হাজী পীর

32 0 0
                                    

ওই দূরে ঝাপসা ঝাপসা যে গ্রামটা দেখা যাচ্ছে, মাঝে মাথা তুলে একটা গম্বুজ মতো, ওটি একটি দরগা। আর ওই গ্রাম ও দরগা দুটোর নামই 'হাজী পীর'। অর্থাৎ গ্রাম থেকে দূরে মরুভূমির মাঝে শুধুমাত্র একটি দরগা ঘিরে গড়ে উঠেছে একটি গ্রাম। পাকিস্তান সীমান্তের আগে এই অঞ্চলের শেষ গ্রাম। যেখানে পৌছতে আমাকে প্রায় ষাট কিমি মরুভূমি পাড়ি দিতে হয়েছে। এর পরে আর কোনো জনবসতি নেই। গ্রামের পরে কিছুটা ঘাসের জঙ্গল পেরিয়ে প্রায় ঝাড়া একশো কিমি লবণের মরুভূমি। শুনেছি সেই সাদা মরুভূমি অপূর্ব সুন্দর। যেখানে তিনশো ষাট ডিগ্রী আকাশ জমি মিলে একরঙা সাদা হয়ে যায়। আর সেই সাদা পৃথিবীর বুক চিরেই কোথাও একটা ভারত-পাক সীমান্ত। যেখানে পৌঁছানো কোনো সাধারণ মানুষের কম্ম নয়।তার ওপারে আছে পাকিস্তানের 'সিন্ধ' অঞ্চল। অর্থাৎ সিন্ধুর পারে গড়ে ওঠা সভ্যতা। যে 'সিন্ধু নদ' পেরিয়ে এককালে এসেছিল ভারতবর্ষের প্রথম মুসলিম সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন(?)। শাহাবুদ্দিন ঘোরী। আমি ইতিহাসে কাঁচা ও অজ্ঞ তাই সেসব ইতিহাসের কথা জানি না। তবে এই 'হাজী পীরে' বসে শুনলাম সেই ঘোরীর সৈন্যদলেরই এক প্রাক্তন সৈনিককে আজ ভারতভূমির এই গোপন কোণায় হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে পূজা শ্রদ্ধা চড়াচ্ছেন লাখো লাখো আপামর জনগন। ইতিহাসে শোনা যায় সেই ঘোরীর নাস্তানাবুদ অবস্থা হয়েছিল রাজপুত রাজাদের হাতে পরে। তার পৈতৃক প্রাণটি খোয়া গেছিল। আর সেই যুদ্ধ শেষে তারই এক প্রাক্তন সৈনিক নিজের বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছিলেন এই অঞ্চলেই গ্রামবাসী ও তাদের গবাদি পশুর সেবা করে। হয়ে উঠেছিলেন এই অঞ্চলের 'জিন্দা পীর'। পরবর্তীতে হজ করে ফিরে তার নাম হয় 'হাজী পীর'। আর আজ এখনো সেই নামেই পূজা পেয়ে আসছেন তিনি মরুভূমির এই এক কোণায় বসে। সারা কচ্ছ ও দূর দূরান্ত থেকে ভক্তরা দূর্গম পথ পেরিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন এই হাজী পীরের দরগায়। কত বিচিত্র এই ভারতভূমির ইতিহাস। প্রচলিত বিশ্বাসে আছে এখানে নাকি দান করলে সেই সম্পদ বহু গুণে বর্ধিত হয়ে ফিরে আসে দাতার কাছে। তাই দান ধ্যানের অভাব নেই কোনো হাজী পীরের দরবারে। আর নেই কোনো হিন্দু মুসলমান ভেদাভেদ তার ভক্তদের মাঝে। বলা বাহুল্য, গুজরাটের কড়া মন্দির কেন্দ্রিক হিন্দু জৈন ধার্মিক পটভূমিতে এ এক অনন্য ব্যাতিক্রম। আরো একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম হাজী পীরের দরগায়। এখানে শ্ৰদ্ধা জানাবার ভঙ্গি কোনো প্রচলিত ইসলামিক বা হিন্দু দেহ ভঙ্গিমায় নয়, বরং দুই হাতের মুঠো শক্ত করে বুড়ো আঙ্গুলটা খুলে বুকের দুই পাশে দুই হাত রেখে মানুষ মাথা ঝোঁকায় এই হাজী পীরের সমাধির সামনে। এর অর্থ বা উৎপত্তি কি আমার জানা নেই, তবে এই ভঙ্গিমার মধ্যে এক বজ্র কঠিন শক্তি ও একই সাথে নতজানু ভাবের বহিঃপ্রকাশ আছে।
