একটুখানিLamyea_Chowdhuryপর্ব :
১- কাইন্ডলি যদি আমাকে একটু জানালার পাশের সিটে বসতে দিন কৃতজ্ঞ থাকবো।কুহু এতক্ষণ জানালার বাইরে স্টেশনের প্লাটফর্মের দিকে তাকিয়ে ছিল। তাকে উদ্দেশ্য করে কথাটা কেউ বলেছে বুঝতে পেরে পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে। কুহু ছেলেটার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে তাকায়। হবে পাঁচ ফুট পাঁচের মতো, চোখে চশমা, বেশ ফর্সা,চুলগুলো সাইড সিঁথি করে আঁচড়ানো তবে চুলগুলো কিছুটা খাঁড়া খাঁড়া। - কাইন্ডলি কি দেওয়া যাবে?ছেলেটা খুব কিউট করে একটা হাসি দিয়ে কুহুর জবাবের অপেক্ষা করছে। কুহু ভাবছে তার কি বলা সমীচীন হবে। প্রশ্নটা তাঁর কাছে পদার্থবিজ্ঞানের চৌম্বক সম্পর্কিত অঙ্ক থেকেও বেশি দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে। অন্য কোনো মেয়ের জন্য হয়তো খুব সহজ ছিল প্রশ্নটা কিন্তু তার মতো মেয়ে যে একে তো ছেলেদের সাথে তেমন একটা কথা বলতে পারে না, আবার এতোটা কোমল হৃদয়ের মেয়ে। তবে সে বেশ আভিজাত্য নিয়ে চলতে পছন্দ করে। কুহুর নিজের কাছেই শব্দটা বেশ ভারী ভারী মনে হচ্ছে। আভিজাত্য আহা! এসকল শব্দ মাথায় ঘুরে রাজ- রাজাদের কাহিনী পড়ে পড়ে আর দেখে দেখে। সহজে ভাবতে গেলে কীভাবে ভাবা যায় কথাগুলো তা একবার ভাবছে। সহজে বললে এমন হয় যে সে চায় না তার কোমল হৃ ধুর নরম মনের জন্য কেউ তাকে নির্বোধ বা বোকা মনে করুক। এইতো হয়েছে। কুহু একমনে কথাগুলো ভেবেই চলেছে।ছেলেটা কুহুর থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে একটু কেশে বললো,- মিস সিটটা কি দেওয়া যায় না?কুহু এই পর্যায়ে উত্তর দেয়,- জানালার পাশের সিটটা তো আমার।- তাইতো আপনাকে রিকুয়েস্ট করছি।কুহু বুঝতে পারছে না ছেলেটাকে কি বলবে আবার মুখ ফিরিয়ে নিতেও পারছে না এটা যথেষ্ট অভদ্রতা হবে।তাই আবার মুখ খুলে বললো,- আসলে আমিও জানালার পাশের সিট ছাড়া কখনো বসি না সরি!কুহু কথাটা বলেই জানালার বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তবে আড়চোখে ছেলেটার রিয়েকশন দেখছে।ছেলেটা বেশ বিরক্ত হয়েই স্টাইল করে ঝুলানো কলেজ ব্যাগটা খুলে উপরে রেখে দিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করে কুহুর পাশের সিটটায় বসে পড়ে।কুহুর কেনো যেন এখন মনে হচ্ছে ছেলেটা এতো করে যেহেতু বলছিলো তাকে সিটটা দেওয়া উচিত ছিলো। ছেলেটাকে তো বেশ ভদ্রই মনে হচ্ছে তার। বেশ স্টাইলিশ তবে ভদ্রতার একটা ছোঁয়া আছে। সাদা প্যান্ট, হালকা নীল শার্ট আর সাদা স্নিকারস্ পড়ে আছে। চোখে নেভী ব্লু ফ্রেমের চশমা। কুহু একটু খেয়াল করে দেখলো ছেলেটা পায়ের গোড়ালির উপর প্যান্ট ফোল্ড করে রেখেছে। কুহুর এই ব্যাপারটা বেশ ভালো লাগছে। ছেলেটা ইসলামিক মাইন্ডের পরক্ষণেই আবার নিজের মাথা নিজেরই ট্রেনে ঠুকতে ইচ্ছে হচ্ছে। সবসময় অকারণেই সে সবাইকে ভালো মনে করে ফেলে, মোটেও সে মানুষ চেনে না। ছেলেটা নিশ্চয় স্টাইল করে এভাবে প্যান্ট ফোল্ড করে রেখেছে আর সে কিনা তাকে মহান বানিয়ে ফেলছে। কুহুর এই এক সমস্যা সে সবাইকে বিশ্বাস করবে না করবে ন। করেও হুটাহাট বিশ্বাস করে বসে। যেখানে তার ছোট বোন পিহু একনজর কাউকে দেখেই বলে দিতে পারে মানুষটা কেমন। যেমন ধরা যায় কুহুর ক্লাসমেট নীরাকে দেখেই পিহু বলে দিয়েছিলো আপুণি এই মেয়ের নির্ঘাত বয়ফ্র্যান্ড আছে। কুহু বেশ কনফিডেন্টলি বলেছিলো,নারে পিহু নেই। হয়তো নীরা একটু টম বয় মার্কা কিন্তু বয়ফ্র্যান্ড নেই। একমাস পড়েই যখন নীরার সাথে কুহুর বন্ধুত্বটা ঘনিষ্ঠ হয়েছিলো তখনই কুহু জানতে পারে নীরার বয়ফ্র্যান্ড আছে। এখন কুহুর আবার মনে হচ্ছে ভালোই হয়েছে সে সিট ছেড়ে উঠেনি নয়তো ছেলেটা তাকে ছেঁচরি টাইপের ভাবতো। কুহু সবসময় জানতো মেয়েরা এভাবে ছেলেদের কাছে জানালার পাশে বসার জন্য রিকুয়েস্ট করে আর ছেলেরাও বেশ মহা আনন্দে নেচে নেচে মেয়েদের সে সুযোগ করে দেয়। কিন্তু কোনো ছেলেও যে কোনো মেয়েকে এমন কথা বলতে পারে তা কুহুর জানা ছিল না। হঠাৎ কুহু শুনতে পায় চানাচুর! চানাচুর!কুহুর ভাবনায় এতক্ষণে ছেদ পড়ে। কুহু খেয়ালই করেনি কখন ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে।- ভাইয়া দশ টাকার চানাচুর দিন তো।কুহু একহাতে চানাচুর নিয়ে অন্যহতে টাকা দিতে যেতেই চোখ যায় ছেলেটার মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে। এফবি থেকে লগ আউট হচ্ছে। ছেলেটার আইডিটার নামও কুহুর চোখে পড়েছে।আইডির নাম " জানালার পাশে"। ছেলেটা লগ আউট করেই মেবাইলটা পকেটে রেখে চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে আছে। কুহু বুঝতে পারছে ছেলেটার আইডিটা ফেইক ছিল তারপরো মনের মধ্যে কেমন যেন খচখচ করছে। মানুষ সাধারণত ফেইক আইডি খুলে নিজের সবচেয়ে প্রিয় কিছুর নামে। ছেলেটারও জন্য হয়তো জানালার পাশের সিটটা বেশ আবেগময়ী কিছু তাই সে এই নামেই ফেইক আইডি খুলেছে। সে নিজেও তো একবার খুলেছিল স্বপ্নবিলাসী নামের একটা আইডি। নাহ্ কুহুর আবার মনে হচ্ছে ছেলেটা নিশ্চয় এখনই ট্রেনে বসে আইডিটা খুলেছে তাও আবার কুহুকে দেখানোর জন্য। এসব উথালপাথাল ভাবতে ভাবতেই কুহু হাতের চানাচুরটুকু শেষ করে উঠে দাঁড়ায়। ছেলেটা একটা পা সামনের সীটের নীচে রেখে আরেকটা পা পিছনের দিকে ভাঁজ করে বসে আছে। কুহু তার বোরকাটা ধরে সামান্য উপরে তুলে ছেলেটার পা ডিঙিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর সামনে থেকে একটা আইসক্রিম হাতে করে নিয়ে এসে ছেলেটার পাশে দাঁড়িয়ে বলে,- এই যে শুনছেন? ছেলেটা চোখ খুলে কুহুর দিকে তাকিয়ে বলে,- কিছু বলবেন?- জ্বি একটু চেপে বসুন তো।- কোথায় চেপে বসবো?- ঐপাশে চেপে বসুন।- দেখুন ঐপাশে কীভাবে আমি চেপে বসবো? আমার পাশে একজন অচেনা মেয়ে বসে আছেন।- আমি তো আপনার পাশে কোনো মেয়ে দেখছি না।।ছেলেটা তার ডান পাশে একবার তাকিয়েই কুহুর দিকে ফিরে তাকিয়ে আবার সেই কিউট হাসিটা দিয়ে বলে,- সরি আসলে আমি খেয়াল করিনি। আমি সাইড দিচ্ছি আপনি যান।- না আপনি ঐ সিটটায় বসুন।- সত্যি?ছেলেটার এমন কান্ড দেখে কুহু আর হাসি থামিয়ে রাখতে পারেনি। যদিও সে ছেলেদের সাথে হাসাহাসি করে না তাও কিছুটা শব্দ করেই হেসে উঠলো। একটা বাচ্চা যখন ফ্যান্টাসী কিংডমে যাওয়ার কথা শুনে তখন যেমন বলে উঠে সত্যি ঠিক তেমনি ছেলেটা কুহুকে বলেছে সত্যি। ছেলেটা জানালার পাশের সীটটায় বসে বেশ কৌতুহলী দৃষ্টিতে জানালার বাইরের দৃশ্য দেখছে। ছেলেটা জানালার দিক থেকে দৃষ্টি না ফিরিয়েই বলে,- ধন্যবাদ!- কিছু বলছেন? শোনা যাচ্ছে না।ছেলেটা কুহুর দিকে তাকিয়ে বলে,- ধন্যবাদ! কোনোদিন ট্রেনে উঠিনি এই প্রথম। আসলে আমার বাসা কুমিল্লায়। থাকি ঢাকায়,পড়াশুনার খাতিরে আরকি। সবসময় বাসে বা প্রাইভেট কারে যাওয়া আসা করেছি। এই যে এখন কুমিল্লায় যাচ্ছি বাসায় কেউ জানে না জানলে গাড়ি পাঠিয়ে দিতো তাই বলিনি। বাসে যদিও যাওয়া আসা হয়েছে কিন্তু ট্রেনে কেনো যেন কোনোদিন চড়া হয়নি। তাই প্রথম। আর বাসে সবসময় জানালার পাশে বসেছি। জানালার পাশে বসার জন্য আমি দুটো টিকিটই কেটে ফেলি কিন্তু এখানে ট্রেনের টিকিট দুটো পাইনি। হুট করে আসা তো ব্ল্যাকে টিকিট পেয়েছি একটা। অনেক অনেক ধন্যবাদ।- ঠিক আছে।- আপনি কোথায় যাচ্ছেন?- এই তো ফেণী।- ওহ্ সেখানে কি আপনার বাসা?- জ্বি।ছেলেটা আর কোনো কথা না বলে বাইরের দৃশ্য দেখছে। কুহুও খুশিই হলো ছেলেটা তাকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করছে না দেখে। কুহুর আবার ট্রেনে বাসে ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস কিন্তু সে ইচ্ছে করে ঘুমোচ্ছে না কারণ ঘুমের ঘোরে যদি ছেলেটার কাঁধে মাথা রাখে তাহলে সেটা খুবই বিশ্রী একটা ব্যাপার হবে। কুমিল্লা স্টেশনে পৌঁছুতেই ছেলেটা উঠে দাঁড়ায়। তারপর ব্যাগটা আবার বেশ স্টাইল করে কাঁধে নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়ে আর কুহু তার জানলার পাশের সিটটায় বসে পড়ে। কুহু সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করতেই শুনতে পায়,- এই যে শুনছেন?কুহু চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে সেই ছেলেটা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে। - জ্বি বলুন।- আমি কূজন। ধন্যবাদ না জানিয়েই ট্রেন থেকে নেমে পড়েছি তাই সরি।- না ঠিক আছে। - আপনার নাম?- কুহু।- সুন্দর নাম। একটু অপেক্ষা করুন আমি এখনই আসছি।কুহুর কাছে কূজনকে পুরোই উদ্ভট লাগছে। কুহু ভাবছে সে কীভাবে অপেক্ষা করবে। ট্রেন ছেড়ে দিলে তো কিছুই করার নেই তবে কেনো অপেক্ষা করবে তাও বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষণ পর কূজন আবার জানালার কাছে এসে দাঁড়িয়ে তার ব্যাগ থেকে একটা কলম বের করে হাতে থাকা বইটায় কি যেন লিখে। লিখা শেষে আবার সেই কিউট মার্কা হাসিটা দিয়ে কুহুর দিকে বইটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে,- ধরুন।কুহুকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে জানালা দিয়েই বইটা কুহুর কোলে রেখে কূজন বলে,- ছোট একটা উপহার। - এই না না লাগবে না থেঙ্কস্।- আরে রাখুন! আমি আসছি বাই।কুহু বইটা হাতে নিয়ে কূজনের দিকে বাড়িয়ে দিতেই কূজন একটুখানি হাসি দিয়ে পিছন ফিরে চলে যায়। আর কুহু অবাক হয়ে কূজনের চলে যাওয়া দেখতে থাকে। ট্রেন ছাড়ার আওয়াজে কুহু বাস্তবে ফিরে আসে। হাতে থাকা বইটার দিকে তাকিয়ে দেখে ডেল কার্নেগী সমগ্র। বইটা সীটের পাশে রেখেই কুহু মোবাইলটা বের করে ফেইসবুকে লগ ইন করে জানালার পাশে লিখে সার্চ করে। সার্চ দিতেই অনেকগুলো আইডি আসে। সবগুলোই যে ফেইক বুঝাই যাচ্ছে তবে একটা আইডিতে একটা ছেলের ছবি দেয়া। সেই আইডিতে যেয়েই দেখলো নিক নেইম দেয়া কূজন। ছবিটা এবার খেয়াল করে দেখলো এটা কুহুর পাশে বসা ছেলেটারই। কূজনের বেশকিছু ইনফর্মেশনও দেয়া আছে।সেখান থেকে কুহু জানতে পারলো কূজন আহসানউল্লাহ তে পড়ে ট্রিপল ই তে। বাড়ি কুমিল্লাতেই। কুমিল্লা ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ থেকে পাশ করেছে সে। এখন আহসানউল্লাহ্তে পড়ে।কুহু মোবাইলটা তার হ্যান্ড ব্যাগে রেখে চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে বসে। কিছুক্ষণ পর চোখ মেলে বইটা আবার হাতে নেয়। বইটা হাতে নিয়ে ভাবতে থাকে বইটা উপহার হিসেবে যদি তার কোনো শিক্ষক বা বাবা- মা টাইপের কেউ দিত তাহলে মানানসই হতো। কিন্তু অন্য যে কারো কাছ থেকে উপন্যাস টাইপের বই পেলে কুহু খুশি হয়। কুহু ভাবছে এই বইটা কেনো দিল? আর বই পায়নি দিতে? বইটা বেশ ভালোই আর কুহুরও এধরনের পড়তে ভালোই লাগে তবে গিফ্ট হিসেবে উপন্যাস পাওয়ার আনন্দই আলাদা। চট করে কুহুর মনে হলো রেল স্টেশনের স্টলগুলোতে এ ধরনের বইগুলোই বেশি পাওয়া যায় তাই হয়তো এটা দিয়েছে। কুহুর ভাবতেই হাসি পাচ্ছে যদি "আমি হিটলার বলছি" বইটা কিনে দিতো তাহলে কেমন হতো? হাসতে হাসতেই কুহু বইটা খুলে। প্রথম পৃষ্ঠায় নজর দিতেই দেখে,"একটুখানি পথচলাতেইবিশাল অবদানএকটুকরো হাসিতে স্মৃতিটুকু অম্লান।"ধন্যবাদ কুহু।কূজন!কুহু লাগেজ নিয়ে এগিয়ে যায় ট্রেনের দরজার দিকে। একটু একটু করে সামনে এগুতেই দেখে কুহুর বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। কুহু তার বাবাকে দেখেই হাসি মুখে আব্বু বলে কিছুটা জোরেই ডাকে। কুহুর বাবা ট্রেনের দরজার কাছে এসেই মেয়ের লাগেজটা হাতে নিয়ে নামিয়ে রাখে। তারপর হাত ধরে কুহুকে নামতে সাহায্য করে।এক হাতে লাগেজ টেনে নিয়ে যাচ্ছে আর আরেক হাতে মেয়ের হাত ধরে স্টেশনের বাইরের দিকে পা বাড়াচ্ছেন কুহুর বাবা। রিকশায় বসেই কুহুকে তিনি বললেন,- আমার বড় কলিজাটাকে কতদিন পর দেখলাম।- কেনো তোমার ছোট কলিজাটা ছিল না তোমার চোখের সামনে?- বড় কলিজাটা তো আর ছিল না।- আমাকে দিয়ে আর কি দরকার তোমার?তোমার আদরের মেয়ে পিহু তো আছেই।- তোকে আমি আরো বেশি আদর করি।- দাহা মিথ্যা! রাস্তা পর্যন্ত কাঁপা শুরু করে দিয়েছে তোমার কথা শুনে।- হাহ্হাহা। আচ্ছা এবার বল লিপি তোকে আদর করেছে তো? কেমন লেগেছে সেখানে?- ছোট ফুফি অনেক আদর করেছেন। আর ফুফাকে তো চিনোই তুমি আব্বু। ফুফার মতো ভালো মানুষই নেই এখনকার যুগে।- তা ঠিক বলেছিস।- আর প্রিয়র সাথে জম্পেস আড্ডা দিয়েছি।- হুম প্রিয়র সাথে তো তোর সেই ছোটকাল থেকেই কি দারুণ জমে।- খুব ভালো লেগেছে। - হুম বারো দিন তো বেরিয়ে আসলি এখন পড়াশুনায় মন দে। নেশনালে পড়ছিস দেখ ট্রাই করে বিসিএস হলেও হতে পারে।- উহু এতদূর ভাবছ কেনো? সময় আছে আরো অনেক। মাত্র তো অনার্স থার্ড ইয়ারের ফাইনালটা দিলাম। আর চিন্তা করো না তো ইংরেজীতে পড়ছি তো চাকরি না পেলেও টিউশনি অন্তত করতে পারবো।- হুম একদম ডিপেনডেন্ট হবি না কারো উপর। আজকালকার ছেলেরা যা খারাপ হয়! ..কুহু রিকশা থেকে নেমেই এগুলো বাড়ির দিকে। দোতালা বাড়ি। বাইরের দেয়ালে কিছুটা শ্যাওলা পড়ে আছে। নীচ তলায় বাড়িওয়ালা থাকেন আর দুতালার একটা ফ্ল্যাটে থাকে কুহুরা আর অপর ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকে তিনটা ব্যাচেলর ছেলে। কুহুদের ফ্ল্যাটে দুইটা ব্যাডরুম। একটায় থাকে মা- বাবা আর অপরটায় কুহু আর পিহু। ড্রয়িংরুমে অবশ্য তোশক ফেলে খুব সুন্দরভাবে সাজিয়ে রেখেছে কুহু। সেখানে মেহমান এলে থাকতে পারে। কুহু কলিংবেল চাপতেই কুহুর মা দরজা খুলে দেয় আর কুহু মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,- আম্মু!- আমার মেয়েটা কেমন আছে? বেড়াতে গেলে তো ভুলেই যাস মায়ের কথা। - মোটেও ভুলিনি বরং তুমি কোথাও বেড়াতে গেলে আমাদের কথা ভুলে যাও।- মা মেয়ের আবার শুরু হয়েছে।- তুমি যখন তোমার ছোট মেয়েকে নিয়ে এমন করো তখন কি আমি কিছু বলি? বলিনা। তাহলে তুমি কেনো আমাদের মা মেয়েকে দেখে হিংসে করো?- ঘাট হয়েছে।- আম্মু পিহু কোথায়?- রুমেই আছে।- আচ্ছা আমি যাই।পিহু পিসিতে বসে বেশ আগ্রহ নিয়ে ইংলিশ গান শুনছে আর নিজেও সাথে সাথে গাইছে।" বি ইচ আদার কম্প্যানি ওওও"কুহু পিহুকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরেই বলে,- এসে পড়েছি তোকে কম্প্যানি দিতে।- উফ্ আমি কি তোর কম্প্যানির কথা বলছি? আমি জাস্টিন বিবারের কম্প্যানি পাওয়ার প্রত্যাশা করছি।- ওরে বাবা তোর মুখে এসব বাংলা শব্দ মানায় না। হাসি পায় হিহিহাহা্হাহা।- কেনো ভুল হয়েছে? প্রত্যাশার জায়গায় কি হতো?- আরে না পাগল ঠিকই আছে। তবে তোর মুখে এসব মানায় না।- হুম এসব হাবিজাবি তোর মুখেই মানায়।- দাঁড়া তোকে একটা শুনাই।- এই না একদম না।- শুনতে হবে শুনতে হবে।- আপুণি তুই এতো ইমমেচিউর কেনো?- কারণ তুই মেচিউর।এখন শোন।"হৃদয় থেকে হৃদয়ে,স্পন্দন স্পন্দনে,ভালোবাসি! ভালোবাসি!এই হাহাকার।তবুও তুমি নির্বিকার।নাই বা বললে ভালোবাসার কথানাই বা শুনলে এই হাহাকার।তাই বলে একটুখানি চোখের ঝিলিক হয়ে,তারা গুণার সাথী হয়ে, পাশে বসা যায় না?হাসিমাখা মুখখানি আমার চোখের ফ্রেমে বন্দি করা যায় না?"- শেষ হয়েছে তোর?- না আরো বাকি আছে তো।- আমি আর শুনতে পারবো না।- প্লিজ! প্লিজ!- যা এখান থেকে।- মর তুই।- তুই মর।- তোর জাস্টুকে নিয়ে মর।- তুই তোর বাংলা শব্দগুলো নিয়ে মর। তাহলে বইয়ের কিছু পড়া কমবে।- হাহ্হাহা।- ইমমেচিউর।- হুহ।- যা সত্যি তা বলেছি।- আরে আমার সত্যবাদীরে।- যা তো গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নে তারপর তোকে একটা কথা বলবো।- কোনো কথা শুনতে চাই না তোর। আবার তোর কলেজের প্যাচাল পারবি আমার কাছে।- আরে না কলেজের প্যাচাল না।- তাহলে?- রাতে শুয়ে শুয়ে বলবো। - ঠিক আছে।..কুহু বিছানায় শুয়ে আছে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে পিহুর জন্য। পিহুর পড়া কখন শেষ হবে আর কখন পিহুর কাছ থেকে সেই কথাটা শুনবে তার জন্য অপেক্ষা করছে। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে এগারোটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। কুহুর বেশ ঘুম পাচ্ছে। সারাটা দিন জার্নি করে এসেছে সে। সেই গাজীপুর থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে আবার ফেণী। দুচোখে ঘুম ভর করছে তারপরো কোনোরকম চোখ মেলে শুয়ে আছে। কথাা না শোনা পর্যন্ত কুহুর আর শান্তি হবে না। কুহুর ইচ্ছে করছে পিহুকে ডেকে কথাটা এখনই জেনে ফেলতে কিন্তু এখন পিহুকে ডাকাডাকি করলে পিহু খুব রেগে যাবে। পড়াশুনায় তার এতো মনোযোগ কোথা থেকে আসে তাই কুহু ভেবে পায় না। কুহু আর কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকলে নিশ্চিত সে ঘুমিয়ে যাবে তাই উঠে বসে। কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে পিহুকে উদ্দেশ্য করে বলে,- পিহু প্লিজ আগে কথাটা বলে ফেল তারপর আবার পড়তে বসিস।- একদম চুপ ডিস্টার্ব করবি না।কুহু বিছানা ছেড়ে উঠে উড়নাটা ভালোভাবে মাথায় দিয়ে তার ঘরের সাথে এটাচড্ বারান্দাটায় যেয়ে দাঁড়ায়। দিনের বেলায় হোক আর রাতই হোক না কেনো কুহু বারান্দায় খুব একটা যায় না। কুহুর যে ভালো লাগে না ব্যাপারটা তা না। আসলে তাদের বারান্দার ঠিক পাশেই অপরপাশের ফ্ল্যাটের বারান্দা। ঔ ফ্ল্যাটে তিন তিনটা ছেলে থাকে তাই বারান্দাটায় কুহু বেশি একটা আসে না। কিন্তু আজ ঘুম না আসার জন্য সে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। চাঁদ দেখতে খুব ভালেবাসে কুহু কিন্তু রাতে সে না যায় বারান্দায় না যায় ছাদে তাই সে এভাবে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখতে পারে নাতবে মাঝে মাঝে পিহু ঘুমিয়ে পড়ার পর সে জানালা খুলে বিছানায় শুয়ে চাঁদ দেখতে থাকে। পিহুটা বড্ড ভয় পায় রাতে জানালা খুলে ঘুমোতে।কুহুর হঠাৎ মনে হলো পাশের বারান্দায় কেউ একজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। আড়চোখে তাকাতেই দেখতে পায় একটা ছেলে মোবাইলে কথা বলছে। কথা শুনে কুহুর মনে হচ্ছে সম্ভবত গার্লফ্র্যান্ডের সাথে কথা বলছে। কুহু চুপচাপ ঘরে ফিরে আসে।পিহু হলে জীবনেও চলে আসতো না বরং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনতো আর পরে এসে কুহুর কাছেও সব ডিটেইলসে্ বলতো। কুহুরও বেশ ইচ্ছে হচ্ছে দাঁড়িয়ে কথা শুনতে। বেশ মজা লাগে এধরনের কথাগুলো তার কাছে আবার বিরক্তও লাগে। কুহু আর পিহুর কাজই হচ্ছে এধরনের কথাগুলো শুনে শুনে হাসহাসি করা। তবে এভাবে দাঁড়িয়ে কথা শোনাটাও অড দেখায় তাই সে চলে এসেছে।- এই পিহু বলবি কিনা বল?- পড়া শেষ হোক তারপর।- আরে বলে ফেল না। আমিও তোকে আজকের কাহিনীটা বলবো।- আজ আবার কি হয়েছে?- ট্রেনে আমার পাশে একটা অদ্ভুত ছেলে বসেছিলো।- তুই নিজেই পিকুলিয়ার তাই তোর সাথে সব আজব আর অদ্ভুত মানুষদেরই দেখা হয়।- এই এখন তোর পড়ার ডিস্টার্ব হয় না?- তুই আমাকে ডিস্টার্ব করছিস।- যা মর!- আচ্ছা বলছি।- হুম বল।- গত শুক্রবারে আমি ফিজিক্স প্রাইভেট থেকে বাসায় ফিরছিলাম। রিকশা থেকে নামার সাথে সাথে একটা মেয়ে হুট করে দৌড় দেয় আর আমার সাথে সে ধাক্কা লেগে পড়ে যায়।- তারপর?- তারপর আর কি সরি বলে মেয়েটা চলে যায়।- এই তোর কাহিনী?- না আরো আছে। বিকেলের দিকে সেই মেয়েটা আমাদের বাসায় আসে।- কেনো?- ধাক্কা লেগে পড়ে গিয়েছিলাম না তখন আমার হাতে তিনটা খাতা ছিল। আমি ভুলে একটা ফেলে দিয়ে এসেছিলাম। তাই সে এটা দিতে এসেছিল।- বাসা কীভাবে চিনলো?- ইরিন নাকি আমাকে দেখেছিল এই বাড়িতে ঢুকতে আর তাছাড়া ইরিন আমাদের পাশের বিল্ডিংটায় থাকে।- ওহ্ মেয়েটার নাম ইরিন।- তুই চিনিস নাকি?- না তো।- কিন্তু মেয়েটা তোকে চিনে।- আমাকে?- হ্যা তোকে চিনে।- কীভাবে চিনে?- এই ইরিন হচ্ছে সেই আজব প্রাণীর বোন। সেভাবেই হয়তো তোকে চিনে।- ও মাই গড।- আমার কি মনে হয় জানিস মেয়েটা ইচ্ছে করে সেদিন দৌড় দিয়েছিল নাহয় রাস্তায় শুধু শুধু কেউ এমনভাবে দৌড় দেয়?- কি বলতে চাচ্ছিস?- দেখ আমার মনে হচ্ছে ইরিন ইচ্ছে করেই আমার বই খাতা ফেলে দিয়েছিল। তারপর আমার খাতা লুকিয়েছিল।- তোর খাতা দিয়ে ঐ মেয়ে কি করবে?- খাতা দিতে আসার নাম করে তোর খোঁজ করবে।- সত্যি সত্যি খাতাটা দিতেও তো এসে থাকতে পারে।- তুই আসলেই কিছু বুঝিস না আপুণি।- তো বুঝিয়ে বল।- ইরিন সেদিন আমায় সরি বলেই উঠে চলে যায় তার মানে সে আগেই আমার খাতা নিয়ে ফুরুৎ করে উড়াল মারে। আর সবচেয়ে সন্দেহজনক হলো তাহলে সে আমার বাসা চিনলো কীভাবে? তার কথা মতে তো সে আমাকে এই বাড়িটায় ঢুকতে দেখেছে।- আগে হয়তোবা কখনো দেখে থাকতে পারে।- তা ঠিক।- আচ্ছা তুই কীভাবে জানলি ইরিন ঐ আজবের বোন?- ইরিন মেয়েটা প্রচন্ড বকবক করে। বাসায় এসে যে আমার সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছিল শেষ করার নামই নিচ্ছিলো না। কথায় কথায় বলে সে নাকি বাস্কেটবল খেলতে ভালোবাসে।- তাতে কি হয়েছে?- ইরিন বলেছে সে তার বড় ভাইয়ের কাছ থেকে বাস্কেটবল খেলা শিখেছে।এখন তুই মিলিয়ে নে। তার উপর আবার ইরিন বারবার তোর কথা জিজ্ঞাসা করছিল। তুই কোথায়? অনেকদিন ধরে নাকি তোকে দেখে না। আসলে ইরিনকে ইরিনের ভাই পাঠিয়েছিল।- আমারো তাই মনে হচ্ছে।- তুই শুয়ে পড় তো আমার আরো পড়া বাকি। কাল তোর অদ্ভুতের কাহিনী শুনবো।- ঠিক আছে।কুহু বেশ কিছুক্ষণ ধরে ঘুমানোর চেষ্টা করছে কিন্তু ঘুম আসছে না। কুহু পাঁচ ছয় মাস ধরে চিন্তা করছে এই ছেলেটা এভাবে কুহুর পিছনে লেগে আছে কেনো? কুহুর বেশ ভয় হয় ছেলেটার কথা মনে পড়লে। কুহুরা এই বাড়িতে আছে প্রায় সাত আট বছর ধরেপ্রায় ছয় সাত মাস আগে কুহুদের বিল্ডিং এর পাশের বিল্ডিংটায় ঐ ছেলেটা তার ফ্যামিলি নিয়ে ভাড়া থাকা শুরু করে। কুহু প্রতিদিনকার মতো বিকেলে গিয়েছিল ছাদ থেকে কাপড় আনতে। হঠাৎ একটা বাস্কেটবল এসে কুহুর পাশে পড়ে। কুহু ভয় পেয়ে আস্তে করে একটা চিৎকার দেয়। সাথে সাথেই একটা ছেলে বলে উঠে,- সরি! বলটা একটু এখানে পাস করুন তো।কুহু কিছুটা ধাতস্হ হয়ে তারপর আবার বাকি কাপড় নামাতে থাকে। ছেলেটা আবার বলে,- বাস্কেটবলটা একটু পাস করুন তো। নইলে আবার কষ্ট করে আপনাদের বাসার ছাদে যেতে হবে।কুহু কিছুটা ইতস্তবোধ করার পর বাস্কেটবলটা তুলে পাশের বিল্ডিং এ ছুঁড়ে ফেলে। - উহু আপনি তো ভালো পারেন না। আর একটু হলেই নীচে পড়ে যেত। এখন থেকে প্রতিদিন আপনি আমাকে বল পাস করবেন তাহলে একটুখানি করে করে শিখে যাবেন। ঠিক আছে?- আজব!- উহু কলরব।-এই কুহু কি হলো ছাদ থেকে কাপড়গুলো নিয়ে আয়।- মা পিহুকে বলো না। আমাকে দিয়ে সব কাজ করাতে হয় কেনো তোমার?- পিহু জীবনেও এখন নড়বে না সে কম্পিউটার নিয়ে বসে আছে।- আমিও পারবো না।- পারবো না এটা আবার কোন ধরনের কথা? যা বলছি।কুহু এখন মোটেও চাচ্ছে না ছাদে যেতে। কারণ আজ শুক্রবার। শুক্রবার দিন ঐ আজবটা ছাদেই দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু মাকে কিছু বলতেও পারছেনা। মাকে কিছু জানালেই মা তিলকে তাল বানিয়ে ফেলবে। এখন যদি কুহু তার মাকে কলরবের কথা জানায় শিউর মা সোজা কলরবের বাসায় যেয়ে উঠবে তারপর তার বাবা - মা চৌদ্দ গোষ্ঠীকে কথা শুনিয়ে আসবে। এটা খুবই কুৎসিত একটা ব্যাপার হবে। এধরনের কর্মকাণ্ডে দেখা যায় হিতে বিপরীত হয়। ছেলেরা দমে যাওয়ার বদলে মনে জিদ পুষে রাখে আর সুযোগ পেলেই ঝাড়ে।তাছাড়া কলরব যে তাকে ডিস্টার্ব করে ব্যাপারটা তেমন না। কলরব শুধু কুহুকে বাস্কেটবল ছুঁড়ে দেয় আর সেটা পাস করতে বলে। অবশ্য একবার নাম জিজ্ঞাসাও করেছিল কুহু বলেনি। সেজন্য কুহুকে ফুলটুশী বলে ডাকে। ফুলটুশীও যে সবসময় ডাকে তেমন না। যখনই কলরব কুহুকে তার নাম জিজ্ঞাসা করে কুহু তখন চুপ করে থাকে আর তখনই কলরব কুহুকে বলে, " ইটস্ ওকে ফুলটুশী "এটাই কুহুর সবচেয়ে বেশি বিরক্ত লাগে। রাস্তা ঘাটের যেকোনো ছেলে তাকে ফুলটুশী বলবে সেটা কুহুর একদমই সহ্য হয় না। কুহু বেডরুমে যেয়ে পিহুর পিছনে দাঁড়িয়ে পিহুকে বললো,- পিহু ছাদ থেকে কাপড়গুলো নিয়ে আয় তো।- এটা কি আমার কাজ??- প্লিজ!- বিছানা গোছানো আমার কাজ আর এসব কাপড়- চোপড় আনা নেওয়া গোছানো এগুলো তোর।- আমি আজ থেকে বিছানা গোছাবো আর তুই ছাদ থেকে কাপড়..- মোটেও না আমার ঘর থেকে বের হতে ভালো লাগে না। একদমই না পারতে বের হই।- একটু করলে কি হয়?? বড্ড বেয়াদব হয়ে গিয়েছিস তুই। চড় থাপ্পর কয়েকটা খেলে ভালো হয়ে যাবি।- এমন রেগে যাচ্ছিস কেনো?- কেনো জানিস না? ঐ ফাজিলটা তো ছাদেই আছে।- তো কি হয়েছে?- আমি যাব না ছাদে।- কেনো?- দেখ ব্যাপারটাকে আমি প্রথম সিরিয়াসলি না নিলেও এখন বেশ ভাবাচ্ছে আমাকে। নিজের বোনকে বাসায় পর্যন্ত পাঠিয়ে দিয়েছে।- কেনো পাঠিয়েছে বল তো?- কারণ আমাকে এই কয়েকদিন ছাদে দেখেনি তাই হয়তো।- ঠিক তাই। এখন তুই ভেবে দেখ যদি তোকে না দেখতে পেয়ে ঐ কলরব বাসা পর্যন্ত চলে আসে তাহলে কেমন হবে?- বাসায় আসতে যাবে কেনো?- যেহেতু বোনকে একবার পাঠিয়েছে নিজে আসতে আর কতদিন।- কি করতে বলছিস?- বলছি তুই নিজের মতো চলবি ঐ আজবের জন্য নিজেকে গুটিয়ে নেয়ার দরকার নেই। তবে এখন থেকে বাস্কেটবল হাতেও নিবি না। সেদিন বাস্কেটবলটা যদি ভালো মানুষী না দেখিয়ে পাস না করতি তাহলে এতদূর গড়াতো না।- একজন মানুষ হেল্প চেয়েছে করেছি এতে আমার দোষ কোথায়?- হেল্প করাটাই তোর দোষ।- তুই হলে কি করতি?- চুপচাপ না শোনার ভান করে চলে আসতাম।- আসলেই কেনো যে এ কাজটা করতে গেলাম।- একদিন করার পর যখন সে বললো তোকে প্রতিদিন একটুখানি করে করে শিখাবে তারপরো তুই তাকে প্রায়ই বল পাস করেছিস। এটা তোর অনেক বড় একটা ভুল। দেখ তুই কিন্তু সেই লেভেলের সুন্দরী না যে তোকে দেখেই লাভ এট ফার্স্ট সাইট জাতীয় কিছু হয়ে যাবে কিন্তু তোর সাথে চলতে চলতে ধীরে ধীরে ভালোলাগাটা তৈরী হয়ে যাবে তুই হচ্ছিস তেমন টাইপের মেয়ে। আমার মনে হয় বেচারা বল পাস করতে করতে তোকে তার মনটাও পাস করে দিয়েছে।- আমি ছাদে যাচ্ছি কাপড় আনতে।- যাও বাবু যাও কিন্তু নিজের মনটা আবার পাস করে দিও না।কুহু ছাদে যেতেই না চাইতেও চোখ চলে যায় পাশের ছাদে। কলরব সেখানে বাস্কেটবল নিয়ে পায়চারী করছে। কুহুকে দেখেই বলটা কুহুদের ছাদে ছুঁড়ে ফেললো।কুহু না দেখার ভাণ করে কাপড় নামাতে লাগলো। কাপড় নিয়ে চলে যেতে পা বাড়াতেই কলরব বললো,- বলটা একটু পাস করো তো।কুহুর মেজাজটা প্রচণ্ড রকমের খারাপ হয়ে গেল। এতদিন আপনি করে বলতো এখন তুমি করে বলছে। কোনোরকম রাগটা মাটি চাপা দিয়ে চলে যেতে নিলেই কলরব আবার বলে,- এতদিন বেড়াতে গিয়ে হয়তো ভুলেই গেছো সুন্দর করে কীভাবে বল পাস করতে হয়। বলটা এমন ভাবে তোমাকে ছুঁড়ে ফেলতে হবে যেন বলটা ঠিক আমার হাতে আসে কেমন?কুহু চিবিয়ে চিবিয়ে কলরবকে বললো,- আপনার কি মনে হয় আমি কোনোদিন বাস্কেটবল খেলা দেখিনি? - তা মনে করবো কেনো?- তাহলে এমন করে বলছেন কেনো?- কেমন করে?