#একটুখানি#Lamyea_Chowdhuryপর্ব:৩১
কলরবের মায়ের ইচ্ছে হলো একটুখানি ঢং দেখিয়ে কিছু একটা বলবে। কিন্তু বললেন না। ছোটবোনের হাজবেন্ডের সাথে রঙ তামাশা মানায় না। সাহরার আফসোস হতে লাগলো কেনো তিনি বড় হলেন। ছোট হলে কূজনের বাবা দুলাভাই হতো তখন বেশ মজা করতে পারতেন। নিজের ইচ্ছাটা দমিয়ে রাখলেন নিজের মাঝেই। তারপর বললেন,
- কেনো কি করেছিলাম আমি? তারপর একটু ভাবলেন। মনে মনে খুব করে চাইছেন রসিকতা করতে তাই আর পেরে উঠলেন না নিজের সঙ্গে। রসিকতার সুরে বলেই ফেললেন,- কেনো আপনার বিয়ের ঘটকালি করেছি তাই??? বিয়ে থেকে তো সব পুরুষ মানুষই পালাতে চায় তাই বলে এখনও???????তারপর বিস্ময়ের চাহনি নিয়ে তাকালেন হাসনাদ সাহেবের দিকে। হাসনাদ সাহেব দাঁত দিয়ে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে বললেন,- আপনি কি আমার সঙ্গে মজা করছেন?- ধরে নিন তাই।কলরব মায়ের এরকম আচরণে অভ্যস্থ কিন্তু কূজনের বাবার সঙ্গেও যে তিনি এমন করতে পারেন ভেবেই অস্ফুট স্বরে বললো,- উফ্ ড্রামাকুইন!হাসনাদ সাহেব আঙ্গুল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বললেন,- আমি ইরিনের সাথে দেখা করেই চলে যাব। ওর জন্য একটা গিফ্ট কিনেছিলাম, সেটা সে ফিরিয়ে দিয়েছে। গিফ্টটা দিয়েই চলে যাব।কলরবের মা আন্তরিকতার সাথে বললেন,- আরে এখনই চলে যাবেন মানে কি? দুই তিন দিন থেকে তারপর যাবেন। ওদের বাবা খুব খুশি হবে আপনাকে দেখলে।আর নিকটআত্মীয়ের বাসায় এসে এভাবে চলে যাওয়া যায় না।হাসনাদ সাহেবের মাথার উপর দিয়ে মনে হলো ঘূর্ণিঝড় গেল। চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়লো।মনে মনে ভাবলেন বাহ্বা মহিলা তো! কি বলে, কি করে কিছুরই ঠিক নেই। কলরব নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেললো কিন্তু কিছু বললো না। কিন্তু মায়ের সবগুলো কথা খুটিয়ে খুটিয়ে বিশ্লেষণ করলো। কলরব আর কূজন সবটাই জানে কিন্তু ইরিন কিছুই জানে না। কলরব আসার সময় দেখে এসেছে ইরিন ঘুমোচ্ছে। কলরব ভাবতে ভাবতে খেয়ালই করলো না হাসনাদ সাহেব কখন বেরিয়ে গেছেন। হাসনাদ সাহেব তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন। গাড়ির সামনে যেয়ে গাড়িতে পা দিয়ে লাথি বসালেন। তারপর ব্লাডি হেল বলে শামসু ডেকে বললেন পানির বোতল দিতে। শামসু হাসনাদ সাহেবকে হঠাৎ এমন রূপ ধারণ করতে দেখে ভয় পেয়ে গেল। পানির বোতল বাড়িয়ে দিতেই হাসনাদ সাহেব চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,- হাতে ব্যাথা করে তোমার? বোতলের মুখটা খুলে দিতে পারোনি?শামসু তাড়াতাড়ি করে বোতলের মুখ খুলে গাড়ির জানালা দিয়েই হাসনাদ সাহেবের দিকে বোতল বাড়িয়ে দিল। হাসনাদ সাহেবের হাত কাঁপছিল তাই বোতল নেওয়ার সময় পানি কিছুটা শার্টের হাতায় পড়েছে। গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে অর্ধেক বোতল খালি করলেন। তারপর একটু সাইড হয়ে মাথায় পানি ঢাললেন। শামসু তাড়াতাড়ি করে গাড়িতে থেকে নেমে গাড়ির পিছনে রাখা টাওয়াল হাতে দৌড়ে গেলেন হাসনাদ সাহেবের দিকে। পুরো বোতল খালি করেই বোতলটা ছুঁড়ে ফেললেন রাস্তায়। তারপর হাত বাড়িয়ে টাওয়াল নিয়ে মাথা মুছলেন। তারপর টাওয়ালটা শামসুর কাঁধে রেখে বললেন,- থেঙ্কস।হাসনাদ সাহেবের মুখে হাসি দেখে শামসুও হাসলো। একটি আগের হাসনাদ সাহেবকে বড্ড অচেনা লাগছিল তার। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে শামসু বললো,- স্যার কূজন ভাইরে বা মেডামরে খবর দিমু? আফনের শরীর কি বেশি খারাপ।- আরে না না শরীর খারাপ না। তুমি যাও গাড়িতে বসো আমি এখনই আসছি।- ঠিক আছে স্যার।..মায়ের ডাকে কলরবের ভাবনায় ছেদ পড়লো।- কিরে ইরিন কি করছে?কলরবের টনক নড়লো। তারপর বললো,- ঘুমোচ্ছে।কলরব সামনে তাকিয়ে খেয়াল করলো হাসনাদ সাহেব নেই। একটুও অবাক হলো না। এটাই তো হওয়ার ছিল। তারপর দুই হাত দুদিকে বাড়িয়ে মাকে প্রশ্নবিদ্ধ করলো কলরব।- মা বেশি হয়ে গেলো না?- কি আমার ড্রামা?কলরব হেসে ফেললো। তারপর ট্রে ভিতরে নিয়ে যেতে লাগলেই মা বললো,- কি করছিস?কলরব নাটকীয়ভাবে বললো,- তোমাকে হেল্প! কলরবের মা ছেলের গাল টিপে বললেন,- ওলে বাবালে! আমার ছেলেটা তাহলে বোঝাতে চাইছে যে আমাকে হেল্প করার জন্য হলেও কাউকে দরকার। কলরব বললো,- উফ্ফো নতুন নাকি? আমি তো সবসময়ই তোমাকে হেল্প করি।কলরবের মা ছেলের চুলে হাত বুলিয়ে বললেন,- উফ্ বাপের মতো কতো লম্বা হয়েছিস নাগাল পাওয়া যায় না তোর। - আচ্ছা সরো এখন এগুলো কিচেনে রেখে আসি।- লাগবে না বললাম তো।কলরব বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,- কেনো?তখনই হাসনাদ সাহেব বাইরে দাঁড়িয়ে কলিংবেল চাপলেন। দরজা খুলাই ছিল। তিনি যাওয়ার পর আর লাগানো হয়নি। তারপরও ভদ্রতা দেখালেন তিনি।কলরবের মা ফিসফিস করে বললেন,- এই জন্য।কলরব পিছন ফিরে দেখলো হাসনাদ সাহেব দাঁড়িয়ে।তিনি সেখানে দাঁড়িয়েই নির্বিকার ভাবে বললেন,- ইরিনের সাথে দেখা করবো বলেছি শুধু। কিছু বিষয় ক্লিয়ার করা দরকার। যেমন ধরুন ইরিন কূজনকে ভুল বুঝছে সেটা ওকে বোঝাতে হবে। তাছাড়া আমিও তখন জানতাম না ইরিন আপনার মেয়ে তাই উল্টাপাল্টা ভেবে বসেছি। কূজন আর ইরিন যে শুধুই ভাইবোন তা যে আমি জানতাম না সেটা ওকে জানিয়ে দিতে এসেছি। কলরবের মা মিথ্যে ভাব দেখানো ভঙ্গিতে বললেন,- এতো কিছু জানার দরকার নেই।হাসনাদ সাহেব এবার আর অবাক হলেন না। তিনি গম্ভীর হয়ে বললেন,- কি করলে আপনার মেয়ের সাথে দেখা করার এপয়েন্টমেন্ট পেতে পারি?কলরবের মা হেসে বললেন,- জাহরার রেফারেন্স আর কূজনের সরাসরি এন্ট্রেন্স। হাসনাদ সাহেব ভাবলেশহীনভাবে বললেন,- ঠিকাছে কূজন আজ বিকালের মধ্যেই হাজির হয়ে যাবে। আমার আজ বিকালে মিটিং আছে তাই আমি কাল সকালে এসে ইরিনের সাথে কথা বলবো। কথা শেষে তিনি চলে যেতে নিলেন। কলরবের মা বাধা দিয়ে বললেন,- চা টা খেয়ে যান। আগামীকাল আপনার সোনার হরিণ আপনাকে শুধু চা না পায়েশ রেঁধেও খাওয়াবে। হাসনাদ সাহেব আর না করলেন না। ভিতরে এসে সোফায় বসলেন। কলরবের মা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চা গরম করে আনলেন। হাসনাদ সাহেব চা খেয়েই চলে গেলেন। কলরব পুরো ঘটনা দেখে মাকে জড়িয়ে ধরে বললো,- ড্রামা কুইন মা আমার তবে গ্রেট!কলরবের মা কলরবের কলার নাচিয়ে বললেন,- তোর বউটা খুব সহজ সরলরে কলরব। খুব ভালো নাচাতে পারবো।কলরবও মজা করে বললো,- ভালোই হলো আমি বিনা টিকিটে হিরোইনের নাচ দেখতে পারবো।..কূজন খুব খুশি। গতকাল রাতে লাগেজ থেকে সব জিনিশপত্র নামিয়ে রেখেছিল। আজ আবার লাগেজ গুছাচ্ছে তবে একটুও বিরক্ত লাগছে না। খালামণি যে কীভাবে সব ম্যানেজ করে কূজন ভেবে কূল পায় না। কূজন খুব খুশি আজ। লাগেজ গুছাচ্ছে আর গুনগুন করে গাইছে," ধীরে ধীরে সে মেরে জিন্দেগী মে আনাধীরে ধীরে সে মেরে দিলকো চোরা নাতুমসে পিয়ার হামে হে কিতনা জানে জানাতুমকো মিলকার হে তুমকো বাতানা।"কূজন সব গুছিয়ে নিল। ডায়েরীটা ও নিতে ভুললো না সে। লাগেজ গুছিয়ে মা- বাবাকে বলে রওনা হলো ফেণীর উদ্দেশ্যে।চলবে......পর্ব: ৩২কুহুর বাবা তৈয়ব সাহেব কুহুর মুখোমুখি বসে আছেন। কুহু হাসি হাসি চেহারা করে বাবাকে বললো,- আব্বু কিছু বলবে নাকি?- হুম বলবো।- বলো!- তোর মা আর পিহু আসুক তারপর বলবো।- ঠিক আছে।কুহুর মা কবরী এলেন চা নিয়ে। পিহু আর কুহু পাশাপাশি বসে চা খাচ্ছে সাথে ওদের কথার খই ফুটছে। তৈয়ব সাহেব সাবলীলভাবেই কুহুকে বললেন,- তোর কি কাউকে পছন্দ?বাবার এমন সরাসরি প্রশ্নে কুহু হতভম্ব হয়ে গেল সাথে লজ্জাও পেল। পিহু আড়চোখে বাবা আর বোনের দিকে তাকালো। দুইজনের ভাবভঙ্গি বোঝে নিয়ে চুপ থাকা শ্রেয় মনে করলো। কুহুর বাবা আবারো বললেন,- পছন্দ থাকলে বলে দে। উপযুক্ত হলে সমস্যা নেই। সেখানেই বিয়ে দিব।কুহু লজ্জা পায়নি একটা ভাব করলো। লজ্জাটা লুকিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বললো,- বাবা তুমি না বলতে চাকুরী করার আগে বিয়ে দিবে না?- আহা আগে শোন। তবে ছেলে যদি আমার পছন্দ নাহয় মানে ফ্যামেলি আর ছেলে কি করে না করে সেসব মিলে গেলে আমার কোনো আপত্তি থাকবে না।আর সমস্যা নেই তো জব পেয়ে যাবি। ফোর্থ ইয়ার না? আর বেশি সময় নেই। এমনিতেও স্কুলে জব করতে পারিস। আর তোর মায়ের কাছ থেকে শুনলাম কিন্ডারগার্টেন এর একটা জব নাকি হয়েছে তোর?- হুম আগামী মাস থেকে করবো।- ভালো এর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। চাকুরী পেয়েছিস শুনেই তো বিয়ের চিন্তাভাবনা করছি। নাহয় আজকালকার দিনে নিজের বল না থাকলে কিছুই হয়না। পড়াশুনা শেষ করে ভালো জবই পাবি। প্রাইমারির ফর্মটা এনেছিস না?- হুম।- আশা করি ঐটাও হয়ে যাবে। তাই বিয়ের কথা ভাবছি।কুহু কি বলবে ভেবে পেল না। তৈয়ব সাহেব আবার বললেন,- কিরে বললি না যে পছন্দ আছে কিনা?কুহু বললো,- না নেই।কুহুর কথা শুনে পিহু অবাক হলো। বাবা বললেন,- তাহলে আমি আমার পছন্দ মতো ছেলে দেখি কেমন?কুহু অস্ফুট স্বরে বললো,- বাবা তোমার ইচ্ছা কিন্তু এখন না হলে হয় না?- এই বয়সেই সাধারণত আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের মেয়ে বিয়ে দিতে হয়। বড় তো হয়েছিস বুঝিসই সামাজিক একটা চাপ থাকে।কুহু আর কিছু বললো না, চুপ করে রইলো। কুহুর বাবা বললেন,- আমি উঠছি একটু বাইরে যেতে হবে।তিনি উঠে দাঁড়িয়েও কুহুর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে বললেন,- সত্যি তো কোনো পছন্দ নেই তো?- না।- তাহলে তো হলোই আর টেনশনের কিছু নেই ছেলে তোর পছন্দ হলেই তারপর ভেবে দেখবো।কুহুর মা কুহুর বাবাকে ইশারায় চুপ থাকতে বললেন। মনে মনে একশো একটা গালি দিয়ে বললেন,"পাগল নাকি বুদ্ধি সব হাঁটুর নীচে। মেয়েকে বারবার অস্বস্তিতে ফেলছে। এসব কথা তো মায়েরাই জিজ্ঞাসা করে।"কিন্তু মুখে এসব বললেন না।তৈয়ব সাহেব চলে গেলেন। কুহুর মাও আর কিছু বললেন না। পরে মেয়েকে আলাদা ডেকে কথা বলবেন। ..কূজন কলরবদের বাসার ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। বাসায় যায়নি সোজা এখানে এসেছে। হাতে ডায়েরি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কুহুর জন্য অপেক্ষা করছে। কুহু যদি এসে চলে যায় তাহলে কুহুকে দেখা মিস হয়ে যাবে।তাই এখানে দাঁড়িয়ে আছে। কুহু তো আসছে না। কেনো আসছে না ভেবে পাচ্ছে না সে। কুহুদের ছাদে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করলো। তারপর বাবাকে কল দিল। হাসনাদ সাহেব ফোন রিসিভ করে ভাবলেশহীনভাবে হ্যালো বললেন।কূজন বাবার কণ্ঠস্বর শুনেই বুঝতে পারলো বাবা এখনো রেগে আছে। কূজন শান্ত কণ্ঠে বাবাকে বললো,- বাবা একটা কথা বলার ছিল।- বলো।- বাবা আমি না কথাটা কাউকে বলিনি তোমাকেই প্রথম বলছি।হাসনাদ সাহেব কৌতূহল বোধ করলেন কিন্তু প্রকাশ করলেন না।স্বাভাবিক হয়েই বললেন,- আমাকে আবার কি কথা বলবে তুমি??? তোমার মা আর খালামণিকে না বলে আমাকে কি কিছু বলা যায় নাকি?কূজন আহত স্বরে বললো,- বাবা!- বলো কি বলবে?- বাবা আমি না কাউকে পছন্দ করি।হাসনাদ সাহেব এবার আর নিজের কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারলেন না। আগ্রহভরে জানতে চাইলেন,- কেমন পছন্দ??? কূজন একটুখানি ভেবে অস্বস্তিতে বললো,- বাবা মানে আসলে...হাসনাদ সাহেবের রাগ পুরো উবে গেছে। তিনি ছেলেকে সাহস দেবার মতো করে বললেন,- আচ্ছা নো প্রব্লেম মাই প্রিন্স। তুমি শুধু বলো কাকে ভালো লেগেছে? - বাবা ঐ যে ট্রেনে একটা মেয়ে আমাকে হেল্প করেছিল না?- ওহ্ আমি তো তেমাকে জিজ্ঞাসাও করেছিলাম।- হুম কিন্তু তখন ওকে আসলে..তারপর সব খুলে বললো। হাসনাদ সাহেব খোশমেজাজে বললেন,- ভালোবাসার কথা জানিয়ে দেয়া ভালো। তুমি মেয়েটাকে বলে দাও তুমি ওকে পছন্দ করো। আর আমি তো কাল ইরিনের সাথে দেখা করতে আসছিই তখন নাহয় ওদের বাসায় যেয়ে ওর বাবা মার সাথে কথা বলবো। কূজন অবাক হয়ে বললো,- এখনি????- এখন নয়তো কখন? ওর বিয়ে হয়ে যাবার পর?- আমি তো মাত্র পড়াশুনা শেষ করলাম। রেজাল্টও তো এখনো দেয়নি, আগামী সপ্তাহে দিবে।- আরে বাবা আমার এতো সবকিছু কার? আর তুমি তো বিজনেসই করবে চাকরির সমস্যা তো আর নেই।- তারপরো...- না না শুনো ওকে এখনি বলে দাও। কূজন দেখলো পিহু এসেছে তাই বললো,- ঠিক আছে এখন রাখছি।- ওকে মাই প্রিন্স।কূজন ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বিনম্র স্বরে বললো,- এক্সকিউজ মি!পিহু ফিরে তাকালো। দেখলো কূজন হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। পিহু জিজ্ঞাসা করলো,- আমাকে বলছেন?- জ্বি একটু প্রয়োজন ছিল। কাইন্ডলি একটুখানি সময় দিতে পারবেন?পিহু কূজনের কথা বলার স্টাইল দেখে মনে মনে বললো বেশ ভদ্রতা জানে।তারপর বললো,- বলুন।কূজন হাতের ডায়েরিটা পিহুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,- প্লিজ এটা একটু কুহুকে দিবেন।পিহু হতভম্ভ হয়ে তাকিয়ে রইলো কূজনের দিকে।কূজন অনুনয় করে বললো,- প্লিজ একটু দিয়ে দিবেন কি? অনেক উপকার হতো।পিহু ডায়েরিটা নিতে চাচ্ছে না কিন্তু এতো অনুনয় করে বলেছে নাও করতে পারছে না। তারপরো পিহুর মতো মেয়ে অন্যের কিছু দ্বারা সহজে প্রভাবিত হয় না। তাই কূজনকে বললো,- আপুরটা আপুর কাছেই দিবেন।- ঠিক আছে থেঙ্ক ইউ। কূজন পিহুকে আর কিছু বললো না। পিহু চলে যেতে নিল তারপর কি মনে করে যেন আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো,- ঠিক আছে দিন।কূজন ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললো,- অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।চলবে....পর্ব:৩৩কলরব এইবার আবার বিসিএস পরীক্ষা দিবে তাই জোরসে পড়াশুনা শুরু করেছে। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর যে পড়া শুরু করেছে এখনো পড়ছে। কলরবের মা ছেলের জন্য চা আর বিস্কুট নিয়ে এসেছেন। পড়ার টেবিলে চায়ের কাপ আর পিরিচ রেখে ছেলের বিছানায় বসলেন। কলরব পড়তে পড়তেই বিস্কুট মুখে দিল। একটুখানি চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই আবার বইয়ে চোখ বুলাচ্ছে। কলরবের মা বসে বসে গুনগুন করে গান গাইছে। কলরব আস্তে করে ববললো,- মা ডিস্টার্ব হচ্ছে।কলরবের মা ছেলের কথায় সিরিয়াস হয়ে চুপ হয়ে গেলেন। কলরব যখন কাপে দ্বিতীয় চুমুক দিল কলরবের মা ঠিক তখন সিরিয়াস হয়ে বললো,- আচ্ছা এই রুমে তো তুই একা থাকিস কূজন আসলে ভালোই করে। গেস্ট রুমে না থেকে তোর রুমে থাকে।কলরব অস্ফুট স্বরে বললো,- হুম।কলরবের মা কণ্ঠে বেদনা মিশিয়ে বললেন,- কূজন চলে গেলেই তোকে আবার একা থাকতে হবে তারচেয়ে বরং কুহুকে নিয়ে এলে ভালো হবে। কলরব অন্যমনস্ক হয়ে অস্ফুট স্বরে জবাব দিল, - হুম।হুম বলে নিজেই ভ্যবাচ্যাকা খেয়ে গেল সে। তারপর ঘুরে তাকালো মায়ের দিকে।কলরবের মা পা দুলাতে দুলাতে বললেন,- এক ঢিলে মানুষ দুই পাখি মারে কিন্তু আমি তিন পাখি মারি।কলরব অবাক চাহনী নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে।কলরবের মা ছেলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলতে লাগলেন,- ইরিনের টিচার, আমার কিচেন পার্টনার আর তোর লাইফ পার্টনার। এই হলো তিন পাখি।কলরব একটুখানি কেশে বললো,- মা আমি এখন পড়ছি।কলরবের মা বিছানা ছেড়ে দরজার দিকে এগুতে এগুতে বললেন,- পড় পড় এখনি যা পড়ার পড়ে নে। কুহু এলে পড়ায় তখন একটুখানিও মন বসবে না। মা চলে যেতেই কলরব টেবিলের দিকে মুখ করে বসলো। হাতে থাকা কলমটা দিয়ে পড়ার বইয়ে যে পৃষ্ঠা খুলা আছে সে পৃষ্ঠায় ছোট করে লিখলো "আই ডু লাভ ইউ কুহু".কূজন খুশি মনে কলরবদের বাসার কলিংবেল চাপলো। ইরিন তখন দরজার কাছ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। কলিংবেলের শব্দে ইরিন দরজার নবে হাত দিল তারপর হঠাৎ করেই তার মনে পড়লো এখন তো কূজনের আসার কথা। যদি কূজন হয়ে থাকে? শিউর হওয়ার জন্য দরজার ম্যাজিক আই এ চোখ রাখল। ইরিন ঠিক ঠিক দেখতে পেল কূজন দরজার ওপাশে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। কূজনকে দেখেই ইরিনের চোখ মুখ কুঁচকে গেল। দরজা না খুলেই সে চট করে নিজের রুমের দিকে পা বাড়াল। ঠিক তখনই কলরবের মা কলরবের রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। কলিংবেল বাজছে কিন্তু ইরিন দরজা না খুলে রুমে চলে যাচ্ছে তা দেখে বিরক্ত হলেন কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। এমনিতেও সেদিন মেয়েটাকে অনেকখানি মেরেছেন। ইরিনকে কিছু না বলে সাহরা গিয়ে দরজা খুললেন। কূজন খালামণিকে জড়িয়ে ধরেই বললো,- থেঙ্ক ইউ খালামণি।- আগে ভিতরে আয় তো। তোর ভোঁতা বাপের কথা বলবো তোকে। কীভাবে যে ম্যানেক করেছি! বেশ বেগ পেতে হয়েছে।কূজন খালার কথায় হাসলো। .পিহু বসে আছে কূজনের ডায়েরি হাতে নিয়ে। ডায়েরিটা যদি কূজনের না তো তাহলে সে খুব ইন্টারেস্ট নিয়ে ডায়েরিটা পড়তো। কিন্তু কূজনের ডায়েরির প্রতি পিহুর কোনো ইন্টারেস্টই নেই। কারণ সে নিশ্চিত কূজন এটায় কবিতা দিয়ে ভরে রেখেছে। পিহু ডায়েরিটা হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখছে। কালো রঙের বেশ সুন্দর একটা ডায়েরী। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ডায়েরিটা বেশ দামি। হাজার বারোশো টাকা তো হবেই। পিহু ডায়েরিটা পড়বে না পড়বে না বলেও খুললো। প্রথম পাতায় দেখলো অনেক সুন্দর করে কূজন নিজের নাম ঠিকানা লিখে রেখেছে। পিহু কূজনের হাতের লিখা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। এত সুন্দর করে লিখা যে মনে হচ্ছে প্রিন্ট করা। পিহুর 'ক' লিখাটা খুব বিশ্রী হয় তাই সে কূজনের মতো করে নিজের খাতায় 'ক' লিখলো। কূজনের মত এত সুন্দর না হলেও খারাপ হয়নি। পিহু শুধু হাতের লিখার জন্য পরের পাতা উল্টে দেখলো। সেখানে সুন্দর করে কূজন লিখে রেখেছে,"যখন তোমার দুচোখ দিয়ে ঝর্নাধারা বয়তখন আমার অন্তরেতে রক্তক্ষরণ হয়।চোখে যখন ভাসে তোমার বিষাদমাখা মুখআমার তখন সন্ধ্যে নামে, দু:খে ফাটে বুক।আমি কি কখনো পাবো সেই অধিকারভালোবাসার পরশ দিয়ে অশ্রু মোছার??".পিহু এই কবিতা পড়ে মুখ বাকালো। তারপর বিড়বিড় করে বললো অন্তরে আবার রক্তক্ষরণ কীভাবে হয়??কবিতার নীচেই ছোট করে লিখা,*একটুখানি চোখের দেখায়,সময়গুলো থমকে দাঁড়ায়★কুহু... আমার বিশাল আকাশে ভাবনার একটা সুখ তারা তুমি... কুহু... অপেহ্মার চাতক পাখির ন্যায় আমার চোখ জুড়ানোর পলক তুমি... কুহু...আমার অপেহ্মার অবসানের এক পশলা হাসি তুমি.... কুহু...তুুমিই আমার প্রেয়সী... "ভালবাসি"পিহুর চোখ কপালে উঠলো। পিহু ভেবেছিল কুহু কবিতা পছন্দ করে তাই বোধহয় কূজন ডায়েরিতে লিখা সব কবিতা কুহুকে পড়ার জন্য দিয়েছে। কিন্তু এই ঘটনা দেখে পিহু একটার পর একটা কবিতা পড়তে লাগলো।#অন্তরবাসিনিঅন্তরবাসিনি, প্রথম যেদিন দেখেছিলাম তোমায়অপূর্ব প্রকৃতির মধ্যে প্রকৃত রুপ পাশের জানালায়।খোলা চুল উড়ছিল বাতাসে।উড়ছে এলো চুল ,নাকি উড়ছে আমার মন? বুঝিনি সেদিন হৃদয়ের আয়নাখানিএঁকেছে তোমার ছবি মায়াবী ও চোখ খানি,জোড়া ভ্রু জুগোল, কাজল চোখ হরিণী।ওহে অন্তরবাসিনি সেই তো প্রথম দর্শন।হারিয়েছি কখন বুঝতেই পারিনিআমার অবুঝ শান্ত সরল মনখানি।কি জাদু দিয়ে করেছো হরণজানিনা তার কোনো বিবরণ।শুধু জানি আমার অবুঝ হৃদয়ই নয়এঁকেছে সে ছবি আমার দুই নয়নখানি।শয়নে, স্বপনে, নিভৃতে, নির্জন জাগরণেচোখ বুজলেই ভেসে ওঠে মায়াবী মুখখানি ওহে অন্তরবাসিনি।হৃদয়ের মাঝে কুহু কুহু সুরে গেয়ে যায় গান খানি।মনের জানালা খুলে বসে আছি আশায় আশায়সেই প্রথম দর্শন পাই যদি একটুখানি।সমগ্র জিবন কাটিয়ে দিতে চাই, হাতে রেখে হাতচোখে রেখে চোখ, চেয়ে থাকতে পারি অপলক।ওগো অন্তরবাসিনি তোমার মনে কি আছে জানিনা,আমি ভাবি আমার শুধুই তুমিময় ভাবনা শুধু তুমি তুমি করে কাটে আমার দিনরাত।নিজের অজান্তেই ভালবেসেছি তোমার অশ্রুখানি! ওহে অন্তরবাসিনি ভালবেসে আমায় গ্রহণ কোরো একটুখানি।।।.#বাতায়নবর্তিনী"ওগো বাতায়নবর্তিনী,শোন একটুখানি। তোমার ঐ হাসিমুখএনেছে আমার স্বপ্নসুখ।থাকি যখন আধোঘুমেপরী হয়ে আসো নেমে,থাকো তুমি বসেজানালার পাশে।আমার সকল গানের সুরেআমার পুরো হৃদয় জুড়েআছে শুধু তোমার হাসি।আমি তোমায় ভালোবাসি।".পিহু একেকটা কবিতা পড়ছে আর একেকবার সপ্তম আকাশ থেকে পড়ে কোমায় যাচ্ছে। ডায়েরিটা বন্ধ করে ঘড়িতে সময় দেখে নিল সে। কুহু কোচিং এ গেছে। আসতে আরো আধা ঘন্টা বাকি। তারপর ডায়েরি খুলে আবার পড়তে শুরু করলো।হয়তো সেদিন চেয়েছিলাম বলতেকিন্তু পারিনি বলতে তোমায়আজ বলবো ভাবছিহয়তো আজো পারবোনা বলতে ভলোবাসি ভালোবাসিকি আছে এই চার অক্ষরের মাঝে?আজও কেনো পারিনি বলতেতুমি কি বুঝেছিলে সেদিন?নাকি আজও বোঝোনিহৃদয়ের গহীনে থাকাআমার মনের কথাভালেবাসি তোমায় ভালোবাসি।।।।Love u kuhu....প্রথম যেদিন দখলে নিয়েছিলে জানালার পাশের সিটটা,হয়তো সেদিনি হরণ করেছিলে এ হৃদয় টা।ছাদে দাঁড়িয়ে একটুখানি তোমার দেখায়,মন যে ভরেনা, সারটি জীবন তোমায় দেখতে চাই।একটুখানি ধরবে কি আমার হাত?রইবেকি চিরোকাল আমার পাশে?ভালবেসে পরম আবেশে রাখতে চাই, তোমায় আমারি চারিপাশে।.