কেক খেয়ে মাহবুব ভাই নিতুর শাড়িটাতে মুখ মুছলেন, পানি খাবার সময় শাড়িতে একটু পানিও ফেলে দিলেন। তারপর হাত -পা ছড়িয়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন।-------ঠিক দু-ঘন্টা পর অামায় ডেকে দিবি নিতু। এখন ন'টা পঁয়ত্রিশ। দু-ঘন্টা মানে এগারোটা পঁয়ত্রিশে ডাকবি। এক সেকেন্ড ও যেনো লেট না হয়।------অাচ্ছা। ততক্ষণ কি অাপনার বন্ধুরা একা থাকবে?? -------একা অাবার কি??? তুই থাকবি ওদের সাথে, তোর বাবার স্টাডিতে বসাবি, মুভি দেখবে ওরা। রাতে অারেকবার খাওয়া দাওয়া করে তারপর ওরা যাবে। খাবার দাবার অাছে তো??? নিতু মনে মনে বললো, অাপনার সবগুলো মেয়ে বন্ধু মরে যাক্, যাক্,যাক্।-------হুঁ অাছে।------তোর ঘরে এত পচা গন্ধ করছে কেনো রে?? কোথাও কি মুতু করে রেখেছিস??নিতু গলার স্বর টেনে টেনে বললো, --------রজনীগন্ধা ফুলের ঘ্রাণ আসছে। এই যে, এখানে ফুল রাখা অাছে।-------তোর কি ধারণা?? অামি কোনটা ফুলের গন্ধ অার কোনটা মুতুর গন্ধ বুঝি না??নিতু অার কথা বাড়াতে গেলো না। এই মানুষটার সাথে কথা বলতে যাওয়া মানে চোখের পানির ট্রিগার প্রেস করা।নিতু দরজার কাছে যেতেই মাহবুব ভাই অাবার ডাকলেন, -------নিতু, নিচে যে অামার সবথেকে সুন্দরী বান্ধবীটা অাছে, পিংক টিশার্ট । ওকে গিয়ে বলবি মাহবুব ভাই গিফট দিতে বলেছে...-------অামি গিয়ে তার কাছে গিফট চাইবো?? -------হু চাইবি। অামি তোর জন্য গিফট এনেছি, স্পেশাল গিফট। এই গিফট ম্যানেজ করতে গিয়ে এত ঝামেলায় পড়লাম যে, তোর বার্থডে পার্টিটাই মিস হয়ে গেলো।নিতুর বুকে অাবার ধুকপুক শুরু হলো। --------স্পেশাল গিফট?? -------গিফটটা কিন্তু তুই সবার সামনে খুলিস না, একা একা ঘরে খুলবি। অামি অনেক কষ্ট করে শুধু তোর জন্য এনেছি নিতু...নিতু একছুটে নিচে এলো, পিংক টিশার্টের মাহবুব ভাইয়ের বান্ধবীকে কিছু বলতে হলো না। নিতু যেতেই তিনি প্যাকেট বাড়িয়ে দিলেন।অরেঞ্জ র্যাপারে মোড়ানো সুন্দর প্যাকেট। নিতু প্যাকেট হাতে দৌড়ে বড় চাচার ঘরে এলো। একা ঘরে খুলতে হবে। ইশ্। মাহবুব ভাই টা যে কি?? এমন করে সারপ্রাইজ দিলে তো নিতু মরেই যাবে... প্যাকেটটার গায়ে নিতুর এক লক্ষ চুমু খেতে ইচ্ছে করছে।