হিয়ার_মাঝে💐

61 5 1
                                    

হিয়ার_মাঝে💐ফারজানা ইসলাম*****************বাবা-মা'র পছন্দের ওপর অগাধ বিশ্বাস অহনা'র । সে বারবার করে বলে এসেছে, আমি কক্ষনো প্রেম করে বিয়ে করবো না । বড় বোনকে দেখে তার ঢের শিক্ষা হয়েছে । তার বোন অপলা যখন প্রেম করে বিয়ে করলো মানে বাড়ি থেকে চলে গিয়ে নিজের বিয়ে নিজেই করেছিলো , বাবা-মা খুব কষ্ট পেয়েছিলেন । তার বাবা-মা যে খুব রক্ষনশীল বা ছেলেমেয়েদের প্রেমের বিপক্ষে, ব্যাপারটা কিন্তু মোটেও তেমন নয় । আপা প্রেম করেছিলো এমনই এক অখাদ্যের সাথে যে তার বাবা-মা কেন, কোনো মা-বাবাই এমন ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দেবেন না । আপার আসলে পুরোপুরি দোষও দেয়া যায় না । জনি এমনভাবে আপার পেছনে লেগেছিলো যে আপা নিজেকে শেষ পর্যন্ত সামলে রাখতে পারেনি । জনি দেখতেও ছিলো মারাত্মক হ্যান্ডসাম । আর ওখানেই হয়েছিলো আপার সর্বনাশ । আপার যেমন সিনেমার নেশা ছিলো তেমনি স্বপ্নেও দেখতো ঐরকম নায়ক মার্কা প্রেমিক অতঃপর বর তারও হবে । তাইতো আপাকে বাগে আনতে জনিকে বেশি পরিশ্রম করতে হয়নি । আর সে ভাড়া নিয়েছিলো ঠিক তাদের সামনের বাড়ির একতলার ফ্ল্যাট । যে কারণে সারাদিন অসংখ্যবার জনির সাথে তাদের চোখাচোখি হয়ে যেতো । সে অথবা আপা বারান্দায় আসলেই দেখতো জনি চেয়ার নিয়ে বারান্দায় বসে আছে ।জনির বিষয়ে তারা এতোটুকুই জানতো, সে লেখাপড়ার জন্য ঢাকায় এসেছে । বাবা-মা থাকেন চট্টগ্রামে । সেখানে তাদের বিরাট ব্যাবসা । নিজের সম্বন্ধে এই গল্পই সে রটিয়েছিলো আশেপাশে । তবে অহনা'র খুব অবাক লাগতো একটা বিষয়ে, জনিকে কখনো সে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে দেখেনি । তবে কেউ জিজ্ঞেস করলেই সে বলতো ঢাকা কলেজে পড়ি । আপা যখন জনির সাথে প্রেমে পুরো মাখোমাখো সেই সময়ে জনির আসল নাম পরিচয় তারা জানতে পারলো । যাকে তারা এতোদিন জনি নামে চিনতো তার নাম নাকি জব্বার আর তার বাড়ি মোটেও চট্টগ্রামে না । ফরিদপুরের ছেলে জব্বার তার বাপমায়ের বখে যাওয়া সন্তান । ছয় বোনের এক ভাই হওয়াতে অতি আদরে আর ওমন লাল্টু মার্কা চেহারা নিয়ে সে যা খুশি তাই করে বেড়াতো । বাপের চালের আড়ৎদারি কারবার । টাকাপয়সা চাওয়া মাত্র পেয়ে গেছে আর লেখাপড়ার প্রতি তেমন আগ্রহ না থাকায় ক্লাস টেন অবধি টেনেটুনে গেছে । তারপর আর কোনো ক্লাস পেরোতে পারেনি । এই সব ভয়াবহ তথ্য তাদের কানে আসার পরও কোনো লাভ হলো না । জনি আপাকে বুঝিয়ে ফেললো যে এগুলো সবই চরম মিথ্যা কথা । তাদের প্রেম যারা সহ্য করতে পারছে না তারা হিংসায় জ্বলেপুড়ে এইসব রটাচ্ছে । অপলা'র নরম মনটা আরো নরম হয়ে গেলো আর সে সাত-পাঁচ না ভেবে জনি ওরফে জব্বারের হাত ধরে সোজা কাজী অফিসে । অপলা ভেবেছিলো তার বাবা যেহেতু তাকে মাত্রাছাড়া আদর করে তাই মেয়ের এই ছোট্ট ভুল ক্ষমা করে দেবেন কিন্তু হলো ঠিক তার বিপরীত । জনির যে চামচাটা এসেছিলো বিয়ের খবর নিয়ে, বাবা তার কলার চেপে ধরে হাওয়ায় তুলে ফেলেছিলো । অহনা আর তার মা মিলে বাবার হাত থেকে সেই চামচাকে কোনোভাবেই ছাড়াতে পারছিলো না । আর একটু হলেই একটা কেলেংকারি কান্ড হয়ে যেতো । বাবা কোনোভাবেই মানতে পারছিলেন না তার বিবিএ পড়া মেয়ে এমন একটা ছেলের জন্য ঘর ছাড়লো । বাবার হাত থেকে ছাড়া পেয়ে চামচাটা পড়ি কী মরি করে দে ছুট । বাবা তখনো থরথর করে কাঁপছে । মা'কে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলো, কন্যা স্নেহে যদি মন বেশি উতলা হয় তাহলে মা'ও বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে পারে । মা আর কথা বাড়ায়নি । এর কিছুদিন পরেই ওরা জানতে পেরেছিলো, অপলা ভালো নেই । জনির সব মিথ্যা ওর কাছে ধরা পরে গেছে । জনি ওকে ফরিদপুরে বাপের বাড়িতে নিয়ে তুলেছে । পালিয়ে বিয়ে করায় জনির বোনদের কাছে বেচারী দিনরাত কথা শোনে আর পুরো সংসারের ভার অপলা'র নাজুক কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছে । কথাগুলো শুনে বাবা এতো বেশি নির্বিকার ছিলেন যে মনে হলো যেন কিছু শুনতেই পাননি ।অহনাকে যেদিন ছেলের বাড়ি থেকে দেখতে আসলো সেদিন সকালেও সে বিষয়টা জানতো না । খালাতো বোন রিনির সাথে লাইব্রেরিতে গিয়োছিলো বই পড়বে আর কিনবে বলে । দু'বোন মিলে অনেকদিন পর বাড়ি থেকে বের হওয়ায় ইচ্ছেমতো ঘোরাঘুরি, ফুচকা, ঝালমুড়ি খাওয়া তারপর একগাদা বই কিনে শেষ দুপুরের বাসে চড়ে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে যখন বাড়ি ফিরলো , মা তখন অগ্নিমূর্তি -কোথায় ছিলি এতক্ষণ? একঘন্টার কথা বলে বের হয়েছিলি, একঘন্টা শেষ হতে বুঝি পাঁচ ঘন্টা লাগে? আর চেহারাটা এমন পুড়িয়েছিস কী করে?মা এতো রাগ করছো কেন? কত্তোদিন পর বের হলাম । জানো মা ঘুরতে ভীষণ ভালো লাগছিলো ।তোর বাবা খুব রাগ হয়ে আছে । বাবা এই চেহারা দেখার আগে গোসল সেরে ঠিকঠাক হয়ে আয় ।আজ এতো চেহারার পিছনে পড়লে কেন তুমি?তোকে দেখতে আসছে?কোন লাট বাহাদুর? হাসতে হাসতে বলে অহনা ।ছেলের বাড়ি থেকে । ওরা একটু আগেই খবর পাঠিয়েছে । যা মা আর সময় নষ্ট করিস না । রিনি তুই আমার সাথে রান্নাঘরে আয় তো মা ।অহনা'র শরীরটা যেন শিরশির করে ওঠে । ছেলের বাড়ি থেকে দেখতে আসছে ! বলা নেই, কওয়া নেই এমন হুট করে দেখতে আসছে বললে হয় নাকি ! অহনা'র খুব রাগ হয় মা'র ওপর । মা নিশ্চয়ই জানতো কিন্তু তাকে একটু আগে থেকে বলার কোনো প্রয়োজনই মনে করেনি । যেন জানলে সেও পালিয়ে যাবে আপার মতো । সে তো বলেছেই যে মা-বাবার পছন্দের ছেলেকেই সে বিয়ে করবে , তাই বলে তাকে না জানিয়ে হুট করে এমন একটা কান্ড করে বসলো! মন ভরা অভিমান নিয়ে অহনা ঢুকে গেলো ওয়াশরুমে। শাওয়ার ছেড়ে তার নিচে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো অনেকক্ষণ । কথাটা মাথায় টোকা দিচ্ছে ফিরে ফিরে - ছেলের বাড়ি থেকে দেখতে আসছে । অপলা পালিয়ে যাওয়ার পর থেকেই তার বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে সবাই । তারপর থেকে এই দিনটার জন্য সে মনে মনে কতো প্ল্যান করছিলো অথচ দিনটা আচমকা তার সামনে এসে দাঁড়ালো । গোসল সেরে বেরোনার পরও অহনা'র রাগ, অভিমান কমলো না । সে ইচ্ছে করেই হাওয়াই মিঠাই রঙের জামাটা বের করলো আলমারি থেকে । গত ঈদে অপলা জরি কাতান কাপড়ের এই জামাটা বানানোর পর তারা সবাই চমকে গিয়েছিলো । জামাটা দেখে অহনা খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো, কোন রুচিতে সে এমন অদ্ভুত কাপড়, তারচেয়েও অদ্ভুত রঙের জামা বানালো এই তাল পাকা গরমে? অপলা উল্টো শুনিয়ে দিয়েছিলো -তুই সুন্দরের কী বুঝিস রে? বই থেকে মুখ তুললে না দুনিয়া দেখতে পারবি । জনি বলেছে এই জামায় আমাকে রাণীর মতো লাগবে ।কিন্তু এটা যে ভয়াবহ উদ্ভট একটা কম্বিনেশন এটা বোঝার মতো চোখ আমার আছে, বুঝলি আপা ।ঈদের দিন অপলা যখন ড্রেসটা গায়ে দিয়ে বেরিয়েছিলো বেচারীর বন্ধুবান্ধবরা ওকে ভীষণ ক্ষেপিয়েছিলো । বাসায় এসে সেই যে খুলে রাখলো আর পরেনি জামাটা । অহনা আজ ইচ্ছে করে ঐ জামাটাই পরলো । ছেলে পক্ষ যেন তাকে দেখেই বাতিলের খাতায় চালান করে দেয় । জামাটা গায়ে দিতেই সে আপার ছোঁয়া অনুভব করলো যেন । কতদিন আপাকে দেখেনা সে । মনে মনে বললো, আপারে কেন এমন একটা কান্ড ঘটাতে গেলি যেটাতে তুইও ভালো নেই আর আমরাও ভালো নেই ।ঘরের ভেতর বেশ কিছু লোকজন । এরমধ্যে সমবয়সী দুজন পাশাপাশি বসে আছে । অহনা ঠিক বুঝতে পারলো না এর মধ্যে পাত্র কোন জন । তাকে ঢুকতে দেখেই সবাই চুপ হয়ে গেলো । সবাই বোধহয় এমন অদ্ভুত ড্রেস দেখে চমকে উঠেছে । অহনা মনে মনে ভীষন খুশি হলো, তার প্ল্যান কাজ করতে শুরু করেছে । সে যেয়ে কোনার সোফাটায় চুপ করে বসলো । তাকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করছে না । সে ভেবেছিলো , হাঁটো তো মা, একটা গান গাও তো মা টাইপ ডায়ালগ এখনই শুনতে পাবে কিন্তু সবাই আবার নিজেদের মধ্যে কথা বলা শুরু করেছে । এরমধ্যে একটা কথায় তার মাথায় পুরো আকাশ ভেঙে পড়লো , কাজী সাহেব আসছে এখনই । হায় হায় কাজী সাহেব আসছে মানে কী! কাজী সাহেবের কাজটা কী? সে তো এখনো ছেলেই দেখলো না । তার সাথে তো কেউ কোনো কথাই বললো না । বাবা এটা কী করছে তার সাথে ! আপা পালিয়ে গেলো দেখে বাবা তাকে এমন চরম শাস্তি দিতে পারেনা । উঠে চলে যাওয়ার কথা ভাবতেই দেখতে পেলো বড় চাচা আর মাসুদ ভাইয়ের সাথে কাজী ব্যাটা ঘরে ঢুকছে ।তারপরের আধ ঘন্টা অহনা'র জীবনে বিরাট পরিবর্তন ঘটিয়ে দিলো । খোরমা আর এনার্জি বিস্কুট দিয়ে মুহূর্তের মধ্যেই বিবাহিতের তকমা তার গলায় ঝুলে গেলো । কান্নার দমকে বরের নামটা পর্যন্ত শুনতে পারলো না সে । এরপর যা শুনলো তাতে তার হাত-পা পুরো অবশ হয়ে গেলো । তারা নাকি আজই অহনাকে নিয়ে যাবে , বাবার যদি অমত না থাকে । বাবা ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে মত দিয়ে দিলো । নিজেকে তখন অহনা'র মনে হচ্ছিলো হাত-পা বাঁধা কোরবানির গরু । বাবার ওপর তীব্র অভিমানে সে আর কোনো কথাই বললো না বাড়ির কারো সাথে । মা, চাচী, মামীরা মিলে বেশ ভালোই আয়োজন করে ফেলেছিলেন ওটুকু সময়ের মধ্যে । অহনা রুমে এসে দেখে রিনি চোখ মুছছে আর তার কাপড় গুছিয়ে দিচ্ছে । হতাশা আর ক্লান্তি ভর করছিলো অহনা'র শরীরে । কোনোমতে গায়ের থেকে সেই কিম্ভুত জামাটা সরিয়ে সুতির একটা শাড়ি পরে নিলো সে । সবাই তো হৈহৈ করে উঠলো সুতির শাড়ি দেখে । সবার মুখের ওপর কড়াভাবে শুনিয়ে দিলো , গেলে আমি এভাবেই যাবো । কেউ আর কোনো কথা বললো না । সেদিন বাড়ি ছেড়ে আসার সময় অহনা কোনো খাবার খেলো না, এমনকি পানিও না । আসার সময় বাবা মাথায় হাত রাখতেই ঝটকায় হাতটা সরিয়ে দিয়েছিলো । বাবা সবসময় বলতো তাদের দু'বোনের বিয়ের পর একদম কাছাকাছি রাখবেন যেন চাইলেই তিনি যখন তখন তাদের দেখতে যেতে পারেন অথচ এখন শুনছে তাকে নাকি এই অচেনা মানুষগুলোর সাথে সিরাজগঞ্জে চলে যেতে হবে । মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো , বাবা যখন আমাকে এভাবেই বিদায় করে দিলো তো আমি আর জীবনে কোনোদিনও বাবার সাথে কথা বলবো না ।