প্রিয় ''কুহু'', আছো আমাতে মিশে, জানিনা কি হবে, এ জীবনের শেষে.....রাখবো তোমায় এ বুকে ধরে,কখনো যাব না তোমায় ছেড়ে।."তুমি হরণ করেছো মোরে মায়াজালে।এলোমেলো করে দিয়েছো আমার সুরকে।আমি সুর তুলেছি তোমার জন্য গিটারে।হারিয়েছি তোমার মায়াবী চোখে।".আমি ডুবতে চাই * তোমার চোখের সাগরে*জড়াতে চাই তোমায় *আমার ভালবাসার চাদরে *আমি হাটতেঁ চাই তোমার সাথে *শুরু থেকে পথের শেষে*হঠাৎ থমকে গিয়ে বলতে চাই্ধন্য তোমায় ভালবেসে*পিহু কবিতা পড়তে পড়তে হাপিয়ে গেছে। এত কবিতা মনে হয় সে সারাজীবনেও পড়ে নাই। ডায়েরি প্রায় শেষের দিকে। পাঠ্যবইয়ের কবিতার বাইরে জীবনে বোধহয় এই প্রথম পিহু কারো কবিতা পড়ছে। যদিও বোরিং লাগছে তার কাছে তাও সে বাকি পৃষ্ঠাগুলোও পড়লো। যখন দেখলো শেষের পাতায় আছে তখন খুশিতে জোরে জোরেই পড়লো,তুমি দূরে বহুদূরে,কখনো কি পারবো না ছুঁতে তোমাকে?আমি ছুটে চলেছি এক মরীচিকার পিছনে,ধুধু মরুভূমির প্রান্তরে।কখনো কি পারবো না ছুঁতে তোমাকে?ছুটতে ছুটতে আজ আমি ক্লান্ত..ভেবো ননা থেমে যাব।তোমারি প্রতীক্ষায় আজ আমি পরিশ্রান্ত!অভিমানী মন আআজো তোমার অপেক্ষাতে।আমার মন কখনো কি পারবে না ছুঁয়ে দদিতে তোমাকে?অভিমানী মন আজো তোমারি অপেক্ষাতে।"এতবড় বোরিং ডায়েরিটা পড়ে শেষ করে পিহুর মনে হচ্ছে সে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ থামিয়েছে।চলবে...পর্বঃ৩৪কূজনের ডায়েরি পড়ে পিহু মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। চেহারায় বিরক্তি আর বিস্ময়ের দারুণ সংমিশ্রণ। বসে বসে গুনগুন করে "নো ব্রেইনার" গানটা গাইছে। তার কাছে কূজনকে তাই মনে হচ্ছে। আজাইরা থেকে গজাইরা গীত গায় এই ছেলে। নাহ্ গীত আজাইরা না সেটা বেশ সুন্দরই গায় তবে এই কবিতাগুলো সেই মাপের দারুণ রকমের ফালতু লাগছে পিহুর কাছে। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে টেবিলের উপর পা তুলে রেখেছে পিহু। নিজেকেও এখন ব্রেইন ছাড়াই মনে হচ্ছে। সে বুঝলো না কেনো কূজন যে কুহুকে পছন্দ করে? অথচ এসব ব্যাপারে তো সে নিজেকে ডক্টরেট ভাবতো। আজ প্রমাণ পেল আসলে এতোটাও বুঝে না সে। আর বুঝবে কীভাবে? আদৌ কূজনের কোনো আচরণে কি এমন কিছু ছিল নাকি? এই সুইট বয় তো সবার সাথে কিউট মার্কা হাসি ঝুলিয়েই কথা বলে। তারপর ছাদে গেলেও তো কুহুর দিকে তাকায় না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খালি প্রকৃতি দেখে। পিহু ভাবছে সবটাই কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে গেছে। একে তো কলরব, কূজন দুই ভাই। দুইজনই কুহুকে পছন্দ করে। তার উপর কুহু আবার কনফিউজড কাকে পছন্দ করে। পিহু ভাবছে কুহু ডায়েরিটা পড়ার পর কি সিদ্ধান্ত নিবে। নিশ্চই পটে যাবে। পিহু তো তার বোনকে চিনে। কবিতার প্রতি দুর্বলতা তার তুঙ্গে। যাক তাহলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। পিহু ভাবছে কুহু শুধু কাকে পছন্দ করে সেটা বুঝলেই হল। কলরব,কূজন যাকে ইচ্ছা চুজ করুক কিন্তু বুঝেশুনে যাতে চুজ করে।কিন্তু আব্বু যে আবার বিয়ে দেখছে? উফ্ সবদিক দিয়ে ঝামেলা আর ঝামেলা। আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতেই পিহু ঘড়ির দিকে তাকালো। সন্ধ্যা ছয়টা বেজে যাচ্ছে। এতক্ষণে তো কুহুর বাসায় এসে যাওয়ার কথা। আসছে না কেনো? পিহু কুহুকে কল করতেই রুমের ভিতর কুহুর মোবাইল বেজে উঠল। পিহু চেয়ারে বসেই মাকে ডাকল।- কি হল ডাকছিস কেনো?- আম্মু আপুণি এখনো এলো না আবার মোবাইলও নিয়ে যায়নি।- ওহ্ তোর বড় খালার বাসায় গেছে।পিহু কাঁদো কাঁদো চেহারা করে বললো,- আমাকে নিয়ে যায়নি কেনো?- তোর না পরীক্ষা চলছে??- তো কি হয়েছে এখান থেকে এখানেই তো।- না যাওয়া লাগবে না পরীক্ষা শেষে যাস আর কুহু কালকেই এসে পড়বে।- ঠিক আছে।মা চলে যেতেই পিহু ডায়েরিটা সযত্নে আলমারিতে তুলে রেখে দিল। কুহু আসলে কুহুকে দিতে হবে। ...ইরিন বিরক্তি মেশানো স্বরে বললো,- ভাইয়া তুমি আবার এসেছ কেনো?কূজন হেসে বললো,- তোমার বিয়ে খেতে এসেছি।ইরিন ওর বড় বড় চোখগুলো আরো বড় করে কটমটিয়ে তাকালো। কূজন ভয় পেয়ে যাওয়ার মতো অঙ্গভঙ্গি করে বললো,- সোনার হরিণ তুমি যে বড় হয়ে গেছ তা বুঝাতে তোমার টানা টানা হরিণী চোখগুলো দিয়ে আমাকে কি ভয় দেখাতেই হবে?ইরিন চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,- যাও এখান থেকে..- না যাব না। - হুহ্ যেও না থেকো আমিই চলে যাব শ্বশুড়বাড়ি।- কোথায় জঙ্গলে? হা হা হা।- এই শুনো একদম উল্টাপাল্টা কথা বলবে না।- কেনো তোমার জেরেফ তো জঙ্গলে জঙ্গলেই ঘুরে আর তুমিও তো সোনার হরিণ বনে থাকাই তো তোমার কাজ। এতো আমাদের সৌভাগ্য তুমি আমাদের লোকালয়ে থাকছো। - এই তুমি কি বলতে চাচ্ছো ভাইয়া? তুমি কি চিড়িয়াখানায় এসেছো নাকি? আমাকে কি...- আরে বাবা থামো না। আমাকে বলতে দাও..- না বলতে হবে না। শুনো জেরেফ তো অভিশপ্ত তাই লোকালয় থেকে দূরে থাকে।- আরে বাবা এইজন্যই তো বললাম তুমি কি জেরেফের কাছে চলে যাবে?ইরিন চোখ ছোট করে বললো,- ভাইয়া তুমি জেরেফকে চিনো কীভাবে?- আমিও ফেইরিটেল দেখতাম আগে। মাঝে মাঝে এখনো দেখি।- সত্যি? তেমার পছন্দের ক্যারেকটার কে?- জেরেফ।ইরিন খুশি হয়ে কূজনকে চিমটি কেটে বললো,- আমারো। জানো ভাইয়া এজন্যই তোমাকে আমার এতো ভালো লাগে। কলরব ভাইয়া তো খেলা ছাড়া আর কিছুই দেখে না। ইরিন কূজনের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কূজন খুব ভালো শ্রোতা তাই মনোযোগ দিয়ে ইরিনের কথা শুনে যাচ্ছে। রাতের খাবার খেতে সাহরা ওদের ডেকে নিতে এলো। এসেই দেখলেন ইরিন আর কূজন গল্প করছেন। এটা দেখে উনার মন খুশিতে ভরে উঠলো। একটু ভাব নিয়ে বললেন,- দুই ভাই বোনের গল্প আর কতো চলবে? - উফ্ মা যাও তো এখন ডিস্টার্ব করো না।- পরে কথা বলিয়েন আম্মাজান। এখন খাবেন চলুন।- তুমি আমাকে আম্মাজান বলবে না। আমাকে তুমি মেরেছো।সাহরা অনায়াসে বলে দিলেন,- ঠিক আছে তাহলে খালাম্মা ডাকবো।তিনজনই হেসে ফেললো তারপর এগুলো ডাইনিং এর দিকে।ইফতেখার সাহেব আর কলরব বসে ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। ইফতেখার সাহেবের হাত নিশপিশ করছে পত্রিকার জন্য। কিন্তু উনার মাষ্টারনীর কড়া নিষেধ খাবার খাওয়ার সময় অন্তত যেন এটা বাদ দেয়। সাহরা প্লেটে খাবার সার্ভ করতে করতে ইফতেখার সাহেবকে ইশারায় কিছু বললেন। ইফতেখার সাহেব একটুখানি কেশে বললেন,- কলরব!- হুম বাবা বলো।- তোর জন্য মেয়ে দেখেছি আমি।কলরবের সামনে প্লেট আর পাশে কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স খোলা। সে চোখ বোলাচ্ছে পাতায়। তাই অন্যমনস্কভাবেই বললো,- ভালো কথা।ইরিন ভাইয়ের এমন আচরণ দেখে মজা করে বললো,- ছি! ছি! ভাইয়া তুমি বিয়ে করার জন্য এতো পাগল হয়ে গেছ????ইরিনের কথায় সবাই হেসে ফেললো। কলরব হাসির শব্দে ওদের দিকে তাকালো। কূজন বললো,- ইশ্ ভাই আমি যদি তোমার মতো এত ভালো স্টুডেন্ট হতাম!ইরিন ইয়ার্কি করে বললো,- তাহলে আঙ্কেলকে বলতে ভালো করেছো আমার জন্য মেয়ে দেখেছো। হা হা হা।কলরব এবার বুঝতে পারলো সবাই কেনো হাসছে। তার বাবা বলেছিল কিছু একটা বলবে কিন্তু খেয়াল করেনি কি বলেছে। কলরব নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,- আমি তখন পড়ায় মগ্ন ছিলাম।সাহরা বললেন,- এত পড়ে কি হবে? শেষে বিয়েই তো করতে হবে।কলরবের মায়ের কথা শুনে কলরবের হার্ট বিট বেড়ে গেল। ভিতরে ভিতরে সে মাইকেল জ্যাক্সেনের সবকটা স্টেপ নেচে ফেলছে। ইফতেখার সাহেব ওদের থামিয়ে বললেন,- আহা আমাকে কথা বলতে দাও তো। মেয়ের বাড়ি একটুখানি দূরে। খুলনার ওদিকে। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। এতটুকু শুনেই কলরব ভিতরে ভিতরে ঘেমে যাচ্ছে। চেহারায় স্পষ্ট বিষাদের ছাপ ফুটে উঠেছে। তার বাবা মেয়ে সম্পর্কে আরো অনেক কিছুই বলে যাচ্ছেন কিন্তু কোনো কথাই তার কানে যাচ্ছে না। সে ভেবেছিল হয়তো কুহুর কথা বলছে। কলরব কাতর দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালো। কলরবের মা নির্বিকার। কলরব যে বাবাকে না করবে সেটুকুও পারছে না। সব কথা যেন গলায় এসে আটকে যাচ্ছে। এবার সত্যি সত্যি সে ঘামতে শুরু করলো। সামনে থাকা গ্লাসটা নিয়ে এক চুমুকেই সবটুকু পানি শেষ করে বললো,- বাবা আমি এখন বিয়ে করবো না, সামনে পরীক্ষা।কলরবের কথায় ইফতেখার সাহেবের কথায় ছেদ পড়লো। তিনি থমকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,- কুহু হলেও না?সাহরা, ইরিন আর ইফতেখার সাহেব একসাথে তাল মিলিয়ে হাসতে লাগলেন। কলরব দারুণ চমকে গেল আর কূজনের পৃথিবী যেন থমকে গেল।চলবে...পর্বঃ৩৫কূজনের প্রচণ্ড মাথা ব্যথা করছে। মাথা ব্যাথা চোখ পর্যন্ত নেমে এসেছে। দুই হাতে মাথা চেপে ধরে বসে আছে। অসহ্যরকমের ব্যাথায় ছেয়ে যাচ্ছে সারা শরীর। হয়তো ব্যাথাটা হৃদয় থেকে উৎপন্ন তাই। মাথা ব্যাথাটা খাবার টেবিলেই শুরু হয়েছে। কুহুর নাম শোনা মাত্রই কূজনের মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। কুহুর সাথে কলরব ভাইয়ের বিয়ে??? মানতে কষ্ট হচ্ছে বেশ। মাথা ব্যাথা আরো বেড়েই চলেছে। ওয়াশরুমে যেয়ে চোখে মুখে পানির ছিটা দিয়ে ফিরে এসে শুয়ে আছে সে। এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না সে যে কুহু আর কলরব। বহু কষ্টে ভদ্রতা দেখিয়ে এতক্ষণ ডাইনিং টেবিলে বসে ছিল সে। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর আর যখন নিজের মনের সাথে পেরে উঠছিল না তখন টেবিল ছেড়ে উঠে এসেছে। এখন সে কি করবে? কেনো সে এখানে আসতে গেল? এখানে না আসলে হয়তো কখনো কুহুকে খুঁজে পেতো না। এটা কি বাবাকে দেওয়া কষ্টের ফল?? বাবার অবাধ্য হয়ে এখানে এসেছিলাম তাই কি??? বাবার কষ্টটা বুঝতে পারিনি তাই আল্লাহ কি আমাকেও একি কষ্টের মধ্যে ফেললেন? বুকের মধ্যে একটা চাপা আর্তনাদ শুনতে পেল সে। পাশ ফিরে শুতেই দরজা খোলার শব্দ হল। কূজন তাকিয়ে দেখলো কলরব রুমে এসেছে। মোবাইল চার্জে দিয়ে বেড়িয়ে গেল রুম থেকে। কলরব বেরিয়ে পড়তেই কূজন উঠে লাইট অফ করে মেঝেতেই বসে পড়লো। মাথাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। চোখ বন্ধ করতেই কুহুলে দেখলো আর বাবা বলে চাপা একটা আর্তনাদ করে উঠলো। আজ কেনো যেন বাবার কষ্টটা খুব করে বুঝতে চাইছে সে। বাবা কি সত্যিই ভালো আছে? নাকি মায়ের সাথে শুধু মানিয়ে নিয়েছে?? এখনো কি খালামণিকে ভুলতে পেরেছে? আচ্ছা সেদিন তো বাবা এই বাসায় এসেছিল। খালামণিকে দেখে নিশ্চই বাবার বুকেও ব্যাথা হয়েছে। যেমনটা এখন আমার হচ্ছে।আচ্ছা ভালোবাসা কি কখনো মলিন হয়ে যায়? নাকি অন্য কারো আবডালে ঢাকা পড়ে যায়? কুহুর সাথে কলরবের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর কূজনের কি কুহুর প্রতি ভালোবাসাটা থাকবে? নাকি নিঃশেষ হয়ে যাবে। কূজন যদি কুহুকে ভুলতে না পারে তাহলে কি হবে??? সে কি মরে যাবে?? নাকি ধুঁকে ধুঁকে মরবে?? আর ভাবতে পারছে না সে। যন্ত্রণায় পেরে উঠছে না নিজের সাথে। কোনোরকমে উঠে বিছানায় উপুর হয়ে গা এলিয়ে দিল কূজন।.কলরব ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। পূর্ণিমা নেই। অবশ্য পূর্ণিমা আমাবস্যা এসব নিয়ে কলরবের মাথা ব্যাথাও নেই।কখনো ছিলও না আর আজ তো একদমই নেই। যার হৃদয় ক্ষণে ক্ষণে জোছনাবিলাস করে, যার চোখের পলকে কুহুর নামে জোছনা ঝরে, যে নিজে কুহু নামক চাঁদনী রাতের রাজা তার এসব পূর্ণিমা, আমাবস্যা এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ কি? হাতে কফির মগ। একটুখানি করে চুমুক দিচ্ছি আর কুহুর কথা ভাবছে সে। কোথায় ভেবেছিল রাত জেগে পড়বে আর এখন করছেটা কি??? কলরব মনে মনে হাসলো। মা আসলে ঠিকই বলেছিল। কুহু আসলে পড়াশুনা শেষ। যাক গোল্লায় যাক পড়াশুনা। কুহুকে পেলে জীবনে আর কিছু লাগবে না তার। হঠাৎ করে কফি খাওয়া থামিয়ে কলরব কফির মগটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ভাবছে কফিটা যদি কুহুর হাতের হতো তাহলে কেমন হতো?? বিয়ের পর কুহুকে নিয়ে কলরব প্রতি রাতে ছাদে দাঁড়িয়ে কফি খাবে, কুহুর হাতের বানানো কফি। এই মগটাতেই দুজন শেয়ার করে কফি খাবে। কুহু প্রথমে কফির মগে চুমুক দিবে তারপর কলরব এই মগে কফি খাবে। আচ্ছা কুহু যদি রাতে ছাদে আসতে ভয় পায় তাহলে কীভাবে এই স্বপ্ন পূরণ হবে??? কুহুকে জোর করে ছাদে নিয়ে আসবে। দরকার হলে পাঁজাকোলে করে নিয়ে আসবে। পাঁজাকোলা করার কথা মনে হতেই ইরিনের বলা সেদিনের কথাটা মনে পড়লো কলরবের। আসলেই পাশাপাশি বাড়ি। বরযাত্রীরা মজা পাবে না। তবে কলরবের বেশ মজা হবে। ইরিন আর তার মা যেই পাবলিক সত্যি সত্যি তাহলে কুহু এ বাসায় কোলে করে নিয়ে আসতে হবে। কুহু লজ্জায় মরেই যাবে। নিজে নিজে এগুলো ভাবছে আর পাগলের মতো হাসছে সে। হঠাৎ রবীন্দ্রনাথের কয়েকটা লাইন মনে পড়লো তার।"যেমন আছ তেমনি এসো, আর কোরো না সাজ।বেণী নাহয় এলিয়ে রবে, সিঁথি নাহয় বাঁকা হবে,নাই-বা হল পত্রলেখায় সকল কারুকাজ।আঁচল যদি শিথিল থাকে নাইকো তাহে লাজ।যেমন আছ তেমনি এসো, আর করো না সাজ।"কলরব যদিও এসব কবিতা পড়ে না তবে তার ব্রেইন খুব শার্প। ভার্সিটিতে একবার একটা নাটক হয়েছিল। নাটকটায় নায়ক সেজেছিল রঞ্জু। বেশ ভালো অভিনয় করে। সে নাটকের দৃশ্যে নায়ক তার নায়িকাকে এই লাইনগুলো বলছিল। বন্ধু রঞ্জুর কথা রাখতে নাটকটা দেখতে গিয়েছিল। কলরবের আবার যেকোনো জিনিস একবার শুনলেই মনে থাকে, ভুলে যায় না কখনো। তাই এতদিন পরও লাইনগুলো মনে আছে তার। কলরব ঠিক করে ফেললো ফুলশয্যার রাতে কুহুকে এই লাইনগুলো বলবে সে।.হাসনাদ সাহেব সকাল সকাল ফেণীর উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। ইরিনের সাথে দেখা করবে তাই মনটা বেশ ফুরফুরে। ইরিনকে দেখলেই মনে হয় ইশ্ আমারো যদি এমন একটা মেয়ে থাকতো। বাসাটা কেমন খালি খালি লাগে। মেয়েরা নাকি ঘর পরিপূর্ণ করে রাখে। হাসনাদ সাহেব আসার সময় ভুলে ইরিনের জন্য কেনা গিফ্টটা ফেলে রেখে আসছিলেন। কিন্তু গাড়িতে বসতেই মনে পড়ে যায়। গাড়ি থেকে নেমে নিজে যেয়ে উপর থেকে গিফ্টা নিয়ে আসেন তিনি। কত শখ করে কিনেছেন এই গিফ্ট। কিন্তু সোনার হরিণ তো তা ফিরিয়েই দিল। আজকে জোর করে গিফ্টটা দিয়ে আসবেন। না রাখতে চাইলে বকা দিবেন তারপরো দিবেন। সারা রাস্তায় এসব ভাবতে ভাবতে পৌঁছে গেলেন কলরবদের গলিতে। গাড়ি থেকে নেমেই কলরবদের বিল্ডিং এ পা বাড়ান তারপর আবার কলরবদের বাসায় না যেয়ে কুহুদের বিল্ডিং এর দিকে যান। কূজন থেকে ঠিকানা জেনে নিয়েছেন তবে কোন তলা আর কোন ফ্ল্যাট তা জানেন না। তবে কুহুর নাম বললেই বের করে ফেলতে পারবেন। সোনার হরিণের সাথে তো দেখা করাই যাবে কিন্তু আগে কূজনের জন্য কুহুর বাবার বাসায় যাবেন তিনি। নিজের প্রিন্সের প্রিন্সেসকে খুঁজে পেতে হবে। কূজনকে বেশ বড়সড় ধরনের একটা সারপ্রাইজ দিবেন ভেবে রেখেছেন। বিয়ের কথা ফাইনাল করে কূজনকে জানালে কূজন পুরোই থতমত খেয়ে যাবে। যেমনটা ছোটবেলায় ওকে একটা ময়না পাখি এনে দেওয়ায় খুশি হয়েছিল ঠিক তেমনটাই হবে নিশ্চই। ধ্যাত সে খুশি আর এই খুশি এক হলো নাকি??? ঐ খুশি এই পাওয়ার তুলনায় নগণ্য। কুহুদের বিল্ডিং এ যেয়ে নীচতলার ডানদিকের ফ্ল্যাটে কলিংবেল চাপলেন। একটু পর একজন বয়স্ক লোক এসে দরজা খুলতেই হাসনাদ সাহেব কুহুর বাসা কিনা জানতে চাইলেন। বয়স্ক লোকটি বললেন না কুহুদের বাসা উপরের তলায়, ডান দিকের ফ্ল্যাট। হাসনাদ সাহেব ধন্যবাদ জানিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপর উঠলেন। তারপর কলিংবেল চেপে দাঁড়িয়ে রইলেন। আরেকবার চাপতে যাবেন ঠিক তখনই দরজা খুলা হলো। হাসনাদ সাহেব দেখলেন বেশ সুন্দর একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি ভেবেছিলেন সালাম দিবে নিশ্চই কিন্তু মেয়েটা জিজ্ঞাসা করলো,- কাকে চাইছেন?- এটা কি কুহুদের বাসা??- জ্বি।- তুমিই কি কুহু?- না আমার আপু কুহু।- ওহ্ তোমার বাবা আর আপু বাসায় আছে?পিহুর কাছে কেমন যেন মনে হচ্ছে ব্যাপারটা। কুহু যে বাসায় নেই তা বললো শুধু বললো,- জ্বি ভিতরে আসুন। আমি আব্বুকে ডেকে দিচ্ছি।চলবে....পর্বঃ৩৬হাসনাদ সাহেব কুহুদের ড্রয়িংরুমে বসে আছেন। কুহুর মা নিজে এসে নাস্তা দিয়ে গেছেন আর বলে গেছেন কুহুর বাবা এখনই আসছেন। প্রায় সাথে সাথেই কুহুর বাবা এলেন। সালাম দিয়ে হাসনাদ সাহেবের মুখোমুখি হয়ে অন্য সোফায় বসলেন। হাসনাদ সাহেব কুহুর বাবা থেকে সালাম এক্সপেক্ট করেননি। কারণ উনার মেয়ে বয়সে ছোট হয়েও সালাম জানালেন না। কেমন যেন অসামাজিক মনে হল পিহুকে। কুহুও কি এমন??? নাও তো হতে পারে। দুই বোনের যে মিল থাকবে তা স্বাভাবিক কিন্তু আচার ব্যবহার ভিন্নও তো হতে পারে। সাহরা, জাহরাও তো দুইবোন। তবে দুইজন দুই মেরুর বাসিন্দা। আর কুহু যেমনই হোক সেটা নিয়ে হাসনাদ সাহেবের কোনো আপত্তি নেই। নিজের প্রিন্স এর খুশিই উনার কাছে সব কিছু। ছেলের খুশির জন্য পারবেন না এমন কোনো কাজ নেই। তৈয়ব সাহেবের কথায় হাসনাদ সাহেবের ভাবনায় ছেদ পড়লো। - ভাই আমার কাছে এসেছিলেন??- জ্বি ভাই আপনার সাথে কথা বলতে এসেছি। আসলে বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনার উয়াইফ থাকলেও ভালো হয়।তৈয়ব সাহেবের কপালে সামান্য ভাঁজ পড়লো। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন জ্বি আমি আসতে বলছি।কুহুর মা আসতেই হাসনাদ সাহেব আবার কথা শুরু করলেন।- আমি একজন বিজনেসম্যান। এক্সপোর্ট ইনপোর্টের বিজনেস। আমার উয়াইফ হাউজ উয়াইফ। আমাদের এক ছেলে। আহসানউল্লাহ থেকে....হাসনাদ সাহেবের পুরো কথা শেষ না হওয়ার আগেই ফোন বেজে উঠল।- এক্সকিউজ মি!- না ভাই ঠিক আছে আপনি কথা শেষ করুন আমরা অপেক্ষা করছি।হাসনাদ সাহেব কথা শেষ করেই ফোন রেখে আবার বলতে শুরু করলেন।- ওহ্ যেটা বলতে নিয়েছিলাম ভালোই হয়েছে ফোনটা এসেছে। আমার ছেলের রেজাল্ট বেরিয়েছে। কূজন আহসানউল্লাহতে ট্রিপল ই থেকে পাশ করে বেরিয়েছে। এখনই জানতে পারলাম। এখন সে আমার সাথে বিজনেস করবে। তাছাড়া আমি প্লটের ব্যবসাও করি। আসলে ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়েছে করেছি। এখন ছেলে বিজনেস করতে চাচ্ছে তাই এটাও করতে দিচ্ছি। আমরা কুমিল্লায় থাকি। আমি আসলে এখানে এসেছি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। আপনার মেয়ে কুহুকে আমি ছেলের বউ করে রাখতে চাই। কুহুর বাবা মা যা ভেবেছিলেন তাই। কুহুর বাবা জিজ্ঞেস করলেন,- আপনি আমার মেয়েকে কোথায় দেখেছেন??- আমি দেখিনি আমার ছেলের সাথে ট্রেনে দেখা হয়েছে আপনার মেয়ের। কুহু আমার ছেলেকে হেল্প করেছিল। কুহুর মা বেশ অবাক হয়ে গেলেন। ভাবছেন যে জিনিসটা নিয়ে মেয়েকে ছোটবেলা থেকে বুঝিয়ে এসেছেন আজ সে জিনিসটাই তার মেয়ের কপাল খুলে দিয়েছে। ছোটবেলা থেকেই বান্ধবীদের উপকার করতে যেয়ে বোকার মত নিজে ফেঁসে যেত। তাই সবসময় না করতো কাউকে হেল্প করতে। কিন্তু মেয়েটা তার অভ্যাস আদৌ ছাড়তে পারলো না। বিয়ে হোক বা না হোক তবে তার মেয়ের গুনটা যে সবার চোখে পড়ছে এটা ভাবতেই করবীর মন খুশিতে ভরে গেল। সেবার তো নীরাকে হেল্প করতে যেয়ে নীরার মায়ের কাছে কত কথা শুনলো। তারপরো নীরাকে আজ অব্দি কিছু বলেনি কুহু। পিহুর মতন এত বুদ্ধিমতি না হলেও কুহু যে গুনবতী তা মনে প্রাণেই বিশ্বাস করেন কুহুর মা।কুহুর মা এসব ভাবছেন তখনই হাসনাদ সাহেব কুহুর মায়ের দিকে কূজনের বায়োডাটা বাড়িয়ে দিলেন। কুহুর মা বায়োডাটা হাতে নিলেন। সাদা খাম থেকে বায়োডাটা বের করলেন। খামের ভিতর কূজনের দুইটা ছবিও রাখা আছে। তিনি সবার আগে ছবি দুইটা দেখলেন। একটা ওদের ফ্যামিলি পিক। দেখেই বুঝলেন ওদের লিভিংরুমে বসে তোলা। ওরা যে বেশ ধনী খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে। পরের ছবিটা দেখলেন তিনি। কূজনের সিঙ্গেল ছবি। ভার্সিটির ক্যাম্পাসে গিটার নিয়ে গান গাইছে। এমন একটা ছবি। গিটারিস্ট না হয়েও অনেকে গিটার নিয়ে ছবি তুলে কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে ছেলেটা আসলেই গিটার বাজাচ্ছে। কূজনের হাসি হাসি চেহারা দেখে কুহুর মা একনজরেই কূজনকে পছন্দ করে ফেললেন। বায়োডাটা খুলেও দেখলেন। তবে পুরোটা দেখলেন না। প্যাটার্নাল ব্যাকগ্রাউন্ড দেখেই হা হয়ে গেলেন। দাদা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। কূজনের দুই চাচাই ক্যাবিনেট সচিব। একজন চাচীর নিজস্ব ফ্যাশন হাউজ আছে। অন্যজন হাউজ ওয়াইফ। ফুফা কাস্টম অফিসার। ফুফু সরকারি কলেজের প্রফেসর। সবার ছেলে মেয়েই বিদেশে পড়াশুনা করে বিদেশেই স্যাটেলড। কুহুর মায়ের বিশ্বাস হচ্ছে না এমন ঘর থেকেও তাদের মত মধ্যবিত্তের মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসতে পারে। কুহু বেশ সুন্দর তবে মহা সুন্দরী তো না। তারউপর পড়াশুনাও সাধারণ। আগ্রহ নিয়ে পরের পাতায় মেটারনাল ব্যাকগ্রাউন্ড দেখতে যাবেন ঠিক তখনই কুহুর বাবা ইশারায় এভাবে বায়োডাটা দেখতে নিষেধ করলেন। করবীর মাথায়ও বিষয়টা আসলো। এভাবে উনার সামনে বসে উনার ছেলের বায়োডাটা দেখাটা কেমন যেন দেখায়। উনি তো দেখার জন্যই দিলেন পরে দেখলেই হয়।