- আপনার কি মনে হয় বাস্কেটবল কি মানুষ এভাবে খেলে? হাতে হাতে ছুঁড়ে খেলে?- না তা খেলবে কেনো? কুহু কলরবকে আর কিছু না বলেই ছাদ থেকে নেমে আসে। রুমে ঢুকেই আলনায় কাপড় গুছিয়ে রাখতে রাখতে পিহুকে বলে,- আজবটা আজ কি করেছে জানিস?- আজবের কাহিনী তো কয় মাস ধরে শুনছিই এখন তুই তোর ট্রেনের ঘটনাটা বল।- কোন ঘটনা?- ঐ যে কোন অদ্ভুত ছেলের কথা বলবি বললি না? - ও হ্যা পরে বলবো এখন মেজাজ প্রচণ্ড রকমের খারাপ।- ওকে আপুণি।কুহু বাসায় এসেছে দুদিন হলো কিন্তু এখনো লাগেজ থেকে জিনিশপত্র নামানো হয়নি। সন্ধ্যায় চা খেয়েই কুহু লাগেজ থেকে সব নামিয়ে রাখতে শুরু করে। তারপর লাগেজটা আলমারির পাশে এক সাইডে রেখে হ্যান্ডব্যাগটায় হাত দেয়। চেইন খুলতেই কূজনের দেয়া বইটা চোখে পড়ে আর নিমিষেই ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে। বিছানার মাঝামাঝি একটা বালিশ রেখে সেটায় উপুড় হয়ে শুয়ে কুহু বইটা পড়তে শুরু করে। পিহুর হোম টিউটর চলে যাওয়ার পর পিহু রুমে এসে কুহুর হাতে বই দেখে বলে,- এটা না একবার পড়েছিস?- হুম কলেজের লাইব্রেরী থেকে নিয়ে পড়েছি।- এটা কি কিনেছিস নাকি?- নাহ্ কূজন দিয়েছে।- একটা খারাপ মানুষ তোকে বই দিল আর তুইও তা নিয়ে নিলি?- তুই কি দেখেছিস তাকে তাহলে খারাপ মানুষ বলছিস কেনো? যদি দেখার পর বলতিস তাহলে আমি মেনে নিতাম কারণ আমি জানি তুই মানুষ চিনতে কখনোই ভুল করিস না।- তুই ই তো খারাপ বললি?- আমি আবার কখন বললাম?- ঐ যে বললি না কুজন।পিহুর কথা শুনে কুহু হাসতে হাসতে বইটা বন্ধ করে উঠে বসে বললো,- আরে গাধী দীর্ঘ উ- কার। সমার্থক শব্দ পড়িসনি কখনো?- পাখির ডাক??- হুম তাই।- এটাই কি ঐ অদ্ভুত ছেলেটা?- হুম।- পুরোটা বল।- বলছি।কুহুর কাছে সব শুনে পিহু বললো,- আইডিটা আমাকে একটু দেখিয়ে দে তো।- কেনো?- মজা করবো।- একদম না পরে ঝামেলা হলে?- হবে না আমি কি উনার সাথে প্রেম করবো নাকি? না এ ধরণের কোনো কথা বলবো জাস্ট জানালা আর উনার কানেকশনের ব্যাপারে জানবো।- কোনো প্রয়োজন নেই।- একটু করি না মজা।- না করেছি কানে যায়নি?- আচ্ছা আচ্ছা।..- ইরিন! ইরিন! ইরিন!- কি হলো ভাইয়া এভাবে চেচাচ্ছো কেনো?- কি করছিলি?- তেমন কিছুই না আর্ট করছিলাম।- ডিস্টার্ব করলাম?- ভাইয়া কি বলবে তাড়াতাড়ি বলো তো।- কুহুর সাথে আজ দেখা হয়েছিল।- ভাবি এসেছে??- এই ভাবি ভাবি করছিস কেনো?- তাহলে কি ডাকবো? লজ্জা পাচ্ছো বুঝি? লজ্জা তো নারীর ভূষণ।- এসব লজ্জা টজ্জা আমার নেই। থাকলে কি আর ক্লাস টেনে পড়ুয়া বোনের কাছে নিজের প্রেমের কাহিনী বলতাম নাকি?- তাহলে ভাবি ডাকলে সমস্যা কোথায়? - কারণ পরে মুখ ফসকে কুহুকে ভাবি বলে ফেলবি আর আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে।- ভাবির সাথে কি আমার কথা হওয়ার কোনো স্কোপ আছে?- আপাতত নেই তবে হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ্।- কীভাবে?- জেনে যাবি এখন তুই তোর কাজে যা।- ওকে ভাইয়া।- এই শোন নে তোর চকলেট।- থেঙ্ক ইউ ভাইয়া।- আর শোন ভাবি ডাকা অফ করে আপাতত আপু ডাকার অভ্যাস কর পরে সারাজীবন তো ভাবিই ডাকতে হবে তাইনা?- ওকে আমার হবু ভাবির বর।- কথাটা বেশ পছন্দ হয়েছে। "হবু ভাবির বর" দারুণ বলেছিস। এটার জন্য কাল দুইটা চকলেট বক্স এনে দিব আমার বোনকে।- ইউ আর দা বেস্ট ব্রাদার ইন দা ওয়ার্ল্ড।- আর তুই বেস্ট সিস্টার ইন দা গ্যালাক্সি। হাসানাদ সাহেব বেড টি এক চুৃমুকেই শেষ করে তাঁর স্ত্রী জাহরা খাতুনকে ডাকলেন।- জাহরা! জাহরা!- আমাকে ডেকেছেন?- হুম ডাকছিলাম।- কিছু লাগবে?- হুম।- বলুন।- আমার ছেলেটা উঠেছে ঘুম থেকে?- মাত্র ডেকে তুলে এসেছি।- আচ্ছা তুমি আজ খিচুড়ি করো তো কয়েকদিন ধরে খেতে ইচ্ছে করছে।জাহরা বেগম হাসিমুখে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, - ভুনা?- ঠিক তাই।স্ত্রী চলে যাওয়ার পর হাসানাদ সাহেব পাইপ টানতে টানতে এগুলেন ছেলের রুমের দিকে। ছেলের রুমে পা দিতেই হাসানাদ সাহেব একগাল হেসে ছেলের বেডে যেয়ে বসলেন। হাসানাদ সাহেবের স্ত্রী বলেছিলেন ছেলেকে ঘুম থেকে তিনি জাগিয়ে তুলেছেন। হাসানাদ সাহেব বেশ ভালো করেই জানতেন উনার ছেলে এখনো বেড ছেড়ে উঠেনি। বেশ প্রফুল্ল মনেই তিনি ছেলেকে ডেকে বললেন,- কূজন! বাবা আমার এখনো উঠোনি ঘুম থেকে?কূজন হাত দিয়ে বেডসাইড টেবিলের উপর রাখা চশমাটা নিয়ে চোখে দিয়েই উঠে বসতে বসতে বললো,- গুড মর্নিং বাবা।- মর্নিং মাই সান।- তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম বাবা।হাসানাদ সাহেব কিছুটা হেসে বললেন,- তোমার মা যখন এসেছিল তোমাকে ডাকতে তখনও নিশ্চয় এভাবেই তোমার মাকে বলেছো তোমার জন্যইঅপেক্ষা করছিলাম মা।- হুম বলেছি।- আচ্ছা তুমি সবসময় দুজনকেই একই কথা বলো কেনো? সেই ছোটবেলা থেকেই তুমি আমাকেও এই কথা বলে আসছো আবার তোমার মাকেও একই কথা বলে আসছো। কেনো বলোতো? আসলে তুমি কার জন্য অপেক্ষা করো বলো তো।কূজন মুচকি হাসি দিয়ে তার বাবার প্রশ্নের জবাবে বললো,- দুজনের জন্যই। আমি চাই দুজনই তাদের ছেলেকে সকালে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলার আনন্দটা পাক।- ভালোই বলেছো তবে দুজন একসাথে ডাকলে কেমন হয়?- ভালোই তবে এটাতে একটা অন্যরকম মজা পাই।- তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও আজ খিচুড়ি হবে।- এখনই আসছি বাবা।হাসানাদ সাহেব ছেলের রুম থেকে বের হতে হতে ভাবলেন ছেলেটা একদম তার মায়ের মতন হয়েছে, হাসি ছাড়া যেন কোনো কথাই বলতে পারে না।সবাইকে কীভাবে খুশি রাখতে হয় তাও জানে।বাবা বের হতেই কূজন ড্রেসিংরুমের দিকে পা বাড়ায়। সে অনেক আগেই ফ্রেশ হয়ে গিয়েছে শুধুমাত্র বাবার জন্য আবার বেডে শুয়ে অপেক্ষা করছিলো। ব্লু জিনস্ আর ব্ল্যাক শার্ট পড়ে শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে কালো ফ্রেমের চশমাটা কোথায় রেখেছে মনে করার চেষ্টা করছে। হঠাৎ দেখে চশমাটা রিডিং টেবিলের উপর। চশমাটা চোখে দিয়ে ব্লু স্নিকারস্ পায়ে দিয়ে কিচেনের দিকে যায়। কিচেনে যেয়েই মাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,- মা তুমি এত্তোগুলো ভালো এখন তাড়াতাড়ি করো তো বাইরে বের হতে হবে। তুহিনরা অপেক্ষা করছে।- এই তো বাবা হয়ে গেছে এখনই দিচ্ছি তোমাকে। কয়টায় ফিরবে?- তুমি যখন বলবে মা।- এটা কেমন কথা? তুমি এতদিন পর এসেছো বন্ধুদের সাথে যতক্ষণ ইচ্ছা আড্ডা দিবে। আমি কি তোমাকে টাইম বেঁধে দিব নাকি? জাস্ট জিজ্ঞাসা করেছি তোমার জন্য কি লাঞ্চের ব্যবস্থা করবো নাকি একেবারে ডিনারের?- তোমার আর বাবার সাথেই লাঞ্চ করবো। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে দুপুরেই এসে পড়বো।- তুমি এতো ভালো কেনো?- অ্যাওয়ার্ড কোথায়?- আনবো আনবো।- কি আনবে?- একটা মিষ্টি বউ আনবো তোমার জন্য।- তাহলে তো আমার অবস্হাও বাবার মতো হয়ে যাবে। মিষ্টি বউ এসে ডায়াবেটিকস এর রোগী বানিয়ে দিবে। - তাই বুঝি?- তিন সত্যি।- এই শুনো গাড়ি নিয়ে যেও কিন্তু।- ওকে মা।..কলরব দশ মিনিট ধরে বাইক নিয়ে অপেক্ষা করছে এখনো ইরিনের আসার নাম গন্ধ নেই। বিরক্ত হয়ে কলরব বাইক থেকে নেমে বাসার দিকে যেতেই ইরিনকে দেখলো গেইট পার করে সে বেরিয়ে এসেছে। কলরব আবার ফিরে বাইকে যেয়ে বসলো। ইরিন পিছনে বসতেই বাইক স্টার্ট দিল কলরব।- তুই কি কোচিং এ যাচ্ছিস নাকি বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে যাচ্ছিস? এতো সাজা লাগে নাকি??- কোথায় এত সাজলাম?- সাজতে সাজতে আমার অফিস টাইমের দেরি করিয়ে দিলি। - সরি ভাইয়া।- ওকে ওকে। কিন্তু দরকার কি এত সাজগুজ করার?- আমি করেছি তো তাই ভালো লাগেনি তোমার। ভাবি সরি কুহু আপু যদি করতো তাহলে তো ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে।- কুহু আবার কখনো সাজে নাকি?- সাজবে না কেনো?- আমি তো কখনো দেখিনি।- তোমার জন্য কি ছাদে সেজে সেজে আসবে নাকি?- একদিন তো জুতার দোকানেও দেখেছিলাম আবার আরেকদিন ওর কলেজের সামনেও দেখেছি কিন্তু সাজতে তো দেখিনি।- কুহু আপু তো বোরকা পরে বাইরে যায় সাজবে কেনো?- বোরকা পরেও মেয়েরা সাজে তো।- কুহু আপু সেরকম না। - তো বললি কেনো সে সাজে?- সাজেই তো আমি দেখেছি।- তুই কখন দেখলি?- ঐ যে ভাবিদের ধুর আপুদের বাসায় গিয়েছিলাম না তখন দেখেছি।- কুহু তো তখন এখানে ছিলই না।- ছবি দেখেছি পিহু আপুর মোবাইলে। সেই সাজ দেয় তোমার কুহু।- সত্যি বলছিস??- আজ্ঞে আমার হবু ভাবির বর।- ইশ্ আমি কখন দেখবো?- তুমি তো মনের কথাই বলো না।- মনের কথা বলার কথা মানে তুই কি আমাকে কুহুর সাথে প্রেম করতে বলছিস?- অনেকটা তেমনই।- কুহু জীবনেও প্রেম করবে না।- বলেই দেখো না। মেয়েরা প্রথম এমন ভাব নেয় কিন্তু পরে নিজেরাই গলে যায়।- তোর ভাবি সেরকম না। - আমার ভাইকে বাংলাদেশের কোনো মেয়ে রিজেক্ট করবে বলে আমার মনে হয় না।- কেনো তোর ভাই কি প্রিন্স হ্যারি?- না তাহলে তো বলতাম পৃথিবীর কোনো মেয়েই আমার ভাইকে রিজেক্ট করবে না। তা তো বলিনি তবে আমার ভাই মিস্টার ইবনাত কলরব যে কিনা সবকিছুতে এত অলরাউন্ডার তাকে কেনো রিজেক্ট করবে?কি নেই তোমার? স্কুল কলেজের ফার্স্ট বয় ছিলে। তার উপর বাস্কেটবল চ্যাম্পিয়ন। দেখতে পুরাই ডার্ক হ্যান্ডসাম। ড্রেসিং চয়েজও সেই লেভেলের। কখনো এক ধাঁচের কিছু পরো তুমি? প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন স্টাইল মারো। আর তোমার সানগ্লাস উফ্। সানগ্লাস পরে যখন বাইকে করে যাও তখন আমার বান্ধবীরা আমাকে বলে,- উফ্ তোর ভাইটা আরেকটু ছোট হতে পারলো না তাহলে বয়ফ্রেন্ড বানাতে পারতাম।- এতো পাম্পিং কেনো? কিছু লাগবে??- হুম ভাবি লাগবে।- ভাবছি বাবাকে বলেই দেই কুহুর কথা।- তাড়াতাড়ি বলো।- বিসিএস টা হোক তারপর বাবাকে পাঠাবো কুহুর বাবার কাছে।- একটুর জন্য মিস হয়ে গেল তোমার,ভাইবাতে যেয়ে বাদ পড়ে গেলে।- প্রথমবার ভাইবা পর্যন্ত গিয়েছি এটাই কয়জন পারে?- বিসিএস এর জন্য অপেক্ষা করতে হবে কেনো? তুমি তো আর বেকার না ভালোই চাকরি করছো। সেলারি ও ভালো পাও।- হ্যা চাইলে এখনো পাঠানো যায় বিয়ের প্রস্তাব।- তুমি বলতে না পারলে বাবাকে আমি বলি?- আরে না বাবা তো বন্ধুর মতো বাবাকে আমিই বলবো।- তাড়াতাড়ি করো কিন্তু।- এখন আপনি নামুন আমরা এসে পড়েছি।- বাই ভাইয়া।- লক্ষী বোন।- লক্ষী ভাবির বর।- ইশ্ ঘায়েল করে দিলি।..কলেজ থেকে ফিরেই কুহু যে ঘুম দিয়েছে উঠেছে একদম বিকেলের দিকে। পাঁচটার সময় লাঞ্চ সেরেই ছাদে চলে এসেছে কুহু। আকাশে কিছুটা মেঘ করেছে দেখতে ভালোই লাগছে। কুহু ভাবলো যেহেতু আজ রবিবার নিশ্চয় কলরব আসবে না তাই সে বেশ ফূর্তিতে কিছুক্ষণ ছাদে থেকে তারপর কাপড় নিয়ে নীচে চলে যাবে। হঠাৎ কুহুর মনে হলো গতকাল তো শনিবার ছিল শুক্র শনিতে তো কলরব বিকেলে ছাদেই থাকে তাহলে গতকাল কেনো আসেনি? কুহু সেদিন যে শক্ত করে কথা বলেছিল তাই রাগ করেছে কি? পরক্ষণেই কুহুর মনে হলো ভালোই হয়েছে আসেনি। কুহু তাহলে বেঁচে গিয়েছে। কলরব বেশ কিছুকক্ষণ ধরে আতর খুঁজছে কিন্তু কোথাও পাচ্ছে না। অবশেষে বিরক্ত হয়ে মাকে ডাকলো,- মা! মা!- কি হলো ডাকছিস কেনো?- শুনো না আতর কোথায় রেখেছি খুঁজে পাচ্ছি না। একটা না দুটা না তিন তিনটা আতরের বোতল এভাবে গায়েব হয়ে গেল কীভাবে।- আমার কাছে।- মা তাড়াতাড়ি দাও তো।- গায়েব করেছি কি তাড়াতাড়ি দেওয়ার জন্য নাকি?- মা তুমি আবার শুরু করলে?কলরবের মা শাড়ির আঁচল নাড়াতে নাড়াতে বললেন,- ছাদে আয় তো একটু আমার সাথে।- এই রোদের ভিতর? ওহো মা তুমি কি চাও তোমার এই হ্যান্ডসাম ছেলেটা ভর দুপুরে ছাদে উঠে পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাক?- তুই কি চাস তোর জুম্মার নামাজের দেরি করতে?- ওকে মাই লর্ড আসছি।কলরব প্রায় দশ মিনিট ধরে তার মায়ের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তার মা বেশ সুন্দর করে দাঁড়িয়ে গুণগুণ করে গান গাইছে,"আমার স্বপ্ন যে সত্যি হলো আজ"কলরব রোদ ঢাকার জন্যে তার মায়ের আঁচল মাথার উপর ধরে রেখেছে। কলরব আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও যখন দেখছে তার মায়ের গুণগুণ করা বন্ধই হচ্ছে না তখন বললো,- মা বাবা তো নীচেই আছে ডেকে দিব?- কেনো?- তোমার তো গান শোনাতে ইচ্ছা করছে তাই ডাকবো?- না।- মা আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।- "মেরে সামনেবালী খিড়কি মে এক চান্দকা টুকরা রেহতা হে.."- মা আমি আসছি।কলরব চলে যেতে পা বাড়ালেই কলরবের মা বলে,- কয়দিন ধরে প্রেম করছিস?- প্রেম আর আমি?- না আমি।- হ্যা তুমিই তো এখনো বাবার সাথে প্রেম করো।- হ্যা তা তো করি তবে তোর বাবা বেশ সাহসী প্রেমিক তোর মতো ঐআমি দূর হতে তোমারেই দেখেছিআর মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থেকেছি টাইপের প্রেমিক না।সে হলো যাব পিয়ার কি তো ডারনা কিয়া টাইপের হিরো।- আর তুমি হলে ড্রামা কুইন।আমি আসছি মা।- হুম নামাজ থেকে ফিরলে তোর সাথে কথা বলবো।কলরব চলে যেতেই কলরবের মা আবার গুণগুণ করতে করতে বাসায় ফিরে এলেন। তিনি বেশ ভালো করেই জানেন কলরব এই বাড়িতে আসার পর থেকেই ছাদে দাঁড়িয়ে একটা মেয়ের সাথে কথা বলে। তিনি বেশ কয়েকদিন দূর থেকে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করেছেন এমনকি একদিন টাঙ্কির পিছনের দাঁড়িয়ে থেকে তাদের কথপোকথন শুনেছেনও। মেয়েটা কোনো কথায় বলেনি উনার ছেলের সাথে বরং মেয়েটাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছিল মেয়েটা বেশ ইতস্ত বোধ করছিল। আর কলরবও তেমন কোনো কথাই বলেনি শুধু বাস্কেটবল টা ছুঁড়ে ফেলে মেয়েটাকে ডেকে বলেছে সেটা দেয়ার জন্য। আবার আপনি বলে সম্বোধন করেছে।কলরবের মা প্রথমে ব্যাপারটা হালকা ভাবে নিয়েছেন তবে এখন মনে হচ্ছে কলরব মেয়েটাকে পছন্দ করে।..কূজন মসজিদ থেকে ফিরেই নিজের বেডরুমে যেয়ে নিজের লাগেজ গুছাতে শুরু করে। লাগেজ গুছানো শেষেই লাঞ্চ করার জন্য ডাইনিংরুমে যেতেই হাসানাদ সাহেব বলে উঠেন,- কিসে যাবে কূজন?- বাবা ট্রেনে করে যাব।- কেনো ড্রাইভারকে বলি গাড়ি বের করতে।- না বাবা ট্রেন জার্নিটা জাস্ট দারুণ লেগেছে আমার।- তুমি আবার ট্রেনে আসলে কখন?- এবার ট্রেনেই এসেছি। - ওহ্।- এসি তে যাবে তো?- হুম।- আসার সময় কীভাবে এসেছো? - না এসিতে আসতে পারিনি আসলে কোনো প্লেন ছিল ট্রেনে আসার হঠাৎ ইচ্ছা হলো তাই চলে এলাম। টিকিট আবার ব্ল্যাকে কেটেছি।- তোমার জানালার পাশের সিট পেয়েছিলে?- না বাবা তবে একটা মেয়ে হেল্প করেছিল।- তা তুমি তার জন্য কি করলে?- ট্রেন থেকে নেমে একটা বই কিনে গিফ্ট করেছি।- ভালো করেছো। মেয়েরা তো জানালার পাশের সিটে বসার জন্য যানবাহনে পেট্রোল বোমাও ছুঁড়তে পারে সেখানে সে তোমাকে নিজে সিট ছেড়ে বসতে দিয়েছে।- হুম বেশ ভালো লেগেছে মেয়েটাকে।- নাম জানো?- হুম কুহু।- বাড়ি কোথায়?- ফেণী।- কিসে পড়ে?- জানি না।- কেনো জানো না? জানা উচিত ছিল তোমার।- ওহো বাবা তুমিও না।- কেনো তুমি নিজেই তো বললে মেয়েটাকে তোমার বেশ ভালো লেগেছে।- আমি সেভাবে ভালো লাগার কথা বলিনি।- তাহলে?- বলতে চেয়েছি মেয়েটা অনেক হেল্পফুল।- ওহ্। আচ্ছা কাউকে ভালো লাগলে বলবে আমাকে। আমাকে বলতে না চাইলে তোমার মাকে বলবে।- ঠিক আছে।- হ্যারে কূজন মেয়েটা দেখতে কেমন ছিল?- মা আমি তেমন একটা খেয়াল করিনি তবে বেশি সুন্দরী না আবার খারাপও না।- ওহ্।..কলরবের কথা ছিল নামাজ শেষে বাসায় ফেরার কিন্তু সে ফিরছে রাত এগারোটায়। তাও চুপিসারে কারণ জানে মা আবার তাকে জেরা করা শুরু করে দিবে।কলরব বেডরুমে ঢুকেই গায়ের পাঞ্জাবীটা খুলে একটা টি- শার্ট পরে নেয়। জিনস্ প্যাণ্টটাও চেঞ্জ করে ট্রাউজার পরে ফেলতে মন চাইছে কিন্তু চেঞ্জ না করেই শুয়ে পড়লো। চোখ বন্ধ করতেই কুহুর চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো আর মনে পড়ে গেলো কুহুকে প্রথম দেখার দিনটা।বাসার সব ফার্ণিচার সেট করে রাখার পর হঠাৎ বাস্কেটবলটা নজরে পড়েছিল তার। কলেজের পর আর তেমন একটা বাস্কেটবলের দিকে পড়াশুনার চাপে নজর দিতে পারেনি কলরব। এডমিশন তারপর ভার্সিটির পড়াশুনা সাথে টিউশনি সব মিলিয়ে তেমন একটা ধরা হয়নি প্রিয় বাস্কেটবলটাকে। হঠাৎ চোখে পড়ায় সেদিন কলরব বাস্কেটবলটা নিয়ে ছাদে চলে গিয়েছিল। অনেকদিন ধরে খেলা হয়না দেখে প্র্যাক্টিস করতে করতে হঠাৎ বলটা পাশের ছাদে চলে যায়। সেখানে তাকাতেই দেখে কুহু কাপড় হাতে দাঁড়িয়ে। কুহুকে বলটা পাস করতে বলাতে যখন কুহু কাঁপা হাতে বলটা কলরবদের ছাদে দিল কলরবের খুব হাসি পেয়েছিল। তারপরো হাসিটা চেপে বলেছিল কুহুকে বল পাস করা শিখাবে। কলরব এই একটা কাজ করতে খুব ভালোবাসে। কাউকে কিছু শিখানো সেটা হোক পড়াশুনা আর হোক না অন্য কেনো অন্যকিছু সে বেশ খুশি মনেই সেটা করে। তাই সে কলেজে পড়ার সময় থেকেই স্টুডেন্ট পড়ায়। এখন অবশ্য পড়ায় না কিছুূদিন হলো বাদ দিয়ে দিয়েছে। কুহুকে যে সে প্রথম দেখায় পছন্দ করেছিল ঠিক তা নয়। সে এমনিতেই জাস্ট বল পাস করাটা শিখানোর জন্য এমন করতো। কলরবের বাবা মা দুজনই স্কুল শিক্ষক হয়তো তাদের সাথে থেকে থেকেই শিক্ষক শিক্ষক একটা ভাব এসে পড়েছে তার মাঝে। কুহুকে যে সে ভালোবেসে ফেলেছে সেটা সে বুঝেছে কুহুকে এই বারোদিন ছাদে দেখতে না পেয়ে। আসলে বারো দিন না চার দিন কারণ সে তো শুধু শুক্রবার ও শনিবারেই ফ্রি থাকে আর তখনই ছাদে যায়। প্রচন্ড রকমের মিস করা শুরু করেছিল যখন শুক্রবারের পরও শনিবারে কুহুর দেখা পায়নি সে। তখন সে বুঝেছিল সে আসলে কুহুকে বল পাসিং শিখাতে শিখাতে মন, দিল, জান,প্রাণ, হৃদয় সব পাস করে দিয়ে দিয়েছে। বুঝতে পেরেই কলরব আরো অস্হির হয়ে পড়ে কুহুর জন্য আর তাই ইরিনকে পাঠায়। কলরবের বেশ হাসি পাচ্ছে যে সে এতো দেরি করে বুঝেছে যে কুহুকে তার এতোটাই পছন্দ। অন্তত যখন মুখ দিয়ে না চাইতেও ফুলটুশী কথাটা বের হয়ে গিয়েছিল তখনই বোঝার দরকার ছিল। কলরব কথাগুলো ভাবতে ভাবতে একটু জোরেই হেসে ফেলেছে আর সাথে সাথে রোমের লাইট জ্বলে উঠে। কলরব চোখ খোলে তাকিয়ে দেখে তার মা এসেছে। কলরব উঠে বসতেই কলরবের মা বলে,- পালিয়ে আর কোথায় যাবি? তোর আর তোর বাবার ঘুরে আবার আমার কাছেই আসতে হয়।কলরবের মা ছেলের বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে ছেলের কান ধরে বললেন,- মিথ্যে বলেছিস কেনো আমার কাছে?- আহ্ মা ছাড়ো না।- কান টেনে ছিঁড়ে ফেলবো।- আরে কোনো মিথ্যে বলিনি মা।- আবার মিথ্যে।- না আমি মিথ্যা না সত্যি বলছি কুহুর সাথে আমার তেমন কিছুই নেই।- না হলে ছাদে কি করিস? প্রেম করা হচ্ছে ছাদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে? তুই কি হাই স্কুলে পড়ুয়া ছেলে?- মা প্রেম করি না তো শুধু ওকে ভালো লাগে।- তো বলিস না কেনো?- এমনি তে বলিনি।কলরবের মা কলরবের কান ছেড়ে বিছানায় বসলেন সাথে সাথে কলরব লম্বা হয়ে মায়ের কোলে মাথা রেখে শোয়ে পড়লো। কলরবের মা হাসতে হাসতে বললেন,- পুরো দস্তুর ছয় ফিটের ছেলে আমার একটা মেয়েকে মনের কথা বলতে ভয় পায় কেনো?- ভয় পাবো কেনো?- অবশ্যই পাস নয়তো ছয়মাস মুখে কুলুপ এঁটে থাকতি না। তোর বাবা যখন আমাকে দেখতে এসেছিল তখন তোর নানা বিয়ে দিতে চাইনি। অল্প বেতনের মাস্টারের কাছে কেই বা মেয়ে বিয়ে দিতে চাইবে? তোর দাদাকে যখন আব্বা না করে দিয়েছিলেন তখন তোর বাবা চলে আসার সময় আমার আব্বাকে বলে এসেছিল যদি আমাকে না পায় তাহলে আর কাউকে কোনোদিন বিয়ে করবে না। আর তুই সেই বাবার ছেলে হয়ে ছয় মাস ধরে বল খেলেছিস। লজ্জাজনক!- মা মজা নিচ্ছো?- বলিসনি কেনো কুহুকে?- আমি নিজেও তো আগে বুঝিনি কুহুকে কয়েকদিন না দেখে বুঝতে পেরেছি কুহু আমি ভালোবাসি।- এখন বলছিস না কেনো?- মা কুহু তো বোঝে কিন্তু তার দিক থেকে তো কোনো সাড়া পাইনা।- হয়তো সেও বোঝেনাআর বোঝলেও সে কি এসে তোকে সেধে সেধে এসে বলবে নাকি?- তাই যেন হয়।- আচ্ছা তোর বাবাকে কি পাঠাবো কুহুর বাবার কাছে?- না মা পাঠানোর দরকার নেই।- আমি শিউর উনি মেয়ে বিয়ে দিতে রাজি হয়ে যাবেন।- তাইতো না করছি কারণ এতে কুহু বাধ্য হয়ে আমাকে বিয়ে করবে নিজ ইচ্ছায় করবে না।- আপনার কি তাহলে প্রেম করার শখ হয়েছে? এসব প্রেম করার ইচ্ছা আাদ দিতে হবে।- না মা আমি তো জাস্ট এইটুকু চাই যে কুহু আগে আমাকে কাছ থেকে দেখুক চিনুক তারপর তুমি নাহয় ওর বাসায় যেও।- ঠিক আছে আপনার কাজ হয়ে যাবে জাঁহাপনা।- এখন আসতে পারো।- জো হুকুম মেরি আকা।কলরব আর তার মা দুজনই হেসে দিল একসাথে।..কুহু ছাদে এসে কলরবকে দেখেই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কেনো ফেলে সে নিজেও বুঝতে পারে না। কেনো যেন মনে হচ্ছে কুহু কলরবের জন্যই ছাদে এসেছে। কথাটা ভাবতেই কুহু মুখে একরাশ বিরক্তি ফুটিয়ে চলে যেতে নেয় তখনই কলরব বললো,- কাপড় না নিয়েই যে চলে যাচ্ছো? কুহু কি বলবে ভেবে না পেয়ে চুপচাপ কাপড় নামাতে থাকে। কলরব আবার বললো,- আচ্ছা আমি কি তোমার নাম জানতে পারি?কুহু বিরক্তি নিয়ে কলরবের দিকে তাকাতেই কলরবের নজরে পড়ে কুহুর জোড়া ভ্রুগুলো। কলরবের খুব ইচ্ছে করছে কুহুকে বলতে তার ভ্রু গুলো খুব সুন্দর তবে ইচ্ছেটা দমিয়ে রেখে সে আবার বললো,- এই শনিবারে অফিস থেকে টু্রে গিয়েছিলাম তো তাই আসতে পারিনি।কুহুর মনে হচ্ছে যে কলরব কাজটা ইচ্ছে করে করেছে কারণ ছেলেরা একটা ট্রিক খুব ভালো করে মেয়েদের উপর এপ্লাই করে। কিছুদিন পিছন পিছন ঘুরে তারপর কয়েকদিন আর দেখা দেয় না এতে করে মেয়েটা ছেলেটাকে মিস করতে শুরু করে দেয় আর ছেলেটা সেটা ভালবাসা বলে চালিয়ে নেয়।আর কলরবও কুহুর সাথে এমন কাজটাই করেছে আর সে গলেও যাচ্ছে।কথাটা ভাবতেই কুহু তাড়াতাড়ি করে ছাদ থেকে নেমে চলে আসে। কুহু আজ এতোটাই ভাবনায় মগ্ন ছিল সে খেয়ালই করেনি কলরব আজ খালি হাতে ছাদে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলো।কুহু বাসায় যেতেই দেখে একজন মহিলা বসে সার মায়ের সাথে কথা বলছে। পিহু মায়ের পাশেই বসে আছে। কুহুকে দেখে পিহু চোখের ইশারায় ঐ মহিলার পাশে বসে থাকা মেয়েটাকে দেখায়। কুহু বুঝতে পারে কলরবের মা আর বোনন এসেছে। কুহু কলরবের মাকে সালাম দিয়ে হাসি মুখে কেমন আছে জিজ্ঞাসা করেই নিজের রোমে চলে যায়। পিহু হলে জীবনেও হাসি মুখে কথা বলতো না এমনকি কুহু শিউর কলরবের মা যদি পিহুকে কিছু জিজ্ঞাসা করে পিহু শুধু সে প্রশ্নের জবাবই দিবে নিজ থেকে ভাল আছে কিনা জিজ্ঞাসা করা তো দূরের কথা। কুহু আবার মেহমানদের সাথে খুব সাবলীলভাবে হাসি মুখে কথা বলে। কুহু অজানা অচেনা একটা মানুষের সাথে দীর্ঘক্ষণ ধরে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারে। এই একটা গুণ সে খুব ভালো করে রপ্ত করেছে। কুহু ঘরে বসে বসে ভাবছে কলরবের মা কেনো এসেছে এখানে? কলরব আর কুহুর বিষয়ে কথা বলতে তো নয়?কলরবের মা চলে যেতেই কুহু মাকে ডেকে বললো,- মা ওরা কারা? কেনো এসেছিলেন?- পাশের বিল্ডিং এর আপা এখানকার হাই স্কুলের শিক্ষক। উনার হাজবেন্ড আবার হেডটিচার।- কেনো এসেছিলেন?- ঐ যে উনার মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন তোর কাছে পড়ানোর জন্য।- তুমি কি বললে?- কি বলবো আর? তুই তো কোচিং সেন্টারেও পড়াস আর পড়ানো তো ভালো তাই বলেছি তুই আগামীকাল থেকেই ইরিনকে পড়াতে যাবি।- পড়াবো ভালো কথা কিন্তু ওদের বাসায় যেয়ে কেনো পড়াতে হবে? পড়তে চাইলে বাসায় এসে পড়বে আমি ওদের বাসায় যেতে পারবো না।- গেলে কি হবে?- না আমার ভালো লাগে না।- আচ্ছা বলে দেখবো।..কলরবের বাবা ইফতেখার সাহেব বাসায় বসে পেপার পড়ছিলেন। ইফতেখার সাহেবের অভ্যাসই হলো সময় পেলে পেপার পড়বেন। একবার পড়ে ফেলা পেপারও তিনি কয়েকবার করে পড়েন। স্ত্রীকে বাসায় ঢুকতে দেখেই ইফতেখার সাহেব পেপারটা ভাঁজ করে রাখতে রাখতে আহ্লাদী সুরে বললেন,- মাস্টারনি কোথায় গিয়েছিলে তুমি?- মাস্টার ঠিক করতে।- কার?- কার আবার তোমার ছেলেমেয়ের।- ইরুর জন্য হলে ঠিক হতো কিন্তু কলরবের জন্য আবার কিসের মাস্টার দরকার? এখন তো ছেলের জন্য বউ খোঁজা ফরজ।- তাই করতে গিয়েছিলাম বাবা।- ইরু তুইও না বেশি কথা বলিস যা বাবার জন্য চা করে নিয়ে আয়।- তাড়াতাড়ি ছেলেকে বিয়ে করাও তারপর পুত্রবধূকে দিয়ে নিজেদের ফরমায়েশ পূরণ করো। তোমাদের লজ্জা হওয়া উচিত পরের ঘরের আমানতকে দিয়ে এভাবে কাজ করাও।ইরিনের কথা শুনে তার বাবা মা দুজনই হেসে দিলো।ইরিন চা করতে চলে গেলেই ইফতেখার সাহেব বললেন,- ইরু তখন কি বললো?- আরে ওর কথায় কান দিও না তো পাগলি পুরাই।- একদম তোমার মতো হা্হাহাহা।..ইরিন ভাইয়ের রুমে বিছানায় বসে আছে আর কলরবের কান্ড দেখছে। কলরব একটার পর একটা কাপড় বের করছে তারপর আবার সেগুলো ছুঁড়ে ফেলছে।- কি হলো ভাইয়া একটাও কি পছন্দ হচ্ছে না?- উহু।- আজ কোন মুভির হিরো হতে যাচ্ছো?- আশিকি 2 এর রাহুল জেকার এর মতো হওয়ার চেষ্টা করছি। একদম ডিস্টার্ব করবি না।কলরব প্রায় আধা ঘণ্টা সময় নিয়ে আদিত্য কাপুর সাজলো তারপর ইরিনকে জিজ্ঞাসা করলো হলো নাকি?- হুম হয়েছে আসলেই আদিত্য আদিত্য একটা লুক আছে তোমার মাঝে। - আমার মনে হয় না আছে আসলে কথা হচ্ছে আমি একেক সময় একেক রকম থাকি। নিজস্ব কোনো ড্রেসআপ সেন্স নেই।- হতে পারে তারপরো তোমাকে কেনো যেন আদিত্য আদিত্য লাগে।- ধন্যবাদ বোনটু।- হেয়ার জ্যাল?- তা তো দিবোই।- আচ্ছা তুমি প্রতিদিন এতো সময় নিয়ে কাপড় চুজ করো কেনো? আবার আমাকে বলো আমি সাজতে সময় নেই।- জানি না তবে ছেলেবেলা থেকেই আমার অভ্যাস। তবে এটার পিছনে মায়ের হাত আছে। মা ছোটবেলা থেকেই আমাকে এভাবে গড়ে তুলেছে। - হুম তুমি তো মায়ের আদরের ছেলে।- আর তুই?- আমি তো বাবার ইরু আর ভাইয়ের আদরের বোন।- আচ্ছা পড়তে যাবি কখন থেকে?- আজ বিকেলেই যাব।- আমি আগেই জানতাম কুহু কখনো এখানে আসবে না।- তুমি কি ভাবির মনের কথা পড়তে জানো?- না তবে ওর চোখ দেখে একটুখানি বুঝি।- আচ্ছা ভাবির কোন জিনিসটা তোমার বেশি ভালো লাগে?কলরব হেসে ইরিনকে বললো,- সেটা কি তোর জানা খুব বেশি প্রয়োজন?- না ঠিক তা না তবে জানতে ইচ্ছে হলো আরকি।- ওর জোড়া ভ্রু গুলো আর একটা ব্যাপার আছে যেটা খুব ভালো লাগে। কুহু খুব হেল্পফুল। আসলে কুহুর এই ব্যাপারটাই আমাকে মুগ্ধ করেছে। আর ভ্রু তো সেদিন খেয়াল করলাম।- ওহ্।- আচ্ছা এতো সময় নিয়ে রেডি হলে কোথায় যাচ্ছো?- এক বন্ধু আসবে ঢাকা থেকে অনেক বছর পর দেখা। ওর সাথেই মিট করতে যাব।- ঠিক আছে সাবধানে যেও।..কুহু আর পিহু দুজন মিলে কূজনের আইডি ঘাটাঘাটি করছে। প্রোফাইল পিকের সাথে সাথে ক্যাপশনে দুই তিন লাইনের কথা লিখা। পিহু খুব বিরক্তি নিয়ে পড়ছে আর চোখ মুখ কুঁচকাচ্ছে।"আমার শূণ্য খাঁচা কু্ঁড়েঘরেতোমার সিংহাসনকবে তুমি আসবে বলোকরবে আরোহণ"পিহু লাইনগুলো পরার পরই কুহুকে উদ্দেশ্য করে বললো এই ছেলে দেখি তোর মতো পাগল ছাগল। ট্রেনে বসে বসে তোরা আসলে কি করেছিস বলতো। আমার তো মনে হয় এই অদ্ভুত বসে বসে কবিতা লিখেছে আর তুই আবৃতি করেছিস।" দুই পাগলের হইলো মেলা ট্রেনে এসেও তোরা যাস নে ও পাগলের দেশে।"