সম্পূর্ণ অজানা, অচেনা কতোগুলো মানুষ, এরাই নাকি এখন তার আপন ! তাদের সাথে অহনা রওনা দিলো নতুন ঠিকানায় । ভাগ্য খারাপ হলে বুঝি এমনই হয় । সবাই গ্রাম থেকে ঢাকা আসে আর সে তার আজন্মের প্রেম, প্রাণের শহর ছেড়ে চলল সিরাজগঞ্জে । গাড়িতে তার পাশে যে মানুষটা বসলো তার চেহারা তখনো ভালোভাবে দেখেনি সে । অহনা'র চোখের পানির যেন বাঁধ ভেঙেছে । তার মন ভালো করার জন্য গাড়িতে থাকা লোকজন কথা বলা শুরু করলে সে বুঝলো , ওনারা শ্বশুর, শ্বাশুড়ি, ননদ, ভাসুর আর স্বামীর দুই বন্ধু । শ্বাশুড়ি, ননদের কথায় অহনা বুঝলো পাশে বসা এই মানুষটাই সেই মানুষ যে তার সব স্বপ্নগুলেকে গলা টিপে মেরেছে । লজ্জায় আর রাগে মুখ তুলতে পারছে না তাই চেহারাটা তখনো দেখা হয়নি । শুধু দুটো হাত নড়াচড়া করছে চোখের সামনে । অহনা'র অবিরাম কান্না দেখে একটা হাত এসে তার বাম হাতটাকে ছুঁয়ে বললো , বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছে ? কী এত্তো বড় চরিত্রহীন ! চেনা নেই , জানা নেই এমন হঠাৎ করে হাত ধরে বসবে ! দাঁড়াও দেখাচ্ছি তোমাকে, অহনা ডান হাতটা দিয়ে একটা রাম চিমটি বসিয়ে দিলো বেহায়া হাতটায় । সাথে সাথে ও'মাগো ! বলে জোরে এক চিৎকার । মা সাথে সাথে বলে উঠলেন -এই মুসা কী হলো তোর? কীরে চিৎকার দিলি কেন?কিছু না মা ।কিছু না তো চিৎকার কেন দিলি? মেয়েটা ভয় পাবে তো ।এতক্ষনে অহনা জানতে পারলো তার নাম মুসা । সারা রাস্তায় সে আর হাত ধরার কোন চেষ্টা করেনি ।গাড়ি সিরাজগঞ্জের বাড়িতে যখন পৌঁছালো ততক্ষণে অহনা গাড়ির মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছে । মুসা সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে অহনা'র পাশে বসে রইলো তার ঘুম ভাঙার অপেক্ষায় । হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে মুসাকে অপলক তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অহনা ভয়ে চিৎকার করে উঠলো । অহনা'র চিৎকারে খেই হারিয়ে মুসা হুমড়ি খেয়ে অহনা'র ওপরই পড়ে গেলো । তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে মুসা বলে উঠলো -অহনা আমাকে চিনতে পারছো না? আমি মুসা ।কে মুসা? অহনা'র তখনোর ঘুমের ঘোর কাটেনি ।আমাদের যে বিয়ে হলো কাল রাতে । মনে পড়ছে?সবাই কোথায়? শুধু আপনি কেন এখানে?তুমি ঘুমিয়েছিলে দেখে আমি বসে ছিলাম । সবাই খুব টায়ার্ড হয়ে আছে তো তাই বাড়ি চলে গেছে ।বাড়ি কোথায় ? অহনা'র কেন যেন মনে হচ্ছে মানুষটার কোনো বদ মতলব আছে ।ঐ তো বাড়ি। সামনে হাত তুলে দেখায় মুসা ।অহনা তাকিয়ে দেখে সামনে ভীষণ সুন্দর একটা বাংলো টাইপ বাড়ি । মেইন গেটের একপাশে হলুদ-বেগুনি বাগানবিলাস আরেক পাশে মাধবীলতার গাছ ফুলের ভারে টালমাটাল । অহনা'র মনটা নিমিষেই ভালো হয়ে যায় । গাড়ি থেকে নেমে মুসা'র পিছে পিছে বাড়ি ভেতর ঢুকলো সে । বাড়ি ভরা মানুষ ! সবাই এসে হৈচৈ করে ঘিরে ধরলো তাকে । তার শ্বাশুড়ি এসে ধমক দিয়ে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বললো , মেয়েটা এতোটা পথ জার্নি করে এসেছে আর তোমরা ওকে নিয়ে পড়লে সাথে সাথে । ও এখন কারো সাথে কথা বলবে না । অহনা'র হাতটা ধরে তিনি বললেন , এই তুই চলতো আমার সাথে । চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে তারপর একেবারে ডাইনিং টেবিলে আসবি, চল । ওখানেই সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো । অহনা'র ভীষণ ভালো লাগে মানুষটাকে । কেমন মায়া মায়া করে কথা বললো ঠিক তার মা'র মতো । মা'র কথা মনে হতেই বুকের ভেতরটা আবারো মোচড় দিয়ে উঠলো । মাকে ছাড়া সে কোনোদিন থাকেনি ।শ্বাশুড়ির সাথে এসে যে রুমটায় ঢুকলে তারা, রুমটা খুব সুন্দর করে সাজানো । এটা নাকি আজ থেকে তার রুম । সবকিছু তাকে দেখিয়ে দিয়ে শ্বাশুড়ি চলে গেলেন ডাইনিং টেবিলে দেখা হবে বলে । রুমের দরজা বন্ধ করে এসে অহনা সটান শুয়ে পড়লো বিছানায় । চব্বিশ ঘন্টারও কম সময়ে তার জীবনে কতটা পরিবর্তনই না ঘটে গেলো । এই যে নতুন এতোগুলো মুখ, নতুন সম্পর্ক আর সেই মানুষটা, "মুসা" সে কেমন হবে কে জানে । তার সাথে কী মানিয়ে নিতে পারবে অহনা অথবা সে অহনা'র সাথে ? সে মনে মনে ঠিক করেছিলো, এখানে এসে উল্টোপাল্টা কান্ড ঘটাবে কিন্তু শ্বাশুড়ি তার সাথে এতো সুন্দর করে কথা বললো যে অহনা উল্টোপাল্টা কিছুর চিন্তা আপাতত বাদ দিলো । শ্বাশুড়ির কথা মনে হতেই উঠে বসলো সে । উনি নিশ্চয়ই অপেক্ষা করে আছেন । অহনা তাড়াতাড়ি গোসল সেরে পরিপাটি হয়ে ডাইনিং টেবিলে পৌঁছে গেলো । সবাই খাবার সামনে নিয়ে তার অপেক্ষায় বসে আছে । একটু লজ্জা পেলো সে । শ্বাশুড়ির কথামতো মুসা'র পাশের চেয়ারটায় গিয়ে বসলো । বিরাট পরিবার । তার শ্বশুরের ভাইবোন সবাই কাছেই থাকেন । তারা সবাই এসেছেন । মুসা'র ভাইবোন কেউ এখানে থাকে না । চাকরীর জন্য একেকজন একেক দিকে থাকে । তাদের এমন ঝটপট বিয়ে হয়ে যাওয়াতে শ্বশুরের জরুরী তলবে সবাই বাড়ি চলে এসেছে । মুসা এবাড়ির ছোট ছেলে । ঘুরে ঘুরে সবাইকে সালাম করা শেষে অহনা'র যেমন কোমর ব্যাথা হয়ে গেলো তেমনি হাতের মুঠো ভরে গেলো সালামির টাকায় । টাকাগুলো কী করবে বুঝতে না পেরে মুসা'র হাতে দিয়ে দিলো । রুমে যেয়ে নিয়ে নেয়া যাবে ।এরমাঝে বাবা ফোন করলো অনেকবার । বাবা নামটা দেখেই সে ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখেছে । কোনোদিনও আর সে বাবার সাথে কথা বলবে না । বাবা'র উতলা ভাবটা সে বুঝতে পারছে । বাবাও একটু বুঝুক সে যে রাগ করেছে । বাবাও কষ্ট পাক । দুপুরে মা ফোন করলো -হ্যালো অহনা কেমন আছিস? তোর বাবা যে এতোবার ফোন করছে ধরছিস না কেন? বাবা তো একেবারে অস্থির হয়ে আছে ।দেখে মা, একদম মিথ্যে কথা বলবে না । তোমরা মোটেও অস্থির হয়ে নেই । থাকলে আমাকে এভাবে বিদায় করতে পারতে না । আমাকে একবার তো জানাতে পারতে মা । আমি তো বলেছিলামই যে তোমাদের পছন্দের ছেলেকেই বিয়ে করবো । তাই বলে এভাবে ! আমি তো বিয়ের আগে মানুষটার নামটাই জানতে পারলাম না, তার চেহারা না দেখেই তাকে বিয়ে করে ফেললাম । তোমাদের থেকে এতোটা দুরে সরিয়ে দিলে আমাকে ! আমার মন চাইলেও যে আমি এখন বাড়ি আসতে পারবো না । তুমি বাবাকে বলে দিও আমি তোমাদের কারো সাথে আর কথা বলবো না । আমি খুব ভালো আছি । টেনশন কোরো না । এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে অহনা লাইনটা কেটে দিলো । সে আর কক্ষনো বাড়ি যাবে না, কক্ষনো না ।এতো মানুষের মাঝে থেকে দিনটা যেন নিমিষেই শেষ হয়ে গেলো । ঝুপ করে রাত নেমে এলো । এই সময়টার ভয়ই সে পাচ্ছিলো । সারাদিন মুসা তার সাথে কথা বলার তেমন সুযোগ পায়নি এতো মানুষের ভিড়ে । এখন তো তাকে একা রুমে যেতেই হবে ওর সাথে । অহনা'র বুকটা ধুকধুক করতে লাগলো । রুমে ঢুকেই ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকবে কিনা ভাবতেই মুসা এসে দরজা বন্ধ করে দিলো । মানুষটা এখন তার পেছনে দাঁড়ানো । ভয়ে তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে । অচেনা এই মানুষটা শুধুমাত্র স্বামী নামের সার্টিফিকেট আছে বলেই কী তার ওপর ঝাঁপ দিয়ে পড়বে ? নাটক, সিনেমায় তো এমনই দেখায় । এই মানুষটাও যদি তেমন কিছু করে সে তখন কী করবে ? অহনা বুঝতে পারছে ধীরে ধীরে দুরত্ব কমে আসছে । সে কী ঘুরে একটা ধাক্কা দেবে মানুষটাকে?.....................অহনা বেশ বুঝতে পারছে মুসা একদম তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে । মুসার নিশ্বাস তার ঘাড়ে পড়ছে । সে ধাক্কা দেয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই মুসা সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বললো -আমি কী তোমার পাশে একটু বসতে পারি?অহনা একটু থতমত খেয়ে গেলো , না বলতে যেয়েও কিছু বললো না । বিছানার কোনায় বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো । সে তার বুকের ধুকপুকানি আর নার্ভাসনেস একদম বুঝতে দিতে চায় না । জানালার বাইরে অনেকটুকু আকাশ দেখা যাচ্ছে । পূর্ণিমার চাঁদটা পশ্চিমে ঢলতে শুরু করেছে । কাছেই বোধহয় কামিনী গাছ আছে । কামিনীর মাতাল করা গন্ধে তার মনটা কেমন উদাস হয়ে গেলো ।একটু দুরত্ব রেখে মুসা বসে বললো, আমাদের তো এই পর্যন্ত ঠিকমতো পরিচয়ই হলো না । আমি মুসা ।অহনা বললো , আমার নাম আপনি জানেন ।তা তো জানিই । আচ্ছা নাম বলতে হবে না । অহনা তুমি কিন্তু আমাকে তুমি করে বলতে পারো । আমি বোধহয় খুব বেশি বড় হবো না তোমার চেয়ে । এই ধরো চার বা পাঁচ ।অহনা মনে মনে বলে, তোমাকে ধরতে আমার বয়েই গেছে । মুখে কিছু বলে না । বাইরের দিকেই তাকিয়ে থাকে ।আমি বোধহয় এতোটাও খারাপ না দেখতে যে মুখটা ওদিকে ঘুরিয়ে রাখতে হবে । কী বলো?হুম, আমি তোমার দিকে তাকাই আর তুমি আমার ওপর ঝাঁপ দিয়ে পড়ো । বুঝিনা মনে করেছো ?কী হলো অহনা , কিছু তো বলো । আমি একাই সব কথা বলে যাচ্ছি । আচ্ছা, তুমি বোধহয় খুব রেগে আছো আমার ওপর তাই না? এভাবে বিনা নোটিশে হুট করে বিয়ে হয়ে গেলো আমাদের । আমিও আসলে এমনটা চাইনি । আব্বার শরীরটা কয়দিন ধরে খারাপ যাচ্ছে আর তোমাকে দেখামাত্রই আব্বা বলে বসলেন যে বিয়ে দিয়ে আজই আমি মেয়ে নিয়ে যাবো । আমাদের কারো বোঝানোতেই কোনো কাজ হলো না । আমি ভেবেছিলাম তোমার মা-বাবা রাজি হবেন না কিন্তু ওনারাও সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেলেন । এখানে আমার আসলে খুব একটা দোষ তুমি দিতে পারো না । প্লিজ কথা বলো অহনা ।অহনা'র ঘুম পাচ্ছে খুব । হাই তুললো কয়েকবার ।আচ্ছা আমি মনেহয় বেশি বকবক করে ফেললাম, তাই না ? ঠিক আছে চলো শুয়ে পড়ি । তুমি তো সারাদিনে এতোটুকুও রেষ্ট নিতে পারোনি । কাল কথা বলবো ।অহনা আঁৎকে উঠে বলে, আপনিও কী এখানে ঘুমাবেন ?আমার তো এখানেই ঘুমানোর কথা । তুমি চাচ্ছো আমি বাইরে চলে যাই ? সেটা কী খুব ভালো দেখাবে? তুমি ভয় পেয়ো না । আমি তোমাকে কোনোভাবেই বিরক্ত করবো না । তুমি নিশ্চিন্তমনে ঘুমাতে পারো । আচ্ছা যাও আমি বিছানায় শুচ্ছি না , ডিভানে যদি শুই তাহলে কোনো আপত্তি আছে?অহনা তবুও চুপ করে থাকে ।তুমি কী কোনো কথাই বলবে না?আমার টাকাগুলো দেন ।টাকা !হুম, সকালে দিয়েছিলাম ।হোহো করে হেসে ওঠে মুসা । কী সাংঘাতিক! এতোক্ষণ পর যাও একটা কথা বললে তাও টাকার কথা ! ভাগ্যিস টাকাগুলো আমার কাছে ছিলো বলে, নাহলে তো এই কথাটাও শুনতে পেতাম না । আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম । বাহ, তুমি তো বেশ বৈষয়িক । আমার তো মনেই ছিলো না। দাঁড়াও দিচ্ছি ।টাকা গুনে মুসা বলে - ওমা তুমি তো বিশাল ধনী । আসতে না আসতেই এতো টাকা পেয়ে গেলে । এই নাও তোমার টাকা ।হাত বাড়িয়ে টাকাগুলো নিয়ে অহনা বলে , কোথায় রাখবো?মুসা আলমারির চাবিটা এনে অহনা'র হাতে দিয়ে বলে , এই আলমারিটা এখন তোমারও । শুধু আলমারিটা হবে কেন? এখানে যা কিছু আমার তার সবই আজ থেকে তোমার ।