পরশু রামগড় থেকে পঞ্চাশ কিমি গভীর মরুভূমি আর বালিয়াড়ির রাস্তা পাড়ি দিয়ে এসে পৌঁছেছি তানোট মাতা মন্দির। ভারতবর্ষের শেষ সীমায় মরুভুমির গভীরে বর্ডার থেকে কুড়ি কিমি দূরে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা এক মন্দির। (এর পরে আছে কিছু মাত্র ছোট ছোট গ্রাম যেগুলি এককালে পাকিস্তানের অন্তর্গত ছিল, অধুনা ভারতের সীমায়। সেখানে স্থানীয় গ্রামবাসী বাদে সাধারণ ভারতবাসীর প্রবেশ নিষেধ) ইতিহাস সূত্রে এই মন্দিরের দেবী বালচিস্তানের বিখ্যাত হিংলাজ মাতার অংশ বলে বিশ্বাস। কোনো কালে এখানকার এক গ্রামবাসীর প্রার্থনায় খুশি হয়ে তার ঘরে দেবী জন্ম নিয়েছিলেন সাত কন্যা ও এক পুত্রের আকার ধারণ করে। তানোট মাতা সেই সাত কন্যারই এক কন্যা। বাকিরাও আজও নিশ্চই কোথাও না কোথাও পূজিত হচ্ছেন এই মরুভূমির কোনো না কোনো বিচ্ছিন্ন অজানা মন্দিরে, আমার জানা নেই। তবে এখান থেকে পাঁচ কিমি দূরে এই দেবীর আরেক সহোদরা ভগিনী 'ঘন্টিয়ালি মাতা'র মন্দির আছে যার দেখা আমি পেয়েছি। তানোট মাতা মন্দিরের বর্তমান মূর্তিটি শোনা যায় প্রায় সহস্রাধিক বর্ষ পুরাতন, রাজপুত রাজাদের প্রতিষ্ঠা করা। যদিও বর্তমানে এই মন্দিরের সম্পূর্ণ দায়িত্ব বি এস এফ এর হাতে। মন্দিরের নিত্য পূজা-আরতি, সেবা থেকে দেখভাল সবই করেন গ্রামবাসীর পরিবর্তে বিএসএফ জওয়ানরাই। এ এক অনন্য নিদর্শন যেখানে রোজ সকালে সন্ধে বিএসএফ জওয়ানরা বন্দুক ছেড়ে ঢাক, ঢোল, কাড়া নাকাড়া, ধুনুচি নিয়ে অতি ভক্তি সহকারে পূজায় মেতে ওঠেন। এমনকি মন্দিরের যে পূজারীটি প্রতিদিন সুকণ্ঠে ছন্দময় মন্ত্র উচ্চারণ করে আরতি পূজা করেন তিনিও বিএসএফএরই এক ব্রাহ্মণ জওয়ান। হয়তো কোনোদিন যুদ্ধ এলে তাকে পূজা ছেড়ে দৌড়াতে হবে যুদ্ধক্ষেত্রেও। স্থানীয়দের পাশাপাশি সৈনিকদের এই দেবীর প্রতি ভক্তি অকারণ নয়। বলা হয় '৬৫ এর যুদ্ধে পাকিস্তানের ছোঁড়া তিন হাজার বোমার একটাও ফাটেনি এই অঞ্চলে। তারপরে '৭১ এর যুদ্ধেও এই তানোট গ্রাম আক্রমণের চেষ্টা হয়। সেখানেও নাকি শত্রুপক্ষের ট্যাংক দেবীর মহিমায় বালিতে ডুবে যায়। ফলে দেবী হয়ে উঠেছেন স্থানীয় মানুষের কাছে যুদ্ধের হাত থেকে গ্রামের রক্ষাকর্ত্রী আর সৈনিকদের কাছে বহিঃশত্রুর হাত থেকে নিরাপত্তার যুদ্ধের দেবী। সেই সব না ফাটা বোমা গ্রেনেড সব সাজিয়ে রাখা হয়েছে এখন মন্দিরের ভিতরে, একটা আস্ত মন্দির পরিণত হয়েছে ধর্ম বিশ্বাসের ওয়ার মেমোরিয়াল মিউজিয়ামে।
তানোট মাতা ছাড়াও আরো বেশ কিছু স্থানীয় মরুভূমির দেব দেবী আছেন যারা এই অসীম বিস্তৃত মরুভূমির চরম বিচ্ছিন্ন জনজীবন নিয়ন্ত্রণ করেন। যেমন নাখত বান্না, রামদেওড়া, কর্নী মাতা, ঘন্টিয়ালি প্রমুখ। তবে এদের সবার মাঝে তানোট মাতার প্রভাব ও দাপট এমনই মুখ্য যে, এই পথে আমি যখন আসছিলাম, এমনকি শত শত কিমি দূর থেকেও আমাকে স্থানীয় গ্রামবাসীদের শ্রদ্ধা ও ভক্তির পাত্র হতে হয়েছে শুধু এই কারণে যে আমি একা একটি সাইকেল চেপে হাজার হাজার কিমি দূর থেকে চলে আসছি দেবীর মন্দিরের উদ্দেশ্যে। রাস্তার আচমকা পথিক, দোকানি আমার হাতে একটি দশ, কুড়ি টাকার নোট ধরিয়ে দিয়েছেন নিজেদের নামটি বলে। যেন আমি ঐ টাকাটি তাদের নামে মন্দিরে চড়িয়ে দিই। আমার ভাগ্যে কিঞ্চিৎ অযাচিত অনাকাঙ্খিত সেবা ও সাহায্যই জুটেছে। বিশ্বাস ও ভক্তির এমন দাপট আমি আমার পরিব্রাজক জীবনে খুব কমই দেখেছি।
