দুই

75 1 0
                                    

"সেদিন ভার্সিটিতে প্রথম ক্লাস ছিলো। স্বপ্নের ঢাকা ভার্সিটি। আমাদের অজপাড়া গাঁ থেকে আমিই প্রথম ভার্সিটি পা রাখলাম। ক্লাসে ঢুকতেই ধাক্কা মতন খেলাম একটা। বিশাল ক্লাসরুম। এত্তবড় ক্লাসরুম আমার জীবনে প্রথম দেখলাম। পাড়া গাঁ গুলোতে স্কুল কলেজের বড় বড় রুম মানে যায়গার অপচয়। কোথাও কোথাও রুমই নেই। টিন দিয়ে বানানো ছাপড়া ঘরের মত। সেখানে এত্ত বড় ক্লাসরুম আমার জন্য রীতিমত অষ্টম আশ্চর্য। রুমে ঢুকেই সামনের সারির একদম কোণার একটা বেঞ্চে বসলাম। পুরো ক্লাস জুরে অনেক ছেলে মেয়ে। কেউবা মুখ গোমড়া করে বসে আছে দেখলে মনে হবে সকালে বাসা থেকে নাস্তার জায়গায় বকা খেয়ে এসেছে। আবার কেউবা ফোন নিয়ে ব্যাস্ত। কয়েকজন আবার জটলা করে কি নিয়ে যেনো গল্প করছে। আর সর্বশেষ দলটি আমার মত এদিক সেদিক তাকাচ্ছে।কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা। হুট করে কোনো অপরিচিত আত্নীয়ের বাসায় বেড়াতে গেলে যেমন হয় ঠিক তেমন । ঘড়ির কাটা, দেয়ালে ছুটাছুটি করা লেজবিহীন একটা টিকটিকি, আশেপাশের ছেলে মেয়ে এগুলো দেখতে দেখতে স্যার চলে আসলো। একে একে রোল কল শেষ করে জানতে চাইলেন কেমন লাগছে আমাদের, কে কোন জেলা থেকে এসেছি এইসব হাবিজাবি। প্রথম দিন দেখে তেমন কিছু পড়া হলোনা। সময়ের আগেই স্যার ছুটি দিয়ে দিলেন.। ক্লাস থেকে বের হয়ে বাসায় যাওয়ার জন্য বের হলাম।

-এই ছেলে এই....এই যে নীল শার্ট। হ্যাঁ তুমি ই। দাঁড়াও....

পিছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখি একটা মেয়ে ডাকছে। কালো জিন্স সাথে অফ হোয়াইট টপস, লম্বা চুল, সামান্য গোলগাল মুখ আর চোখে চশমা। দাঁতগুলো ধবধবে সাদা। যেকোনো টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনে সহজেই মানিয়ে যায় এই মেয়ে। এসেই বলল-

-তোমার মানিব্যাগটা কই? বের করো তো..

কি বলে এই মেয়ে?! মানিব্যাগ?!! মহিলা মাস্তান না তো আবার? চেহারা অবশ্য কিছুটা মাস্তান মাস্তান টাইপ। নাকি সিনিয়র আপু? র‍্যাগ ট্যাগ দিবে আবার?? ভয়ে ভয়ে মানিব্যাগের জন্য পকেটে হাত দিতেই দেখি মানিব্যাগ নেই। পকেটমার হলো নাকি আবার?? এখন?! এখনো পুরো মাস বাকি। সারামাসের টাকা মানিব্যাগে। এখন কিভাবে চলবে সে?? টাকাই বা চাইবে কিভাবে বাবার কাছে। এত সামর্থ্য নেই তার যে মাসে দুইবার টাকা পাঠাবে। একবারের টাকা পাঠাতেই অবস্থা কাহিল তার।