অহনা উঠে যেয়ে আলমারি খুলে অবাক হয়ে যায়, এতো গোছানো ! একটা ছেলের আলমারি এতো গোছানো থাকে! মানামের আলমারি খুললেই ঝুপঝাপ কাপড় পড়তে থাকে । সে কতোবার বলেছে, এই শেষবারের মতো আমি তোর আলমারি গোছালাম। এরপর আর কোনোদিনও গুছিয়ে দেবো না । মানাম তার গলা জড়িয়ে বলতো , কয়দিন পর তো বিয়ে করে চলেই যাবি ছোটপা । তখন আমি ঠিক গুছিয়ে রাখবো , প্রমিস । ব্যাগে টাকাগুলো রেখে ব্যাগটা আলমারিতে রেখে দিলো সে । কাপড়গুলো কাল গুছিয়ে রাখবে । আলমারি বন্ধ করে বিছানার কাছে আসতেই মুসা দুটো বালিস তুলে নিলো বিছানা থেকে । গুডনাইট বলে ডিভানে যেয়ে শুয়ে পড়লো সে । অহনা ঘাপটি মেরে পড়ে থাকলো যদি হঠাৎ মুসা উঠে আসে সেই দুশ্চিন্তায় । মুসা ঘুমিয়ে গেলো কিছুক্ষনের মধ্যেই কিন্তু অহনা'র কিছুতেই ঘুম আসলো না । সে শুয়ে শুয়ে চাঁদটাকে আরো সরে যেতে দেখলো । রাতের ঝিঁঝির আওয়াজ একসময় থেমে গেলো । পাশেই কোনো মসজিদ থেকে আজান ভেসে আসছে । কে জানে কেন, আজানটা কানে যেতেই সে ডুকরে কেঁদে উঠলো । প্রিয় মুখগুলো ভেসে উঠছে চোখের সামনে । একটা দুটো করে একসময় পাখিদের কিচিরমিচির শুরু হয়ে গেলো । ভোরের বাতাসটা কী ঠান্ডা ! ধীরে ধীরে তার চোখ জুড়ে রাজ্যের ঘুম নেমে এলো ।নির্ঘুম রাত কাটানোর ক্লান্তিই হবে বোধহয় অহনা'র ঘুম ভাঙলো বেশ বেলা করে । কিছুক্ষন সে বুঝতেই পারলো না কোথায় আছে । জানালা দিয়ে বাইরে চোখ পড়তেই মনে পড়ে গেলো সে এখন নতুন ঠিকানায় । ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে মুসাকে খুঁজতে লাগলো দুই চোখ । মানুষটা ঘরে নেই দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মনে মনে । তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে তৈরি হয়ে রুম থেকে বের হয়েই পড়লো বিপদে । এ বাড়ির এখনো সে কিছুই চেনে না । বিশাল বাড়িটার কোনদিকে সে যাবে ঠিক বুঝতে পারছে না । আশেপাশে কাউকে দেখাও যাচ্ছে না । মুসার ওপর ভীষণ রাগ হলো তার । কেমন বেআক্কেল মানুষটা । কোথায় তাকে ডেকে তুলে দেবে তা না করে নিজেই ফিট বাবু সেজে বেরিয়ে গেছে । মুসাকে ফোন করার জন্য মোবাইলটা হাতে নিতেই মনে পড়লো এ বাড়ির কারো নাম্বারই তার কাছে নেই । তখনই দেখতে পেলো বাগান থেকে সবজি তুলে একজন বয়স্ক লোক ভেতরের দিকে আসছেন । অহনা ঠিক চিনতে পারলো না ওনাকে তবে গতকাল দেখেছিলো এটুকু মনে আছে । তিনি কাছে আসতেই অহনা সালাম দিয়ে ওনার হাতের দিকে তাকিয়ে রইলো । সুন্দর করে একটা হাসি দিয়ে তিনি বললেন -কী গো মা একা একা কী করো এখানে?জ্বী মানে....নাও সবজিগুলি ধরো । তোমার হাতে দেখলে তোমার শ্বাশুড়ি কেমন বকা দেয় আমারে দেখো । আবার মনে মনে ঠিকই খুশি হবে ।অহনা ভাবলো, ইনি হয়তো শ্বশুরের অথবা শ্বাশুড়ির ভাই হবেন। সবজির একটা ব্যাগ ওনার কাছ থেকে নিয়ে অহনা ওনার পিছে পিছে রওনা দিলো ।মাত্র তো আসলা মা , আমাদের এই জায়গাটা কিন্তু অনেক সুন্দর । অনেক ভালো লাগবে তোমার । আমি মুসাকে বলে দেবো , তোমাকে যেন সবদিক ঘুরায় ঘুরায় দেখায় । সে কই? রুমে নাকি?জ্বী না , রুমে নেই ।আচ্ছা আচ্ছা চলো দেখি তোমার শ্বাশুড়ি কী করছে ।ওনার পিছে পিছে ডাইনিং হলে এসে দাঁড়ালো অহনা । শ্বাশুড়ি কাজের লোকদের বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন দুপুরে কী কী রান্না হবে । ডাইনিং টেবিলে তিন-চারজন বসে গল্প করছেন। অহনা দেখলো দু'জন নাস্তা খাচ্ছেন । এরাও তাহলে তার মতো দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছে । খিদেয় তার পেটের ভেতর নাড়িভুঁড়ি হজম হবার যোগাড়। টেবিলে তখনো অনেক খাবার কিন্তু সে তো নিজে থেকে যেয়ে খেতে বসতে পারে না আর যারা খাচ্ছিলো তারাও নিজেদের মধ্যে গল্পে এতোটাই মশগুল যে অহনাকে কেউ খেয়ালই করলো না । একজন কাজের লোক ইশারা করতেই শ্বাশুড়ি তাদের দিকে ফিরে তাকালেন । দ্রুত সেই মহিলাকে কিছু একটা বুঝিয়ে দিয়ে তিনি হইহই করে ছুটে এলেন -কী ব্যাপার? ও তোমার সাথে কেন? জোর কীে বাগানে নিয়ে গিয়েছিলে? কীরে মা, তোর শ্বশুর বুঝি এই সবজির বস্তা জোর করে ধরিয়ে দিয়েছে তোর হাতে ! পেয়ারার মা এগুলো নিয়ে যাও বলে জোরে চিৎকার দিতেই একসাথে তিনজন ছুটে এলো ।শ্বশুর! অহনা'র লজ্জায় একদম লাল হয়ে গেলো । মাঝে মাঝে সে যে কী গাধামি করে বসে ! মানুষটাকে তো সে একদম চিনতেই পারেনি । ওনার চার,পাঁচজন ভাইকে সে গতকাল দেখেছিলো । সবাই একই রকম দেখতে । গতকাল সকালের পর ওনাকে আর দেখেনি সে তাই তো এমন বিশ্রী কান্ড ঘটে গেলো । ছিঃ ছিঃ তিনি কী বেআদব মনে করবেন তাকে । অহনা তাড়াতাড়ি যেয়ে শ্বশুর, শ্বাশুড়ি দু'জনকেই পা ছুঁয়ে সালাম করে নিজের ভুলটা স্বীকার করেই ফেললো -মাফ করবেন আংকেল, আমি আপনার চেহারা অন্য চাচাদের সাথে মিলিয়ে ফেলেছিলাম ।সে আমি তখনই বুঝেছি । তোমার তাকানো দেখেই বুঝেছি মা, তুমি আমাকে চিনতে পারোনি । অসুবিধা নাই এখন তো চিনে গেলে, তাই না ?জ্বী আর ভুল হবে না ।আমি কিন্তু একটু মন খারাপ করলাম রে মা ।অহনা অসহায় ভাবে তাকিয়ে থাকে ওনার দিকে ।শুন রে মা , তোর শ্বশুরের খুব শখ আর ইচ্ছার কারণেই এতো তাড়াহুড়া করে বিয়ের কাজ করানো হলো । এখন যদি তুই তাকে আংকেল ডাকিস তার তো মন খারাপ হবেই । আব্বা, বাবা যেইটা খুশি ডাকিস কিন্তু আংকেল ডাকিস না ।জ্বী, মনে থাকবে ।আরে চল চল নাস্তা খাবি চল । একটুপর তো সব দুপুরের খাবার খেতে হাজির হয়ে যাবে । শ্বাশুড়ি তার হাত ধরে নিয়ে খেতে বসালেন । টেবিল ভরা তার পছন্দের খাবার । ভুনা খিচুড়ি আর গরু ভুনাটা এতো বেশি মজা হয়েছে কিন্তু লজ্জায় সে খেতেই পারলো না, যদিও পেটে অনেক খিদে । টেবিলে যারা আগে থেকে বসেছিলো তারা খাওয়া শেষে এবার তার দিকে মনযোগ দেয়ায় তার গলা দিয়ে খাবার নামলো না । অল্প একটু খাবার নিয়ে খেয়ে সে শ্বাশুড়ির পাশে যেয়ে দাঁড়ালো ।কীরে কী খেলি ! এমনই খাওয়াদাওয়া করিস বুঝি বাড়িতে? তাই তো এমন হাড্ডিসার শরীরখানা । আমার কাছে দু'মাস থাকলেই তোর চেহারা পুরো পাল্টে যাবে । তারপর বাপের বাড়ি গেলে দেখবি কেউ আর তোকে চিনতে পারবে না ।বাড়িতে সে আর কোনোদিনই যাবে না । এমন পাষাণ বাবা-মা'র কাছে যাওয়ার আর কোনো ইচ্ছে তার নেই শুধু মানামের জন্য মনটা খারাপ লাগবে মাঝে মাঝে ।শ্বাশুড়ি তাকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে পুরো বাড়িটা দেখালেন আজকে । বিশাল বড় বাড়িটায় এখন লোকজন গমগম করছে । সবাই বিয়ে উপলক্ষ্যে এসেছে কিন্তু সবাই যখন চলে যাবে, বাড়িটায় শুধু শ্বশুর, শ্বাশুড়ি আর কাজের লোকেরা থেকে যায় । মুসার দুই বোন আর বড় ভাই থাকেন সিরাজগঞ্জ শহরে । প্রতি সপ্তাহের শেষে তারা সবাই চলে আসেন ছেলেমেয়ে নিয়ে । তখন বাড়িটা আনন্দে ভরপুর হয়ে থাকে তারপর যে যার জায়গায় ফিরে গেলে আবার সব নিরব । আরেক ভাই ঢাকায় থাকেন ফ্যামিলি নিয়ে । তারা প্রতি সপ্তাহে আসতে না পারলেও মাসে একবার আসে । আর মুসার ঠিক আগেই যে বোন সে থাকে আমেরিকায় । শ্বাশুড়ির কাছ থেকে যতোই গল্প শুনছিলো ওনাকে ততই ভালো লাগছিলো অহনা'র । এখানে আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত ওনাকেই খুব আপন মনে হচ্ছে তার কাছে । তার মা'র ছায়াটা দেখতে পাচ্ছে সে ওনার মধ্যে ।দুপুর, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো কিন্তু মুসাকে সারাদিনে একবারও দেখেনি অহনা । সে ভাবতে লাগলো, একেও কী তার মতো জোর করে ধরে বিয়ে দেয়া হয়েছে নাকি অন্য কিছু । কাউকে মুসার কথা জিজ্ঞেস করলে যদি তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে তাই সে ঐ বিষয়ে কোনো কথাই তুললো না । আসুক যখন খুশি । না আসলেও তো কোনো ক্ষতি নেই । সে বরঞ্চ পুরোটা রুমে আরাম করে থাকতে পারবে ।আজকেও বাবা কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু সে ফোনই ধরেনি । মা'র ফোন থেকে যখন কথা বলতে চেয়েছে, পরে কথা বলবে বলে সাথে সাথে লাইন কেটে দিয়েছি । মানাম ফোন করলো সন্ধ্যার পরে -কীরে ছোটপা কেমন আছিস ?মানামের গলার আওয়াজ শুনে কেমন যে হাহাকার লাগলো বুকের ভেতর । মানাম যতোক্ষন বাসায় থাকে ঘুরেফিরে তাকে বিরক্ত করতেই থাকে । আর ঝগড়া লগলে একই কথা বলতো বারবার, তুই যে আমাকে এতো জ্বালাচ্ছিস সবসময় , দেখিস তোর বিয়ে হবে একটা ইয়া ভুঁড়িওয়ালা আর টাকমাথা লেকের সাথে, পান খেয়ে যার দাঁতগুলো সব তরমুজের বিচি হয়ে আছে । আর দেখিস তোর শ্বশুরবাড়ি হবে টেকনাফ নয়তো তেঁতুলিয়া । ইচ্ছে হলেই তখন ছুটে ছুটে এসে আমার কান মলে দিতে পারবি না । কথাটা মনে পড়তেই হেসে ফেললো অহনা ।কীরে হাসছিস কেন? কেমন আছিস বল?ভালো আছি রে । তুই কেমন ছিলি বলতো? দেখলি মানাম , শকুনের দেয়ায় গরুটা কেমন মরে গেলো ।মানে কী ! কী বলিস তুই এইসব?এই যে তুই সারাক্ষন বলতি যে আমার বিয়ে হবে এতো দুরে যে ইচ্ছে হলেও আর যখন তখন ছুটে আসতে পারবো না । দেখলি তো বাবা আমাকে কোথায় পাঠিয়ে দিলো । দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে অহনা ।অহনা যেন মানামের দীর্ঘশ্বাসের শব্দও শুনতে পেলো । জানিস ছোটপা বড়আপা যাওয়ার পরে ঠিক বুঝতে পারিনি কিন্তু তুই যাওয়ার পর ঘরটা কেমন ফাঁকা হয়ে গেলো । তিনজন মানুষ তিন রুমে থাকি । সব যেন কেমন হয়ে গেলো । আচ্ছা শোন বড়আপা ফোন করেছিলো একটু আগে । খুব কাঁদছিলো রে । ও বেশি ভালো নেই । আচ্ছা নতুন দুলাভাই কেমন মানুষ বলতো ছোটপা? ওখানে সবাই তোর সাথে ভালো ব্যবহার করছে তো?হুম সবাই ভালো আর সবচেয়ে ভালো আমার শ্বাশুড়ি । তুই কবে আসবি আমার কাছে?আসবো তো । আমরা সবাই মিলে আসার প্ল্যান করছি । আমি, রিনি আপু, বড়দা, মাসুদ ভাই সবাই আসবো ।ঠিক আছে রাখছি রে । ভালো থাকিস ।মানামের সাথে কথা বলে মনটা ভীষন উতলা হয় অহনা'র । আপাটা সত্যি খুব বাজে অবস্থায় আছে । অপলাকে ফোন দিলেও ঠিকমতো কথা বলতে পারে না । জনি ফোন কেড়ে নেয় তবুও অহনা ফোন দিলো যদি কথা বলা যায় এই আশায় -হ্যালো আপা কেমন আছিস?ভালো, বলেই কাঁদতে শুরু করলো অপলা ।কাঁদিস না আপা , কথা বল । কী হয়েছে?আমি আর পারছি না অহনা । আর সহ্য করা যাচ্ছে না । এদের সবকিছু আমাদের থেকে ভীষণ আলাদা । বাড়ির পরিবেশ, কথাবার্তা , চিন্তাভাবনা সবকিছু । এমনও মানুষ হয় !তুই ওখানে তারপরও কীসের আশায় পড়ে আছিস? চলে আয় আপা ।এরা আমাকে বের হতে দেয় না । কোথাও যেতে পারি না ।জনি তোর সাথে খারাপ আচরণ করে?ঐটা তো একটা জানোয়ার । সারাদিন কতোগুলো সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে রাস্তায় লোফারগিরি করে আর বাড়ি এসে বোনদের সাথে মিলে আমার পিছে লেগে থাকে । ওর বোনগুলো ওকে চালায় । গাধাটার নিজের কোনো বুদ্ধিই নেই ।ভুল বললি আপা । ও গাধা না , তুই গাধা । ও যদি গাধাই হবে তো তোকে এভাবে ফাঁসাতে পারতো না । ও একটা শিয়াল ।