এক ফালি রোদ্দুর দিলাম তোমায়

71 1 0
                                    

চৈত্রের প্রায় শেষ ভাগ চলছে। কোথাও কোথাও রোদের ঝাঁঝ এত তীব্র যে একদম পুড়িয়ে দিচ্ছে। রোদ তো নয় যেন আগুন। জ্যেষ্ঠ মাসে কী হবে ভেবে কান্না আসছে। এমন এক সংকট জনক পরিবেশ পরিস্থিতিতে বিয়ে বাড়ির নেমতন্ন এল কোন গ্রাম থেকে। খুব নিকট আত্মীয় নাকি। কী সব লতায় পাতায় মামা হয়। মামা এখনও আইবুড়ো? আমার আঠারো হয়ে গেল। না না জোরে বলিনি। তাহলে মাথাটা থাকত না। এতদিন কান্না আসি আসি করছিল কিন্তু কার্ড দেখে কেঁদে ফেললাম। কারণ রাতে আমি দুটো ফ্যান ছাড়া ঘুমোতে পারি না। আমার গরম লাগে বেশি। সেখানে কারেন্ট আছে কিনা কে জানে।থাকলেও গাঁ ঘরে কারেন্টের থেকে বেশি থাকে পাওয়ার কাট।নেট পাব না। কারও সাথে কথা হবে না। আমি কাঁদো কাঁদো হয়ে মাকে ওরা নিমন্ত্রণ করে চলে যাওয়ার পর বললাম- মা যাবে?

- বা রে। এত দূর থেকে বলতে এল যাব না? যাব।
- বাবা গেলে হবে না। যাবে , দেবে , খাবে , চলে আসবে।
- অমন বলিস না। আমার নিজের না হোক খুব আপন ভাই। যাব।
- কদিন থাকবে?
- কদিন থাকব বল্।
- আমি যাব না।
- সবাই যাব। তোর পরীক্ষা হয়ে যাচ্ছে। সেই ছোটোতে গিয়েছিলি।
- আমি এখানে থাকব।
- কোথায়?
- ছোটো মামুর বাড়ি।
- সব্বাই যাচ্ছি।
- ছোটির তো টিউশন আছে।
- কয়েকটা রাত। বিরাট তো পড়াশোনা করবি।
আমি এবার সত্যি কেঁদে বলে ফেললাম- খারাপ কথা বলতে নেই। আমার কী হবে?