কুহুর বাবা বললেন,- ভাই আমি আপনাকে পরে জানাবো। আমার মেয়ে তো বাসায় নেই ওর খালার বাসায় বেড়াতে গিয়েছে। আসলে মেয়ের মতামতের ও একটা বিষয় আছে। তারপর ওর চাচা আর মামাদের সাথে কথা বলতে হবে। মেয়ের গার্জিয়ান তো আমি একা নই।হাসনাদ সাহেব হেসে বললেন,- অবশ্যই মেয়ের মতামতই তো ইম্পর্টেন্ট। আর আপনার ফ্যামিলির সঙ্গেও বুঝে শোনে দেখবেন।- ভাই আপনি তো আমাদের ব্যাকগ্রাউন্ডই জানেন না। আসলে মেয়ের বায়োডাটাও এখনো বানাইনি। আমি টিএনটিতে জব করি।- আপনার ফ্যামিলি ইম্পর্টেন্ট না। কুহু ইম্পর্টেন্ট আমার জন্য। আচ্ছা আজ উঠি আপনাদের মতামতের অপেক্ষায় থাকবো। যাওয়াী আগে হাসনাদ সাহেব কুহুর বাবাকে নিজের কার্ড দিয়ে গেলেন। হাসনাদ সাহেব বেশ ফুরফুরে মেজাজে বের হলেন। একে তো কূজনের রেজাল্ট বেরিয়েছে। আর কূজনের আগে তিনিই জানেন। কূজনকে সারপ্রাইজ দিবে বলে ভার্সিটির কম্পিউটার অপারেটরকে তিনি আগেই টাকা দিয়ে রেখেছিলেন যেন রেজাল্ট সবার আগে উনাকেই জানিয়ে দেয়। তারউপর কূজনের সিজিপিএ বেশ ভালো। সবচেয়ে ইম্পর্টেন্ট ব্যাপার হলো কুহুর মায়ের চেহারা দেখেই বোঝা গিয়েছে উনি হতভম্ব হয়ে আছেন। তাঁর প্রিন্সকে ফিরিয়ে দিবে এমন কেউ অন্তত বাংলাদেশে নেই বলে হাসনাদ সাহেবের ধারণা।.বাসায় মেহমান এলে পিহুর একদমই সহ্য হয় না। বিরক্তি তখন তুঙ্গে থাকে। তাই তখন নিজের ঘর ছেড়ে সে বেরই হয়না। চুপচাপ ঘরে বসে থাকে। আজও এর ব্যতিক্রম হয়নি। চুপচাপ বসে ক্যামিস্ট্রি পড়ছিল। পানির পিপাসা পাওয়ায় ডাইনিং এ গিয়েছিল পানির জন্য। ডাইনিংরুমে যাওয়ার সময় হালকা পাতলা কথা কানে এসেছে তার। বড়দের কথায় কোনোকালেই সে কান দেয় না। কুহু হলে নিশ্চই কান খাড়া করে কথা শুনতো। কুহুর আবার বড়দের আজাইরা প্যাঁচাল শুনতে ভালো লাগে। পিহু যতদূর শুনেছে বিয়ে নিয়ে কথা হচ্ছে। নিশ্চই কুহুর বিয়ে নিয়েই হচ্ছে। যেহেতু কুহুকে এসে খোঁজ করেছেন আবার সবাই এখন কুহুর বিয়ে নিয়ে ভাবছেন তাই পিহু বুঝে নিল বোনের বিয়ের কথা চলছে। তবে বেশি কিছু শুনতে পারেনি ফোন এসেছিল কলেজের ম্যামের। তবে বেশ করেই বুঝতে পারছে কোনো বড় ধরনের সমস্যা হবে। পিহু বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। হঠাৎ দেখলো হাসনাদ সাহেব ওদের বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে কলরবদের বিল্ডিং এ গেল। এটা দেখেই পিহুর চোখ বড় বড় হয়ে গেল। কোনোরকমে মেডামের সাথে কথা বলে মায়ের কাছে গেল। করবী ছোট মেয়েকে সব বললেন। পিহু নরমাল ভাব নিয়ে বললো,- কই দাও তো বায়োডাটা। আর ছেলের ছবিটা দেখি।- ওয়ারড্রবের উপর রেখেছি।- আচ্ছা আমি দেখছি।পিহু বায়োডাটা নিয়ে নিজের রুমে ফিরে এল। এসব বায়োডাটা নিয়ে ঘাটাঘাটি করা, মজা করা এসব করে কুহু। ওদের যেকোনো কাজিনের বিয়েতে সবার আগে কুহু দুইটা জিনিস খুব ইন্টারেস্ট নিয়ে দেখে। এক বায়োডাটা আর দ্বিতীয়ত ইনভিটেশন কার্ড। আর পিহু জীবনেও এসবে নজর দেয় না। কিন্ত এই প্রথম এত ইন্টারেস্ট নিয়ে বায়োডাটা খুললো। বায়োডাটা পড়লো তারপর ছবি দেখে পুরো শিউর হলো যে কূজনই কুহুর জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। পিহু বিড়বিড় করে বললো,- কলরব যদি আগুনের গোলা হয় এই কূজন হলো হীম শীতল বরফ। কলরব থেকে একটুখানি বেশি এগিয়ে সে।চলবে...পর্বঃ৩৭তৈয়ব সাহেব পিহুকে ডাকলেন।- আব্বু ডেকেছো?- হুম ডেকেছি। বায়োডাটা নাকি তোর কাছে?- হ্যাঁ।- দে তো দেখি।পিহু বাবাকে বায়োডাটা এনে দিল।কুহুর মা আবারো শুরু থেকে পড়ছেন। তার আগে আরো একবার কূজনের ছবি দেখে নিলেন। কূজনকে দেখলেই উনার বড্ড মায়া মায়া লাগে। কেন জানেন না তবে ছেলেটার হাসিটায় হয়তো কিছু একটা আছে। বেশ ভদ্র ভদ্র চেহারা আর দেখতেও রাজপুত্র। কুহু থেকেও ফর্সা ছেলেটা। উনি খুশি মনে বায়োডাটা পড়ছেন। তৈয়ব সাহেব চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছেন। পিহু দাঁড়িয়ে আছে বাবার পাশে। তৈয়ব সাহেব পিহুকে পাশে বসতে বললেন। তারপর বললেন,- কুহুর মা! কুহুর বিয়ে নিয়ে তো আমি প্রায় অন্য কাউকে আশ্বাস দিয়ে ফেলেছি।করবী বিরক্ত হয়ে বললেন,- তুমি না পারো বটে। এমন ভাবে বললে মনে হলো কথা দিয়ে ফেলেছ। কথা দেওয়া আর আশ্বাস দেওয়া ভিন্ন!- তারপরো..- শুনো মেয়ে বড় হলে সবাই প্রস্তাব নিয়ে আসে আর তিন কবুলের আগ পর্যন্ত কিছুই শিউর ভাবে বলা যায় না। আমার মেয়ে যেখানে সুখী হবে সেখানে আমি মেয়ে দিব। ছেলেটাকে দেখেই আমার কত ভালো লাগছে। কি যেন নাম রবিন। আর তাছাড়া এত ভালো প্রস্তাব। আমার মেয়ের মন আয়নার মত পরিষ্কার তাই আল্লাহ নিজ হাতে ভাগ্য খুলে দিয়েছেন।- শুনো এই ছেলে অনেক বড় লোকের ছেলে। বড় লোকের ছেলেমেয়েরা বিগড়ে থাকে। নেশাখোর হয়! দুই দিন পর পর বিয়ে করে ঘরে বউ তুলে।- তুমি একবার ছেলেটাকে দেখো দেখলেই বোঝা যায় কত ভালো।তৈয়ব সাহেব কূজনের ছবিটা দেখলেন।- চেহারা দেখে ভালো মনে হলেও তুমি কি মনে কি আছে জানো? আর কোথাকার কোন ছেলে চিনিও না, জানিও না। টাকা দেখে বিয়ে দিয়ে আমার মেয়ের জীবন নষ্ট করবো নাকি? ছেলে দেখে মেয়ে বিয়ে দিব। ছেলের বাবার টাকা দিয়ে কি হবে?? আমার মেয়ে এক টাকা কম খেয়ে হলেও যেন শান্তিতে থাকে সেটা দেখবো।- তুমি হেডমাষ্টারের ছেলের কথা বলছো তো?- হুম।- আরে কলরব যে ভালো হবে তা তুমি শিউর হয়ে বলছো কীভাবে?কলরবের কথা শোনে পিহুর মাথা ঘোরাতে লাগলো। কলরব, কূজন দুইভাই একই সাথে বিয়ের প্রপোজাল পাঠিয়েছে??? দুইটাই রাম ছাগল। কিন্তু ফ্যামিলিও তো পাগল। এখন আপুণির অবস্হা আরো খারাপ হবে। এই হলো আরেক গাধী। কাকে পছন্দ করে জানে না। পিহু সবদিক দিয়ে অন্ধকার দেখছে। মাথা ঘুরছে। কি হবে তা ভাবতেই বিরক্তি ছেয়ে গেল মনে। আর বেশি কিছু ভাবতে পারলাম না পিহু। বাবা - মায়ের কথপোকথনে ভাবনায় ছেদ পড়লো।- ছেলেটাকে আমি প্রতিদিন ফজরের সময় মসজিদে দেখি নামাজ পড়তে আসে। একদিনও মিস দেয় না। আর তোমার বড় আপার ছেলে সঞ্জু কলরবের কলিগ। সঞ্জুকে বলায় বললো, "খালু এক কথায় রাজি হয়ে যান। ফিউচার খুব ব্রাইট কলরবের। দাই দাই করে উপরে উঠবে জীবনে। খুবই ইন্টিলিজেন্ট। আর আচার ব্যবহারও ভালো।" করবী বললেন,- বাড়ির পাশের ঘাস গরুতেও খায় না।- কুহুর মা! আমরা মধ্যবিত্ত তাই বামুন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানোটা ঠিক হবে না।- চাঁদ যখন বামুনকন্যা চায় তাহলে ফিরিয়ে দেয়ার কোনো মানেই হয় না।- শুনো হাসনাদ সাহেব অনেক বড়লোক। ওদের স্ট্যাটাস আর আমাদের স্ট্যাটাস কখনোই এক হবে না। সবচেয়ে বড় কথা এত বড়লোকের ছেলেমেয়েরা বখে যাওয়া হয়। তারপর ছেলে স্ট্যাবলিশ না। আজকেই রেজাল্ট বেরিয়েছে।- ছেলের বাবার যা টাকা আছে না সেগুলো এই ছেলের নাতি নাতনী পর্যন্ত বখে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট।আর সে তো ফ্যামিলি বিজনেসই করবে। বাবা মায়ের এক ছেলে। সবই তো ওর। - বিজনেস করে লস খাবে না কোনো শিউরিটি আছে?- লস খেলেও সমস্যা হবে না। বাবার ছায়া আছে মাথার উপর।- কলরব খুব মেধাবী একটা ছেলে। স্কুল কলেজের ফার্স্ট বয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফরেস্ট্রি থেকে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছে। আর এই ছেলে বাবার টাকায় প্রাইভেটে পড়েছে। কলরবদের খুব ভালো করে চিনি। ওর বাবা মা বেশ ভালো মানুষ। হাসনাদ সাহেবের মত অপরিচিত নয়।- কলরবের ছোট একটা বোন আছে। ঘরে অবিবাহিত ননদ থাকা মানে কালশাপ থাকা। একলা ঘর দেখে বিয়ে দেয়া ভালো। কলরবকে কত দায়িত্ব পালন করতে হবে আর এই ছেলে সম্পূর্ণ রাজা। - তাও ঠিক। তবে হাতে দুইটাই থাক। দেখাশোনা করি তারপর কুহু যেটা চাবে সেটা হবে। আচ্ছা বাকিটুকু পড়ো তো।তৈয়ব সাহেব আর করবী দুজন মিলে বায়োডাটা দেখলো। মেটারনাল ব্যাকগ্রাউন্ডে যেয়ে একে অপরের দিকে বিস্ময়ভরা চাহনী নিয়ে তাকালো। তৈয়ব সাহেব চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন,- কূজন আর কলরব তো রিলেটিভ।করবী অবাক হয়ে বললেন,- শুধু রিলেটিভ না আপন খালাতো ভাই।- এটা কি করে সম্ভব?? ইফতেখার সাহেব যেখানে আগে প্রস্তাব দিয়ে রেখেছেন সেখানে হাসনাদ সাহেব কীভাবে আমাদের কাছে আসতে পারেন?? বড়লোক হলেই যে মানুষ অমানুষ হয়ে যায় তার প্রমাণ পেলাম।করবী আস্তে করে বললেন,- এমনো তো হতে পারে উনি জানেন না যে কলরব আর কুহুর বিয়ের কথা চলছে। - কি জানি বাবা। ওদের ব্যাপারস্যাপার কিছুই বুঝলাম না।পিহু যা শোনার শোনে নিয়েছে। বাবা মার আজাইরা প্যাঁচাল আর শুনলো না সে। নিজের রুমে এসে সঞ্জু ভাইয়ের বউ শিপ্রা ভাবীকে কল করলো সে। দুইবার রিং হতেই ওপাশ থেকে শিপ্রা ফোন ধরে বললো,- হ্যালো পিহু কেমন আছো?- জ্বি ভাবি ভালো। আপনি কেমন আছেন?- ভালো থাকি কীভাবে বলো। ননদিনী আমার কোনো খবরই রাখে না। কুহু তো মাঝে মাঝে আসে তুমি খুব কম আসো।- আমি আসতে চেয়েছিলাম কিন্তু পরীক্ষা তাই মা দেয়নি।- থাক এই কয়টা বছর কষ্ট করো তারপর তো আরাম আর আরাম।- হুম। ভাবী আপুণি আছে?- আছে তো। দিব??- জ্বি ভাবী আর্জেন্ট।- আচ্ছা দিচ্ছি।শিপ্রা কুহুর হাতে মোবাইল দিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো। কুহু ফোন কানে নিয়ে আহ্লাদ করে বললো,- পিহু সোনা তুমি পড়ো! বেশি করে পড়ো আর আমি এখানে মজা করি।- আজাইরা কথা বাদ দিয়ে আসল কথা শোন।তাড়াতাড়ি বাসায় আয়।- জীবনেও না। নিজে মজা করতে পারবে না বলে আমাকেও বেড়াতে দেয় না।- উফ্ ঢং রাখ তো। আর্জেন্ট!- ঠিক আছে ম্যাডাম আসছি।.কূজন ঘুম থেকে দেরি করে উঠলো। রাতে মাথাব্যাথায় ভালোভাবে ঘুম হয়নি। বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমে গেল। ফ্রেশ হয়ে মোবাইল চার্জে দিতেই মোবাইলের স্ক্রিনে ডেইট দেখে মনে পড়লো আজ রেজাল্ট দেয়ার কথা। রেজাল্ট জানার জন্য কোনো আগ্রহবোধ করলো না। মনটা বেশ খারাপ হয়ে আছে তার। রাতের শোনা কথাগুলো কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। বুকের ভিতর সবকিছু কেমন যেন শূণ্য শূণ্য লাগছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুম থেকে বের হলো সে। রুম থেকে বেরিয়েই দেখলো বাবা আর ইরিন বেশ গল্প করছে। ইরিনের হাতে একটা মাঝারী সাইজের হরিণের শো-পিজ। সোনালী রঙের। এন্টিকের বেশ সুন্দর। কূজন যথাসম্ভব প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে বাবার পাশে বসলো। ইরিন শাসন করার মতো করে বললো,- ভাইয়া এত দেরি করে কেউ ঘুম থেকে উঠে? আরেকদিন দেখলে মাইর দিব।অন্য সময় হলে কূজন ইরিনের কথায় হেসে দিত কিন্তু আজ হাসলো না। ইরিন কূজনের জন্য ব্রেকফাস্ট আনতে চলে গেল। ইরিন চলে যেতেই হাসনাদ সাহেব কূজনকে তার রেজাল্টের খবর জানালো। বাবাকে এত খুশি দেখে কূজনের প্লাস্টিক হাসিটা সত্যিকারের হাসিতে বদলে গেল। হাসনাদ সাহেব কূজনের কাঁধে হাত রেখে বললেন,- প্রিন্স তোমার জন্য অনেক বড় একটা সারপ্রাইজ আছে।কূজন হেসে জিজ্ঞাসা করলো,- কি সারপ্রাইজ বাবা?হাসনাদ সাহেব কণ্ঠে আনন্দ ঝরিয়ে বললেন,- আমি কুহুর বাবা মায়ের সাথে কথা বলে এসেছি। রেজাল্ট প্রায় পজিটিভ ধরে নিতে পারো।হাসনাদ সাহেবের কথা কূজনের মাথার উপর দিয়ে গেল। কি বলছে বাবা? কুহুর সাথে তার বিয়ে??? তাহলে গতকালের ঘটনা, কুহু আর কলরব ভাই.... ঐটা কি স্বপ্ন ছিল?? নাহ্ দুঃস্বপ্ন ছিল? নাকি এখন সে স্বপ্ন দেখছে।চলবে...পর্বঃ৩৮কুহু থমথমে হয়ে বসে আছে। রুমের দরজা বন্ধ করে পিহু কুহুকে ডায়েরিটা দিল। প্রথম কবিতাটা শুধু পিহুর সামনে পড়লো। তারপর পিহুকে রুম থেকে চলে যেতে বললো। পিহু উঠে যেতে যেতে বললো,- তুই একটা রাবিশ আপুণি।কুহু পিহুর কথায় চোখ রাঙিয়ে তাকালো। পিহু বোনের এই দৃষ্টি চিনে। এমনিতে কুহুকে সারাদিন গালমন্দ করলেও কুহু পিহুকে বলে পিহুর মুখে বকা শুনতেই নাকি ভালো লাগে তার। কিন্তু রেগে গেল তখন পিহুর কপালে চড় থাপ্পর জুটে। তখন সাধারণ কথা বললেও পিহুকে বকা শুনতে হয়। কুহু যে রেগে গিয়েছে বুঝতে পেরে পিহু চলার গতি দ্রুত করে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো। পিহু বের হতেই কুহু দরজা বন্ধ করে ডায়েরি নিয়ে নীচে বসে পড়লো। একে একে কূজনের লিখাগুলো পড়তে লাগলো সে। একেকটা কবিতা পড়ে তার চোখে মুখে লাল আভা ছড়িয়ে পড়ছে। বুকের মধ্যে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ হতে লাগলো। তবে সে শব্দ অন্য কেউ শুনতে পাবে না। ঠোঁটে হাসির রেখা বিস্তৃত হতে লাগলো। পিহুর সামনে কুহুর এই অবস্হা হলে পিহু ওকে জ্বালিয়ে মারতো। তার উপর ছোট বোন। যতোই ফ্রি হোক তারপরো পিহু তো আর বান্ধবী না তাই কুহু পিহুকে সরিয়ে দিল। এত ভালো লাগছে কেনো কুহুর? হঠাৎ কুহুর চোখ গেল খাটের নীচে। সেখানে কলরবের বাস্কেটবলটা পড়ে আছে। যেটার জন্যই সেদিন কলরবের কাছে দুই বোন ধরা পড়েছিল। কুহুর হাত থেকে ডায়েরিটা পড়ে গেল। হাত পা কাঁপা শুরু করেছে তার। দুম করে দুই চোখের পাতায় কান্নারা ঝেঁকে বসলো। হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলো সে। বুকের ভিতর সবকিছু কেমন যেন শূণ্য শূণ্য লাগছে। কান্না বেড়েই চলছে। একসময় ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ কাঁদার পর উঠে দাঁড়ালো। ডায়েরিটা দরজার পাশে যেখানে কুহু বসেছিল সেখানেই পরে রইলো। কুহু এগিয়ে গেল ড্রেসিংটেবিলের দিকে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে একনজর দেখলো সে। বিশেষ কিছু খুঁজে পেল না নিজের মধ্যে। ভাবতে লাগলো কেনো দুইজন আমাকে পছন্দ করে?? আমার মাঝে তো তেমন কিছুই নেই। কি দেখলো ওরা? কিসে মুগ্ধ হয়েছে? এত ভেবেও কূল কিনারা করতে পারলো না সে। হতাশ ভঙ্গিতে দরজার কাছে ফিরে এসে ডায়েরিটা তুললো। তারপর ডায়েরিটা সযত্নে আলমারিতে তুলে রেখে পিহুকে ডাকলো। পিহু বোনের ডাক শুনেই ঝড়ের গতিতে এসে বোনের কাছে বসলো। কুহু সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করলো,- আমার জায়গায় তুই হলে কি করতিস পিহুন?কুহু যে ওকে এরকম কোনো প্রশ্ন করবে এ সম্পর্কে ওর বিন্দু মাত্র ধারনা ছিল না। তাই আচমকা এই প্রশ্ন শোনেই সাথে সাথে কিছু বলতে পারলো না। কুহু অস্হির হয়ে পিহুর হাত চেপে ধরে বললো,- বল না পিহুন কি করতিস?? পিহু একটুখানি ভেবে বললো,- জানি না।কুহু হতাশ হয়ে পিহুর হাত ছেড়ে দিল। পিহুও চুপচাপ বসে রইলো। কিছুক্ষণ বোনকে পর্যবেক্ষণ করে পিহু চাপা স্বরে বললো,- যদি পরিস্হিতি আগের মতন হতো তাহলে আমি নির্দ্বিধায় কলরবের নাম বলতাম। কারণ আমি ভেবেছিলাম কলরব তোকে ভালোবাসে কিন্তু কূজন বাসে না। এখন যখন জানতে পেরেছি দুইজনই ভালোবাসে তাই একমাত্র উপায় হলো তুই যাকে ভালোবাসিস বা পছন্দ করিস তাকে বেছে নেয়া। কুহু পিহুর দিকে অসহায়ের দৃষ্টিতে চেয়ে বললো,- এটাই জানি না। কূজনের সবকিছু আমার ভালো লাগে, সবকিছু। একদম মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত। আর কলর...পিহু বোনকে থামিয়ে দিয়ে বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললো,- তুই এত খেয়াল করে কবে দেখেছিস ঐ ছেলেকে???কুহু বোনের কথায় হেসে ফেললো। আস্তে করে বোনের মাথায় টোকা দিয়ে বললো,- বুদ্ধু আমি বলতে চেয়েছি যে কূজনের গান, কবিতা, কথা বলা এগুলো ভালো লাগে।- ওহ্ এত পেঁচিয়ে বলিস কেনো? সোজাসাপ্টা বলতে পারিস না? এই জন্যই আমার তোদের মতন মানুষদের বিরক্ত লাগে।কুহু চোখ ঈষৎ ছোট করে বললো,- কাদের মতন?- এইতো যেমন ধর তুই তারপর কূজন। কুহু কণ্ঠে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিস্ময় কুড়িয়ে এনে বললো,- কিহ্?? কূজনকে ভালো লাগে না?? তুই মানুষ না অন্য কিছু?- তুই গাধী তাই এই ছাগলকে তোর পছন্দ হয়। কি বড় বানোয়াট একটা কথাই না লিখলো সে। - কি লিখেছে?- ঐ যে তোর চুল বাতাসে উড়ছে, জানালার পাশে...কুহু হুহু করে জোরে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে পিহুর উপর গড়িয়ে পড়লো।পিহু বিরক্ত হয়ে কুহুকে ধাক্কিয়ে সড়িয়ে দিল। কুহু হাসতে হাসতেই বললো,- ঐটা এমনি লিখেছে। কবিতা লিখার সময় মানুষ তো এমন করেই।- এই জন্যই তো এই সাহিত্যিক মার্কা লোকজন দেখলে আমার গা জ্বলে যায়।- তুই এসব বুঝবি না।- বোঝার দরকারও নেই। তবে আমার একটা কথা মনে রাখবি সবসময়। বিজ্ঞানী আর সাহিত্যিক এই দুই শ্রেণীর মানুষ হয় ঢিলা ক্যারেকটারের। কুহু এই কথা পিহুর মুখ থেকে হাজারবার শুনেছে। পিহুর ধারনা বিজ্ঞানীরা সাধারণ একটা ফুল নিয়েও কিসব হাবিজাবি জিনিস পরীক্ষা করে। নিষ্পাপ ফুলগুলোকেও ক্যারেকটারল্যাস বলে চালিয়ে দেয়। পরাগধানী,গর্ভমুন্ড, পুংকেশর, স্ত্রীকেশর এসব নিয়ে ফুল জাতির মান সম্মান নিয়ে পর্যন্ত টানাটানি করে। অপরদিকে যারা লেখক ওরা প্রতি গল্পেই প্রতিটি নায়ক নায়িকার প্রেমে পড়ে যায়। একেকবার একেক নারী পুরুষকে বর্ণনা করে। কীভাবে পারে এসব?? ক্যারেকটার ঢিলা বলেই এগুলো করে ওরা। আর কুহুও আজ দোটানায় ভুগছে কারণ মেডামের দুইজনকেই ভালো লাগে।কুহুর কাছে পিহুর কথাগুলো আজ কেনো যেন কিছুটা সত্যি মনে হচ্ছে। আচ্ছা নরেণ আর তপন এই দুজনকেই তো কুহুর পছন্দ। আজো ভেবে বের করতে পারলো না নরেণকে বেশি ভালো লাগে নাকি তপনকে? ওগুলো না ভাবলেও চলবে তার। উপন্যাসের নায়ক দুইজন কেনো হাজারজনকে পছন্দ হলেও সমস্যা নেই। কিন্তু বাস্তবে এটা আদৌ সম্ভব না। কুহু একইসঙ্গে দুইজনকে কখনোই ভালোবাসতে পারে না। যেকোনো একজনকে ভালোবাসে সে কিন্তু কাকে? কুহু প্রথম থেকে দুইজনের সাথে দেখা হওয়া, কথা হওয়া সব মনে করলো। লাভ হলো না। কুহু চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থেকে সিদ্ধান্ত নিল সে এই দুইজনের কাউকেই বিয়ে করবে না। অন্য যেকোনো ছেলেকে সে বিয়ে করবে কিন্তু এই দুইজনের একজনকেও সে বিয়ে করবে না। মনে মনে দৃঢ় প্রতীজ্ঞা করলো সে। তারপর পিহুর দিকে মুখ ফিরিয়ে দৃঢ় গলায় বললো,- আমি পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্যতম ছেলেকেও বিয়ে করতে রাজি এমনকি সারাজীবন বিয়ে না করেও থাকতে রাজি তবে এই কূজন কিংবা কলরব একজনকেও আমি বিয়ে করবো না।চলবে...#একটুখানি--- লামইয়া চৌধুরীপর্বঃ ৩৯কুহু মা কুহুর মাথায় নারিকেল তেল দিয়ে দিচ্ছেন। কুহুর মা এত সুন্দর করে তেল দেন যে কুহুর মাথায় তেল দেওয়ার সময় তন্দ্রা লেগে যায়। আজো ব্যতিক্রম হয়নি। আরামে কুহু চোখ বন্ধ করে বসে আছে। কুহুর তন্দ্রা লাগবে লাগবে এমন সময় কুহুর মা বললেন,- কুহু একটা কবিতা শোনা তো। অনেকদিন ধরে তোর আবৃতি শুনি না।কুহু মৃদু হেসে চোখ বন্ধ করেই আবৃতি করতে লাগলো,"অন্তরবাসিনি, প্রথম যেদিন দেখেছিলাম তোমায়অপূর্ব প্রকৃতির মধ্যে প্রকৃত রুপ পাশের জানালায়।খোলা চুল উড়ছিল বাতাসে।উড়ছে এলো চুল ,নাকি উড়ছে আমার মন? বুঝিনি সেদিন হৃদয়ের আয়নাখানিএঁকেছে তোমার ছবি মায়াবী ও চোখ খানি,জোড়া ভ্রু জুগোল, কাজল চোখ হরিণী।ওহে অন্তরবাসিনি সেই তো প্রথম দর্শন।....পিহু বারান্দায় দাঁড়িয়ে নখ কাটছিল। কুহুর কবিতা আবৃতি বারান্দায় দাঁড়িয়ে স্পষ্ট শুনতে পেল সে। প্রথমে পাত্তা দেয়নি কারণ কুহু প্রায় কবিতা নিজে নিজে আওড়াতে থাকে যদিও এটাকে সবাই আবৃতি বলে কিন্তু পিহু বলে আওড়ানো। হঠাৎ তার কাছে কবিতাটা পরিচিত মনে হলো। পিহু শিউর হওয়ার জন্য রুমের ভিতর পা বাড়ালো। রুমে যেয়ে দেখলো কুহু ফ্লোরে বসে আছে আর মা একটা মোড়ায় বসে কুহুর দীঘল চুলে তেল দিয়ে দিচ্ছে। কুহু চোখ বন্ধ করে একমনে কূজনের লিখা কবিতা আবৃতি করে চলেছে।পিহু এবার দাঁত দিয়ে নখ কামড়াতে লাগলো। কুহু পুরো কবিতা শেষ করে চোখ মেলতেই দেখতে পেল পিহু হতাশ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে নখ কামড়াচ্ছে আর কুহুর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কুহু চোখের ইশারায় জিজ্ঞাসা করলো,- কি??পিহুও ইশারায় বললো,- এই কবিতা কেনো? পিহুর প্রশ্ন শুনে কুহু নিজেই থতমত খেয়ে গেল। আস্তে করে বললো,- উফ্!কুহুর মা কুহুর উফ্ কথাটা শুনলেন না। কুহুর চুলে তেল দেওয়া শেষ করে তিনি চুল আঁচড়ে দিতে লাগলেন। চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতেই বললেন,- কার লিখা কবিতারে??মায়ের প্রশ্ন শোনে দুই বোন একবার চেখাচোখি করলো। তারপর কুহু বললো,- কেনো?- অনেক সুন্দর তো তাই বলছি। মনে হল কেউ যেন আমার কুহুকে নিয়েই লিখেছে। মায়ের এই কথা শুনে ভয়ে কুহুর বুক দুরুদুরু কাঁপতে লাগলো। মার কাছে কি ধরা পড়ে গেল? মা এখন কি করবে? যদিও পিহুর কাছে শুনেছে মা কূজনকে অনেক পছন্দ করেছে। তারপরো ছি! কেমন মেয়ে ভাববে মা ওকে? নিশ্চয় ভাববে কুহু প্রেমটেম শুরু করেছে। অথচ সে এগুলোর ধারে কাছেও নেই। মায়ের ডাকে কুহুর ভাবনায় ছেদ পড়লো। - কিরে বললি না যে?কুহু ভয়ে কাঁচুমুচু হয়ে বললো,- কি বলবো?- তুই লিখেছিস কিনা?কুহু মায়ের কথা শেষ না হতেই বলে উঠলো,- হুম আমি লিখেছি।- হা হা হা।- হাসছো কেনো মা?- পৃথিবীতে তুই বোধহয় প্রথম মেয়ে যে কিনা নিজেকে নিয়ে কবিতা লিখেছিস।- নাহ্ মানে আমাকে নিয়ে লিখিনি। আমার এক বান্ধবী আছে ওকে নিয়ে লিখেছি।- ওহ্ তাই বল। তবে তোর সাথে হুবুহু মিলে গেছে।