খুব বড় ভুল করে ফেলেছি আমি জীবনে । এখন আর শোধরানোর উপায় নেই । তখন তোদের কথা না শুনে তার শাস্তি আমি হাতেনাতে পেয়ে গেছি । মা-বাবার অভিশাপ লেগেছে আমার ওপর ।তুই কী করবি এখন কিছু ভেবেছিস?আমি জানি না অহনা । এই ক'মাসে আমি একদম অতিষ্ঠ হয়ে গেছি । ওকে বলেছি পর্যন্ত যে আমি ওর সাথে থাকবো না , চলে যাবো ।সে কী বলে?বলেছে তেমন চিন্তা যেন ভুলেও না করি । খুব পস্তাতে হবে তাহলে আমাকে । আর আমি বের হয়ে যাবো কোথায় বল? বাড়ির দরজা আমার জন্য বন্ধ । বাবা আমাকে কোনোদিন মাফ করবে না বলেছে । আচ্ছা তুই কেমন আছিস বল । বাবা এমন হুট করে কী করলো এটা ! তোর শ্বশুরবাড়ির সবাই কেমন রে?তোর কারণেই তো আমার এমন শাস্তি ভোগ করতে হলো, কথা বলতে যেয়েও হজম করে ফেললো সে । আমি ভালো আছি আপা আর এখানেও সব ঠিকঠাক কিন্তু এভাবে থাকলে তো তুই পাগল হয়ে যাবি ।আমার মাঝে মাঝে মাথা নষ্ট হয়ে যায় জানিস অহনা । সব এলোমেলো লাগে, কিছু ভাবতে পারি না । একেক সময় মনে হয় আত্মহত্যা করে ফেলি ।আপা... ধমকে ওঠে অহনা । মানুষের জীবনে এক্সিডেন্ট হয়না? তারা সবাই কী আত্মহত্যা করতে যায় ? কী সব আজেবাজে কথা বলছিস তুই । জনি কী তোর সামনে আছে ? এতোক্ষণ কথা বলছিস কেমন করে ?না, কেউ বাড়িতে নেই । কে যেন মারা গেছে, ওখানে গেছে সবাই ।তোকে ওখান থেকে বেরোতেই হবে আপা ।বের হয়ে কেথায় যাবো বল? বাসায় তো আমার জায়গা হবে না । ক্ষনিকের মোহে আমি সব হারালাম এই জীবনের মতো ।অপলা কেঁদেই যাচ্ছে । অহনা'র খুব ইচ্ছে করছে ছুটে যেয়ে অপলাকে জড়িয়ে ধরতে । সে বললো, শোন আপা বাবা-মায়ের রাগ কয়দিন বাদেই শেষ হয়ে যাবে । বাবা-মা'দের রাগ বেশিদিন থাকে না । তুই শুধু মাথায় রাখ তোকে এই সম্পর্ক থেকে বের হতেই হবে । দেশের আইন এখন অনেক কড়া । নারী নির্যাতন কেসে জড়ালে সহজে পার পাওয়া যায় না । আচ্ছা আমাকে একটা কথা সত্যি করে বলতো আপা, জনির মোহ তোর কী পুরোপুরি কেটেছে? এখনো ভালোবাসিস নাতো ঐ অসভ্যটাকে ?আমি এর হাত থেকে মুক্তি চাই অহনা । যেকোনো উপায়ে , কোনো উপায় না পেলে মরে যেয়ে মুক্ত হবো তবু আমি মুক্তি চাই ।আপা, আবার যদি মরার কথা বলেছিস তো আমি আর কখনো কথা বলবো না তোর সাথে ।মুসা ফিরলো সন্ধ্যার পরে । অহনা তখন শ্বাশুড়ির রুমে । শ্বাশুড়ি জোর করে তার হাতে দুটো সোনার চুড়ি আর গলায় একটা চেইন পরিয়ে দিয়েছেন । বিয়ের দিনেও তিনি একটা চেইন পরিয়ে দিয়েছিলেন । দু'টো চেইন মিলে কেমন গলার ফাঁস মনে হচ্ছে তার কাছে । সে বারবার করে নিষেধ করেছিলো কিন্তু তিনি শুনলেন না । অহনা'র কখনোই এইসব গয়নাগাটি ভালো লাগে না কিন্তু তিনি যেহেতু এতো ভালোবেসে পরিয়ে দিলেন তাই আর কিছু বললো না সে । মুসা রুমে ঢুকতেই শ্বাশুড়ি বললেন -এখন কেমন আছে আলিফের আম্মা ?এখন একটু ভালো ।আলিফ আসলো?হুম, আলিফ আসার পরেই আমি আসলাম । খালাম্মা তো সারাক্ষন অস্থির হয়ে ছিলো । সবাইকে চিনতে পারছেন না । একটু পরপর আমাকে বলছিলেন , মুসা তুই যাবি না , আমার কাছে বসে থাক । রুমা আপা আর খালু মিলে তো ওনারে সামলাতেই পারেনা । তাই ওনারা আমাকে আসতে দিচ্ছিলো না ।হাসপাতালে কয়দিন থাকা লাগবে?জানিনা আম্মা । আলিফ কথা বলবে ডাক্তারের সাথে ।অহনা কিছু বোঝার আগেই মুসা ওর হাতদুটো ধরে বললো , আম্মা এই চুড়িগুলো তোমার না?হুম ।নতুন চুড়ি দাও । আমার বউয়ের হাতে পুরোনো চুড়ি দিলে কেন?"আমার বউ" কথাটা শুনে অহনা'র ভেতরটা হঠাৎ একটু কেঁপে উঠলো । সে ভালো করে তাকালো মুসার দিকে ।আরে বোকা , মুরুব্বীদের গয়নার মধ্যে একটা ভালোবাসা থাকে । এইটা তো আম্মার চুড়ি । আমি কয়দিন হাতে দিয়ে তুলে রেখেছিলাম তোর বউয়ের জন্য । পুরোনা গয়না আমি আমার সব ছেলেমেয়েদেরই দিয়েছি । এগুলো স্মৃতি, এগুলো মা-বাবার দোয়া । এগুলো পুরোনা ডিজাইন, তোর হাতে দিতে ভালো লাগবে না জানি । কয়দিন হাতে থাক তারপর খুলে তুলে রাখিস ।অহনা হাতের দিকে তাকায় । তার হাত দুটো এখনো মুসার মুঠোয় । সে আবার মুসার দিকে তাকাতেই মুসা তাড়াতাড়ি হাত ছেড়ে দেয়................রাতে খাওয়ার পর চাচাতো, মামাতো, খালাতোসহ আরো যতো দেবর ননদ ছিলো সবাই মিলে তাদের নিয়ে আড্ডায় বসলো । এখানে আসার পর একটা জিনিস এখন পর্যন্ত তার খুব ভালো লাগছে , এরা সবাই খুব হাসিখুশি, প্রাণোচ্ছল । সে যে এই বাড়িতে নতুন এসেছে , কারো আচরণে সেটা বোঝাই যাচ্ছে না । মুসার চাচাতো ভাই রোমল একাই আসর জমিয়ে তুলতে ওস্তাদ । রোমেলের সাথে আজ বেশ কিছুক্ষণ গল্প হয়েছে তার । রোমেল নিজেও যেমন গান করে যাচ্ছে একটার পর একটা তেমনি অন্যদের দিয়েও করিয়ে নিচ্ছে যে যেটা করতে পারে । বেশ ভালো গান করে ছেলেটা । অহনা বসেছে মুসার ঠিক উল্টো দিকে । সে খেয়াল করছে , একটু পরপরই মুসা তার দিকে তাকাচ্ছে । কেউ হয়তো গান করছে কিন্তু মুসার চোখ তার দিকে । এমা, কী নির্লজ্জের মতো চেয়ে আছে ! অহনা যতোই ভাবছে আর তাকাবে না মানুষটার দিকে কিন্তু তার চোখও কী কম বেহায়া ! ঘুরেফিরে শুধু মুসার দিকেই তাকাতে হবে তার ! কিছুক্ষণের মধ্যেই দস্যু ভাইবোনের চোখে পড়ে গেলো । সবগুলো একসাথে সোরগোল করে উঠলো , আরে ভাইয়া একটু পর তো ভাবি তোমার সাথে রুমেই যাবে তখন যতো খুশি মন ভরে তাকিয়ে থেকো । এখন তো আমদের একটু সময় দাও ।সবাইকেই কিছু না কিছু করতে হচ্ছে । মুসাকে যতোই বলা হচ্ছে কিন্তু সে কিছুই করবে না । বারবার করে অনুরোধ করার পর বললো, ঠিক আছে আমি দুইটা লাইন বলবো । এটা আমার একটা বন্ধুর লেখা -জীবনটা চলছিলো একটা ছন্দে , ঠিকঠাক ।সবকিছু হচ্ছিলো সময়মতো , নিয়ম মেনে ।আম্মা-আব্বা, ভাই -বোন , বন্ধুরা,সবাইকে নিয়ে আমার বিশাল ভালোবাসার জগৎ ।ভাবতাম, আর কী লাগে জীবনে?এর বেশি ভালোবাসা দিয়ে কী হবে?আমি কী ভুল ছিলাম?হয়তো ছিলাম নতুবা ইদানিংকেন যেন একটা টান অনুভব করি ।কেমন যেন ঘোর লাগা ভাব হয় এখন ।আমাকে কী কিছুর নেশা পেয়ে বসেছে?আমি কী কিছুর টানে ফিরে ফিরে আসছিবারবার সেই একই জায়গায় ?কোনো একটা অবয়ব দেখেছি মাত্র ।এখনো সবকিছু ভাসাভাসা,এখনো বাকী আছে কাছে আসা ।এ কী ভালোবাসা নাকি প্রেম?উত্তর কী আছে জানা তারও?অপেক্ষায় আছি, উতলা লাগে সারাক্ষণ,সত্যিই মন আজ বড়ই উচাটন ।।মুসার এক পুঁচকে খালাতো বোন আছে নওরিন, যে ক্লাস টেনে পড়ে সে ছুটে এসে মুসার গালে টুক করে চুমু দিয়ে বললো, ভাইয়া এত্তো সুন্দর করে কীভাবে বললা? দারুণ হইসে । অহনা'র শরীরটা যেন জ্বলে উঠলো রাগে । ও কেন মুসাকে চুমু দেবে? লজ্জাহীন মেয়ে একটা । পরমুহূর্তেই সে খুব অবাক হলো , তার কেন এতো রাগ হচ্ছে ! সে তো মানুষটাকে পছন্দই করে না । দু'দিন আগেও তো সে চিনতো না এদের কারোকে । ও কারো সাথে লুটোপুটি করুক না জড়াজড়ি করুক, তার কিছু যায় আসে না ।সবাই হৈহৈ করে উঠলো , ভাইয়া এইটা তোমার মনের কথা, তাই না ? তোমার কোন বন্ধু লিখেছে নাম বলোতো দেখি ? ভাবিকে দেখেই তোমার এই ভালবাসার রস নিংড়ানো কাব্য । মুসা যতোই না বলে ওরা কেউ শোনে না তার কথা । মুসা ভীষণ লজ্জা পেয়ে যায় কিন্তু কী করবে সে? তার যে খুব জানাতে ইচ্ছে হচ্ছিলো মনের কথাগুলো কিন্তু অহনা তাকে কোনো সুযোগই দিচ্ছে না । সত্যি তো তার যেন কেমন কেমনতর লাগছে এখন । মেয়েটাকে বলতে গেলে সে চেনেই না , নাম ছাড়া অতটুকুই জানে যতোটুকু আম্মা তাকে বলেছে । এতো অল্প সময়ে কী এতোটা অনুরাগ তৈরি হয় মনে? সে কী শুধুমাত্র মেয়েটা তার বউ বলে? কেমন যে একটা অধিকার এনে দেয় শব্দটা । সে যতোটা অহনা'র দিকে আকর্ষিত হচ্ছে অহনা'রও তো তাই হওয়ার কথা কিন্তু সে তো নির্বিকার । তার ভেতরে কী চলছে মুসা তো কিছুই বুঝতে পারছে না । তাইতো সুযোগ পেয়ে নিজের কথাটা বলে ফেললো সে ।অহনা'র পালা যখন আসলো মুসা বলে উঠলো, আরে ও তো কথাই বলতে পারে না । ওকে ছেড়ে দে তোরা । মুসার কথায় অহনা'র রাগ হলো খুব । আমি খুব পছন্দের একটা কবিতা বলছি, বলেই সে এক নিশ্বাসে"শুনতে পেলাম পোস্তা গিয়ে,তোমার নাকি মেয়ের বিয়ে"পুরো ছড়াটা শেষ করে তবেই থামলো । মুসার দিকে তাকিয়ে দেখলো মুসা খুব অবাক চোখক দেখছে তাকে । রোমেল বলে উঠলো , আরে ভাবি আপনি এইটা কী বললেন! এইটা কী ভাইয়ার জন্য বললেন নাকি? আমাদের ভাই কিন্তু তেমন কালো না আর লেখাপড়ায় কিন্তু অনেক ভালো সবসময় । এতো সুন্দর সন্দেশের মতো প্রেমের কয়টা লাইন বললো আমাদের ভাই তার বদলে আপনি এমন পোড়া রুটির মতো জিনিষ ফেরত দিলেন? অহনা একটু লজ্জা পেলো বোধহয় । তার যে রাগ কোনোভাবেই কমছে না । এখন মনে হচ্ছে এই কবিতাটা বলা ঠিক হয়নি ।আড্ডা ভাঙতে বেশ রাত হয়ে গেলো । মুসার বড় বোন আয়েশা আপু এসে সবাইকে বকাঝকা করে যার যার রুমে পাঠালো । মুসা রুমে এসে দেখলো অহনা বিছানার ধারে ঠিক সেখানেই বসে আছে কাল যেখানে বসে ছিলো । খোলা চুলে কী ভীষন মায়াবতী লাগছে মেয়েটাকে দেখতে । খুব ইচ্ছে হলো কাছে যেয়ে চুলে হাত বুলিয়ে দিতে কিন্তু চিমটির কথা মনে হতেই ইচ্ছেটা দুর করে দিলো মন থেকে । গতকাল অনেক কিছুই বলতে পারেনি , আজ সে কথা গুছিয়ে রেখেছে একান্তে বলার জন্য । ডিভানে চোখ পড়তেই দেখলো বালিশ দুটো আগে থেকেই সেখানে রাখা । বালিশগুলো সারাদিন বিছানাতেই ছিলো । তার মানে অহনা রুমে এসে আগে বালিশ সরিয়েছে যাতে মুসা বিছানায় ঘেঁষতে না পারে । টগবগ করে ফুটতে থাকা আবেগে কে যেন হঠাৎ পানি ঢেলে দিলো ।সে আজ বাড়ি ফেরার সময় অহনা'র জন্য গিফট কিনেছে । এই প্রথম সে মেয়েদের কোনো কিছু কিনলো । আলমারি খুলে ব্যাগটা বের করে সে অহনা'র সামনে দাঁড়ালো । অহনা তখনো বাগানের দিকে তাকিয়ে আছে । মুসা তাকিয়ে দেখলো পূর্ণিমার আলোয় তাদের বাগানটা ভেসে যাচ্ছে একেবারে । অহনা'র আনমনা ভাব দেখে মুসা বললো -তোমার খুব জোছনা ভালো লাগে, তাই না?