আমার বোন বড় ঠোঁটকাটা। ডাইরেক্ট বলে দিল - ওখানে সাঁতার শিখবি। গ্রামের জলটা ভারী।
পূর্বকথা একটু বলা আবশ্যক।আমি আমার এক বন্ধুর কাছে সাঁতার সম্বন্ধে শুনে মানে উপকারিতা শুনে সাঁতার শিখতে চেয়েছিলাম। আমি জল বড় ভালোবাসি।মাকে বলেছিলাম। মাকে কিছু বলার আগেই আমার থেকে তিন বছরের ছোটো ছোটি বলল- এখানে শিখিস না। সুইমিং পুলের জল হালকা হয়। তুই জলে নামলে জল ডাঙায় উঠে যাবে। ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
- জল ডাঙায় উঠবে মানে?
- আরে বাবা আর্কিমিডিসের সূত্র পড়িসনি। ভুলে গেছিস? কাকের গল্পটা তো ভুলিসনি। হালকা জিনিস উপরে উঠে যায়। পাথর নীচে জল উপরে।
- আমি এত ভারী?
- সন্দেহ আছে?
রাগে দুদিন জোর ডায়েট করেছিলাম। ফলস্বরূপ দুদিন পর বেশি খেয়ে ষাট থেকে একষট্টি করে আবার ছোটির হাসির পাত্রী হয়েছিলাম।
সেই এক বছর পুরানো ঘটনা।
যাইহোক মূলপর্বে ফিরি। অনেকের অনেক কথা শুনে শেষ পর্যন্ত যাওয়াটাই ফাইনাল হল ।
যাচ্ছি আমি, ছোটি , মা ( বাবা বিয়ের দিন যাবে), তিন মামা, তাদের মামীরা মানে আমার মামীরা আর তাদের এক দুই দুই করে পাঁচ পুত্র কন্যা।বিয়ের কয়েক দিন আগে সেই লতা মামার বিয়েতে যাবার জন্য রওনা হলাম।
- এ কী! এত অজ গাঁ। গ্রাম স্নিগ্ধ, সতেজ, শ্যামল, সুন্দর - অনেক বিশেষণে বিশেষায়িত। তবে অন্য ঋতুতে গ্রীষ্মকালে নৈব নৈব চ। এসে জানলাম আমার সন্দেহ অমূলক নয়। এখানে একবার লাইন চলে গেলে আসতে ভুলে যায়। বিয়েবাড়িতে কাঁদতে নেই। অমঙ্গল। নইলে.....
আমার লতা মামা মাস্টার। বেশ কমবয়সীই দেখলাম। দেখতেও ভাল। বউটির ছবি দেখলাম। কলেজে পড়ে। আমার থেকে এক বছর বড়।
- পুরো সিনেমার হিরোইন যে।
- তোর মত অত অত খাই খাই করে না।
- ছোটি!
আমার থেকে সব ভাই বোনই ছোটো। হেসে উঠল।
ওদের বাড়িটা দারুণ।ছবির মতন। মাঝখানে বিরাট আঙিনা। আঙিনার চারদিকে পাঁচটি ছোটো টোটো ঘর। দূরে একটি রান্নাঘর। পেছনে বড় গোয়াল আছে। গোলা , বাগানবাড়ি, ঘামারবাড়ি সব আছে। একটা একেবারে বাড়ি সংলগ্ন পুকুর। চারপাশের গাছের জন্য জলটাতে ঘন সবুজ ছায়া পড়েছে।পুকুরটার পাড়ে পাড়ে খেজুর গাছে ভর্তি। আর নাম না জানা কত গাছ যে আছে।তেমনি পাখির কূজন। কিন্তু ঐ যে বললাম অন্য সময় ভাল।গ্রীষ্মকালে না। ঘরে এত পায়রা। এক মিনিট বিরতি নেই।
- এত পায়রা কেন? ঘর নোংরা হচ্ছে । তেমনি আওয়াজ।
এক মাসি হেসে বলে উঠল- পায়রা লক্ষী। যে বাড়িতে সুখ নেই সেই বাড়িতে যায় না।
- খেতে পেলেই আসবে। সুখ অসুখ।
লতা মামা ( ভাল নাম আছে। লতায় পাতায় সম্পর্ক বলে লতা মামা বলি। সামনেই বলি) বলল- গ্রীষ্মের অলস, নিস্তব্ধ দুপুরে রোদের ঝাঁঝে কাঁচা পথে একটা রোদপোড়া গন্ধ পাওয়া যায়। হালকা হাওয়ায় গাছের পাতা সরসর করে সেই সময় ঘুঘু আর পায়রার ডাক দারুণ লাগে।
- পোড়া গন্ধ খারাপ হয়। আর রোদে পোড়া গন্ধ বলেও যে গন্ধ আছে সাত জন্মে শুনিনি।
- সাত জন্মের কথা তোর মনে আছে নাকি?আর শহরে এটা নেই। থাকলেও খোঁজার সময় নেই।
মামা বলেই জোরে হেসে ফেলল। বুঝলাম মামীমার এক পাগলের সাথে বিয়ে হচ্ছে। বেচারা মিষ্টি মামীটা আমার!