নিতু দরজা বন্ধ করে বিছানায় অায়েশ করে বসলো। প্যাকেট খুলে সে হতভম্ব... দুটো ব্যাঙ লাফিয়ে বেরিয়ে বিছানায় পড়লো। নিতু ও মা গো বলে চিৎকার দিয়ে নিজের কান নিজেই চেপে ধরলো। মাহবুব ভাই প্যাকেটে ভরে ব্যাঙ নিয়ে এসেছেন। এই তাঁর বিশেষ গিফট?? ব্যাঙ দুটো বিছানায় ইচ্ছেমত লাফাচ্ছে। দুটোর গায়েই নীল রং করা। নিতু রাগ অার অভিমানের তেতো মিশ্রণ নিয়ে কাঁদতে লাগলো। প্যাকেটের ভেতরে চিরকুট ও অাছে, " নিতু এবং মুতু"জন্মদিনে তোকে কি উপহার দেয়া যায়, এটা অামি দশঘন্টা ভেবে বের করেছি। দেখ, উপহার হিসেবে তোর সাথে ব্যাঙের চেয়ে ভালো কিছু যায় না। তুই মুতু করিস, অাবার ব্যাঙ ধরামাত্রই মুতু করে। তোরা দুজনেই লাফাস। তোদের কি মিলরে নিতু?? অাচ্ছা, এমন তো নয় যে, তুই অাগের জন্মে ব্যাঙ ছিলি??? পানিতে এক ঝাঁক ছানা তৈরি করতি?? তোর সেসব ছানাকে বলা হতো ব্যাঙাচি।ছিঃ।।চোখ মুছে, বড়চাচার ঘর থেকে নিতু খুব স্বাভাবিক ভাবেই বেরিয়ে এলো। অাজ মাহবুব ভাইকে সে কিছু শক্ত কথা বলবেই। ঘরে এসে সে চেঁচিয়ে মাহবুবকে ডাকলো, -------ডাকছিস কেনো?? দু-ঘন্টা হয়ে গেছে?? ঘুম ঘুম চোখে মাহবুব ভাই পাশ ফিরলেন। ফর্সা গালের খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে মুখটায় কি যে মাদকতা। চোখের চশমা না খুলেই ঘুমুচ্ছেন। এত অগোছালো হলে হয়??অাচ্ছা, চুলগুলো এত কপাল ঢাকা সুন্দর কেনো?? অার এই যে, গালের পাশে বাঁকানো দাগটা ; এটার জন্য তো নিতু হাজারবার মরতে পারে।নিতু ফিসফিস করে বললো, -------অাপনি অামাকে হাজারটা ব্যাঙ দিলেও অামি রাগ করবোনা। একটা ব্যাঙভর্তি কুয়োয় ফেলে দিলেও রাগ করবো না। অাপনার এমন মুখটা দেখে তো, অামি অনায়াসে এক লক্ষ ব্যাঙের কামড় খেতে পারি।নিতু উঠে দাঁড়ালো, মাহবুব ভাই অস্পষ্ট স্বরে বললেন, -------চশমাটা খুলে দিয়ে যা নিতু।নিতু শুধু চশমা খুললো না। চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে দিলো। এই মাহবুব ভাইয়ের চশমা খোলার জন্য হলেও সে এই পৃথিবীতে হাজারবার অাসতে চায়, ব্যাঙ নিতু হয়ে।মাহবুব ভাইয়ের ঘুম ভাঙলো, রাত সাড়ে বারোটায়। নিতুর বড়চাচীর চেঁচামেচিতে। তিনি সারাবাড়ি মাথায় তুলে চেঁচাচ্ছেন। চেঁচানোর কারণ,তিনি বিছানায় শুয়েছেন। হঠাৎ তাঁর পেটে কিছু একটা লাফ দিলো, তিনি বাতি জালিয়ে দেখলেন তার বিছানায় ব্যাঙ লাফাচ্ছে। নীল ব্যাঙ, লাল ব্যাঙ। শতশত ব্যাঙ।বাড়ির সবাই তাঁর দরজা ঘিরে দাঁড়িয়ে অাছেন। নিতুর বাবা সোবহান চৌধুরী সাহেব, মহা চিন্তিত হয়ে বললেন, --------অামার অাটচল্লিশ বছরের জীবনে অামি এই প্রথম কোনো নীল ব্যাঙ দেখলাম ভাবী।অামার মনে হচ্ছে এটা অামাজন জঙ্গল থেকে এসেছে?? বাংলাদেশে তো এই প্রজাতির ব্যাঙ অাছে বলে মনে হয়না। নিতুর বড়চাচা ইরফান চৌধুরী সাহেব অারো গম্ভীর মুখ করে বললেন, ------- পরিবেশ ও বন অধিদপ্তরে একবার কথা বলা দরকার। নাকি প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তরে??? এরকম ব্যাঙ, কতটা ভয়ংকর! এদের কামড়ে মানুষ মারা যায় কিনা, এদের প্রজনন, অাবাসন এসব সম্পর্কে জানা দরকার।