কুহু তাড়তাড়ি করে বললো,- অন্য ফ্রেন্ডরাও তাই বলে। - ওহ্ আচ্ছা শোন এটা দেখ।- কি এটা?- খুলে দেখ।কুহু খাম খুলে কূজনের ছবি পেল। ছবিটা একনজর দেখেই খামে পুরে রাখলো। কুহুর মা বললো,- ছেলেটাকে কেমন লাগলো?কুহু কিছু বললো না চুপ করে রইলো। মেয়েকে চুপ থাকতে দেখে তিনি আবার বললেন,- আমার বেশ ভালো লেগেছে কতো মায়া চেহারায়। কুহু এবারো কিছু বললো না।কুহুর মা কুহুর চুল বেণী করছিলেন। বেণী করা শেষে রাবার দিয়ে চুল বেঁধে দিয়ে বললেন,- আচ্ছা ইরিনের ভাই কলরবকে কেমন লাগে তোর?কলরবের কথা শোনা মাত্রই কুহুর মনে হলো শ্বাস নিতেই কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভিতর দড়াম দড়াম শব্দ হতে লাগলো। কুহুর মনে হচ্ছে কুহুর মা এমনকি দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পিহুও বুঝি এই শব্দ শুনতে পাবে। নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে বললে,- আম্মু আমার ইরিনের ভাইকেও ভালো লাগে না আর এই ছেলেকেও ভালো লাগে না।কুহুর মা বিস্ফোরিত চোখে কুহুর দিকে তাকিয়ে বললো,- তোকে না তোর বাবা সেদিন জিজ্ঞাসা করলো তখন বললি না কেনো তোর অন্য কাউকে পছন্দ? ছেলের নাম কি? কোথায় থাকে? কি করে...মায়ের কথা শুনে কুহুর প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,- আশ্চর্য তো আম্মু। আমি কখন বললাম আমার অন্য কাউকে পছন্দ?- এই না বললি..কুহু রাগে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,- বলেছি এই দুই ছেলে ছাড়া তুমি যার সাথে ইচ্ছা আমার বিয়ে দাও। আমার কোনো আপত্তি নেই। এমনকি আমি একবার ছেলেকে দেখতেও চাইবো না।কুহু নিজের কথা শেষে রাগে গজগজ করতে করতে হেঁটে চলে গেল। আর একমুহুর্তও দাঁড়ালো না। কুহুর মা মেয়ের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে নিজেও উঠে পড়লেন। এখন আর কুহুকে কিছু বলবেন না। এখন ভালো কথা বললেও হিতে বিপরীত হবে। একটু পর যেয়ে মেয়ের সাথে কথা বলবেন। কুহুর রাগ পড়ে গেলে কুহুকে তিনি যা বোঝাবেন তাই বুঝবে। এদিক থেকে পিহু আবার অন্যরকম। একবার যা ঠিক করবে তাই। নিজের কথার বাইরে একচুলও নড়বে না। আজকালকার মেয়েরা কতো কি করে...। কুহুর সেরকম মেজাজ খারাপ হচ্ছে মায়ের উপর। রাগে ইচ্ছে করছে কলরব, কূজন দুইজনকেই বিয়ে করে মাকে শান্তি করে দিতে। বিরক্তিকর তো এই চিনে মা তাকে? এমন করে বললো কেনো মা ওকে?? ডাইনিং থেকে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো সে। সাথে সাথেই আবার সিদ্ধান্ত নিল এখন রুমে যাবে না। এখন রুমে গেলেই পিহু তাকে প্রশ্ন করবে কেনো সে এই কবিতা আবৃতি করে শোনালো। সে না বললো কাউকেই বিয়ে করবে না। কুহুর নিজের উপরও রাগ হচ্ছে বেশ। দুনিয়াতে কি কবিতার অভাব আছে নাকি? সে তো কতোশতো কবিতা পড়ে ঐগুলো মাকে শোনালেই হতো। তবে তার কি দোষ? কবিতাটা পছন্দ হয়েছে তার। কুহু মাথা কিছুটা ঠান্ডা করার জন্য ছাদে গেল। রেলিং এর দিকে এগিয়ে যেতেই দেখলো মধ্যবয়স্ক একজন লোক তাদের ছাদের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে একটা ছেলের সাথে কথা বলছেন। ছেলেটা পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে বলে সে বুঝলো না ছেলেটা কে। তবে পিছন দিক থেকে দেখে কূজন মনে হলো। কুহুর মেজাজ ঠান্ডা হওয়ার বদলে আরো চড়ে গেল। কুহু দেখতে পেল মধ্যবয়স্ক লোকটিও বেশ রেগে কথা বলছে। যদিও কি কথা হচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু উনার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে উনি বেশ রেগে আছেন। ছেলেটা কথা বলতে বলতে একটু ঘুরে দাঁড়ালো আর তখনই দেখলো ছেলেটা কূজন, তার ধারনাই ঠিক। এখানে এসেছিল মাথা ঠান্ডা করতে আর যেই ছাগলদের কারণে আজ ওর এই অবস্হা সে ছাগলদের একজন আবার এখানে হাজির। রাগে চোখ বন্ধ করে পায়ের কাছে থাকা টবে লাথি দিল কুহু। টবটা কাত হয়ে পড়ে গেল। কুহু পায়ে একটুখানি ব্যাথাও পেল। জোরে আউ বলে উঠলো সে। হাসনাদ সাহেব আর কূজন কথা থামিয়ে পাশের ছাদে তাকালেন। কুহুও ওদের দিকে তাকালো। দুইজনকেই ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কুহু তাড়াতাড়ি করে সিঁড়িঘরের দিকে পা বাড়ায়। কুহু চলে যেতেই হাসনাদ সাহেব কুজনকে বললেন,- এই মেয়েই কি কুহু?কূজন অবাক হয়ে বললো,- তুমি জানো কি করে?- কুহুর ছোট বোনকে দেখেছি। দুই বোনের ফেসকাটিং একইরকম। নাকটা তো পুরাই একরকম। - ওহ্।হাসনাদ সাহেব গম্ভীর হয়ে বললেন,- মেয়েটা দেখতে ভারি মিষ্টি আর তুমি কিনা...- বাবা উফ্ফো প্লিজ বুঝতে চেষ্টা করো কলরব ভাইয়ের সাথে কুহুর বিয়ে...হাসনাদ সাহেব হুংকার দিয়ে বললেন,- তুমি থাকো তোমার কলরব ভাইকে নিয়ে। আমিও দেখে নিব কুহু কীভাবে আমার ছেলের বউ না হয়ে থাকতে পারে? হাসনাদ সাহেব কূজনের কথা না শোনেই চলে যেতে নিলে কূজন পিছন থেকে বলে,- বাবা তোমার ছেলেই যদি বিয়ে না করে?হাসনাদ সাহেবের হাঁটার গতি কিছুটা শ্লথ হলেও তিনি পিছন ফিরে তাকালেন না। যেতে যেতেই বললেন,- তুমি আমাকে জন্ম দাওনি, আমি তোমাকে জন্ম দিয়েছি। কথাটা মাথায় রেখো। বাবা চলে যেতেই কূজন দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের চুল দুই হাতে খামচে ধরে বললো,- উফ্ বাবা তুমি বুঝো না কেনো?চলবে...পর্বঃ ৪০কুহু দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে লাগলো আরবিড়বিড় করে বলতে লাগলো,- ওরা কি আমার পিছু ছাড়বে না?? পাগল করে আমাকে পাবনা পাঠিয়ে দেখা যাবে দুই ভাই অন্য দুই মেয়েকে নিয়ে সংসার করা শুরু করবে। মাঝখানে থেকে আমিই বৈরাগী হবো। নিজে নিজে কথা বলতে বলতে আর দৌড়ে নামতে গিয়ে পড়ে যেতে নিল সে। তাড়াতাড়ি করে দেয়াল ধরে ব্যালেন্স ঠিক রাখলো। তবে পায়ে আবারো ব্যাথা পেল। এবার একটুখানি বেশিই ব্যাথা পেয়েছে। পায়ের আঙুলের দিকে তাকিয়ে দেখলো রক্ত পড়ছে হালকা। এবার ধীরে ধীরে দেখেশুনে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলো সে। কুহুদের বাসা যে তলায় সে তলায় পা রাখতেই কলরবের মুখোমুখি হলো কুহু। কলরবকে সে যেখানে সেখানে দেখে না শুধু ঘুমানোর সময় ওর কথা মনে হয় আর চোখ বন্ধ করলে তাই কলরব যে বাস্তবে হাজির তা বুঝতেপারলো। এবার কুহুর আর রাগ হলো না বরং প্রচণ্ড বিরক্ত লাগলো। যাদের চিন্তা মাথা থেকে সরাতে বাসা থেকে বের হয়েছিল তাদেরকেই কেনো ওর সামনে পড়তে হয়। কলরব কুহুকে দেখে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো কুহুর দিকে। তারপর হেসে জিজ্ঞাসা করলো,- কেমন আছো ফুলটুশী?কুহু তখন সেখানে দাঁড়িয়ে মনে মনে দুই ভাইকে ওয়াশিং মেশিনে ফেলে ইচ্ছে মতো ধুলাই করছিল। কলরবের কথা শোনে সে কলরবের দিকে সরাসরি তাকালো। তারপর ধীর পায়ে কলরবের একটু কাছে যেয়ে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে বললো,- আপনার সাহস তো কম না আপনি আমার বাসা অব্দি চলে এলেন। এত অভদ্র কেনো আপনি? আমার সাথে ফাজলামি করার জায়গা পান না। যত্তসব ফালতু!কলরব হালকা হেসে বললো,- কে বলেছে জায়গা পাই না? ছাদে দাঁড়িয়েই তো তোমার সাথে ফাজলামি করতে পারি কিন্তু তুমি তো আমার ভয়ে ছাদেই যাও না।কুহু চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,- আমি আপনাকে ভয় পাই না। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আমি কাউকে ভয় পাই না।কলরব এবার জোরে হেসে ফেললো। তারপর বললো,- ভয় পাও অবশ্যই আমাকে তুমি ভয় পাও। কিন্তু যখন রেগে যাও তখন পাও না আরকি। কিন্তু ফুলটুশী হঠাৎ রেগে আছো কেনো?কুহু এবার গলা চড়িয়ে আঙুল তুলে বললো,- একদম চুপ! এসব ফুলটুশী টুলটুশী বলে আমাকে ডাকবেন না। আর আপনার সমস্যা কি? ঘরে মা, বোন নেই? মেয়েদের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় জানেন না? আমাকে তুমি বলে সম্বোধন করার জন্য আমি আপনাকে পারমিশন দিয়েছি কি?- তুমি এত ভারি ভারি শব্দ ইউজ করো কেনো? সম্বোধন না বলে তুমি করে কেনো বলি এটা বললেই হতো।- আপনি এরকম ফাজলামি শুরু করেছেন কেনো?- শুনো ফুলটুশী আমার ঘরে মা আর বোন দুটোই আছে সাথে আছে বোনের একটা রাগী টিচার। অবশ্য ঘরে বউ নেই। তাই তোমাকেই যেতে হবে আমার বউ হয়ে।কুহু কথা বলছে ঠিকই কিন্তু পায়ের ব্যাথায় সে কাহিল হয়ে আছে। দাঁড়িয়ে ঝগড়া করার মতো শক্তি তার নেই। তার উপর কলরব যেভাবে তাকে বউ করার কথা বললো লজ্জা লাগছে তার। তাই আর দাঁড়ালো না সে।নিজেদের ফ্ল্যাটের দরজার নব ঘুরিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল। তবে পিছন থেকে কলরবের বলা কথাগুলো সে ঠিকই শুনেছে।কলরব উঁচু গলায় বলেছিল," বাই দ্যা ওয়ে ফুলটুশী আমি তোমার বাসায় আসিনি। বন্ধুর জন্য বাসা ভাড়া নিতে এসেছিলাম। আর আজ থেকে আপনি বলেই সম্বোধন করবো তোমায় তবে ফুলটুশী বলা বাদ দিব না।"কুহু নিজের রুমে যেয়ে প্রথমেই পায়ে ঔষধ দিল। তারপর চুপচাপ শুয়ে রইলো। অসুস্হ হলেই কুহু শুধু পড়ে পড়ে ঘুমায়। এতে করে ব্যাথা টের পাওয়া যায় না। কুহুর ঘুম ভাঙলো মায়ের ডাকে। কুহু কথা বললো না, ইশারায় মাকে পাশে বসতে বললো। মা পাশে বসতেই কুহু মায়ের কোলে মাথা রেখেমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,- সরি আম্মু ঐসময় মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল।কুহুর মা হেসে বললো,- এই জন্যই তো আপনার জন্য একটা ঠান্ডা স্বভাবের বাবাজি আনতে চাই। যাতে আপনি এভাবে হুটহাট রেগে গেলে বাবাজী চুপচাপ বসে থাকে। কুহু মায়ের কথায় লজ্জা পেয়ে বললো,- উফ্ আম্মু তুমি সবসময় খালি এসব নিয়ে পড়ে থাকো।কুহুর মা কুহুর কপালে চুমু দিয়ে বললো,- শোন না আমার কাছে কূজনকে বেশ ভালো লেগেছে। ছেলের বাবাটাও ঠান্ডা মেজাজের ছেলেকেও আমার তেমনই মনে হলো। যদিও কলরব ভালো। তোর বাবা তো কলরবকেই সাপোর্ট করছে....- আম্মু তুমি আবার শুরু করলে কেনো?- আহা আগে শোন তারপর বলিস। আমারো কলরবকে ভালো লাগে কিন্তু তোর যা রাগ ওদের ফ্যামিলিতে চলতে কষ্ট হবে। আমি বলছি না ইরিন খারাপ মেয়ে আবার ইরিন এখন ছোট তাই হয়তো ভালো।বড় হতে হতে অনেক কিছু বুঝবে, মায়ের আগে আগ বাড়িয়ে কথা বলবে, মাকে শিখিয়ে পড়িয়ে দিবে। শোন ননদরা খারাপ তা না। তবে দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো ননদটার সাথে চলতে গেলেও অনেক বুঝে শোনে বুদ্ধি খাটিয়ে চলতে হয়।একে তো তুই বোকাদের দলনেত্রী তার উপর যা রাগ। এভাবে যেয়ে চলতে পারবি না সেখানে। দুইদিন পর পর ভেজাল হবে। সাহরা ভাবিও কিন্তু প্রচন্ড চালাক। এত চালাক শ্বাশুড়ী ভালো না আবার বোকা শ্বাশুড়ীও ভালো না। মোটামুটি টাইপের হলে ভালো হয়। যদিও আমি জানি না কূজনের মা কেমন। হয়তো সাহরা ভাবীর মতোই হবে। আপন বোন বলে কথা আবার নাও হতে পারে। যেমন ধর পিহু কতো চালাক আর তুই একদম সহজ সরল। বাবারা এতো কিছু বুঝে না। মনে করে ছেলে ভালো হলেই হয়। কিন্তু সংসারের কতো প্যাঁচ আছে তা মায়েরা জানে....কুহুর মা আরো অনেক কথাই বলছে কিন্তু কুহু কিছুই শোনছে না। সে আনমনেই বললো,- মা ওদের দুইজনকে বাদ দেওয়া যায় না?- কেনো আমি তো বলি ওদের দুইজন থেকে একজনের কাছেই তোকে বিয়ে দিব।- কেনো মা?- কারণ ওরা দুইজনই সুপাত্র।- মা ওদের ফ্যামিলিতে বড় ধরনের ঝামেলা হবে।- হোক তাতে আমাদের সমস্যা কি? কলরব, কূজন তো আপন ভাই না। আপন ভাই হলে সমস্যা হতো এমনকি চাচাতো ভাইও না। খালাতো ভাইদের ক্ষেত্রে এতে তেমন কোনো সমস্যা হবে না।- মা তারপরো..- তোর তো অন্য কোথাও পছন্দ নেই তাই না?- না নেই।- তাহলে আমার উপর ভরসা আছে?- আছে।- তাহলে তুই কিছু বলিস না আমি তোর ভালোটাই করবো বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা আর তোর তকদির।কুহু আর কিছু বললো না। আসলেই তার মা সবসময় তার জন্য বেস্ট জিনিসটাই করেন। পিহু বেশি চালাক আর চটপটে বলে তিনি কুহুকে বেশি আদর করেন।কুহু আর কিছু ভাববে না কারণ মায়ের মনে কোনোদিনো সে কষ্ট দেয় না। পিকনিকে বা ঘুরতে গেলে মেয়েরা সমসময় নিজেদের জন কেনাকাটা করে কিন্তু কুহু সবসময় মা আর পিহুর জন্য গিফ্ট কিনে। ইলাভেনে পড়ার সময় রাঙামাটি গিয়েছিলঘুরতে। বাসে টাকা হারিয়ে ফেলেছিল। কাঁধে ঝুলানো ব্যাগে শুধু পাঁচশো টাকার নোট ছিল বাকি সব টাকা কেউ চুরি করে নিয়েছিল। সেবার সে পিহুর জন্যও কিছু নিয়ে আসতে পারেনি। শুধু মায়ের জন্য পাহাড়ীদের হাতে বুণা কামিজের কাপড় নিয়েএসেছিল। মা এমন পোষাক খুব পছন্দ করে দেখে নিজের জন্য কিছু না কিনেও সে মায়ের জন্য কিনেছিল। বাসায় এসে অবশ্য কামিজের সাথের ওড়নাটা পিহুকে দিয়ে দিয়েছিল। ছোট বোনকে কিছু না দিতে পেরে খুব খারাপ লাগছিল তার। যদিও পিহুজানে টাকা হারিয়ে না ফেললে পিহুর জন্যও কিছু নিয়ে আসতো। আর সেই মাকে কষ্ট দিতে পারবে না সে। আর তাছাড়া ভালোই হবে কূজন -কলরব নামক পাজেল থেকে মা তাকে মুক্তি দিবে।মা যাকে চুজ করবে সে তাকেই বিয়ে করবে।ছোটবেলায় পরীক্ষার সময় মা যদি বলতো পাট রচনাটা পড়ে যা তাহলে সেটাই পরীক্ষার প্রশ্নে থাকতো আবার যদি বলতো পরিবেশ দূ্ষণ পড় এবার তাহলে সেবার কেমন করে যেন সেটাই আসতো। কুহু মায়ের কথা মতো পড়তো আর সেটাই কমন পেতো সে। আজো সে মায়ের কথা মতো চলবে। মায়ের সাথে রাগ দেখিয়েই পায়ে ব্যাথা পেল সে। মাকে কষ্ট দিলেই তার কপালে শনি লাগে।..রাতে খাওয়ার টেবিলে কুহুর মা আবার কথা তুললেন। এবং সব শুনে বুঝেই তৈয়ব সাহেবও স্ত্রীর সাথে একমত হলেন। ঘরোয়াভাবে সিদ্ধান্ত হয়ে গেল আগামীকাল হাসনাদ সাহেবের সাথে কথা বলবেন।কূজনই যে কুহুর জন্য পারফেক্ট তৈয়ব সাহেবকে খুব সুন্দর করে বুঝিয়েছেন কবরী। পিহু কিছু বললো না শুধু ইশারায় বোনকে জিজ্ঞাসা করলো বোন রাজি আছে কিনা?কুহু ইশারায় বলে ফেললো মা - বাবা যা করবে তাতে সে দ্বিমত করবে না। ওদের এই একটা বিষয় আছে দুই বোনের মাঝে। হাজার মানুষের চোখ এড়িয়েও দুইবোন দিব্যি ইশারায় নিজেদের কথাগুলো বলে ফেলে। কেউ দেখলেও এই ইশারা বোঝে না। পিহু বোনের কথা শোনে নিশ্চিন্ত হয়েছে। যাক অবশেষে তার বোন থিতু হয়েছে। পিহুর মনটা আনন্দে ছেয়ে গেল।আপুণির বিয়ে অনেক মজা করবে সে। তারও একটা দুলাভাই থাকবে। দুলাভাই মানেই হলো সব আবদার পূরণ করার ছোট খাটো মেশিন। অবশ্য এই আবদারগুলো সবই হলো শয়তানী আবদার। কূজন দুলাভাই হিসেবে কেমন হবে ভাবতে লাগলো সে। বেশ ভোলাভালা দুলাভাই হবে। বড়লোক বাপের টাকা পকেটে নিয়ে ঘুরে তাই পকেট খালি করতে সমস্যা হবে না, নিজের রোজগার উড়াতে কষ্ট হয় কিন্তু বাপের টাকা উড়াতে মজা লাগে সবার। আর কূজন বেশ ভদ্র টাইপের মানুষ। অনেক দুলাভাই আছে যাদের খেচর মনে করে শ্যালিকারা। কিন্তু কূজন হবে কিউট দুলাভাই। বাহ্ বেশ সুন্দর গান শোনাবে।কূজনের গান অসাধারণ তবে কবিতাগুলো খুবই বোরিং। ঐগুলো না আবার জোর করে পড়ানো শুরু করে।মনে মনে হিসাব নিকাষ কষে ফেললো সে। নাহ্ মোটামুটি ভালোই দুলাভাই হবে।..কুহুর সারারাত ঘুম হয়নি। মাঝরাতের দিকে চোখে একটুখানি ঘুম এসেছিল। কিন্তু ভোররাতে ঘুমভেঙে গেল তার। পিহু তখন বিভোর হয়ে ঘুমোচ্ছে। কুহু এপাশ ওপাশ করছে। ঘড়ি দেখলো সে আজান পড়তে আরো সময় লাগবে। তাই বিছানা ছেড়ে উঠলো না। পিহুকে জড়িয়ে ধরে শুয়েরইলো। পিহু ঘুমের ঘোরেই কুহুর হাতে চড় দিল। কুহু হেসে হাত সরিয়ে ফেললো। পিহুকে কেউজড়িয়ে ধরে ঘুমোতেই পারে না। পিহু ঘুমের মাঝেও বিরক্ত হয়। কুহু উল্টো ফিরে চোখ বন্ধকরে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। চোখ বন্ধ করতেই কলরবকে মনে পড়লো। আজ কলরবকে কতোগুলো কথা শুনিয়েছে সে কিন্তু কলরব কিছু বলেনি। কলরবকে মনে পড়তেই মনেহলো কয়দিন বাদেই কূজনের সাথে বিয়ে হয়ে যাবে। তখন কূজনকে নিয়ে সংসার করতে হবে তার।ভাবতেই কান্না পেল কুহুর। প্রচন্ড জোর করেও কান্না আটকে রাখতে পারলো না। চোখ থেকেবারিধারা ঝরতে লাগলো। কুহু কাঁদতে কাঁদতেই উঠে পড়লো বিছনা ছেড়ে। তারপর চোখ বন্ধ করে সবকটা ঘটনা ভাবলো সে। তারপর লাইট জ্বালিয়ে আস্তে করে টেবিলের দিকে এগুলো। রিডিং টেবিলে রাখা খাতাগুলোর একটা থেকে একটা কাগজ ছিঁড়ে খাতাটা জায়গায় রেখে বসে পড়লো চেয়ার টেনে। কলম দিয়ে পৃষ্ঠার মাঝামাঝি দাগ কাটলো।তারপর একপাশে লম্বা করে কূজনের নাম অনেকবার লিখলো। তারপর অন্য পাশে একইভাবে কলরবের নাম লিখলো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো লিখাগুলোর দিকে। তারপর কিছু আঁকিবুকি করলো সাথে কিছু লিখাও লিখলো। পৃষ্ঠাটা হাতে নিয়ে বিছানার কাছে যেয়ে পিহুকে ডেকে তুললো। পিহু বিরক্ত হয়ে বললো,- পাগল হয়ে গেলি নাকি? ঘুম থেকে ডেকে তুললি কেনো? পাগল মেয়ে কোথাকার!কুহু পিহুর দিকে পৃষ্ঠাটা এগিয়ে দিল। পিহু ঘুম ঘুম চোখেই দেখতে শুরু করলো। পিহুর চোখছানাবড়া হয়ে গেল। অবাক চাহনী নিয়ে পিহু কুহুর দিকে তাকিয়ে বললো,- এর মানে কি?কুহু সামান্য হেসে বললো,- এর মানে হলো আমি কূজনের কবিতা, গান, আচার, ব্যাবহার সব ভালোবাসি কিন্তু ভালোবাসি কলরবকে।পিহু ঝাঁঝালো কণ্ঠে কুহুকে বললো,- তোকে আমি কালকেই আব্বুর কাছে বলে পাবনা পাঠাবো।কুহু শান্ত স্বরে পিহুর হাত থেকে কাগজটা নিয়ে পিহুর পাশে বসে পড়লো। তারপর কাগজটায় আঙুল দিয়ে পিহুকে দেখিয়ে বললো,- এই যে দেখ কূজনের নামের উপর আমি লাভ চিহ্ন দিয়েছে কিন্তু ওর নামের পাশে ভালোবাসি কথাটা লিখতে পারিনি। কলরবের নামের পাশে বারংবার লিখেছি ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি। লাভ চিহ্ন আঁকা আর ভালোবাসির মধ্যে বহু তফাৎ পিহুন।- এই লিখা দিয়ে তুই কীভাবে বুঝলি?- ভালোবাসা আর মুগ্ধ হওয়া এক নয়। কূজনকে আমি কখনোই ভালোবাসিনি। ভালোবেসেছি কলরবকে। কূজনের কবিতা গান এসব আমাকে মুগ্ধ করেছে এমনকি আমি কখনো কলরবকে নিয়ে তেমন একটা ভাবিনি। সবসময়ই কূজনকে নিয়ে ভেবেছি। কূজনের গান নিয়ে ভেবেছি। কূজনের কবিতা পড়ে কবিতায় মুগ্ধ হয়েছি কিন্তু যতবার আমি কূজনের গান শুনেছি ততোবারই কলরবকে মনে পড়েছে। কূজনের লিখা কবিতায় আমি কলরবের চোখে নিজেকে দেখেছি।পিহু হা হয়ে আছে। মুখ কিছুতেই বন্ধ করতে পারছে না। কুহু একমনে বলেই চলেছে,- কলরবকে নিয়ে আমার কখনো ভাবতে হয়নি সে নিজেই আমার হৃদয়ের মাঝে ঝেঁকে বসেছিল তাই ওকে নিয়ে ভাবা লাগতো না সে এমনিতেও মনে পড়তো। তার উপর কূজন আর আমি সবদিক থেকেই সেইম। দুজনের পছন্দের জগৎটা একই। অপরদিকে কলরবের কিছুই আমার ভালো লাগে না। কলরব গায়ে পড়া স্বভাবের ছেলে, তারউপর বেশি পটপট করে, খেলাধূলায় মেতে থাকে। এসব কিছুই আমার ভালো লাগে না। তারপরো কেনো আমার তাকে ভালো লাগে জানিস? আসলে আমি কলরবকে ভালোবাসি।কূজনের প্রতি ভালোলাগা কাজ করে আর কলরবের প্রতি ভালোবাসা। তুই যাকে ভালোবাসবি তাকে কারণ ছাড়া ভালো লাগবে তোর। যেমনটা কলরবের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এই ছেলের মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অব্দি আমার কিছুই ভালো লাগে না। মানে ওর আচরণের কথা বলছি আরকি তারপরো কেনো আমার তাকে ভালো লাগে?? কারণ আমি কলরবকে ভালোবাসি।এতটুকু বলেই কুহু কাগজটা মাঝ বরাবর ছিঁড়ে ফেললো। কূজনের নামগুলো লিখা যে পাশটায়সে অংশটুকু বটে ফেললো আর কলরবের নাম লিখা কাগজটায় চুমু খেয়ে উঠে পড়লো বিছানাছেড়ে। মোবাইল আর ইয়ারফোন নিয়ে বারান্দার দিকে এগুলো সে। বারান্দায় যাওয়ার আগে রুমের কোণায় রাখা ময়লার ঝুড়িতে কূজন লিখা কাগজটা ফেলে দিলো। বারান্দায় যেয়ে চুলের বেণুণী খুলে চুল ছেড়ে দিলো সে। তখন চারিদিকে অন্ধকার, সবাই ঘুমিয়ে শুধু কুহুর মন জুড়ে কলরব নামক বহ্নিশিখা জ্বলছে আর কুহুর হৃদয় জেগে কলরব ধ্বনিতে মুখোরিত হচ্ছে। হালকা বাতাসে কুহুর দীঘল কালো চুলগুলো উড়ছে। কুহুর এই কেশের নেশায় যেকোনো ছেলেই কুহুরগ্রীবায় গহীনে মত্য হবে, ডুবে যেতে চাইবে তার চুলের নেশায়। কিন্তু কুহু ডুবছে কলরব নামক সমুদ্দুরে। কুহু কানে ইয়ারফোন গুঁজে চোখ বন্ধ করে গান শুনছে আর কলরবের বলা একেকটাকথা, তার গগণবিহারী হাসি, হৃদয় ছিদ্র করে ফেলার মতো ডাক ফুলটুশী সব মনে করছে সে। গানের প্রতিটি লাইনেই সে কলরবের নামে উত্তর দিচ্ছে।" সুজন তুমি আমায় যে গো ভুল বুঝো না।আমি ছিলাম তোমার, থাকবো তোমার হয়েই ঠিকানা।হৃদয় জুড়ে এখনো তো তোমায় আঁকে মন।আমার কাজল কালো আখিতে রয় তোমারি স্বপন।আজ ভুলের পাহাড় গইড়া তুমি ডুবলে যে নেশায়।"কুহু গানের লাইনের বিপরীতে বললো,- উঁহু কলরব আমি ভালোলাগার নেশায় তোমার ভালোবাসা বুঝিনি।ভুল করেছি আমি তুমি না কলরব। "সেই নেশাই যেন দূরে ঢেইলা দিল যে আমায়।"কুহু ঘোর লাগা কণ্ঠে আবার বললো,- আমি দূরে ঢেলে দিতে চেয়েছিলাম তোমায় কিন্তু তুমি প্লিজ এই গাধীটাকে দূরে ঢেলে দিও না।"হায় কেমন কইরা ভাবলা তোমার খবর নিব না? হায় কেমন কইরা ভাবলা এই মন তোমায় দিব না? দূরে কোথাও যাইনি আমি কাছে যে আছি। শুধু চোখটা মেলে দেখো আমি যে একউদাসী। আমার পায়ের নূপুর শুধু তোমার আঙিনায়। বাজবে যখন ডাকবে তুমি আমায় একটিবার। রোজ বিকালে আমি একা থাকি দাঁড়িয়ে। তুমি কখন আইসা দেবে তোমার হাতটা বাড়িয়ে? এই হৃদপিন্ডের ধুঁকপুৃঁকানি শুধুই যে তোমার। বন্ধু কেনো বুঝো নাগো বলি বারেবার।"