শম্পা?"
- "মন্দ নয়। তবে আমার একটাই আপত্তি, আজকালকার দিনে এত বিশাল অট্টালিকার মতো বাড়ি কে কেনে গো? এতটা বড় জায়গা....বাগান....ফোয়ারা....উফ্! কে মেন্টেইন করবে এত্তসব? আমার তো ভাবলেই মাথাটা ঝিমঝিম করছে।"
- "হাহা!" হাসিটা আর চেপে রাখতে পারলাম না, "আরে সে নাহয় ঝি-চাকর লাগিয়ে সব কাজ করিয়ে নেওয়া যাবে'খন। কিন্তু একটা কথা ভেবে দেখো, আজকের যুগে এইটা কয়েক কোটি টাকার প্রপার্টি। আর আমরা পেয়ে গেলাম মাত্র কুড়ি লক্ষ টাকায়....ভাবতে পারছ?"
- "সেখানেই তো আমার খটকা, মিস্টার সরকার এমন জলের দরে এই রাজপ্রাসাদের মতো বাড়িটা কেন বিক্রি করলেন বলো তো?"
- "ভদ্রলোক বিপত্নীক। তাঁর একমাত্র মেয়ে-জামাই বিয়ের পরে পাকাপাকি ভাবে এখানকার বাস উঠিয়ে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার পর উনি আর কদ্দিন যক্ষের ধনের মতো বাড়িখানা আগলাতেন? ভাগ্যিস আমার প্রোমোটার বন্ধুটার মারফৎ এই বাড়ির সন্ধান পেলাম!"
- "কে জানে বাবা!" সন্দিহান চোখে বাড়িটা জরিপ করতে-করতে শম্পা বলল, "সব ভাল হলেই ভাল।"

দেখেই বোঝা যায় যে বাড়িটা স্বাধীনতার বহু বছর আগেই বানানো হয়েছিল। শোনা যায়, ব্রিটিশ আমলে বাড়িটা ছিল গভার্নমেন্ট প্রপার্টি। তখনকার দিনে বাড়িটা "ইন্সপেকশান বাংলো" হিসেবে ব্যবহৃত হতো। স্বাধীনতার পর অনেক হাত ঘুরে আজ এই বাড়িটা আমার, অর্থাৎ ব্যাঙ্ক ম্যানেজার প্রতীক ঘোষের মালিকানাধীন। গতানুগতিক ব্রিটিশ স্থাপত্য, বাইরে বড় বাগান। আর সেই বাগানের ঠিক মাঝখানে শ্বেত পাথরের একটা ফোয়ারা....যদিও ফোয়ারার পরীর ডান হাতটা বহুকাল আগেই বেপাত্তা হয়ে গেছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বাগানটাও বেশ শ্রীহীন হয়ে পড়েছে। সত্যি, সরকার বুড়ো এই বাড়ি নিয়ে মোটেই কুলিয়ে উঠতে পারছিল না!

অবশ্য বাইরের তুলনায় বাড়ির ভিতরটা কিন্তু অনেকটাই পদের। বৈঠকখানার বড় ফায়ারপ্লেসটা আজও বহন করে চলেছে ইংরেজ আমলের সাহেবিয়ানা। তবে অন্যান্য আসবাবপত্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নজর কাড়ে বেডরুমের বড় গ্র্যান্ডফাদার ক্লকটা। কালচে-মেরুন ওয়ালনাট্ কাঠ দিয়ে তৈরি। উচ্চতায় প্রায় সাড়ে ছয় ফুট। পেন্ডুলাম আর ঘড়ির কাঁটাগুলো সম্ভবতঃ রূপোর উপর সোনার জল করা। জিনিসটা সত্যিই খাসা বটে! কোনও অজ্ঞাত কারণে সরকার বাবু বাড়ি ছাড়ার আগে জিনিসটা নিজের সাথে নিয়ে যাননি। শম্পা চিরকালের খুঁতখুঁতে, তবে গোটা বাড়ির মধ্যে শুধু এই একটিমাত্র জিনিসই ওর কিছুটা মনে ধরেছে। অদ্ভুত এক ব্যক্তিত্ব আছে ঘড়িটার মধ্যে। ওইটা যেন শুধু কাঠ-ধাতু ইত্যাদি দিয়ে গড়া কোনও জড় বস্তু নয়, জিনিসটার নিজস্ব একটা প্রাণ আছে। কাঠের শুষ্ক আবরণের তলায় কোথাও একখানা জীবন্ত হৃদয় ধুকপুক করছে। ঘড়িটা এত বছর ধরে এক নির্লিপ্ত দার্শনিকের মতো মানুষের সব কাণ্ডকারখানা নীরবে লক্ষ্য করে চলেছে। শুধু যেন কিছুক্ষণ পরপর মানুষের অফুরন্ত মূর্খামিগুলো প্রত্যক্ষ করতে-করতে একটা হতাশায় ভরা ধাতব দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ঘড়ির বুক ঠেলে:- ঢং ঢং ঢং!!

ডাকWhere stories live. Discover now