ভয়ে নিতুর গলায় শুকিয়ে এলো। মাহবুব ভাই পেছন থেকে ইশারা করলেন,------ তুই কি বলতো নিতু??? দুটো ব্যাঙ দিলাম, তাও তোর বড়চাচীর বিছানায় ছেড়ে দিয়ে এলি??? দুটো মাত্র ব্যাঙ সামলাতে পারলি না???----অাপনি একা গিফট খুলতে বলেছিলেন...?? বড়চাচীর ঘর ফাঁকা ছিলো তখন।-------অামি কি তোকে উনার বিছানায় ছেড়ে দিয়ে অাসতে বলেছি?? তোদের সারাবাড়ি এখন ব্যাঙ ব্যাঙ বলে ঢাকাবাসীকে মেরে ফেলবে। যা গিয়ে বল, তুই ব্যাঙ ছেড়েছিস।------অামি বলবো?? -------অবশ্যই তুই বলবি। দুটো নীল রং করা ব্যাঙ, তোর মহামিথ্যুক বড়চাচী বলছে, শতশত লাল-নীল ব্যাঙ। এই জন্যই তোদের বাড়িতে অামি অাসতে চাই না। সবকিছুতে বাড়াবাড়ি। সবগুলো চূড়ান্ত ধাপ্পাবাজ। -------তিনি ভয় পেয়ে এরকম বলছেন, মাহবুব ভাই। -------তো যা, এখন গিয়ে ভয় ভাঙ্গিয়ে দিয়ে অায়। অামার কাঁচা ঘুমটা নষ্ট। এখন মাথা ধরে গেছে, উফ্। যা, বল গিয়ে, নাহলে অামি এক্ষুণি চলে যাবো।বড়চাচা, ফোনে কথা বলছিলেন, নিতু মাথা নিচু করে ভয়ে ভয়ে তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। --------চাচা, ব্যাঙ অামি এনেছি। কলেজে প্রাকটিক্যাল অাছে। বড়চাচা বিস্মিত চোখে তাঁকিয়ে বললেন, --------তুমি এনেছো?? --------জি চাচা, বায়োলজির প্রাকটিক্যালের জন্য। সবাইকে দুটো করে ব্যাঙ নিয়ে যেতে বলেছে।অামার ব্যাঙ, চেনার জন্য অামি নীল রং করে এনেছি... -------তুমি ব্যাঙের গায়ে নীল রং লাগিয়েছো?? -------জি চাচা। বলে নিতু কেঁদে ফেললো। বড়চাচাকে সে কখনোই মিথ্যা বলে না। শুধু মাহবুব ভাইয়ের জন্য অাজ বলতে হলো। -------ঠিক অাছে, তুমি কেঁদো না। ব্যাঙ রেখেছিলে কোথায়?? অামাদের বিছানায় এলো কি করে??? --------প্যাকেটে রেখেছিলাম, প্যাকেট ফুঁড়ে বেড়িয়ে গেছে। জন্মদিনের ব্যস্ততায় খোঁজ করতে ভুলে গিয়েছিলাম।বড়চাচা কিছুটা বিস্মিত, কিছুটা রাগান্বিত হয়ে বললেন, -------এরপর থেকে প্রাকটিক্যালে এসব প্রাণী জাতীয় কিছু দরকার পড়লে, বাড়িতে ঘরে অানবে না, গ্যারেজের স্টোররুমে রাখবে। তোমার চাচী ব্যাঙ ভীষণ ভয় পান। ভয়ে তাঁর শ্বাসকষ্টের মত হচ্ছে, যাও তাঁকে গিয়ে সত্যিটা বলো।নিতু বিমর্ষ মুখে চোখ মুছতে মুছতে বড় চাচীর ঘরে রওনা হলো। এই মাহবুব ভাইয়ের জন্য সে সব অপমান সইতে রাজি।