কুহু কান থেকে ইয়ারফোন খুলে কাগজটা বুকের সাথে চেপে ধরে বললো,- আই ডু মাভ ইউ কলরব! আই ডু লাভ ইউ!কুহুর চোখ থেকে এক ফোঁটা ভালোবাসার জল গড়িয়ে পড়লো। চিবুক পেরিয়ে বুকের মাঝেচেপে ধরা কাগজটায় মিলিয়ে গেল এই ভালোবাসার জল।চলবে....পর্বঃ ৪১কুহু মায়ের রুমে উঁকি দিয়ে দেখলো মা নামজ পড়ছেন। কুহু দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলো নামাজশেষ হওয়ার। মায়ের নামাজ শেষ হতেই কুহু রুমের ভিতর ঢুকলো। তারপর আস্ত করে বললো,- আম্মু! আব্বু কি মসজিদে??- হুম। কিছু বলবি?কুহু মায়ের কথা শোনে ঢোক গিললো। হঠাৎ মনে হলো কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে তার। গলারকাছে এসে সব শব্দ আটকে যাচ্ছে। কুহুর মা বিছানায় বসতে বসতে বললেন,- কি হলো কি বলবি বলে ফেল।কুহুর ভয়ে বুক কাঁপছে। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। কীভাবে মাকে ব্যাপারটা বোঝাবেসে?? মাকে কীভাবে বলবে কথাটা?? আমি কলরবকে ভালোবাসি মা। ছিঃ মায়ের সামনে ভালোবাসা নিয়ে কথা বলতে পারবে না সে। তাহলে কীভাবে?? মা আমি কূজনকে না কলরবকে বিয়ে করবো। এভাবে বলবে?? নাহ্ কলরব নাহ্ বলবো ইরিনের ভাই। নাহ্ এভাবেও না। অনেক ভেবেও বুঝতে পারছে না কীভাবে কি বলবে। বুকের ভিতর চাপা একটা কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে কলরবকে হারিয়ে ফেলবে। কুহুর শ্বাসপ্রশ্বাস নেয়া হঠাৎ বেড়ে গেল। হাত পাও কাঁপতে শুরু করলো। কুহু মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। কুহুর মা মেয়ের এই অবস্হা দেখে কুহুকে টেনে বিছানায় বসিয়ে জড়িয়ে ধরে বললেন,- কি হলো আমার আম্মার??কুহু এবার মাকে জড়িয়ে কেঁদো দিল।কুহুর মায়ের এবার ভয় হচ্ছে। এই বয়সী মেয়েদের নিয়ে যে কতো বড় সমস্যা তা মেয়ের মা ছাড়া অন্য কেউ জানে না। কবরীর প্রেশারও হাই হয়ে যাচ্ছে। উনি মেয়েকে আঁকড়ে ধরে বিছানা ছেড়ে দাঁড়ালেন। তারপর মেয়ের মুখ দুহাত দিয়ে উপরে তুলে বললেন, - আমাকে বলো আম্মা। কি হয়েছে তোমার??আম্মু সব ঠিক করে দিব।কুহু মাকে ছেড়ে দিয়ে হাত দিয়ে চোখ মুছলো তারপর চুপ করে বসে রইলো। কুহুর মা আবার কুহুর পাশে বসে আস্হা মেশানো কণ্ঠে বললেন,- আম্মা আমার তুমি শুধু একবার বলো। না বললে আমি বুঝবো কি করে???কবরী মেয়েদের তুই তোকারি করলেও সিরিয়াস মোমেন্টে তুমি ছাড়া কথা বলতে পারেন না। কবরী রীতিমতো ঘামছেন। ভিতরে বাহিরে সর্বাঙ্গে মেয়ের চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছেন। কাঁপা স্বরে বললেন, - কুহু আম্মা আমার বলো না কি হয়েছে??কূজনকে ভালো লাগে না?? কাকে ভালো লাগে?? আম্মুকে বলো। আর তোমার আব্বুও তো সেদিন বললোই...কুহু মায়ের কথায় ফুঁপিয়ে কেঁদে বললো,- আম্মু আমি.. আমি....কবরী এইবার ধমকে উঠে বললেন,- তুমি না বললে বুঝবো কি করে??কুহু মায়ের কাছ থেকে নিজেকে ছাঁড়িয়ে নিয়ে বললো,- তুমি আমাকে ধমকাচ্ছো কেনো আম্মু??দরকার নেই শোনার। যা ইচ্ছা তাই করো। তারপর উঠে দাঁড়ালো বিছানা ছেড়ে। কবরী চোখ বন্ধ করে মেজাজ শান্ত করলেন তারপর মেয়ের হাত ধরে টেনে মেয়েকে থামিয়ে বললেন,- সরি আম্মাজান আর বকবো না।কুহু চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর কাঁপা স্বরে বললো,- তুমি বকবে না তো?- নাহ্ একদম না।- রাগ করবে??- না রাগও করবো না।কুহু চোখ বন্ধ করে এক নিঃশ্বাসে বললো,- মা আমি কূজনকে বিয়ে করবো না। আমি..আমি.. আমি....কুহু এতোটুকু বলার পর আবার বাকশক্তি হারিয়ে ফেললো। ওর চিন্তাজগত মায়ের হাতে চড়খাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলো। ইচ্ছে হচ্ছে দৌড়ে পালিয়ে যেতে কিন্তু পা গুলো সঙ্গ দিচ্ছে না। মায়ের দিকে তাকাতেও পারছে না সে। অপরদিকে কবরী থতমত খেয়ে বসে আছে। মেয়েকে কি বলবে বুঝতে পারছেন না। এই মেয়েকে নিয়ে তিনি দূর্ভোগে পড়েছেন। এই মেয়ে কখন কি বলে না বলে নিজেই জানে না। কোনো সেন্স নেই।ছোটবেলায় পড়ে ব্যাথা পেয়েও বুঝতো না যে ব্যাথা পেয়েছে। উনি নিজে দেখে তারপর মলম লাগিয়ে দিতেন। আজো তাই করতে হবে উনাকে। মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে ফেললেন তিনি। তারপর ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে মেয়েকে উদ্দেশ্যে করে বললেন,- ঠিকা আছে কাঁদিস না কূজনের বাবাকে না করে দিব।মায়ের কথা শোনে কুহুর বুক থেকে পাথর সরে গেল। কুহু আল্লাহকে মনে মনে ধন্যবাদ জানাতে লাগলো। ঠিক তখনই কবরী আবারো বলতে শুরু করলেন,- তুই তো বলেছিস কাউকে তোর পছন্দ না তাহলে সমস্যা কোথায় তোর?কূজন আর কলরবই তো ঠিকাছে ওরা বাদ। আমার আম্মাজানের জন্য তাহলে অন্য ছেলেদেখবো। এবার খুশি তো?? আমার মেয়ের জন্য কি পাত্রের অভাব হবে নাকি???কুহু মায়ের কথা শোনে ভয়ার্ত চোখে মায়ের দিকে তাকালো। বুকের মধ্যে তার ঢিপঢিপ আওয়াজ হতে লাগলো। মনে হলো পৃথিবী উল্টে যাচ্ছে। কুহু নিজের ঠোঁটের সাথে আন্দোলন করে অস্ফুট স্বরে বললো,- আম্মু ইরিনের ভাই....কবরী ভ্রু কুঁচকে মেয়ের দিকে তাকালেন। কুহু মায়ের তাকানো দেখে ভয়ে চুপসে গেল। ঢোকগিললো সে। তারপর বিনাবাক্যে পা বাড়ালো রুম ছাড়ার জন্যে। কবরী পিছন থেকেআস্তে করে বললেন, - কুহু! তুই আর কলরব কি একজন আরেকজনকে পছন্দ করিস???কুহু মায়ের কথায় হাঁটার গতি আরো বাড়ালো।কুহুর মা মেয়ের অবস্হা দেখে সম্মোহিত হয়ে বললেন,- তাহলে কলরবের সাথেই তোর বিয়ে ঠিক করছি।কুহু না চাইতেও তাঁর পা দুটো থমকে গেল। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে সে মায়ের দিকে ফিরে তাকালো। পরমূহুর্তেই সে নিজের ঘরের উদ্দেশ্যে দৌড় দিল। কুহুর মা হালকা হাসলেন। তারপর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।অনেক বড় ভুল করা থেকে আল্লাহ বাঁচিয়েছেন উনাকে। মেয়ের চোখে একটু আগে কলরবেরসাথে বিয়ের কথা বলার পর যে কৃতজ্ঞতা ভরা চাহনী আর ঠোঁটের কোণে খেলে উঠা রঙধনু তিনি দেখেছেন তাতে তাঁর হৃদয় প্রশান্তিতে ছেয়ে গেছে।..কলরব মসজিদ থেকে বের হয়ে এলোমেলোভাবে রাস্তায় হাঁটছে। আর বিড়বিড় করে বলছে, - ফুলটুশী আপনি কেমন আছেন?? আপনাকে আপনি বলতেও ভালো লাগে। তবে তুমি করে বললে কেমন যেন মায়া মায়া লাগে। আচ্ছা কখন আপনাকে হাতে ধরে ধরে বাস্কেটবল শিখাতে পারবো?? এতদিন তো বাস্কেটবল শিখাইনি শুধু বল ছোঁড়াছোঁড়ি করেছি। মিস কুহু আরিজা আপনি কি জানেন আপনার ভ্রুগুলো কতো সুন্দর?? আর আপনার চোখে কেমন যেন মায়া আছে? এতো মিষ্টি কেনো আপনি? আমি বরাবরই ঝাল পছন্দ করি। এই প্রথম কোনো মিষ্টি ভালো লাগলো। মিষ্টির নামকরণটা কিন্তু মহান কলরব ইবনাতই করেছেন। ফুলটুশী নামক মিষ্টিতে এই ঝালবাবু উবে গেছেন।কলরব বিড়বিড় করা থামিয়ে নিজের মাথায় টোকা দিয়ে বললো,- মিস্টার কলরব ইবনাত আপনি তো দেখছি পুরো পাগল হয়ে গেছেন। এভাবে চললে কোনো মেয়ের বাপ মেয়ে দিবে না আপনার কাছে। তারপর নিজে নিজেই কলরব নিজের বলা কথাশুধরে নিয়ে বললো,- কোনো মেয়ের বাপ না শুধু কুহুর বাপ।চলবে...পর্বঃ৪২কূজন কুহুদের বাসার সোফায় বসে আছে। কুহুর বাবা - মা ও বসে আছেন। এমনকি কূজনের মুখোমুখি হয়ে সামনের সোফাটায় বসে আছেন ওরা। কূজনের মন অস্বস্তিতে ভরে আছে। কূজনকে উশখুশ করতে দেখে কুহুর মা কূজনকে ইশারায় আশ্বস্ত করলেন। কূজন কুহুর মায়ের ইশারায় তর্জনী দিয়ে কপালের ঘাম মুছলো। ভারমুক্ত লাগছে এখন তাকে। কূজন ঠোঁটে হালকা হাসি মিশিয়ে তাকালো পাশে বসে থাকা কলরবের দিকে। চোখে মুখে খুশির ঝিলিক বয়ে যাচ্ছেকলরবের। যে চোখে কূজন শুধু বুদ্ধির দীপ্তশিখা দেখতো আজ কলরবের সে চোখেই ভালোবাসার দীপ জ্বলতে দেখছে সে। কিন্তু তাঁর বুকের ভিতর যে চিতা জ্বলছে তা কি কেউদেখছে?? বুকের মধ্যে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে তার। চোখে মুখে ফুটে উঠবে সে ভয়ে কৃত্রিম চওড়া এক হাসি ঠোঁটে এঁকে রেখেছে। এই হাসি দিয়ে নিজের বসন্ত প্রেমের প্রথম কুহু ডাক না পাওয়া নামক হিমালয়ে বিলীন করে দিতে চাচ্ছে কূজন। কিন্তু সেই কুহু ডাক বুকের পাঁজর নামক হিমালয়ে গিয়ে কঠিন ধাক্কা দিচ্ছে আর ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছে বেদনা হয়ে। আসলেই কি কেউ বুঝেনি তার কষ্ট নাকি সবাই বুঝেও না বোঝার ভাণ করে যাচ্ছে?কেউ বুঝেনি কে বলেছে?? বাবা তো বুঝেছিল।বাবা তো যেকোনো মূল্যে কুহুকে তার করেই দিত কিন্তু ঐ যে বুকের পাঁজরে কুহু ডাক শুনলেওপরিবারের মাঝে আর কোনো বিদ্রোহ ক্লেশ দেখতে চায় না সে তাই তো মাকে দিয়ে কুহুর মা -বাবার কাছে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে যেন সবার কাছে বিষয়টা গোপন থাকে। জাহরা কবরীরকাছে ক্ষমাও চেয়েছেন। বলেছেন আসলে কলরবও যে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে তা অজানা ছিল। জানা থাকলে এই ভুলটা করতেন না। কূজন মায়ের কাছেও কথা শুনেছে। কেনো সেদিন রাতেইবাবাকে কুহুদের বাসায় যেতে না করেনি?? না করলেই তো কূজনের বাবা কুহুদের বাসায় যেত না।কূজন মাকে কীভাবে বোঝাবে সে তো নিজের মধ্যেই ছিল না, নিজেকেই সামলাতে পারছিলো না। বাবা যে কাল সকালেই কুহুদের বাসায় যাবে মাথা থেকেই আউট হয়ে গিয়েছিল। কূজন ভাবছে ভালোয় ভালোয় সব মিটে গেলে হয়। বাবাকে তো বলে কয়ে দমিয়ে রেখেছে সে। কি জানি আসলেই দমে গেছে নাকি ঝড়ের পূর্বাভাস? কূজন খুব ভালো করেই জানে ওর বাবার পাওয়ার কেমন। বাবার একটুখানি ইশারায় সব উলটপালট হয়ে যেতে পারে। ওর বাবা চাইলে কলরবকে যেকোনো ধরনের কাজে ফাঁসিয়ে জেলেও পাঠাতে পারে এমনকি মেরে ফেলে লাশ গুম করার মতো ক্ষমতাও আছে। চাকরিটাও খেয়ে ফেলতে পারে। যেকোনো ধরনের স্ক্যান্ডেল লাগিয়ে দিতে পারে কলরবের মাথায়। এসব কথা ভাবতেই কূজনের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। ওর বাবা নিতান্তই ভালো মানুষ কিন্তু ছেলের জন্য সব করবেন উনি।বড় বড় আমলা থেকে শুরু করে পুলিশ ডিসি, এসপি, সন্ত্রাস সবাই বাবার টাকার কাছে হার মানবে। কিন্তু কূজন তো এগুলো চায় না। সে চায় শান্তি! সবাই শান্তিতে থাকুক এটাই। কূজনের ভাবনায় ছেদ পড়লো কলরবের ডাকে।- কিরে উঠ আমার সাথে চল।- কোথায়?ইরিন আনন্দে গদগদ হয়ে বললো,- আমরা ভাবির সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। কূজন ভাইয়া তাড়াতাড়ি চলো।কূজন অবাক হয়ে বললো,- কোন ভাবি??- কোন ভাবি আবার কুহু ভাবি। আমাদের একমাত্র ভাবি নাহ্ তোমার একমাত্র ভাবি তবে আমার বড় ভাবি হবে কুহু ভাবি আর ছোট ভাবি হবে তোমার বউ। ওয়াও দুই ভাবিকে দিয়ে কাজ করাবো আমি। জংলি ননদিনী হবো আমি।কূজন বিড়বিড় করে বললো,- কুহু ভাবি!তারপর উঠে দাঁড়ালো। তবে হাত পা ছেড়ে দিতে চাইছে মন। সারা শরীর জুড়ে অস্ফুট ব্যাথা জেঁকে বসেছে। পা চলছে না, মনও চলছে না তবুও কূজন কলরব আর ইরিনের সাথে চললো। সাহরাও আছেন সাথে। পিহু ওদের কুহুর রুমে নিয়ে যাচ্ছে। যাওয়ার পথে কলরব ইরিনকে ফিসফিস করে বললো, - ইরিন তুই জংলি না তুই হবি জঙ্গী ননদিনী। হাহাহহা ইরিন ভাইকে চিমটি কাটলো তারপর কূজনের হাত ধরে বললো,- এই জন্যেই কূজন ভাইয়াকে আমার ভালো লাগে। তোমার মতো খালি আমাকে ক্ষেপায় না। হুহ্হহ্ একবার বিয়েটা করো তারপর দেখো আমি আর কুহু ভাবি মিলে কেমন নাকানিচুবানি দেই তোমাকে।কলরব ইরিনের কথায় হেসে ফেললো।..কুহুর মা কুহুকে নীল রঙের একটা শাড়ি পরিয়েছেন।কুহু পরতে চায়নি তারপরো জোর করেপরিয়েছেন। হাত ভর্তি নীল কাঁচের চুরি পরিয়ে হহাতখোঁপা করে ঘোমটা টেনে দিয়েছেনমেয়ের। তারপর বলেছেন একটু সেজে নিতে।কিন্তু কুহু সাজেনি। কবরী বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন," এত ঢং করিস কেনো তুই?এমনিতে তো কতোই সাজিস, শুধু শুধু বাসায় বসেবসে সেজে এ ঘর ও ঘর ঘুরে বেড়াস কিন্তুযেই মানুষজনের সামনে যাবি পেত্নীর মতোচলে যাস। "কুহু বিরক্ত হয়ে বলেছিল,- আম্মু শাড়িও কিন্তু পড়বো না তাহলে।- আচ্ছা মা আর বলবো না। তুই যে আমাকে কি পরিমাণজ্বালাস আল্লাহ খালি বুঝতে পারবে। ভালোয়ভালোয় তোকে বিদায় করলে বাঁচি।কুহু মায়ের কথা শোনে হেসে বলেছিল,- দেখা যাবে! পরে কান্নাকাটি করলেও আমি তোমারবাড়ি আসবো না।কবরীও তখন মেয়ের সাথে হেসেছেন কিন্তুচোখের কোণে পানি চিকচিক করছিল।ইরিনকে ভিতরে আসতে দেখেই কুহু জমেগেল। কুহু বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসেছিল। পা গুলোফ্লোর ছুঁয়ে রেখেছে। কলরবকে ভিতরেআসতে দেখে পা দিয়ে ফ্লোর আঁকড়েধরলো। নীচের দিকে চোখ নামিয়ে বসেআছে সে। হঠাৎ চোখ গেল কূজনের স্নিকারসএর দিকে। মূহুর্তেই কূজনের জন্য খারাপ লাগা শুরুকরলো তার। কূজনের নিশ্চয় কষ্ট হচ্ছে। এভাবেওকে ভাইয়ের বউ হিসেবে দেখলে কূজনেরকষ্ট হওয়াটাই স্বাভাবিক। কুহু তো চায়নি কাউকে কষ্টদিতে আর কূজনকে তো সে তেমন কোনোকথাও দেয়নি এমনকি ইশারাও করেনি তাহলে নিশ্চয়কূজন মনে কষ্ট পেলে কুহুর তাতে কোনদোষ নেই। সাহরা কুহুর চিবুকে হাত রেখে কুহুর মুখতুলে ধরলেন। কুহু সাথে সাথে সালাম দিল সাহরাকেতারপর পা ছুঁয়ে সালাম করতে নিলেই সাহরা বললেন,- পা ছুঁয়ে সালাম করতে হয় না।কুহুও চায়নি করতে। কুহুর মা জোর দিয়ে বলেদিয়েছেন যেন অবশ্যই পা ছুঁয়ে সালাম করে তাইকরতে চেয়েছিল। কুহু মনে মনে খুশি হলোএরকম আজেবাজে কুসংস্কার মানেন না সাহরা।ইরিন কুহুকে জড়িয়ে ধরে বললো,- শুনো ভাবি আজ থেকে তুমি করে বলবোতোমাকে। আর আমাকে একদম বকা দিবে না কিন্তু।পড়া না পারলে ভাইয়ার মতো সুন্দর করে বুঝিয়েদিবে। ভাইয়া আমাকে যেভাবে ফিজিক্স বুঝিয়েদেয় ঠিক সেভাবে ওকে??কুহুর খুব হাসি পাচ্ছে কিন্তু হাসতেও কেমন জড়তা কাজকরছে তাই চুপ করে মাথা নেড়ে ইরিনের কথায় সায়দিল সে।সাহরা আদর মেশানো হাতে কুহুর মাথার ঘোমটাএকটুখানি সরিয়ে নিতেই কুহু আতঙ্কিত হয়ে পিছিয়েগেল।সাহরা হেসে বললেন,- পুরো ঘোমটা সরাচ্ছি না তো মা। আমার আবার ড্রামাবেশি, সিরিয়াল টাইপের। তাই বহুদিনের শখ ছেলেরবউকে টিকলি দিব। সাধারণ মানুষের মতো আংটি ফাংটিদিয়ে কথা পাকা করবো না। সিনেমা টাইপ টিকলি দিব।সিনেমাও না। সিনেমাতে তো হাতের বালা দেয় আমিআরো একধাপ এগিয়ে টিকলি পরিয়ে দিব তোমাকে।কথা শেষ করে সাহরা কুহুর দিকে এগিয়ে গিয়ে টিকলিপরিয়ে দিলেন কুহুকে। তারপর কুহুর কপালে চুমুখেয়ে বললেন,- অনেক মিষ্টি লাগছে তোকে।- দোয়া করবেন।- অবশ্যই।সাহরা ইরিন আর কূজনকে উদ্দেশ্য করে বললেন,- ইরিন! কূজন! এখন চল তো আমরা যাই। ওরা একটুখানিকথা বলুক।কুহু চুপসে গেল ভয়ে। কলরব যদি এখন ওকেগতকালকের জন্য ধমক দেয়?? কলরব একটুখানি সিরিয়াসহয়ে কথা বললেই কেমন যেন গম্ভীর গম্ভীরলাগে তাকে, ভয় করে কুহুর। সেদিন স্কেল দিয়েটেবিলে মেরেছে আর কুহুর মনে হয়েছিল এইবুঝি তাকে মারবে। মনে মনে কথাগুলো ভেবেকুহু ঢোক গিললো। ইরিন আর কূজন এতক্ষণে ঘরছেড়ে চলেও গেছে। সাহরা দরজার কাছেযেয়ে পিহুকেও ডেকে বললো চলে আসতেউনার সাথে। পিহু রুমের ভিতরেই ছিল। পিহু চলেযেতে নিতেই কুহু সঙ্কিত গলায় বললো,- না পিহু তুই থাক।পিহু বোনের কথা শোনে সাহরার দিকে তাকালো।কলরবের মা পিহুর হাত ধরে টেনে পিহুকে নিজেরসাথে নিয়ে চলে গেলেন। ওরা চলে যেতেইকুহু কলরবের দিকে চোখ তুলে তাকালো। কলরবফরমাল সাজে এসেছে আজ। সাদা ফর্মাল শার্টপরেছে সে। কুহু পরমুহূর্তেই চোখ নামিয়ে নিল।কলরব যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানেই দাঁড়িয়েইবললো,- কেমন আছেন আপনি??কুহু কিছু বললো না। কলরবের মুখে আপনি শুনেসে আরো জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ালো। মানেসত্যি সত্যি কলরব রেগে আছে। এখন নিশ্চয় ধমকদিবে কুহুকে।কলরব কুহুর কাছে উত্তর না পেয়ে রুমটা ঘুরেঘুরেদেখতে লাগলো। কুহু অস্বস্তিতে কুৃঁকড়েযাচ্ছে। কলরব হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলো,- আচ্ছা ফুলটুশী আমি কি তোমাকে না মানে সরিআপনাকে একটুখানি ছোঁয়ে দেখতে পারি??কুহু খাট ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল।কলরবের কথা শুনেআতঙ্কে পিছিয়ে গেল আর বিছানায় ধপ করেপড়ে গেল। কলরব কুহুর দিকে তাকিয়ে দেখলোকুহু বিছানায় বসে আছে। চোখে মুখে স্পষ্টআতঙ্কের ছাপ। কলরব কুহুর এই অবস্হা দেখেহেসে ফেললো তারপর আঙুল দিয়ে ইশারায় কুহুরছবির ফ্রেম দেখিয়ে কুহুকে বললো,- এখানে ছোঁয়ার কথা বলছি। ছু্ঁতে পারি???কুহু কলরবের কথা শোনে অবাক হয়ে কলরবেরদিকে তাকিয়ে রইলো। কুহু একবার নিজের ছবিটারদিকে তাকাচ্ছে, আরেকবার কলরবের দিকে। সেসম্মোহিত হয়ে কলরবের কথা গুলো মনে মনেআওড়াচ্ছে। কলরব কুহুর দিকে একনজরে তাকিয়েআছে। ঘোর লাগা দৃষ্টি নিয়ে কুহুর চোখে ডুবেযাচ্ছে সে। কুহুর চোখে বিস্ময় দেখতে পাচ্ছেসে।চলবে....পর্বঃ৪৩কলরব ড্রয়িংরুমে ফিরে আসতেই পিহু গেল কুহুরকাছে। রুমে যেয়ে দেখলো কুহু বিছানায়হতবাক হয়ে বসে আছে। মাথায় আর ঘোমটানেই। কুহুকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তার মাথাএখন পুরাই ফাঁকা। পিহু কিছুটা অবাক হলো।তারপর দরজা বন্ধ করে বোনের পাশে বসলো।কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললো,- আপুণি কলরব ভাই কি তোকে কিছু করেছে??কুহু ভাবনায় মগ্ন ছিল তবে বুদ হয়ে ছিল না তাইকথাটা কানে গেল। সে পিহুর দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,- কিছু করেছে মানে কি????পিহু ফিক করে হেসে দিয়ে বললো,- আপুণি তুই ইদানিং চালাক হয়ে যাচ্ছিস। মাআসলে ভুল বলে। তুই বোকা না।পৃথিবীতেবোকা বলতে কেউ নেই। সবাই চালাক কেউএকটুখানি কম আর কেউবা একটুখানি বেশি।তাছাড়া প্রেমে পড়লে বোকারা তো চালাকহয়েই যায়, তুইও হয়ে গেছিস।কুহু চোখ ছোট ছোট করে পিহুর দিকে রাগী লুকদিয়ে বললো,- আমি কবে চালাকি করলাম??- এই তো এখনি।- মোটেও না।- তাহলে তোকে এমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছেকেনো??কুহু চোখ মুখ কুঁচকে বললো,- জানিস কলরব যে পাগল???পিহু আর্তনাদ করে বললো,- নাহ্ এ হতে পারে না! আমার ওয়ান এন্ডঅনলি এটিএম কার্ড পাগল হতে পারে না।- এটিএম কার্ড মানে?- তোর জামাইর টাকা মারবো আরকি।- আরে জামাই টামাই রাখ আগে শোন পাগলটাকি করেছে।পিহু দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে বললো,- না না ছিঃ! আমি শুনবো না আমার শরম করে।কুহু হতাশ গলায় বললো,- পিহুন এমন করছিস কেনো? আর শরম আবারকি? লজ্জা বলবি। কতবার বলি সুন্দরভাবে কথাবলবি। শুনিস না কেনো?- এই যে মেডাম ফুলটুশী আমি তো সুন্দর করেইকথা বলি। মাঝে মাঝে দুষ্টোমি করি আরকি।- এই এগুলো আবার কি? ফুলটুশী টুলটুশী একদমবলবি না,যাস্ট ডিজগাজটিং লাগে।- কলরব ভাই বললে দোষ নাই আমি বললে দোষকেনো??- আরে কলরব ভাই দিয়ে মনে পড়েছে জানিসকলরব কি করেছে?- কি করেছে?- প্রথমে ঘুরে ঘুরে রুমটা দেখেছে তারপরওয়ারড্রবের উপর রাখা আমার ছবিটায় ইশারাকরে আমাকে বলেছে আমি কি আপনাকে ছুঁতেপারি??পিহু ইন্টারেস্ট নিয়ে বোনের হাত চেপে ধরেবললো,- তুই কি বললি?- আমি তো প্রথমে বুঝতে পারিনি যে উনিছবির কথা বলছে তাই ভয়ে বিছানায় ধপাসকরে বসে পড়েছিলাম।পিহু অস্হির হয়ে বললো,- তারপর কলরব ভাই কি করেছে?- এরপর কলরব আমার অবস্হা দেখে হেসেছিলএন্ড দ্যান...পিহু বিরক্ত হয়ে বললো,- রাখ তোর মাস্টারি এন্ড দ্যান এন্ড দ্যান নাকরে তাড়াতাড়ি বল।- কলরব টুপ করে ফ্রেমটা হাতে নিয়ে ছবিটাখুলে পকেটে পুরে নিয়েছে।পিহু দাঁত বের করে হেসে বললো,- তারপর! তারপর!- ছবিটা পকেটে নিয়েই ড্রেসিংটেবিলেরদিকে এগিয়ে গেল। আমি তখনো হা হয়েআছি।- তোর কাহিনী বাদ রাখ আমি তো আমারদুলাভাইয়ের কাহিনী শুনতে চাই।- ড্রেসিংটেবিলের আয়নায় আমাকে দেখাযাচ্ছিল। সে আয়নায় হাত রেখে বললো," ফুলটুশী! আজ আপনার রুম অব্দি চলে এসেছিআর আপনাকে ছুঁয়েও ফেলেছি। ঘোমটাটামাথায় দিয়ে ফেলুন হয়তোবা আমাকে ভয়পাওয়ার চুটে কখন খসে পড়ে গেছে খেয়ালইকরেননি।"কুহু এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলো।তারপর পিহুকে আঙুলের ইশারায়ড্রেসিংটেবিলের আয়নায় তাকাতে বললো।পিহু ড্রেসিংটেবিলের দিকে চোখ সরাতেইদেখলো সেখানে লিপস্টিক দিয়ে বড় বড় করেলিখা," ফুলটুশী! আই ডু লাভ ইউ।তোর আমায় মনে পড়লে তুই দে না মিসড কল০১*********সরি! আপনি হবে গানের লাইনটাই এমন তাইবান্দা ভুল করলো "পিহু বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লো। তারপরনিজের দুইগালে হাত দিয়ে বললো,- উমা কলরব ভাই কি ফেসিনেটিংরোমান্টিক! কেমনে কি আপুণি?? তুই হলিবোরিং রোমান্টিক আর কলরব ভাইফেসিনেটিং রোমান্টিক। আহা! আমাদেরএলাকা রোম্যান্সে ডুবে যাবে।কুহু আবার চোখ ছোট করে বললো,- আমি রোমান্টিক ছিলাম কখন??পিহু কুহুর পাশে দাঁড়িয়ে কুহুকে কনুই দিয়েগুঁতো দিয়ে বললো,- সেদিন কে যেন কলরব নামের কাগজে চুমুখেয়েছিল মনে পড়ছে না আমার। আপুণি তোরমনে আছে কি?কুহু পিহুর কান টেনে বললো,- ভাগ এখান থেকে।পিহু চলে যাওয়ার বদলে কুহুকে জড়িয়ে ধরেবললো,- আপুণি তোর কলরব কি লিপস্টিকটাও নিয়েগেছে নাকি?কুহু লজ্জা পেয়ে বললো,- নাহ্ সেখানেই রেখে গেছে।..জাহরা ছেলের রুমে যেয়ে বসে আছেন।