হিহিহিহাহহাহাহিহিহাহুহুকুহু পিহুকে ধমকে বললো তুই চুপ করবি? দিন দিন পাগল হয়ে যাচ্ছিস তুই। এতো মেচিউরিটি ভালো না।- তোর মতো ভেবলি থাকবো নাকি?কুহু পিহুকে বালিশ দিয়ে মারতে শুরু করলো আর পিহুও করলো পাল্টা আক্রমণ। দুই বোন মারামারি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে বসে হাপাতে থাকলো তারপর কুহু বললো,- যাই বলিস ভালোই কবিতা লিখে।- আমি এর থেকে আরো ভালো লিখতে পারবো।- যে মেয়ে প্রতিভাবানকে প্রতিভবন পড়ে সে নাকি কবিতা লিখবে মরে যাই! মরে যাই!- তোর ঢং বন্ধ কর আপুণি।- মেচিউর গার্ল হিহি।- মেচিউরই তো।- আচ্ছা আচ্ছা তা তো স্বীকার করিই।চলবে...,#একটুখানি#Lamyea_Chowdhuryপর্ব:৮হালকা হেসে কুহু ইরিনকে বললো,- কেমন আছো?- ভালো।- আমি কিন্তু খুব কড়া।- কি যে বলেন না ভা.. না মানে আপনাকে দেখে ভাবাই যায় না আপনি যে স্ট্রিক্ট হতে পারেন।- পড়ছো তো পড়লেই বুঝবে। ইংরেজী পড়তে তোমার কেমন লাগে?- বিরক্ত লাগে।- আচ্ছা ঠিক হয়ে যাবে। আগে ইংরেজী কার কাছে পড়তে?- কোচিং ক্লাসে।- ওহ্ অন্য সাবজেক্ট গুলোর জন্যও কি আলাদা টিচার আছে?- না আপু।কুহু কিছুটা ভড়কে গেলো ইরিনের এমন জবাবে। ভাবতে লাগলো কলরব ইচ্ছে করে করেনি তো?তারপর ভাবতে ভাবতেই ইরিনকে জিজ্ঞাসা করলো,- সায়েন্স?- হুম।- তাহলে সায়েন্সের সাবজেক্ট গুলো যদি কোচিং করে কভার করতে পারো তাহলে সামান্য ইংরেজী পারো না?- না আসলে বাবা তো আছেই অঙ্ক দেখিয়ে দেয় আর আমার ভাইয়া তো আছেই ফিজিক্স কেমিস্ট্রি কোনো সমস্যা হয় না। ভাইয়ার মতো যদি আমি ব্রিলিয়ান্ট হতাম তাহলে কতো ভালো হতো।- তোমার রোল কতো?- 36 কিন্তু আমার ভাইয়া ছিল ফার্স্ট বয়। ভাইয়া তো চিটাগাং ভার্সিটিতে ফরেস্ট্রীতে পড়েছে আর সেখানেও ভাইয়া...- তুমি নিজে কোথায় পড়বে সেটা ভাবো।ইরিন কুহুর এমন কথায় চুপ হয়ে যায়।..ইরিনকে ছুটি দেয়ার পর কুহু যেয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। খুব লক্ষ্য করে সে নিজেকে দেখছে। পিহু ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে কুহুকে এভাবে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো,- মনে কি রং লেগেছে?- না তো।- তাহলে এভাবে আয়নায় কি দেখছিস?- কাকে আবার আমাকে?- তা তো বুঝলাম কিন্তু কেনো দেখছিস?- ভাবছি তেমন সুন্দর তো আমি নই তারপরো ঐ আজব কলরব এমন করছে কেনো?পিহু হাতে মোবাইল নিয়ে বসতে বসতে বললো,- ইরিনকে পাঠিয়েছে তাই বলছিস?- হুম।- তোকে কলরব পছন্দ করে তাই হয়তো।- এটাই তো ভাবছি কেনো পছন্দ করে? আসলে আমার মনে হয় ফাতরামি করছে আমার সাথে।- আমার কেনো যেন তা মনে হয় না।কুহু পিহুর পাশে বসতে বসতে বললো,- কেনো তোর এমন মনে হয় না?- আচ্ছা তুই ইদানিং সবসময় কলরবকে নিয়ে ভাবিস কেনো? - সে এমননসব কাজ করে যে ভাবনায় পড়ে যাই।- সামলে থাকিস কোনদিন না আবার প্রেমে পড়ে যাস।- বাজে কথা রাখ তো। আমি ভাবছি কলরবের চোখে কি তোকে লাগে না?কুহুর কথা শোনে পিহু বিরক্তিভাব নিয়ে কুহুর দিকে তাকিয়ে বললো,- তোর মাথাটা পুরাই গেছে। আরো পর বেশি বেশি কবিতা হেনতেন তারপর আরো উল্টা পাল্টা কথা বলবি।- না আসলেই ভাবছি তোকে তো সে চিনে নাহয় ইরিন তোকে চিনতো না।- তো??- তাহলে কলরব তোর পিছনে ঘুরে না কেনো?- আমি একটা বাচ্চা মেয়ে আপুণি।- কলেজে পড়িস বাচ্চা কীভাবে? আর তুই তো যা ঝাক্কাস তোকে দেখে মাঝে মাঝে আমি নিজেই হা হয়ে থাকি বিশেষভাবে যখন কাঁদিস তখন। - আর কিছু বাকি আছে বলার?- হুম আছে তো। শোন তুই এক কাজ করবি এই শুক্রবারে ছাদে যেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদবি।- তুই দয়া করে যা মাথায় একটু ঠান্ডা পানি ঢেলে আয় নয়তো এমন পাগলের প্রলাপ পারতে থাকবি আর আমার কাছে ডান্ডা খাবি।- আরে আগে সবটা শোন। তুই যখন কাঁদিস তখন তোর বড় বড় টানা টানা চোখগুলো লাল টকটকে হয়ে যায় তখন তোকে যে কি লাগে না বলে বোঝানো যাবে না। আর তোর থুতনীতে যে ছোট একটা তিল আছে উফ্ সেই। তুই পুরাই হলুদ পরী।- ইশ্ এগুলো যদি জাস্টিন বিবার বলতো!- উফ্ জাস্টু জাস্টু পরে করিস তো এখন তোকে একটা কাজ দিব করে দিবি।- কি কাজ আর কেনোই বা করবো?- কাজটা হলো ছাদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একদিন কাঁদবি আর কয়েকদিন আমার সাথে ছাদে যাবি। কোনো কোনোদিন একাও যাবি।- নেভার!- পুরস্কারটা শোন।- কি?- তোকে নিয়ে যেয়ে নাগরদোলা চড়াবো সাথে আমিও চড়বো।- পারবো না।- পুরো পনেরো দিন নিয়ে যাব তোকে রাজি?- তুই আবার বলতে পারবি না যে পিহু তুই একাই উঠ আমি উঠবো না।- বলবো না।- নাগরদোলায় উঠে আঙ্কেল প্লিজ আমি নেমে যাব, পিহু থামাতে বল এধরনের কথা বলা যাবে না।- ঠিক আছে।- কিন্তু কথা হচ্ছে কাঁদবো কীভাবে? আই মিন কারণ ছাড়া কাঁদা যায়?- আমি আছি না কাঁদতে তোমাকে হবেই সুন্দরী।- আমি এতো সেন্টিমেন্টাল না।- আমি জানি কোথায় আঘাত করতে হবে।পিহু বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে বললো,- ঠিক আছে দেখা যাবে কেমন কাঁদাতে পারিস।পিহু কথাটা বলেই রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো।কুহু গা এলিয়ে দিয়ে যেই না চোখ বন্ধ করতে যাবে তখনই পিহু এসে ডেকে বললো,- আপুণি।- হুম কিছু বলবি?- তুইও কিন্তু কম যাস না। তোর মাঝে মিষ্টি মিষ্টি একটা ভাব আছে। ভ্রু গুলোও অসম্ভব সুন্দর। আর একটা জিনিস আছে যেটা হলো তোর চুল খুবই সিল্কি তবে এটা তো আর কেউ দেখে না হিজাব তো থাকেই তোর।- হুম আমার এই সিল্কি চুলগুলো আবার বর দেখবে মন ভরে তাই কাউকে দেখাই না। আচ্ছা এক মিনিট এতো পাম্পিং কেনো?- হঠাৎ মনে হলো তাই বললাম আরকি।- শোন ট্রেনের চাকায় পাম্প দিয়ে যেমন কোনো কাজ হয় না তেমনি এক্ষেত্রেও কিছুই হবে না।- না তুই আমার এতোগুলো সুনাম করলি একটু ভদ্রতা আছে না?কুহু পিহুর কথা শুনে হাসতে হাসতে বললো,- পিহু তুই খুব চালাক।- আজকাল তোর মতো ভ্যাবলি হলে হয় না।- যা ভাগ।- যাচ্ছি তো বাবা।..কলরব বাসায় ফিরতেই ইরিন বললো,- ভাইয়া ভাবি অনেক কড়া।কলরব হেসে বললো,- আমি ফ্রেশ হয়ে আইসক্রিম খেতে খেতে তোর সাথে কথা বলবো।- কোথায় আইসক্রিম?- ফ্রিজে রেখেছি পাঁচ মিনিট লাগবে আমার।- ঠিক আছে ভাইয়া। আচ্ছা তোমার হাতে কিসের কার্ড?- বিয়ের কার্ড।- কার বিয়ে?- যে বন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম ওর বিয়ে।কলরবের মা রান্নাঘর থেকে কলরবকে জিজ্ঞাসা করলো,- কোন বন্ধুর?- রঞ্জুর বিয়ে মা।..............বেশ কিছুদিন ধরে হাসানাদ সাহেবের শরীর ভালো যাচ্ছিলো না কিন্তু আজ এমন কিছু হয়ে যাবে তা হাসানাদ সাহেব ভাবতে পারেনি। এখন তিনি বসে আছেন অচেনা অজানা একটা বাসায়। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে কিন্তু তারপরো গরম লাগছে। হাসানাদ সাহেব ব্লেজারটা খুলে টাই ঢিল করে সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছেন। এসি না থাকায় কষ্ট হচ্ছে খুব। হাসানাদ সাহেব প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করে ফোন দিলেন কূজনকে। রিং হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই কূজন ফোন রিসিভ করলো।- হ্যালো বাবা!- কূজন কোথায় তুমি?- আমি ক্যাম্পাসে। তোমার কথা শুনে কেমন যেন মনে হচ্ছে। তুমি ঠিক আছো তো?- সকালে ব্যবসার কাজে কুমিল্লার বাইরে এসেছিলাম। ফিরার পথে গাড়ি নষ্ট হয়ে গিয়েছে তাই ড্রাইভারকে পাঠিয়েচ্ছিলাম মেকানিকের কাছে।গাড়িতে একা বসে থাকতে ভালো লাগছিলো না তাই একটু বের হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎ দেখি আশেপাশের সব আওয়াজ ধীরে ধীরে কমে আসছে, মাথা ভনভন করতে থাকে। ভেবেছিলাম ঠান্ডা জাতীয় কিছু একটুখানি খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। সামনে এগিয়ে একটা বেকারি থেকে পেপসি কিনে ফিরে আসার সময় হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যাই।- এখন তুমি কোথায় বাবা?- একটা মেয়ের বাসায়। বেকারিতে যখন পেপসি কিনছিলাম একটা মেয়ে তার পার্স হারিয়ে ফেলেছিলো। আইসক্রিম বক্স হাতে নিয়ে ফেলেছিলো কিন্তু টাকা দিতে যেয়ে দেখে পার্স নেই তখন আমি বেশ জোর করেই টাকাটা দিয়ে দিয়েছিলাম। আমি এখন তার বাসায় আছি।- বাবা আমি এখনই আসছি জাস্ট লুকেশন বলো।- আহা আমি এখন ফেণী আছি তোমার কষ্ট করে আসা লাগবে না। এখন আমি ঠিক আছি গাড়িও ঠিক করা হয়েছে।- না বাবা আমি আসছি আর শুনো মাকে বলার দরকার নেই।- পাগল নাকি যে বলতে যাব? আর শুনো বাবা এখন ঠিক আছি। সামনে তোমার ফাইনাল পরীক্ষা মন দিয়ে পড়াশুনা করো।- বাবা প্লিজ।- না এখন আসা লাগবে না।- ওকে বাবা খেয়াল রেখো নিজের আর বাসায় পৌঁছে আমাকে জানিয়ো। ও হ্যা রওনা হয়েও আমাকে ইনফর্ম করো কিন্তু।- আচ্ছা।হাসানাদ সাহেব ফোন রাখতেই তাকিয়ে দেখে মেয়েটা হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।- মা তোমাকে কষ্ট দিলাম।- না আঙ্কেল একদমই কষ্ট হচ্ছে না। এখন নিন একটুখানি আইসক্রিম খেয়ে নিন।- না মা থেঙ্ক ইউ।- আরে আঙ্কেল আপনি নিজেই তো কিনে দিয়েছেন।- তোমাকে কিনে দিয়েছি তুমি খেয়ো।- আরে আমি কি পুরো বক্স খেয়ে ফেলবো?- না মা এখন খেতে ইচ্ছে করছে না।- তাহলে পায়েশ এনে দিচ্ছি খেতেই হবে, একদম না শুনবো না।- আচ্ছা নিয়ে এসো।হাসানাদ সাহেব মুগ্ধ দৃষ্টিতে মেয়েটার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটার মাঝে একটা চটপটে ভাব আছে, সাথে আছে খুব তাড়াতাড়ি মানুষকে আপন করে নেওয়ার গুণ।পায়েশ খেতে খেতে হাসানাদ সাহেব বললো,- তুমি রেঁধেছো?- জ্বি আঙ্কেল। কেমন হয়েছে বললেন না যে?হাসানাদ সাহেব হাসতে হাসতে বললো,- খুব ভালো।- থেঙ্ক ইউ সো মাচ আঙ্কেল।- আচ্ছা তোমার বাবা মাকে দেখছিনা যে?- বাসায় নেই এখন। - ওহ্।- আঙ্কেল একটা ব্যাপার জানেন?- কি?- আপনার হাসিটা বেশ সুন্দর, আর হাসি ছাড়া একটাও কথা বলতে পারেন না আপনি, সব কথাই হেসে হেসে বলেন। খুব ভালো লাগে দেখতে।হাসানাদ সাহেব হুহু করে হেসে দিলেন। তারপর বললেন,- আমাকে দেখেই তোমার এই অবস্হা তাহলে আমার স্ত্রী আর ছেলেকে দেখলে তোমার যে কি হবে। ইনফেক্ট ওদের মা ছেলের সাথে থাকতে থাকতেই আমি এমন হয়ে গিয়েছি।- তাহলে তো ওদের সাথে একবার দেখা করতে হয়।- হুম অবশ্যই করাবো আর তোমার কণ্ঠটাও ভারি মিষ্টি।- আঙ্কেল গান শুনবেন?- শুনাও দেখি কেমন পারো।" ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনেরো মন্দিরেআমারো পরাণে যে গান বাজিছে তাহার তালটি শেখোতোমার চরণো মঞ্জীরে.."- বাহ্ বেশ সুন্দর গান গাইতে জানো তুমি।- সবাই তাই বলে।- জানো আমি গান খুব পছন্দ করি। আমার ছেলেও গান গায়, খুব সুন্দর করে গাইতে জানে সে।- তাই?- হুম। আচ্ছা তুমি কার কাছে গান শিখেছো?- আমার মায়ের কাছে।- তোমার মা বাবা কারো সাথেই তো দেখা করা হলো না। আরেকদিন এসে দেখা করে যাব আজ উঠতে হবে।- আঙ্কেল না খেয়ে তো চলে যেতে দিব না।- আরেকদিন খাবো মা প্রমিজ।- ঠিক আছে প্রমিজ যেহেতু করেছেন তাই ছেড়ে দিচ্ছি।হাসানাদ সাহেব গাড়িতে উঠে বসে ড্রাইভারকে বললেন গাড়ি স্টার্ট দিতে। পরক্ষণেই মনে পড়লো মেয়েটার নাম জিজ্ঞাসা করা হয়নি তাই তিনি গাড়ি থেকে নামলেন। মেয়েটা এতক্ষণে বাসার গেটে ঢুকে গিয়েছে তাই তিনি মেয়েটার পিছন পিছন যেয়ে মেয়েটাকে ডেকে বললেন,- মা তোমার নামটা তো জানা হলো না।মেয়েটা হেসে জবাব দিলো,- ইরিন।হাসানাদ সাহেব হেসে বললো,- হরিণ! তোমাকে হরিণ বলে ডাকবো। আপত্তি নেই তো তোমার?- যদি আরেকদিন এসে বাসায় খেয়ে যান তাহলে অনুমতি দিব।- বেঁচে থাকো মা।..কুহু বেশ বিরক্ত ইরিনের উপর। মেয়েটা খুবই ফাঁকি দেয় পড়ায়। তার উপর আবার এখন পা ভেঙ্গে বসে আছে বাসায়,সামনে পরীক্ষা। কুহু ইরিনের রেজাল্ট নিয়ে টেনশন করছে। বাকিগুলোতে ডাব্বা মারলেও কুহুর কিছু আসে যায় না কিন্তু ইংরেজীতে অবশ্যই ইরিনকে ভালো করতে হবে। কুহু বেশ বকাঝকা করে ইরিনকে তারপরো মেয়েটা রাগ করে না বরং দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে কুহুকে এটা ওটা জিজ্ঞাসা করে। কুহুরও সত্যি বলতে ইরিনকে খুব পছন্দ কিন্তু ইরিনকে সে বুঝতে দেয় না দুই কারণে। এক তখন কুহুকে ইরিন আর ভয় পাবে না আর আরেকটা হচ্ছে কলরবের ব্যাপারটা। কুহু এখন বেশ সাহস করেই ইরিনদের বাসার কলিংবেল চেপে দাঁড়িয়ে আছে। পিহুটাও নেই কলেজে গিয়েছে নয়তো পিহুকে নিয়ে আসতে পারতো। কুহু আরেকবার বেল চাপতেই দরজা খুলে যায়।কলরব কুহুকে দেখে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে।কুহু ঢোক গিলে বললো,- ইরিনকে দেখতে এসেছিলাম।কলরবের তখনও অবাক হওয়ার পালা শেষ হয়নি। কলরবকে চুপ থাকতে দেখে কুহু বললো,- ইরিন কি বাসায় আছে?চলবে...পর্ব:১০কলরব দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে কুহুকে বললো,- ইরিন ভিতরেই আছে।কুহুকে তখনও বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কলরব আবারো বললো,- ভিতরে এসো বাবা বাসায় আছেন।- ইরিন কোন রুমে আছে?- এসো দেখিয়ে দিচ্ছি।কুহু কলরবের পিছন পিছন হেঁটে যেতেই দেখলো ক্রিম কালার পাঞ্জাবী পড়া একজন ভদ্রলোক পেপার পড়ছেন। তিনি পেপার থেকে চোখ না সরিয়েই বললেন,- কলরব কে এসেছে?- বাবা ইরিনের টিচার এসেছেন ওকে দেখতে।ইফতেখার সাহেব পেপার থেকে মুখ তুলে কুহুকে বললেন,- তুমি ইরুর টিচার?- জ্বি আঙ্কেল। ভালো আছেন আঙ্কেল?- আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো। কলরব ওকে ইরিনের রুমে নিয়ে যা তো।- হ্যা বাবা সেখানেই নিচ্ছি।কুহু ইরিনের রুমে যেয়ে অবাক হয়ে কতক্ষণ চেয়ে রইলো তারপর ইরিনকে উদ্দেশ্য করে বললো,- তুমি তো বেশ ভালো আর্ট করো।- থেঙ্ক ইউ আপু।- এখন কেমন আছো?- ভালোই মুটামুটি।- কীভাবে পা ভাঙলে?- স্কুলের সিঁড়ি থেকে পড়ে।- এতো ছটফট করলে তো এমন হবেই। আন্টি কোথায় দেখছি না যে?- মা তো স্কুলে।- ওহ্।কুহু আর ইরিনের কথার মাঝেই কলরব ঢুকলো নাস্তার ট্রে হাতে। - মা বাসায় নেই তো তাই বেশি কিছু দিতে পারিনি।- না সমস্যা নেই।কলরব চলে যাওয়ার পর ইরিন কুহুর হাতে চায়ের কাপ তুলে দিয়ে বললো,- আপু এমন সময়ে এলেন যে মাও নেই আর আমি ভালো থাকলে আপনাকে পায়েশ রেঁধে খাওয়াতাম।কুহু হেসে বললো,- আপু তুমি পায়েশ রান্না করতে জানো?- আপনি আমার টিচার না হয়ে অন্য কিছু হলে ভালো হতো।ইরিনের কথা শুনে কুহু গম্ভীর হয়ে গেল।ইরিন বললো,- বললাম কারণ যখন আপনি টিচার থাকেন তখন একটুও হাসেন না, এতো সুন্দর করে আপুও বলেন না। কিন্তু আজ কি সুন্দর করে মিষ্টি করে কথা বললেন।কুহু ইরিনের কথা শুনে এবার জোরে হেসে ফেললো।- আচ্ছা এখন থেকে আপু বলে ডাকবো।- আল্লাহ আপনি এতো মিষ্টি করে হাসতে পারেন!- মিষ্টি করে কোথায় হাসলাম? এটাকে তো রাক্ষসী হাসি বলে।- হাহ্হাহহাা না আপনার হাসির আওয়াজটা কেমন যেন অনেক মধুর। আপু আপনি কি গান গাইতে জানেন?- নাহ্ তবে শুনতে ভালোবাসি।- একদম ভাইয়ার মতন।কুহু আবারো কিছুটা গম্ভীর হয়ে গেল তারপর বললো,- এখন আমি আসি, আরেকদিন দেখে যাব এসে।- আচ্ছা থেঙ্ক ইউ।কুহু উঠতে উঠতেই তার ব্যাগের চেইন খুলে সেখান থেকে একটা ডেইরি মিল্ক সিল্ক খুলে ইরিনকে দিয়ে বললো,- এটা তোমার জন্য।- না না লাগবে না।- আহা মিষ্টি আপুর হাত থেকে চকলেট নিতে কেউ কি আবার না করে নাকি?ইরিন ঠোঁটে হাসিয়ে ফুটিয় চকলেট নিয়ে বললো,- থেঙ্ক ইউ মিষ্টি ভা.. মানে আপনি অনেক ভালো আরকি মিষ্টি আপু।কুহু সবসময় একটা ব্যাপার খেয়াল করে সেটা হলো ইরিন প্রায় কথায় কথায় ভা... বলেই থেমে যায়। কুহু বুঝতে পেরেও না বুঝার ভাণ ধরে থাকে।কুহু চলে যেতেই ইরিন কলরবকে ডাকলো।- কি হলো ডাকছিস যে?- তোমাকে একটা জিনিস দেওয়ার ছিল।- কি?কলরব ইরিনের হাত থেকে চকলেট নিতে নিতে বললো,- কি করবো খুলে দিবো? পা ভাঙলে বুঝি চকলেট খুলে খাওয়া যায় না?- ইশ্ আমি এতো আহ্লাদী কবে হলাম?- তুই তো মায়ের মতোই আহ্লাদী।- ভাইয়া আমি তো তোমাকে খেতে দিলাম।- আমাকে?- হুম।- আমাকে কেনো?- এটা ভাবি এনেছে তাই।- মানে?- কুহু আপু আমাকে দিয়েছিলো আমি ভাবলাম তুমি এই চকলেটটা পেলে খুশি হবে।কলরব তার গগনবিহারী হাসি দিয়ে উঠে বললো,- থেঙ্ক ইউ ইরিন সোনা।- ভাইয়া তুমি কি একটা ব্যাপার জানো?- কি?- ভাবিও তোমার মতোই জোরে শব্দ করে হাসে।- তাই?- হুম একটু আগে শুনলে না?- না আমি তো তখন বাইরে গিয়েছিলাম।- বাইরে কেনো?- আমার মনে হচ্ছিলো আমি বাসায় থাকায় কুহু খুবই আনকমফরটেবল ফিল করছিলো।- ইশ্ তুমি একটুখানি বেশিই ভালো।- তোর ভাই যে তাই বোধহয়..কুহু অপেক্ষা করছে পিহু কখন প্রাইভেট থেকে বাসায় ফিরবে। পিহু বাসায় আসতেই কুহু বললো,- বোন তোর সাথে কথা আছেরে।- বলতে না করেছে কে?- আমার পাশে বস বলছি।- দ্বারা একটু ঠান্ডা পানি খেয়ে আসি।- খেয়ে আসি না পান করে আসি।- তোর চাইনিজ ভাষা তুই নিজের কাছেই রাখ।- আচ্ছা তাড়াতাড়ি আয়।- বল কি বলবি।- ইরিনকে দেখতে গিয়েছিলাম ওদের বাসায়। তখন ওর বাবা বললো ও তো অসুস্হ তাই যেন একটু কষ্ট করে হলেও ওদের বাসায় যেয়ে ওকে পড়িয়ে আসি। এখন কি করবো বল তো?পিহু বেশ বিরক্তির সাথে কুহুর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর বললো,- ইরিন কি সত্যি সত্যি তোর ননদ নাকি যে সে অসুস্হ হওয়ায় ওকে দেখতে যেতে হবে?- কি বলিস মেয়েটা পা ভে...- তোর এসব দরদী কর্মকান্ডেই তুই ফেঁসে যাস।- একটা ভদ্রতা আছে না?- ওদের কাছে তুই ভদ্র হলেই কি আর না হলেই কি? তোর শ্বশুড়বাড়ির মানুষ তো আর না।- এই উল্টাপাল্টা কথা বলবি না তো। আমি কি তোর মতো পাথর নাকি যে একটা মেয়ে অসুস্হ তাকে দেখতেও যাব না?- আরো বেশি করে যাও দেখলেই তো এখন কি হলো।- কি করবো পিহু?- তুই ইরিনের বাবাকে কি বলেছিস?- বলেছি আব্বু বললে পড়াব।- ভালো করেছিস আর এখন আব্বুকে না করে দিবি যেন ওরা বললে নিষেধ করে দেয়।- ঠিক আছে।- ফোন করে খবর নিলেই পারতিস শুধু শুধু ভেজালে পড়লি।কুহু কিছু একটা বলতে যেয়েও আর বললো না।..কুহুর রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে। সে ইরিনকে দুই দিন ধরে বলে এসেছে এমফেটিক স্টেটমেন্টের উপর পরীক্ষা নিবে। কিন্তু এখন এই মেয়ের খাতা দেখে কুহুর মেজাজ পুরোই গরম হয়ে উঠেছে। রাগে গজগজ করতে করতে কুহু খাতা থেকে চোখ সরিয়ে সামনে বসে থাকা ইরিনের দিকে চাইলো তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,- আমি যে পরীক্ষা নিব তোমাকে কয়দিন আগে বলেছি?ইরিন ভয়ে ভয়ে বললো,- দুই দিন।- তুমি কি পড়েছো নাকি না পড়েই পরীক্ষা দিয়েছো?- পড়েই দিয়েছি।- তাহলে এটা কি লিখেছো এখানে? মিথ্যে বলা হচ্ছে আমার সাথে?- কি লিখেছি?- ''গতকালও আমি সেখানে গিয়েছিলাম''বাক্যটার ট্রান্সলেট করে কি লিখেছো তুমি?- আই ওয়েন্ট দেয়ার ইয়েসটার্ডে।- একটা চড় দিব মেয়ে।তোমাকে আমি পড়াইনি?কুহু কথা বলতে বলতে স্কেলটা হাতে নিয়ে টেবিলে বেশ জোরেই একটা বারি দিয়ে বললো,- কয়েকদিন ধরে তোমাকে কিছু বলছি না দেখে পড়াশুনা একেবারে বাদই দিয়ে দিয়েছো নাকি?তোমাকে আমি শিখাইনি ইনভার্শন বা এমফেটিক স্টেটমেন্ট?ইরিন কাচুমুচু হয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে বললো,- শিখিয়েছেন আপু।- তাহলে বলো গতকালও আমি সেখানে গিয়েছিলাম ইংরেজী কি?- আই ওয়েন্ট দেয়া...- চুপ করো মেয়ে। আমি তোমার খাতায় লিখে দেইনি? এটা হবে, ইয়েসটার্ডে আই ওয়েন্ট দেয়ার। বলো লিখে দেইনি?কুহু কথা বলতে বলতে আবার স্কেলটা দিয়ে টেবিলে বারি দিলো।কলরব মাত্র অফিস থেকে এসেছে। বৃহস্পতিবার হওয়ায় হাফ টাইম তাই বিকেলেই এসে পড়েছে। টাইটা ঢিল করতে করতে সে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছিলো। ইরিনের রুম ক্রস করেই তার রুমে যেতে হয় তাই যাওয়ার সময় সে কুহুর সবটা কান্ড দেখলো। তারপর এগিয়ে এসে কুহুর হাত থেকে স্কেলটা এক ঝটকায় নিয়ে নিল।কুহু অবাক হয়ে তাকাতেই দেখে কলরব দাঁড়িয়ে।কলরব বললো,- এভাবে কেউ পড়ায়? পড়াতে হলে অনেক ধৈর্য্য প্রয়োজন। তুমি কখনোই একজন ভালো শিক্ষক হতে পারবে না। একজন ভালো শিক্ষক স্টুডেন্টের সাথে নমনীয় ভাবে কথা বলে তার কাছ থেকে বুঝিয়ে পড়া আদায় করে নেয় এভাবে ধমকিয়ে নয়। এভাবে ধমকালে সবাই তোমার ইনভার্শন ভুলে যাবে। কলরব খুব ঠান্ডা স্বরে কথাগুলো বলেই স্টাডি টেবিলে স্কেলটা কুহুর চেয়েও জোরে বারি দিয়ে বললো,- "হে আমি গিয়েছিলাম " ট্রান্সলেট করো।কুহুর মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না, সে কোনোভাবেই গলা দিয়ে কথা বের করতে পারছে না।কলরব আবারো স্কেল টেবিলে মেরে বললো,- কি হলো ভুলে গেছো?কুহু কোনোরকম নিজের গলার সাথে পনেরোশো ছাপান্ন সালের পানি পথের যুদ্ধের চেয়েও বড় যুদ্ধ করে আস্তে করে বললো,- ইয়েসটার্ডে ডিড আই গোউ দেয়ার।- এবার বলো, ''যদি আমার ছেলে ডাক্তার হতো''- ইফ মাই সান বি অ্যা ডক্টর।- আমি তোমাকেই ভালোবাসি।- আই ডু লাভ ইউ।চলবে...পর্ব :১১কলরব হাসি চেপে রাখতে পারছে না কিন্তু হাসতেও পারছে না। কারণ কলরব মুচকি হেসে চলে যেতে পারবে না। তার হাসি বেশ জোরেশোরেই। স্কেলটা হাতে নিয়েই কলরব কোনোরকমে নিজের রুমে ফিরে এলো।দরজাটা দিয়েই হাসা শুরু করে দিলো। হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা হয়ে যাচ্ছে বেচারার।ইরিন আকস্মিকতায় চোখ বড় করে হা হয়ে কুহুর দিকে তাকিয়ে আছে। ইরিন আজ যেই ইনভার্শন শিখলো জীবনেও ভুলবে না, নিজের নাম ভুলে গেলেও ভুলবে না। গতকাল আর গতকালও এবং তোমাকেই আর তোমাকেতে যে পার্থক্য আছে তা খুব ভালো করেই বুঝে গেছে সে। কলরবের বেডরুম আর ইরিনের বেডরুম পাশাপাশি। কলরবের হাসির আওয়াজ কুহু আর ইরিনও শুনতে পাচ্ছে। কুহু এতোক্ষণ হাসির আওয়াজ শুনতে পেলেও ধীরে ধীরে কুহুর মনে হচ্ছে হাসির শব্দটা কমে আসছে। কুহু তরতর করে ঘেমে যাচ্ছে, হাত পাও ঠান্ডা হয়ে আসছে। কুহু আস্তে করে ইরিনকে বললো,- একটু পানি দাও তো।ইরিন ধীরে ধীরে অসুস্হ পা নিয়েই ডাইনিংরুম থেকে এক গ্লাস পানি এনে দিতেই কুহু একটানে সবটা পানি শেষ করে ভেনিটি ব্যাগ নিয়েই বের হয়ে যায়। কুহু চলে যেতেই ইরিন গেলো কলরবের ঘরে। দরজায় টোকা দিতেই কলরব দরজা খুলে ইরিনকে জড়িয়ে ধরে আবার হাসতে লাগলো। এবার ইরিনও ভাইয়ের সাথে যোগ দিল। হাসতে হাসতে বললো,- ভাইয়া আমি আগে ভাবতাম তুমি পৃথিবীর বেস্ট ভাই কিন্তু আজ থেকে তুমি আমার কাছে পৃথিবীর বেস্ট টিচার।- টিচার নারে চিটার।কলরব আবারো হাসতে লাগলো। - আচ্ছা ভাবি যেভাবে চলে গেল আসবে তো?- অবশ্যই আসবে।- উহু আমার তা মনে হয় না।- দেখিস আসবে।- আসলেই ভালো।- এই তুই হেঁটে এলি যে?- লাফিয়ে লাফিয়ে এসেছি। হাঁটতে কোথায় দেখছো?- আহারে আমার বোনটা।- আরে একদম ঠিক আছি।..কুহু বাসায় যেয়েই দরজা বন্ধ করে আলো নিভিয়ে বসে রইলো। নিজের গালে কষে কয়েকটা থাপ্পর মারতে ইচ্ছে হচ্ছে কুহুর। পিহু যে বলে সে বোকা একদম ঠিক বলে, মাও কুহুকে নিয়ে শুধু শুধুই এতো চিন্তা করে না, বুঝেসুঝেই করে। কুহু এত হাবলি কেনো? সে কিভাবে ঐ আজব প্রাণীটাকে আই ডু লাভ ইউ বলতে পারলো? লাভ ইউ ও না একেবারে আই ডু লাভ ইউ। পিহু এসে দরজা ধাক্কাচ্ছে।- এই কিরে ঘুমিয়ে গেলি নাকি?- না আসছি।দরজা খুলতেই পিহু শরবত খেতে খেতে রুমে ঢুকলো। পিহু রুমে ঢুকার সাথে সাথেই কুহু আবার দরজা আটকে দিলো। তারপর বললো,- পিহু সর্বনাশ হয়েছে?- কে তোর সর্বনাশ করলো?- কলরব।কুহুর কথা শুনেই পিহুর মুখ থেকে শরবত বেরিয়ে এলো তাও আবার কুহুর উপরেই পড়লো। পিহু এখন নিজেই ভয়ে শেষ। পিহু জানে এখনই কুহুর হাতে দুই গালে দুইটা কষে থাপ্পর খাবে। পিহু ঢোক গিলে বললো,- আপুণি সরি।- আরে রাখ তোর সরি। জানিস আমি কি করেছি?- কি কি করেছিস?- কলরবকে আই লাভ ইউ বলেছি না আই ডু লাভ ইউ বলেছি।পিহু এবার হাতে থাকা গ্লাসটা ছেড়ে দিল।- আপুণি আয় বস।- পিহু কেনো গেলাম ঐ বাসায়? আসলেই ইরিনের জন্য কেনো এতো দরদ দেখাতে গেলাম?- কিছুই বুঝতে পারছি না একটু খুলে বল।পিহু কুহুর কাছে সবটা শুনে থ হয়ে রইলো। তারপর হঠাৎ হাসতে শুরু করলো। পিহু সাধারণত খুব বেশি মজা না পেলে এতো হাসে না। বালিশ মুখে চেপে তারপর হাসছে পিহু। কুহুর যে প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হচ্ছে তা বুঝে পিহু হাসি থামিয়ে বোনের উদ্দেশ্যে বললো,- আরে এতো টেনশন নিস না। তুই তো ট্রান্সলেট করেছিস আর কিছু তো না।- কিন্তু পিহু ঐ কলরব যেভাবে হাসছিলো না..- আরে বাদ দে তো।- সত্যি বলছিস সিরিয়াস কিছু হয়ে যাবে না তো?- আরে বাবা এইটুকুতে আর কি হয়?- আচ্ছা তুই যেহেতু বলেছিস বুঝেই বলেছিস।- আচ্ছা এখন পড়তে বসবো আর কোনো কথা না।- হ্যা বস আমারো অ্যাসাইনমেন্ট কমপ্লিট করতে হবে।কুহু আর পিহু দুইজনই নিজেদের পড়ায় লেগে গেল।পিহু পড়তে যেয়ে বায়োলজির এক টপিকে আটকে যাওয়ায় কুহুর টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে বললো,- আপুণি সালোকসংশ্লেষণের আলোক পর্যায় আমার কাছে ক্লিয়ার না। একটু বুঝিয়ে দে তো।কুহু বেশ বিরক্ত হয়ে জবাব দিল,- দেখছিস না কাজ করছি?- একটু বুঝিয়ে দে তারপর আবার করিস।- ভাগ এখান থেকে।- এতো ভাব মারিস কেনো সবসময়? স্টুডেন্টদের জন্য তো কতো দরদ আর নিজের বোনের জন্য..- বায়োলজি কাওকে আবার বুঝিয়ে দিতে হয় নাকি?- তুই বায়োলজিতে ভালো ছিলি তাই তুই নিজে নিজে পড়েই পেরেছিস। - এখন যা বলছি মন মেজাজ একদম ভালো না।- তোর এই এক সমস্যা রেগে যাস। - আমার ডিস্টার্ব হচ্ছে পিহু।- কলরব ঠিকই বলেছে তুই জীবনেও ভালো টিচার হতে পারবি না।পিহু কথাটা বলেই নিজের স্টাডি টেবিলে যেয়ে অন্য সাবজেক্টে মন দিল।কুহু নিজের টেবিল থেকে উঠে যেয়ে পিহুর বায়োলজি বইটা নিয়ে বেডে বসতে বসতে বললো,- আয় বুঝিয়ে দিচ্ছি।- হুম ধমক খাওয়ার জন্য রেডি হয়েই আসছি।কুহু মন খারাপ করে বললো,- আমি কি আসলেই বেশি বকা দেই পড়ানোর সময়?- হুম।আজ কুহু পিহুকে পড়া বোঝানের সময় একটাবারে ধমক দেয়নি বরং নরম সুরে এক পড়া দুইবার করে বুঝিয়ে দিয়েছে। পিহু মনে মনে কলরবের উপর বেশ খুশিই হলো। কুহু আর পিহু রাতের খাবার খাওয়া শেষে শুয়ে পড়লো। কুহুর কিছুতে ঘুম আসছে না। চোখ বন্ধ করলেই শুধু কলরবের হাসির আওয়াজ কানে বাজে। কুহু পিহুর দিকে ফিরে পিহুকে জড়িয়ে ধরতেই পিহু উফ্ফো আপুণি সরতো বলে কুহুকে ধমকে উঠলো।- এই শুন না আমার না ঘুম আসছে না।- কেনো কি হয়েছে?- চোখ বন্ধ করলেই শুধু কলরবের হাসির আওয়াজ শুনতে পাই। - আহা শোন শশী কাপুরের কথা মনে কর দেখবি তোর ঘুম চলে আসবে আর স্বপ্নে শশী কাপুরও চলে আসবে।- ঐ মোবাইলটা দে তো।- হাত বাড়িয়ে নিজে নিয়ে নে।- তোর পাশেই তো দে না।- পারবো না।