সকালে নিতুর ঘুম ভাঙলো ছয়টায়। মাহবুব ভাই ডেকে তুলেছেন। -------অামি চলে যাবো, অায় নাশতা দে। -------এত সকালে?? -------অামার ভোর ছয়টায় ক্ষিধে পায়। তোদের বাড়ির সবাই -ই তো ঘুমে। বুয়াকে ডাকলাম জবাব দিলো না। রাজা"র বাড়ির গাঁধাগুলোও রাজা বনে গেছে।নিতু চোখ কচলাতে কচলাতে বললো, -------অামি নাশতা বানাতে পারিনা। ------পারিনা মানে?? অামি না খেয়ে যাবো, তোর জন্য এত কষ্ট করে ব্যাঙ অানলাম, অার তাঁর ফলাফল এই...তুই এক্ষুনি আমার জন্য নাশতা বানাবি। দশমিনিটের মধ্যে।রান্নাঘরে এসে নিতু ডিম ভাজি করলো। ব্রেড টোস্ট করলো, রাতের তরকারি গরম করলো।মাহবুব ভাই ডিম মুখে দিয়েই বললেন, -------থুওওওও... লবণ দিসনি?? একটা কাজও যদি পারতি তুই। এগুলো টোস্ট?? পুরে ছাড়খাড়। পারিস তো খালি কাটাকুটি। মাহবুব ভাই নাশতার মধ্যে পানি ঢেলে দিয়ে উঠে পড়লেন।-------অামার ফ্রেন্ড রুমঝুম কত ভালো নাশতা বানাতে পারে জানিস। শুধু বিরিয়ানিই রান্না করতে পারে পাঁচ রকমের। মাটন বিরিয়ানি টানিতু সাথে সাথে মনে মনে বললো, রুমঝুম এক্ষুনি এক্সিডেন্ট করে মরে যাক্,,অথবা স্মৃতি হারিয়ে ফেলুক। সব রান্না ভুলে যাক।নিতু গলা শক্ত করে বললো, ------অামি ভালোমত পড়াশোনা করি, তাই অাপাতত রান্না শিখছি না। পড়াশোনা শেষ করে অামি অবশ্যই ভালো রান্না করতে শিখবো। কিন্তু রেগুলার রান্না করবো না। বড় চাকরি করবো তো, তাই সবসময় হোটেলে হোটেলে খাবো।------তুই তো মস্ত বেয়াদব। হোটেলে খাবি স্বপ্ন দেখিস। নিতু কিছুতেই ভেবে পেলো না, হোটেলে খাবার খাওয়ার মধ্যে বেয়াদবির কি অাছে???মাহবুব ভাই রাগে গজগজ করতে করতে বেড়িয়ে গেলেন, দরজা পর্যন্ত গিয়ে বললেন, -------অারিফ নামে তোর কোনো বন্ধু অাছে??? নিতু মাথা নাড়লো। -------এই যে অারিফের সাথে একসাথে রিকশায় বসিস, দেখা যাবে তোকে টিপাটিপি করে সর্বনাশ করে দিয়েছে। খবরদার অার বসবি না।।অার তাঁরই বা কি অাক্কেল জ্ঞান, বিছানা ভেজানো একটা মেয়ের সাথে রিকশায় বসে যাচ্ছে, অামি তো জীবনেও বসতে পারতাম না, নাক চেপে ধরেও পারতাম না। অন্য গন্ধ যেমন তেমন, কিন্তু মুতুর গন্ধ ডিরেক্ট ব্রেনে গিয়ে ধরে অামার।নিতুর চোখে অাবার পানি এসে গেলো! মাহবুব ভাই কি তাঁকে কাঁদিয়ে কাঁদিয়ে মেরে ফেলতে চায়? এত খারাপ কেনো মানুষটা??মানুষটা কি বুঝতে পারে না,প্রতি রাতে ঘুমোবার অাগে নিতু শুধু এই মানুষটাকে ভেবে ভেবেই হাজার বার, লক্ষ বার, লজ্জা পেয়ে কেঁপে উঠে??
YOU ARE READING
মাহবুব ভাই
Romanceঅাজ তাঁর সতেরো তম জন্মদিন। এই জন্মদিন তাঁর অন্য জন্মদিন গুলোর থেকে বিশেষ। কারণ অাজ মাহবুব ভাই অাসছেন। গত তিনটে জন্মদিনের একটাতেও মাহবুব ভাই অাসেননি, তাঁর পরীক্ষা ছিলো......