কূজনের বিন ব্যাগের উপর বসে বসে জাহরাভাবছে ছেলেটা তো এমনিতেই কষ্টের মধ্যেআছেতার উপর এভাবে উনার বলা উচিত হয়নি। ছোট্টএকটা নিঃশ্বাস ফেলে ফোন করলেন ছেলেরকাছে। কূজন কল রিসিভ করেই বললো,- হ্যালো মা কেমন আছো?জাহরা ছেলের কণ্ঠ শুনেই কেঁদে দিলেন।কূজন ফোনের ওপাশ থেকে বললো,- মা কাঁদছো কেনো? আমি তো ঠিক আছি।জাহরা ছেলের কথা শুনে চোখের পানি মুছেবললেন,- আমার বুঝা উচিত ছিল তুমি যে পরিস্হিতিরমধ্যে ছিলে বাবা এতে তোমার কোনো দোষনেই। কলরবের সাথে কুহুর বিয়ের কথা শুনার পরআগে তো তোমার নিজেকে সামলাতে হবেতারপর না তোমার বাবাকে সামলাবে। কিন্তুআমি না বুঝেই তোমার সাথে রিএক্ট করেছিআব্বু।কূজন হেসে বললো,- মা তুমি এমন করছো মনে হচ্ছে আমি প্রেমকরে প্রেমে ব্যর্থ ছ্যাঁকাকুমার। সেরকম কিছুইনা। কুহুকে দেখে জাস্ট একটুখানি ভালোলেগেছিল। গভীরভাবে ওকে চেয়েছি বাভালোবাসা টাইপের কিছু তো আমাদের মাঝেছিল না।কূজনের কথা শুনে জাহরার আবার কান্না চলেএসেছে তাই তাড়াতাড়ি করে ফোন রেখেদিলেন। জাহরা তো জানেন তাঁর ছেলে কেমন।ছেলেটা সবাইকে ভালো রাখার জন্য যেএতোটুকু কষ্ট করছে তা এই মায়ের বুকে সুঁচেরমতন বিঁধছে। বহুবছর আগে তাঁকেও সবার মুখেএকটুখানি হাসি ফুটানোর জন্য অনেক কিছুইকরতে হয়েছিল কিন্তু কোনো দুঃখ কষ্টেরসম্মুখীন হতে হয়নি। শুধু একটুখানি সময় দিতেহয়েছিল হাসনাদকে। এর বিনিময়ে অনেকসুখেই দিন কেটেছে তার কিন্তু আজ তাঁরছেলেকে কেনো সবার মুখে একটুখানি হাসিফুটানোর জন্য এতোখানি কষ্ট করতে হচ্ছে???চলবে...পর্বঃ৪৪কলরব আর কুহুর বিয়ের ডেট ঠিক করা হলো। দেড়মাস পর বিয়ে। ইরিনের পরীক্ষা তারপর কলরবেরআবার অফিসের ট্রেনিং চলবে। এতে পনেরোদিন লাগবে। ইফতেখার সাহেব চেয়েছিলেনবিয়েটা কলরবের ট্রেনিং শুরুর আগেই সেরেফেলতে। সাহরা বাধ সেধেছেন। ইরিনের একমাত্রভাই কলরব। ওর পরীক্ষার সময় বিয়ে এটা মানাই যায় না।ইরিনের পরীক্ষার রুটিন অনুসারে বাইশ দিন লাগবেপরীক্ষা শেষ হতে। এসএসসি পরীক্ষা তাইহেলাফেলা করার মতো না। ইরিনের পরীক্ষার পরপর কলরবের ট্র্যানিং শুরু,ঢাকা যেতে হবে। ইরিনেরপরীক্ষা শেষে বিয়ের শপিং করা শুরু হবে। সাহরাবিয়ের শপিং নিয়ে সবচেয়ে বেশি ইন্টারেস্টেড।একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা। এই একছেলের বিয়েতে উনি তা করবেন যা মানুষ সাতছেলের বিয়েতেও করে না। বাসায় যেয়েইখুশিতে আগে নিজের গহনাগুলো দু ভাগে ভাগকরলেন তিনি। ইফতেখার সাহেব যে বেশি একটাগহানা গড়ে দিয়েছেন তা নয়। তবে নিজের বাবারবাড়ির দেয়া অনেক গহনা উনার। সেগুলো সমানভাগে ভাগ করে একভাগ রাখলেন ইরিনের জন্য আরবাকিগুলো কুহুকে দিবে। তাছাড়া নতুন গহনা তোদিবেনই। কলরবের স্যালারীর বড় অংশটুকু জমানোআছে। সেগুলো দিয়ে কুহুকে বেশ সুন্দরকরে সাজানো যাবে। সব মিলিয়ে ঠিকঠাক হলোদেড় মাস পর বিয়ে।..- পিহু! পিহু! শোন না..- বললে তো শুনবো ফুলটুশী।- কলরবকে একটা কল দিই?পিহু ধমকে বললো,- কি বলছিস কি তুই? তুই কলরব ভাইকে কল দিবিকেনো?কুহু কাঁচুমুঁচু হয়ে বললো,- না মানে খুব খারাপ দেখাবে কি?পিহু টেবিলে চাপড় দিয়ে বললো,- অবশ্যই খারাপ দেখা যাবে। শুধু খারাপ কেনো খুববেশি খারাপ হবে...কুহু ব্যস্ত হয়ে বললো,- না সে তো নাম্বার দিয়ে গেল। তাই ভেবেছিলামফোন না দিলে হয়তো রাগ করবে। বাট দিব না তুইশিউর থাক। আমি এত ছ্যাঁচড়ি নাকি?পিহু নিজের কপালে চাপড় দিয়ে বললো,- আরে মা তুই আমার কথা তো শেষ করতে দেআগে তারপর নাহয় বলিস।- আচ্ছা বল।- তুই আমার কথায় বাধ সাধচ্ছিস কেনো? আমাকেবলতে দে।কুহু পিহুর কথা শুনে চুপসে গেল।পিহু ভাব নিয়ে বললো,- তুই কলরব ভাইকে কল দিবি না..- বললামই তো দিব না।পিহু দাঁত কিড়মিড় করে বললো,- কুহু আরিজা তোকে যদি আমি এখন খামচে না দিই নাতাহলে আমার নামও পিহু আলিশা না।কুহু পিহুকে ভেঙচি কেঁটে বললো,- আমাকে খামচে দিবেন উনি আর আমি বুঝি হাত পাগুটিয়ে বসে থাকবো??- তুই কি আমাকে বলতে দিবে....কুহু ঠোঁটে আঙুল রাখতেই পিহু বললো,- কলরব ভাইকে কল দিয়ে ছ্যাঁচড়ি সাজবি না একদমতবে মিসড কল দিতেই পারিস।পিহু কথা শেষ করেই চোখ মারলো কুহুকে। কুহুহাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।- উফ্ তুই যেভাবে বলেছিলি আমি তো ভাবলাম কিনাকি।- দুলাভাইয়ের আমার ভাব বেশি। তোর নাম্বার তো আছেই ওদের কাছে তারপরো নিজে ফোন দিবেন না। বসে বসে মিসড কলের অপেক্ষা করবেন।কুহু আর পিহু বসে বসে কথা বলছিল এতক্ষণ। পিহুর কথা শেষ হতেই কুহু পিহুর দিকে মোবাইল বাড়িয়ে দিয়ে বললো,- নে তোর এটিএম কার্ডকে মিসড কল দে।- কেনো আপনি কি পঙ্গু?? হাত নেই আপনার? শ্বশুরবাড়ি যেয়ে ঠিকই তো এই হাত দিয়ে রুটি বেলবেন,বাসন মাজবেন,কাপড় কাঁচবেন। বাপের বাড়িতে এত ঢং কিললাই দেখান?- তোকে না বললাম সুন্দর করে কথা বলবি।- মজাও করতে পারি না তোর জন্য।- পিহুন সোনা আমার আমি মিসড কল দিয়ে দিচ্ছি তবে ব্যাক করলে বলবি তুই করেছিস। আর কিসব বলছি আমি?মিসড কল কেনো দিব? আমি কল দিব, তুই লাউড দিয়ে কথা বলবি।পিহু আৎকে উঠে বললো,- মাথা খারাপ নাকি? তুই জানিস না আমি ফোনে কথা বলতে জানি না? একদম না পারতেই কথা বলি। আর কেমন হাম্বুশলি কথা বলি আমি। কলরব ভাইয়ের সামনে মান ইজ্জত পাম্পচার।- আরে একটুখানি বলবি সমস্যা কি তোর?- অনেকখানি সমস্যা আছে। তুই কথা বল ফোন দিয়ে। ফোনে হোক আর বাস্তবেই হোক তুই সবার সাথে গুছিয়ে কথা বলতে পারিস। যা আমি একদম পারি না আর ফোনে তো কথা বলতেই আমার বিরক্ত লাগে। বরং তুই হেব্বি করে কথা বলতে পারিসফোনে। মনে নেই মৌসুমী আপুর বিয়ের আগে তুই দুলাভাইয়ের সাথে আপু সেজে কত কথা বলেছিলি?কুহু কপালে পড়ে থাকা চুলে ফুঁ দিয়ে বললো,- তা আর বলতে বাকি?? ফোনে আমি হাজারজনকে পটাতে পারবো। আই অ্যাম দ্যা প্লে গার্ল।কুহু পিহু দুজনই হেসে দিল। হাসি থামতেই পিহু বললো,- তা আপনি এখন নিজের আসল মানুষটার সাথে ফোনে কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন কেনো ফুলটুশী?কুহু পিহুর চুল টেনে বললো,- একদম ফুলটুশী বলবি না।- ঠিক আছে।- পিহু আসলে আমি না কলরবকে দেখলেই অনেককিছু গুলিয়ে ফেলি। মানে যা বলতে চাই বা করতে চাই তা করতে পারি না, বলতেও পারি না। সব কেমন যেন আটকে যায়।পিহু কুহুর পিঠে হাত রেখে বললো,- মাই গার্ল! ব্রেভো গার্ল! তুমি ঠিক ঠিক পারবে। এখন আমার এটিএম কার্ডকে কল দাও দেখি।কুহু পিহুর কথায় মাথা নেড়ে সায় দিয়ে কলবের নাম্বারটা ডায়াল করলো। নাম্বারটা মুখস্হ করে নিয়েছে কুহু।ডায়াল করলো ঠিকই কিন্তু ব্যালেন্স না থাকায় কল হলো না। ইমার্জেন্সি ব্যালেন্স এর জন্য ডায়াল করলো সে। সাথে সাথে দুইটা মেসেজ এলো।কুহু মেসেজ চেক করে দেখলো একটা ইমার্জেন্সি ব্যালেন্স এর অন্যটা আননোউন নাম্বার থেকে। মেসেজ ওপেন করে জোরেজোরে পড়লো সে।" ফুলটুশী আপনার লিপস্টিক খরচ করায় কি আপনি রাগ করেছেন? যদি রাগ না করে থাকেন তাহলে কি ঐ গানটা ভালো লাগেনি? গানটা অবশ্য আমারো ভালো লাগে না। কিন্তু ঐটাই পার্ফেক্ট লেগেছিল তাই লিখেছি। আচ্ছা একটুখানি কষ্ট করে আপনার মহামূল্যবান সময় নষ্ট করে আমাকে কি একটা মিসড কল দেওয়া যায় না?~ "আজব কলরব"কুহু মেসেজ পড়া শেষ করতেই দুইবোনের চোখাচোখি হলো। দুইজন চোখের ইশারায় কথা শেষ করেই দুজন চিৎকার করে হাই ফাইব দিয়ে একসাথে বললো,- ইয়াহু!! এখন মজ্জা হবে।..কলরব মোবাইল হাতে নিয়ে বসে আছে পনেরো মিনিট ধরে কিন্তু কুহুর ফোন আসার নাম গন্ধও নেই। বিরক্ত হয়ে পকেট থেকে ছবিটা বের করলো। লাল সাদা একটা শাড়ি পরে আছে কুহু।মাঝে মাঝে সোনালী কাজও করা কিছু। পহেলা বৈশাখের শাড়ির মতন লাগলো কলরবের কাছে। লম্বা চুলগুলো সাইড সিঁথি করে আঁচড়ে ছেড়ে রেখেছে, হাত ভর্তি লাল চুড়ি, সেজেছেও বেশ। কলরব বেশ অবাক হয়েছে কুহুকে এভাবে দেখে। ইরিন আসলে সত্যি বলেছিল কুহুকে সাজলে আরো অনেক বেশি সুন্দর দেখায়। তবে কুহুর চুলের প্রশংসা কম হয়ে গেছে। ইরিন যতটুকু বলেছে তার চেয়ে বহুগুণ সুন্দর কুহুর চুলগুলো।ছবিটা একটা বাড়ির আঙিনার বেঞ্চিতে বসে তোলা,বাইরে কোথাও নয়। বাড়িটা চিনলো না কলরব হয়তো কুহুর কোনো আত্মীয়র বাড়ি। কুহুর ছবিটার দিকে একনজরে কতক্ষণ চেয়ে থাকার পর কলরবের অনুভব হতে লাগলো ওর দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে, চোখ ধাঁধানোসুন্দর লাগছে কুহুকে। কলরবের হার্টবিটও বেড়ে গেল হঠাৎ। কলরব তাড়াতাড়ি করে ছবিটা বালিশের নীচে রেখে চোখ বন্ধ করলো । তারপর ফিসফিসিয়ে বললো,- কুহু! তুমি এত সুন্দর কেনো? এত অপরূপা কেনো? আজ আফসোস হচ্ছে কবি হতে পারিনি বলে।কবি হলে তোমার জন্য দুই এক লাইন লিখতাম।কূজন ওয়াশরুম থেকে বেরুতেই দেখলো কলরব চোখ বন্ধ করে ফিসফিসিয়ে কি যেন বলছে। কূজন কিছু শুনেনি তারপরো বুঝলো কলরব কুহুকেই ভাবছে। প্রেমিক হৃদয় প্রেমেজর্জরিত সকল হৃদয়কেই অনুভব করতে পারে। তাই কূজনের ও বুঝতে অসুবিধা হলো না কলরব এখন কুহুতেই মগ্ন।কূজনের চোখগুলো হঠাৎ জ্বলতে শুরু করলো, রক্তবর্ণ লাভ করলো তার চোখজোড়া। সে তাড়াতাড়ি করে কলরবের রুম থেকে বেড়িয়ে পড়লো।চলবে...পর্বঃ৪৫কূজন এর সাধারণত রাগ হয় না,খুব কম। আজ রাগে সব ভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। চোখ ঝাঁঝাঁ করতে লাগলো। হাতগুলো নিশপিশ করছে, ইচ্ছে হচ্ছে সব ভেঙ্গে গুঁড়ো করে ফেলতে।কলরবকে কুহুর কথা ভাবতে দেখে কূজনের প্রচণ্ড মন খারাপ হয়েছিল। কূজনের মন ভালো করার টনিক হলো ইরিন। তাই সে গিয়েছিল ইরিনের রুমে। ইরিনকে পড়ার টেবিলে দেখে সে ফিরে চলে আসছিল। ইরিন কূজনকে দেখে ডেকে ভিতরে যেতে বললো। কূজনও ভিতরে যেয়ে ইরিনের সাথে বেশ গল্প করছিল। মনটা হালকা হালকা লাগছিল। ইরিন কি মনে করে যেন কূজনকে বসতে বলে কলরবকে ডেকে নিয়ে এলো। তারপর জানতে চাইলো কলরব আর কুহুর মাঝে কি কথা হয়েছে। কলরব প্রথমে খুব ভাব নিয়ে বলেছিল," ভাইয়া ভাবীর কথা শুনতে নেই বাবুরা!"তারপর নিজে নিজেই হেসেছে সে, সেই গগণবিহারী হাসি। ইরিনও যোগ দিয়েছিল কলরবের সাথে। শুধু কূজনেরই হাসি আসছে না। প্লাস্টিক হাসিটাও খুঁজে পাচ্ছে না সে। চুপচাপ কলরবের দিকে তাকিয়ে কলরবের হাসি দেখছে। কলরব হাসি থামিয়ে কুহুর সাথে কি কি কথা হলো সব বললো। আয়নায় ভালোবাসার কথা লিখেছে সেটাও বললো। ছবি নিয়ে আসা আর আয়নায় কুহুর প্রতিফলনে হাত রাখার কথাটা চেপে গেল সে। ইরিন খুশিতে গদগদ হয়ে কলরবের কথা শুনছে। আর কূজনের রাগ হচ্ছে। কুহুকে নিয়ে কলরব এত কথা বলছে তাই কূজনের সহ্য হচ্ছে না। একদম অসহ্য লাগছে। ইচ্ছে করছে সব ছেড়ে কুহুকে নিয়ে বহুদূর চলে যেতে। যেখানে কুহু শুধুই ওর। একথা ভাবতেই কূজন ভিতরে ভিতরে ঘেমে গেল। কি ভাবছে এসব? দুইদিন পর কুহুর বিয়ে হয়ে যাবে। আর সে তার ভাইয়ের বাগদত্তাকে নিয়ে এসব কি চিন্তা করছে? কূজন কল দেবার ছুঁতোয় ওদের মাঝ থেকে উঠে চলে এলো।কূজন চলে যেতেই কলরব ইরিনকে বলল,- ইরিন দেখি তোর চুলের খোঁপা করে দিই। ইরিন মুখ হা করে ফ্যালফ্যাল করে কলরবের দিকে তাকিয়ে রইলো।কলরব ইরিনের চাহনী দেখে একটুখানি ইতঃস্ত করে বলল,- আসলে আমি শিখতে চাইছি খোঁপা কীভাবে করে..ইরিন হুহু করে হাসতে হাসতে ভাইয়ের উপর গড়িয়ে পড়লো। কোমরে হাত রেখে অট্টহাসিতে ফেঁটে পড়ছে ইরিন। কলরব বিরক্ত হয়ে ইরিনের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইরিনের হাসি থামার কোনো নাম গন্ধ নেই। কলরব বিরক্ত হয়ে ইরিনের বেণী ধরে টানলো। ইরিন বলল,- ভাইয়া এখন কি বেণী ধরে টেনেও তুমি প্র্যাকটিস করছো নাকি? আর যাই করো ভাবীর চুল টেনো না। বাপের বাড়ি একটুখানি বেশি কাছে তাই নারী নির্যাতন একদমই চলবে না।তোমার জন্য আমরা গোষ্ঠী শুদ্ধ জেলে যেতে পারব না।কলরব অসহায় ভঙ্গীতে ইরিনের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইরিন কলরবের এই অবস্হা দেখে হাসি থামিয়ে বলল,- চলো তোমাকে খোঁপা বাঁধা শিখিয়ে দিই তবে আমি কিন্তু আমার ভাবীর মতন রাগী টিচার না, আমি হলাম আমার হবু ভাবীর বরের মতন ঝাক্কাস টিচার। একদম বকা দিব না তোমায়।কলরব হাসতে হাসতে বোনকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিল। ইরিনও ভাইকে জড়িয়ে ধরে বলল,- তুমি নিশ্চই ভাবীর খোঁপা দেখেছো,তাইনা?- হুম! তোর হবু ভাবী তার বরকে দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কবে যে এই ফাঁকে মহারানীর খোঁপা দেখেছি তা উনি জানেনই না। ইরিন ভাইয়ের দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো,- ভাইয়া তুমি ভাবীকে অনেক ভালোবাসো তাইনা?কলরব ডানে বায়ে মাথা নাড়িয়ে বলল,- উঁহু একটুখানি!..কূজন খুব করে চাইছে নিজেকে কন্ট্রোল করতে। কিন্তু স্নায়ুকোষগুলো বোধহয় আর কূজনের নেই। কুহু বোধহয় দেবী চৌধুরাণী হয়ে সেগুলো ডাকাতি করে নিজের আয়ত্তাধীন করে নিয়েছে। কূজন গিটার নিয়ে বসে টুংটাং করে যাচ্ছে। চোখ দুটোও কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে। কুহুকে আজ নিজ চোখে সে দেখেছে কলরবের জন্য হাত ভর্তি চুড়ি পরতে। কলরবের জন্যই তো সেজে বসেছিল সে। শাড়ি পরে নিজেকে কলরবের আকাশ বানিয়ে নীল পরী হয়ে উড়ছিল কুহু। আর এক এক করে কূজনের আকাশের তারাগুলো নিভে যাচ্ছিল। কূজন আনমনা হয়ে গান গাইতে লাগলো।" ইয়ে জিসমে হ্যায় তো কিয়ারুহুকা লিবাস হ্যায়ইয়ে দারদ হ্যায় তো কিয়াইয়ে ইশকেকি তালাশ হ্যায়ফানা কিয়া মুঝেইয়ে চাহনেকি আস নেতারাহ তারাহ শিকাসত হি হুয়ারেজা হ্যায় কিয়া তেরিদিলো যাহা তাবাহ কিয়াজাজাবি কিয়া তেরিবাফা কো বেবাফা কিয়াহুয়ারে জিন্দেগী সে ইয়ু মুঝে জুদা কিয়া..."..কুহুর মা একদম কুহুকে এখন কলরবদের বাসায় আসতে দিতে চায়নি। দুদিন পর বিয়ে তাই এসময় কলরবদের বাসায় না যাওয়াই ভালো। কিন্তু কলরবের মা মানলেন না। তিনি এক কথায় অটল। যেমন চলছিল সব ঠিক তেমনি চলবে। এসব ছাইপাশ মানেন না উনি। কবরী বলেছিলেন ইরিন যেন বাসায় এসে পড়ে। সাহরা বলেছেন,- "আরে নাহ্ কুহু আমাদের বাসায় আসবে যাবে, আমাদের সাথে মিশবে। সমস্যা কোথায়?"কবরীকে সাহরার কথা মানতেই হলো। সাহরা একদম রাজি করিয়ে ছাড়লেন। তাই কুহু ইরিনকে পড়াতে এল। ইরিনকে ন্যারেশন করতে দিয়ে কুহু বসে বসে একটা বই পড়ছে। ইরিনের রুমে বেশ ভালো গল্পের বইয়ের কালেকশন। কুহু বই পড়তে পড়তেই হঠাৎ চোখ গেল আয়নার দিকে। ইরিনের টেবিলের সাথেই ড্রেসিংটেবিল রাখা। কলরব দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আয়নায় কুহুকে দেখছে। কলরবকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কুহু একটু নড়েচড়ে বসলো। কুহুর বেশ অড লাগছে। এভাবে মানুষ তাকিয়ে থাকে নাকি? আর ইরিন দেখলেই বা কি ভাববে? কলরব কুহুর এ অবস্হা দেখে মজা পেল। এর আগেও বহুবার ইচ্ছে হয়েছিল কুহুকে এভাবে একদৃষ্টিতে দেখার। কিন্তু কুহুর কাছে খারাপ লাগবে তাই সে দেখেনি। কিন্তু এখন আর কলরবকে পায় কে? কুহু তো তারই। কলরব হাত দিয়ে ইশারায় বুঝালো কুহু কল দেয় না কেনো? কুহু দেখেও না দেখার ভাণ করলো। কলরব বারকয়েক আরো দেখালো কিন্তু কুহু কলরবকে বুঝতে দিচ্ছে না। কলরব হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর চলে গেল সে। কলরব চলে যেতেই কুহু মনে মনে বলল,- " এই আজবটা গেল কোথায়?"অনেকক্ষণ কলরবকে না দেখতে পেয়ে কুহুর মন উশখুশ করছে। ইরিনের কাজ শেষ হতেই কুহু ইরিনের খাতা দেখতে লাগলো। কি মনে করে যেন চোখ বারবার খাতা থেকে সরে আয়নায় চলে যাচ্ছে। কিছুতেই মন ধরে রাখতে পারছে না সে। হঠাৎ দেখলো কলরব দরজার ওপাশ থেকে সরে আয়না বরাবর দাঁড়ালো। কলরবকে দেখে কুহুর ঠোঁটে অজান্তেই হাসি ফুটলো। কলরব এটা দেখে কুহুকে চোখ মারলো। সাথে সাথে কুহু হা হয়ে গেল। লজ্জায় আয়না থেকে চোখ সরিয়ে খাতা দেখতে লাগলো। খাতা দেখা শেষে ইরিনের দিকে খাতা বাড়িয়ে দিতেই ইরিনও কুহুকে চোখ মারলো। এবার কুহু সত্যি বেশ লজ্জা পেয়েছে। ইরিন এভাবে দেখে ফেললো ভেবেই মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে কুহুর। সাথে কলরবকেও গলা টিপে মেরে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। এই পাগল জায়গাও বুঝে না। কোথায় কি করতে হয়, আর কোথায় কি না করতে হয় কিছুই মাথায় নেই। কুহু কোনোরকমে ইরিনকে ছুটি দিয়ে উঠে পড়লো। ইরিনের রুম থেকে বের হতেই কলরব কুহুর সামনাসামনি দাঁড়ালো। কুহু সাইড দিয়ে চলে যেতে নিতেই কলরব আবারো পথ আটকায়। কুহু ডানে গেলে সেও ডানে যায়, আর বামে গেলে সেও বামে যায়। কুহুর অবস্হা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ডাইনিং এ কেউ এভাবে পথ আটকাতে পারে সে ভাবতেই পারছে না। ইরিন তো দেখে ফেলবে কুহু শিউর। কিন্তু বাসায় আর কেউ আছে না নেই জানেও না। কেউ দেখলে কি ভাববে। কুহু নিরুপায় হয়ে কলরবের দিকে তাকালো। এতক্ষণ সে নীচের দিকে তাকিয়েছিল। কলরব কুহুকে আস্তে করে বললো,- ফুলটুশী! আজ যদি ফোনে কথা না বলেন তাহলে আবারো রাস্তা আটকাবো। মিসডকলের অপেক্ষায় রইলাম।তারপর নিজেই কুহুর সামনে থেকে সরে দাঁড়াল। কলরব সরে দাঁড়াতেই কুহু হন্তদন্ত হয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো। কূজন তখন ডাইনিংরুমে এসেছিল পানির জন্য। ওদেরকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওর সব শেষ করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল। সব বলতে একদম সব। কিসের কি পরিবার, আর কিসের কি। ওর শুধু এখন কুহুকে দরকার, আর কিছুই না। পৃথিবী ভেসে যাক, জনশূন্য হয়ে পড়ুক তাতে কূজনের একটুও ভাবনা নেই। এই মুহূর্তে কূজন শুধু চাচ্ছে কুহুর হাত ধরে জীবন কাটিয়ে দিতে। কূজন নিজেই হতভম্ব হয়ে যাচ্ছে সে এগুলো একের পর এক কি ভাবছে? পাগল পাগল লাগছে নিজেকে। যতোটা সহজ ভেবেছিল সে তার চেয়ে সবকিছু আরো বেশি জটিল মনে হচ্ছে। নাহ্ এখানে থাকা যাবে না। কুহু কলরবকে একসাথে দেখলে তার সব উলটপালট হয়ে যায়। এমন হতে থাকলে মন কিছুতেই কুহুকে ভুলতে পারবে না। কূজন তাই সিদ্ধান্ত নিল সে বাসায় ব্যাক করবে। ফেণী আসাটাই কূজনের জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল, মারাত্মক রকমের ভুল!চলবে...পর্বঃ৪৬"আপনি অনেক ভালো একজন মানুষ। আপনার সবটা জুড়েই ভালো লাগা কাজ করে। আপনার মতন পার্ফেক্ট মানুষ আমার কাছে দ্বিতীয় আর নেই। সবার কাছে মুভির হিরোরা যেমন পার্ফেক্ট হয় আমারো আপনাকে তেমন পারফেক্টই মনে হয়। আমি আপনাকে কষ্ট দিতে চাইনি কিন্তু কথাটা সত্য আমি আপনাকে ভালোবাসি না। দয়া করে আমার জন্য মনে দুঃখ কিংবা রাগ পুষে রাখবেন না। আমাকে নিজের পক্ষ নিয়ে কিছু বলতে দেওয়া হলে আমি বলব আমি কোনোদিন আপনাকে সেরকম কোনো ইশারা ইঙ্গিত করিনি। তাই আশা করি আমার উপর রাগ পোষণ করে থাকবেন না। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি আপনি খুব খুব ভালো কাউকে যেন জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়ে যান। আপনাকে একটা কথাই বলব আপনি একজন মনোমুগ্ধকর মানুষ। আল্লাহ নিশ্চয় আপনাকে ঠকাবেন না। আমার মতো অতি সাধারণ একজন মেয়ে আপনার জীবনে না এলেও আপনার জীবনে সুখের অভাব হবে না। আপনি যেন এক অনিন্দ্য সুন্দরীকে জীবনসাথী রূপে পান। দয়া করে এটাকে আমার সিমপ্যাথি মনে করবেন না। আমি শুধু আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে চেয়েছি। তবে আরেকটা কথা আমি কলরবকে ভালোবাসি অনেক আগে থেকেই ভালোবাসি। ভালো থাকুন আর আমাকে প্লিজ ক্ষমা করুন।"কুহু চিঠিটা লিখে ডায়েরীর মাঝে রেখে পিহুকে দিয়ে বলল,- তুই যে করে হোক কূজনের কাছে এটা পৌঁছে দিবি। - ঠিক আছে। তবে তুই সরাসরি দিলেই ভালো হতো।আর এখানে ক্ষমার কথা বলছিস কেনো তুই? ভালোবাসিস না এইটুকুই যথেষ্ট। - নারে তুই দিয়ে দিস। কূজন ছেলেটা সত্যি অনেক ভালো। আমার নিজের কাছেই খারাপ লাগছে ভেবে যে দুইদিন পর আমি ওর সামনেই ওর ভাইয়ের বউ হব। বিষয়টা কূজনের জন্য খুবই বেদনাদায়ক।পিহু বিরক্ত হয়ে বলল,- নিজের চিন্তা কর তুই। তোর এসব ভালেমানুষী দেখলে আমার গা জ্বলে যায়। - এমনভাবে বলছিস কেনো? কূজনের মনে কষ্ট দিয়ে আমি কখনোই ভালো থাকতে পারব না। কূজন ছেলেটা অনেক বেশি ভদ্র। দেখিসনি কেমন চুপচাপ সব সয়ে যাচ্ছে।- এত খারাপ লাগলে বিয়ে করে নে ওকে।- পিহু! আমি কি সেটা বলেছি নাকি? আমি শুধুই কলরবকে চাই। কূজনের জন্য খারাপ লাগছে এতটুকুই..- ঠিক আছে আপুণি রাগিস না। সরি! সরি!- এখন সামনে থেকে যা তুই। তোকে দেখলেই মেজাজ খারাপ হতে থাকবে। যা বলেছি তা কর।পিহু চুপচাপ রুম ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো। ..