আগের দিন 'ধলাভিরা' থেকে 'খাওড়া' এসে রাত কাটিয়ে, পরদিন রন উৎসবের 'ধরদো' হয়ে আমি প্রায় বিকেলে এসে পৌছাই এখানে। আসার পথ 'খাওড়া' থেকে ষাট কিমির ধু ধু মরুভূমি। মাঝে শুধু ধরদোর টেন্ট সিটি আর এক জায়গায় একটা দোকান। যার আশেপাশে কয়েকটা গ্রাম আছে। সেখানেও প্রায় এক অন্য জগৎ, যেন ভারতের সীমা পেরিয়ে প্রত্যন্ত পাকিস্তানের কোনো অঞ্চলে এসে পড়েছি। তখনও বুঝিনি আমি আসলে প্রবেশ করছি ভারতেরই 'সিন্ধ' অঞ্চলে। কারণ এই অঞ্চলেই এককালে ছিল সিন্ধু নদের অববাহিকা। যে নদ প্রায় দুইশো বছর আগের এক ভূমিকম্পে চলে গেছে আরো পশ্চিমে অধুনা পাকিস্তানে। সেই একমাত্র ও শেষ দোকান থেকে আরো প্রায় পনেরো কিমি কাঁটা ঝোপের জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে সরু পথ বেয়ে পথের শেষে এই হাজী পীর। পথে একটু ভুল চুক হলে প্রবল সম্ভাবনা বিএসএফ এর এলাকায় ঢুকে যাওয়ার। যার অর্থ নিশ্চিত গোলযোগ। দরগা এলাকায় পৌঁছাতেই সিন্ধের স্বাভাবিক লোকসংস্কৃতি দৃশ্যপট ছাপিয়ে দেখা দিল তথাকথিত মূলধারার মুসলিম সমাজের ছায়া। চারপাশে ভারতবর্ষের আর পাঁচটা মুসলিম এলাকার মতোই অবয়ব ও বেশ ভূষার মানুষ। লম্বা গোঁফহীন মেহেন্দি করা দাড়ি, পরনে পাঞ্জাবি। যেটা এতক্ষণ ছিল আবাল বৃদ্ধ নির্বিশেষে ট্রেডমার্ক গোঁফ ও শেরওয়ানির মতো পাজামা পাঞ্জাবি। আমি কয়েক বার এলাকায় চক্কর দিলাম জায়গাটার গন্ধ নেওয়ার জন্য। তারপর একটু খোলা জায়গা দেখে গিয়ে বসলাম এক চায়ের দোকানের পিছনের ঢাকা চত্বরে। জায়গাটা হাজী পীরের বিখ্যাত সরোবরের ঠিক সামনেই ও দরগায় প্রবেশপথের ঠিক কেন্দ্রস্থলে। যে সরোবর নাকি এই মরুভূমির মধ্যেও দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। সেখানে গিয়ে বসতেই কিছুক্ষনের মধ্যে আপন করে নিলো গ্রামের বহু মানুষ। তারা যারপরনাই খুশি কলকাতার মত এতদূর থেকে একজন দর্শন দিতে এসেছে তাদের দরগায়। সেই গল্প গাছায় কেটে গেল সন্ধে অবধি। আর আশ্চর্য ভাবে এত জমজমাট একটা দরগা অন্ধকার নামতেই সব কেমন নিঝুম হয়ে গেল। দোকানের ছেলেটি আমার চায়ের দাম নিতে অস্বীকার করলো। আমি ততক্ষনে ঠিক করে নিয়েছি এই ঢাকা জায়গাটাই আমার আজ রাতের আস্তানা। যদিও সে বললো সারা রাতে ডিস্টার্ব হবে অনেক। পুলিশ, কুকুর, মশা ইত্যাদি। সব শেষে জানালো আমার রাতের খাবারটা সেই দিয়ে যাবে বাড়ি থেকে। এলাকায় এত জমজমাট দরগা হলেও খাবারের দোকান নেই কোনো। কিছুক্ষণে তার দোকান বন্ধ হয়ে গেল। সেই ছেলে কাজ শেষ করে গুছিয়ে বসলো সরোবরের দিকে মুখ করে, আর আমার খাবার এলো তার বাড়ি থেকে। আলুর তরকারি আর কয়েকটি রুটি। আগে জিগেস করেছিল একবার নন-ভেজ আমার চলবে কিনা। আমি নিরামিষাশী হওয়ায় বোধ হয় আলাদা করে বানিয়ে নিয়ে এলো। আমি সদ্য পাওয়া খাবারের সদ্ব্যবহার করে গিয়ে বসলাম তার পাশে। এবার শুরু হলো আমাদের কথাবার্তা। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার কথায় হারিয়ে গেলাম অন্য এক জগতে। ধীরে ধীরে উন্মোচিত হল আমার এতক্ষণ পাওয়া আতিথেয়তা আর সদ্য সদ্য পাওয়া গরম খাবারের রহস্য।