কুহু আর কথা না বাড়িয়ে শুয়া থেকে উঠে হাত বাড়িয়ে মোবাইল আর হেডফোন নিল। তারপর কুহুর পছন্দের নায়ক শশী কাপুরের গান শুনতে লাগলো।" নেনোমে নিন্দিয়ানিন্দিয়া মে সাপনেসাপনো মে সাজানজাপসে বাসাবাহারে আয়ী জীবানমেনেয়ি হালচাল হে তান মানমেএক নেয়ি রূপ বাসা হে আখিয়ুমে.."গানটা শুনতে শুনতে কুহুর মন ভালো হয়ে গেল। গানটা শেষ হতেই কুহু মোবাইল অফ করে চোখ বন্ধ করলো।চোখ বন্ধ করার সাথে সাথে এবার কলরবের চেহারাটা ভেসে উঠলো সাথে কলরবের বলা আমি তোমাকেই ভালোবাসি কথাটা বারবার কানে বাজতে লাগলো। কুহু আবার পিহুকে জড়িয়ে ধরে একথা টা বললো।পিহু কিছুটা বিরক্তির সুরে বললো,- তোর না কালকে বান্ধবীদের সাথে শালবন বিহার ঘুরতে যাওয়ার কথাএখন ঘুমিয়ে পর নয়তো যেতে পারবি না।- হ্যা ঠিকই তো।কুহু বহু কষ্টে দুচোখের পাতা এক করলো।সকালে উঠেই মাকে বলে বান্ধবীদের সাথে কোটবাড়ির উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিল কুহু।কোটবাড়ির শালবন বিহার দেখা শেষ হতেই জাদুঘরে যাওয়ার জন্য মাত্র টিকিট কাটলো আর পিহুর ফোন এলো।- হ্যালো পিহু বল।- আপুণি তুই এক্ষণই আয় মা সিঁড়ি থেকে পড়ে গেছে।কুহু এ কথা শুনে হন্তদন্ত হয়ে কোনোরকম বান্ধবীদের বলেই জাদুঘরের বাইরে চলে এলো। কুহুর চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়েই যাচ্ছে কোনোভাবেই থামাতে পারছে না। কুহুর মাথাও কাজ করছে না কি করবে। আসলে একা আসা উচিত হয়নি মিতা বা টিনাকে সাথে নিয়ে আসা উচিত ছিল।কুহু চোখ মুছতে মুছতে একটা সিএনজি ডাকলো।সিএনজি তে উঠতে যাবে এমন সময় কুহু কারো কণ্ঠে নিজের নাম শুনতে পেয়ে পিছন ফিরে তাকালো।- কুহু কেমন আছেন?কুহুর কি বলা উচিত কিছুই বুঝতে পারছে না। - চিনতে পেরেছেন? আমি কূজন।কুহু কোনোরকম মাথা নাড়িয়ে হা সূচক উত্তর দিল।কূজন আবার বললো,- প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড আপনি কি কোনো সমস্যায় পড়েছেন? দেখুন আমাকে বলুন হেল্প করার চেষ্টা করবো।- না তেমন কিছুই না। আমাকে এখনই বাড়ি যেতে হবে আমার মা অসুস্হ হয়ে পড়েছেন।- আপনার বাসা ফেণী না?- জ্বি আমি এখন আসছি।- কুহু শুনোন আমি আপনাকে ড্রপ করে দেই। সিএনজি দিয়ে তো ভেঙে ভেঙে যেতে হবে অনেক বেশি সময় লাগবে। আমার সাথে গাড়ি আছে আমি বরং গাড়িতে করে আপনাকে পৌঁছে দেই।- না ধন্যবাদ।- শুনুন এখন আপনাকে আপনার পরিবারের অনেক দরকার তাই বলছি যত তাড়াতাড়ি পৌঁছুবেন ততোই ভালো।- ধন্যবাদ কিন্তু আমি যেতে পারবো। আপনাকে শুধু শুধু কষ্ট করতে হবে না।- প্লিজ কুহু চলুন ড্রপ করে দিচ্ছি। কোনো কষ্ট হবে না। আর আপনার জন্য তো এটুকু করতেই পারি। আপনিও তো আমাকে হেল্প করেছিলেন।কুহু আর কিছু না বলেই রাজি হয়ে গেল। কুহুর কাছে পৃথিবীর সব কিছুর উর্ধ্বে তার পরিবার।চলবে...পর্ব:১২কূজন গাড়ির দরজা খুলে দিতেই কুহু গাড়িতে বসলো। কূজন দরজা লাগিয়ে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসলো। কুহু অনবরত কেঁদেই চলছে। ফুপিয়ে কান্না চলে আসছে কিন্তু কান্নাটা নিবারণ করলো। এভাবে রাস্তাঘাটে ফুপিয়ে কাঁদার কোনো মানেই হয় না। কিন্তু কুহু হাজার চেষ্টা করেও চোখ থেকে পানি পড়া বন্ধ করতে পারছে না।কূজন গাড়ির লুকিং গ্লাস দিয়ে কুহুকে দেখছে। কূজন কখনোই কারো কান্নাকাটি সহ্য করতে পারে না। সে চায় তার আশেপাশের সব মানুষ হাসি খুশি থাকুক আর সে তা করতে আপ্রাণ চেষ্টাও করে। কিন্তু কুহুকে কি বলা উচিত সে বুঝতেই পারছে না। কুহুকে অনবরত চোখ মোছতে দেখে কূজন লুকিং গ্লাস থেকে চোখ সরিয়ে নিল। কূজনের খুব খারাপ লাগছে কারণ সে কুহুর জন্য কিছুই করতে পারছে না। গাড়ি ফেণী পৌঁছুতেই ড্রাইভার কুহুর কাছ থেকে বাসার ঠিকানা জানতে চাইলো। কূজন বললো,- বাসায় না যেয়ে যে হসপিটালে ভর্তি সেখানে যাওয়া উচিত। কুহু পিহুর কাছ থেকে হসপিটালের নাম জেনে ড্রাইভারকে বললো। গাড়ি হসপিটালের সামনে যেতেই কুহু গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে হসপিটালের ভিতর ঢুকলো। কূজন কতক্ষণ গাড়িতে বসে থাকার পর গাড়ি থেকে বের হলো। হাসপাতালের ভিতর যেয়ে মনে হলো কোন ফ্লোরে ভর্তি বা কোন কেবিনে আছে সে তো কিছুই জানে না। কূজন আবার যেয়ে গাড়িতে বসলো কিন্তু খেয়াল রাখলো হাসপাতালের মেইন এনট্রেন্সে। বেশ কিছু সময় পর দেখলো কুহু একজন মধ্যবয়স্ক লোকের সাথে বের যাচ্ছে। কূজন একবার ভাবলো যেয়ে কুহুর সাথে কথা বলা দরকার। ওর মা কেমন আছে জানা দরকার। পরক্ষণেই সে এই চিন্তা দূর করে ড্রাইভারকে কুমিল্লার উদ্দেশ্যে রওনা হতে বললো।কূজন মোটেও চাইছে না কুহুকে এখন বিপদে ফেলতে এমনিতেই ওর মা অসুস্হ। এখন যদি কূজন যেয়ে কুহুর সাথে কথা বলতো কুহুর পরিবারের লোক অন্যভাবেও ব্যাপারটা দেখতে পারতো। আফটার অল কূজন জানে না কুহুর পরিবার কেমন। কনজারভেটিভও হতে পারে আবার নাও হতে পারে তবে কুহু বেশ কনজারভেটিভ।তাছাড়া কুহু কোটবাড়ি গিয়েছিলো বেড়াতে এখন তার সাথে ফিরতে দেখলে কুহুর পরিবার কুহুকে ভুলও বুঝতে পারে। ..কলরব বাসায় ফিরলো রাত দশটার দিকে। কলরবের মা জিজ্ঞাসা করতেই বললো, অফিসে কাজের খুব চাপ ছিল তাই দেরি হয়েছে। কলরবের মা মুখ বাকিয়ে বললেন,- তুই যে কতো বড় গাধা আল্লাহই জানেন। ভার্সিটিতেই তো সুযোগ পেয়েছিলি না উনি বিসিএস হবেন পররাষ্ট্র কেডারে যাবেন।- মা এটাই আমার এইম।- এখন দেখ রাত পর্যন্ত কাজ করতে হচ্ছে।- আরে কয়েকদিনই তো। আমার কনফিডেন্স আছে আমার বিসিএস হয়ে যাবে।- আচ্ছা বিসিএস হওয়ার আগ পর্যন্ত শিক্ষকতা করতে পারতি ভার্সিটিতে।- আরে একবার পড়ানো শুরু করলে আর ছাড়তে পারতাম না।ইরিন এতোক্ষণ চুপচাপ শুনছিলো কিন্তু কলরবের এ কথা শুনে ইরিন চোখ মেরে বললো,- ভাইয়া তুমি যদি ভার্সিটিতে থেকে যেতে তাহলে তোমার ছাত্রীরা তোমাকে লাভ ইউ লাভ ইউ বলতে বলতে শেষ হয়ে যেত।- এই থাম তো।- না মাকে বলি??- একদম না।- এই কি লুকাচ্ছিস তোরা? আমাকেও বল নাহলে আমি শান্তি পাব না।- উফ্ ইরিন যদি কিছু বলিস মাকে তাহলে তোর বিয়ে দিয়ে দিব।- আচ্ছা দিয়ে দিও। ভালোই হবে পড়াশুনা করতে হবে না। পড়াশুনা করে কি হয় বলো তো? শেষ পর্যন্ত বিয়েই তো করতে হয়। মা মা শুনো না কাল ভাইয়া কি করেছে..ইরিন এতটুকু বলার পরই কলরব উঠে ইরিনের মুখ চেপে ধরলো। কলরবের মা বললো,- আচ্ছা থাক আমাকে বলা লাগবে না।কলরব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আবার খাবার শুরু করলো। কলরব খেয়ে উঠে যেতেই ইরিন মাকে সবটা বললো। কলরবের মা সবটা শুনে কতক্ষণ কি যেন ভাবলো তারপর বললেন,- ওরে বাবা ছেলে আমার এতো ব্রিলিয়ান্ট । আমি তো ভাবতাম এই ছেলে শুধু পড়া আর খেলা ছাড়া কিছুই পারে না।তারপর মা মেয়ে আবার হাসা শুরু করলো।..কূজন এপাশ ওপাশ করছে কিন্তু ঘুম আসছে না তার। বারবার কুহুর মা কেমন আছে তা জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। ইশ সাথে সাথে কেনো দৌড়ে কুহুর পিছন গেল না তাহলেই তো জানতে পারতো। কুহু কি এখন কাঁদছে? কুহুর কান্নার কথা মনে হতেই কূজনের মন খারাপ হয়ে গেল। কূজন বেড ছেড়ে উঠে গিটার নিয়ে বসলো। গিটারে টুংটাং বাজাচ্ছে। গিটার বাজাতেও ভালো লাগছে না। কূজন যতক্ষণ না কুহুর হাসিমাখা মুখ দেখতে পাবে ততক্ষণ তার শান্তি হবে না। কেনো যে কূজন এমন কূজন নিজেই জানে না। কূজন বেডরুম ছেড়ে বের হয়ে এগুলো বাবার ঘরের দিকে। লিভিংরুম পার হয়ে বাবা মার বেডরুমের কাছে যেয়েই আবার কূজন নিজের ঘরের দিকে ব্যাক করলো। কূজনের বাবার শরীরটা কয়েকদিন ধরে ভালো যাচ্ছে না। তাই কূজন বাবার সাথে গল্প করার ইচ্ছাটা বাদ দিল। বেডরুমে এসেই কূজন লাইটা অফ করে দিয়ে গিটার নিয়ে বেডে হেলান দিয়ে বসলো। তারপর গান ধরলো,"এখন তো সময় ভালোবাসারএ দুটি হৃদয় কাছে আসারতুমিও যে একাআমিও যে একালাগে যে ভালোও প্রিয় ও প্রিয়.."..কুহু বাসায় ফিরলো রাত দশটার দিকে। পিহুও সাথে এলো। কুহুর বাবা হসপিটালেই আছেন স্ত্রীর সাথে। কুহুর মায়ের পায়ের আঙ্গুলে সেলাই দিতে হয়েছে কয়েকটা। কুহু সারাদিনের ধকল শেষে বাসায় ফিরে সোজা বিছানায় শুয়েই ঘুম দিল। ফজরের নামাজ পড়তে ঘুম থেকে উঠতেই বুঝতে পারলো যে তার বড্ড ক্ষিধে পেয়েছে। নামাজ শেষে কুহু রান্না ঘরে যেয়ে পরোটা বেললো। পরোটা হয়ে যেতেই ডিম ভাজি করে সোজা রুমে চলে এলো। তারপর পিহুকে ডাকলো উঠার জন্য কিন্তু পিহু কিছুতেই উঠলো না। কুহুর হঠাৎ খাওয়ার ইচ্ছেটাই চলে গেলো। প্লেটটা ডাইনিং টেবিলে রেখে এসে বারান্দায় দাঁড়ালো। এসময় পাশের বারান্দায় কেউ এসে দাঁড়াবে না তাই গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। হঠাৎ কুহুর মনে হলো সে কূজনকে কৃতজ্ঞতাটুকু জানায়নি। টেনশনে কূজনের কথা খেয়ালই ছিল না। একটুখানি ধন্যবাদ পাওয়ার প্রাপ্য তো কূজন ছিলই। কুহু দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমে ফিরে এসে মোবাইল হাতে নিল। তারপর কূজনের আইডিতে নক করলো।চলবে...পর্ব: ১৩হাসানাদ সাহেব বের হতেই কূজন বেড ছেড়ে নামলো। অন্যদিন হলে রেডি হয়ে বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যেত আজ মন ভালো নেই তাই বারান্দায় যেয়ে দোলনায় বসলো। চোখ বন্ধ করে ছন্দ মিলাতে চেষ্টা করছে। কূজনের মন ভালো থাকার সাক্ষী যেমন তার গিটার তেমনি মন খারাপের সঙ্গী হলো কবিতা। চোখ বন্ধ করে দুইলাইন ভেবেছে কূজন,'' মেঘের ভেজা ভেজা আবেগ,সূর্যের তীব্র ভালোবাসা,বিরহীদের কান্না নিয়ে,ভোর হওয়ার শুরু।ঝাপসা চোখের তারা,সব আশায় গুড়ে বালি,একটুখানি ভালোবাসার জন্যে,একটু ভালো থাকার জন্যে।"কূজন দোলনা ছেড়ে উঠে রুমে ফিরে এলো তারপর মোবাইল নিয়ে বেক ইয়ার্ডে গেল। ভোর হওয়ার কিছু সুন্দর ছবি তুলে ডাটা অন করলো পিক আপলোড দেওয়ার জন্য। এফবিতে যেয়েই একটু আগের ভাবা লাইনগুলো ক্যাপশন দিয়ে পিকগুলো আপলোড করলো। তারপর মেসেঞ্জারে মেসেজ চেক করতে করতে বাড়ির ভিতর ঢুকলো। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে একটা মেসেজ পড়লো।" ধন্যবাদ আপনাকে সাহায্য করার জন্য আর দুঃখিত না বলে চলে আসার জন্য"কূজন সিঁড়িতেই থমকে দাঁড়ালো। একমিনিট সময় নিল বুঝার জন্য যে মেসেজটা কুহু পাঠিয়েছে। কিন্তু যখন বুঝলো এক দৌড়ে নিজের বেডরুমে চলে এলো তারপর মোবাইল নিয়ে কাউচে বসে পড়লো। শিউর হওয়ার জন্য কুহুর প্রোফাইলে ঢুকলো। নাম কুহু আরিজা দেখেই শিউর হলো যে এটা কুহুর মেসেজ। সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় নাম না দেখেই মেসেজ পড়েছিলো।কিন্তু কূজন বুঝতে পারছে না কুহু তার আইডি কীভাবে খুঁজে বের করলো। কূজন তো নিক নেইমে দেওয়া। কূজন এই চিন্তা বাদ দিয়ে কুহুকে মেসেজ করলো,- আপনি কি কুহু বলছেন? আই মিন জানালার পাশের কুহু? আন্টি এখন কেমন আছেন?তারপর ওয়েট করতে লাগলো রিপ্লাই পাওয়ার কিন্তু কোনো রিপ্লাই পেল না।আধা ঘণ্টা পর মোবাইলে রিমাইন্ডার দেখে মনে হলো কূজনের তো এক জায়গায় গান গাওয়ার প্রোগ্রাম ছিল। কুহুর চিন্তা করতে করতে ভুলেই গিয়েছিল ভাগ্যিস রিমাইন্ডার দিয়ে রেখেছিল। মোবাইলে রেখেই ডেসিংরুমের দিকে গেল।রেডি হয়েই ওয়ালেট বের করলো। মোবাইল, ওয়ালেট আর গিটার নিয়ে এগুলো মা বাবার ঘরের দিকে। কূজন রুমের দরজায় উঁকি দিয়েই বললো,- মা আমি আসছি।- এতো সকাল সকাল যে?- প্রোগ্রাম আছে ফিরতে রাত হবে।- খেয়ে যা।- না মা বাইরে খেয়ে নিব নয়তো দেরি হয়ে যাবে। রাগ করো না কিন্তু মা।- আমার লক্ষী ছেলের উপর কি রাগ করে থাকতে পারি?কূজন দৌড়ে এসে মায়ের কপালে চুমো দিয়ে বললো,- আসছি মা।কূজন বাড়ি থেকে বের হয়ে ড্রাইভার রফিক ভাইকে বললো,- রফিক ভাই ফেণী চলুন।- কূজন ভাই ঐ হাসপাতালে?- কোন হাসপাতালে?- ঐ যে কালকে যে একটা আফারে নিয়ে গেলাম।- না আমি এড্রেস বলবো সেখানে নিয়ে যাবেন, প্রোগ্রাম আছে।- ওহ্।- ভাই তাড়াতাড়ি।- আচ্ছা কূজন ভাই একখান কথা কমু?- অবশ্যই রফিক ভাই এভাবে প্রশ্ন করার প্রয়োজন নেই।- আইচ্ছা আমনে সবসময় আমার লগের সিটে বসেন কেন? পিছনেও তো বসতে পারেন?- আহা রফিক ভাই আপনি আমার ভাই না? ভাই সামনে একা বসবে আর আমি পিছনে বসবো এটা কোনো কথা?- কূজন ভাই আমনে আসলেই অনেক ভালা। আমনের লগে গাড়িতে থাকলে নিজেরে ড্রাইভার ড্রাইভার লাগে না আমনের বন্ধু বন্ধু লাগে।- আহা রফিও ভাই বন্ধু না বলুন ভাই।রফিক কূজনের একথায় হেসে বললো,- আমনে আসলেই অনেক ভালা।- জানি তো কিন্তু অ্যাওয়ার্ড কোথায়?- এই তো এহন আমনেরে ঝড়ের গতিতে উড়াইয়া ফেণী নিয়া যামু।.কূজন ফেনী আদর্শ মেমোরিয়াল স্কুলের সামনে যেতেই রফিককে গাড়ি থামাতে বললো।গাড়ি থেকে নেমে পিছনে রাখা গিটার নিয়ে স্কুলের ভিতর গেল। কথা ছিল সকাল আটটায় শুরু হবে অনুষ্ঠান। কূজন পৌঁছুলো আটটা এগারোতে।সব স্টুডেন্টরা তখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। কূজন সোজা স্টেজে যেয়ে উঠে গিটার নিয়ে বসলো। একজন ছাত্র এসে মাইক্রোফোন ঠিক করে দিয়ে গেল। কূজন হেসে তাকে ধন্যবাদ জানিয়েই মাইক্রোফোনে বললো,- হ্যালো! আমি রবিন ইবনে হাসানাদ। সবার কাছে প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এতোটা অপেক্ষা করানোর জন্য তবে প্রমিজ পুষিয়ে দিব। কূজন কথা বলা শেষ করেই গিটারে সুর তুলে চোখ বন্ধ করে গান ধরলো," হো এক লারকি কো দেখা তো এসা লাগাএক লারকি কো দেখা তো এসা লাগা''এতোটুকু গাওয়ার পরই কুহুর চেহারা ভেসে উঠলো আর কূজনের কিউট হাসিটা ধীরে ধীরে চওড়া হলো। "যেসে খিলতা গোলাবযেসে শায়েরকা খাবযেসে উজলি কিরাণযেসে মানমে হিরাণযেসে চাঁন্দনী রাতযেসে নারমি কি বাত যেসেমান্দির মে হো ইক জালতা দিয়াএক লারকি কো দেখা তো এসা লাগাএক লারকি কো দেখা তো এসা লাগাযেসে সুবহোকা রুপযেসে সার্দিকি ধুপযেসে বিনাকি তানযেসে কাঙ্গুকি জানযেসে বালখায়ি বেল যেসে লেহেরোকা খেল যেসে খুশবো লিয়ে আয়িঠান্ডি হাওয়া হোএক লারকি কো দেখা তো এসা লাগাহো এক লারকি কো দেখা তো এসা লাগাএক লারকি কো দেখা তো এসা লাগাযেসে নাচতা মোর যেসে রেশমকি ডোর যেসে পারীওকা রাগযেসে সামদালকি আগ যেসে সোলা স্রিঙ্গারযেসে রাসকি হোয়ারযেসে আহিসতা আহিসতাবাড়া নেশা"কূজন গানটা শেষ করতেই সবার করতালিতে ক্যাম্পাস মুখরিত হয়। কূজন চোখ খুলেই নিজের বুকের বাম পাশে হাত রাখলো। হার্ট বিট বেড়ে গেছে কূজনের। কূজনের কলেজ লাইফ থেকেই সবচেয়ে প্রিয় গান এটা কতোশতো রাত যে কূজন এই গানটা গেয়ে পার করেছে তা তার গুণা নেই। কই কখনো তো এমন হয়নি। কাল রাতে মনেই ছিল না প্রোগ্রামের কথা তাই কোনো গান প্র্যাকটিস করেনি সে। আর তাই সবচেয়ে ভালো পারা গানটাই গাইলো কূজনকিম্তু হঠাৎ কুহুর চেহারাটা ভেসে উঠলো কেনো? কুহুকে যখন সিট দেয়ার কথ বলা হয়েছিল তখন কুহু যে চিন্তার জগতে পড়ে গিয়েছিলো সেখান থেকে শুরু করে কুহর আইস্ক্রিম হাতে কূজনের পাশে এসে দাঁড়ানো, কুহুর সিটে বসতে দেওয়া,তারপর বই দেওয়া দেখে বোকা বনে যাওয়া,শালবনে কুহুর সাথে দেখা হওয়া, কুহুর কান্নারত দুটো লাল চোখ, সেই দৌড়ে চলে যাওয়া সব এক এক করে কূজনের চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। কূজন অবাক হয়ে গিটারটা রেখে দাঁড়ালো তারপর আবার শুরু করলো," লাইক আ স্মল বোউটঅন দি ওউশেনসেনডিং বিগ ওয়েবসইন দা মোউশেনলাইক হাউ অা সিঙ্গেল ওয়ার্ডক্যান মেইক অা হার্ট ওউপেনবাট আই হেব অনলি ওয়ান ম্যাচবাট আই ক্যান মেইক আ এক্সপ্লোউশেনএন্ড অল দোউজ থিঙ্গসআই ডিডেন্ট সেরেকিং বলস ইনসাইড মাই ব্রেইনআই ওয়াজ স্ক্রিমিংক্যান ইউ হিয়ার মাই বয়েজদিস টাইমদিস ইজ মাই ফাইট সংটেইক ব্যাক মাই লাইফ সংঅলরাইট সংমাই পাওয়ারস টার্ন্ড অনআলবি স্ট্রং আই প্লে মাি ফাইট সং"কূজন গানটা শেষ করে নিজে বোকা বনে গেল কারণ সে অনেকগুলো ওয়ার্ড মিস করেছে, এমনকি শেষের দুই লাইন ভুলেও গেছে। কূজনের মনে হলো সবাই এখন তার উপর পচা ডিম ছুঁড়বে। কিন্তু কেউ এটা করলো না কারণ ইংলিশ গান সবাই তেমন একটা শুনে না তাই কূজন বেঁচে গেল উল্টো সবাই আরো জুড়ে হাততালি দিচ্ছি।..ইরিন সেই সকাল থেকে বসে আছে সুইটি ভিডিও সেন্ড করবে বলে। দূপুর বারোটা বেজে গেছে এখনও সুইটির ভিডিও পাঠানের কোনো নাম গন্ধ নেই। ইরিনের মনটাই খারাপ হয়ে গেল কাল কতো করে কলরবকে বললো কিন্তু কলরব নিল না। কাল যখন সুইটি থেকে স্কুলে কনসার্ট হবে জেনেছিলো তখনই সাথে সাথে কলরবকে ফোন করেছিল।- ভাইয়া স্কুলে গান হবে আমাকে নিয়ে যাও প্লিজ।- পায়ের এ অবস্হায় কখনো না।- প্লিজ।কলরব জবাব না দিয়েই ফোন কেটে দিল। সে জানে ইরিনের সাথে আর দুমিনিট কথা বললেই ইরিন কাজ আদায় করে নিবে। কিন্তু ইরিনের পা আগে ঠিক হতে হবে তারপর এসব আবদার পূরণ করা যাবে। ইরিন রাগে গজগজ করতে করতে তার বান্ধবী সুইটির কাছে আবার ফোন দিল,- সুইটি আমি তো আসতে পারবো না প্লিজ তুই অনুষ্ঠানের পুরোটা ভিডিও করবি আর আমাকে পাঠাবি।- ওকে ইরিন।- না পাঠালে খেয়ে ফেলবো কিন্তু তোকে।- আরে আরে পাঠাবো ল্যাংড়ি দাদী।- একদম এসব বলবি না।- ঠিক আছে ঠিক আছে।- আচ্ছা যে ভাইয়াটা ঢাকা থেকে আসবেন গান করার জন্য নাম যেন কি?- রবিন ইবনে হাসানাদ।- প্রফেশনাল কেউ?- না বোধহয় যতোটুকু শুনেছি শখের বসে টুকটাক গায়।- ওহ্।- আচ্ছা এখন রাখছি।.ইরিনের এখন ইচ্ছে হচ্ছে পা টেনে খুলে ফেলে দিতে। এমন পা ইরিনের দরকার নেই যার কারণে ইরিন গানের কনসার্টে যেতে পারলো না। ইরিনের যখন প্রায়য় কান্না এসে যাবে তখন সুইটি ভিডিও সেন্ড করলো। ইরিন খুশি মনে ভিডিও অন করতেই ইরিনের খুশি ধীরে ধীরে ঠোঁটে ফুটে উঠলো। ইরিন অবাক দৃষ্টিতে কূজনের গানটা শুনলো। ইরিন পুরাই মণ্ত্রমুগ্ধ, অবাক, হতবাক। এটা কি সত্যি রবিন ইবনে হাসানাদ?পর্ব:১৪ইরিন পুরোটা ভিডিও দেখা শেষ করে ডায়েরী খুঁজে একটা নাম্বার বের করলো। তারপর ডায়াল করলো নাম্বারটায় কিম্তু রিং হয়েই যাচ্ছে রিসিভ করার নাম গন্ধ নেই।ইরিন বিরক্ত হয়ে ফোনটা বেডে ছুঁড়ে বসে রইলো।..কূজন স্টেজ থেকে নেমে সোজা গাড়িতে যেয়ে বসলো। তারপর রফিককে বললো,- রফিক ভাই কিছু মনে না করলে একটা কথা বলবো?- আরে কূজন ভাই বইলা ফেলেন।- আপনি কি একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসবেন? আমি আছি গাড়িতেই।- আইচ্ছা ভাই।রফিক চলে যেতেই কূজন চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে বসে রইলো। কূজনের কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না কূজন একটা গানে এতোগুলো ভুল করলো কীভাবে? আর কেনোই বা ঐ গানটা গাওয়ার সময় কুহুকে মনে পড়লো? কুহুকে তো কূজন দুইবার দেখলো। কই তখন তো কোনো স্পেশালিটি চোখে পড়েনি? তাক লাগিয়ে দেয়ার মতো সুন্দরী তো নয় কুহু তাহলে?? কূজনের ভার্সিটিতে তো অনেক সুন্দর মেয়ে আছে তাদের চেহারা তো ভেসে উঠেনি কখনো? এই জন্য কি কুহুর কান্না দায়ী? কোনো মেয়ের কান্না দেখে কি কেউ তাকে পছন্দ করতে পারে? তাও আবার কূজনের মতো ছেলে যে কিনা কান্না সহ্যই করতে পারে না। চোখ বন্ধ করে কূজন কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কুহুর চেহারাটা মনে করার চেষ্টা করছে কিন্তু কেনো যেন মনে করতে পারছে না। কূজন এবার চোখ খুললো। তার হিসাব আরো ঘোলাটে হয়ে গিয়েছে। কুহুর চেহারাটা এখন চোখে ভাসছে না কেনো? হঠাৎ চোখ বন্ধ করে কূজন আবার গাইতে শুরু করলো এক লারকি কো দেখা তে এসা লাগা... গানটা গাইতেই কুহুর চেহারা আবার ভেসে উঠলো। কূজন চোখ বন্ধ করেই কুহুর চেহারার বিশেষত্ব খুঁজছে। কুহুর মাঝে কি এমন আছে যা কূজনের ভালো লেগেছে? কূজন খুঁজে পেয়েও গেছে। কুহুর গায়ের রঙ। এতো মিষ্টি কেনো মেয়েটার মুখের আভা? কূজন নিজেই তো কতো ফর্সা কিন্তু কুহুর গায়ের রঙটা এতো কেনো ভালো লাগছে কূজনের? কুহু তো ফর্সাও না হলুূদ পরীও না,বা লাল সুন্দরীও না। কূজন আবারো একবার চেষ্টা করলো কুহুর বিশেষত্ব খুঁজে বের করার। কুহুর ভ্রুগুলোও সুন্দর কিন্তু গায়ের রঙটা অস্হির। কূজন এখন খুব ভালো করেই বুঝেছে কুহুর কান্না আর গায়ের রঙটাই তার মন কেঁড়েছে যদিও ভ্রুগুলোও সুন্দর। কূজন দীর্ঘশ্বাস ফেলে কুহু রিপ্লাই দিয়েছে কিনা দেখার জন্য মোবাইলটা পকেট থেকে বের করলো। মোবাইল বের করতেই দেখলো এগারোটা মিসড কল তাও সোনার হরিণের দেওয়া। কূজন ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে কল ব্যাক করলো। ওপাশ থেকে কল রিসিভ করতেই লূজন বললো,- হ্যালো সোনার হরিণ!- তোমার নাম কি রবিন ইবনে হাসানাদ?- হুম আমার নাম রবিন। কেনো বলো তো?- তুমি কি এখন ফেণী?- হুম।- আমি এখনই এড্রেস মেসেজ করে দিচ্ছি চলে এসো।- কোথাকার এড্রেস?- আমাদের বাসার এড্রেস।- সোনার হরিণ তুমি তো জানো বাবা একদম রাগ করবেন একথা শুনলে।- প্লিজ প্লিজ একবার এসো না।অন্তত আমার জন্য এসো।- না বাবা অনেক রাগ করবেন।- আঙ্কেল জানলে তো রাগ করবেন।- বাবাকে কি মিথ্যা বলা যায়?- আমি অতো শতো বুঝি না তুমি প্লিজ এসো। জানো তুমি যেই স্কুলে গান করতে গিয়েছিলে সেটা আমার স্কুল কিন্তু আমার পা ভাঙা তাই যেতে পারিনি।- কি বলো? কীভাবে ভেঙেছে?- প্লিজ একবার এসো বাসায় তোমার গান শুনবো আমি।- না এটা তো হয়না।- প্লিজ আমার কথা রাখবে না তুমি?- আহা ইরিন শুনো না..- না কোনো কথা শুনবো না তুমি আসবে কিনা বলো।- এটা অসম্ভব ইরিন।ইরিন কূজনের এ কথা শুনে সাথে সাথে ফোন কেটে দিল তারপর বিছানায় শুয়ে কাঁদতে লাগলো। কেউ ইরিনের কথা শুনে না। কলরবকে কতো করে কাল বললো নিয়ে যেতে নেয়নি আর আজ কূজনকে বললো বাসায় আসতে কিন্তু সেও আসলো না। কূজন বারবার ফোন করেই যাচ্ছে ইরিনকে কিন্তু ইরিন ফোন ধরছেই না এমনকি মেসেজ পাঠাচ্ছে তাও সীন করছে না। ইরিন এখানে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েই গেল। দুপুর তিনটার দিকে কলরব বাসায় এসেই ঢুকলো ইরিনের রুমে। কলরব ধীরে ধীরে ইরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মেয়েটা কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। কলরব ইরিনের কপালে চুমু দিয়েই আস্তে করে ডাকলো,- ইরিন!ইরিন! উঠ্ তো।ইরিন ওপাশ ফিরে ঘুমঘুম কণ্ঠে বললো,- না।- উঠ্ না ভাইয়া ডাকছি তো।- তোমরা কেউ আমার কথা রাখো না। আমি ছোট বলে আমাকে পাত্তা দাও না।- কে বলেছে এগুলো? এখন উঠ তো।ইরিন ভাইয়ের হাত কপাল থেকে সরিয়ে দিয়ে বললো,- বুঝো না রাগ করেছি।.- বুঝি তো আর এজন্যই তো রাগ ভাঙাতে চাইছি।- আইসক্রিম দিলেই আমি গলবো না।কলরব ইরিনকে টেনে তুলতে তুলতে বললো,- আয় তো আমার সাথে।- না যাব না তুমি আমাকে কনসার্টে নিয়ে যাওনি।কলরব ইরিনের সাথে আর কথা না বাড়িয়ে সোজা ইরিনকে পাঁজাকোলে নিয়ে নিল।ইরিন মুখ গম্ভীর করে বললো,- আমাকে কোলে নিতে হবে না। যাও ভাবীকে নাও।কলরব কিছুটা কেশে বললো,- ইরিন আস্তে বল তোর কথার যা শ্রী মা বাবা শুনলে কি বলবে আল্লাহই জানে।- আস্তে বলার কি আছে ভাবীকে তো কোলে নিবেই তুমি। বিয়ের দিন ঐ বাড়ি থেকে এ বাড়ি পর্যন্ত আমার ভাবীকে কোলে করে নিয়ে আসতে হবে তোমাকে। বুঝলে আমার হবু ভাবীর বর?- বুঝলাম তাই একটু প্র্যাকটিস করছি আরকি।কলরব কথা বলতে বলতে ইরিনকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে এলো। তারপর বললো,- ট্যানট্যানা.....ইরিন কলরব থেকে চোখ ফিরাতেই দেখলো কূজন সোফায় বসে আছে। ইরিন কলরবের গলা জড়িয়ে ধরে গালে চুমো দিয়ে বললো,- থেঙ্ক ইউ কূজন ভাইয়াকে এখানে নিয়ে আসার জন্য।কলরব কূজনের পাশেই ইরিনকে বসিয়ে দিতেই কূজন গিটার নিয়ে গান গাওয়া শুরু করলো।'' মায়াবনো বিহারিণী হরিণীগহনো স্বপনো সঞ্চারিণী.....''গান গাওয়া শেষ হতেই ইরিন কূজনের হাত ধরে বললো,- থেঙ্ক ইউ সো মাচ কূজন ভাইয়া।- প্লেজার মাই সোনার হরিণ।কলরবের মা সাহরা খাতুন স্কুল থেকে মাত্র ফিরলেন। আর কলিংবেল চাপতেই কলরবকে দরজা খুলে দিতে দেখে অবাক হলেন কারণ কলরবের এখন অফিসে থাকার কথা। আর উনিও ভুলে কলিংবেল চাপলেন কারণ ইরিনের তো পায়ে ব্যাথা। মনেই ছিল না চাবি দিয়ে দরজা খুলতে। অবাক হয়ে কলরবকে কিছু বলতে যাবে এমন সময় গানের শব্দ ভেসে এলো ভিতর থেকে। সাহরা খাতুন ভিতরে ঢুকতেই দেখলেন কূজন গান গাইছে আর ইরিন পাশে বসে শুনছে। গান শেষ না হওয়া পর্যন্ত একটা শব্দও করেননি তিনি। আসলে গান গাওয়া আর শোনা দুটাই উনার শৌখিনতা। কূজন গান শেষ করতেই সাহরা খাতুন ব্যাগ সোফায় রেখে বললেন,- কিরে কূজন গরীবের বাড়িতে পা পড়লো অবশেষে তোর।- খালামণি কি যে বলো না। এই ইরিনটার জন্য এখন আসতে হলো। বাবা জানলে খুব মন খারাপ করবে। তুমি তে জানোই বাবা কেমন।- যাক ইরিন একটা কাজের কাজ করেছে।- আরে বলো না মেয়ে রাগ করে ফোনই কেটে দিল। তারপর কতো কল দিলাম, মেসেজ দিলাম কিন্তু আমার সেনার হরিণ তো রাগ করেছিল আমার উপর। তারপর কল দিলাম কলরব ভাইকে। ভাই অফিস থেকে এসে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। রফিক ভাইকেও বিদায় করে দিয়েছি কারণ বাবার কানে কথাটা গেলেই শেষ।- তোর বাবাটা না পারেও।এখন বস আগে কিছু খেয়ে নে।কূজন বসা থেকে উঠতে উঠতে বললো,- আরে খালামণি না না এখনই বাসায় ফিরতে হবে।কলরব ভাই বাইক আছে না তোমার?- আছে তো।- আমাকে কুমিল্লা পৌঁছে দাও।- আচ্ছা তোকে কুমিল্লা পৌঁছে দিব।সে চিন্তা তোকে করতে হবে না কিন্তু না খেয়ে এক পাও কেথায়ও যেতে পারবি না।- আরে ভাই তুমি অন্তত বুঝার চেষ্টা করো।কলরবের মা বললো,- যদি কথা দিয়ে যাস আবার কাল আসবি ব্যাগ পত্র নিয়ে তাহলে আজ ছাড়বো। তোর বাপ জাহান্নামে যাক তা নিয়ে ভাববো না। এখন বল কাল তুই বিকালের মধ্যে তোর মাকে বলে বাবাকে ম্যানেজ করে কয়েক সপ্তাহের জন্য এখানে আসবি।- কথা দিতে পারছি না।- তুই জাহরাকে বলবি যে করেই হোক তোকে আসতেই হবে।- বাবা আছে তো।- আরে তোর মাকে বলিস ফোন দিতে বাকিটা আমি ম্যানেজ করে নিব। তুই তোর খালামণিকে চিনিস না?- তা ভালো করেই চিনি তোমার মতো ইন্টিলিজেন্ট আছে নাকি আর আমাদের ফ্যামিলিতে? কলরব ভাই এখন চলো তো।- আচ্ছা তুই যা আমি এখনই আসছি।- কূজন ভাইয়া কাল কিন্তু আবার আসবে তুমি।- খালামণি ম্যানেজ করে দিতে পারলে অবশ্যই আসবো সোনার হরিণ।চলবে..পর্ব: ১৫কুহু মোবাইল হাতে নিয়ে কূজনের মেসেজটা সীন করলো। জানালার পাশের কুহু লিখাটা দেখে হাসি পেল কুহুর, হাসলোও বেশ। তারপর রিপ্লাই করলো। রিপ্লাই করেই ইরিনদের বাসার উদ্দেশ্যে বের হলো। কলিংবেল চাপতেই কলরবের মা দরজা খুলে দিল। কুহু সালাম দিয়ে হাসি মুখে বললো,- আন্টি ইরিন আছে?- হ্যা এসো ভিতরে এসো।কুহু ভিতরে যেতেই দেখলো ইরিন ডয়িংরুমের সোফায় বসে ইয়ার ফোন কানে দিয়ে মোবাইলে কি যেন দেখছে। কুহু সামনে দাঁড়িয়ে বললো,- ইরিন!ইরিন শুনলো না তাই কুহু ইরিনের সামনে হাত নাড়ালো। ইরিন তাকিয়েই কুহুকে দেখতে পেয়ে হা করে রইলো তারপর ইয়ারফোন কান থেকে নামিয়ে বললো,- ভা... ভালো আছেন আপু?কুহু ঠিক বুঝলো ইরিন ভাবি বলে ফেলতে নিয়েছিল। কুহুর প্রথম প্রথম খুব বিরক্তি লাগলেও এখন উল্টো হাসি পায়। কুহু হালকা হেসেই ফেললো। তারপর বললো,- ইরিন আমি ভালো তুমি?