শেষ বারের মতো

299 13 3
                                    

রাগে ফোস ফোস করতে করতে রুমের মধ্যে সে পায়চারী করছে অনেক্ষন। রাগটা এখন দেখাতে চাচ্ছেনা কিন্তু আমি জানি ও রেগে আছে। হঠাৎ চেচিঁয়ে উঠলো,

"আবার! আবার এমন হলো!" এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললো, "এ বয়সে তোকে এসব কাজ মানায়?"

"তুমি আমার সাথে এমন করছো কেন বুঝলাম না। বলছিতো আমি করিনি। আর এভাবে চেচাঁলে অসুস্থ হয়ে যাবে।"

কিন্তু কে শুনে কার কথা? আমার কথায় কান না দিয়ে সে রুমের এদিক ওদিক হাটছে আর বকছে, "বিয়ের দিন এমন হলো, ১ম বিবাহ বার্ষিকিতেও হলো। দু'বারই তুই চুরি করেছিলি। এখন আমাকে বিশ্বাস করতে হবে যে অন্য কেউ নিয়েছে?"

এবার আমারও সহ্য হচ্ছে না। অনেক্ষন ধরেই "তুই" সম্বোধনে কথা বলছে আমার সাথে। বিয়ের পর থেকে এ অভ্যাসটা দু'জনই পরিবর্তন করেছিলাম। কিন্তু আজকাল ও একটু অন্যরকম আচরন করে। রেগে গেলেই আগের মতো তুই তুকারি করে কথা বলে। ও রেগে গেলে এখন আমি চেষ্টা করি শান্তু থাকার কিন্তু অযথা এমন করার মানে হয় না।

"জুতা জোড়া খুলে চেয়ারের উপর একটু পা তুলে বিশ্রাম নিতে চাচ্ছিলাম আর এর মধ্যেই এমন কান্ড! খুব বেশি বেশি হয়ে গেলো না?"

"তুমিই হয়তো পৃথিবীর একমাত্র ব্যক্তি যে বিবাহবার্ষিকিতেও বিশ্রাম করতে চাও। ভালো হয়েছে জুতো চুরি হয়েছে। জুতো খোজাঁর সাথে সাথে ব্যায়ামও হয়েছে। এ বয়সে ব্যায়াম করা ভালো।" বলেই উঠতে যাচ্ছিলাম আর তখনই রুমের দরজা খুলে কেউ দাড়ালো।

ওরা দুইজন এসে দরজায় দাড়ালো। মধ্যবয়স্ক ছেলে ও তার পাশে তার স্ত্রী দাড়িয়ে মুচকি হাসছে। আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে ছেলে প্রশ্ন করে উঠলো, "এখনো রাগ কমেনি তোমাদের? সেই কখন থেকেই জুতা নিয়ে তর্ক বিতর্ক চলছে। এবার থামো!"

আমি বললাম, "তোর বাবাকে বোঝানোর সাধ্য আমার নেই। সে আমার দোষ দিচ্ছে। বুড়ো বয়সে সামান্য বিষয়ে এতো চেচাঁমেচি এখন ভালো লাগেনা। ১ম বার এ কারনেই জুতো ওর মাথায় ছুড়ে মেরেছিলাম।"

এবার ও বললো, "আচ্ছা বউমা তুমিই বলো, এর আগে একই ঘটনা তোমার শাশুড়ি ঘটিয়েছে দুইবার। এতো বছর পর আবার হলো। আর কাকে সন্দেহ করবো? আমি তো আর চোরকে খুন করবো বলিনি। জিজ্ঞাসা করেছি যে সে নিয়েছে কিনা। তাতেই আমাকে ধমকানো শুরু।"

আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম। কত বড় মিথ্যুক! ছেলের বউয়ের কাছে ভালো সাজা হচ্ছে। আর ছেলের বউও শশুড়ের কথায় হাসছে। এরপর রুমের বাইরে তাকিয়ে কাকে যেন ইশারা করলো।

"এই যে দাদার জুতা!!!!!" বলে চিৎকার করে দৌড়ে জুতা হাতে ছুটে এলো পাজিটা। দাদার পায়ের কাছে জুতা রেখে আমার কোলে এসে দৌড়ে বসলো। "আম্মু আমাকে জুতা লুকাতে বলেছিলো। দাদী নেয়নি তো।"

আমরা দুজন এবার অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকালাম। ছেলে ও ছেলের বউ দুজনই যেন খুব মজা পাচ্ছে আমাদের অবস্থা দেখে।

"আপনাদের ৪০ তম বিবাহবার্ষিকি আমাদের জন্য স্মরনীয় করে রাখতেই অনুষ্ঠান করলাম আজ। আর এমন দিনে পুরাতন কিছু স্মৃতি ফিরে আসবেনা তা কি করে হয়?" বলেই জোড়ে হাসতে লাগলো বউমা। ছেলেও হাসছে।

এবার ও বললো, "তোর মায়ের মতো শয়তানি বুদ্ধি ভরা তোদের মাথায়।" বলেই আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। হয়তো আমাকে আবার রাগাবে ভেবেছিলো। কিন্তু কথাটি শুনে রাগ হইনি। বরং সবাই হেসেছি।

রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে রুমে এসে দেখি ও মাথা নিচু করে বসে আছে যেন কিছু ভাবছে। জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে কিন্তু মাথা নাড়িয়ে হেসে বলে, "কিছুনা।" ওর এই হাসির কাছে আমি এখনো হার মেনে যাই।

এরপর শুয়ে শুয়ে দুজনের সারাদিনের গল্প শুরু হলো। দেখতে দেখতে যেন এতোগুলো বছর চোখের পলকে কেটে গেলো। দু'জনের মা-বাবাকে হারিয়েছি বহু বছর আগেই। আমার ননদটাও মারা গেলো কয়েক বছর আগে। ছেলে, ছেলের বউ আর নাতনি নিয়ে দিনগুলো ফুড়িয়ে আসতে শুরু করেছিলো কবে খেয়ালই করিনি কেউ। সম্ভবত এ কথাগুলোই সে তখন বসে বসে ভাবছিলো। কথা বলতে বলতে আমার ঘাড়ের নিচে হাত দিয়ে আমাকে নিজের দিকে ঘুড়িয়ে বুকের কাছে টেনে নিলো। এ আর নতুন কি? বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই এভাবেই নিয়মিত ঘুমায় সে। আমাকে বুকের কাছে আগলে নিয়ে ঠোঁটজোড়া ঠিক আমার কপালের মাঝে রেখে কথা বলতে বলতে ঘুমায়। মনে হয় ছেড়ে দিলেই আমি হারিয়ে যাবো।

এখন আর আগের মতো ঝগড়া হয়না আমাদের। বয়সের সাথে সাথে ক্লান্তিও বেড়ে গেছে। দিন কাটে পুরানো দিনগুলোর কথা ভেবে। সবকিছু ভাবতে ভাবতেই ঘুমে চোখের পাতাগুলো বন্ধ হয়ে আসছিলো। ঘুমিয়ে যাওয়ার আগে মনে হলো ও আমাকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।

এরপর দুজনই ঘুমের দেশে পাড়ি জমাই.....
একসাথে,
শেষবারের মতো।

সমাপ্ত

চোরDonde viven las historias. Descúbrelo ahora