কূজন ছাদের রেলিং ঘেঁষে বসে আছে। ডায়েরীর প্রত্যেকটা পাতা বসে বসে ছিঁড়ছে সে। একটা একটা করে পেইজ টেনে খুলে ফেলছে সে। বারবার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। মাগরিবের আজান কানে ভেসে আসছে। চারিদিকের আকাশটাও লালচে আভায় ছেয়ে আছে। কূজন মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকালো। একসময় এই আকাশের এই লালরঙা রূপ দেখে কূজন ভাবতো এই বুঝি কুহুর কপালের লাল টিপ। আজ মনে হচ্ছে এ হলো ওর নিজের বুকের রক্তক্ষরণ। পিহুর হাত থেকে ডায়েরী পেয়েছে বহু আগেই। এতোটা সময় নিয়ে সে কুহুর লিখা চিঠিটা পড়েছে সে। একবার নয় বহুবার। চিঠিটা পড়তে পড়তেই বিকেলের মিষ্টি রোদ ছুঁয়ে এখন লাল আকাশপটে তাকিয়ে আছে কূজন। কূজন এখনো ডায়েরীর সব পাতা ছিঁড়েনি। যেগুলো ছিঁড়েছে সেগুলো ভাঁজ করে পকেটে পুরে নিয়েছে সে। তারপর ডায়েরীটা হাতে নিয়ে কুহু চিঠিটা রেখেছে শার্টের বুক পকেটে। দ্রুত পায়ে ছাদ থেকে নেমে রাস্তায় বেড়িয়ে পড়লো সে। গলির রাস্তা ধরে এলোপাথাড়ি পা ফেলতে লাগলো সে। কুহু তাকে ভালোবাসে না, ভালোবাসে কলরবকে। সে তাহলে কিসের স্যাক্রিফাইজ করছে? সে তো ওদের দুজনের মাঝে এসে যাচ্ছিল। কূজন তো ভেবেছে কুহু কাউকেই ভালোবাসে না, শুধু পরিবারের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে। নাহ্ কুহু কুহুর নিজের ভালোবাসাকে বেছে নিয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে গলির শেষ প্রান্তের টং দোকানটার সামনে এসে দাঁড়ালো সে। কাঁপা স্বরে দোকানদারকে বলল,- একটা ডলফিন দিয়াশলাই দিন তো।দিয়াশলাই এর প্যাকেট নিয়ে আবারো হাঁটতে লাগলো উদ্দেশ্যহীনভাবে। গলি পেরিয়ে মেইনরাস্তায় চলে এল কূজন। কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে রইলো আর রাস্তার গাড়িগুলো গুনতে লাগলো। সময়টা বেশ গড়িয়েছে কিন্তু কূজনের সেদিকে খেয়াল নেই। সে ফুটপাতের উপর দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে আছে। ফুটপাতে মানুষ চলাচল করছে। মাঝে মাঝে ধাক্কা লাগছে কূজনের সাথে। কেউ কেউ বিরক্ত হয়ে কূজনের দিকে তাকাচ্ছে কেউবা বলেও ফেলছে,- এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? এটা কি দাঁড়িয়ে থাকার রাস্তা? কূজনের সে কথাগুলো কানে যাচ্ছে না। সে চুপচাপ নিজেতে মগ্ন। হঠাৎ মোবাইলবেজে উঠায় কূজনের হুঁশ ফিরে। পকেট থেকে মোবাইল বের করতেই দেখে স্ক্রিনে কলরবের নাম। সাথে সাথে মোবাইলটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় রাস্তায়। চোখের নিমিষেই একটা ট্রাক চলে যায় মোবাইলটার উপর দিয়ে। দুমড়েমুচড়ে পড়ে থাকে ভাঙা মোবাইলটা। গুড়ো হয়ে গেছে প্রায়। মোবাইলটার দিকে তাকিয়ে কূজন হালকা হেসে বললো,- কূজন তোমার অবস্হাও এমন।দীর্ঘশ্বাস ফেলে কূজন গলির রাস্তায় পা বাড়ালো। গলির মোড়ে ঢুকতেই একটা পরিত্যক্ত বাড়ির দেখা পাওয়া যায়। ভিত গড়ার পর আর করেননি বাড়ির মালিক। বোধহয় কোনো সমস্যা আছে। কূজন বাড়িটার দিকে গেল। নিতান্তই কাঁচা বাড়ি। একপাশে রড সিমেন্ট রাখা,অল্প কিছু,।পাহাড়াদারও নেই তাহলে চুরি হয়নি কেনো? এগুলো ভাবতে লাগলো কূজন। হঠাৎ তার মনে হল সে আর তার বাবা মিলেও তো কুহুর ভালোবাসা আর স্বপ্ন চুরি করে নিচ্ছিল। হাতের ডায়েরিটা ছুঁড়ে ফেললো পরিত্যক্ত বাড়ির মাঝ বরাবর। তারপর পকেট থেকে ডায়েরীর ছিঁড়া কাগজগুলো বের করে দিয়াশলাই দিয়ে সেগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিল কূজন। কাগজ গুলো চোখের সামনে ধরে তীক্ষ্ণ গলায় বলল,- কুহু! আমি তো অনিন্দ্য সুন্দরী কাউকে চাইনি,চেয়েছি তোমাকে। আমার কাছে অনিন্দ্য সুন্দরীর সংজ্ঞা তুমি। তোমার চোখের জলকে ভালোবেসেছিলাম তাই আজ আমার বুকে কান্নার জোয়ার আসে। ভালো থেকো কুহু! ভালো থেকো।ঝড়ের মতো আগুনসহ কাগজগুলো ছুঁড়ে ফেললো ডায়েরীর উপর। বুক পকেটে থাকা কুহুর চিঠিটা আবার পড়লো কূজন। তারপর ছুঁড়ে ফেলে দিতে নিয়েও ফেললো না। ভাঁজ করে সযত্নে বুকপকেটে রেখে দিল সে। বিড়বিড় করে বলল,- "তোমার সুখটুকু দেখেই যাব।"...কলরব একের পর এক কল করেই যাচ্ছে কূজনকে। মোবাইল বন্ধ করে রেখেছে। কেনো বন্ধ করে রেখেছে কলরব কিছুতেই বুঝতে পারছে না। এদিকে রাতের এগারোটা বাজতে চললো। কূজন তো তেমন কোথাও যায় না। যখনই ঘুরতে যায় দুইভাই মিলে একসাথে যায়। তারউপর ফোনেও পাচ্ছে না। মাকে কিছু বলাও যাবে না, কেঁদে কেটে বাসা অস্হির বানিয়ে ফেলবে। কলরব নিরুপায় হয়ে গেল ইরিনের কাছে। ইরিনও বলল সে জানে না। ইরিনকে কলরব বলে দিয়েছে যেন "কূজন কোথায় কেউ জানতে চাইলে বলে দেয় কি কাজ যেন আছে বলেছে আসতে দেরি হবে।" কলরব আবারো ট্রাই করেই চলেছে। আশা করছে একবার না একবার লাইনে পাবে কূজনকে। কিন্তু সব আশায় গুঁড়ে বালি তারপরো কলরব একের পর এক কল দিয়েই যাচ্ছে। এর মাঝেই কলরবের মোবাইলে কল এল। কলরব রিসিভ করে বলল,- হ্যালো! আসসালামু আলাইকুম!কিছুক্ষণ উত্তরের অপেক্ষা করে যখন উত্তর পেল না আবারো জিজ্ঞাসা করলো,- কে বলছেন?কিছুক্ষণ আবারো অপেক্ষা করলো জবাবের আশায়। ফোনের ওপাশ থেকে কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে কলরব হালকা গলায় বলল,- ফুলটুশী! আপনার সাথে পরে কথা বলছি এখন একটুখানি ব্যস্ত আছি।সাথে সাথে ওপাশ থেকে ফোন রেখে দেওয়ার শব্দ হল। কলরব মোবাইল পকেটে রেখে শার্টের উপর একটা পাতলা সুয়েটার পড়লো। তারপর বেড়িয়ে পড়লো কূজনকে খোঁজার উদ্দেশ্য। ..কুহুর রাগে কান্না এসে যাচ্ছে। চোখগুলো টলমল করছে, যেন পলক পড়লেই চোখ থেকে পানি টুপ করে পড়ে যাবে। সামনে পিহু বসে আছে তাই কুহু কোনোভাবেই কাঁদতে চাইছে না। কিন্তু চোখের কোণায় অলরেডি পানি চিকচিক করতে লাগলো। কোনোরকমে পিহুকে বলল,- পিহু যা তো এখন পড়তে বস। আর এর আগে আম্মুকে বল আমার জন্য একটু চা করে দিতে।- এত রাতে চা খাবি?? কেনো রে তোর কলরব কি রাত জেগে কথা বলবে বলেছে?- যা বলেছি তা কর।- ঠিক আছে ফুলটুশী মেডাম।কুহু সাথে সাথে বেডসাইড টেবিলে থাকা টেবিলঘড়ি হাত দিয়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে বলল,- একবার বলিনি আমাকে এসব ডাকবি না?পিহু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।- কি হল কথার জবাব দিচ্ছিস না কেনো?- হুম না করেছিস।- তাহলে বারবার না করা স্বত্তেও কেনো একি কাজ করিস?- আর করবো না।- এখন সামনে থেকে সর আমার।পিহুও মেজাজ দেখিয়ে বলল,- তুই শুধু শুধু আমার সাথে রাগছিস কেনো?- পিহু মার খেতে না চাইলে সামনে থেকে ফুট।পিহু আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ উঠে চলে গেল। কুহু পিহুকে ডেকে বলল,- লাইটটা অফ করে যা, তুই অন্যরুমে পড়।পিহু লাইট অফ করতেই কুহু গুটিসুটি মেরে বিছানায় শুয়ে পড়লো, কেঁদে বালিশ ভিজাতে লাগলো।চলবে...পর্বঃ ৪৭- মামা! আমার ভাইকে দেখেছো?মুদি দোকানদার তিতাস পানের ফিঁক ফেলে বললো,- ঐ সুন্দর কইরা পোলাডা? চশমা পড়ে যে?কলরব হেসে বলল,- হুম মামা সুন্দর ছেলেটাই।- হো দেখছি তো কিছুক্ষণ আগেই গলির ভিতর ঢুকলো।- শুকরিয়া মামা!- আরে হিরো যাও কই? শুনলাম তোমার নাকি বিয়া?- ভুল শোনোনি মামা।- তা হিরোইন নাকি আমগো তৈয়ব সাহেবের বড় মাইয়া?কলরব ম্লান হাসলো। তারপর বলল,- কেন হিরোর সাথে যাবে না?দোকানদার তিতাস মিয়া ফিক করে হেসে দিয়ে বলল,- কি যে কও হিরো। তৈয়ব সাহেবের মাইয়াগুলা তো সেনালক্ষী মাইয়া। জীবনে বারান্দায় ও দাঁড়াইতে দেখে না কেউ। মেলা ভালো বউ খুঁইজা বাইর করছো। তয় দাওয়াতি হইতে পারমু তো?- কি যে বলো মামা অবশ্যই। আমি এখন যাই পরে কথা বলব।- ঠিক আছে হিরো যাও।তিতাস মিয়ার সাথে কথা শেষ করেই কলরব আবার গলির রাস্তায় হাঁটতে লাগলো। চারিদিক তীক্ষ্ণ নজরে দেখছে কলরব। গলির ভিতরও দুই একজনকে জিজ্ঞাসা করলো। বাড়িওয়ালার ছেলেকে দেখে ওকেও কূজনের কথা বলল। - কিরে মন্টু কূজনকে দেখেছিস?- কলরব ভাই! কূজন ভাইয়া তো ছাদে গেল। আমার কাছ থেকেই চাবি নিয়েছে ছাদের।- এত রাতে ছাদে? অবশ্য যেতেই পারে আমিও যাই।- আমিও তো ভাবলাম তুমি বোধহয় ছাদে যাবে তাই চাবি নিতে কূজন ভাইয়াকে পাঠিয়েছ।- উমাহ্ ভুললি কি করে? আমার কাছে তো ছাদের একস্ট্রা চাবি আছে।- ও হ্যাঁ আমিই তো বানিয়ে দিয়েছিলাম তোমায়।কলরব মন্টুর পিঠে চাপড় দিয়ে বলল,- ব্যাটা প্রেমটেম করছিস নাকি? এত ভুলাভুলি কিসের?- প্রেম করলে তুমি, বিয়েও করছো তুমি আর এখন আমার উপর দোষ চাপাচ্ছো।- কবে প্রেম করলাম?- আমি তোমার খেলা দেখেছি তো..কলরবের কপালে ভাঁজ পড়ল। তারপর অবাক হয়ে বলল,- কি খেলা?- বাস্কেটবল ছুঁড়াছুঁড়ি।কলরব গগনবিহারী হাসি দিয়ে বলল,- কখন দেখলি?- একদিনই দেখেছিলাম। তুমি তো ভাবীকে পুরাই ইভ্টিজিং করো। কলরব আরো জোরে হেসে মন্টুর চিবুকে হাত রেখে বলল,- মন্টু সোনা ইভটিজিং এর শাস্তিসরূপ এখন জেলখানার কয়েদী হতে যাচ্ছি।- বাহ্ ভালো তো! আমিও এমন কয়েদী হতে চাই।- এই ছেলে এইটে পড়িস না? সামনে না তোর পরীক্ষা? পড়তে বসেন পড়ে মজনু হলেও চলবে।- নাহ্ আমি তো মজনু হব না। আমি হবো তোমার মতন। তোমার কাছ থেকে অবশ্যই বাস্কেটবল খেলা শিখব। তারপর মেয়েদের সেটা শিখানোর নামে বল থেকে শুরু করে মন ছুঁড়াছুঁড়ি সব করব। - আরে বাবা কতসব দেখেছে। কখন দেখলি? মন্টু লজ্জা মাখা হাসি দিয়ে বলল,- ঐ একদিনই দেখেছি। আন্টি আর আমি দুজন একসাথে টাঙ্কির চিপায় দাঁড়িয়ে দেখেছি।- মা তো পারেও বটে। আর শোন আমি এতদিন মোটেও প্রেম করিনি কিন্তু এখন করব। কিন্তু তুই এত রাতে পড়ার টেবিলে না বসে থেকে টইটই করছিস কেনো?- আম্মু কয়েল কিনতে পাঠিয়েছে।- ওহ্ তাড়াতাড়ি বাসায় যা।কলরব পা বাড়ালো বাড়ির দিকে। সোজা ছাদে চলে এল সে। টর্চ আনেনি কিন্তু চাঁদের আলোয় স্পষ্ট সব দেখা যায়। জোছনা চুইয়ে পড়ছে চারিদিকে। কূজন পকেটে হাত রেখে আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। কূজনকে পিছন থেকে দেখে কলরবের মুখে প্রশান্তির হাসি ফুটলো। কলরব পিছন থেকে কূজন বলে ডাক দিল। কূজন কলরবের ডাকে পিছন ফিরে চাইলো। তারপর ম্লান হেসে বলল,- ভাই এখানে এসে দাঁড়াও।কলরব কূজনের পাশে দাঁড়িয়ে কূজনের কাঁধে হাত রাখতেই কূজনের চোখগুলো সাথে সাথে ভিজে উঠলো। কলরব দেখে ফেলবে ভয়ে কূজন মুখ তুলে চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর ধাতস্হ হয়ে বলল,"জোছনা কুড়াইয়ো না বন্ধু!চোক্ষে ধইরা রাখো।স্বপন দেইখো মোরে লইয়া!ছুঁইতে নাহি চাইয়ো।"কলরবও কথাটা মনে মনে রিপিড করলো। তারপর হেসে বলল,- তুই অনেক সুন্দর কবিতা লিখিস। ইশ্ আমি যদি কবি হতাম তাহলে তোদের ভাবীর জন্য কিছু লিখতাম। কলরবের কথায় কূজন কলরবের দিকে তাকালো। তারপর কাঁপা গলায় বলল,- ভাই একটা গান গাইবো?- উমাহ্ না করেছে কে? গান তো বেশ লাগে আমার। দাঁড়া আমি তোর গিটারটা এক দৌঁড়ে নিয়ে আসছি। - নাহ্ ভাই খালি গলায় শুনাই? গিটার বাজাতে ইচ্ছে করছে না।- কি ভালো লাগছে না? এখনি নিয়ে আসছি আমি।কলরব সত্যি সত্যি গিটার নিয়ে আসতে চলে গেল। কলরবের চলে যাওয়ার দিকে কূজন তাকিয়ে রইল কতক্ষণ তারপর বলল,- ভাই তোমাকে কুহু অনেক ভালোবাসে। চোখ থেকে চশমাটা খুলে শার্টের কোণা দিয়ে মুছলো কূজন। তারপর চোখে দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো কলরবের জন্য। কলরব পাঁচ মিনিটের মধ্যেই গিটার নিয়ে চলে এল। কূজন গিটার হাতে গান ধরলো,"তেরে নাম সে জি লুতেরে নাম সে মার জায়ুতেরে জানকে সাদকে মেকোচ এসা কার জা য়ুতুনে কিয়া কারডালামার গায়ি মে মিট গায়ি মেওহো জি আহা জিহোগায়ি মে তেরি দিওয়ানীদিওয়ানী তেরি দিওয়ানী দিওয়ানীইশক জুনু যাব হাদসে বার যায়েহাসতে হাসতে আশিক সুলি চার যায়ে"কূজন এতটুকু গেয়েই আর টাল সামলাতে পারলো না। গিটার হাত থেকে পড়ে গেল। সেও দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। হাত পা কাঁপছে, শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। কলরব হঠাৎ ঘটে যাওয়া কান্ডে হতবাক হয়ে গেল। এগিয়ে যেয়ে কূজনের কাঁধে হাত রাখলো। সাথে সাথে কূজন ঢলে পড়লো। কলরব তাড়াতাড়ি করে কূজনকে ধরলো। কূজন কলরবের হাত ধরে বলল,- ভাই আমার শরীরটা ভালো না। আমাকে একটু ধরে বাসায় নিয়ে যাও তো।কূজনের হাত এত গরম দেখে কলরব কূজনের কপালে হাত রেখে দেখলো। তারপর ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বলল,- আল্লাহ জ্বরে তো কপাল পুড়ে যাচ্ছে তোর। শীত পড়েছে গায়ে শীতের কাপড় না জড়িয়ে ছাদে দাঁড়িয়ে থাকলে তো এমন হবেই।কূজন কিছু বলল না। কূজনের হাত ধরে রেখেই আরেক হাতে কলরব কূজনের গিটারটা তুলে নিল। তারপর ছাদ থেকে নেমে বাসায় এসে সোজা নিজের রুমে নিয়ে গেল কূজনকে। কূজন রুমে ঢুকেই বিছানায় বসে পড়লো। চশমা খুলে কলরবের হাতে দিয়ে বলল,- ভাই আমি এখন ঘুমাবো।কলরব দেখলো কূজনের চোখ লাল টকটকে হয়ে আছে। কলরব ধমকে বলল,- আগে জ্বর মেপে নিই তারপর। আর না খেয়ে আবার ঘুম কিসের? ঔষধ খেতে হবে না?কূজন লাল টকটকে চোখগুলো দিয়ে কলরবের দিকে তাকালো। তারপর বিড়বিড় করে বলল,- ভাই আমার ঔষধ অন্য কারো ভালোবাসার টনিক।কূজনের কথাগুলো কেমন যেন জড়ানো মনে হচ্ছে। কলরব সবটুকু না বুঝলেও ভালোবাসার টনিক শব্দটা বুঝলো। - কি বলছিস কূজন বুঝতে পারছি না স্পষ্ট করে বল।কূজন কিছু বলল না চুপচাপ শরীর ছেড়ে দিল বিছানায়। কলরব আর কূজনকে ঘাঁটলো না। কাবার্ড এর ড্রয়ার থেকে থার্মোমিটার নিয়ে এল। কূজনের পাশে বসে কূজনের মাথায় হাত রাখতেই কূজন চোখ খুলে আকুতির স্বরে বলল,- ভাই কুহুকে বলবে একবার আমাকে ভালোবাসি কথাটা বলতে? কূজনের জড়ানো কণ্ঠের প্রতিটা শব্দ কলরবের কানে বজ্রপাত মনে হলো। সে অবাক হয়ে কূজনের দিকে তাকিয়ে রইলো। কূজন অসহায় দৃষ্টিতে কলরবের দিকে তাকিয়ে আছে। কলরব খেয়াল করলো কূজন ওর হাত জুড়ে চেপে ধরে রেখেছে। কলরবের মাথা হ্যাং হয়ে যাচ্ছে। কিছুই ভাবতে পারছে না সে। কূজন কলরবের হাত ছেড়ে দিয়ে হতাশ গলায় বলল,- থাক বলা লাগবে না। কিন্তু বিশ্বাস করো কুহু যদি একবার আমাকে বলে কূজন তোমাকে আমি ভালোবাসি তাহলে আমি চলে যাব এখান থেকে। আর কোনোদিন আসব না তোমাদের মাঝে। কলরব আর শুনতে পারলো না। ওর কান ঝাঁঝা করতে লাগলো। কি বলছে কি এসব? কোন কুহুর কথা বলছে কূজন? সে কি ফুলটুশীর কথা বলছে? তার ফুলটুশীর কথা বলছে কি? কলরব কি করবে কি ভাববে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। কলরব যখন খুব বেশি টেনসড থাকে তখন কফি খায়। কলরব কিচেনের দিকে এগিয়ে গেল। এক মগ স্ট্রং কফি দরকার ওর, খুব বেশি দরকার।চলবে...পর্বঃ ৪৮+৪৯+৫০+৫১+৫২কলরব অনেকক্ষণ ধরে কুহুর নাম্বারে ট্রাই করছে। কল হচ্ছে কিন্তু ওপাশ থেকে কেউ রিসিভ করছে না। কলরব ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো একটা বিশ বাজে। একবার ভাবলো কুহু বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। আরো আগে ফোন করা উচিত ছিল। কূজনকে খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দিয়েছে সে। বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে কলরব রুমের ভিতর উঁকি দিল। ডিম লাইটের আলোতে দেখলো কূজন উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। ডিম লাইটের নীল আলোয় কূজনের চেহারা দেখে আরো বেদনার্ত মনে হল কলরবের। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে কলরব বারান্দায় গিয়ে বসলো। কলরবের হঠাৎ সিগারেট টানতে খুব ইচ্ছে হলো। পর মূহুর্তেই নিজের ইচ্ছা দমিয়ে ফেললো সে। ক্লাস নাইনে পড়া অবস্হায় বন্ধুদের সাথে ট্রুথ অর ডেয়ার খেলে সিগারেট টেনেছিল। বাসায় ফিরতেই মা দেখে কলরবকে কিছু বলেনি শুধু ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে কেটে বাড়ি মাথায় তুলে নিয়েছিল। ইরিন তখন ছোট। মায়ের কান্না দেখে খুব ভয় পেয়েছিল। আর বাবা বাসায় এসে মায়ের কান্নাকাটি দেখে অস্হির হয়ে খুব মেরেছিল কলরবকে। কলরবের বাবা জীবনেও কাউকে কোনোদিন বকা দেয় না। নিতান্তই নিজেকে নিয়ে মগ্ন থাকেন। কলরব সেদিন বাবার সে রূপ দেখে খুব ভয় পেয়েছিল। তারপর থেকে আর কোনোদিন সিগারেট হাতেও নেইনি। ভার্সিটিতে রঞ্জুরা কতো বলতো। কিন্তু কলরবের কাছে বন্ধুদের আবদার নাকোচ হয়ে যেতো। কলরব উল্টাপাল্টা চিন্তা ভাবনা ছেড়ে আবার কল করলো কুহুকে। পিহু ডাইনিংটেবিলে বসে পড়েছে এতক্ষণ। বড্ড ঘুম পেয়েছে তার তাই বই খাতা গুটিয়ে বেডরুমের দিকে পা বাড়ালো। রুমে যেয়ে দেখলো রুমে ডিম লাইটও জ্বালেনি। পিহুর আবার অন্ধকার দেখলেই ভয় শুরু হয়। তাড়াতাড়ি করে ডিম লাইট জ্বেলে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো পিহু। ব্রাশ করে রুমে এসে শুয়ে পড়লো কুহুর পাশে। কুহু ঘুমের ঘোরেই জড়িয়ে ধরলো পিহুকে। পিহু বিরক্ত হয়ে কুহুর হাত সরিয়ে দিয়ে বিড়বিড় করে বলল,- আপুণি যে আমাকে ধরে কি মজা পায় আল্লাহ মালুম। কুহুর থেকে কিছুটা দূরে সরে পিহু উল্টোদিকে মুখ করে শুয়ে চোখ বুজলো সে। তারপর নিজেই আবার কুহুর দিকে কিছুটা সরে এলো কিন্তু কুহুকে পিঠ দিয়েই শুয়ে রইলো। পিহু কুহুর দিকে সরে আসতেই কুহু আবার পিহুকে জড়িয়ে ধরলো। পিহু মুচকি হাসলো। মনে মনে বলল,- আর তো কয়েকটা দিন তারপর আর আমাকে জ্বালাতে পারবি না।আমি এই বিছনায় রাজত্ব করবো। আচ্ছা আপুণির বিদায়ের দিন আমি কি কাঁদবো? হয়তো! কিন্তু মানুষ যেভাবে মরা কান্না শুরু করে সেরকম কিছুই পিহুর দ্বারা সম্ভব না। তবে শিউর আপুণি যে কাঁদতে কাঁদতে এলাকায় বন্যা করে ফেলবে। বেচারা কলরব ভাই বিয়ের রাতে টিস্যু বক্সের সাথে রোম্যান্স করবে। পিহুর হঠাৎ খুব হাসি পেল। তারপর বিড়বিড় করে বলল,- ধুর! এখন ঘুম আসছে না। অথচ পড়ার সময় মনে হয়েছে ঘুমের নানী পিহু রাণী। আর একটু পড়লে ম্যাথ চ্যাপ্টারটা শেষ করে ফেলতে পারতো। কিছুতেই ঘুম আসছে না পিহুর। বাধ্য হয়ে মোবাইলটা কোথায় রেখেছে মনে করতে লাগলো। মনে পড়লো মোবাইলে তো চার্জই নেই। পিহু বিছানা ছেড়ে উঠে ইয়ার ফোন আর কুহুর মোবাইল হাতে নিল। মোবাইল হাতে নিতেই দেখলো একুশটা মিসড কল তাও কলরবের মোবাইল থেকে। এর মধ্যে আবার কলরব ফোন করলো। পিহু ধরলো না। ধরে কি বলবে সে? ভেবে না পেয়ে ইগনোর করলো। কিন্তু বারবার কলরবের ফোন আসছে। মোবাইল বন্ধ করতে যেয়েও বন্ধ করলো না। পিহু একটুখানি ভেবে দেখলো তারপর হিসাব মিলিয়ে নিলো। নিশ্চয় কলরব আর কুহুর মাঝে কিছু হয়েছে নয়তো কুহু তখন রাগতো না। আর কলরবই কেনো এমন পাগলের মতন ফোন করছে? পিহু না চাইতেও ফোন রিসিভ করলো। এখন যদি ফোন রিসিভ না করে তাহলে কলরব নিশ্চয় রাগ করলেও করতে পারে। তাই ফোন ধরেই এক নিঃশ্বাসে বলল,- ভাইয়া! আসসালামু আলাইকুম। আপু ঘুমুচ্ছে আর আপুকে ঘুম থেকে ডেকে তুললে আপু আমাকে বকা দিবে।কলরব ওপাশ থেকে পিহুর কথা শুনে বলল,- ঠিক আছে মৌটুশী গুড নাইট। ওয়ালাইকুম আসসালাম।তারপর ফোন কেটে দিল সে। পিহু কলরবের কথা শোনে ভ্যাবলি হয়ে রইলো কতক্ষণ। তারপর মোবাইল রেখে কুহুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো। আর মনে মনে বলল বেশ মজার একটা দুলাভাই পেয়েছি। ...ইরিনের ডাকে কূজনের ঘুম ভেঙেছে। কূজন বিছানায় উঠে বসেই বলল,- সোনার হরিণ কাল রাতে বোধহয় জ্বর এসেছিল আমার।- হুম এসেছিলই তো। ভাইয়ার কাছে সকালেই শুনলাম। তারপর ইরিন কূজনের কপালে হাত রেখে বলল,- এখন তো নেই।কূজন মৃদু হাসলো। তারপর বলল,- কলরব ভাই কোথায়?- ভাইয়া তো ভাবীদের বাসায় গেছে।- ওহ্!- এই ভাইয়া বিছানা ছেড়ে উঠো তো। দেখো এগারোটা বাজে। তোমার জ্বর তাই এতক্ষণ ঘুমোতে দিয়েছি। আর নাহয় কখনো দিতাম না।কূজন ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট করতে বসলো। সাহরা আর ইফতেখার সাহেব দুজনই স্কুলে। ইরিন কূজনের প্লেটে পরোটা দিতে দিতে বলল,- কূজন ভাইয়া তুমি কাল বিকেলে হাওয়া হয়ে কোথায় গেলে? ভাইয়া তো মহাব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। - ঘুরাঘুরি করছিলাম আরকি।- ধুর ছাই! কোথায় যে ছিলে.. খুব বড় একটা মজা মিস করলে। জানো কালকে ভাইয়া আর আমি মিলে ভাবীকে কি লজ্জাটাই না দিলাম। কূজন মোটেও কুহুর কথাগুলো শুনতে চাইছে না। তারপরো চুপচাপ খেয়ে যেতে লাগলো। ইরিন একাধারে বলেই চলছে,- ভাইয়া আয়নায় ভাবীকে কি যেন ইশারায় বলছিল। ভাবী উত্তর দিচ্ছিলো না দেখে ভাইয়া দরজার আড়ালে দাঁড়িয়েছিল। ভাবী ভাইয়াকে না দেখে যখন উশখুশ করছিল ভাইয়া আবার চলে এলো। আর তখনি আমি আর ভাইয়া একসাথে চোখ মেরে দিলাম ভাবীকে। আর ভাবী তো লজ্জায় পুরা টমেটো। কোনোভাবে পড়া দিয়েই ভাগলো। তবে ভাইয়াও কি ছাড়বার পাবলিক নাকি? সেই রাস্তায় আটকালো। যেতেই দেয়না। তারপর ফিসফিসিয়ে কিছু একটা বলল আর ভাবীকে যেতে দিল। হাহাহাহ। তুমি থাকলে আরো মজা হতো। তিনজন একসাথে চোখ মারতাম ভাবীকে। কূজন একটু কেশে বলল,- আমার হয়ে গেছে সোনার হরিণ।রুমে ফিরে আসতেই কূজনের বেজায় মন খারাপ হলো। কুহুর দেয়া চিঠিটা খুঁজতে লাগলো সে। বুক পকেটে রেখেছিল মনে পড়তেই পকেট থেকে চিঠিটা খুলে আরো একবার পড়লো। তারপর নিজের লাগেজ খুলে কাপড়ের ভাঁজে রেখে দিল চিঠিটা। হঠাৎ মনে পড়লো কলরব ভাই দেখে ফেলেনিতো?? পর মুহূর্তেই মনে হল না দেখবে কেনো? চিঠি চিঠির জায়গায় আছে। আর দেখলে নিশ্চয় সকাল সকাল কুহুদের বাসায় যেত না। কূজনকে বেশ কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন করতো আগে। আচ্ছা জ্বরের ঘোরে কিছু বলেছে কি? ছোটবেলার অভ্যাস এটা। কলরব ভাইকে ইনিয়েবিনিয়ে জিজ্ঞেস করতে হবে একবার।...- এই যে বোরকটা টান দিন।কুহু চলন্ত রিকশায় বসে আড়চোখে কলরবের দিকে তাকালো। কিন্তু বোরকা টান দেয়নি। ইরিন, কুহু আর পিহু এক রিকশায় বসেছে। ইরিন উপরে বসে আছে। ইরিন কুহুকে আহ্লাদী হয়ে বলল,- ভাবী ঠিক করে বসো তো। পরে তোমার কিছু হলে আমার ভাইয়ের কি হবে?