- আমিও।- কি হলো হা করে আছো কেনো? কোথায় পড়বে তোমার রুমে নাকি এখানে?- এখানেই বসি?- আচ্ছা তুমি বসো আমি তোমার বই খাতা নিয়ে আসছি।- না আপু মাকে বলছি মা দিয়ে যাবে।- আরে আন্টিকে বলার প্রয়োজন নেই আমি নিয়ে আসছি।- থেঙ্ক ইউ আপু।কুহু ইরিনের রুমে যেয়ে ইরিনের বই আর কলম নিল কিন্তু খাতা খুঁজে পেল না। খাতা খুঁজতে খুঁজতে ইরিনের আর্ট খাতা দেখতে পেল। বরাবরই কুহুর ইরিনের আর্ট খুব ভালো লাগে। ইরিনের পুরোটা বেডরুম এই সেই দৃশ্য দিয়ে ভরা। ফেইরি টেইল এর বিভিন্ন ক্যারেকটারের হাতে আঁকা ছবিও দেয়ালে ঝুলছে। কুহু আর্ট খাতাটা খুলে দেখতে লাগলো। প্রথমে ইরিনের নিজের ছবি আঁকা। নীচে লিখে রেখেছে ইরিন, ইরু, সোনার হরিণ,হরিণ। পরের পাতায় ইরিনের বাবার ছবি আঁকা। বাবার ছবির পাশে লিখেছে প্রিয় বাবা,পত্রিকা সাহেব। কুহু হেসে পাতা উল্টাতে দেখলো ইরিনের মায়ের ছবি। মায়ের ছবিতে কুহু লিখেছে ড্রামাকুইন,মাষ্টারনী। ড্রামা কুইন লিখা দেখে কুহু একগাল হেসে পরের পাতা উল্টালো। পরের পৃষ্ঠাতেই কুহুর চোখ আটকে রইলো। কুহু দেখলো ইরিন কলরবের ছবি এঁকেছে। বাইকে বসা সানগ্লাস পড়া কলরবের ছবির পাশে লিখা বেস্ট ব্রাদার ইন দি ওয়ার্ল্ড, কলরব ইবনাত দি ডার্ক হ্যান্ডসাম, বাস্কেটবল চ্যাম্পিয়ন,হবু ভাবীর বর। ইরিন এতো ভালো ছবি একেঁছে যে দেখে মনে হচ্ছে কলরবের সত্যিকারের ছবি। কুহু একমনে কিছুক্ষণ ছবিটা দেখলো তারপর পাতা উল্টিয়ে নিজের ছবি দেখে নিজের চোখকে নিজে বিশ্বাস করতে পারছে না। কুহু এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাতাটা দেখছিল সাথে সাথে চেয়ার টেনে বসে পড়লো। ইরিন কুহুর ছবি এঁকেছে ভাবতেই কুহুর খুব ভালো লাগছে। সত্যি ইরিন মেয়েটা কুহুকে অনেক পছন্দ করে। কুহুর ছবির পাশে ইরিন লিখেছে মিষ্টি আপু, রাগী টিচার, হবু ভাবী। কুহু হবু ভাবী লিখা দেখে আগের পৃষ্ঠাটা কুহু আবার দেখলো। কলরবের ছবির পাশে লিখেছে হবু ভাবীর বর আর কুহুর ছবির পাশে লিখেছে হবু ভাবী। কুহু না চাইতেও হাসলো তবে রাক্ষসী হাসি না মিষ্টি হাসি। তারপর পরের পাতা আবার উল্টালো। সেখানে দেখলো ইরিন আর কলরবের মা - বাবা সহ ফ্যামিলির ছবি আঁকা। এরপরের পাতা উল্টাতেই কুহু হা করে রইলো। কারণ কলরব আর কুহুর ছবি পাশাপাশি আঁকা। ছবিতে ইরিন কুহুর বউ সাজার ছবি এঁকেছে। পাশে আবার কলরবও আছে। কুহু ছবিটা দেখে লজ্জায় একদম লাল হয়ে গেল। কুহু তো নিজেও কোনোদিন বউ সাজলে কেমন লাগবে তা নিয়ে ভাবেনি। কুহু খাতাটা বন্ধ করে জায়গায় রেখে চলে এলো।- ইরিন তোমার ইংরেজী খাতা পাইনি।- এটা তো এখানেই রাখা। - ওহ্।কুহু আজ খুব সুন্দর ইরিনকে পড়ালো। একবারো ধমকায়নি। কুহু চাচ্ছে কলরবের কথাটা ভুল প্রমাণ করতে। তাছাড়া ইরিন ওকে রাগী টিচার বলেছে। পিহুও একই কথা বললো। কুহুর কাছে একটাও ধমক না খেয়ে ইরিন নিজেও স্তব্ধ। কুহু চলে যেতেই ইরিন ফোন দিল কলরবকে।- হ্যালো ভাইয়া!- হুম বল।- কূজন ভাইয়াকে কি পৌঁছে দিয়েছো?- হ্যা এখন ফেণী ব্যাক করছি।- শুনো না ভাবী এসেছিল।- হুম তা তো আসবেই।- আমি ভাবলাম আর আসবেই না।- কেনো আসবে না? আমি জানতাম কুহু ঠিকই আসবে আর তোকে একটাও ধমক দিবেনা।- হ্যা হ্যা একদম ঠিক একটাও ধমক দেয়নি।- হাহ্হাহা।- ভাইয়া তুমি আসলেই ভাবীর চোখ পড়তে জানো।- একটুখানি।..কূজন বাসায় ফিরে মাকে সবটা বললো। কূজনের মা বললো কলরবের মাকে ফোন দিয়ে কথা বলবে। কূজন মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে পকেট থেকে মোবাইল বের করলো। ডাটা অন করতেই কুহুর মেসেজ দেখে মাকে বললো,- মা তুমি খাবার দাও আমি আসছি। কূজন মেসেজ পড়তে পড়তেই রুমে গেল। কুহুর রিপ্লাই ছিল এমন," হ্যা আমি জানালার পাশের কুহু। আচ্ছা কিছু মনে করবেন না একটা কথা বলতে চাই। আপনার সব কথা কি জানালার পাশেই আটকে থাকে?"কূজন কুহুর মেসেজ পড়ে নিজের আনমনেই বললো,- এখন থেকে সব কথা তোমাতেই আটকে থাকবে।কথাটা বিড়বিড় করে বলে নিজেই বোকা বনে গেল। একি বললো সে? কূজন কি সত্যি পাগল হয়ে গেছে? কূজন নিজের মাথায় নিজে টোকা দিয়ে বললো,- মিস্টার রবিন আপনি পুরো পাগলহয়ে গিয়েছেন।তারপর রিপ্লাই লিখলো,'' না শিউর হওয়ার জন্য বলেছিলাম আরকি। আর আন্টি কেমন আছেন বললেন না যে???"..কুহু বাসায় আসার পর থেকে যে বারান্দায় গিয়ে বসেছে আর বেডরুমে ফিরেনি। কুহুর মনে হচ্ছে ইশ্ ঐ আজব কলরব তার বোনকে এতো কিছু বলে কেনো? কুহু তো পিহুকে সব বলে কারণ ওরা পিঠাপিঠি। কিন্তু ইরিন তো ছোট ওকে কেনো বলে এসব? আর বোনরা একে অপরের সাথে সবকিছু শেয়ার করে কিন্তু ভাই বোন কি একে অপরকে এতকিছু বলতে পারে নাকি? আর কলরব সত্যি কি তাকে নিয়ে এতো কিছু ভেবে রেখেছে? হঠাৎ পিহুর ডাকে কুহুর ভাবনায় ছেদ পড়ে।- ঐ আপুণি!- হ্যা বল।- এখানে কি করিস? - বসে আছি আরকি।- তা তো দেখতেই পাচ্ছি।- তাহলে জিজ্ঞাসা করছিস কেনো?- তুই তো বারান্দায় তেমন একটা আসিস না তাই।কুহু আমতা আমতা করে বললো,- এমনিতেই তুই ছিলি না তো তাই একা একা ভালো লাগছিল না।- তুই কি অন্ধ? আমি তো রুমেই ছিলাম। তুই আরো রুমে এসে বোরকা খুলে সোজা বারান্দায় চলে এলি।- না মানে খেয়াল করিনি।পিহু কুহুর পাশে বসে বললো,- কি হয়েছে তোর আপুণি?- কিছু হয়নি।- আমাকে তো বল।- আগামীকাল কি বার?- হ্যা?- কি বার?- শুক্রবার।- কাল তুই ছাদে যাবি।- কেনো?- ভুলে গেলি? নাগরদোলা চড়াবো তোকে তাও টানা পনেরোদিন।- ও হ্যা মনে পড়েছে। তোর কলরবকে পরীক্ষা করার জন্য যেতে হবে।পিহুর মুখে তোর কলরব কথাটা শুনে কুহুর কেমন যেন লাগলো। কুহু পিহুকে বললো,,- তুই যা আমি আসছি।- আচ্ছা।পিহু উঠতে উঠতে আবার বললো,- আপুণি শোন ভালবাসা এমন একটা অদ্ভুত বিষয় সেটা সবার ভাগ্যে থাকে না। কেউ হাজার চাইলেও ভালোবাসার পিছনে ছুটেও ভালোবাসার নাগাল পায় না। আবার কেউবা না চাইতেও একটুখানি জীবনে ভালোবাসার সমুদ্রে ভেসে যায়। কেউ কেউ তো এমন যে সে বুঝতেই পারে না সে ভালোবাসার জোয়ারে ভেসে কোনদিকে যাচ্ছে। পিহু চলে যেতেই কুহু দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলো আর সাথে সাথে কলরবকে দেখতে পেল। চলবে..পর্ব:১৬- মাষ্টারনী!- হুম ইফতেখার সাহবে বলুন।- শুনলাম জাহরার ছেলে এসেছিল।- হুম কূজন এসেছিলো।- হাসনাদ সাহেব জানতে পারলে খবর আছে।- এতো ভাব ধরে কেনো ঐ ব্যাটা?- আরে অাত্মসম্মানে লেগেছে। তুমি উনাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলে..- দেখো আমি উনার ভাগ্য খুলে দিয়েছি বরং। আমার বোন জাহরার মতো এতো শান্তশিষ্ট সুন্দরী একটা মেয়েকে বিয়ে করতে পেরেছে একমাত্র আমি ফিরিয়ে দেয়ার কারণেই।- কিন্তু হাসনাদ সাহেব তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন।- আল্লাহ! বুদ্ধি করে কাজটা না করলে আজ আর তোমাকে পাওয়া হতো না।- ভাগ্যিস তোমার বাবাকে বুঝিয়েছিলে তুমি আমাকে ছাড়া আ কাউকে বিয়ে করতে পারবে না।- হুম তবে আমি ঠিকই বিয়ের আগের দিন বাবাকে বলে বিয়েটা ভাঙলেও হাসনাদ সাহেবকে আমি ঠকাইনি বরং আমার থেকে রূপে গুণে সবদিক থেকে এগিয়ে থাকা আমার ছোট বোনকে বিয়ে করে তিনি ধন্য হতে পেরেছেন।- তোমার রূপ কি কম নাকি? আমার ইরু তো পুরো তোমার মতো হয়েছে। সেই হরিণী চোখ সেই রকম গোলাপের পাপড়ির মতো ঠোঁট একদম তোমার ডুপ্লিকেট। আর চটপটে ভাবটাও পেয়েছে তোমার।- বুদ্ধিটা কিন্তু আমার কলরব পেয়েছে।- হুম তোমার বুদ্ধির প্রশংসা না করে যাব কোথায়? তুমি যেভাবে সবদিক হ্যান্ডেল করেছিলে বাববাহ্। তোমার জায়গায় অন্য কেউ হলে পালিয়ে যেত নয়তো হাসনাদ সাহেবকে বিয়ে করতো। কিন্তু তুমি তা না করে তোমার বাবাকে ম্যানেজ করে ফেললে আবার হাসনাদ সাহেবের সাথে নিজের ছোট বোনের বিয়েটাও দিয়ে কি সুন্দর সিচুয়েশন হ্যান্ডেল করলে।- আমি আমার আপনজনদের জন্য সব কিছু করতে পারি। একদিকে বাবার সম্মানও রক্ষা করলাম অন্যদিকে হাসনাদ সাহেবকে সবচেয়ে বেস্ট অপশন দিয়েছি আর আমার বোনটাও সুখী। গাড়ি বাড়ি টাকা পয়শায় রাণীর হালে রেখেছেন কূজনের বাবা জাহরাকে।- হুম কিন্তু তুমি হঠাৎ বিয়ের আগেরদিন পল্টি মারলে কেনো?- মারলাম কারণ তুমি আমাকে যেদিন দেখে গিয়েছিলে সেদিনই তো বাবা তোমায় ফিরিয়ে দিয়েছিল। তোমার মতো অল্প বেতন পাওয়া কারো কাছে বিয়ে দিবে না তাও হাসনাদ সাহেবের মতো এতো বড় ব্যবসায়ী যখন আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছে। কিন্তু তুমি বাবাকে বলেছিলে আমাকে না পেলে চিরকুমারথেকে যাবে। কথাটা কেনো যেন আমার মনে ধরেছিল। তাই পরে পল্টি মারলাম।- হাসনাদ সাহেবও কিন্তু তোমায় বেশ পছন্দ করতো। তোমার স্কুলের অনুষ্ঠানের চিফ গেস্ট হয়ে যেদিন স্কুলে গিয়েছিলেন সেদিনই তো তোমাকে দেখে তোমার বাবার কাছে প্রস্তাব পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।- হুম তবে আমার মনে হয়েছিলো আমাকে না পেলেও হাসনাদ সাহেব জীবনে ভালোই থাকবেন তবে কেনো যেন বারবার মনে হতো তোমার জীবন থমকে যাবে।- তুমি আসলেই বুদ্ধিমতী। তোমার ভাবনাটা একদম ঠিক। হাসনাদ সাহেব নিজের জীবনে ভালোই আছেন। আর আমিও আমার মাষ্টারনীকে নিয়ে ভালোই আছি।- হাসনাদ সাহেব যে বিয়ে করে আমাদের বাড়ি থেকে জাহরাকে নিয়ে গেলেন আর কোনোদিন আসেননি।- জাহরা আর কূজনকে কিন্তু তোমার বাবার বাড়িতে যেতে নিষেধ করেননি কখনো তবে আমাদের বাসায় আসতে বারণ করে রেখেছেন তাও খুব স্ট্রিক্টলি।- কি যেন বাবা এতো রাগ যে কেনো আমি বুঝিনা। বেচারার আরো আমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকা দরকার তা না করে ক্ষোভ জমিয়ে রেখেছেন। আমার তাতে কিছু আসেও না যায়ও না। আমার কাছের মানুষগুলো সুখী হলেই হলো। আমার বাবার সম্মানও ঠিক আছে আবার আমার বোনও অনেক সুখী আর তুমিও খুশি। আর হাসনাদ সাহেবকে আমি ঠকাইনি বরং জিতিয়েছি। জাহরা আমার মতো এতো চটাং চটাং করে না আর কতো রূপবতী, হাসিটাতেই সবাইকে পাগল করে দেয়।- কিন্তু তোমার চোখ সেটা এই হেডমাষ্টারকে পাগল করে দিয়েছে।- হুম এই জন্যই তো পাগলামি করো। সারাদিন একটার পত একটা পেপার পড়ো।- হা হা হা। আচ্ছা কূজন আসবে তো?- আরে আমি আছি না। না এসে যাবে কোথায়?- হাসনাদ সাহেব?- আরে রাখো তোমার হাসনাদ সাহেব আমার কাছে সবাই হার মানতে রাজি।- একদম ঠিক মাষ্টারনী।..কুহু সারাদিন অপেক্ষা করলো কখন বিকেল হবে আর কখন পিহুকে ছাদে পাঠাবে। আছরের আজান দিতেই তাড়াডাড়ি পিহুকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে নামাজ পড়তে বললো। পিহু সপ্তাহের এই একটা দিন পড়াশুনা করে না। শুধু রেস্ট নেয় আর গান শুনে। পিহু আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বললো,- একটু পরে পড়ি?- না এখনই।- এতো তাড়া কিসের তোর?- নাগরদোলা চড়বি না???পিহু কুহুর কথা শুনে লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে বললো,- একমিনিট আমি ওযু করেই নামজটা সেরে ছাদে যাচ্ছি।পিহু নামজ পড়া শেষ করে কুহুকে ডেকে বললো,- আপুণি যাচ্ছি কিন্তু কান্না তো আসছে না।- আরে তোকে কাঁদতে বললো কে?- তুমিই তো সেদিন বললে।- আরে প্রথম দিনই কান্নাকাটি করার দরকার নেই। নরমালি যাবি আবার নরমালি চলে আসবি। আর কলরব কিছু বললে কি বলতে হবে সেটা নিশ্চয় আমার মতো হাবলীর কাছ থেকে তোকে জানতে হবে না।পিহু আর কিছু না বলে সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠলো। সেই যে গত ইদে ছবি তোলার জন্য পিহু ছাদে উঠেছিল তারপর আর উঠেনি। ছাদে যেতেই পিহুর সেখানে দাঁড়িয়ে হেডফোনে জাস্টিন বিবারের একটা গান শুনতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু মোবাইলটা নিয়ে আসেনি তাই আর শোনা হলো না। কাপড় নামাতে নামাতে চোখ দিল পাশের ছাদে। পিহু দেখলো দুইটা ছেলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। খুব ধীরে সুস্থে ইচ্ছে করে একটু সময় নিয়ে পিহু কাপড় নামালো। কুহু এখানে নিজেদের ফ্ল্যাটের দরজার সামনেই পিহুর জন্য অপেক্ষা করছিলো। পিহুকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখে কুহু বললো,- কিরে এতক্ষণ লাগলো কেনো?- ইটিশপিটিশ করছিলাম তোর কলরবের সাথে। - বাজে কথা রেখে ভিতরে চল।- কাপড়গুলো ভাঁজ করে নেই তারপর কথা বলবো।- না এগুলো আমি পরে করে দিব তুই এখন রুমে চল।- ঠিক আছে আমি তো বেঁচেই গেলাম।- উফ্ চল তো।- পাশে বস বলছি।- আরে নাটক বন্ধ করে বল।- শোন তোর কলরব..- এই চড় দিব কিন্তু। আমার কলরব মানে কি?- আচ্ছা সরি! - ঠিক আছে ঠিক আছে। এখন বল কি হয়েছে ছাদে?- কিছুই হয়নি আর ইম্পর্টেন্ট কথা হলো আমি তো আর কলরবকে চিনি না।- আরে পাশের ছাদে যে ছেলেটাকে দেখবি সেটাই কলরব।- আমি তো দুইজনকে দেখলাম।- দুইজন আসবে কোথা থেকে?- হ্যা দুইজন ছিল। আচ্ছা আমি বর্ণনা দেই তুই বলিস কোনটা কলরব।- বল।- একজনকে দেখেছি মোটামুটি লম্বা, চোখে চশমা বেশ ফর্সা সুইট বয় যাকে বলে।- না কলরব এমন না।- আরেকজনকে দেখেছি বেশ লম্বা ছয় ফুট বলা যায়, বেশ এটরাকটিভ, চুলে জ্যাল দেয়া। হ্যান্ডাসাম এককথায় ডার্ক হ্যান্ডসাম অতোটা ফর্সা না আরকি।- হ্যা এটাই।- আচ্ছা শোন আমি ছাদে যেয়ে দেখি দুইজন কথা বলছে। এর মধ্যে চশমিশ হেসে হেসে কি যেন বলছে আর কলরব বেশ জোরে জোরে হাসছে। আমি যেতেই কলরব একবার তাকিয়েছিল। আমাকে দেখে চোখ ফিরিয়ে আবার চশমিশের সাথে কথায় লেগে যায়। কলরবকে আমাদের ছাদে তাকাতে দেখে চশমিশও তাকিয়েছিল। সেও কলরবের মতোই চোখ ফিরিয়ে পরে কথায় মেতে যায়।- ওহ্।- আর আরেকটা কথা আজকে কারো হাতে বাস্কেটবল ছিল না।- কি বলিস সবসময় কলরবের হাতে বাস্কেটবল থাকে।- মনে হয় সাথে চশমিশ ছিল তাই আনেনি।- হয়তো।- ওহ্ আরেকটা ব্যাপার দুজনই আমাকে এক পলক দেখেছিল তবে দুজনই এক ঝলকের দেখায় বেশ গভীরভাবে আমাকে দেখেছে।- মানে কি?- মানে হলো দুজনই অবাক হয়ে আমাকে দেখেছিলো। আমার অন্তত তাই মনে হয়েছে।- হুম।- এখন আমাকে নিয়ে নাগরদোলা চড়াবি।- ঠিক আছে রেডি হয়ে নে।পিহু খুশি মনে চলে যেতে যেতে বললো,- ম্যাডাম আমি একা না আপনাকেও চড়তে হবে।- ঠিক আছে।চলবে...পর্ব: ১৭কুহু পিহু দুজনই চট করে রেডি হয়ে নিল। দুই বোনের রেডি হতে সময় লাগে না তেমন। চট করেই পাঁচ দশ মিনিটের মধ্যে তৈরী হয়ে নীচে নেমে এলো। রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে দুজন। হঠাৎ পিহু কুহুর হাত চেপে ধরলো। কুহু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে পিহুর দিকে তাকাতেই পিহু কুহুকে ইশারায় সাইডে তাকাতে বললো। কুহুডানপাশে ফিরে তাকাতেই দেখে কলরব বাইকে বসে আছে। লেদার বাইকার জ্যাকেট, বাইকার বুট আর চোখে সানগ্লাস। কলরব কুহুকে বোধহয় দেখেনি। কলরব ওদের বাসার গেইটের দিকে তাকিয়ে আছে। কুহু দেখলো কলরবদের বাসার গেইট দিয়ে একটা ছেলে বেরিয়ে আসছে। ছেলেটাকে কুহুর কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। ছেলেটা কিছুটা সামনে আসতেই কুহু দেখলো ছেলেটা আর কেউ নয় কূজন। কূজন একটা সাদা সুয়েটশার্ট পড়ে আছে, সাথে নীল জিন্স, সাদা স্নিকারস, চোখে নীল ফ্রেমের চশমা। কূজন কলরবের বাইকের পিছনে বসতেই কুহু হা হয়ে গেল। কূজন বসতেই কলরব হেসে কথা বলতে বলতে বাইক স্টার্ট দিয়ে কুহুদের সামনে দিয়ে চলে গেল। কলরব আর কূজন কথা বলায় এতো ব্যস্ত ছিল যে কুহুদের দেখেনি তাছাড়া কুহু আর পিহু ওদের বাসার গেইটের ভিতর দাঁড়িয়েই রিকশা খুঁজছিলো তাই আরো দেখেনি। পিহু কুহুকে হা হয়ে থাকতে দেখে বললো,- আপুণি দেখলি তো। আমি বলেছিলাম না দুইজনকে দেখেছিলাম। ওরাই ছিল ছাদে। এই হা হয়ে আছিস কেনো? মশা ঢুকবে তো। পিহুর কথা শুনে কুহু মুখ বন্ধ করলো। পিহু আবার বলতে শুরু করলে,- তোর কলরব কোনটারে? আশিকি টুর আদিত্য কাপুর নাকি জাব উই মেট এর শাহেদ কাপুর??- এই শুন না আজব আর অদ্ভুত একসাথে কি করছে?- কি বলছিস তুই?- চশমিশটাই তো কূজন।- ঐ যে জানালা কাহিনী?- হুম।- আচ্ছা দাঁড়া আমি চাদর নিয়ে আসছি। এক্সাইটমেন্টে চাদর আনতেই ভুলে গিয়েছি।- যা নিয়ে আয়।পিহু চাদর গায়ে জড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেইটের কাছে আসতেই দেখলো কুহু রিকশায় বসে আছে। কুহুর পাশে বসে পিহু বললো,- আপুণি কি ব্যাপার?- তোকে তো একটা কথা বলতেই ভুলে গিয়েছিলাম।- কি কথা?কুহু শালবন থেকে ফেণী আসার ঘটনা থেকে শুরু করে মেসেজ এর কথাও বললো। পিহু সব শুনে বললো,- কি দরকার ছিল নক করার?- আরে ধন্যবাদ জানাতে চেয়েছিলাম তাই।- শোন এসকল ধন্যবাদ থেকেই পড়ে কেচাল লাগে।- কেচাল??- ভেজাল আরকি।- এখানে ভেজালের কি আছে?- কিছু না থাকলেই হলো।কুহু আর পিহু নাগরদোলায় চড়লো। কুহু তো উঠতেই চায়নি কিন্তু পিহুর আবার একা চড়ে মজা লাগে না তাই শর্তের কথা মনে করিয়ে কুহুকে টেনে নাগরদোলায় উঠালো। নাগরদোলা উপরে উঠার সময় কুহুর ভয় করে না বেশ মজাই লাগে কিন্তু নীচে নামার সময় আত্মা শুকিয়ে যায়। কুহুর মনে হয় যেন সে নিজে নামার আগেই তার আত্মা লাফ দিয়ে দেহ থেকে আলাদা হয়ে নীচে পড়ে যায়। তাই চোখ বন্ধ করে কোনোরকম বসে ছিল। তবে ভয়ে অনবরত দোয়া দরুদ পড়া তার বন্ধ হয়নি। একটার পর একটা পড়েই যাচ্ছে। হঠাৎ বেশি ভয় পেয়ে পিহুর হাত চেপে ধরে বলতে লাগলো,- প্লিজ থামাতে বল আঙ্কেলকে।- আপুণি প্লিজ থামালেই এখন আমাকেও নেমে যেতে হবে। প্লিজ! প্লিজ! - না আঙ্কেল থামান প্লিজ।পিহু কুহুর হাত আরো শক্ত করে ধরে বললো,- আপুণি তোর শশী কাপুরের কসম তোকে।- এই পাগল মেয়ে মরার সময় আল্লাহর নাম নে। শশী কাপুরের কথা বলতে বলতে মরলে আল্লাহর কাছে কি জবাব দিব আমি? আমার প্রাণ যায় যায় অবস্হা আর উনি শশী কাপুর নিয়ে পড়ে আছেন।কুহু আবারো একমনে দোয়া পড়া শুরু করলো।নাগরদোলা থামতেই কুহু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। বাসায় ফিরার সময় পিহু কুহুকে ক্ষেপানোর জন্য বারবার বলতে লাগলো,- এই তোর শশী কাপুরের প্রতি প্রেম?- আমার তখন জান বেরিয়ে যাচ্ছিলো।- এই একটুখানিতেই তোর এতো ভয়? জীবনে চলবি কীভাবে?- আমার আল্লাহ্ আছে না।- আল্লাহ্ সাহসী মানুষেরও থাকে।- আমার মতো বোকাদের পাশেও কিন্তু থাকে।- হয়েছে এবার এইটটিজের ডায়ালগ মারা বন্ধ কর প্লিজ।- ওকে ওকে।..কলরব আর কূজন সারা সন্ধ্যা বাইকে ঘুরাঘুরি করে আড্ডা দিয়ে পার করলো। আসার সময় ইরিনের জন্য ফুচকা নিয়ে এলো দুজন।বাসায় ফিরেই ইরিনকে ফুচকা দিতেই আনন্দে ইরিন একা একাই সবটুকু খেলো। কলরব ইরিনের খাওয়া দেখে বললো,- তুই তো বড্ড খারাপ। দেখা যাবে বিয়ের পর আমার বউ এই বাড়িতে এসে ফুচকা আর খেতে পারবে না।কূজন কলরবের কথা শুনে হেসে দিল। ইরিন কূজনের হাসি দেখে বললো,- ভাইয়া তুমি শব্দ করেও হাসতে জানো?- জানতাম না তবে কলরব ভাই শিখিয়ে ফেলেছে। কি বলো ভাই?কলরব কলার নাচিয়ে বললো,- কলরব ইবনাত দি..বাকি কথাটা কূজন আর ইরিন কলরবকে বলতে না দিয়েই নিজেরা একসাথে বললো,- সানশাইন অফ আওয়ার আড্ডাবাজি। তারপর তিনজন এক সাথে হেসে উঠলো। ইফতেখার সাহেব ওদের হাসি শুনে পাশের ঘর থেকে পত্রিকা হাতে নিয়েই উঠে এলেন। কূজনের পাশে বসে কূজনের পিঠে চাপর দিয়ে বললেন,- নবাব সাহেব আপনার খালামণি আপনার খেদমত ঠিকভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন তো?- খালামণির সবই ঠিকঠাক শুধু গানটা শোনাচ্ছেন না।- কি বলো এতো বড় সাহস মাষ্টারনীর হলো কি করে?কলরবের মা গরম গরম মাংসের সমুচা বানাতে বানাতে রান্নাঘর থেকে বললেন,- কাল রাতে নবাবের আর্জি পূরণ করবো পত্রিকা সাহেব।কলরবদের বসার ঘরে আবারো হাসির রোল উঠলো। খাওয়া শেষে কূজনের জায়গা হলো কলরবের ঘরে। কলরবদের বাসাটা বেশ গুছালো। বিশেষভাবে বসার ঘরটা নানান মাটির জিনিস দিয়ে সাজিয়ে রেখেছেন কলরবের মা। চারটা বেডরুম, ডাইনিং, ড্রয়িং মিলিয়ে বেশ ভালো একটা ফ্ল্যাট। উচ্চ মধ্যবিত্তদের মতোই তাদের বাসাটা শুধু এসি নেই।কূজন চাইলেই ফাঁকা রুমটায় থাকতে পারতো কিন্তু সে ইচ্ছে করে কলরবের সাথে কলরবের রুমে থাকতে চেয়েছে।কলরব কূজনের পাশে শুতে শুতে বললো,- এসি ছাড়া তোর একটু কষ্ট হবে রে ভাই। ভাড়া বাসা তাই লাগায়নি।- আরে না কোনো সমস্যা নেই। তোমার সাথে থাকতে পারছি এটাই বা কম কিসে?- আমাকে এতো ভালো লাগে? যেমন করে বলছিস মনে হচ্ছে আমি প্রিন্স হ্যারি।- হা হা হা। এজন্যই তোমাকে এতো ভালো লাগে আমার। তোমার সাথে কথা বললে মন ভালো হয়ে যায়। - হুম তবে দেখা তো বছরে একবারই হয়। নানার বাড়িতেও বছরে একবার যাওয়া আর আমাদের দেখা হওয়াও একবার।কূজন কলরব কথা বলতে বলতে রাত দুটো বাজিয়ে ফেলেছে। দুটোর দিকে কথা শেষে দুই ভাই দুই দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করে আছে। কিন্তু চোখ বন্ধ করে দুজনই পিহুকে নিয়ে ভাবছে। কলরবের ভাবনা: পিহু আজ ছাদে এলো কেনো? কুহু কি অসুস্হ? পিহুকে ডেকে কি কিছু জিজ্ঞাসা করার দরকার ছিল? ইশ্ কুহু কেমন আছে? সত্যি যদি শরীর খারাপ হয়ে থাকে? কালই ইরিনকে দিয়ে খবর নিতে হবে, দরকার পড়লে পিহুর সাথেও কথা বলবে।কলরব এসব ভাবতে ভাবতে যখন ঘুমে তলিয়ে গেল তখনও কূজন মোবাইল হাতে নিয়ে কুহুর রিপ্লাইয়ের অপেক্ষা করছে। কুহুর রিপ্লাই না পেয়ে সে পিহুর কথা ভাবতে লাগলো। ছাদের ঐ মেয়েটাকে এতো পরিচিত মনে হচ্ছে কেনো ওর? খুব চেনা চেনা লাগছে। কে ঐ মেয়েটা?চলবে...পর্ব: ১৮কলরব ঘুৃম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়েই গেল ইরিনের রুমে। ইরিন তখনও ঘুম থেকে জাগেনি। কলরব ইরিনকে ডেকে তুললো।- ভাইয়া যাও তো ঘুমাচ্ছি।- শ্বশুড়বাড়িতে যেয়ে আমাদের বদনাম বের করবি তুই।ইরিন মুখ বাকিয়ে বললো,- ঢং!- আচ্ছা যা আগে হাত মুখ ধূয়ে আয়।- তোমার এতো তাড়া কিসের?- আছে আছে।- সেটাই তো জানতে চাচ্ছি।- আসলে কালকে না কুহু ছাদে আসেনি, কুহুর বোন এসেছিল।- পিহু আপু?- হুম।- হঠাৎ?- এটাই তো। কুহু অসুস্হ নয় তো?- কি যেন জানি না তো।- তোকে কি আজকে পড়ানোর কথা?- হুম বিকেলে আসার তো কথা, খবর নিব?- না থাক বিকেলে না এলে ফোন করিস।- ঠিক আছে।কলরব নিজের রুমে ফিরে এসে পায়চারী করতে লাগলো। কিছুই ভালো লাগছে না তার। কূজন ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে কলরবকে এভাবে পায়চারী করতে দেখে বললো,- কি ভাই এমন দেখাচ্ছে কেনো তোমাকে?- না তেমন কিছু না।কূজন আর কথা বাড়ালো না। কলরবের রুম থেকে বের হয়ে কূজন গেল ইরিনের রুমে। দরজায় দাঁড়িয়ে নক করলো। ইরিন কূজনকে দেখেই বললো,- আরে নক করতে হয় নাকি আবার?কূজন ইরিনের বেডের পাশে চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো,- সোনার হরিণ তুমি দেখি ভালো আর্টিস্ট, পুরো রুম জাস্ট ওয়াও!ইরিন হেসে বললো,- তোমার একটা ছবি এঁকে দেই?- সত্যি?- টেবিলের উপর একটা আর্ট খাতা আছে নিয়ে এসো তো।- দাঁড়াও।- উহু দাঁড়াতে পারবো না পায়ে সমস্যা।- তুমিও মজা করতে জানো বেশ।ইরিন বেশ খানিকটা সময় নিয়ে কূজনের ছবি আঁকলো। কূজন অধীর আগ্রহে ইরিনের দিকে তাকিয়ে আছে। ইরিনের ছবি আঁকা শেষ হতেই ইরিন কূজনকে বললো চোখ বন্ধ করতে। কূজন চোখ বন্ধ করলো। ইরিন খাতাটা কূজনের সামনে তুলে ধরে কূজনকে চোখ খুলতে বললো। কূজন চোখ খুলতেই তার ঠোঁটে লেগে থাকা হাসিটা বিস্তৃত হলো। কূজন হাত বাড়িয়ে খাতাটা নিয়ে অবাক দৃষ্টিতে কতক্ষণ চেয়ে রইলো। কূজন অভিভূত হয়ে গিয়েছে। কূজন প্রোগ্রামে গান গাওয়া শেষে যখন চোখ খুলে বুকের বাম পাশে হাত রেখে নিজের বেড়ে যাওয়া হৃদকম্পন অনুভব করছিলো ঠিক সেই সময়কার চিত্র এঁকেছে ইরিন। কূজন স্টেজের চেয়ারে বসা, সামনে মাইক, এক হাতে গিটার ধরে রেখেছে আর আরেক হাত বুকে চেপে ধরে রেখেছে। কূজন কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে ইরিনের দিকে তাকাতেই ইরিন বললো,- লিখাটা পড়েছো?কূজন ইরিন থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে ছবির নীচে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। সিলভার টাং, হাসিমাখা আকাশ, কূজন ভাইয়া।কূজন জোরে জোরেই পড়লো। তারপর ছবি থেকে চোখ না সরিয়েই বললো,- সোনার হরিণ আমাকে কি ছবিটা দিয়ে দিবে?- না।কূজন ইরিনের কথায় অবাক হয়ে ইরিনের দিকে তাকালো। ইরিন কূজনের হাত থেকে আর্ট খাতাটা নিমিষেই নিয়ে নিল। তারপর বললো,- সরি ভাইয়া কিন্তু আমি কাউকে আমার আঁকা ছবি দেই না। অবশ্য এই খাতায় যেই আর্টগুলো করি সেগুলো আরকি।কূজন ইরিনের কথার মানে না বুঝে শুধু ইরিনের দিকে চেয়ে রইলো। ইরিন বিষয়টা বুঝতে পেরে বললো,- বুঝিয়ে বলছি শুনো। এ খাতায় আমি শুধু আমার খুব পছন্দের মানুষগুলোর ছবি আঁকি। আর যার ছবি আঁকি তাকে ছাড়া অন্য কাউকে দেখতে দেইনা। আবার তাকে দেখতে দিলেও ছবিটা নিজের কাছে রেখে দেই।কূজনের বিস্ময়ে অবাক হওয়া চোখজোড়া খুশিতে ঝলমল করে উঠলো তারপর সেই কিউট হাসিটা ঠোঁটে এনে বললো,- আমি কি খুব প্রিয় কেউ?- হুম।- আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো?- অবশ্যই।- এই ইরিন শোন তো তোর সাথে অনেক ইমপর্টেন্ট একটা কথা আছে।কলরব কথা বলতে বলতে ইরিনের রুমের ভিতর চলে এলো। কূজন চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বললো,- আচ্ছা তোমরা কথা বলো আমি আসছি।কূজন চলে যেতেই কলরব অস্হির হয়ে বললো,- ইরিন আমার একদম ভালো লাগছে না। - কেনো কি হলো?- শোন তুই এখনই একটা কল দে কুহুকে। বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবো না।- আচ্ছা দিচ্ছি।ইরিন কলরবের সামনেই কুহুকে কল দিল। প্রথম কল বেজে কেটে গেল কিন্তু কুহু রিসিভ করলো না। কলরব অস্হির হয়ে ইরিনের পাশে বসলো। ইরিন আরেকবার কল দিতেই পিহু ফোন রিসিভ করলো।- হ্যালো আপু তো ওয়াশরুমে তুমি একটু পরে কল করো।- আচ্ছা।ইরিন কান থেকে ফোন সরাতেই কলরব জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ইরিনের দিকে তাকালো। ইরিন বললো,- ভাবি ওয়াশরুমে।- পাঁচ মিনিট পর আবার কল করবি।ইরিন পাঁচ মিনিট পর আবার কল করলো। এবার কুহু রিসিভ করলো।- হ্যালো ইরিন বলো।- আপু আমি না ভুলে গিয়েছি হোম ওয়ার্ক কি ছিল।কুহু ধমক দিতে যেয়েও ধমক দিল না উল্টো ইরিনকে বলে দিল কি কি হোমওয়ার্ক দিয়েছিল। - আচ্ছা আপু আজকে কয়টায় যেন আসবেন পড়াতে?কুহুর এবারো মেজাজ খারাপ হলো কিন্তু মেজাজ ঠান্ডা করে বললো,- সাড়ে তিনটায়।- থেঙ্ক ইউ আপু।ইরিন ফোন রাখতেই কলরব বললো,- কি বললো?- বললো তো সাড়ে তিনটায় আসবে।কলরব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ইরিনের কপালে চুৃমো দিয়ে বললো,- থেঙ্ক ইউ।ইরিন কিছু না বলে শুধু হাসলো।কলরব বেড ছেড়ে উঠতে উঠতে বললো,- অসুস্হ হলে তো আর আসতো না, তাই না?ইরিন অবাক হয়ে কিছুক্ষণ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো তারপর বললো,- অনেক ভালোবাসো তাই না?কলরব কিছু বললো না শুধু হাসলো, সেই ঘর কাঁপানো হাসি।..ইরিন ফোন রাখতেই কুহু মোবাইলটা ছুঁড়ে টেবিলের উপর ফেললো।- কি হলো হঠাৎ রেগে গেলি যে?