হুম, বাইরে থেকে চোখ না সরিয়েই উত্তর দেয় অহনা । আমার বাবা'রও খুব পছন্দ পূর্ণিমা রাত । যখনই সুযোগ পাওয়া যেতো বাবা আমাদের ভরা পূর্ণিমায় নতুন নতুন জায়গায় নিয়ে যেতেন জোছনা দেখতে । বাড়ির ছাদ থেকে জোছনা দেখতে একরকম লাগে । একবার বাবা আমাদের সবাইকে নিয়ে বান্দরবান গেলেন জোছনা দেখতে । তার যে কী ভয়াবহ সৌন্দর্য্য! না দেখলে বোঝা যায় না । একবার গেলাম কক্সবাজার । সেবার ছিলো বর্ষায় পূর্ণিমা দেখার প্ল্যান । বৃষ্টির পানির সাথে চাঁদের আলো যেন ঝরঝরিয়ে নেমে আসছিলো । মা ওখানে যাওয়ার আগে খুব রাগ করেছিলো বাবা'র পাগলামি দেখে । বারবার বলছিলো, খামাখা এতোগুলো পয়াসা নষ্ট না করলে কী হয় না তোমার? একে তো চিটচিটে গরম তার ওপর ঘ্যানঘ্যানে বর্ষাকাল । অসহ্য লাগছে আমার । বাবা বলেছিলো , এখনো বুড়ো হতে অনেক বাকি, এতো তাড়াতাড়ি সব অসহ্য লাগলে চলবে? ওখানে গিয়ে যখন সাগরের পানিতে পা ভিজিয়ে তোমার হাতটা ধরে হাঁটবো আর জেছনায় অবগাহন করবো দুজন মিলে, দেখো তোমার ঝিমিয়ে যাওয়া প্রেম, ভালোবাসা আবার মাথাচাড়া দেবে । মা তো আরো রেগে গিয়ে বললো , ছেলেমেয়েদের সামনে মুখে কিছু আটকায় না তোমার, তাই না । ভীমরতিতে ভালোই পেয়েছে তোমাকে অথচ কক্সবাজার যাওয়ার পর ঘটলো উল্টো ঘটনা । মা যেন সত্যি প্রেমের দিনগুলোয় ফিরে গেছে । বাবার হাত ধরে সে কী দৌড়ঝাঁপ! ঝুম বৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি ভিজেছিলো মা । মা যেন কোনো স্কুল পড়ুয়া মেয়ে তখন । পূর্ণিমা দেখার চেয়ে মা'র সেই উচ্ছ্বাস দেখে বেশি ভালো লেগেছিলো সেবার আমাদের । আমাদের গ্রামের বাড়িতে প্রায়ই যাওয়া হতো পূর্ণিমার সময় । একবার হলো কী , চাচা, ফুপু সবার ফ্যামিলি মিলে ঠিক করা হলো চাঁদের আলোর নীচে হবে নৌকা ভ্রমন আর রাতের খাওয়া । বিশাল এক নৌকায় চড়ে সবাই বেরিয়ে পড়লাম । চারদিক শুনশান শুধু আমাদের নৌকাতেই কোলাহল । নদীর ধারের গাছের পাতাগুলো বাতাসে দুলে দুলে নড়ছে । সেখান থেকে ঝিঁঝির ডাক ভেসে আসছে । চাঁদের এতো আলো যে ঘড়ির সময় আর হাতে থাকা পেপারের একটু বড় লেখাগুলো সুন্দর পড়া যাচ্ছে । আপা আমার পাশে বসেছিলো । হঠাৎ শুনি কান্নার ফোঁপানি । আপা কী হয়েছে, এই আপা বল না কী হয়েছে? জিজ্ঞেস করতেই আপা বললো , জানিস অহনা , আমি ঠিক এই দৃশ্যটাই স্বপ্নে দেখেছিলাম । ভরা জোছনায় আমরা নৌকায় ভাসছি । জনির হাত ধরে ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছি দিগন্তের শেষ সীমায় কিন্তু দেখ আজ এতো সুন্দর জোছনা রাতে জনি আমার সাথে নেই । এতো সৌন্দর্য্য আমার একা একা দেখতে খুব কষ্ট হচ্ছে । আমি আর কোনোদিন তোদের সাথে জোছনা দেখতে আসবো না । জনি যেদিন সাথে থাকবে সেদিনই আবার যাবো পূর্ণিমা রাতে আকাশের নীচে । তার কিছুদিন পরই আপা চলে গেলো বাড়ি ছেড়ে জনির হাত ধরে আর ওর জীবনটা অমাবস্যাময় হয়ে গেলো ।সেবার আমরা দার্জিলিং যাবো পূর্ণিমায় । চাঁদটাকে আরো হাজার মাইল কাছে থেকে দেখা যাবে । মানাম তো মা'কে পটিয়ে একটা ডিএসএলআর কিনে ফেললো । বাবার সে কী খুশি । ঘুরে ঘুরে টুকটাক জিনিসপত্র কিনছে । শীতের কাপড় কিনলো অকারণে একগাদা । সব ঠিকঠাক, যাওয়ার আগের রাতে মানামের চোখে পড়লো চাঁদটা । দুদিনের বাচ্চা চাঁদ । যারা জোছনা পাগল মানুষ তারা কিন্তু পূর্ণিমা-অমাবস্যার হিসেব রাখে খুব । সবার তো হাহুতাশ শুরু হয়ে গেলো । এমন ভুল হলো কীকরে ? আসলে আমরা মানামের পরীক্ষার ফাঁকে যে ছুটি ছিলো ঐ সময়টাকেই বেছে নিয়েছিলাম । আমার বাবা হলো চন্দ্রগ্রস্থ মানুুষ । আমি ভেবেছিলাম বাবা সবচাইতে বেশি আফসোস করবে অথচ আমাদের সবার মন ভালো করার জন্য বাবা বললো , দুনিয়াতে কী শুধুই পূর্ণিমাই আছে নাকি? আল্লাহর এই দুনিয়ায় আরো কত কিছু যে দেখার আছে বাকি । আমরা তো সমতলের মানুষ । এবার চল পাহাড় দেখে আসি । এতো আমাদের দেখা পাহাড়গুলোর চেয়ে একটু আলাদা । হিমশীতল ঠান্ডার সাথে নতুন মানুষ, নতুন সংস্কৃতি সবই ভালো লাগবে, চল তোরা । সত্যিই ভীষণ ভালো লেগেছিলো দার্জিলিং। ছবির মতো সুন্দর কিছু কিছু জায়গা । ওরা তো ওদের পর্যটন টাকে সত্যি শিল্পের ছোঁয়া দিয়ে রেখেছে আর আমরা আমাদের প্রকিতিকে সৌন্দর্য্যের বদলে ডাস্টবিন বানিয়ে রেখেছি । দার্জিলিং গিয়ে আমার এ পার্থক্যটা দেখে খুব মন খারাপ হয়েছিলো । আমাদেরও তো কত জায়গা আছে কিছু সাজানো, গোছানোর মানসিকতা নেই ।মুসাও যেন চন্দ্রগ্রস্থ, মোহগ্রস্ত হয়ে ছিলো এতক্ষণ । এতো কথা বলতে পারে মেয়েটা ! এতো সুন্দর করে অথচ আজ তিনদিনে টাকা চাওয়া ছাড়া আর কোনো কথাই বললো না তার সাথে ! একটু সামলে মুসা জিজ্ঞেস করলো , তোমার আপাকে তো দেখলাম না সেদিন । আমি অবশ্য মেহরাবের কাছে কিছু ঘটনা শুনেছিলাম ।অহনা'র যেন এতোক্ষণ কোনো বোধই ছিলো না । সে যে মুসার সাথে এতো কথা বলেছে এটা তার মনেই ছিলো না । সে যেন নিজের সাথেই কথা বলছিলো এতক্ষণ । ভীষণ রাগ হলো নিজের ওপর । ধ্যাৎ কী দরকার ছিলো এত কথা বলতে যাওয়ার । সে জিজ্ঞেস করলো , আপনি আমার বড়দাকে চেনেন?বড়দা, মানে মেহরাব? ওর জন্যই তো তোমার দেখা পেয়েছি । আমাদের বিয়ের ঘটক হলো তোমার বড়দা । ও তো আমার স্কুল ফ্রেন্ড ।অহনা খুব অবাক হলো , বড়দা এমন চুপেচাপে এমন একটা কান্ড ঘটিয়ে দিলো ! সারাক্ষণ তাদের বাসায় যাওয়া-আসা করছে অথচ তাকে একবারও বলার প্রয়োজন মনে করলো না ? তাকে তেপান্তরে পাঠানোর পেছনে তাহলে বড়দারও হাত আছে?মুসা ব্যাগটা অহনা'র দিকে বাড়িয়ে দিলো , এখানে একটা শাড়ি আছে । আমি আজ প্রথম শাড়ি কিনলাম । হয়তো তোমার পছন্দ হবে না । পছন্দ না হলেও নাও। রেখে দিও, পরতে হবে না । আমি খুব ভালোবেসে কিনেছি অহনা । খুব কিনতে ইচ্ছে হলো আজ । বাসায় আসার সময় কিন্তু খুব লজ্জা লাগছিলো । সবাই কী ভাববে এই চিন্তায় প্যাকেট থেকে বের করে ল্যাপটপের ব্যাগে ভরে এনেছি । আরেকটা জিনিস আছে, জানিনা তোমার ফিট হবে কিনা । আমি অবশ্য তোমাকে দেখে আন্দাজ করে এই সাইজটা নিয়েছি । খুলে দেখো ।শাড়ি পর্যন্ত ঠিক ছিলো কিন্তু আরেকটা কী জিনিস এনেছে মুসা যেটা তাকে দেখে আন্দাজ করে কিনেছে ? ভয়ে ব্যাগ খুলতে সাহস হচ্ছে না তার । কী বেরোতে কী বেরোয় তারপর বন্ধ ঘরের ভেতর কী একটা অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়তে হবে তাকে । মুসাকে একটু একটু ভালো মানুষ মনে হচ্ছিলো তার কাছে কিন্তু এ তো পুরোই বিটকেল । কালকে কাছে আসতে না দেয়ায় আজকে অন্য পথ ধরেছে । অহনা সোজা বলে দিলো, সে এখন ব্যাগ খুলবে না । কাল সকালে দেখে নেবে । তবুও মুসা সরছে না সামনে থেকে ।প্লিজ একটু খুলে দেখো । আমি খুব শখ করে এনেছি । এটা আমার একটা ছোট্ট অনুরোধ ।এতো রাতে এ কী যন্ত্রণা? অহনা ঠিক করলো ব্যাগ খোলার পর যদি উল্টোপাল্টা কিছু বের হয় তাহলে যে গালে নওরিন চুমু দিয়েছে সেই গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দেবে । ভয়ে ভয়ে ব্যাগটা খুলতেই টকটকে লাল একটা জামদানী দেখতে পেলো অহনা । সে খুব ভালো শাড়ি চেনে না কিন্তু এই শাড়িটা দেখে ভালো লাগলো । পাশেই ছোট একটা ব্যাগ । এটার মধ্যেই তাহলে সেই জিনিসটা । ব্যাগটা খুলতেই ছোট্ট একটা অর্নামেন্টস বক্স বের হলো । বক্সটা হাতে নিয়ে মুসার দিকে তাকালো সে । মুসাও তাকিয়ে আছে তার দিকে । বক্সটা খুলতেই সুন্দর ডিজাইন করা একটা আংটি উঁকি দিলো । মুসা আস্তে করে বললো, একবার হাতে দিয়ে দেখোনা প্লিজ । অনিচ্ছা সত্ত্বেও আংটিটা অনামিকায় পরলো অহনা । যদিও একটু বড় কিন্তু আংটিটা তার হাতে যেন অনেক সুন্দর মানিয়েছে । মনে মনে লজ্জা পেলো ভীষণ। সে কী সব হাবিজাবি ভাবছিলো এতক্ষণ ছিঃ । বারবার সে মানুষটাকে খারাপ ভাবছে আর মানুষটা তার ভাবনাগুলোকে ভুল প্রমান করছে । আংটি আর শাড়ি আলমারিতে রেখে অহনা দেখলো রাত প্রায় শেষের দিকে । গতকাল অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে সে । আজ সকাল সকাল উঠতেই হবে । শোয়ার আগে আরো একবার জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো সে । বৃষ্টি হয়েই যাচ্ছে অবিরাম । হালকা ছাঁট এসে লাগছে তার চোখেমুখে । অহনা বুঝতে পারলো মুসা এসে আবারো দাড়িয়েছে তার পেছনে । এখন আবার কী চায়? বালিশ নিয়ে চলে আসেনি তো? সে ঘুরে তাকাতেই মুসা বললো -একটা কথা বলবো অহনা মানে আরেকটা ছোট্ট অনুরোধ ।অহনা উত্তর না দিয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো ।তোমার গালের ওপর যে এলোমেলো চুলগুলো লুটিয়ে আছে আমি কী একটু ধরতে পারি ? গুছিয়ে কানের পাশে গুঁজে দিই ? ভীষণ রকমের ইচ্ছে করছে , ভীষণ ।অহনা কী বলবে বুঝতে পারে না । অহনার অনুমতির তোয়াক্কা না করে মুসা আনাড়ি হাতে চুলগুলো গুছিয়ে কানের পাশে গুঁজে দেয় । যাওয়ার সময় আলতো করে গালটা ছুঁয়ে দিয়ে যায় আর বলে , আমরা দুজন পূর্ণিমার রাতে দার্জিলিং যাবো , ঠিক আছে অহনা । দার্জিলিং এর জোছনা তোমার দেখা হয়নি , এবার দুজন একসাথে দেখবো ।এতোটুকু ছোঁয়ায় শরীরে একটা ঝাঁকুনি লাগলো যেন । বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে । মানুষটা কী চুপিচুপি তার হৃদয়ে কড়া নাড়তে শুরু করেছে ? সে তো ঠিক করেছিলো বাবা'র পাশাপাশি মুসাকেও সে কক্ষোনো ক্ষমা করবে না । তাহলে তার এমন লাগছে কেন? তাকিয়ে দেখলো মুসা দেয়ালের দিকে ফিরে ডিভানে শুয়ে আছে । সে তেমনই দাঁড়িয়ে থাকলো আরো কিছুটা সময় ।শ্বাশুড়ির ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙলো অহনার -কীরে মা আর কতক্ষণ ঘুমাবি? এবার ওঠ তাড়াতাড়ি । ঘড়ির কাঁটা তো বারোটা ছুঁই ছুঁই ।অহনা চোখ খুলতেই শ্বাশুড়ির হাসি হাসি মুখটা দেখতে পেলো । ইশ, আজও সে এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে? আটটায় এলার্ম দিয়ে শুয়েছিলো অথচ এখন প্রায় বারোটা । ভয়ে ভয়ে ডিভানের দিকে তাকালো । মুসাকে ডিভানে ঘুমাতে দেখলে শ্বাশুড়ি নিশ্চয়ই মনে কষ্ট পাবেন । শূন্য ডিভান দেখে একটু স্বস্তি পেলো সে । শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে অপরাধীর ভঙ্গিতে বললো, সরি । আর হবেনা ।আচ্ছা পরে দেখা যাবে, ওঠ শিগগির । দেখ কারা এসেছে তোকে দেখতে?কারা আম্মা ?এ দেখ , পিছে তাকিয়ে দেখ দরজায় কে দাঁড়িয়ে আছে ।ড্রেসিং টেবিলের আয়না দিয়ে অহনা দেখতে পেলো মা দরজায় দাঁড়ানো । কাল বিকেলেও মা'র সাথে কথা হয়েছে তার তখন তো মা কিছুই বলেনি তাকে । সবাই যে কী লুকোচুরি শুরু করেছে তার সাথে, আগে থেকে সে কিছুই জানতে পারছে না । অহনা দৌড়ে গিয়ে মা'কে জড়িয়ে ধরলো -মা তুমি আসবে এটা কাল বলনি কেন আমাকে ?মানাম, রিনি ওরা গতকাল ঠিক করেছে যে আজকে তোর এখানে আসবো সবাই । আমি তোর শ্বাশুড়ির সাথে বলেছিলাম রাতে । উনিও বললেন, না জানিয়ে এসে তোকে চমকে দিতে ।শ্বাশুড়ির দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করে অহনা , আম্মা আপনি জানতেন ?হুম, ইচ্ছে করেই বলিনি তোকে । বললে তো আর মজাটা থাকলো না । এখন তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে ডাইনিং রুমে আয় । সবাই অপেক্ষা করছে তোর সাথে দেখা করার জন্য ।অহনা চলে গেলে অহনার মা শ্বাশুড়ির হাত ধরে বললেন , থ্যাংক ইউ আপা ।কেন আপা, কীসের জন্য ধন্যবাদ ?আমার মেয়ে খুব বলে আপনার কথা । একা একা এতো দুরে চলে এসেছে মেয়েটা । আপনি যে ওকে এতো আদর দিয়ে আপন করে নিয়েছেন এর জন্য আমি কৃতজ্ঞ ।কী বলেন আপা এইসব ? ও তো এখন আমারও মেয়ে । আমি আলাদা করে কী কিছু করি ওর জন্য? এতো শখ করে ছেলে বিয়ে দিলাম । মেয়েটার সাথে খারাপ ব্যবহার করে আমার কোনো লাভ আছে বলেন ? ও যদি খারাপ থাকে তাহলে আমার ছেলেও খারাপ থাকবে ।