আমি নিজে আস্তিক বা নাস্তিক কোনোটাই হয়তো নই, বা হয়তো নিজের সুবিধামত সময় সুযোগ বুঝে দুটির চরিত্রেই সমান দক্ষতায় অভিনয়কারী। বরং আমি এই দুই পক্ষের মধ্যবর্তী মন্দিরের চাতালে শুয়ে থাকা ভবঘুরে নীরব দর্শক। সেই দর্শক হয়ে দেখছি কেমন করে রাষ্ট্রের সীমা সুরক্ষা স্থানীয় লোকধর্ম বিশ্বাসের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। মরুভূমির গভীরে ঢুকতে ঢুকতে এই পর্য্যন্ত না পৌঁছালে ভারতভূমীর গোপন থেকে গোপনতর নিভৃত এই সব সমাজের এই সমস্ত গলি ঘুঁজি দিক আমার অদেখাই থেকে যেত। তাই দেবীকে প্রণামের পাশাপাশি আমি প্রণাম জানাই আমার সাইকেলের চাকাদুটিকে।
এর সাথে শেষ হলো আমার প্রথম বড় চ্যালেঞ্জ, বিকমপুর থেকে তানোট মাতা মন্দিরের ২৫০ কিমি মরুভূমির শূন্যতার পথ। এখান থেকে আরো অন্তত চারটি বড় চ্যালেঞ্জ আছে যার প্রতিটি ১৫০-২৫০ কিমি লম্বা। যার মাঝে কোনো প্রকার দোকান বাজার বা জল, খাবার পাওয়ার জায়গা নেই। সামনের কয়েকদিন শুধু মরুভূমির যাযাবর ছাগল ভেড়া চড়ানো রাখালরা আমার একমাত্র সঙ্গী হবে যদি অবশ্য তাদের সাথে দেখা হয়। আমার আর ভয় করছে না সত্যি, এই মরুভুমির wilderness একা পার করার আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। কিন্তু মনোবল ভেঙে যাচ্ছে। নিজেকে প্রশ্ন করছি কেন এই মরুভূমির শূন্যতার শয়ে শয়ে কিমি পথ একা সাইকেল চালাবার চ্যালেঞ্জ নিচ্ছি। এইসব রাস্তা চালাতে শারীরিক দক্ষতা শক্তি তো লাগেই, তবে তার থেকে বেশি লাগে ইস্পাত কঠিন মানসিক শক্তি। কঠিন কঠিন! এই মরুভূমি যেন অসীম! কোনোদিন শেষ হওয়ার নয়। এর পর আবার আছে কচ্ছের রন! যেটা এখানকার থেকে আরো কঠিন হবে। এখানে তবুও দূরে দূরে হলেও নির্দিষ্ট দূরত্বে জলের যোগান আছে অপ্রতুল। ওখানে তাও থাকবে না।আমি অর্ঘ্য মন্ডল রাজস্থান ও গুজরাটের ভারত পাক মরু সীমা বরাবর এক সাইকেল অভিযান চলা কালীন জড়ো করছি এইসব স্থানীয় জনজীবনের গোপন অদেখা কাহিনী সমগ্র। এই অভিযান একটি চরম কঠিন দুর্গম দুরূহ কর্মকান্ড হওয়ার পাশাপাশি এতে প্রয়োজন যথেষ্ট অর্থমূল্যেরও। তাই এমন কাহিনী আরো জড়ো করতে অনুপ্রেরণা স্বরূপ নিচের ঠিকানায় নূন্যতম ৫০ টাকা থেকে যার যেমন খুশি অনুদান পাঠাতে পারেন।
Gpay number : 9051680606
UPI ID : arghyamondal51@okicici
VOUS LISEZ
ভারত-পাক মরু সীমা অভিযান
Non-Fiction২০২২ এর সেপ্টেম্বরের শেষে হিমাচলের কুল্লু জেলা থেকে শুরু করে হিমাচলের অজানা অনালচিত কিছু অংশের ওপর দিয়ে পাঞ্জাবের ভারত-পাক সীমান্ত অবধি পৌঁছে, সেখান থেকে ভারতের সীমান্ত বরাবর ভারতের সমুদ্রসীমার পশ্চিমতম কোণা, গুজরাটের লাখপত অবধি পৌঁছনোর চেষ্টা করি...