- ইরিন এতো কেয়ারলেস কীভাবে হতে পারে?- কি করেছে?- হোমওয়ার্ক কি ছিল সেটা ভুলে গিয়েছে এমনকি আমি কখন যাব পড়াতে তাও ভুলে গিয়েছে।পিহু কুহুর কথা শুনে হাসলো তারপর বললো,- তুই যে কিছু বললি না ওকে?- হ্যা ওকে কিছু বলবো আর কলরব আর তুই এসে পরে আমাকে কথা শুনিয়ে যাবি তাইনা?- চিল বেইবি চিল। - চুপ কর।- আরে মাথা ঠান্ডা করে চিন্তা কর। আসলে সে কিছুই ভুলেনি।- তাহলে?- আরে কলরব কল করিয়েছে।- কেনো?- কাল তুই ছাদে যাসনি তাই তোর খবর নিতে।- ওহ্পিহু আর কিছু বললো না, কলেজ ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বললো,- আসছি।পিহু কলেজে যাওয়ার জন্য বের হয়ে রিকশা নিল। কূজন ইরিনের রুম থেকে বেরিয়ে সোজা ছাদে চলে এসেছিল। ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের কিছু ছবি তুলছিল। হঠাৎ রাস্তায় তাকাতেই দেখলো পিহু রিকশায় করে কোথায় যেন যাচ্ছে। কূজন বেশ ভালো করে খেয়াল করলো পিহুকে, যতটুকু করা যায় আরকি। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছে না পিহুকে সে কোথায় দেখেছে। ছবিগুলো আপলোড দিতে ডটা অন করতেই কুহুর মেসেজ দেখে তাড়াতাড়ি সীন করলো।- " আম্মু আল্লাহর রহমতে ভালোই আছে"কূজন মেসেজটা পড়ে ভাবতে লাগলো কুহুকে আর কি লিখা যায়। অনেক ভেবেও খুঁজে বের করতে পারলো না কুহুকে কি লিখলে কুহু তাকে রিপ্লাই দিবে।..দূপুরের খাওয়া শেষেই কূজন আর কলরব আবারো ঘুরতে বের হলো। কূজন বিকেলের দিকে বের হতে চেয়েছিল কিন্তু কলরবের জোরাজুরিতে এখনই বের হতে হলো। কলরব বিকালের মধ্যে বাসায় ফিরে আসতে চায়। শনিবার অফিস নেই তাই বিকেলে ছাদে দাঁড়িয়ে কুহুকে দেখবে যদিও একটু পর কুহু কলরবদের বাসাতেই আসবে। কিন্তু কুহু বাসায় এলে কলরব কুহুর সামনে তেমন একটা যায় না এমনকি দূর থেকেও দেখে না। কলরব জানে দূর থেকেও যদি সে কুহুকে ফলো করে কুহু সেটা বুঝে যাবে। এটা সব মেয়েরাই পারে। আর কুহুকে কলরব মোটেও অস্বস্তিতে ফেলতে চায় না তাই কলরব এই কাজটা করে না। কলরব মনে করে ছাদে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকা ব্যাপারটায় প্রেমিক প্রেমিক ভাব আছে কিন্তু নিজের বাসায় আসা কোনো মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকাটা অনেকটা ক্যারেকটার ঢিলাদের কাজ।কূজনরা বের হওয়ার আধা ঘণ্টা পরই কুহু এলো ইরিনকে পড়াতে। ইরিনকে পড়াতে পড়াতে পাঁচটা বাজলো। হোমওয়ার্ক বুঝিয়ে দিয়ে চলে এলো কুহু। কুহুকে ওদের বাসার গেইট দিয়ে ঢুকতে দেখে কূজন ঢোক গিললো। তারপর বাইক থেকে নামতে নামতে মনে মনে বললো,- মিস্টার রবিন ইবনে হাসনাদ তুই পাগল হয়ে গিয়েছিস। আগে তো চোখ বন্ধ করলে কুহুকে দেখতে পেতি আর এখন রাস্তাঘাটেও কুহুকে দেখা শুরু করে দিয়েছিস।চলবে.................. part 19 missingপর্ব:২০কলরব মায়ের ঘর থেকে বের হয়ে যে ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে বাসায় আর ফিরে যায়নি।এক দৃষ্টিতে কুহুদের ছাদে তাকিয়ে আছে। দেখতে দেখতে সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। মাগরিবের নামজ পড়তে হবে মনে হতেই মসজিদে চলে গেল। নামজ শেষ হতেই কলরব আবার ছাদে চলে এসেছে। জোছনা রাত, আকাশে মেঘও ভাসছে। মেঘ বারবার চাঁদকে ঢেকে দিচ্ছে। কলরবের চাঁদটাকে দেখতে বেশ ভালো লাগছে। শুধু চাঁদ আর মেঘে ঢাকা চাঁদ দুইটার মাঝে কলরব আজ পার্থক্য খুঁজে পেয়েছে। কলরব কখনো প্রকৃতি নিয়ে ভাবেনি, গভীরভাবে পর্যবেক্ষণও করেনি সে। ছোট থেকেই পড়াশুনা আর খেলাধূলা, হই হুল্লোড়, মজা করা এসবই করে এসেছে। প্রকৃতি খুব একটা টানেনি তাকে। কিন্তু আজ খুব ভালো লাগছে চাঁদ দেখতে। হালকা শীত লাগছে কিন্তু বাসায় যেয়ে গরম কাপড় আনতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কুহুকে তো দেখতে পেল না কিন্তু চাঁদকে দেখে তা পুষিয়ে নিচ্ছে। মেঘে ঢাকা চাঁদ যেন কুহুর অন্য এক রূপ। কুহুর চুলগুলো দেখার কলরবের অনেক শখ। ইরিনের কাছে শুনেছে কুহুর চুলগুলো অনেক সুন্দর। মাঝে মাঝে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে কলরবের। কলরব আপন মনেই হাসলো, দেখাই হলো না আর ছুঁয়ে দেখা। ইরিন বলেছিলো সাজলে নাকি কুহুকে অন্যরকম লাগে, অনেক সুন্দর লাগে। কলরব চোখ বন্ধ করে কুহুকে বউ সাজে একবার ভাবতে যেয়েও ভাবলো না। কলরব সরাসরি দেখতে চায় কুহুকে কেমন লাগে, কল্পনার সাথে গুলিয়ে ফেলতে চায় না। কলরবের একটা গান শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব। মোবাইল বের করে গান ছাড়লো। কলরব আবার ইয়ারফোন লাগিয়ে গান শুনে না। কলরব সবসময় জোরেই গান শুনে। নিজের চারপাশটা মাতিয়ে রাখতেই পছন্দ তার।''মনের অবুঝ পাখিস্বপ্ন দুটি নয়নেঅভিসারে যাবে মধু লগনেআকাশ নদী পাহাড় আজইশূণ্য তোরই কারণেঅভিানে পুড়ে ভরা ফাগুণেতুই হয়ে যারে রাধাপিরিতে নাইরে বাধাভালোবাসা রাখিসনে আর গোপনে গোপনেলোকে ভালেবাসা হলো এমনিদিনে দিনে বেড়ে চলে প্রেমের কাহিনীতোরই কারণে তোরই স্মরণেভালো লাগা তুলে দিব চরণে চরণেমাঝে মাঝে দিশেহারা লাগে জীবনেছায়া যদি সরে পরে মিছে স্বপনেতোরই কারণে তোরই বাঁধনেতোরই কারণে তোরই বাঁধনেরয়ে যাব চিরদিন তোর ভুবনে ভুবনেমনের অবুঝ পাখিস্বপ্ন দুটি নয়নেঅভিসারে যাবে মধু লগনেআকাশ নদী পাহাড় আজইশূণ্য তোরই কারণেঅভিমানে পুড়ি ভরা ফাগুণে''গানটা শেষ হতেই ইরিন বলেউঠলো,- ভাইয়া এখন আসল গান শুনবে, এতক্ষন তো নকল টা শুনেছো।কলরব পিছন ফিরে দেখলো ইরিন কূজনের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। - নকল হবে কেনো?ইরিন মাদুরে বসতে বসতে বললো,- বুঝোনি নকল কেনো? প্রথমে একজন গান গাইলো সেটা রেকর্ড হলো তার সেখান থেকে রেডিওতে বা টিভিতে, তারপর তোমার আমার কানে এলো। তিনটায় মিলে নকলই তো।কূজন ইরিনের পাশে বসতে বসতে বললো,- শাপমোচন কি বলো সোনার হরিণ?ইরিন কূজনের কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,- এই ভাইয়াকে আবার বলো না যেন আমি ডায়ালগটা শাপমোচন থেকে নিয়েছি। বই টই পড়ে না বুঝবে না। মনে করবে আমার মাথা থেকে কথাটা বেরিয়েছে।কূজন আস্তে করে বললো,- ওকে সোনার হরিণ।কলরব ওদের সামনে মুখোমুখি বসতে বসতে বললো,- কানে কানে কথা বলে কানু মিয়ার বউ।ইরিন ক্ষেপে গিয়ে বললো,- ভাইয়া!- ডায়ালগ খালি আপনিই মারতে পারেন তাই না???কলরবের কথা শুনে কূজন আর ইরিন হাসতে শুরু করলো।- এই হাসছিস কেনো তোরা?কূজন হাসি থামিয়ে বললো,- ভাই তুমি কি মুভি দেখো না? - কি বলিস প্রচুর দেখি, আমার ড্রেস আপ দেখে বুঝিস না??- পুরাতন, উত্তম সূচিত্রার??- নাহ দেখা হয় না। তুই দেখিস?- না আমি মুভি তেমন একটা দেখি না তবে মা উত্তম সূচিত্রার মুভি দেখে তো তাই সেগুলো আমারো দেখা হয়।- হঠাৎ এ কথা বললি যে??ইরিন আর কূজন আবার হাসলো।কলরব বিরক্ত হয়ে বললো,- তোরা থাক আমি যেয়ে স্নেকস নিয়ে আসি।কলরব উঠে বাসায় এলো। কলরব আসতে দেখলো তার বাবা পত্রিকা হাতে কোথায় যেন যাচ্ছেন।- বাবা কোথায় যাচ্ছো?- ছাদে গান শুনবো।- ওহ্ বাট এখানেও পত্রিকা?- হা হা হা।কলরব রান্না ঘরে যেয়ে মায়ের পাশে দাঁড়ালো তারপর বললো,- ট্রে কোথায় রেখেছো মা?- ওই যে ওই পাশটায় দেখ।কলরব ট্রেতে একে একে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, সমুচা, বিস্কিট, চানাচুর, চা সব উঠিয়ে নিয়ে বললো,- মা আমি এগুলো নিয়ে ছাদে যাচ্ছি তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো।- হুম এখনই আসছি।..কুহু ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে বেণী করছিল। পিহু সেসময় কুহুকে যেয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। কুহু একটু ঢং করে বললো,- মতলবটা কি আপনার???- এখন আমার সাথে তোকে এক জায়গায় যেতে হবে।- এই রাতে কোথায়?পিহু কুহুকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,- আপুণি প্লিজ না করিস না ছাদে যাব।কুহু পিহুর হাত সরিয়ে বললো,- এই রাতে? পাগল নাকি?- আপুণি এমন করিস কেনো? আমি ভয় পাই তাইতো বলছি। তুই তো আর আমার মতো ভয় পাসনা তাহলে সমস্যা কি তোর?- ভূতের এতো মুভি দেখলে ভয় তো পাবিই।- আরে প্লিজ চল না, তুই তো ভূতের মুভি দেখেও ভয় পাস না।- ভূত বলতে কিছু আছে নাকি? ভূতের মুভি দেখলে আমার আরো হাসি পায়।- আর তোর সেই হাসি শুনে আমার তখন আরো বেশি ভয় লাগে।- তাহলে আমাকে নিয়ে দেখিস কেনো?- একা দেখতে সাহস পাইনা।- আচ্ছা হঠাৎ ছাদে যাওয়ার মতলব কেনো হলো? তুই তো বছরে একবারো যাস না, চাঁদ দেখারও শখ নেই তাহলে?- হি হি হি বাস্কেটবল আনতে যাব।- মানে?- হাবলি কলরবের বাস্কেটবল আমাদের ছাদে।বেচারা না নিয়েই চলে গিয়েছে।- তো??- এখন এটা রেখে দিয়ে মজা নিব।- তোর সব ব্যপারে এতো মজা নেওয়া লাগে কেনো?- প্লিজ একবার ঐ কূজনের আইডিতে নক দিতে দিলি না এখন আবার এটা করতে না করিস না যেন।- ওর বাস্কেটবল যা ইচ্ছা হোক।- না না আমি ওটা আনবো। বিকেলে ভুলে গিয়েছিলাম, এখন মনে পড়েছে।- ভাগ ফাজিল মেয়ে।- আপুণি প্লিজ প্লিজ।- কখনো না।পিহু জানে কুহুর পিছনে পড়ে থাকলে খুব সহজেই কুহুকে সে রাজি করিয়ে ফেলতে পারবে। বোনকে খুব ভালোবাসে কুহু। আর কুহু যেই নরম মনের মানুষ পিহু তো জানেই। ঠিক ঠিক রাজিও করিয়ে ফেললো সে কুহুকে। টর্চ নিয়ে ছাদে উঠার সময় কুহুর হাত শক্ত করে ধরে রাখলো পিহু। কুহু বিরক্ত হয়ে বললো,- এমন ভাব করছিস মনে হয় সত্যি ভূত এসে যাবে।- আপুণি নাগরদোলায় তোরও কিন্তু এমন হয়।- আমি ভয় পাই তাই উঠিও না, তুই জোর করে আমাকে উঠাস।- ভয়কে জয় করতে হয় মিস কুহু আরিজা।- মিস পিহু আলিশা দেখো তো তোমার পিছনে কি?পিহু চিৎকার দিয়ে কুহুকে জড়িয়ে ধরলো। কুহু হাসতে শুরু করলো। পিহু বললো,- এটা ঠিক না আপুণি।- আচ্ছা সরি! কিন্তু আমি বলতে চেয়েছিলাম তোর পিছনে রড রাখা সাবধানে দাঁড়া।- ওহ্।কুহু আর পিহু দুজনই টর্চ জ্বেলে পা টিপে টিপে বাস্কেটবলটা খুঁজতে লাগলো হঠাৎ গানের আওয়াজ শুনতে পেল। মনে হচ্ছে পাশের ছাদে। কুহু পিহু ওদের ছাদের পিছন দিকটায় বাস্কেটবল খুঁজছিল সেখান থেকে ছাদের সামনে এগিয়ে এলো। জোছনা রাত টর্চের প্রয়োজন নেই তবুও পিহু টর্চ জ্বালিয়ে রেখেছে। পিহুর মনে হচ্ছে টর্চের আলো নিভালেই পিহুকে আজ কবরে যেতে হবে। সামনের দিকটায় যেতেই গানের সুর স্পষ্ট পিহু কুহুর কানে ভেসে এলো । দুইবোনই থমকে দাঁড়ালো।কলরবদের ছাদে কয়েকজন বসে আছে। কুহু দেখলো কলরবের মা, ইরিন আর আরেকজন ছেলে একসাথে গান গাইছে।''বকুলের মালা শুকাবেরেখে দিব তার সুরভীদিন গিয়ে রাতে লুকাবেমুছো নাকো আমারই ছবিআমি মিনতি করে গেলামতুমি চোখের আড়াল হওকাছে কিবা দূরে রও মনে রেখো আমিও ছিলামএই মন তোমাকে দিলামএই প্রেম তোমাকে দিলামতুমি চোখের আড়াল হওকাছে কিবা দূরে রও মনে রেখো আমিও ছিলামএই মন তোমাকে দিলামএই প্রেম তোমাকে দিলামভালোবেসে আমি বারে বারতোমারি ও মনে হারাবোএ জীবনে আমি যে তোমারমরণেও তোমারি রবোতুমি ভুলো না আমারই নামতুমি চোখের আড়াল হওকাছে কিবা দূরে রওমনে রেখো আমিও ছিলামএই মন তোমাকে দিলামএই প্রেম তোমাকে দিলামতুমি চোখের আড়াল হওকাছে কিবা দূরে রওমনে রেখো আমিও ছিলামএই মন তোমাকে দিলামএই প্রেম তোমাকে দিলাম''কুহু খেয়াল করলো ছেলেটা কূজন। কুহু পিহুকে ফিসফিস করে বললো,- গিটার হাতের ছেলেটা কূজন।- ওহ্ চশমিশটা।কুহু বললো,- তুই কি বাস্কেটবল খুঁজে পেয়েছিস?- না।- আমার ডান পাশেই, পায়ের কাছে।- ভালো চুপচাপ এটা আমাদের সিঁড়ির ওখানে রেখে আয়।- তুই ভয় পাবি না?- না এখানে তো ওরা আছে তাই ভয় পাব না।কুহু বাস্কেটবল সিঁড়িতে রেখে এসে পিহুর পাশে দাঁড়ালো আর সাথে সাথে কলরব কুহুদের ছাদে টর্চ মারলো।চলবে...পর্ব:২১কলরব টর্চ জ্বালানোর সাথে সাথে কুহু বসে গেল আর পিহুকেও হাত টেনে বসালো। কলরব কাওকে দেখতে না পেয়ে টর্চ নিভিয়ে ফেললো। কলরবের বাবা বললেন,- কি ব্যাপার?- না মনে হলো সেখানে কেউ দাঁড়িয়ে ছিল।- থাকলে থাকুক গান শুনতে যে কেউই দাঁড়িয়ে থাকতে পারে।- হুম সমস্যা নেই তো। জাস্ট কৌতূহলের কারণে দেখেছিলাম আরকি।ইরিন বললো,- গান তো শেষ এখন আর কে আসবে?- উহু গান শেষ না।- কে গাইবে তুমি আর বাবা? হা হা হা হি হি হা হা।কলরবের মা বললেনন,- কূজনরে তোর ভাই আর খালুর গান শুনলে তুই আর বেঁচে জাহরার কোলে ফিরতে পারবি না।কূজনও হাসতে লাগলো।ইফতেখার সাহেব বললেন,- মাষ্টারনী তুমি তো টিয়া পাখি আঁকতে বললে কাকের চেহারা বানিয়ে ফেলো। কি বলিস কলরব??? হা হা হা।কলরব তার বাবার কথায় তাল মিলিয়ে বললো,- আর বাস্কেটবল..!ইরিন বললো,- আমি কিন্তু গান, ছবি আঁকা আর বাস্কেটবল সবগুলোই পারি।কূজন বললো,- ওরে আমার সোনার হরিণ!কলরব বললো,- বাস্কেটবল কে শিখিয়েছে তোকে? আমি শিখিয়েছি।- ঘাট হয়েছে আমার।- এই কূজন আমার জন্যে একটা গান গেয়ে শুনাবি তুই, ওদের গাইতে হবে না।- কোন গানটা বলো।- মেরে সামনে বালি খিড়কিমে ঐটা আছে না পারিস?- হুম।- শুরু কর।কূজন একাই শুরু করলো,'' মেরে সামনে বালি খিড়কি মেএক চান্দকা টুকরা রেহতা হেআফসোস হে কি বো হামসে কুছ উখরা উখরা রেহতা হে"কলরব উঠে দাঁড়ালো। আস্তে আস্তে ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালো তারপর মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে কুহুদের ছাদের দিকে ধরলো। কুহু আর পিহু রেলিং ঘেঁষে বসে গান শুনছিলো। কলরব হেসে বললো,- ফ্রেঞ্চ ফ্রাই???পিহু বললো,- অবশ্যই।পিহু কথাটা বলে জ্বিব কামড়ে ধরলো আর কুহু পিহুকে পা দিয়ে লাথি দিলো।কলরব ফিরে এসে বাটিতে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর বিস্কিট নিলো। তারপর উঠে আসতেই ইফতেখার সাহেব বললেন,- কোথায় যাচ্ছিস?- পাশের ছাদে দুইজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গান শুনছিলো। - ওহ্ বলে কলরবের বাবা পিছন ফিরে তাকালো।- কই কাউকে দেখতে পাচ্ছি না যে?- ওরা বসে আছে রেলিং ঘেঁষে তাই।ইরিন বললো,- কারা ভাইয়া?- তোর টিচার আর ওর বোন।- কুহু আপু???কূজন তখন চোখ বন্ধ করে গান গাইছিলো,'' জিস রোজ সে দেখা হে উসকোহাম শামা জ্বালানা ভুল গায়েদিল থামকে অ্যায়সে বেঠে হেকাহি আনা জানা ভুল গায়েআব আঠ পেহের ইন আখোমে বো চাঞ্চাল মুখরা রেহতা হেমেরে সামনে বালি খিড়কি মে এক চান্দকা টুকরা রেহতা হে "কুহুর কথা শুনে কূজন চোখ খুললো। কূজনের এখন ছাদ থেকে লাফ দিয়ে মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। কুহু কি ওর পিছু ছাড়বে না? কূজন দেখতে পেলো কলরব রেলিং এর কাছে যেয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে কি যেন বলছে।- ফুলটুশী উঠে দাঁড়াও।কুহু দাঁত কিড়মিড় করে উঠে দাঁড়ালো আর পিহুর দিকে রাগে কটমট করে চাইলো।পিহু ঢোক গিলতে গিলতে উঠে দাঁড়ালো আর বললো,- আপুণি তুই কি আমাকে বাসায় যেয়ে মারবি??কুহুর রাগে কান্না চলে আসছে চোখ দিয়ে। পিহুর কি খুব দরকার ছিল কলরবের সামনে এই কথাটা বলার? সে কি এতোটাই রাগী নাকি??কলরব পিহুর দিকে বাটিটা ধরে বললো,- নাও। আর তুমি করেই বলি হ্যা??পিহুর তখন কলরবের কথা কানে যাচ্ছে না সে আছে নিজের চিন্তায়। একে তো তার জন্যই কুহুকে ছাদে আসতে হয়েছে আর এখন সে কি বললো। কলরব বাটি থেকে একটা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই পিহুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,- নাও তোমার আপু কিছু বলবে না।পিহু এমনিতেও কোথাও গেলে কুহু না বলা পর্যন্ত কিছু খায় না আর কলরবের হাত থেকে তো কখনোই কিছু নিবে না। কলরব এবার কুহুর দিকে বাড়িয়ে ধরলো। কুহুও নিলো না। কলরব এবার বললো,- কুহু নাও মা বানিয়েছে।কুহু রাগে ফুসতে লাগলো।ইফতেখার সাহেব কলরবের পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,- আরে নিচ্ছো না কেনো? মামণিরা নিয়ে নাও।প্রতিবেশীর হক আছে তো।কুহু এবার একটু হাসলো। তারপর বললো,- না আঙ্কেল থেঙ্ক ইউ। আমরা মাত্র চা খেয়ে এসেছি।কলরব বললো,- পিহু তুমি অন্তত নাও।- না ভাইয়া থেঙ্ক ইউ।কলরবের বাবা বললেন,- আরে নাও তো এই কলরব ওর হাতে দে।পিহু কুহুর দিকে তাকালো।কুহু রাগে পিহুর দিকে তাকাচ্ছেই না।- নাও ধরো।পিহু কলরবের হাত থেকে একটা নিল। কলরব কুহুকে দিতেই কুহু বললো,- না না আঙ্কেল আমি খাবো না।- আরে নাও আমি বলছি নয়তো কিন্তু রাগ করবো।কলরব সাথে সাথে হাতে একটা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই উঠিয়ে কুহুকে দিল। কুহু চুপচাপ নিল কিন্তু নেওয়ার সময় খেয়াল করলো কলরব কুহুকে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই দেওয়ার সময় হাত দিয়ে একটুখানি ভেঙে রাখলো। কলরব বাটিটা পিহুর হাতে দিয়ে বললো,- নাও তোমার আপু কিছু বলবে না।কলরব কথাটা বলেই চলে এলো। কলরব হাতে থাকা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এর একটুখানি অংশ হাসতে হাসতে খেয়ে মাদুরে বসলো। কূজন ভালো করে তাকিয়ে তাকিয়ে এতোক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে বুঝলো কলরব আর আঙ্কেলকুহু আর সেদিন ছাদে দেখা মেয়েটার সাথে কথা বলছিলো। কূজন চশমাটা খুলে পরিস্কার করলো তারপর চোখে দিয়ে আবার দেখলো। এরপরো বিশ্বাস করতে পারছে না যে সে কুহুকে দেখছে। তাই ইরিনকে বললো,- কলরব ভাই আর আঙ্কেল কাদের সাথে কথা বলছিলেন এতক্ষণ?- কুহু আপু আর পিহু আপুর সাথে।কূজন অবাক হয়ে বললো,- ওহ্ ওরাই কি তোমার টিচার?- না কুহু আপু আমার টিচার আর পিহু আপু কুহু আপুর বোন।চলবে...পর্ব:২২কুহু নীচে নামতে নামতে পিহুর পিঠে এলোপাথাড়ি মারতে লাগলো। - আপুণি সরি সরি।- এই এভাবে তো কোনোদিন কারো সাথে কথা বলিস না কিন্তু খাবারের নাম নিতেই অবশ্যই।- আপুণি সরি।- কিসের সরি হ্যা?- এই আমার উপর দোষ দিচ্ছিস কেনো?- তো কার উপর দিব??- তোর রাক্ষসী হাসির কারণেই কিন্তু বুঝেছে যে কেউ দাঁড়িয়ে।কুহু এবার দমে গেল। কিছুক্ষণ ভেবে তারপর আবার বললো,- হাসিটা কেনো উঠেছিলো??? কার জন্য উঠেছিলো? কে ছাদে আমাকে নিয়ে এসেছিল?- আমি কিন্তু সরি। বাট আমি না নিয়ে এলে এতো সুন্দর গান কীভাবে শুনতি?- তা ঠিক ওরা অনেক সুন্দর গান গায়।- আচ্ছা কূজন কি ওদের রিলেটিভ?- মনে হয়।- তবে টিয়া পাখি আর কাকের বিষয়টা জোস ছিল।- হা হা হা।- আবার রাক্ষসী হাসি...- সরি সরি। তোর বাস্কেটবল এনেছিস??- এই তো।..কূজন ডিনার শেষে মোবাইল হাতে অনেকটা সময় বসে ভাবলো কুহুকে সে কি মেসেজ পাঠাবে। অনেক ভেবে লিখলো,"জোছনায় নাকি মানুষ অনেক ভুলভাল দেখে। আমিও কি তেমন কিছুই দেখেছি? চোখের চাহনীতে হঠাৎ আপনি ভেসে উঠলেন কেনো কুহু??কূজন মেসেজ সেন্ড করে কলরবের সাথে আড্ডায় মেতে উঠলো। কলরবের কথা শুনে হাসতে হাসতে কূজনের অবস্হা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।..কুহু ঘুমানোর জন্য বেডে শুতেই আবার গান শোনার ইচ্ছা জাগলো কুহুর। তাই মোবাইল নিয়ে গান ছেড়ে এফবিতে লগইন করলো।কূজনের মেসেজ দদেখে কুহু সিন করলো। কুহু মেসেজ পড়ে অভিভূত হয়ে থাকলো কতক্ষণ তারপর পিহুকে বললো,- পিহু কূজন যেমন সুন্দর গান গায় তেমন সুন্দর মেসেজও পাঠায়।- আরে সুন্দর মেসেজ পাঠানোর জন্য বই আছে না কিছু ঐ যে আমাদের বাসায়ই তো আছে ঐগুলোর মতো কোনো বই থেকে বা গুগোল থেকে নিয়ে তোকে পাঠিয়েছে।- আরে না তেমন না। তোকে শোনাচ্ছি।পিহু সবটা শুনে বললো,- কূজন তো কবিতাও লিখে তাই একটু ভাবিস্টভাবে লিখেছে আরকি।- দেখলি তো এখন ঠিকই পল্টি মারলি।- তুই রিপ্লাই কি দিয়েছিস?- আমি লিখেছি," আপনি এখানে যে? "- কি রিপ্লাই দিল?- এখনো দেয়নি।- দিলে বলিস তো।- অবশ্যই।- হা হা হা।..কূজন ভাবতে পারেনি কুহু এতো তাড়াতাড়ি রিপ্লাই দিবে। কলরবের সাথে আড্ডা শেষে কূজন এমনিতেই মেসেঞ্জারে মেসেজ চেক করছিলো। কুহুর লিখা তিন শব্দ পড়ে কূজনের সারাটা দিনই যেন স্বার্থক মনে হলো। কলরব তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। কূজনের আবার চোখে প্রবলেম হয় তাই আলো নিভিয়ে মোবাইল ইউজ করে না। কলরব ঘুমোচ্ছে তাই লাইটও অন করছে না পাছে আবার কলরবের প্রবলেম হয়। কূজন এতো রাতে চশমা পড়ে শুয়ে শুয়ে টাইপ করছে। শিউর একটু পর চোখ জ্বালা শুরু করে দিবে। তারপরো কুহুর মেসেজ এর রিপ্লাই করছে তাও খুব ভেবে চিন্তে লিখছে সে। কূজন চোখ বন্ধ করেই পাঁচ ছয় মিনিটের মধ্যে আস্ত কবিতা লিখে ফেলতে পারে আর সামান্য মেসেজ শুধু কুহুর জন্য তাই এতোটা সময় নিয়ে ভেবে লিখছে।" একটুখানি দেখা তো আজ হয়েই গেল বাকিটা না হয় দিনের আলোতে খুঁজে নিবেন।"কুহু বেশ ইমপ্রেসড কূজনের মেসেজ দেখে। তবে পিহু পুরাই বিরক্ত।- সোজা সাপ্টা কথা এতো ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে ঢং করে বলার কি আছে?? অটিস্টিক!- এই কতো সুন্দর গুছিয়ে কথা বলেন আর তুই যা তা বলছিস।- অদ্ভুত।- হ্যা তা একটুখানি।- আমি তোমার কথা বলছি মিস কুহু আরিজা, তুমি অদ্ভুত।- আমি আবার কি করলাম?- এই যে এই ছেলের সাথে চেটিং করছিস মোটেও সুবিধার মনে হচ্ছে না আমার আর তাও এই পাগলা ছাগলার কথা পড়ে ফিদা হয়ে যাচ্ছিস।- ফিদা হতে যাব কেনো? - আচ্ছা এটা কোনো কথা? জিজ্ঞাসা করেছিস এখানে কীভাবে? বললেই হয় উনি বেড়াতে এসেছেন অর সামথিং। না মশাই বলেছেন দিনের আলোতে খুঁজে বের করতে।- কাব্যিক আরকি।- পাগল! পাগল!- তুই প্রতিবন্ধী।- ইশ আপনি তো এই পোলার মেসেজে পটে যাচ্ছেন। পটবি তো পটবি গান শুনে পট কতো সুন্দর কণ্ঠ না আজাইরা অটিস্টিক মার্কা মেসেজ পড়ে আকাশে বাতাসে উড়বেন তিনি।- মোটেও না।- অবশ্যই।- হি হি হি।কুহু পিহু কথা বলতে বলতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে তার খবরই নেই। অন্যদিকে কূজন মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে একটানা তাকিয়ে রিপ্লাই পাওয়ার অপেক্ষা করতেই লাগলো। মাঝে চোখে জ্বালা শুরু করাতে ওয়াশরুমে যেয়ে চোখে পানির ঝাপটা দিয়ে এসেছে। তারপর বিছানায় শুয়েই আবার মোবাইল হাতে অপেক্ষা করতে লাগলো। ফজরের দিকে চোখ লেগে এলো কূজনের। তখনই কলরব নামাজ পড়তে উঠলো। ফ্রেশ হয়ে কূজনকে ডাকলো। কূজন ঘুমঘুম কণ্ঠে বললো,- মাত্র ঘুমিয়েছে পরে কাজা পড়ে নিবে।কলরব আর কিছু বললো না। কলরব মনে করছে কূজনের বোধহয় এসি ছাড়া থাকতে কষ্ট হচ্ছে তাই বোধহয় ঘুমাতে পারেনি। পরক্ষণেই আবার মনে হলো না এখন হালকা শীত পড়েছে। ঠিক শীতও না ঠান্ডা একটা আবহাওয়া। তাই গরম নিয়ে সমস্যা নেই।কলরব মসজিদ থেকে বের হয়ে ফাঁকা রাস্তায় হাঁটতে লাগলো। কলরব ভেবেছিল কুহুর সাথে বুঝি আবার এক সপ্তাহ পর সরাসরি দেখা হবে বা কথা হবে। কিন্তু আজই হয়ে গেল। কলরব আল্লাহকে মনে মনে হাজারবার ধন্যবাদ জানাতে লাগলো আর ভাবতে লাগলো মানুষ একটুখানি সুখের পিছনে ছুটে হুচট খেলে ভাবে সব শেষ কিন্তু সৃষ্টিকর্তা একটুখানি নয় সবটুকু সুখ কুঁড়িয়ে পাওয়ার জন্যই রাস্তা দেখিয়ে দেয়।চলবে...পর্ব:২৩কুহু সকালবেলা ঘুম থেকে উঠতেই মনে পড়লো কূজনের মেসেজের রিপ্লাই না দিয়েই সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ইশ কূজন ওর সম্পর্কে না জানি কি ভাবছে ভেবেই কুহু মেসেজ পাঠিয়েই রেডি হয়ে কলেজে চলে গেল। কলেজে আজ এসাইনমেন্ট জমা দিবে। এমনিতে তেমন একটা যাওয়া লাগে না। কিন্তু যে কারণে কলেজে গেল সে কাজের কিছুই হলো না। এসাইনমেন্ট যে ফাইলে রেখেছিল সে ফাইল নিতেই ভুলে গেল কুহু। এসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার লাস্ট ডেইট আগামীকাল। কুহুর এসাইনমেন্ট আগেই কমপ্লিট তাই ভেবেছিল আজই দিবে কিন্তু দেওয়া হলো না। কাল ঠিকই আবার কুহুকে আসতে হবে। কুহুর কলেজে ক্লাস করতে ভালো লাগে না তাই ভাবলো বাসায় চলে যাবে। কিন্তু গেইট থেকে তো আর বের হতে দিবে না। দারোয়ানগুলো প্রিন্সিপালেরও আব্বা। কুহু তাই কলেজের অ্যাপ্রোনটা খুলে ব্যাগে নিয়ে নিলো। এখন আর দারোয়ান কুহুকে আটকাবে না। ভাববে হোস্টেলের মেয়ে। কুহুকে বোরকা পড়া দেখে ঠিক ঠিক দারোয়ান ওকে আর বাধা দেয়নি। কুহু গেইট থেকে বের হয়েই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে যখন রিকশা পেল না তখন সামনের দিকে হাঁটা শুরু করলো। একটুখানি এগিয়ে যেতেই একটা রিকশা পেল। রিকশাওয়ালা ডাবল দাম চাইলো তাই কুহু রিকশাটা না নিয়েই সামনের দিকে হাঁটা ধরলো। আজকালকার রিকশাওয়ালারা নিজেদের পাইলট মনে করে। কুহুর ইচ্ছে করছিল দুই একটা কথা শুনিয়ে দিতে কিন্তু এনার্জি নষ্ট করতে চাইলো না। আরো একটুখানি এগুতেই সেই রিকশাওয়ালাটাই বললো,- আফা উডেন।- আপনার উড়োজাহাজের ডাবল ভাড়া আমি দিতে পারবো না।- যা ভাড়া তাই দিয়েন।কুহু রিকশায় উঠলো। রিকশা চলতে শুরু করতেই হঠাৎ কুহুর মনে হলো কলরবকে বাইকে করে কোথাও যেতে দেখলো। কুহু পিছন দিকে ফিরে আবার দেখলো। ছেলেটা কলরবই ছিল । কুহুর কেনো যেন মনে হলো কলরবই রিকশাটা ঠিক করে দিয়েছে। কুহুর হঠাৎ বুকের ভিতর ধুকপুক ধুকপুক শুরু হলো। কলরবকে ফিল করে না ভয় পেয়ে। কুহুর এমনিতেই খুব পিপাসা পেয়েছিল কলরবকে কলেজের সামনে দেখে এখন মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে পানি না পেলে প্রাণটাই বোধহয় যাবে। কুহু আবার সাথে পানি রাখে না তাই পিপাসা বাড়তেই লাগলো। কলরব কি কুহুকে এখন ফলো করে? কুহু যেখানে যায় সেখানেই কি কলরব যায়? কলরব কুহুকে পাহাড়া দেয়? কথাগুলো ভাবতেই কুহু ঢোক গিলতে লাগলো। রিকশা বাসার সামনে আসতেই কুহু তাড়াতাড়ি রিকশা থেকে নেমে রিকশাচালককে টাকা দিল। কুহু ভেবেছিল টাকাটা রিকশাওয়ালা নিবে না কিন্তু ঠিকই নিলো। কুহু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। যাক কলরব তাহলে রিকশা ঠিক করে দেয়নি। রিকশা ঠিক করে দিলে নিশ্চয় ভাড়াটাও মিটিয়ে দিতো।কুহু বাসায় যেয়ে পিহুকে পেলো।- কিরে তুই বাসায় যে?- শরীরটা ভালো লাগছিলো না তাই যাইনি।- জ্বর নাকি?- আরে না মাথা ব্যাথা করছিলো।- এখন করছে না?- না এখন আর নেই।- আচ্ছা তুই এতো তাড়াতাড়ি চলে এলি যে?- আরে বলিস না এসাইনমেন্ট নিতে ভুলে গিয়েছি।- ওহ্।কুহু পিহুর পাশে বসে কলেজ থেকে ফেরার কাহিনী বলতে লাগলো। পিহু সব শুনে বললো,- রিকশাটা কলরবই ঠিক করে দিয়েছে।- না কলরব তাহলে ভাড়া মিটিয়ে দিতো।- জ্বি না এই পোলা আগুনের গোলা। সে এতো কাঁচা কাজ করে না। - মানে?- সে জানে ভাড়া মিটিয়ে দিলে তুই কাজটা পছন্দ করবি না তাই ভাড়া দেয়নি।- এটা কোনো যুক্তি হলো?- দেখ রিকশাওয়ালা হঠাৎ কেনো তোকে তোর বলা দামে রিকশায় উঠালো?- কেনো?- হাবলি কলরব অর্ধেক ভাড়া মিটিয়ে দিয়েছে।- কি বলিস এইটুকু রাস্তা পঞ্চাশ টাকা? বেশি হলে ত্রিশ টাকা দেওয়া যায়।- তোর যাতে হাঁটতে না হয় তাই দিয়ে দিলো আরকি।কুহু কতক্ষণ ভেবে বললো,- আমি এতো বোকা কেনোরে পিহু?- আরে এতোটাও বোকা না।- আরে না অনেক বোকা।আর শুন কলরব কি আমাকে ফলো করে? আমার অনেক ভয় করছে। এই ছেলে তো সুবিধার না।- ফলো করতেও পারে নাও করতে পারে।