সবাই এভাবে ভাবে না আপা । আমার মেয়েটার সত্যি কপাল ভালো যে আপনার মতো শ্বাশুড়ি পেয়েছে ।একটা মেয়ে কতো কষ্ট বুকে নিয়ে মা-বাবার সংসার ছেড়ে একদম নতুন একটা জায়গায় আসে । শ্বশুরবাড়ির লোকেরা যদি তার সাথে খারাপ ব্যবহার করে , জোর করে সব জিনিস তার ওপর চাপিয়ে দেয় সেটা খুব অন্যায় করা হয় মেয়েটার সাথে । আমারও তো মেয়ের বিয়ে হয়েছে । ওদের কোনো কষ্ট দেখলে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে । আমার অন্য ছেলেদের বউদের সাথেও আমার খুব ভালো সম্পর্ক । ছুটি পেলেই ছুটে চলে আসে আমার কাছে ।আপনার মনটা অনেক বড় আপা ।আপারে এক জীবনে অনেক কষ্ট করেছি । টাকার কষ্ট না, মানসিক কষ্ট । আমার শ্বাশুড়ি আমাকে যেভাবে জ্বালিয়েছে , আমি তো কারো কাছে যেয়ে বলতে পারতাম না । মা ছিলো না , আর কার কাছে বলবো ? মুখ বুঁজে সব সহ্য করেছি । আশায় ছিলাম, একদিন নিশ্চয়ই তিনি আমাকে পছন্দ করবেন । তিনি আমাকে ভালোবাসলেন ঠিকই কিন্তু ততদিনে আমার জীবনের সব সাধ-আহ্লাদ শেষ হয়ে গেছে , স্বপ্নগুলো মরে গেছে । তখনই মনে মনে ঠিক করেছিলাম , আমি আমার ছেলের বউদের সাথে কক্ষনো খারাপ ব্যবহার করবো না । ভালো ব্যবহার করতে বেশি কিছু লাগেনা আপা শুধু মনটা একটু উদার করতে হয় । যে মেয়েটা আমার বাড়িতে আসলো সে'ও তো কারো অনেক আদরের মেয়ে । তার বাপ-মা'ও তো তাকে কিছু শিখিয়ে বড় করেছে । একটু ভালোবাসা দিয়ে, একটু ধৈর্য্য ধরে তাকে একটু সময় দেই আমি । সে নিজের মতো করে মন থেকে আমাদের সবাইকে আপন করে নিক । সেটাতে অনেক বেশি আনন্দ, অনেক আন্তরিকতা থাকে আপা ।অহনা'র মা'র চোখের কোন বেয়ে জল গড়ালো , আনন্দ অশ্রু । সত্যিই তার এই মেয়েটাকে নিয়ে আর কোনো ভাবনা নেই তার....................অহনা লিভিংরুমে ঢুকে দেখলো মানাম, রিনি, বড়দা ছোট চাচা আর বড় খালার সাথে বাবাও এসেছে । বাবাকে দেখে তার অভিমান যেন আবার উথলে উঠলো । রিনিকে দেখে কী যে ভালো লাগছে । কত কথা জমে আছে বলার জন্য । মনে হচ্ছে কত জনম রিনির সাথে কথা হয় না । সবাই একসাথে জানতে ব্যস্ত হয়ে গেলো কেমন আছে সে ? মানামকে দেখে ইচ্ছে করছে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখতে কিন্তু নিজেকে সংযত করলো সে । এই যে ভাইটার সাথে দুরত্ব তৈরি হয়ে গেলো, এ দুরত্ব সারাজীবনের । মাত্র ক'দিন আগেও তাদের মধ্যে যে খুনসুটি চলতো তা একটা সম্পর্কের বেড়াজালে আটকা পড়ে গেলো । দুজনের সারাক্ষন ঝুটোপুটি ঝগড়া, প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তার শখের জিনিসটা নষ্ট করে চুপ করে সরে পরা , বাইরে থেকে ঘরে ফেরার সময় পছন্দের খাবার অল্প হলেও দু বোনের জন্য নিয়ে আসা, এই ছোটখাটো আনন্দগুলো আর আগের মতো করে আসবে না জীবনে । খুব কষ্টে চোখের পানি আটকালো অহনা । বড়দা সামনে আসতেই চাপা রাগে ফেটে পড়লো অহনা -বড়দা, আমি কী তোমার বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছিলাম কখনো যে তুমি এমন একটা প্রতিশোধ নিলে আমার সাথে ?কী করলাম বলতো? এই জন্যে মানুষের উপকার করতে হয় না ।আমার উপকার করতে কে বলেছিলো তোমাকে?যে'ই বলুক তার কথাটা শোনা আমার উচিৎ হয়নি, এখন বুঝতে পারছি । তুইও অনন্ত আকাশ নামে কারো সাথে পালিয়ে যেতিস আর পালানোর পর দেখতি সে হয়ে গেছে গাঞ্জা মফিজ ।কী বলো এইসব !ঠিকই বলি যা বলি । বোকা গাধাটাই পালিয়ে গেলো আর তুই তো একটা শিয়াল ।আমি শিয়াল ! বড়দা খুব খারাপ হচ্ছে কিন্তু ।বাদ দে ফালতু কথা । একটু শুকরিয়া করতে শিখে যা বুঝলি । কার সাথে জীবনটা জুড়ে গেছে ক'দিন পরে বুঝবি । মানুষ চিনতে শিখলি না এখনো ।মাফ করো বাবা ,খুব ভুল হয়েছে আমার । আমার খুব উপকার করেছো তুমি তোমাদের সবার কাছ থেকে দুরে সরিয়ে দিয়ে ।বিয়েটাতো ভাগ্য রে বোন । কাকে কোথায় নিয়ে যায় আগে থেকে কী কেউ জানে কখনো ? কেন এরা কী তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করে ? করার কথা না । খালাম্মার মতো মানুষ হয়না । হয়না মানে হয়না । মুসা কিন্তু ভীষণ ভালো একটা ছেলে । তুই নিজে সারাজীবন খুঁজলেও এমন পাবি না ।আমি কী কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেছি বলো? এখানে সবাই অনেক ভালো বড়দা । আমার শ্বাশুড়ি খুব, খুব ভালো মানুষ ।আর মুসা?জানিনা , তোমার বন্ধু তুমি ভালো জানো তাকে । বড়দা একটা কথা বলবো ?কী কথা বলনা।এবার আরেকটা উপকার করে দাও বড়দা । আপা খুব কষ্টে আছে । ওকে ওখান থেকে বের করে নিয়ে এসো বড়দা প্লিজ ।ওর কথা আমাকে বলবি না । অন্য কিছু বল অহনা ।এমন করে বলোনা প্লিজ । বাবা রাগ হয়ে আছে, তুমিও যদি এমন করো তাহলে কার কাছে যাই আমি ?যখন হাজার বার করে বললাম ছেলেটা খারাপ, ওখান থেকে সরে আয় তখন খুব বড় বড় কথা শুনিয়েছিলো আমাকে । তুই ভুলে যেতে পারিস আমার সব মনে আছে ।বড়দা তুমিই তো বললে, ও বোকা আর গাধা । সেটা ভেবেই নাহয় মাফ করে দাও ।তুই কী থামবি?প্লিজ বড়দা...ধ্যাৎ , আসলাম একটা ভালো মুড নিয়ে আর তুই.... আচ্ছা বল কী করতে হবে?আপা অনেক ভাবেই চেষ্টা করেছিলো জনির কাছ থেকে সরে আসার কিন্তু.....জনি না জব্বার ।আচ্ছা ঠিক আছে জব্বার । সে বলেছে আপাকে ছাড়বে না । ডিভোর্স নেয়ার চেষ্টা করলে খুব বিপদে পড়ে যাবে আপা । ওর বোনগুলোও খুব অত্যাচার করছে আপার ওপর ।বললেই হলো ছাড়বে না । আমাকে অপলার নাম্বারটা দে । দেখাচ্ছি মজা জব্বারের গুষ্টিকে । অপলাকে তো আনবোই আর ওরা যদি বেশি বাড়াবাড়ি করে তো কেরানিগঞ্জ পাঠিয়ে ছাড়বো সবগুলোকে ।কেরানিগঞ্জে কী আবার!তোর আরেকটা শ্বশুরবাড়ি । দিনদুনিয়ার খবর রাখিস কিছু? শুধু গল্পের বইয়ে মুখ গুঁজে থাকিস না জ্ঞানের বইও একটু পড়িস । ঢাকা জেলটা কী আর আছে এখানে? সে তো এখন কেরানীগঞ্জে । আর তুই চোখ মোছ । ঐ দেখ মুসা কথা বলছে খালুর সাথে কিন্তু চোখ আমাদের দিকে । ও বেচারা নির্ঘাত ভাবছে যে তুই শ্বশুরবাড়ির নামে বদনাম করছিস । এই তুই খালুর সাথে কথা বলছিস না কেন রে? খালা বললো, তুই নাকি আসার পর থেকে একবারও খালুর সাথে কথা বলিসনি । যা এক্ষুনি গিয়ে কথা বল ।না, আমি বাবা'র সাথে জীবনেও কথা বলবো না । বাবা সারাজীবন মিথ্যে বলেছে আমাদের সাথে । বিয়ে দিয়ে একদম কাছে রাখবো , যেই ছেলের বাড়ি ঢাকার বাইরে তার সাথে মেয়ের বিয়েই দেবো না । এইসব তাহলে কেন বলতো এতোদিন ? আপা পালিয়েছে তো এতে আমার দোষ কোথায় ! আমি কখনো বাবা-মাকে ছাড়া থেকেছি তুমি বলো ? আমার ফ্রেন্ডরা কতো জায়গায় বেড়াতে যায় কিন্তু রাতে থাকতে হবে দেখে আমি কোথাও যাইনি ওদের সাথে । বাবা এগুলো একবারও চিন্তা করলো না?শুধু নিজেদেরটাই বুঝলি? খালা-খালুর টেনশন , তাদের কষ্টটা একবার চিন্তা করলি না । এতো আদরের মেয়েটা যখন বাপ-মাকে লজ্জায় ডুবিয়ে দিয়ে একটা কুলাঙ্গারের সাথে পালিয়ে যায় এটার জ্বালা কতটুকু একবার ভেবে দেখেছিস ? শুধু যে অপমানিত হয়েছে তা তো না, মেয়েটা যে ভালো নেই, মেয়েটা যে রাতে ঘুমোতে পারেনা, এই যন্ত্রণা তো তাদের কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে । যা খালুর সাথে কথা বল ।মেহরাব বলার পরও অহনা'র অভিমান কমে না বাবা'র ওপর । সে তাকিয়ে দেখে মুসা আর বাবা গল্পে একেবারে মশগুল হয়ে আছে । বাবা'র বোধহয় খুব ভালো লেগেছে মুসাকে । অহনা সেদিকে না যেয়ে অন্যদের সাথে গল্প করতে লাগলো । বাবা যতোবারই তার দিকে তাকিয়েছে সে তাতবার চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে ।সবাই খুব খুশি অহনা'র শ্বশুরবাড়ি এসে । তাদের আন্তরিকতায় সবাই মুগ্ধ হয়ে গেলো । এতো অল্প সময়ের মধ্যে মুসার মা সকলের জন্য নতুন কাপড় আনালেন । অহনা ভাইবোনকে ঘুরে ঘুরে পুরো বাড়ি , বাগান সব দেখালো যদিও সে নিজেই খুব ভালো চেনেনা এখনো সবকিছু । বিশাল বাগান আর পরিচিত, অপরিচিত হরেক রকমের গাছ সবাইকে মুগ্ধ করলো খুব । মানাম আর রিনি ঠিক করলো যে তারা এখানে রয়েই যাবে ।দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর সবাই একটু এদিক ওদিক গড়ালে বাবা অহনার পাশে এসে বসলো -কেমন আছিস মাগো?অহনা কোনো কথা বলে না । মাথা নিচু করে বসে থাকে ।কী কথা বলবি না আমার সাথে? রাগ করেছিস বাবা'র সাথে? আমার সাথে রাগ করে থাকতে পারবি তুই?অহনা তবুও কোনো কথা বলে না । মনে হচ্ছে সে একাই আছে এখানে । আশেপাশে কোথাও কেউ নেই ।একটু পর তো চলেই যাবো তোকে ছেড়ে । একটু কথা বল আমার সাথে । এই ক'দিন যতোবার ফোন দিলাম তুই একবারও কথা বললি না আমার সাথে । আমার কতো কষ্ট হয়েছে তুই কী জানিস না মা ?তুমি কী জানো বাবা আমার কতো কষ্ট হয়েছে? তুমি কী জানো কোনো রকম প্রিপারেশন ছাড়া হুট করে আমাকে বলা হলো "তোকে দেখতে আসছে । " সেই ধাক্কা সামলানোর আগেই সমন জারি হলো "এবার তোর বিয়ে।" আমি কিছুই জানতে পারলাম না বাবা । কার সাথে বিয়ে হচ্ছে , কী তার নাম? এমনকি তার চেহারাটা ঠিকমতো দেখার আগে আমার বিয়ে হয়ে গেলো তার সাথে । জানো বাবা নিজেকে আমার সত্যিই কোরবানির গরু মনে হচ্ছিলো তখন । আমি তো বারবার করে বলেছিলাম যে তোমাদের পছন্দের ছেলেকেই বিয়ে করবো তাহলে কেন বাবা এই অন্যায় আমার সাথে? আমাদের তো বন্ধুর মতো সম্পর্ক ছিলো বাবা । তুমি আমাকে না বলে এমন একটা কাজ কী করে করলে বাবা? একদিক দিয়ে ভালো হয়েছে জানো, আমার যে এতো দুরে বিয়ে দিলে এতে আমি খুব খুশি । আরো দুরে দিলে আরো খুশি হতাম । আমি আর কক্ষনো তোমাদের বাড়িতে যাবো না, কোনোদিনও না ।মা'রে এভাবে কথা বলিস না আমার সাথে । আমার খুব কষ্ট হচ্ছে । ফাঁকা বাড়িঘরে আমি যে কী করে আছি আমি জানি । আমার বাড়ির প্রান তো চলে গেছে । এখন শুধু পরিস্থিতি মেনে নিয়ে বেঁচে থাকা । মাত্র ক'মাসে আমার ভরা ভরা বাড়িটা কেমন সুনসান হয়ে গেলো ।অহনা আর কোনো কথা বলে না ।আনন্দের দিনগুলো যেন তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায় । বিদায় নেয়ার সময় রিনি হুট করে বলে ফেললো, আন্টি অহনা আর ভাইয়াকে আজকে নিয়ে যাই আমাদের সাথে? মুসার মা কোনে উত্তর দেয়ার আগেই অহনার মা বললো -না, না ও এখন কেন যাবে আমাদের সাথে ! আমরাই তো আসলাম ওকে দেখতে । সারাদিন কাটালাম একসাথে । ওরা কয়দিন পরে যাবে ঢাকায় । অহনা'র খুব ইচ্ছে করছিলো সে সবার সাথে চলে আসে কিন্তু সে বুঝে গেছে কোনোকিছুই আর আগের মতো নেই । ইচ্ছে হলেই যখনতখন যা খুশি তা করার দিন শেষ । তার শ্বশুড়বাড়ির লোকেরা অনেক ভালো, এখন সে যাওয়ার কথা বললে তারা হয়তো কিছু বলবে না কিন্তু তার নিজেরই উচিৎ হবে না তেমন কিছু করা । বিয়ে নামের এই বন্ধনটা দায়িত্বের বেড়াজালে জড়িয়ে ফেলেছে । না চাইতেও অনেক কিছু করতে হয় আবার চাইলেও অনেক কিছু করা যায় না । আর সে তো বাড়িতে আর কখনোই যাবে না । সবাই যখন চলে আসছে অহনা'র বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে । সে তাড়াতাড়ি সরে যায় ওখান থেকে ।