আমার সামনে যে বসে আছে, সে আশেপাশের আট গ্রামের মধ্যে সবথেকে শিক্ষিত ব্যক্তি। একজন গ্রাজুয়েট। এ এলাকায় ক্লাস নাইন টেনের বেশি কেউ শিক্ষিত হয় না। তার প্রয়োজনও পড়ে না এই ধূধূ মরুভূমির জীবনে। আমাদের স্কুল কলেজে যা শেখানো হয় তা এই জীবনে কোন কাজে আসে না। আর আমি যে দোকানটায় বসে আছি, সেটা ছিল তার বাবার হোটেল। যা আজ পরিণত হয়েছে একটি চায়ের দোকানে। আর আমার সামনে যে খাবারের থালাটা ছিল একটু আগে, সে ট্র্যাডিশন আজকের নয়, এই ছেলের পিতামহ পেরিয়ে প্রপিতামহের সময় থেকে চলে আসছে। এই খাবারের থালা আসার আদেশটিও তার স্বর্গগত পিতার থেকে আসা। তার পিতা মারা যাওয়ার আগে তাকে বারবার বলে গেছিলেন,
- খায়াল রাখনা ইয়ে জাগা সে কৈ ভুখা বাপাস নাহি জানা চাহিয়ে! দরগাকে আশ পাশ কৈ আদমি ভুখা নাহি রাহনা চাহিয়ে।
কারণ তার ধর্মে আদেশ আছে, এমনকি তার প্রতিবেশীও যদি অভুক্ত থাকে তবে তাকে মৃত্যুর পরে জবাবদিহি করতে হবে। আর অনাহুত অতিথিকে যে খাদ্যটি দেওয়া হচ্ছে, তার মালিক গৃহকর্তা নয়। সেই অতিথি আসার চল্লিশ দিন আগে নাকি বিধাতা তার খাদ্য ওই কর্তার গৃহে লিখে দিয়েছেন। অতিথি তার ভাগটুকুই ভক্ষণ করছেন মাত্র। এসব ধর্মের গভীর তত্ত্বকথা আমি জানি না, কিন্তু এইসব হতদরিদ্র মানুষদের জীবনে ধর্ম আর দরগার মাহাত্ম যেমন করে মানুষের প্রতি প্রেম স্থাপন করে দিয়েছে তা দেখে আমি বাকহীন। 
আমরা কথা বলছিলাম বহু বিবিধ বিষয়ে। এই এলাকায় জল নেই, কৃষিকার্য নেই মানুষের হাতে কোনো কাজ নেই। জল আসে সপ্তাহে একবার জলের গাড়িতে করে। সেই জল পয়সা দিয়ে কিনে ভরে রাখতে হয় ট্যাংক। সেই জলেই সব কাজকর্ম। পানীয় জল থেকে রান্নাবান্না থেকে শৌচ। পেশা বলতে কিছু মানুষের কিছু মহিষ আছে, সেই পশুপালন, আর কিছু মানুষ কাঁটা ঝোপঝাড় পুড়িয়ে একপ্রকার কয়লা বানায়, সেটাই মূখ্য পেশা মানুষের। আর বাকিরা এদিক ওদিক বা বাইরে জন মজুরি। 'হাজী পীর' গ্রামটায় তবুও দর্শনার্থী আছে, কিছু দোকান আছে, ব্যবসা আছে, বাকি গ্রামগুলির কথা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। কেমন করে বেঁচে আছে এরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই নিঃস্ব চরাচরে। যেখানে দিন আনা দিন খাওয়াটাই একমাত্র বাস্তবতা। তার বাইরে জীবন হতে পারে সেটাই অকল্পনীয়। আমি জিগেস করেছিলাম,
- তোমাদের ওপারে দেশভাগের আগের আত্মীয় স্বজন নেই? দেশ ভাগ হওয়ার পর যোগাযোগ রাখো কিভাবে?