আর রাতের দুঃখের কথা কী বলব। তিনটে গামছা ভিজিয়ে জড়িয়ে জল ঢেলে ঢেলে ঠান্ডা করা মেঝেতে শুই। দুদিন রাতে কারেন্ট যায়নি। ভগবানের কাছে রোজ আমি প্রার্থনা করছি যেন রাতে লাইন না যায়। আমার প্রার্থনা শুনল না। তিন দিনের দিন রাতে নটা থেকে আর লাইন নেই। আমার চোখের জল বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে এল। লতা মামা বলল -" আজ পূর্ণিমা। চাঁদের আলোয় চারদিক ভেসে যাচ্ছে। হাওয়াও দিচ্ছে ভাল। সবাই দাওয়াতে শোব।"
সবাই রাজিও হয়ে গেল। পূর্ণিমা রাত। চাঁদটা কত্ত বড় লাগছে। আমাদের বাড়িতেও এমনই চাঁদ ওঠে নিশ্চয়ই। কই কখনও তো খেয়াল করিনি। লাইন নেই। চাঁদের মিষ্টি আলোয় চারদিক ভেসে যাচ্ছে। লতা মামা বলল একে নাকি জোছনা স্নান বলে। সবাই জড়ো হয়েছি। হ্যারিকেন সব নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। অবশ্য দরকারও বিশেষ নেই।
লতা মামা বলল - প্রতি পূর্ণিমায় জোছনা স্নান করা নাকি জরুরি। কোনো কৃত্রিম আলো থাকবে না। কারণ ঈশ্বরের জিনিস আমাদের থেকে অনেক বেশি সুন্দর।বুঝলি?
- বুঝলাম মামীমার বদ্ধ উন্মাদের সাথেই বিয়ে হচ্ছে।
সবাই হেসে উঠল। সবাই। ভাই বোনরা মামা মামীরা মা সব্বাই। আমার ছোটোমামুর এগারো মাসের ছেলেটা কিছু বুঝতে না পেরেই সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছে আর কী মিষ্টি করে হাসছে। চারিদিক জোছনায় ভেসে যাচ্ছে। গাছের পাতা বাতাসে শিরশির শব্দ করছে। এমন সময় ওদের হাসিটা বোঝাতে পারব না একটা অপার্থিব পুলক ভরে দিল মনটা। একটা অন্য রকম স্নিগ্ধ আনন্দ। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। এত অপূর্ব মায়াময় রাতও পৃথিবীতে নামে! এর আগেও নেমেছিল কখনও?
হালকা হাওয়া দিচ্ছে। মাঝে মাঝে নয় ঘন ঘন। হাওয়া দিচ্ছেই। একটা খুব মিষ্টি ফুলের বাস আসছে। বাতাসটা হালকা গন্ধে ভরে রয়েছে। কী ফুল কে জানে। নিশাচর পাখিরা মাঝে মাঝে ডেকে উঠছে। খুব দূর আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। গ্রামের সবাই নিদ্রামগ্ন। আমাদের বেশিরভাগ ঘুমিয়ে পড়েছে। কেউ কেউ গুণগুণ গল্প করছে। আমার ঘুম আসছে না। তখনের হাসিটা আমার ভেতর নাড়িয়ে দিয়েছে। আমি রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখনো কখনো চোখে জল চলে আসছে। মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে চাঁদ চলছে। ছোটোবেলায় এ নিয়ে কত তর্ক করেছি। তবু বুঝতাম না। আস্তে আস্তে ভেসে বেড়াচ্ছে। ছোটোবেলায় কত আপনজন ছিল। এখন সবাই কেমন হারিয়ে গেছে। কারও বিয়ে হয়ে গেছে তো কেউ পৃথিবী থেকেই চলে গেছে । সবাই ব্যস্ত। একসাথে কতদিন পর আজ দেখা হল। এই দিনটা যদি ধরে রাখতে পারতাম। মনের মণিকোঠায় লুকিয়ে রাখতাম, আগলে রাখতাম।আনন্দের অনুভূতি এত মধুর,সুন্দর, অপূর্ব বলেই কি এত কম স্থায়িত্ব? আজ সবাই বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বাস করি। দেখা তো দূর রোজ কথাও হয় না।এই রাতটা আবার কখনও আসবে তো?কোনো একদিন । আসবে না?
আরও দূরত্ব বাড়বে। একদিন বাড়তে বাড়তে সবাই হারিয়ে যাবে। বহুদূর চলে যাবে। আজকেই দিনটা ভুলেই যাবে।
আমি ভুলব না। আমার আজ রাতের সমস্ত অনুভবটুকু আমি আমার মনের গহন গভীরে চিরকাল রেখে দেব। যেখানেই থাকি। সুখে বা দুখে আজকের রাতটা আমার বড় আপন হয়ে থাকবে। হারাতে দেব না একে। এই রাতের আনন্দ অনুভব আমাকে অনেক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে সাহস দেবে। শক্ত রাখবে।
সত্যিই বড় মনোরম আজকের রাতখানি।

সমাপ্ত

এক ফালি রোদ্দুর দিলাম তোমায়Tahanan ng mga kuwento. Tumuklas ngayon