আজ বেশ আগেভাগেই চলে এসেছে তারা রুমে । মুসা এসে দেখলো অহনা সেই আগের জায়গাটাতেই বসে আছে । সে কাছে এসে বললো -তোমার বোধহয় এই জায়গাটা খুব পছন্দ, তাই না?অহনা কোনো কথা বললো না । বাগানের দিকে তাকিয়ে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে পা নাড়াচ্ছে ।তুমি কিন্তু খুব প্রানবন্ত একটা মেয়ে। কী হাসিখুশি ছিলে আজকে সারাটা দিন । খুব ভালো লাগছিলো তোমাকে দেখতে । আমি ভেবেছিলাম তুমি বুঝি একটু গম্ভীর স্বভাবের । আমারও খুব ভালো লেগেছে তোমাদের বাসার সবাইকে । প্রথমদিন তো তেমন কোনো কথাই হয়নি কারো সাথে । আচ্ছা মানামের সাথে তোমার মনেহয় খুব বেশি খাতির, তাই না ? ও যাওয়ার সময় একদম মনমরা হয়ে ছিলো । ওকে রেখে দিতে দু'দিন তোমার কাছে । তাহলে তোমার মনটাও ভালো থাকতো । আচ্ছা তোমার নতুন সেমিস্টার কবে থেকে শুরু বলো তো ? তোমার ভার্সিটির একটা শাখা কিন্তু আমাদের শহরেও আছে । তুমি ইচ্ছে করলেই পরেরটুকু এখান থেকে করতে পারো ।অহনা কোনো কথারই কোনো উত্তর দেয় না । চুপ করে শুনে যায় ।হঠাৎ মুসার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো । সে ভেবেছিলো আজ বোধহয় অহনা তার সাথে মন খুলে কথা বলবে । এই কয়দিন সে তাকে সময় দিলো সহজ হওয়ার জন্য । বন্ধ দরজার ভেতরে থেকেও তারা একদম অচেনা মানুষের মতো কাটিয়েছে আগের রাতগুলো । প্রতিদিন সে তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে অহনা'র কাছে এসেছে । আজ বোধহয় অহনা সহজ হবে, আজ বোধহয় অহনা মনের কথা বলবে তার সাথে । প্রতিদিনই সে মন খারাপ নিয়ে ঘুমাতে গেছে । আজ সে নিশ্চিত ছিলো, আজ অহনা তার সাথে স্বাভাবিক আচরণ করবে । মুসা জিজ্ঞেস করলো , অহনা একটা কথা বলবে আমাকে?অহনা পা নাড়ানো বন্ধ করে মুসার দিকে এক পলক তাকায় । এই তাকানোটা বড় অস্থির করে দেয় তাকে । যে কয়বার অহনা তার দিকে এভাবে তাকিয়েছে, ভেতরে তোলপাড় শুরু হয়েছে । কেমন যেন একটা ঘোরলাগা নেশা আছে ঐ চাহুনিতে । ঘোর কাটিয়ে মুসা বলে, অহনা তোমাকে কী জোর করে ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়েছে তোমার মা-বাবা? আমি আজ দেখেছি , তুমি সবার সাথেই হাসিখুশি ভাবে কথা বলছিলে শুধু তোমার বাবা'র সাথে কথা বলার সময় মনে হলো খুব রাগ আর বিরক্ত হয়ে আছো । তোমার কোনো সমস্যা থাকলে তুমি আমাকে বলতে পারো । না বললে তো বুঝবো না কী চলছে তোমার মনের ভেতর ।অহনা তবুও কিছু বলে না । মাথা নিচু করে বসে থাকে ।অহনা শুধু একটা কথার উত্তর দাও তো , তুমি কী কাউকে পছন্দ করতে মানে কারো সাথে তোমার রিলেশন ছিলো? আমাকে বলতে পারো । আমি কিছু মনে করবো না ।অহনা'র নিরব থাকাতে মুসা কী বুঝলো কে জানে, বিছানা থেকে বালিশ দু'টো তুলে নিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে ডিভানের দিকে চলে গেলো ।অহনা'র খুব বলতে ইচ্ছে করছিলো , প্লিজ তুমি যেয়ো না । আমিও তোমাকে অনেক কথা বলতে চাই কিন্তু তুমি সামনে আসলে কেন যেন বোবা হয়ে যাই । সত্যি আমার খুব রাগ ছিলো তোমার ওপর । আমি ঠিক করেছিলাম বাবা'র পাশাপাশি তোমার সাথেও কখনো কথা বলবো না কিন্তু তোমাকে দেখতে দেখতে সব যেন কেমন পাল্টে যেতে লাগলো । তুমি যখন আমার চুড়ি পরা হাত দু'টো ধরেছিলে, বিশ্বাস করো আমার মনে হচ্ছিলো হাত দু'টো যেন তোমার মুঠোর মধ্যেই থাকে । তোমার মতো আমিও ধীরে ধীরে তোমাকে অনুভব করতে শুরু করেছি কিন্তু কী ভীষন এক জড়তা আমাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে বলে বোঝাতে পারবো না । কথা ছাড়া আমি তো থাকতেই পারিনা । সবার সাথে কতো সহজেই কথা বলতে পারছি শুধু তুমি কাছে আসলেই সব যেন কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে । আমার যে কতো কথা জমেছে তোমাকে বলার জন্য , জমতে জমতে এক সমুদ্র কথা জমা হয়ে গেছে । তুমি যখন আমার এলো চুল ঠিক করার ছলে গাল ছুঁয়ে দিয়েছিলে, আমার পুরো শরীরটা অবশ হয়ে গিয়েছিলো যেন । খুব, খুব ইচ্ছে করছিলো তোমাকে জড়িয়ে ধরতে । পারলাম না কিছুই , কেন পারলাম না জানিনা কিন্তু আমি পারতে চাই । অহনা তাকিয়ে দেখলো আজও দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে মুসা । সে বেশ বুঝতে পারছে মুসা ঘুমায়নি । ছুটে গিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, তুমি আমাকে ভুল বুঝলে, আমার জীবনে তো কেউ ছিলোই না কখনো । জীবন খাতার পাতাগুলো একদম ফাঁকা । সেখানে শুধু তোমার গল্প লেখা হবে । তোমার -আমার ভালোবাসার গল্প । বুকের ভেতর আকুলিবিকুলি খেতে থাকা কথাগুলো মুসাকে বলতে পারেনা সে । বন্ধ দরজার ভেতরে দুটো প্রানের হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাস চোখের জলে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় ।সারারাত অহনার ঘুম এলো না এতোটুকু । ভোরের দিকে টুংটাং ম্যাসেজ আসতে লাগলো মোবাইলে । এতো ভোরে কে তাকে ম্যাসেজ করছে বুঝতে পারলো না সে । দেখবে না দেখবে না করেও মোবাইলটা হাতে নিলো অহনা । মানাম লিখেছে তাকে -ছোটপা, বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে । তোর ওখান থেকে ফেরার সময় খুব মন খারাপ ছিলো বাবা'র । বাসায় ফিরে কিছুই খায়নি । বারবার শুধু একই কথা বলছিলো, আমার মেয়েগুলো ভালো নেই । আমি কী মেয়েটাকে ধরে বেঁধে পানিতে ফেলে দিলাম ? আমার সাজানো সংসারটা কেন এমন তছনছ হয়ে গেলো? টেনশনে মাথা ধরে বসেছিলো অনেকক্ষণ । আমি আর মা কতো করে বললাম কিছু খাওয়ার জন্য কিন্তু বাবা একটু পানিও মুখে দিলো না । বারান্দায় ঠায় বসে রইলো । টেনশনেই হবে বোধহয় রাত দুটোর দিকে অজ্ঞান হয়ে গেছে । কোনোভাবেই সেন্স ফিরছিলো না তাই আমি আর বড়দা মিলে হাসপাতালে নিয়ে এসেছি । মা খুব ভয় পেয়েছে । মা'র সাথে একটু কথা বলিস ছোটপা ।ম্যাসেজটা পড়ে অহনা'র যেন মাথা খারাপ হয়ে গেলো । সে কেন এতো খারাপ ব্যবহার করলো বাবা'র সাথে ? বাবা'র মনটা এতো নরম, তার এই ব্যবহার বাবা সহ্য করতে পারেনি । এখন সে কীভাবে বাবা'র কাছে যাবে ? মা'কে ফোন করে বললো , মা তুমি একদম চিন্তা করো না আমি আসছি । রিনিকে বললো মা'র খেয়াল রাখতে । সব জড়তা ঝেড়ে ফেলে মুসার সামনে যেয়ে দাঁড়ালো সে -কী বলবে, কীভাবে ডাকবে ঠিক বুঝতে পারেনা সে । এই যে শুনছেন? শুনতে পাচ্ছেন ? এভাবে ডাকাডাকিতে যখন মুসার ঘুম ভাঙলো না, মুসার কাঁধে হাত রেখে মৃদু ঝাঁকুনি দিলো সে, শুনছেন । মুসা চোখ মেলতেই অহনা বললো , আমি বাবা'র কাছে যাবো । মুসার গালে দু'ফোঁটা চোখের জল পরলো । মুসা হতচকিত হয়ে উঠে বসলো , কী হয়েছে অহনা ?বেশ তাড়াতাড়িই তারা পৌঁছে গেলো ঢাকায় । সরাসরি হাসপাতালে চলে আসলো তারা । বাবা তখন ঘুমিয়ে ছিলো । বাবা'র মুখটা কী মলিন লাগছে দেখতে । অহনা'র অসহ্য কষ্ট হলো বুকের ভেতর । ডুকরে কেঁদে উঠতেই বাবা চোখ মেলে তাকালো । অহনা ছুটে গিয়ে বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো -সরি বাবা, আমার ভীষন অন্যায় হয়েছে । আমাকে মাফ করে দাও তুমি । আমি কী করবো বলো? তোমাদের ছাড়া একরাতও দুরে থাকিনি কখনো । তুমি আমাদের অভ্যাস নষ্ট করেছো । সবসময় কাছে রাখবে, কখনো দুরে যেতে দেবে না , এই কথাগুলো শুনতে শুনতে মাথায় গেঁথে গেছে । সেই তুমি এক ঝটকায় আমাকে এতোটা দুর করে দিলে বাবা ! বাবা তুমি কেমন আছো এখন? বাবা কথা বলো আমার সাথে, আমার ভীষন কষ্ট হচ্ছে ।মাহাবুব হোসেন মেয়ের মাথায় হাত রাখেন , তোরা আমাদের ওপর রাগ করিস । তোরা কী আমাদের কষ্টটা কখনো অনুভব করতে পারিস রে মা ? একটা সন্তান, কতো যত্নে বড় করে তোলা সন্তান, কত স্বপ্ন নিয়ে যে সন্তানদের আমরা মানুষ করি , তাদের এতোটুকু কষ্ট, তাদের কোনো অমঙ্গল আমাদের পৃথিবীটাকে নাড়িয়ে দেয় । এই যে মেয়েরা বাবা'র বাড়ি ছেড়ে চলে যায় যেমন তুই গেলি , এ যাওয়ার সাথে অনেক অধিকারও চলে যায় বাবা-মা'র কাছ থেকে । কোনোকিছুই আর আগের মতো হয়না । এতো আদরের সন্তান যখন নতুন একটা সম্পর্কে ঢোকে তখন একটাই চাওয়া থাকে, আমার বাচ্চাটা ভালো থাক । হ্যাঁ আমার ভুল হয়েছে তাড়াহুড়ো করে তোকে এভাবে বিয়ে দেয়া । তোরা বড় হয়েছিস, নিজের সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা হয়েছে তোদের । স্বাধীনতার সুযোগে যখন বিশাল কোনো ভুল করে ফেলিস, চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিচ্ছু করার থাকে না আমাদের । আমি মুসার সাথে ভালোভাবে কথা বলেই আমার সিদ্ধান্ত নিয়েছি । কোনো কোনো সময় মানুষ চিনতে পুরো জীবন লেগে যায় আবার কিছু মানুষ থাকে যাদের সাথে কিছুটা সময় কাটালেই বোঝা যায় মানুষটা কেমন । ছেলেটা ভালো, ছেলেটা সরল আর মনটা খুব ভালো । আমার মনে হয়েছে আমার অহনা এই ছেলেটার সাথে ভালো থাকবে । এই মনে হওয়াটা যদি ভুল হয়, আমাকে ক্ষমা করে দিস ।বাবা তোমার কোনো ভুল হয়নি, আমি তোমাকে ভুল বুঝেছি । আমাকে মাফ করে দাও বাবা । আমি জানি আমার বাবা আমার জন্য সবচেয়ে ভালোটা চিন্তা করে সবসময় । তোমাদের কাছ থেকে দুরে চলে যেয়ে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো । তাই খুব অভিমানে মাঝের দিনগুলো নষ্ট করেছি বাবা । সরি বাবা ।ছেলেটা কেমন বলতো ? তোর সাথে মিলমিশ হচ্ছে তো?মুসার সাথে যে এ পর্যন্ত তার কথাই হয়নি এটা বাবার কাছে লুকায় অহনা । বাবা ও খুব ভালো মানুষ, খুব ভালো । আমার বাবা কী ভুল মানুষকে পছন্দ করতে পারে কখনো? বাবা একটা কথা বলি? রাগ করবে নাতো?কী কথা, বল না ।বাবা, আপা খুব কষ্টে আছে ।মাহাবুব হোসেন অহনাকে থামিয়ে দিতে যান , অন্য কথা বল মা ।বাবা তোমার অপলা ভীষণ কষ্টে আছে আছে বাবা । একটা অন্যায়, একটা ভুল ও করে ফেলেছে । আপা ফিরে আসতে চায় বাবা । বাবা তুমি যদি ক্ষমা না করো ওর জীবনটা এখানেই থেমে যাবে বাবা । নিজে থেকে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো দৃঢ় মনোবল আপার নেই । খেয়ালের বশে কাজটা করে ফেলেছে । এখন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার সাহস পাচ্ছে না বাবা । আপা ঐ বাড়িতে থাকতে পারছে না বাবা । ওর জীবনটা যেন পিষে ফেলছে কতগুলো অমানুষ । আপাকে মাফ করে দাও বাবা । ছোটবেলায় আমাদের কতো ভুল তুমি ক্ষমা করে দিয়েছো । তুমি বারবার বলতে, ভুল না করলে শিখবে কোত্থেকে? বাবা ওর খুব শিক্ষা হয়েছে বাবা । এবারের মতো ক্ষমা করে দাও বাবা ।