-নেই মানিব্যাগ। পাচ্ছিনা। পকেটমার হয়েছে মনে হয়।
-পকেটমার তাইনা?? সামান্য একটা মানিব্যাগই সামলাতে পারোনা বউ বাচ্চা কেমনে সামলাবে পরে?? এই যে নাও তোমার মানিব্যাগ। ক্লাসে যেখানে বসেছিলে সেখানে পরে ছিলো। ভাগ্যিস তোমার পিছনের সিটে বসেছিলাম আজ।

মেয়েটাকে এখন আর মাস্তান মাস্তান লাগছেনা। কৃতজ্ঞতায় কদমবুসি করতে ইচ্ছে করছে। কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,

-থ্যাংকু। তুমি যে আমার কত্তবড় উপকার করলে বলে বোঝাতে পারবনা।
-হইছে। ঢং বাদ দিয়ে এখন চলো আমার সাথে।
-কই যাবো?!
-বারে...! এত্তবড় উপকার করলাম আর কিছু খাওয়াবানা? ফলো মি...

চুপচাপ ওর পিছনে হাঁটা শুরু করলাম। মনে মনে ভাবছি না জানি কতগুলো টাকা চলে যায় আবার। কি কামে যে অত থ্যাংকু দিলাম।আসাই ভুল। মানিব্যাগ নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে আসা উচিৎ ছিলো।

-দশ টাকা দাও তো।
-দশ টাকা?
-হ্যাঁ...চকো চকো কিনবো..। দুইটা। কেনো আরো কিছু নিবো নাকি?

আরো একবার কৃতজ্ঞতায় কদমবুসি করতে ইচ্ছা হলো..আবারো আবেগ কন্ট্রোল করে বললাম,

-না না..সেটা না.।আচ্ছা নাও..ওহহো..তোমার নামই তো জানা হলো না..। কি নাম তোমার?
-তিশা। তুমি?
-আমি অয়ন। নাইস টু মিট ইউ তিশা ^_^
-নাইস টু মিট ইউ টু। আচ্ছা শুনো আমার একটু কাজ আছে আজ। যাই এখন। পরে কথা হবে আবার। টাটা..আর মানিব্যাগ সাবধানে রেখো কিন্তু। বুঝছ?

বলেই যেভাবে ঝড়ের গতিতে এসেছিলো ঠিক সেভাবেই চলে গেলো। যেন একটা টর্নেডো। মুহূর্তেই সব তথনছ করে দিয়ে ফুড়ুৎ। এভাবে প্রতিদিন দেখা হতে লাগলো ওর সাথে কোনো না কোনো বাহানায়। আস্তে আস্তে অনেক গভীর হতে থাকলো আমাদের সম্পর্ক। কিভাবে কিভাবে যেন ও আমাকে গ্রাম্য ভূত থেকে পোশাকে-আশাকে, ব্যাবহারে, আচরণ সব দিক থেকেই শহরে বাস করা আর দশটা ছেলের মত করে তুলল।আমি গান শুনতে ভালোবাসতাম বলে আমার জন্মদিনে ও একটা আইপড গিফট করেছিলো। সারাদিন গান শুনতাম আমরা। হেডফোনের এক মাথা থাকতো ওর কানে, আর অন্য মাথা আমার কানে। ভালোই কাটছিলো দিনগুলো আমাদের। কথায় আছে না মানুষের কপালের সুখ বেশি দিন সয় না। আমাদেরও তাই হলো......"
এইটুক বলে থামলো সে। ত্রয়ী অবাক হয়ে দেখলো লোকটির চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে একদম। যেনো রাগে ফুসছে...। শিশুসুলভ চঞ্চলতার লেশমাত্র নেই এখন তার মধ্যে..।ত্রয়ীর ভয় ভয় করতে লাগলো..। কিন্তু সে সবটা না শুনে যাবেনা...পেয়ে বসেছে গল্পটা তাকে...।

শেষ বিকেলের কয়েকটি ফুল ও অন্যান্যWhere stories live. Discover now