- যদি করে তাহলে ব্যাপারটা কি বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে বল তো।- হুম তা ঠিক এসব মোটেও ভালো লাগে না।..কুহু ইরিনকে পড়া দিয়ে বসে বসে চা খাচ্ছে। ইরিন পড়াটা শেষ করেই লিখে ফেললো। কুহু খাতা দেখতে দেখতে বললো,- ইরিন তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি?- জ্বি আপু।- তুমি তো অনেক ভালো আর্ট পারো। আমার একটা ছবি এঁকে দিতে পারবে?- আপু আপনার ছবি আমি অলরেডি এঁকে রেখেছি চাইলে দেখাতে পারি কিন্তু একেবারে দিয়ে দিতে পারবো না।- আচ্ছা ঠিক আছে আরেকদিন দেখবো আজ একটু তাড়া আছে।- আচ্ছা আপু।কুহু ইরিনের রুম থেকে বের হয়েই দেখলো কূজন ড্রয়িং রুমে বসে আছে। সেন্টার টেবিলের উপর রাখা পেপারওয়েটটা ঘুরাচ্ছে আর খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। পেপারওয়েট থামতেই আবার ঘুরিয়ে দিচ্ছে। কুহু কিছুক্ষণ এটা দেখে চলে এলো।কুহু চলে যেতেই কূজন পেপারওয়েটটা চেপে ধরে থামিয়ে দিল। তারপর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। কুহু থাকাকালীন অবস্হায় ইচ্ছে করে কূজন এই কাজটা করেছে। কুহুর দিকে একবার তাকালে কূজন আর চোখ সরাতে পারবে না, ড্যাবড্যাব করে তাকিয়েই থাকবে তাই কুহুর থেকে মনোযোগ সরাতে পেপারওয়েট নিয়ে বাচ্চাদের মতো খেলতে শুরু করলো। আল্লাহ জানে কুহু ওকে কি রকম পাগল ভাবছে। না পাগল ভাবছে না কিন্তু অটিজমে আক্রান্ত ভাবছে নিশ্চয়। কূজন আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে ইরিনের রুমের সামনে যেয়ে নক করলো।ইরিন বললো,- কূজন ভাইয়া এসো।- কি করছিলে?- রেস্ট নিচ্ছিলাম মাত্র ছুটি পেয়েছি তো তাই।- এই এক ঘণ্টার পড়ায় তোমার ব্রেক নিতে হয়?- কুহু আপু যতক্ষণ থাকে আমি ভয়ে ভয়ে থাকি তাই আমার স্নায়ুকোষগুলোর রেস্টের খুব প্রয়োজন হয়। হা হা হা।- তোমার টিচার কি এতোই স্ট্রিক্ট? - হ্যা আগে তো বকাও দিতো।- এখন দেয় না?- না ভাইয়ার ধুলাই শুনে আর দেয় না।- ধুলাই মানে?ইরিন কূজনকে সেদিনের ঘটনাটা পুরোটা বললো।কূজন ইরিনের কাছে সবটা শুনে হাসতে হাসতে বললো,- আরে আমি যেই ফাঁকিবাজ ছিলাম এমন টিচার থাকলে ভালোই হতো। তাহলে আর এতো টাকা খরচ করে প্রাইভেটে পড়তে হতো না।- আরে তোমাদের কি টাকার অভাব আছে নাকি?- তারপরো সরকারিতে চান্স পাওয়াটা ক্রেডিট নেওয়ার বিষয়। চান্স পাবো কীভাবে পড়ার টেবিলে বসে হাবিজাবি চিন্তা করে কাটিয়ে দিতাম। একবার হোম টিউটর অঙ্ক করতে দিয়েছিলেন আমি অঙ্ক খাতায় কবিতার লাইন লিখে ভরিয়ে রেখেছিলাম। টিউটর তো এটা দেখে আমাকে কি বকাটাই না দিলেন। তারপর স্কেল নিলেন মারার জন্যে। বাবা সেদিন বাসায় ছিলেন। বাবা এটা দেখে টিউটরকে সেদিনই বিদেয় করে দিয়েছিলেন। - তোমাকে কি টিচার মেরেছিলেন?- আরে না জাস্ট স্কেল হাতে নিয়েছিলেন।- আঙ্কেল তো তাহলে অনেক আদর করেন তোমায়।- হুম অনেক। এরপর থেকে বাবা সব টিচারকে শর্ত দিয়ে রাখতেন যে আমাকে মারা যাবে না এমনকি বকাও যাবে না। আর এজন্যেই পড়াশুনা লাটে উঠেছিলো আমার।- আঙ্কেল অনেক ভালোবাসে তোমাকে।- হুম কিন্তু তাই তো বাবাকে কোনোদিন কষ্ট দিতে চাই না। বাবা যদি জানে আমি তোমাদের এখানে তাহলে অনেক কষ্ট পাবে।চলবে...পর্ব:২৪কলরব তো বাসায় থাকে না, সকাল নয়টার দিকে অফিসে চলে যায় আর আসে সন্ধ্যার পর। ইরিনও নিজের পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কূজনের সময় কাটে না বললেই হয়। বাসায় যেমন একা এখানেও সারাদিন একাই থাকতে হয় তবে সন্ধ্যার পর বেশ ফূর্তিতে থাকে। কূজন সারাদিন প্রায় শুয়ে বসেই কাটিয়ে দেয়। সে এই সময়টুকু বেশ কাজে লাগিয়েছে। ডায়েরীতে কবিতা লিখে ভরিয়ে ফেলেছে। সবগুলো কবিতাই কুহুকে নিয়ে লিখা। কুহু যদি জানতো কুহুকে নিয়ে কেউ একজন কবিতা লিখে তাহলে কুহুর বেশ ভালো লাগতো। কুহু তো এমনিতেই কবিতা খুব পছন্দ করে, আবৃতিও করে। স্কুল, কলেজে সবসময় আবৃতিতে পুরস্কারজয়ী। কূজন তো আর কুহুর কবিতার প্রতি এতো অাগ্রহের কথা জানে না। জানলে হয়তো কবিতাগুলো কুহুকে দিলেও দিতো। কূজন যে কুহুকে পছন্দ করে কূজন এটা শতভাগ শিউর এমনকি ভালোবাসে। প্রতি রাতে যে সবাই মিলে ছাদে গানের আসর বসায় সেখানের প্রতিটি গান কূজন কুহুর জন্যেই গায়। গান গাইতে গাইতে ভাবে হয়তো কুহু পাশের ছাদে দাঁড়িয়েই শুনছে। কিন্তু সেদিনের পর কুহুকে বা কুহুর বোনকে সে রাতের বেলায় ছাদে আসতে দেখেনি। পিহুকে সেদিন কেনো এতো চেনা চেনা লাগছিলো সেটা কূজনবুঝতে পেরেছে। দুই বোনের চেহারায় অনেক মিল। দুইজন যে বোন দেখলেই বোঝা যায় যদিও পিহু মহাসুন্দরীদের দলে পড়ে। কূজন প্রায় বিকেলে ছাদেও যায়, কুহুকে দেখে ছাদে আসতে কিন্তু কোনোদিন কথা বলে না, ডাকও দেয়না। একদিন অবশ্য ইরিনকে পড়াতে যখন বাসায় এসেছিলো তখন কথা হয়েছিল। কথা বলতে ঐটুকুই কুহুর মা কেমন আছে? কূজন এখানে কেনো? ওরা কি রিলেটিভ? কুহু কোথায় পড়ে? এসব কথাই হয়েছে। ইরিন আর ইরিনের মা শুনে বেশ অবাক হয়েছিল যে কুহু আর কূজন পূর্বপরিচিত। কুহু প্রতিদিনই ছাদে যায় কিন্তু শনি,রবিতে যায় পিহু। কূজন এই বিষয়টা খেয়াল করেছে। এটা নিয়ে অনেক ভেবেছেও। কারণ খুঁজে পেয়েছে কূজন। কূজন ধারণা করে নিয়েছে পিহু আর কলরবের মাঝে কিছু একটা আছে নয়তো কলরব ছাদে যাওয়ার দিনগুলোতেই কেনো কুহুর বদলে পিহু কাপড় নিতে ছাদে আসে। তবে পিহু এসে কাপড় নিয়েই চলে যায় কোনোদিন কথা বলে না, কলরবও বলে না। কলরবের সাথে কূজনও থাকে তাই হয়তো ওরা কথা বলতে পারে না এজন্য যেদিন কলরব ছাদে যায় সেদিন কূজন ছাদে যায় না। একবার ভেবেওছিল কলরবকে কিছু জিজ্ঞাসা করবে কিনা। তারপর আর এই সম্পর্কে কথা বলেনি। কলরব বলার হলে ওকে নিজ থেকেই বলতো। তাছাড়া কারো ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে টানাহেঁচড়া করা কূজনের কাছে অপছন্দনীয়। কূজন অনেকদিন ধরে ভাবছে ভালোবাসার কথা কুহুকে জানিয়ে দিবে কিন্তু ভেবে পাচ্ছেনা কীভাবে। মেসেঞ্জারে? কিন্তু কুহু মেসেজ পাঠালে রিপ্লাই দিতে অনেক দেরি করে, মনে হয় যেন না পারতে খুব ভেবে চিন্তে রিপ্লাই দেয়। কূজনের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ওর বাবা কিন্তু বাবাকে কি আদৌ কূজন এমন কথা বলতে পারবে? এটা কি বলা সম্ভব? বাবা কখনোই মাইন্ড করবে না কিন্তু কূজনের অস্বস্তি বোধ হবে। কূজনের এখন আফসোস হচ্ছে কেনো তার এতো বন্ধুবান্ধব নেই। থাকলে আজ এমন কথাগুলো শেয়ার করতে পারতো। দুই একজন যারা ফ্রেন্ড আছে তারা সেরকম ঘনিষ্ঠ না তারপরো শেয়ার করতেই পারে। এটা তেমন অস্বাভাবিক কোনো বিষয় না কিন্তু কূজন কারো সাথে সহজে কিছু শেয়ার করতে পারে না। নিজের দুঃখগুলোও না, ফিলিংসও না। তবে নিজের সুখটুকু মানুষকে উজাড় করে বিলিয়ে দেয়। ছোট একটা মধুর স্মৃতি সবাইকে হাজারবার বলে বেড়ায় কিন্তু মরে গেলেও নিজের কষ্টের কথাগুলো বলে না। ইরিনকে আবার কূজনের খুব ভালো লাগে, ওর সাথে কেনো যেন সব কথা বলতে ইচ্ছে হয় কিন্তু ও তো ছোট তাই সব শেয়ার করতে পারে না। বাবার পর বোধহয় ইরিনকেই কূজন এতো ভালোবাসে। ইরিনের মতো ছোট একটা বোন পেয়ে কূজনের নিজেকে খুব লাকি মনে হয় আবার আফসোসও হয় ইরিন যদি ওর আপন বোন হতো, তাহলে কতো ভালো হতো। সবসময় ইরিনকে নিজের সাথে রাখতে পারতো। বাবার যদি ইরিনদের ফ্যামিলির প্রতি রাগ না থাকতো কূজন তাহলে এই কাজটাই করতো। ইরিনকে নিজেদের বাসায় নিয়ে যেতো। বাবা যে কেনো এতো বছর আগের একটা বিষয় নিয়ে পড়ে আছে কূজন তা বুঝে উঠতে পারে না। বাবা তো কোনোদিন বুঝিয়ে বলেনি তাহলে কূজন বুঝবে কি করে? আচ্ছা বাবা যদি জেনে যায় খুব রাগ করবে, এটা কি সে ঠিক করছে? বাবাকে না জানিয়ে এখানে থাকছে। বাবা তো জানে ফাইনাল এক্সাম শেষ তাই বন্ধুদের সাথে ট্যুরে গিয়েছে। বাবার সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে কূজনের। মোবাইল চার্জে দিয়ে রেখেছিল। চার্জ দেওয়া বন্ধ করে কূজন হাসনাদ সাহেবকে কল দেয়।- হ্যালো! কূজন কেমন আছো?- ভালো বাবা। তুমি কেমন আছো?- আমিও ভালো। কেমন হচ্ছে ট্যুর?- ভালো খুব ভালো।- এজন্যই তো বলি বাবা মাকে এখন সপ্তাহ পার হলে কল দেওয়া হয় তাইনা?- না বাবা মায়ের সাথে কথা হয়, মা প্রতিদিন ফোন করে।- আমিও চাই করতে কিন্তু করি না কারণ বন্ধুদের সাথে মজা করতে গিয়েছো তাই তোমার টাইম ওয়েস্ট করি না।- না বাবা সমস্যা নেই।- তোমার রেজাল্ট কখন দিবে?- সামনের মাসের তেরো তারিখ।- রেজাল্ট নিয়ে টেনশন করবে না। রেজাল্ট যাই হোক তাতে তোমার কিছু যায় আসে না।- বাবা তুমি যদি এমন না হয়ে কড়া হতে তাহলে আমিও খুব ভালো রেজাল্ট করতাম।- তুমি কি কখনো বাজে রেজাল্ট করেছো? কখনো ফেইল করেছো?- না তা করিনি কিন্তু খুব একটা ভালোও করিনি।- তোমাকে তো বাইরে পড়াতে চেয়েছিলাম তুমিই বললে আমাদের ছেড়ে কোথাও যাবে না, দেশেই থাকবে।- তোমাদের ছেড়ে বাইরে যেয়ে পড়ে থাকতে পারবো না।- তুমি যেভাবেই চাইবে সেভাবেই সব হবে। আফটার অল আমার প্রিন্স বলে কথা।- হুম প্রিন্স।- পড়া তো শেষের দিকে চাকরী করবে নাকি আমার ব্যবসায় যোগ দিবে?- ব্যবসা করারই ইচ্ছে।- আমিও মনে প্রাণে এটাই চাইছিলাম।- তুমি খুশি হলেই আমি খুশি।- আমাকে খুশি করার জন্য আবার নিজের ইচ্ছা দমিয়ে রাখোনি তো? - না এটা আমার নিজের মতামত, তোমাকে খুশি করার জন্যে নয় বাবা।- দেখো কিন্তু আমার জন্যে নিজের উপর কিছু চাপিয়ে নিবে না।- তুমি অনেক বেশি ভালো বাবা।- এতোটাও ভালো না তবে বাবা হিসেবে খুব ভালো। হা হা হা।- আচ্ছা বাবা একটা কথা বলি?- বলো।- তোমার আত্মসম্মান খুব বেশি তাই না?- হঠাৎ?- না থাক এমনিতেই বললাম আরকি। তুমি কি এখন অফিসে?- হুম মিটিং করছিলাম।- ওহ্ শিট বাবা তুমি সবসময় এমন করো কেনো?- কি করি?- তুমি বলবে না তোমার জরুরি মিটিং চলছে।- তুমি আর তোমার মায়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে আর কিছুই না।- ওহো বাবা আমি ফোন রাখছি পরে কথা বলবো।- আমার বেশ ভালো লাগছে ফোন কেটো না।- না বাবা অফিস আওয়ারে আর বেশি কথা বলবো না, রাতে আবার কল দিব।- এই যে তুমি কিন্তু বেশ কড়া ছেলে। - হা হা হা।- তুমি শব্দ করে হাসা শুরু করলে কবে থেকে?কূজন কলরবের সাথে থেকে থেকে এই অভ্যাস বানিয়ে নিয়েছি। বাবাকে তো আর এটা বলা যাবে না তাই বললো,- তুমি যাতে বুঝতে পারো আমি হাসছি তাই এভাবে হাসলাম আরকি।- তাহলে ভিডিও কল দেই?- না না এখন রাখছি পরে কথা হবে।কল কেটেই কূজন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ভিডিও কল দিলে তো বাবা সন্দেহ করতো তাই তাড়াতাড়ি কল রেখে দিলো। কয়দিন যে এভাবে লুকিয়ে থাকবে আল্লাহই জানে। আর খালামণিরাও যেতে দেয় না কূজন দুই নৌকায় পা দিয়ে আতঙ্কে আছে এখন, অনেকটা শাখের করাত।চলবে...পর্ব:২৫,২৬কলরব বেশ কিছুদিন ধরে কুহুর দেখা পাচ্ছে না। অসম্ভব বিরক্তিকর লাগছে সবকিছু। পিহুকে ছাদে দেখলেই মুডটা খারাপ হয়ে যায়। ইরিনকে তো সপ্তাহে তিন দিন পড়ায় এর মাঝে একদিন পড়ায় শুক্রবারে। সেদিন অবশ্য কুহুকে কলরব একনজর দেখে। ইরিনের রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে এক পলক দেখেই চলে আসে। দেখতে অবশ্য সমস্যা হয় না কারণ ইরিনের পড়ার টেবিলের পাশেই ড্রেসিংটেবিল ড্রেসিংটেবিলের আয়নাতেই কুহুকে স্পষ্ট দেখা যায়। কলরব ভেবে পাচ্ছে না কুহু কেনো এখন ছাদে যায় না। কুহুর ফ্যামিলিতে কোনো সমস্যা হয়নি তো? কলরবের বিষয়টা কি কুহু তার ফ্যামিলিকে বলে দিয়েছে? নাকি ওর ফ্যামিলি কোনোভাবে জেনে ফেলেছে? নাহ্ জানেনি, জানলে নিশ্চয় ইরিনকে পড়াতে আসতে দিতো না। তাহলে কেনো কুহু ছাদে আসে না? রিকশা ঠিক করে দিয়েছিল এজন্য? না এজন্য হবে কেনো? হতেও তো পারে কারণ কুহু যদি ভেবে থাকে কলরব ওকে ফলো করে? আসলে কলরব তো কুহুকে ফলো করেনি। কুহুর কলেজের সামনেই কলরবের এক বন্ধুর বাসা। সেদিন কলরব বন্ধুর বাসায় গিয়েছিল আসার পথে কুহুকে দেখেছিলো হাঁটতে। হয়তো রিকশা পাচ্ছে না দেখে একটু দূরেই বাইক থামিয়ে কলরব কুহুকে দেখছিলো। কুহু কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলে কলরবও কিছুটা সামনে যেয়ে বাইক থামিয়ে পিছন থেকে কুহুকে দেখছিলো। যতদূর পর্যন্ত কুহুকে দেখা যায় ততদূর পর্যন্ত কলরব তাকিয়ে থাকতো। যখনই আর দেখা যেত না তখনই কিছুটা এগিয়ে যেত। কুহু একটা রিকশা পেয়ে রিকশা ঠিক করছিলো হয়তো রিকশাওয়ালা বেশি দাম চেয়েছে তাই রিকশায় উঠেনি। কলরব ব্যাপারটা লক্ষ্য করে কুহু কিছুটা সামনে যেতেই রিকশাওয়ালাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করে। ডাবল ভাড়া চেয়েছে শুনে ধমক দিয়ে বলে,- এই একটুখানি রাস্তা কতো টাকা বললেন?- পঞ্চাশ টাকা।- ঐ আপা কতো বললেন?- ত্রিশ টাকা।- বেশিই তো বললেন পঁচিশ টাকার ভাড়া উনি ত্রিশ টাকা বলেছেন। যান উনাকে ডেকে রিকশায় তুলুন।রিকশাওয়ালা কুহুকে রিকশায় উঠানোর জন্য যেতে নিলেই কলরব রিকশাওয়ালাকে থামিয়ে বিশ টাকা দিয়ে বলে,- ঐ আপার কাছ থেকে ত্রিশ টাকা নিয়ে নিবেন আর আমারটা বলার দরকার নেই।- আইচ্ছা ভাই।কলরব রিকশাওয়ালার সাথে চড়া গলায় কথা বলে নিজেই হতবাক হয়ে যায়। তাই ডেকে টাকাটা দিয়ে দেয় যদিও না দেয়াটাই উচিত ছিল। আসলে কুহুর কাছে ডাবল ভাড়া চেয়েছে শুনেই মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কলরব অবশ্য খুব সহজে রাগে না কিন্তু একবার রাগলে খবর আছে। কিন্তু রিকশাওয়ালাকে ধমক দিয়ে নিজেরই খারাপ লাগছিলো। এই ছোটখাটো বিষয়ে কলরব কখনোই রাগে না বরং সে রাগের মাঝেও খুব বড় বড় কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারে। যদিও রেগে গেলে সবাই তাকে অনেক ভয় পেয়ে যায়। কেনো পায়? রেগে গেলে কলরব কিছুটা ধমক দিয়ে সবার সাথে কথা বলে তাই হয়তো যেমন এই রিকশাচালকও পেয়েছে। কলরব এই ছোট একটা বিষয়ে কেনো রেগে গেল? কুহুর সঙ্গে জড়িত ঘটনা বলে কি? নাকি সে ধীরে ধীরে কুহুর মতো হয়ে যাচ্ছে? ছোটখাটো বিষয় নিয়ে হুট করে রেগে যাওয়া তো কুহুর অভ্যাস, কলরবের নয়। তাহলে কলরবকে ধীরে ধীরে কুহুর মতো হয়ে যাচ্ছে? প্রেম কি মানুষকে এতোটাই বদলে দিতে পারে? কলরব আনমনেই হাসলো। কিন্তু ভাবছে কুহু কেনো ছাদে আসে না? কুহুর তো জানার কথা না যে কলরব রিকশা ঠিক করে দিয়েছে। কলরব ইচ্ছে করেই ভাড়াটা মিটিয়ে দেয়নি পিছে আবার কুহু বুঝে যায়। তাহলে কি রিকশাওয়ালা বলে দিয়েছে নাকি কুহু সেদিন কলরবকে দেখেছিলো। যদি রিকশাওয়ালা বলে থাকে তাহলে রিকশাওয়ালার খবর আছে। কলরব ঐ ব্যাটাকে বাস্কেটবল বানিয়ে খেলবে। কিন্তু রিকশাওয়ালার তো বলার কথা না, কেনো বলবে সে? ধমক দিয়েছিলো তাই কি? কিন্তু সেরকম ধমক তো দেয়নি বেশ ভদ্রভাবেই কথা বলেছিলো সে, আপনি করে সম্বোধন করেছিল, শুধু বলেছিলো বেশি দাম চেয়েছেন। আর কিছু তো বলেনি যদিও রিকশাওয়ালা ওকে ভয় পেয়েছিলো। আসলে কলরব রেগে গেলে ওর মাঝে একটা গাম্ভীর্য চলে আসে যেটা দেখে সবাই ওকে ভয় পেয়ে যায়। নাহ্ কলরব অনেক ভেবে দেখেছে রিকশাওয়ালা কুহুকে কথাটা বলেনি আর এই ঘটনার কিছুদিন আগে থেকেই তো কুহু ছাদে আসতো না যদিও বা রাতে গান শুনতে এসে ধরা পড়ে গিয়েছিলো। কলরব লাঞ্চ টাইমে বসে বসে কথাগুলো ভাবছিলো। হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেয় আজকে বিকেলের আগেই অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নিবে আর পরীক্ষা করবে কুহু কি শুধু কলরব যেদিন ছাদে যায় সেদিন ছাদে যায় না নাকি অন্য দিনগুলিতেও এমন। যেই ভাবা সেই কাজ। বিকেলের দিকে কলরব ছুটি নিয়ে বাসায় চলে আসে। কূজন তখন ইরিন আর কলরবের বাবার সাথে বসে তাদের ছবি আঁকার কাহিনী শুনছে। কলরবকে দেখে সবাই প্রায় অবাক হলো। কলরব সবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে বললো,- অফিসে আজ কাজের চাপ কম তো তাই এসে পড়েছি।- ভাইয়া তুমি খেয়েছো? বাবাও খায়নি মাত্র স্কুল থেকে ফিরলো এখনই খাবে, তুমিও সাথে খেয়ে নাও।- না ইরিন আমি খেয়ে এসেছি।কলরব আর কিছু না বলে ফ্রেশ হতে চলে গেল। কফি কালার এর একটা টিশার্ট আর কালো ট্রাউজার পরে এগুলো ছাদের দিকে। কূজন ভেবেছিলো ছাদে যাবে কিন্তু কলরবকে ছাদে যেতে দেখে আর যায়নি। ভেবে নিয়েছে পিহুর সাথে কথা বলতেই হয়তো আজ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরেছে। কলরব ছাদের সিঁড়িতে যেয়ে দাঁড়িয়ে কুহুদের ছাদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রেখেছে। ইচ্ছে করেই ছাদে যায়নি কারণ কুহু কোনোভাবে দেখে ফেললেই কলরবের কষ্ট বিফল হয়ে যাবে। প্রায় দশ বারো মিনিট অপেক্ষা করার পর কলরবের ঠোঁটে হাসি ফুটলো। কুহু ছাদে এসেছে তার মানে সে কলরব থেকে পালানোর জন্যেই এমন করছিলো। কলরব পা টিপে টিপে যেয়ে রেলিং এর কাছে দাঁড়ায়। কুহু তখন একমনে নিজের কাজ করছিলো। কলরব বেশ সুন্দর করে বললো,- ফুলটুশি তোমার নামটা কি জানা যাবে?কুহু হঠাৎ কলরবের কণ্ঠ শুনে ভয় পেয়ে যায় আর আল্লাহ্ মাবুদ বলে ফিরে তাকায়। কলরবকে দেখেই কুহুর হাতে থাকা কাপড়গুলো পড়ে যায়।কলরব এটা দেখে হুহুহু করে অট্টহাসিতে মেতে উঠে। তারপর বলে,- নামটা কি আমাকে বলা যায় না ফুলটুশি? কুহু দাঁতে দাঁত চেপে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে কাপড়গুলো তুলতে থাকে।কলরব আবারো বললো,- আমি হেল্প করবো? তুমি চাইলে আমাদের রেলিং টপকে তোমাদের ছাদে এসে তোমাকে হেল্প করতে পারি।- আজব!- উহু কলরব! আচ্ছা আমি আসছি...- এই না না আমার হয়ে গেছে।কলরব হালকা হেসে বললো,- ফুলটুশি তুমি আমাকে এতো ভয় পাও কেনো?- কোথায় ভয় পাই?- তাহলে পিহুকে ছাদে পাঠাও কেনো তাও আবার আমি যেদিন যেদিন আসি সেদিনগুলোতে?কুহু আর কিছু বললো না।চুপচাপ চলে যেতে নিলে কলরব বললো,- পিহুকে জিজ্ঞাসা করলাম সে কিছুই বললো না, তুমি নিজেই বলো আসল ঘটনা কি?কুহু কলরবের কথায় থমকে দাঁড়ায় তারপর দুই মিনিট সময় নেয় কিছু একটা ভেবে বলার জন্য কিন্তু কি বলবে ভেবে না পেয়ে চুপচাপ হাঁটা ধরে। কলরব এইবার একটু চেঁচিয়েই বললো,- ফুলটুশি আমি কি তোমার বাবার কাছে আমার বায়োডাটা পৌঁছে দিতে পারি?কুহু এই কথা শুনে দৌড়ে নীচে নেমে গেল। কলরব কুহুকে বললো,- আস্তে ফুলটুশি আস্তে নামো।কলরবের একথা শুনে কুহু যখন আরো তাড়াতাড়ি করে দৌড়ে চলে গেল তখন কলরব হাসতে লাগলো সেই গগনবিহারী হাসি।চলবে...:#একটুখানি#Lamyea_Chowdhuryপর্ব:২৬কুহুর হাত পা কাঁপছে। অর্ধেক সিঁড়ি পর্যন্ত নেমেই শরীরের সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছে সে। সিঁড়িতেই বসে পড়েছে, বিশ মিনিট হয়েছে এখনো বসেই আছে। কলরবের কথাগুলো মাথার উপর দিয়ে গেলেও হৃদয়ে কিছু একটার আবাশ পাচ্ছে কুহু। চোখ বন্ধ করে সিঁড়ির পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসলো সে। চোখ বন্ধ করতেই কলরবকে দেখতে পেলো। তবে অবাক হয়নি কুহু কারণ এটা ওর নিত্যদিনের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। কুহু চোখ বন্ধ করলেই কলরবকে দেখতে পায় এমনকি ঘুমোতে গেলেও একই অবস্হা হয়। কুহু দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ খুললো আর তখনই দেখতে পেলো কূজন ওর সামনে দাঁড়িয়ে। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে পকেটে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। কুহু কূজন থেকে চোখ সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর আবার সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলো ঠিক তখনই কুহু শুনতে পেলো কূজন বলছে,- কুহু আপনাকে একটা গান শুনাবো?কুহু কূজনের কথায় পাত্তা না দিয়ে নীচে নেমে গেল। কি উত্তর দিবে সে কূজনকে? এটা তো কূজন নয় কূজনের অবয়ব যেটা কুহু প্রায়শই কল্পনা করে। বাসার দরজা খুলাই ছিল। কুহু বাসায় এসেই নিজের রুমে চলে এলো। তারপর দরজা লাগিয়ে ওয়ারড্রব থেকে কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো। একটু আগেই গোসল সেরে ঘুম দিয়েছিলো। ঘুম থেকে উঠেই নামাজ পড়ে ছাদে গিয়েছিলো কাপড় আনতে। কিন্তু ছাদ থেকে আসার পর পুরো মাথা হ্যাং হয়ে আছে। কুহু শাওয়ার হেডের দিকে একদৃষ্টিতে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকলো তারপর শাওয়ারের নীচে বসে পড়লো। কুহুর মনে হচ্ছে কয়দিন ধরে সে পুরো পাগল হয়ে গেছে। সব কেমন যেন ঘোলাটে। চোখ বন্ধ করলেই কলরব আর পথে ঘাটে যেখানে সেখানে কূজন। নিজের চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে কুহুর।পিহুও জানে ব্যাপারটা। পিহুর ভাষ্যমতে, সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কূজনের গান শুনে শুনে কুহু কূজনের ভক্ত হয়ে গিয়েছে। আর কলরবকে নিয়ে এতোভাবে তাই চোখ বন্ধ করলে কলরব কলরব আর কলরব। কুহুর কাছে পিহুর কথাগুলো যুক্তিসংগত মনে হয়েছে কিন্তু তারপরো কুহুর যেন কেমন কেমন লাগে। এই কেমন কেমন কাউকে বলে বোঝানো সম্ভব নয়। আচ্ছা সে কি প্রেমে পড়েছে? হয়তো পড়েছে কিন্তু কার? কার প্রেমে পড়েছে কুহু? কলরবের না কূজনের? কুহু কিছুই বুঝতে পারছে না। হঠাৎ তার খুব কান্না পেলো, কেঁদেও দিল। কুহু অঝরে কাঁদছে কিন্তু কেনো কাঁদছে নিজেও জানে না। অনেকক্ষণ কেঁদে কেটে উঠে দাঁড়ালো। শাওয়ার বন্ধ করে কাপড় পাল্টে মায়ের রুমে চলে গেলো। কুহুর মা তখন টিভি দেখছিলো। কুহু মায়ের পাশে বসে মাকে জড়িয়ে ধরে বললো,- আম্মু তোমার কোলে একটু মাথা রাখি?- মানা করেছে কে? আয় মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।কুহুর মা পা মেলতেই কুহু মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে রইলো। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মা বললেন,- শরীর খারাপ?- না।- তাহলে মন খারাপ?- জানি না।- একটু চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাক তাহলে হয়তো ভালো লাগবে।কুহু চোখ বন্ধ করলো না কারণ সে জানে চোখ বন্ধ করতেই আবার কলরবকে দেখতে পাবে। আচ্ছা একজন মানুষ কি একই সময়ে দুইজনের প্রেমে পড়তে পারে? কুহু অনেক ভেবে বের করলো, এটা সম্ভব না। একই মানুষ দুইটা মানুষের প্রেমে পড়তেই পারে না, তাও আবার একই সময়ে। কুহুর মা কুহুকে বললো,- আম্মাজান আমাকে বলা যায় না?- নাহ্ তেমন কিছু না।- আচ্ছা যখন ইচ্ছে হবে তখন বলবি সমস্যা নেই।কুহু আর কিছু বললো না তবে চোখ বন্ধ করলো। কলরবকে দেখতে দেখতেই একসময় ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুম থেকে যখন উঠলো তখন দেখলো কুহুর বাবা কুহুর পাশে বসে আছে।- কি ব্যাপার তুই তো দেখি জ্বর বাধিয়ে ফেলেছিস। আজ কি এতোই গরম পড়েছিলো যে দুইবার গোসল করেছিস?- আরে বাবা তেমন কিছু না। হালকা টেম্পারেচার বেড়েছে হয়তো।- হুম কিন্তু তোর কি কিছু হয়েছে? হলে বলে দে, শেয়ার না করলে হবে নাকি?- নাহ্ তেমন কিছু না তো।কুহু মা বাবার রুম থেকে বের হতেই দেখলো ডাইনিং টেবিলে বসে পিহু স্যারের কাছে পড়ছে। কুহু ইশারায় পিহুকে বললো তাড়তাড়ি যেন ছুটি নিয়ে নেয় দরকারি কথা আছে। পিহু একটু পরেই স্যারকে বিদায় করে কুহুর কাছে গিয়ে বসলো। তারপর বললো,- তুই কি আম্মু আব্বুকে কিছু বলেছিস?- নাহ্।- ভালো করেছিস এই পাগলামির কথা শুনলে তোকে পাবনা পাঠাবে নয়তো বিয়ে দিয়ে দিবে।কুহু কাঁদো কাঁদো হয়ে পিহুকে বললো,- পিহুন শুনবি কলরব আজকে কি বলেছে?- কলরবের সাথে তোর দেখা হয়েছে? - হুম বিকেলে আজ ছাদে এসেছিলো।- আচ্ছা বল কি বলেছে? - জিজ্ঞাসা করেছে আব্বুর কাছে বায়োডাটা পাঠাবে কি না?পিহু বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লো। তারপর মাথায় হাত দিয়ে বললো,- মানে বিয়ের প্রস্তাবের কথা বলছে?- হুম।- আগুনের গোলা তো জাতে মাতাল তালে ঠিক। আচ্ছা তুই কি বলেছিস?- আমি কিছু বলিনি, কি বলবো ভেবে পাইনি।- ভালোই করেছিস।- আচ্ছা আমি এখন কি করবো?- তুই কি চাইছিস মানে কাকে চাইছিস?- আমি জানি না! জানি না!কথা বলতে বলতে কুহু বিছানায় থাকা বালিশটা ছুঁড়ে ফেললো। পিহু কুহুর হাত চেপে ধরে শান্ত স্বরে বললো,- আপুণি রাগিস না। মনে রাখবি রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন।- পিহুন আমি কি করবো বোন? কলরব যদি এখন সত্যি বাসায় আসে তাহলে?- মনে হয়না তুই না বলা পর্যন্ত আসবে কারণ সে তোর কাছ থেকে জানতে চেয়েছে আসবে কিনা, অনুমতি চেয়েছে।- তারপরো যদি আসে?- আব্বু কি তোর মতের বাইরে কিছু করবে নাকি? তুই চাইলে কলরবকে বিয়ে করবি আর না চাইলে না করবি।- এটাই তো বুঝতে পারছি না আমি কি চাচ্ছি। তুই বল তুই আমার জায়গায় হলে কি করতিস?- কলরবকে বিয়ে করতাম।কুহু চোখ মুছে বললো,- একটু বুঝিয়ে বল কেনো কলরবকে করতিস?- দেখ তুই দুটানায় ভোগছিস। তুই বুঝতেই পারছিস না তুই কাকে পছন্দ করিস। কূজনকে নাকি কলরবকে? কিন্তু একটা বিষয় আমি এখানে পরিস্কার যে কলরব তোকে চাচ্ছে, মনে প্রাণে চাচ্ছে কিন্তু কূজন তো আর তোকে ভালোবাসে না, তাইনা?- হুম।- যদি বাসতো তোকে কিছু একটা বলতো। যেমন ধর কূজন তো ছাদেই থাকে তোর দিকে তো ভালোভাবে তাকায়ও না, কথাও বলে না। দেখ যদি তোর কথা মেনে নেই তাহলে দেখা যাচ্ছে তুই দুইজনকেই পছন্দ করিস কিন্তু বুঝতে পারছিস না কাকে চুজ করবি, তাইতো?- হুম।- এখানে চুজ করার মতো কিছুই নেই আপুণি কারণ যদি এমন হতো কূজনও তোকে পছন্দ করে তাহলে তুই দুইজনের একজনকে চুজ করতি। কিন্তু কূজনের দিক থেকে সেরকম কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে এখন বুদ্ধিমতির কাজ করতে হবে ।- কি করতে হবে?- দেখ যেহেতু দুইজনকেই পছন্দ করিস তাহলে যে তোকে পছন্দ করবে তোকে ভালোবাসবে তাকেই তোর প্রাধান্য দেওয়া উচিত। আমি কি তোকে বোঝাতে পেরেছি?- হুম।- আরেকটা বিষয় আমি তোকে ক্লিয়ার করে বলি সেটা হলো এই যে কলরব আমাকে ছাদে দেখতো কোনোদিন অন্য চোখে তাকায়নি। বরং তোকে দেখতে না পেয়ে আমার উপর বিরক্ত হতো। আমি কি বোঝাতে চেয়েছি বলতো?- কলরব শুধু আমাকেই পছন্দ করে।- নাহ্ এটা বুঝায়নি।- তাহলে কি বুঝাতে চেয়েছিস?- কলরব শুধু তোকেই ভালোবাসে।চলবে..পর্ব:২৭"তোরা যে যা বলিস ভাইআমার সোনার হরিণ চাইমনোহরণ চপল চরণসোনার হরিণ চাইআমার সোনার হরিণ চাইআমার সোনার হরিণ চাইতোরা যে যা বলিস ভাইআমার সোনার হরিণ চাইসে যে চমকে বেড়ায় দৃষ্টি এড়ায়যায় না তারে বাঁধাসে যে নাগাল পেলেপালায় ঠেলেলাগায় চোখে ধাঁধাসে যে চমকে বেড়ায় দৃষ্টি এড়ায়সে যে নাগাল পেলেপালায় ঠেলেলাগায় চোখে ধাঁধা।"হঠাৎ কলিংবেলের শব্দ আসতেই ইরিন বেতের মোড়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। কূজন তখন চোখ বন্ধ করে গান গেয়েই চলছে। ইরিন বললো,- ভাইয়া তুমি গান গাইতে থাকো আমি দেখে আসছি কে এসেছে। কূজন চোখ খুলে মাথা নেড়ে ইরিনের কথায় সায় দিলো। আর একমনে গেয়ে চললো,"আমি ছুটবো পিছে মিছে মিছেপাই বা নাহি পাইআমি আপন মনে মাঠে বনেউধাও হয়ে ভাইআমার সোনার হরিণ চাই আমার সোনার হরিণ চাইতোরা যে যা বলিস ভাইআমার সোনার হরিণ চাই"হাসনাদ সাহেবকে দেখে ইরিন আনন্দে আটখান হয়ে বললো,- আঙ্কেল! আপনি?????