উত্তরে জানলাম, কোনো যোগাযোগ নেই। শেষ একবার কথা হয়েছিল তাও বছর পাঁচেক আগে। তবে তারাও ভালোই আছে পাকিস্তানে, সুখে আছে। এরা ভিসা নিয়ে যে যাবে তার জন্যেও দিল্লি যেতে হবে ভিসা করতে। সূদুর ওয়াঘা বা রাজস্থানের মুনাবাও সীমান্ত দিয়ে পাকিস্তান প্রবেশ করতে হবে। সে সব বড় ঝামেলার কাজ। এই দিন আনা দিন খাওয়ার জীবনে এইসব মানুষদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে এর পিতামহ গিয়েছিলেন শেষবার পাকিস্তানে আত্মীয়দের সাথে দেখা করতে। সে নাকি এক কান্ড হয়েছিল তখন। এক ট্রাক ভরে চল্লিশ পঞ্চাশ জন ঢোল বাজিয়ে এসেছিল অতিথিকে স্বাগত জানাতে। এমন অতিথি আপ্যায়নের কথা আমরা ভাবতেও পারি না। তিনি বেশ কিছু দিন পাকিস্তানে থেকে আমিষ খেয়ে খেয়ে বিরক্ত হয়ে শেষে ওখানকার মানুষকে শিখিয়ে এসেছিলেন পালং শাকের ব্যবহার।
এমন বহু গল্পে রাত গড়িয়ে গভীর হয়ে গেল। হামিদ চলে গেল ঘরে। সে যাওয়ার কিছু আগে মাত্র জানতে পারলাম তার নাম এতক্ষণ পর। আমি শুয়ে পড়লাম ওই ঢাকা জায়গাটিতেই নিজের স্লিপিং ব্যাগ ম্যাট খুলে। অনেক গভীর রাতে প্রায় দুটো নাগাদ এলো পুলিশের টহলদারী গাড়ি। আমার ঘুম ভাঙিয়ে চললো জেরা ও পরিচয় পত্র পরীক্ষা। প্রায় আধ ঘন্টা জেরার শেষে পরীক্ষা পাশ করলাম। কাল আমার গন্তব্যে চলে যাওয়ার অনুমতি মিললো এই শর্তে যে আমি যাওয়ার পথে চোদ্দ কিমি দূরের 'নারা' গ্রামের থানায় নাম লিখিয়ে যাবো। পুলিশ চলে যাওয়ার পরেও চললো কুকুরদের চিৎকার অত্যাচার। সেটাও থামার পরে মশার আক্রমণ। এভাবেই কোনোমতে রাতটি পার করে দিলাম এই অনন্য গ্রাম 'হাজী পীর' এ।

You've reached the end of published parts.

⏰ Last updated: Nov 14, 2022 ⏰

Add this story to your Library to get notified about new parts!

ভারত-পাক মরু সীমা অভিযানWhere stories live. Discover now