মাহাবুব সাহেব তবুও নির্বাক হয়ে তাজিয়ে থাকেন সিলিং ফ্যানটার দিকে ।বাবা প্লিজ এতোটা কঠিন তুমি হয়ো না , প্লিজ বাবা । বাবা'র হাত ধরে ঝাঁকাতে থাকে অহনা ।হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বাসায় চলে এসেছেন মাহাবুব হোসেন। কাছের আত্মীয়স্বজন সবাই এসেছে বাসায় । অহনা যেয়ে মেহরাবকে ধরলো -বড়দা আপার ব্যাপারটা কিছু ভাবলে?ভাবাভাবির কী আছে , যা করার করছি । অপলার সাথে কথা হয়ে গেছে । আমি যাচ্ছি আজ বিকেলে ওর ওখানে । ওরা যদি ভালোভাবে অপলাকে আসতে না দেয়...তখন?হ্যাঁ সেই ব্যবস্থাও নেয়া আছে । সিয়ামকে মনে আছে তোর? সিয়ামের বড় ভাই ওখানকার থানার দায়িত্বে আছেন । ওনার সাথে কথা হয়েছে আমার । কোনো ঝামেলা করলেই থানা থেকে ব্যবস্থা নেবে ।থ্যাংকইউ বড়দা ।থ্যাংকসের কিছু নেই রে অহনা । এটা আমার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে ।সবাই অনেক জোরাজোরি করার পরও থাকলো না মুসা । সে খুব চাচ্ছিলো অহনা তাকে একবার বলুক থাকার কথা । অহনা যখন একবারও বললো না , জরুরি কাজের কথা বলে বিদায় নিয়ে চলে আসলো মুসা ।অহনা'র ভীষণ কান্না পাচ্ছে । কী এমন জরুরি কাজ যে সবাই এতোবার করে বলার পরেও মানুষটা এভাবে চলে গেলো । মুসা চলে যাওয়ার সময় রাগে , অভিমানে অহনা কাছেই থাকলো না ।বাবা'র শরীরটা এখন একটু ভালো । অহনা অনেকক্ষণ বাবা'র সাথে গল্প করেছে আজকে । গল্প করতে করতে বাবা ঘুমিয়ে পড়লে রুমের বাতি নিভিয়ে দিয়ে অহনা বেরিয়ে আসলো রুম থেকে । মা'র মনটা খুব খারাপ ছিলো, খুব বেশি ভয় পেয়েছিলো মা । অহনা এটাওটা গল্প করে মা'র মনটা ভালো করার চেষ্টা করলো । ঘরভরা লোকজন থাকাতে মা'র ওপর দিয়ে ধকল গেছে বেশ । জমে থাকা কাজগুলোয় অহনা মা'র সাথে হাত লাগিয়ে তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেললো । মা'কে জোর করে শুতে পাঠিয়ে নিজের ঘরটায় ঢুকলো সে । ঘরে ঢুকেই ভীষণ কান্না পেলো তার তার । কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে চারপাশটা । মনে হচ্ছে কী যেন নেই অথচ তার ঘরটা ঠিক তেমনই আছে । তাহলে এতো ফাঁকা লাগছে কেন তার? বুকের ভেতরটা এমন হাহাকার করছে কেন? সবই ঠিক হয়ে গেছে এখন, বাবা ঠিক আছে , সব ঠিক থাকলে আপাও চলে আসবে কালকে তাহলে তার এতো অস্থির লাগছে কেন? বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণ গড়াগড়ি খেয়ে উঠে পড়লো সে । ঘুমানোর চেষ্টা করে লাভ নেই । জানালার ধারে এসে দাঁড়ালো অহনা । তার জানালা দিয়ে একফালি আকাশ দেখা যায় অথচ এই কয়দিনে চোখ মেললেই বিশাল আকাশ দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে । অভ্যাস কী এতো দ্রুত বদলায় ? কী জানি, হয়তো বদলায় নাহলে তার রুমে আজ তার ঘুম আসছে না কেন ? এতো রাতে হঠাৎ ম্যাসেজের টুংটাংয়ে কেঁপে উঠলো অহনা । এখন আবার কে? ম্যাসেজটা দেখতেই শরীরে শিহরণ লাগলো যেন, মুসা ! মুসা তাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলো । সে একসেপ্ট করেনি দেখে নিজেই একসেপ্ট করেছিলো তার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে । ছোট দুটো শব্দ লিখেছে মুসা -জেগে আছো?লেখাটা পড়ে কী যে ভালো লাগলো তার কিন্তু উত্তর দিলো না ।জানি তো জেগে আছো ।হুম ।পা ঝুলিয়ে বসে আছো জানালার ধারে?আমার এখন থেকে অল্প একটু আকাশ দেখা যায় ।ঘুমাচ্ছো না কেন? সারদিন কোনো রেস্ট হয়নি তোমার । ঘুমাও এখন ।ঘুম আসছে না ।কেন?সব জড়তা ঝেড়ে ফেলে অহনা লেখে - আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও ।দশ মিনিট কোনো রিপ্লাই পায় না সে । দশ মিনিট যেন অনন্তকালের মতো লাগে । নিশ্বাঃস নিতেও কষ্ট হচ্ছে তার কান্নার দমকে । মুসা কেন উত্তর দিচ্ছে না তাকে? সে তো লাজ সরমের মাথা খেয়ে নিজের মনের কথাটা লিখলো আজ । ঠিক দশ মিনিট পর ফোনটা বেজে উঠলো রাতের নিস্তব্ধতা খান খান করে । মুসার ফোন । রিসিভ করে চুপ করে থাকলো অহনা । কোনো কথা বলতে সাহস হচ্ছে না তার । মুসা'ই কথা বললো প্রথমে -কী হয়েছে, মন খারাপ?অহনা কথা বলতে পারে না । কান্নার রেশ কাটেনি তখনো । অহনা খুব অবাক হয় , এতো কাঁদছে কেন সে ? কান্না বন্ধই হচ্ছে না ।কাঁদছো কেন?আমার ভীষন কষ্ট হচ্ছে । আমি থাকতে পারছি না এখানে । ফোঁপাতে ফোপাঁতেই কথাগুলো বলে সে ।কেন? এখন তো বাবা'র শরীর ঠিক আছে । তাহলে কেন মন খারাপ?তুমি জানো সেটা ।তুমি কী নিজে থেকে কিছুই বলবে না? সবই আমার অনুমান করে বুঝে নিতে হবে ? তুমি তো জানো না, তোমার কথা শোনার জন্য কতোটা উতলা হয়ে থাকি আমি । তুমি এভাবে কেঁদো না । আমার ভীষন কষ্ট হচ্ছে ।তুমি চলে গেলে কেনো আমাকে একা রেখে ?তুমি তো আমাকে একবারো থাকতে বলোনি । বাবা-মা'র কাছে থাকো কিছুদিন । তোমাদের সবার ভালো লাগবে ।আমার ভালো লাগছে না । আমি আমার ঘরটায় যেতে চাই । আমাকে নিয়ে যাও এসে ।এতোদুর থেকে এখন আসবো কীকরে ? আর ঐ ঘরটা তো তোমার ভালো লাগে না । সারাক্ষণ জানালা দিয়ে আকাশ দেখো । তারচেয়ে ওখানেই থাকো কিছুদিন । মন ভালো থাকবে ।অহনা ডুকরে কেঁদে ওঠে , আমি তোমার কাছে যাবো । আমাকে নিয়ে যাও তোমার কাছে । এখনই আসো ।এখনই কীভাবে আসবো? সকাল হোক , আমার কিছু কাজ আছে , ওগুলো গুছিয়ে তারপর কাল রাতের মধ্যে চলে আসবো ।আমি কিচ্ছু জানিনা, আমি কিচ্ছু জানতে চাই না । তুমি এখনই আসো আমার কাছে ।আরে বোকা মেয়ে বললেই কী এতো দুর থেকে হুট করে চলে আসা যায় ?কাল রাত পর্যন্ত আমি সহ্য করতে পারবো না । মরেই যাবো । এতো কষ্ট আমাকে দিও না প্লিজ ।আমি যে রাতগুলো নির্ঘুম কাটিয়েছি তার কষ্টটা তুমি বুঝতে পারছো অহনা?আমি কিছু জানিনা, আমি তোমার কাছে যাবো । আমি আমার ঘরটায় যাবো ।তারপর...কী তারপর?তারপর তুমি আকাশ দেখবে আর আমি ডিভানে ঘুমাবো, তাই তো?অহনা'র কান্না আরো বেড়ে যায় , আমি জানি না, কিছু জানি না, শুধু জানি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি ।এতো কেঁদো না লক্ষী প্লিজ । এতো কাঁদলে মাথা ব্যাথা করবে । এখন একটু ঘুমাও, আমি কাল আসবো যতো তাড়াতাড়ি পারি ।যতো তাড়াতাড়ি না , তুমি সকালে উঠেই চলে আসবে । কাজ পরে করবে । আমি এতক্ষণ তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না ।আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে । সকালে উঠেই রওনা দেবো । এবার খুশি তো?কয়টা বাজবে তোমার আসতে?দেখি জ্যাম ঠেলে কখন আসা যায় । তাও বিকেল হয়ে যাবে কিন্তু ।হুম, বাই ।ফোন রেখে অহনা দেখে রাত বিদায় নিলো প্রায় । আরেকটু পরেই ভোর হবে । গত কয়টা দিন তার নির্ঘুম রাত কেটেছে । এই কয়দিনে রাতের নিস্তব্ধতা , নিস্তব্ধতা ভেঙে কোনো পাখির ডেকে ওঠা , ঝিঁঝির ডাক এসব কিছুতে সে যেন অভ্যস্ত হয়ে গেছে । খোলা জানালা দিয়ে আসা চাঁদের আলো আর হঠাৎ দমকা বাতাস এসবকিছুর নেশা যেন পেয়ে বসেছে তাকে আর সব ছাড়িয়ে ঐ ডিভানে শুয়ে থাকা মানুষটা ! ঐ মানুষটা তার , একান্তই তার । এবার কাছে এলে শক্ত করে হাতটা চেপে ধরবে । সেই রাত গুলোর আফসোস, ঘুমহীন রাতের দীর্ঘশ্বাস সব ভুলিয়ে দেবে সে ভালোবাসা দিয়ে । হঠাৎ একটা গান মনে পড়লো তার । মোবাইলে লো ভলিউমে গানটা চালিয়ে অটো প্লে দিয়ে বিছানায় এসে শুয়ে থাকলো চোখ বুঁজে । গানটা যেন তার জন্যই গাওয়া হয়েছে । গানের প্রতিটা লাইন যেন তার মনের কথা । ভীষণ ভালো লাগছে গানটা শুনতে ।দরজাটা চাপানো ছিলো । দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো মুসা । মাত্র ভোর হচ্ছে তাই রুমটা এখনো অন্ধকার । পা টিপেটিপে বিছানার কাছে চলে এলো । মোবাইলে গান বাজছে । দাঁড়িয়ে গানটা শুনলো সে।আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে,দেখতে আমি পাইনি তোমায়,দেখতে আমি পাইনি।আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে.....ভালোলাগায় মনটা ভরে যায় গানটা শুনে । বিছানায় শুয়ে থাকা মানুষটার দিকে তাকিয়ে বুকটা ধুকধুক করতে থাকে তার । এলো চুলগুলো আজও কপালের ওপর পড়ে আছে । আস্তে করে চুলগুলো সরিয়ে দিতেই চোখ মেলে অহনা । অহনার মনে হচ্ছে সে স্বপ্ন দেখছে । স্বপ্নে মুসা চলে এসেছে তার কাছে । খুব সুন্দর করে একটা হাসি দিয়ে দু'হাত বাড়িয়ে মুসার গলা জড়িয়ে ধরে সে । মুসা কপালে একটা চুমু দিতেই তাড়াক করে লাফ দিয়ে ওঠে সে । ঘোর কিছুতেই কাটছে না । কী করে সম্ভব ! মাত্রই সে কথা বললো মুসার সাথে । আধ ঘন্টাও হয়নি এখনো । সিরাজগঞ্জ থেকে কীভাবে এই সময়ে আসলো মুসা?কী হলো কিছু বলো । তোমার জন্য অসাধ্য সাধন করে চলে এলাম । কিছু তো বলো ।তুমি কীভাবে এলে? সিরাজগঞ্জ থেকে কীভাবে, আমার ঘরে ঢুকলে কী করে ?আমি কী একটু বসতে পারি আমার বউয়ের কাছে? এই ঘরে কোনো ডিভান নেই তো ।অহনা মুসার হাতটা টান দিয়ে পাশে বসায় । বললে না কেমন করে এলে এতো তাড়াতাড়ি ?তোমার চাওয়াটা এতোটাই তীব্র ছিলো যে আমি আর থাকতে পারলাম না ।অহনা বোঝে মুসা দুষ্টামি করছে । গানটা তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দেয় সে ।বন্ধ করলে কেন? চলুক না । এটা কী তোমার না বলা কথা?অহনা কপট রাগ করে বলে, তুমি তখন চলে গেলে কেনো?আমার বউ না বললে আমি কী করে থাকি বলো ? আমি তোমার চাওয়াকে প্রথমদিন থেকে সন্মান দেখিয়েছি । আমাদের বিয়েটা একেবারে হুট করে হয়েছিলো । আমরা দুজন দুজনকে জানার আগেই শরীরটা কাছে আসুক এ আমি কখনোই চাইনি । মনটা আগে মনটাকে পড়তে শিখুক, তোমার মনটা আমাকে খুঁজুক সেটাই তো হলো প্রেম । ভালোবাসা ছাড়া শরীরটা কাছে আসলে নিশ্চয়ই তোমারও ভালো লাগতো না । আমি যদি তোমাকে কোনোভাবে জোর করতাম তাহলে তোমার মন থেকে আরো দুরেই সরে যেতাম শুধু ।আমি বাবার ওপর রাগ করেছিলাম, তোমার ওপরও রাগ ছিলো খুব । সেই রাগটা যে কখন অনুরাগে বদলে গেলো বুঝতেই পারিনি । তুমি যে কখন মনটা দখল করলে, কখন যে আমি তোমার হয়ে গেলাম জানিনা ।বাবার ওপর এখন কোনো রাগ নেই তো ? এখন বুঝতে পারছো তো বাবা-মা কখনোই আমাদের অমঙ্গল চান না ।হুম কিন্তু তুমি কী করে...কী করে এলাম, তাই তো?হুম ।আমি তো এখানেই ছিলাম, ভাইয়ার বাসায় । তোমার কাছ থেকে দুরে যেতেই পারছিলাম না যে । আমার মন বলছিলো তুমি আমাকে খুঁজবেই ।আমার রুমে এলে কেমন করে? দরজা খুললো কে এতো ভোরে?শালা আছে কী করতে? এইসব সময়ে তো শালারাই কাজে আসে, তাইনা ।আমি আমার ঘরটায় যাবো । খুব মিস করছি ঘরটাকে ।ওখানে তো দুজন দুমাথায় রাত কাটিয়েছি ।ওখানেই তো আমাদের ভালোবাসার জন্ম হয়েছে । ওখানেই তো আমাদের না বলা কথা গুলো ভাষা খুঁজে পেয়েছে । ওখানেই শুরু হবে তোমার আমার ভালোবাসার সংসার ।(সমাপ্তি)

হিয়ার_মাঝেKde žijí příběhy. Začni objevovat