- কেমন আছো হরিণ?ইরিন হাসনাদ সাহেবকে ইশারায় চুপ থাকতে বলে উনাকে ভিতরে নিয়ে আসেন।হাসনাদ সাহেবের হঠাৎ মনে হলো কেউ গান গাইছে আর সে কেউটা কূজন। ইরিন ধীরে ধীরে হাসনাদ সাহেবকেনিজের রুমের বারান্দায় নিয়ে গেলো। হাসনাদ সাহেব দেখতে পেলেন একটা ছেলে বেতের মোড়ায় বসে গিটার হাতে একমনে গান গেয়েই চলছে। কূজন পিছন ফিরে থাকায় হাসনাদ সাহেব কূজনকে দেখেনি। কিন্তু ঠিকই বুঝে নিয়েছেন এই ছেলে আর কেউ নয় কূজন।হাসনাদ সাহেব শিউর হওয়ার জন্যে কূজনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। কূজন চোখ বন্ধ করে আছে তাই বাবাকে দেখতে পায়নি।হাসনাদ সাহেব এতোদিন পর ছেলেকে দেখে বেশ খুশি হলেন। কূজনের সামনের মোড়াটায় বসলেন। ইরিনকেও ইশারায় বসতে বললেন। ইরিন হাসনাদ সাহেবের পাশের মোড়াটায় বসলো। দুইজন একমনে কূজনের গান শুনতে লাগলো। কূজনের গান শেষ হতেই কূজন চোখ খুলতে খুলতে বললো,- সোনার হরিণ কে এসে....কূজন পুরো বাক্য আর বলতে পারলো না। হাসনাদ সাহেবকে দেখে কূজনের মনে হলো চোখে সরষে ফুল দেখছে। মুখ দিয়ে আর কোনো কথা বের হচ্ছে না তার। ইরিন হঠাৎ বলে উঠলো,- আঙ্কেল আপনি আমার গান শুনে বলেছিলেন না অনেক সুন্দর তাহলে এখন কি বলবেন?হাসনাদ সাহেব হেসে বললেন,- হরিণ! নাহ্ সোনার হরিণ! আমার তো মন অন্য কিছু চাইছে। তোমাদের যুগলবন্দী শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে।- তাহলে তাই হবে। কি বলো কূজন ভাইয়া???কূজনের সবকিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ওর মাথায় এখন অনেকগুলো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। বাবা এখানে কি করে? বাবা জানলো কি করে যে সে এখানেই আছে? আর ইরিন আর বাবা এমনভাবে কথা বলছে কেনো? ইরিন তো বাবাকে চেনার কথা না এমনকি কলরব ভাইও তো বাবাকে চেনে না আর বাবাও তো ওদের চিনে না। বাবা এখন কি করবে? অনেক রেগে যাবে নিশ্চয় কিন্তু রাগার কোনো লক্ষণ তো দেখছি না।ইরিনের কথায় কূজনের ভাবনায় ছেদ পড়লো।- না আঙ্কেল তা হবে না আগে আপনাকে খাওয়া দাওয়া করতে হবে তারপর যা বলবেন তাই হবে।- হুম করবোই তো দেখোনা এই ভর দুপুরে এসেছি তোমার কাছে। - হা হা হা। আচ্ছা সেদিনের মতো আবার ভেগে যাবেন না তো?- নাহ্ যাবো না হরিণ। সোনার হরিণ!- আচ্ছা আমি এখনই টেবিলে খাবার সাজাচ্ছি।ইরিনের পা এখন প্রায় পুরোপুরি সেরে গেছে তাই আগের চটপটে ভাব আবার চলে এসেছে তার মাঝে। ইরিন চলে যেতেই হাসনাদ সাহেব কূজনকে উদ্দেশ্য করে বললেন,- কি ব্যাপার তোমার ট্যুর শুনেছিলাম বান্দরবন,রাঙামাটি,নাফাখুম। তা ফেণীতেই থমকে গেলো কি করে?- বাবা আসলে..- বন্ধুর বাসায় আছো বললেই তো হতো। ট্যুর বাদ দিয়ে এসে পড়েছো নাকি ট্যুর শেষ হয়ে গেছে?- না মানে ট্যুর শেষে এসেছি।- কোন বন্ধুর বাসা এটা? সোনার হরিণ তো আর তোমার বন্ধু হতে পারে না। না মানে হতে পারে তবে বয়সটা একটুখানি ম্যাটার করে আরকি। তোমার থেকে ছোটই মনে হলো তার উপর ভাইয়া বলছে। - না ওহ্ আমার ফ্রেন্ড না।- তাহলে কে তোমার ফ্রেন্ড?কূজন কোনোরকম বললো,- কলরব!- কলরব আবার কোন বন্ধু? আগে তো নাম শুনিনি। তোমার ভার্সিটির ?- না কলরব ভাই আমার সিনিয়র। ভাইয়া চিটাগাং ভার্সিটির। ফরেস্ট্রি তে পড়াশুনা শেষ করে জব করছে।- সিনিয়র বন্ধু বেশ ভালো। কলরব কি সোনার হরিণের ভাই?- জ্বি বাবা। বাবা তুমি এখানে যে?- কয়েকদিন আগে নতুন প্রজেক্ট এর উপর কাজ করছিলাম তখন না একবার ফেণী এসেছিলাম?- হুম।- বলেছিলাম না একটা মেয়ে খুব হেল্প করেছিলো?সেই মেয়েই হলো তোমার সোনার হরিণ।- ওহ্।- আজ আবার ফেণী আসতে হলো। ভাবলাম ইরিনের সাথে দেখা করেই যাই তাই চলে এসেছি। ইরিন বললো,- ভালো করেছেন আঙ্কেল এখন তাড়াতাড়ি চলুন তো।হাসনাদ সাহেব উঠতে উঠতে বললেন,- চলো মা।- কূজন ভাইয়া তুমিও চলে এসো তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।ইরিন কিছু বলার আগেই কূজন তাড়াতাড়ি করে বললো,- ইরিন তার প্রয়োজন নেই। উনি আমার বাবা।ইরিন তার টানা টানা বড় চোখগুলো আরো বড় করে থমকে দাঁড়ালো।হাসনাদ সাহেব হেসে বললেন,- আমার ছেলের গানের কথা বলেছিলাম না শুনলে তো কেমন গায়?ইরিন কূজনের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। কূজন ইশারায় নির্ভরতার আশ্বাস দিলো। কিন্তু ইরিন বুঝতে পারছে না আঙ্কেল কূজনকে দেখে কেনো রিএক্ট করছে না। ইরিন তাই চুপ থাকাটাই শ্রেয় মনে করলো। ডাইনিং টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে হাসনাদ সাহেব বললেন,- তোমার মা, বাবা, ভাইকে দেখছি না যে?- মা, বাবা স্কুলে আর ভাইয়া অফিসে।- ওহ্ তোমার মা, বাবা টিচার?- জ্বি আঙ্কেল।- আচ্ছা তুমি নিজ হাতে কিছু রেঁধেছো?- না আঙ্কেল তবে সালাদটা আমি বানিয়েছিলাম। - আমি তো ভাবলাম তোমার হাতের রান্না খাবো।- আসলে কয়েকদিন ধরে অসুস্হ তো তাই করা হচ্ছে না।- সমস্যা নেই। একটুখানি মজা করলাম আরকি। তবে তোমার পায়েশটা অনেক ভালো লেগেছিলো। তোমার আন্টির মানে কূজনের মায়ের হাতের খিচুড়িটা যেমন আমার সবচেয়ে প্রিয়, তোমার পায়েশটাও আমার খুব পছন্দের।- থেঙ্ক ইউ আঙ্কেল।- তুমিও বসো আমাদের সাথে। হাসনাদ সাহেব এর সাথে তাল মিলিয়ে কূজন বললো,- ইরিন বসে যাও, বাবাই তো এতো ফর্মালিটিস দেখিয়ে সার্ভ করতে হবে না।- ইরিন বলছিস যে? সোনার হরিণ বলবি। হা হা হা।বসে পড়ো মা। তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি। আসলে সেদিন বলেছিলাম না তোমাকে, আবার আসবো তাই চলে এলাম।ইরিন চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো,- আপনি অনেক ভালো আঙ্কেল।- আচ্ছা তুমি যেন কিসে পড়ো?- এইবার এসএসসি দিবো।- তুমি তো তাহলে অনেক ছোট কিন্তু কতো গুছিয়ে কথা বলো।ইরিনের অনেক কথাই বলতে ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু সে যতোটুকু না বললেই নয় ঠিক ততোটুকু বলছে পাছে আবার কোনো ঝামেলা বাঁধে। খাওয়া দাওয়া শেষে হাসনাদ সাহেব ওদের দুজনের যুগলবন্দী শুনতে চাইলেন। ইরিনের তখন বুক ঢিপঢিপ করছে। কোনসময় কি ঝামেলা বাঁধে এই ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে তাই গান গাইতে না করে দিলো। কিন্তু হাসনাদ সাহেবের পিড়াপিড়িতে শেষ পর্যন্ত রাজি হতেই হলো। তবে বললো একটু পরে গাইবে। কূজন ইরিনের একথা শুনে ভাবলো,ইশ্ বুঝে না কেনো মেয়েটা? যতো তাড়াডাড়ি বাবাকে বিদায় করা যায় ততো ভালো। কূজনও বেশ জোর করেই ইরিনকে গান গাইতে রাজি করালো। কিন্তু ইরিনকে আর গান গাইতে হলো না। হাসনাদ সাহেবের ব্যবসার কাজে ডাক পড়লো। তাই তিনি বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। ইরিন আর কূজন হাসনাদ সাহেবকে বিদায় জানাতে নিচে গেলো। গাড়িতে বসেই হাসনাদ সাহেব বললেন,- ভালো থেকো মা! আর কূজন তোমার বেড়ানো শেষ হলেই বাসায় এসো।- বাবা আমি কাল সকালেই বাসায় আসছি।- আহা তাড়াহুড়ার দরকার নেই। আরো কয়েকদিন থাকো,আনন্দ করো।হাসনাদ সাহেব কথা শেষ করেই ইরিনের হাতে একটা প্যাকেট দিলেন।- এটাতে কি আঙ্কেল?- একটা শোপিস! আর কিছু চকোলেট। তোমার জন্য উপহার।ইরিন নিতে চাইলো না খুব জোর করে হাসনাদ সাহেব এটা ইরিনকে দিয়ে গেলেন তাও আবার কূজনের হাতে গছিয়েই বললেন,- তুই রাখ পরে দিয়ে দিস, এই ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দাও তো নয়তো সোনার হরিণ আবার আবার প্যাকেট ফেরত দেওয়ার সুযোগ পেয়ে যাবে।গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার পর হাসনাদ সাহেব গাড়ির জানালা দিয়ে পিছন ফিরে তাকিয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানালো দুইজনকে। কূজন আর ইরিন সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। গাড়ি যতোদূর দেখা গেলো তাকিয়ে রইলো। গাড়ি পাশের মোড়ে বাঁক নিতেই গাড়ি কোথায় যেন মিলিয়ে গেলো। তারপর কূজন বললো,- বাবাকে জীবনেও আমি এতোগুলো মিথ্যে বলিনি।- সব আমার জন্যে হলো। তোমাকে জোর না করলে এখানে আসতেও না আর আঙ্কেলকে মিথ্যেও বলতে হতো না।- আরে সোনার হরিণ তুমি মন খারাপ করো না। তুমি আমার বড় উপকার করেছো। - চলো বাসায় যাই।কূজন হেসে বললো,- আমার সোনার হরিণকে মনমরা হয়ে থাকলে একদমই ভালো লাগে না।- ঠিকাছে ভাইয়া মন খারাপ করবো না।- গুড গার্ল।চলবে... পর্ব:২৮কূজন আর ইরিন দুইজন পাশাপাশি বসে আছে। কূজনের মাথায় হাত আর ইরিন কতক্ষণ পর পর দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। কূজনের প্রচন্ড মন খারাপ। সে ভেবেই পাচ্ছে না সে এতো মিথ্যা কথা কবে শিখলো? তাও আবার বাবাকে মিথ্যে বলেছে সে। ইরিনের মন খারাপ কারণ সব ওর জন্যই হলো। ইরিন কূজনের দিকে ঘুরে বসে বললো,- কূজন ভাইয়া তুমি তাড়াতাড়ি চলে যাও।কূজন মাথা থেকে হাত সরিয়ে বললো,- কালই চলে যাব।- ভাইয়া প্লিজ তুমি এভাবে থেকো না আমার কান্না পাচ্ছে।- আরে তুমি কেঁদো না।- ভাইয়া আমার খুব কান্না পাচ্ছে।ইরিনের কথা শেষ হওয়ার আগেই চোখ দিয়ে দু ফোঁটা পানি পড়লো। কূজন অবাক হয়ে বললো,- আরে বোকা মেয়ে তোমার জন্য কিছুই হয়নি। - আমি সেজন্য কাঁদছি না।- তাহলে??- আঙ্কেলকে মিথ্যে বলেছি তাই।ইরিনের চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছেই।কূজন পকেট থেকে মোবাইল বের করে বাবার নাম্বারে ডায়াল করলো। হাসনাদ সাহেব রিসিভ করেই বললেন,- হ্যালো মাই প্রিন্স!- বাবা সোনার হরিণ তোমার সাথে কথা বলবে।- দাও।কূজন মোবাইলটা ইরিনের হাতে দিয়ে বললো,- বাবাকে সত্যিটা বলে দাও।ইরিন কূজনের দিকে হা হয়ে তাকিয়ে রইলো। কূজন হাত দিয়ে ইরিনের চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,- ভাইয়া আছি তো। তুমি বলে দাও কিছু হবে না।- ঠিক আছে।ইরিন স্পিকার অন করে বললো,- আঙ্কেল!- সোনার হরিণ গিফ্ট পছন্দ হয়েছে?- আঙ্কেল প্যাকেট এখনো খুলে দেখিনি।- কি বলো তাহলে তাড়াতাড়ি খুলে দেখো পছন্দ হয়েছে কিনা।- আঙ্কেল আমি আর কূজন ভাইয়া আপনাকে মিথ্যে বলেছি। কূজন ভাইয়া আমার ভাইয়ের ফ্রেন্ড না।ইরিন আবারো কেঁদে ফেললো। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে বললো,- আঙ্কেল সরি! আপনি প্লিজ কূজন...- হয়েছে মা কাঁদতে হবে না। সোনার হরিণকে কাঁদলে ভালো দেখায় না।- আঙ্কেল সরি প্লিজ আপনি রাগ করবেন না বলুন।- আরে বাবা রাগ করিনি। আমি তো এমনিতেও তোমাকে অনেক পছন্দ করতাম। আমি বরং কূজনকে তোমাদের এখানে দেখে খুশি হয়েছি। আমি ভাবতাম আমি বুঝি কূজনের বেস্ট ফ্রেন্ড কিন্তু ছেলেটা আমায় কিছুই বলেনি। তোমরা একজন আরেকজনকে পছন্দ করো ভালোই হলো আমার কাজ সহজ হয়ে গেলো।হাসনাদ সাহেবের কথা শুনে ইরিনের হাত থেকে মোবাইল পড়ে গেলো। কূজন ব্যাপারটা বুঝতে একটুখানি সময় নিলো। যখন বুঝলো ওর বাবা কি মিন করছে কূজন তাড়াতাড়ি মোবাইল তুলে নিয়ে একটানা পুরো ঘটনা বললো। হাসনাদ সাহেব কূজনের কথা শেষ হতেই ফোন কেটে দিলো। কূজন আবার কল করলো কিন্তু লাভ হলো না। হাসনাদ সাহেব মোবাইল বন্ধ করে রেখেছেন। কূজন আরো দুই একবার ট্রাই করলো কিন্তু লাভ হলো না। কূজন মোবাইল বন্ধ করে পকেটে রেখে দিলো তারপর ইরিনকে বললো,- বাবার হয়ে আমি সরি।ইরিন চুপচাপ থম মেরে কতক্ষণ বসে রইলো তারপর বললো,- তুমি এখনই এই মুহূর্তে চলে যাবে।ইরিন সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো তারপর আবারো বললো,- ভাইয়া তোমার লাগেজ গোছাও আর কুমিল্লা ফিরে যাও। কূজন একটাও কথা বললো না, চুপচাপ কলরবের রুমে গিয়ে লাগেজ গুছিয়ে নিয়ে এলো। কূজন সবসময় টিপটপ থাকে আর একই রকম থাকে তাই যাওয়ার জন্য আলাদা করে সময় নিয়ে রেডি হতে হয়নি।ইরিন তখন ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে। ড্রয়িংরুমে লাগেজটা রেখে কূজন পা বাড়ালো ইরিনের রুমের দিকে। ইরিন সাথে সাথে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,- আমার রুমে যাচ্ছো কেনো ভাইয়া?কূজন শান্ত কণ্ঠে বললো,- তোমার রুমের বারান্দায় আমার গিটারটা রাখা।- আমি এনে দিচ্ছি।ইরিন গিটারটা এনে কূজনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,- আর কিছু?- না তবে তুমি আমার একটা ছবি এঁকেছিলে...ইরিন কূজনের কথা শেষ না হতেই বলে উঠলো,- দিয়ে দিচ্ছি।ইরিন নিজের রুমে যেয়ে আর্ট খাতা থেকে কূজনের ছবিটা যে পাতায় আঁকা সে পাতাটা ছিঁড়ে নিয়ে এলো। তারপর কূজনকে দিয়ে বললো,- নাও তোমার ছবি।- আরেকটা জিনিস বাকি আছে।- কি?কূজন ওর বাবার দেয়া প্যাকেটটা ইরিনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,- এটা রাখো।- না রাখতে পারবো না।- প্লিজ বাবা দিয়েছে, বাবা না হয় কষ্ট পাবে।- না ভাইয়া আমি এটা রাখতে পারবো না।- রেখে দাও প্লিজ।- ভাইয়া এটা ভাবিকে দিয়ে দিও।কূজন অবাক হয়ে বললো,- কোন ভাবি?- তোমার বউকে।- মানে???- আঙ্কেল এটা আমার জন্য এমনিতে নিয়ে আসেননি, যেটা ভেবে নিয়ে এসেছিলেন সেটা অসম্ভব। তুমি নিয়ে যাও।- ইরিন রেখে দাও।- ভাইয়া তুমি এখন যাও প্লিজ।- আচ্ছা ভালো থেকো সোনার হরিণ।- তুমিও ভালো থেকো ভাইয়া।চলবে...পর্ব:২৯কূজন বাড়ি আসার পর থেকেই বাবার সাথে কথা বলতে চাইছে কিন্তু বাবা সে সুযোগ দিচ্ছে না। কূজন ভেবেছিল তার বাবা খুব রাগ দেখাবে,বকাঝকা করবে কিন্তু কিছুই করছে না, শুধু সূক্ষভাবে এড়িয়ে চলছে। বাসায় ফিরেই কূজন বাবার সাথে কথা বলতে চেয়েছিল। হাসনাদ সাহেব ব্যস্ত থাকার অজুহাতে কথা বলেননি। বরং কূজনকে জিজ্ঞাসা করেছেন,- এতো তাড়াতাড়ি চলে এলে যে? আরো কয়দিন থেকে আসতে। কূজন বাবাকে উত্তরে কিছুই বলেনি। কি বলার আছে? বাবা যে কষ্ট পেয়ে বলেছে তা কূজন খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে। হাসনাদ সাহেব জাহরার সাথেও কথা বলছেন না। যা কিছু লাগছে নিজে নিজে করছেন। এমনকি যে ঔষধের কথা উনার স্ত্রীকে দিনে হাজারবার মনে করিয়ে দিতে হয়, শুধু মনে করিয়ে দিলেই হয় না হাতে তুলে দিতে হয় সেই ঔষধও আজ নিজে মনে করে খেয়েছেন। কূজন আসার আগ পর্যন্ত কূজনের মা বুঝতেই পারেনি কূজনের বাবা কেনো এমন করছে। কূজন এসে সব বলার পর হাসনাদ সাহেবের সাথে অনেকবার কথা বলতে চেয়েছেন। কিন্তু হাসনাদ সাহেব স্ত্রীকে কথা বলার কোনো সুযোগ দেয়নি। এ কাজে সে কাজে ব্যস্ত বলে এড়িয়ে চলছেন। কূজনের মা সারাদিন চেষ্টার পরও যখন হাসনাদ সাহেব কথা বললেন না তিনি কাঁদতে লাগলেন। কূজন শুধু সব চেয়ে দেখছে কিন্তু কিছু বলতে পারছে না। মাকে কান্না থামাতে বললেই মা আরো বেশি চোখের পানি ঝরাতে লাগলেন। কূজন কখনোই কারো কান্না সহ্য করতে পারে না। এখনো সহ্য করতে পারছে না। তাই রুমে এসে চুপ করে বসে আছে। ইরিনের আঁকা ওর ছবিটা দেখে আরো মন খারাপ হয়ে যায়। ইরিন বলেছিল যারা খুব প্রিয় তাদের ছবি শুধু ওর ঐ খাতায় আঁকে আর সেটা রেখে দেয়। কূজন সেদিন চেয়েছিল কিন্তু দেয়নি বলেছিল কাউকে দেয় না। কিন্তু আজ দিয়ে দিল কেনো? কূজন কি এই সামান্য ঘটনার জন্য ইরিনের অপ্রিয় কেউ হয়ে গেলো? ভাবতেই মনটা বিষাদে ভরে গেলো। কুহুর চিন্তা এখন মাথায় আনতে চাইছে না তারপরো এতো কিছুর মাঝে কুহুকেও ভুলতে পারেনি। কুহুকে কি ভালোবাসার কথা জানান দেওয়া যেতো না? ডায়েরীটা কুহুকে দিয়ে আসলেও পারতো। এতো ভেবে ভেবে কূজনের প্রচন্ড মাথা ধরেছে। মাথার ব্যথা চোখ পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। লাইট নিভিয়ে চুপ করে শুয়ে রইল কূজন। হাসনাদ সাহেব জাহরাকে কখনো কাঁদতে দেখেনি। এমনকি বিয়ের দিনও উনি স্ত্রীর চোখে পানি দেখেননি। হাসি মুখে বাবার আর বড় বোনের কথায় সব মেনে নিয়েছিলেন। হাসনাদ সাহেব তলস্তয় এর বিখ্যাত উপন্যাস পিস এন্ড ওয়ার পড়ছেন। পড়ায় ঠিকভাবে মন দিতে পারছেন না। জাহরা যে শোয়ে শোয়ে কাঁদছে তা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছেন। খুব খারাপ লাগছে সেই যে কূজন হওয়ার সময় জাহরা ভয়ে হাসনাদ সাহেবের হাতে ধরে কেঁদেছিলেন আর কাঁদেননি। মাঝে মাঝে হাসনাদ সাহেব ভেবে পায় না কূজনের মা কি সত্যি কাঁদতে জানে না? তিনি তো শুনেছিলেন নারীর প্রধান অস্ত্রই হলো চোখের জল তাহলে জাহরা কি অস্ত্রবিহীন যোদ্ধা? তাহলে কীভাবে জয় করলো হাসনাদ সাহেবকে? হাসনাদ সাহেব একটু ভাবতেই জবাব পেয়ে গেলেন। সেই একটুকরো হাসিতেই তিনি মনের সব কষ্ট ভুলে গিয়েছিলেন। হাসনাদ সাহেব হাতের বইটা বেডসাইড টেবিলে রেখে ডাকলেন,- জাহরা কাঁদছো কেনো? এসব কান্নাকাটি তোমাকে যায় না। কূজনের মা শুয়েছিলেন। চোখ মুছে উঠে বসে বললেন,- আপা ইরিনকে অনেক মেরেছে।- ইরিনকে মারলো কেনো? ওর দোষ কোথায়?- ইরিন কূজনকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে তাই।- কেনো?- আপনি নাকি কূজন আর ওর মাঝে অন্যকিছু আছে ভেবেছিলেন। - হুম প্রথমে ভেবেছিলাম আমি তো আর জানতাম না। ভেবেছিলাম ইরিনকে পছন্দ করে দেখেই ওর বাসায় এতোদিন ধরে থাকছে।কলরব আর ইরিন যে তোমার আপা ছেলেমেয়ে তা তো জানা ছিল না।- ইরিনের কান্নাকাটিতেই কূজনকে সেখানে পাঠিয়েছিলাম।- ঠিকাছে এখন ঘুমাও।- ইরিনকে আপা অনেক মেরেছে। আপার রাগ উঠে গেলে ছেলেমেয়েকে অনেক মারে। - তুমি কার কাছ থেকে জেনেছো?- দুলাভাই বলেছেন। - ইফতেখার সাহেব ফিরাতে পারলেন না?- দুলাভাইকে দোকানে পাঠিয়ে তারপর ইরিনকে মেরেছে। কলরবও অফিসে ছিল।- আচ্ছা তুমি চিন্তা করো না আমি কাল যেয়ে সব ঠিকঠাক করে দিব।কূজনের মা অবাক হয়ে বললেন,- কি করবেন?- তেমন কিছুই না। তুমি টেনশন করো না। আমার উপর বিশ্বাস আছে না?- আছে।- তাহলে ঘুমাও।..কলরবকে অনেকক্ষণ ধরে খাওয়ার জন্য কলরবের মা ডাকছেন। কলরব দরজা দিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। মায়ের উপর খুব রাগ হচ্ছে। ইরিনকে এভাবে মারতে পারলো কীভাবে? এতটুকুনি মেয়েকে মারতে মারতে বেত পর্যন্ত ভেঙে ফেলেছে। মাকে কিছু বলতেও পারছে না আবার সইতেও পারছে না তাই রাগ দেখিয়ে না খেয়ে বসে আছে। ইরিন অবশ্য ভয়ে খেয়ে ফেলেছে। ইরিনের বাবা ইরিনকে খাইয়ে বাসা থেকে বের হয়ে চলে গেছে। আজ বোধহয় আর বাসায় ফিরবেন না। স্ত্রীর সাথে মনোমালিন্য হলেই তিনি মসজিদে রাত কাটান। আজও মসজিদে যেয়ে তাই জানান দিচ্ছেন। কলরবের মা কলরবকে ডেকেও যখন রুম থেকে বের করতে পারলেন না তখন বললেন,- কূজন তোর ভাই না? এই ভর দুপুরে হঠাৎ করে ছেলেটাকে তোর বোন বের হয়ে যেতে বললো কীভাবে ?কলরবের মেজাজও খারাপ হয়ে গেলো। বিরক্ত স্বরে মাকে বললো,- মা যাও তো কানের কাছে প্যানপ্যান করবে না।- তুই খেতে আয়।- আমি বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি।- মিথ্যে বলতে হবে না।- মা ভালো লাগছে না।- কূজনের ভালো লেগেছিল? শান্তশিষ্ট ছেলেটার সাথে কি ব্যবহারটাই না করলো।- ইরিন ছোট মানুষ মা। আঙ্কেল ওভাবে বলায় খারাপ লেগেছিল, ঘাবড়ে গিয়েছিল মেয়েটা। তাই হয়তো বলেছে।- ঐদিকে ছেলেটা বোধহয় বাপের কাছে গালমন্দ শুনছে।- মা কূজনের সাথে আমার কথা হয়েছে। আঙ্কেল কিছুই বলেনি।- যাক বাঁচলাম এখন খেতে আয়।- মা বললাম না ক্ষিধে নেই।কলরবের মা কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো,- কলরব বাবা চলে আয়। মাকে এতো কষ্ট দিস না। মা তাহলে মরে যাব।কলরবের হাসি পেলো। ওর মা যে কীভাবে এক মিনিটেই চোখ থেকে হাজার টাঙ্কি পানি ঝরিয়ে ড্রামা করতে পারে তা খুব ভালেভাবেই জানে। কলরব মনে মনে বললো,- ড্রামা কুইন একটা।তারপর ডুবে গেলো কুহুর ভাবনায়। ভাবতে লাগলো বিয়ের পর কলরব যখন ঝগড়া হলে রাগ করে বসে থাকবে তখন কুহু কি ওর রাগ ভাঙাবে? নাকি ওকে কুহুর রাগ ভাঙাতে হবে? নাহ্ কলরব রাগ ভাঙাবে না। এভাবেই দরজা দিয়ে বসে থাকবে। কুহু তখন ওর জন্যে নিজ হাতে মজার মজার খাবার রান্না করে রাগ ভাঙাবে। ইরিনের কাছে শুনেছিল কুহু নাকি অনেক ভালো রাঁধতে জানে। মায়ের ডাকে কলরবের ভাবনায় ছেদ পড়লো। হাসিমুখে দরজা খুলে মাকে জড়িয়ে ধরে বললো,- ড্রামা কুইন চলো আগে ইরিনকে আদর করবে তারপর আমি খাব।কলরবের মা মুখ বাকিয়ে বললেন,- চলুন নবাবজাদীর কাছে যাই।চলবে...পর্ব:৩০হাসনাদ সাহেব কলরবদের বাসার সামনে গাড়িতে বসে আছেন। গাড়ির জানালার কাঁচের মধ্য দিয়ে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছেন। অনেক্ষণ হলো তিনি একই ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছেন। ড্রাইভার শামসুর ডাকে হুশ ফিরলো। ড্রাইভার শামসু বিনয়ের স্বরে বললেন,- স্যার আমি কি আফনারে ভুল ঠিকানায় নিয়া আইছি?হাসনাদ সাহেব আচমকা বলে ফেললেন,- ভুল ঠিকানারে সামসু বড্ড বড় ভুল ঠিকানা।পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলেন হাসনাদ সাহেব। তারপর এমন একটা ভাব করলেন যেন মশকারা করেছেন। ইয়ার্কির সুরে বললেন,- সোনার হরিণের খোঁজ করতে তো মানুষ বনে যায় আমি লোকালয় এসেছি তাই মজা করে বললাম।শামসু এই পরিবারটাকে খুব ভালোবাসে। যতো দেখে ততো মুগ্ধ হয়। সুন্দর করে নরম স্বরে কথা বলা যেন এদের বংশের পরম্পরা। ওরা ইয়ার্কি ঠাট্টাও করে নরম স্বরে, কেমন যেন একটা ভদ্রতা মেশানো থাকে। হাসনাদ সাহেব গাড়ি থেকে নেমে কলরবদের বাড়ির গেইটে ঢুকলেন। ঢুকার আগে নেইমপ্লেট পড়লেন "সালাউদ্দিন ভিলা"। হাসনাদ সাহেব বুঝে নিলেন এই বাড়িটায় ইরিনরা ভাড়া থাকে। তিনি যতোদূর জানেন ইফতেখার সাহেবের বাবার নাম ইলিয়াস আহম্মেদ। আর দাদার নাম ইদ্রিস আহম্মেদ। সালাউদ্দিন নামের কেউ নেই উনার। তাই বাড়িটায় যে তারা ভাড়াটে হাসনাদ সাহেব শিউর। তিনি সিঁড়ি দিয়ে ধীর পায়ে উঠলেন। তারপর তিনতলার ডান দিকের ফ্ল্যাটটায় কলিংবেল চাপলেন। একটুখানি দাঁড়াতেও হলো না হাসনাদ সাহেবকে। প্রায় সাথে সাথে একজন দরজা খুলে দিলো। হাসনাদ সাহেব দেখলেন উনার সামনে পুরো ছয় ফুটের এক যুবক দাঁড়িয়ে। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, দেহের গড়ন মাঝারী। মেদবহুলও নয় কৃশকায়ও নয়। চোখ দুটিতে বুদ্ধির ঝিলিক। হাসনাদ সাহেব আনদাজ করে নিয়েছেন যুবকটি কলরব, ইরিনের ভাই। কলরব শান্ত কণ্ঠে হাসনাদ সাহেবকে সালাম দিলো। হাসনাদ সাহেব সালামের উত্তর দিলেন। তারপর কিছুটা কেশে বললেন,- আমি কূজনের বাবা।কলরব মনে করলো সে ভুল শুনেছে তাই একমিনিট সময় নিলো ভাবার জন্য। একটুখানি ভেবেই হিসাব কষে ফেলেছে সে। তারপর দ্বিধা না করে আন্তরিক ভঙ্গিতে হেসে বললো,- আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল! আসুন ভিতরে আসুন।- ওয়ালাইকুম আসসালাম। তোমার বাবা মা বাসায় আছেন?- জ্বি আঙ্কেল। আপনি বাইরে দাঁড়িয়ে কেনো? ভিতরে আসুন।হাসনাদ সাহেব একটু ইতস্তত: করে বললেন,- ইরিন আছে?কলরব ঠোঁটে ঈষৎ হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,- জ্বি আঙ্কেল আছে। আপনি আগে ভিতরে আসুন প্লিজ।হাসনাদ সাহেব কলরবের পিছন পিছন ভিতরে ঢুকলেন।উনাকে বসতে বলে কলরব গেলো তার মাকে ডাকতে। মায়ের ঘরে ঢুকেই কলরব বিস্ময়ের সাথে বললো,- মা আঙ্কেল এসেছেন!কলরবের মা বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসেছিলেন। পা দুলাতে দুলাতে বললেন,- কোন আঙ্কেল?- কূজনের বাবা।কলরবের মা ছেলের কথা শুনে পা দোলানো বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথা ঢেকে বললেন,- খবরদার ইরিন যেন ওর ঘর থেকে না বের হয়।কলরব কিছু একটা বলতে যাবে তখন মা বললো,- কোনো কথা শুনতে চাই না। তোর বাবা আছে??কলরব বিরক্তি মেশানো কণ্ঠে জবাবা দিলো,- না বাবা এখনও স্কুল থেকে ফিরেনি।সাহরা খাতুন ছেলের সঙ্গে কথা বলে আর সময় নষ্ট করলেন না। সোজা রান্নাঘরে যেয়ে দশ মিনিটে ট্রে তে নাস্তা সাজালেন। তারপর কলরবকে ডেকে বললেন ড্রয়িংরুমে ট্রেতে রাখা নাস্তাগুলো নিয়ে যেতে। হাসনাদ সাহেব তখন চমৎকার করে সাজানো ড্রয়িংরুমটা মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন। এর আগেও দুইবার এসেছেন কিন্তু এতো করে খুঁটিয়ে দেখেননি। আজ কেনো দেখছেন তাহলে? আজ কি কেনো এই রুমে এতো চাঞ্চল্য খুঁজে পাচ্ছেন? হাসনাদ সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর হুট করেই মনে হলো চিরচেনা সেই বহু আকাঙ্খিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছেন। যে কণ্ঠে তিনি বহু বছর আগে একবার মুগ্ধ হয়েছিলেন। তারপর আচমকাই হাসনাদ সাহেবের চোখের সামনে জাহরার ভুবনভুলানো সেই হাসিমাখা মুখশ্রী ভেসে উঠলো। হাসনাদ সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন সাথে নিজেকে ধন্য মনে করলেন জাহরার মতো এতো ভালো জীবনসাথী ভাগ্যে জুটেছে বলে। কলরবকে নাস্তার ট্রে হাতে আসতে দেখে হাসনাদ সাহেবের কপালে ভাঁজ পড়লো। কলরব সেন্টার টেবিলে ট্রে রাখতেই কলরবের মা কলরবের পিছন পিছন ভিতরে এসে বললেন,- আসসালামু আলাইকুম।হাসনাদ সাহেব বেশ সাবলীলভাবে সালামের উত্তর দিয়ে বললেন,- ইফতেখার সাহেব বাসায় আছেন?- না এখনও স্কুল থেকে ফিরেনি।কলরবের মা কলরবকে ইশারায় হাসনাদ সাহেবকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিতে বললেন। কলরব হাসনাদ সাহেবের হাতে চায়ের কাপ তুলে দিলেন। হাসনাদ সাহেব কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,- চা কি ইরিন বানিয়েছে?কলরবের মা ভাবলেশহীনভাবে জবাব দিলেন,- না।হাসনাদ সাহেবের মুখখানা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। তিনি করুণ মুখ করে বললেন,- ইরিনকে একটুখানি ডেকে দেওয়া যাবে? ওর সাথে দেখা করতে এসেছি।সাহরা বেশ সাবলীলভাবে বললেন,- না দেখা করতে দেয়া যাবে না।হাসনাদ সাহেব প্রথমে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। কলরবও যেন একদম স্তম্ভিত হয়ে গেছে। হাসনাদ সাহেব নিজেকে সামলে নিয়ে চায়ের কাপটা টেবিলে নামিয়ে রাখলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে শান্তস্বরে বললেন,- কেনো জানতে পারি কি?- অবশ্যই জানতে পারেন। আপনি যেমন আপনার বউ বাচ্চা কার সঙ্গে দেখা করবে আর কার সঙ্গে দেখা করবে না তা নিয়ন্ত্রণ করেন তেমনি আমিও আমার সন্তান বা স্বামী কার সঙ্গে দেখা করবে সে বিষয়ে এখতিয়ার রাখি।হাসনাদ সাহেবের ঠোঁট কাঁপতে লাগলো, মাথার রগ টনটন করতে লাগলো। মনে হচ্ছে এখনই ছিঁড়ে যাবে। তারপরও যতোটুকু সম্ভব নিজের রাগ সংবরণ করে তিনি বললেন,- আপনি শুধু শুধু ইরিনকে মারলেন কেনো? বাচ্চা একটা মে..হাসনাদ সাহেবের কথা শেষ না হতেই সাহরা বললেন,- বাচ্চা মেয়েটা আমার আমি তাকে কি করবো না করবো সেটা আমার ব্যাপার।- দেখুন আপনি এভাবে শুধু শুধু পারিবারিক ঝামেলার মাঝে ইরিনকে না আনলেই পারতেন।- আপনিও এতো আগের একটুখানি ঘটনায় এতো বছর ধরে রিএক্ট না করলেও পারতেন।হাসনাদ সাহেব এবার বেশ উঁচু স্বরে বললেন,- আপনার কাছে এটা একটুখানি মনে হয়????চলবে....