কুহু মনে মনে বলল,- কি আর হবে? আরেকটা ফুলটুশী ধরবে....পিহু কুহুর চেহারা দেখেই বুঝলো কিছু একটা হয়েছে। কলরব ভাই নয়তো সকাল সকাল বাসায় এসে বিকেলে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার জন্য মাকে বলতো না। আর আপুণিই বা হুট করে রেগে আছে কেনো? আসতেও চাইলো না মা জোর করে পাঠিয়েছে। কি জানি আপুণির থেকে কথা বের করতে হবে। ...কূজন আর কলরব বাইকে এসেছে তাই ওরা কুহুদের জন্য ওয়েট করছে। কুহু রিকশা থেকে নেমেই অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কলরব ভাড়া মিটিয়ে পিহুকে বলল,- মৌটুশী! ইরিনের কাছে শুনেছি তুমি নাকি নাগরদোলা চড়তে খুব পছন্দ করো?কলরবের মুখে মৌটুশী শুনে কুহু চোখ ছোট করে পিহুর দিকে তাকালো। পিহু খেয়াল করলো না। সে এখন নাগরদোলার নাম শুনে পাগলপারা। পারে না লাফালাফি শুরু করে দেয়। বিনাবাক্য ব্যয়ে নাগরদোলার দিকে পা বাড়ালো পিহু। ইরিন মেয়েটাকে পিহুর পাগল পাগল মনে হয়। এত কথা বলে তাই ভালো লাগে না। কিন্তু আজ বেশ পছন্দ হলো ওকে। ইরিন যদি পটপট না করতো তাহলে ওর যে নাগরদোলা পছন্দ তা জানতে পারতো না। ইরিন কুহুর হাত ধরে নাগরদোলার দিকে হাঁটতে লাগলো। আর বলল,- আমি নাগরদোলা ভয় পাই তারপরো এতো ইন্টারেস্টিং লাগে যে ভয়টয় মনে রাখি না। - ইরিন তুমি যাও আমার ভালো লাগে না। - আরে ভালো না লাগলেও কিছু করার নেই। তোমাকে ছাড়বো না ভাবী।ইরিন ঠিকঠিক টেনেটুনে কুহুকে বসালো। একটায় ইরিন,কুহু আর কলরব বসলো। আরেকটায় বসলো পিহু আর কূজন। ইরিন কুহু আর কলরবের মাঝে বসেই বলল,- আমি হলাম কাবাবমে হাড্ডি তাই না পিহু আপু?পিহু ম্লান হাসলো। কলরব তীক্ষ্ণ নজরে কূজনকে দেখছে। কূজন ভাবলেশহীনভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। বাসা থেকে বের হওয়ার পর থেকে কুহুর দিকে একবারো তাকায়নি সে। তবে চেহারায় একটা চাপা কষ্ট ফুটে উঠছে। কূজন থেকে চোখ সরিয়ে কলরব কুহুর দিকে তাকালো। কুহুও অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। নাগরদোলা চলতে লাগলেই কুহু চোখ বন্ধ করে ফেললো। চেহারায় স্পষ্ট আতঙ্ক দেখা দিল তার। বিড়বিড় করে কি যেন পড়ছে। ইরিন চোখ খুলে আছে তবে ভয়ে চিৎকার করছে। ইরিনের চিৎকারের চুটে কুহুর কথাগুলো কলরব বুঝতে পারলো না। কুহু এক পর্যায়ে বেশ জোরেই বলতে লাগলো,- ইরিন! প্লিজ থামাতে বলো। প্লিজ ইরিন নয়তো আমি এখনি মরে যাব। ইরিন তোমার ভাইয়াকে বলো থামাতে বলতে...কলরব ইরিনের হাত ধরে কুহুর হাতের উপর ইরিন হাত রেখে নিজে ইরিনের হাত চেপে ধরে বলল,- কিছু হবে না আমি আছি তো।কুহু ভয়ের চুটে চোখ খুললো না কিন্তু হাত সরাতে নিলেই কলরব আরো শক্ত করে ইরিনের হাত দিয়ে কুহুর হাত চেপে ধরলো। ইরিন ভাইয়ের কান্ড দেখে ভয় পাওয়া ভুলে গেল। তারপর বলল,- ইশ! কেনো যে আমি এখানে বসতে গেলাম!!! পুরাই একটা বাচ্চা মেয়ে আমি।ইরিনের কথা শুনে কলরব গগনবিহারী হাসি হাসতে লাগলো। কলরবের হাসির শব্দ কুহুর বেশ ভালো লাগছে। বুকের মধ্যে কেমন যেন একটা প্রশান্তি পাচ্ছে সে। নাগরদোলা থামতেই কুহু চোখ খুলে তাকালো। তাকিয়ে দেখলো কলরব ইরিনের হাতের উপর হাত রেখে কুহুর হাত চেপে ধরেছিল। এক মুহূর্তেই কুহুর মনটা ভালো হয়ে গেল, খুব বেশি ভালো হয়ে গেল। ...মৃদু ভলিউমে গান চলছে। খাবারের অর্ডার দিয়ে বসে আছে সবাই। ইরিনের খুব বোরিং লাগছে। কূজন চুপচাপ বসে মোবাইল চালাচ্ছে। পিহু রেস্টুরেন্টের একটা কাপলকে ফলো করছে আর কুহুর সাথে বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। কুহুও চুপচাপ পিহুর কথা শুনছে। মাঝে মাঝে আস্তে করে কি যেন বলছে। কলরব একদৃষ্টিতে কুহুকে দেখছে। ইরিন বিরক্ত হয়ে বলল,- চলো খেলা খেলি। ওয়েটারকে ডেকে একটা কাঁচের বোতল জোগাড় করলো সে। তারপর বোতলটা টেবিলে রেখে ঘুরালো। বোতলটা ঘুরে কুহুর দিক বরাবর থামলো। ইরিন আগ্রহ নিয়ে বলল,- ভাবী তুমি যেটা সবচেয়ে ভালো পারো সেটা করো।- আমি আবার কি করবো?- কেনো আবৃতি করো। তোমার ঘরে তো কত প্রাইজ। আবৃতিতে তুমি বেস্ট না হলে কীভাবে পেলে?কুহু হেসে বলল,- ঠিক আছি করছি।কবিতার নাম- তুই কি আমার দুঃখ হবি?শ্রদ্ধেয় আনিসুল হক স্যার।পিহু কুহুকে উদ্দেশ্য করে বিরক্তভরা কণ্ঠে বলল,- উনি কবে তোর স্যার ছিলেন?- উনারা শ্রদ্ধাভাজন তাই স্যার বলতে হয়। পিহু বিড়বিড় করে বলল,- ভালোই ছিলাম এখন কবিতা শুনে মুডটাই নষ্ট করতে হবে।কুহু ইরিনের কথায় কান না দিয়ে কবিতা আবৃতি শুরু করলো,"তুই কি আমার দুঃখ হবি?এই আমি এক উড়নচন্ডী আউলা বাউলরুখো চুলে পথের ধুলোচোখের নীচে কালো ছায়াসেইখানে তুই রাত বিরেতে স্পর্শ দিবি।তুই কি আমার দুঃখ হবি?তুই কি আমার শুষ্ক চোখে অশ্রু হবি?মধ্যরাতে বেজে ওঠা টেলিফোনের ধ্বনি হবি?তুই কি আমার খাঁ খাঁ দুপুরনির্জনতা ভেঙে দিয়েডাকপিয়নের নিষ্ঠ হাতেক্রমাগত নড়তে থাকা দরজাময় কড়া হবি?একটি নীলাভ এনভেলাপে পুরে রাখাকেমন যেন বিষাদ হবি?তুই কি আমার শুন্য বুকেদীর্ঘশ্বাসের বকুল হবি?নরম হাতের ছোঁয়া হবি?একটুখানি কষ্ট দিবি,নীচের ঠোট কামড়ে ধরা রোদন হবি?একটুখানি কষ্ট দিবিপ্রতীক্ষার এই দীর্ঘ হলুদ বিকেল বেলায়কথা দিয়েও না রাখা এক কথা হবি?একটুখানি কষ্ট দিবিতুই কি একা আমার হবি?তুই কি আমার একান্ত এক দুঃখ হবি?"কলরব একদৃষ্টিতে মুগ্ধ চোখে কুহুর দিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি তার তীক্ষ্ণ। বুঝতে চেষ্টা করছে কবিতাটার মানে কি? চলবে...#একটুখানি--- লামইয়া চৌধুরী।পর্বঃ ৪৯- ভালোবাসো?কুহু হাতের টিস্যু একবার ভাঁজ করছে একবার খুলছে।- কি হল বললে না যে ভালোবাসো? কুহু কলরবের দিকে মুখ তুলে তাকাচ্ছে না। দৃষ্টি মেঝের দিকে রেখে একমনে সে হাতের টিস্যুটা নিয়ে মেতে আছে। - বিয়েটা কি তোমার ইচ্ছেতে হচ্ছে?কুহু তার নিরবতা পালন করেই যাচ্ছে। কলরবের কোনো কথারই জবাব দিবে না ঠিক করে ফেলেছে সে।কলরব বিরক্ত হয়ে বলল,- কি ব্যাপার একটা কথারও জবাব দিচ্ছো না কেনো? - আমি বাসায় যাব। আজ আসি পিহু নীচে অপেক্ষা করছে।কুহু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই কলরব থমথমে গলায় বলল,- আমার কথা কি শেষ হয়েছে কুহু?কলরবের কণ্ঠ এই প্রথম কুহু নিজের নাম শুনেছে। কোকিলের কুহু ডাক আজ যেন কলরব ছিনিয়ে এনেছে। কলরব শান্ত স্বরে বলল,- বসো কুহু আগে আমার কথা শেষ হোক। পিহু আর ইরিন কূজনের সাথে আছে। সমস্যা নেই কূজন অনেক ভালো ছেলে।কলরব এতটুকু বলেই কুহুর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। কলরবের শান্ত কণ্ঠস্বর কুহু এর আগে শুনেনি। খুব গম্ভীর আর ভয়ঙ্কর মনে হলো কুহুর কাছে। তাই চুপচাপ চেয়ারে বসে পড়লো সে।- কাল রাতে তোমাকে কল দিয়েছিলাম। পিহু কিছু বলেছে?- হুম।- তাহলে পরে কল দাওনি কেনো? চুপ করে থাকবে না প্লিজ।- এমনিতে।- তাহলে আজ আমার সাথে ঘুরতে আসতে চাওনি কেনো?কুহু নিশ্চুপ। কলরবের বেশ মেজাজ খারাপ হচ্ছে তাও কিছু বলছে না। রাগটাকে গিলে ফেলে এবার সে নরম স্বরে বলল,- কুহু! অনেস্টলি বলো তোমার বিয়েতে মত আছে কিনা? কুহু এবারো চুপ করে রইলো। কলরবের কোনো কথার জবাব সে দিবে না বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কলরব প্রশ্নটা করে কিছুক্ষণ সময় দিল কুহুকে। কুহুর জবাব না পেয়ে কলরব আহত স্বরে বলল,- তুমি চিন্তা করো না আমি বিয়েটা ভেঙে দিব। তোমাকে চাপ নিতে হবে না। কেউ তোমাকে কিছু বলবে না। তোমার ফ্যামিলিও না আমার ফ্যামিলিও না। কলরবের কথা শুনে কুহু এত বেশি অবাক হয়েছে যে সে হাতে থাকা পার্স হাত থেকে ছেড়ে দিয়েছে। কলরব পার্সটা তুলে টেবিলে রাখতেই কুহু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর টলমলে চোখে কলরবের দিকে তাকিয়ে বলল,- উদ্ধার করেছেন আমাকে ধন্যবাদ। আর আপনিও আপনার অন্য ফুলটুশীদের মাঝে কোনো একজনকে নিয়ে সুখে থাকুন দোয়া রইলো।কথাটা বলেই কুহুর দম আটকে গেল। চোখ উপচে পানি বেরিয়ে আসতে লাগলো। কলরবের সামনে সে কিছুতেই কাঁদবে না তাই তাড়াতাড়ি পা চালালো। কলরব কুহুর কথা শোনে বিস্ফোরিত চোখে কুহুর চলে যাওয়া দেখছে। কি বলে গেল মেয়েটা? অন্য ফুলটুশীরা মানে? ফুলটুশী কয়টা আছে?? কলরব ব্যাপক অবাক হয়েছে। হা হয়ে আছে পুরা। কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে থাকার পর ধাতস্হ হলো কলরব। কুহুর কিছু একটা হয়েছে। তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ালো সে। পা বাড়ালো চলে যাওয়ার জন্য। পরমূহুর্তেই পিছন ফিরে টেবিল থেকে কুহুর পার্সটা নিল সে। তাড়াতাড়ি করে নীচে নামতেই কলরব দেখলো কুহু, পিহু রিকশায় করে চলে যাচ্ছে। ইরিন প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে দিবে এমন চাহনী দিতেই কলরব কুহুর পার্সটা ইরিনের হাতে দিয়ে বলল,- এটা রাখ।- ভাবী এভাবে হুড়মুড় করে চলে গেল কেনো? আর পিহু আপুকেও সাথে নিয়ে গেল আর কাঁদছেই বা কেনো? কূজন বাইকের সাথে ধাক্কা দিয়ে দূরে কোথাও তাকিয়েছিল। কে আসলো গেল কিছুতেই তার মন নেই। কুহু কখন এলো আর কখন গেল, কবেই বা কাঁদলো কূজন কিছুই টের পায়নি। ইরিনের কথায় সম্বিত ফিরে পেল কূজন। কানে বাজলো কুহ কেঁদে চলে গেছে। সেদিনের কথা মনে পড়তেই চিৎকার করে কুহুকে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে হলো "কেনো কাঁদলে কুহু? কেনো কাঁদাচ্ছো কুহু? "কলরব ইরিনের কথার জবাব দিল না শুধু বলল,- বাসায় চল আর পার্সটা হাতে রাখ।...কুহু রিকশায় বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ঠোঁট কাপঁছে, বুকের মধ্যে সূচ গাঁথা হয়েছে এমন কষ্ট হচ্ছে। পিহু কিছুই বুঝতে পারছে না। হঠাৎ কি হলো কুহুর? এভাবে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বেরিয়ে এলো কেনো? আর কেনোইবা এখন এভাবে কাঁদছে? বাসায় যেয়ে জানতে হবে। কুহু সারা রাস্তায় কেঁদেকেটে গলির ভিতর রিকশা ঢুকতেই চোখমুখ মুছে ফেললো। বাসায় যেয়েও নরমাল বিহেভ করলো। পিহুরও বান্ধবী এসেছে বাসায় তাই কুহুর সাথে আর কথা বলা হলো না। সন্ধ্যা সাতটার দিকে বান্ধবীকে বিদায় করে কুহুর কাছে গেল সে। চুপচাপ গুটিসুটি মেরে বসে আছে কুহু। পিহু বোনের মুখোমুখি বসে বলল,- কলরব ভাই কি কোনো শালীন কাজ করেছে?কুহু ভাঙ্গা কণ্ঠে বলল,- বাক্যটা ভুল হয়েছে। অশালীন শব্দটা হলে তোর মনের ভাব প্রকাশ পেতো। পিহু কুহুর কথার রিপিড করে বলল,- ঢং!!! মনের ভাব তুই বুঝেছিস তাতেই হলো এখন বল এমন কিছু?- না।- তাহলে?- বলেছে বিয়ে ভেঙে দিবে।বোনের কথা শোনে পিহু আৎকে উঠলো।- কি বলিস কি? এটার কোনো মানে হয়? যতসব ফাজলামি...পিহুর কথা শেষ না হতেই কুহু পিহুকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো। পিহু চুপ করে বসে রইলো। কুহুর কান্নাকাটি শেষ হলে আরো কথা জানতে হবে। কুহুর কান্না কমে এলে পিহু কুহুকে বলল,- তুই কাল রাতে এতো রেগেছিলি কেনো?- কারণ কাল রাতে আমি যখন ফোন করি তখন কলরব...- এই আল্লাহ আমার না কালকে কোচিং এ পরীক্ষা। আল্লাহ পরে বলিস এখন পড়তে হবে।কুহু হতাশ হয়ে বলল,- তোর পরীক্ষা আর আমার জীবন...পিহু বই বের করতে করতে বলল,- পড়াশুনা আমার জীবন। - তুই অনেক বড় হবিরে পিহু।- বল ডাক্তার হবি।- ইনশাআল্লাহ!...কলরব কিছুতেই বুঝতে পারছে না কি করবে। কুহুর মোবাইলটা পার্সের ভিতর ছিল তাই সেটাও এখন তার কাছে। পিহুর নাম্বার জানে না কলরব। কুহুর মায়ের মোবাইলের ফোন দেওয়াটা পছন্দসই মনে হচ্ছে না কলরবের তাই তাও দিচ্ছে না। ইরিনকে এতো রাতে পাঠানোও সম্ভব না। তাছাড়া পরশু থেকে ইরিনের পরীক্ষা, এখন পড়া দরকার। কুহুর সাথে যোগাযোগ করতেই হবে। বেশি দেরি হয়ে গেলে সবকিছু কমপ্লিকেটেড হয়ে যাবে। বাধ্য হয়ে মায়ের কাছে যেয়ে আবদার ধরলো কুহুর সাথে দেখা করিয়ে দেবার।- ঠিক আছে কাল সকালে কথা বলিস নয়তো ওর মায়ের থেকে আমি পিহুর নাম্বার নিয়ে নিচ্ছি। পিহুর মোবাইলে ফোন দিয়ে কথা বল।- মা আমি সরাসরি কথা বলতে চাই।- কাল সকালেই বলিস।- মা আমি এখন কথা বলতে চাই।- রাতের আটটা বাজে তুই ওর সাথে কি কথা বলবি?- ইম্পর্টেন্ট।- তাহলে আমার সাথে ওর বাসায় চল..- নাহ্ মা ওর বাসায় না..- কুহুর মা এখন ওকে জীবনেও আসতে দিবে না।- না মা কুহুকে আমাদের বাসায় আসতে হবে না।সাহরা বিস্ফোরিত চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,- তাহলে?- মা ওকে ওদের ছাদে আসতে বলো।- তোর পা দুইটা ভেঙে হাতে ধরিয়ে দিব। এতো রাতে কিসের কথা তোর?- মা বুঝো না কেনো? আর্জেন্ট! আমি বললে সে কখনো আসবে না প্লিজ কিছু একটা করো।- কিছু একটা করবো মানে কি? সামনে থেকে সর বলছি। যতসব ফাজলামি! এতোদিন বিয়েই করতে চায়নি আর এখন পাগল হয়ে গেছে।- মা বুঝো না কেনো?- তোকে বললাম যা নিজের কাজ কর গিয়ে।- ভালো হয়েছে বলা লাগবে না কুহুকে। কুহু যেমন পাগল তুমিও একইরকম পাগল। দুই পাগলের মাঝে আমি ফেঁসেছি। একটা নরমাল কথাকে কি থেকে কি বানিয়েছো। লাগবে না কারো বলা। কোনো কুহুটুহুর সাথে কথা বলানো লাগবে না। আজ কেনো কালও কথা বলবো না। মায়ের সাথে রাগ দেখিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছে কলরব। প্রচন্ড রকমের মেজাজ খারাপ তার। কূজনকে কেটে কুঁচি কুঁচি করে পানিতে ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে তার। সারা দুনিয়াতে আর একটা মেয়েও খুঁজে পায়নি। আর কুহু গাধীটাও একটা! ক্লিয়ার করে কিছুই বলে না। মায়ের উপর সবচেয়ে বেশি বিরক্ত লাগছে। একটু কথাই তো বলবে নাহ্ সেটাও বলা যাবে না। আর খুঁজে টুঁজে কুহুকেই ধরতে হলো। একে তো কি রাগ আবার বোকাসোকা। প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি কুহুদের বারান্দার দিকে। মেয়েটা কি একবার বারান্দায় ও আসতে পারে না? হতাশ হয়ে কলরব দাঁড়িয়ে আছে। পকেটে ফোন বাজতেই পকেট থেকে মোবাইল বের করলো।- হ্যালো রঞ্জু বল!- কি খবর দোস্ত?- কি আর খবর।- কেনো দোস্ত কি হলো আবার? তুই না তোর ফুলটুশীকে পেলি। আর কি চাই?- শালার কচু পেয়েছি। মানুষ বিয়ের পরে পস্তায়। আমার জ্বালা আগেই শুরু।- ভাবী অনেক প্যারা দেয় নাকি?- প্যারা দেয় মানে সে নিজেই তো একটা প্যারা। তার উপর মা আরেক ড্রামাকুইন।- বউ শ্বাশুড়ীর যুদ্ধ শুরু নাকি?- আরে নাহ তেমন না। বলেছিলাম কুহুর সাথে আর্জেন্ট কথা আছে ওকে একটু ছাদে দেখা করতে বলো। নাহ্ উনি বলে দিয়েছেন সকালে দেখা করিস। রঞ্জু ফোনের ওপাশ থেকে হাসতে হাসতে বলল,- তা তো বলবেই। তুই এতো বলদ হলি কবে দোস্ত? আন্টিকে যেয়ে বলেছিস দেখা করবি হাহাহাহা। ভাবীকে বল তুই দেখা দেখা করতে চাচ্ছিস..- আরেহ্ আপনার ভাবীরে..আপনার ভাবী খালি রাগ দেখাতে জানে আর কিছুই জানে না। আর পারে শুধু শুধু আমাকে জমের মতন ভয় পেতে। উনি কি এখন জীবনেও আসবেন? উনাকে তো আমি খেয়ে ফেলবো।- আরে বল বল বললেই আসবে। প্রথম একটুখানি পার্ট নিবে আরকি।- আরে নাহ্ তোর ভাবী হলো অন্য চিজ। এখন রাখ তো সেই মেজাজ খারাপ হচ্ছে। চলবে...#একটুখানি--- লামইয়া চৌধুরী।পর্বঃ ৫০কলরবের খুব কফি খেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু এলাকায় কফি পাওয়া যায় না। কফি খেতে হলে দূরে যেতে হবে। আর বাসায় তো এখন যাবেই না। মায়ের ঢং দেখলে আরো বেশি রাগ উঠবে। ভাবটা এমন যেন উনি কুহুর মা। কুহুর চিন্তায় মরে যাচ্ছেন উনি। আপাতত কলরব নিজের মাথা ঠাণ্ডা করতে এককাপ চা খেলো দোকান থেকে। তারপর চুপচাপ চায়ের দোকানেই বসে রইলো। সমীকরণ মিলাচ্ছে সে। কাল রাত থেকেই তার মাথা কেমন যেন ভোঁতা হয়ে গেছে। কি করবে কি ভাববে কিছুই কূল পাচ্ছিলো না সে। এখন মাথা ঠাণ্ডা করে ভাববে সে। একদম কুল ডাউন হয়ে। মেরিয়েম উজারলি যতটা হট ঠিক তার চেয়ে বেশি কুল হয়ে কলরব সবটা ভেবে দেখবে। প্রথমত একটু আগে খুবই জঘন্য একটা চিন্তা করেছে সে। কূজনকে নাকি কুঁচি কুঁচি করে পানিতে ভাসিয়ে দিবে। কীভাবে ভাবতে পারলো খুঁজে পেল না কলরব। কলরব ভাবছে কূজনের কি দোষ? আর সে নিজেও তো খুঁজে এই গাধী মেয়েটাকেই ভালোবেসেছে। কূজনেরও হয়তো একই প্রশ্ন। আর কূজন বেচারা তো চুপচাপ সব সয়েই যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা কলরবকে বা অন্য কাউকে সে নিজের মনের কথা বুঝতে দেয়নি। জ্বরের ঘোরে যা বলার বলেছে। জ্বরের ঘোরেও তো বলল সে দুজনের মাঝে আসবে না, চলে যাবে। তাহলে কূজনের দোষটা কোথায়? কিন্তু কুহু! কুহু যদি কূজনকে ভালোবাসে তাহলে কলরব নিজে ওদের বিয়ে দিয়ে দিবে। কূজন আর কুহুর মাঝে কখনো আসবে না সে। কিন্তু সমস্যা হলো এই মেয়ে ক্লিয়ারলি কিছুই বলে না। যদিও বা কলরবের ধারণা সে কুহুর মনের কথা বুঝতে পারে তাও মেয়ে মানুষের মন বুঝা বড় দায়। কথায় আছে স্বয়ং দেবতারাও নাকি বুঝে না। কলরব একটার সাথে আরেকটা ঘটনা মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করছে। প্রথমত কূজন বলেছিল কুহু যেন একবার তাকে ভালোবাসি কথাটা বলে তাহলে সে চলে যাবে। মানে কুহু কূজনকে ভালোবাসি বলেনি। কিন্তু আজ যখন কলরব নিজে কুহুকে জিজ্ঞাসা করলো তাকে ভালোবাসে কিনা জবাবে কুহু কিছুই বলেনি। কলরব অবশ্য এই জবাবের আশাও করেনি। এতো তাড়াতাড়ি কি বলা যায় নাকি? সে নিজেও বেশ সময় নিয়েছে। আর কুহুর মুখ থেকে ভালোবাসি নামক কথা শুনতে সে মরেও যাচ্ছে না। ভালোবাসাবাসি যদি শুধু তিন শব্দে আটকে থাকতো তাহলে তো হতোই। ভালোবাসা প্রকাশের অনেক ধরণের পথ আছে। তবে ছেলেদের রাস্তাগুলো সীমিত। মেয়েরা বহু উপায়ে ভালোবাসি বলে। এই ভালোবাসা কান দিয়ে শোনা যায় না, শুনতে হয় হৃদয় দিয়ে। কোনো কোনো মেয়ে খুব সুন্দর করে প্রেমিকের চোখে চোখ রেখে অহর্নিশ জেগে থাকতে পারে। কেউবালজ্জায় মুখ তুলে তাকাতেই পারে না। কিছু মেয়ে অভিমানের ঝুঁড়ি নিয়ে বসে থাকে। কেউবা ভালোবাসার মানুষের প্রতি হুটহাট রেগে যায়, কারণ ছাড়াই। ওরা চায় ভালোবাসার মানুষটি ওদের রাগ ভাঙাক। অভিমানি মেয়েটি চায় প্রেমিক পুরুষটি যেন মেয়েটির চোখের পানিটুকু দেখে আৎকে উঠে বুকে টেনে নেয়। এরা সবাই তো ভালোবাসে কিন্তু ধরণটা ভিন্ন। কলরব নিজের ভাবনা দেখে বেশ অবাক হলো। মেয়েদের সম্পর্কে পিএইচডি করে ফেলেছে এমন মনে হচ্ছে নিজেকে। আনমনেই হাসলো তারপর হঠাৎ বুঝতে পারলো কুহু বোধহয় তার উপর রেগে আছে। ফুলটুশীর তো নাকের ডগায় রাগের রাজত্ব। নিশ্চই ঐসময় ফোনে কথা বলেনি তাই হয়তো রাগ করেছে। কিন্তু এতে রাগ করার কি আছে? ব্যস্ত ছিল তা তো বলে দিয়েছে সে। তারপর ফোনও দিয়েছে। এই সামান্য একটা বিষয় নিয়ে ঝামেলা করার কি আছে? এই হল মেয়ে মানুষ। প্রথম তো কত কারখানা করে কল দেওয়ার জন্য রাজি করাতে হয়। তারপর এটা নিয়েই নাগড়ামি শুরু। হতে পারে প্রথম ফোনে কথা বলা নিয়ে কুহুর কিছু এক্সপেকটেশন ছিল। মেয়েরা তো আবার প্রথম দেখা হওয়া, প্রথম কথা বলা, প্রথম চোখে চোখ রাখা, হাতে হাত রাখা সব কিছু স্পেশাল চায়। সব প্রথমের দিন, বার, তারিখ সব মনে রাখে। কুহু হয়তো তাই রেগে আছে। কিন্তু বিয়ে চাপে পড়ে করছে কিনা সে প্রশ্নের জবাব দিল না কেনো সে? এটা তো বলতে পারতো। চুপ থাকা সম্মতির লক্ষণ হলেও কিছু বিষয় সোজাসোজি বলা ভালো। অন্তত ইনিয়েবিনিয়ে কিছু বললেও কলরব বুঝতে পারতো। কিন্তু বিয়ে ভেঙে দিবে বলায় কান্না করলো কেনো? আবার সাথে বলে দিয়েছে যেন অন্য ফুলটুশীদের মধ্য থেকে কাউকে বিয়ে করে সে। কলরব চায়ের দোকানের বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে দাম মিটিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এলো। এক দুইটা রিকশা যাচ্ছে পাশ দিয়ে। কলরব বুঝতে পেরেছে কুহু তার উপর রেগে আছে। তাই বিকেলে একবারো তাকায়নি তার দিকে। যতবার দেখেছে আড়চোখে তাকিয়ে দেখেছে। কলরবের চিন্তা ভাবনা তো চুম্বকের মতন। সবসময় প্রব্লেমটা টেনে বের করে ফেলে সে। কিন্তু কূজন কুহুকে ভালোবাসে শুনে সবটুকু চিন্তা ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল তার। সব একসাথে গুলিয়ে ফেলেছিল। মায়ের উপরও কতক্ষণ রাগ ঝেরে এসেছে। কলরব নিজেই চিন্তা করলো ইরিনের সাথে এতো রাতে কেউ ছাদে দাঁড়িয়ে কথা বলবে সেটা সেও মেনে নিবে না। মা তো মায়ের জায়গায় ঠিকই আছে। বিষয়টা আসলেই খারাপ দেখায়। যতোই ফিওন্সে হোক। কলরবের এখন বাসায় যেতে মোটেও ইচ্ছা করছে না। তাই ছাদে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখছে সে। যদিও চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে তবে খুব বেশি ফিল করতে পারছে না। কেমন যেন বিবর্ণ লাগছে। হঠাৎ কিছু একটার শব্দ শুনতে পেল কলরব। দরজা খোলার শব্দ মনে হলো। কলরব তো ছাদের দরজা খুলা রেখেই এসেছে এটা আবার খুলবে কে? দেখার জন্যে এগুতে যেতেই কিছু একটা মনে করে ঘাড় ঘুরিয়ে কুহুদের ছাদের দিকে তাকালো। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেল একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। সিঁড়িঘরের সাইড দিয়ে হেঁটে ছাদের ওপাশে চলে যাচ্ছে। কলরব মৃদু হেসে মোবাইলে সময় দেখলো। নটা বেজে বারো মিনিট। কলরব খুব দ্রুত ভাবতে লাগলো। মা কি কুহুকে পাঠিয়েছে? নাহ্ মা পাঠাবে না। সে নিজেই কি এসেছে? হয়তোবা! কলরব ডাক দিতে যেয়েও ডাকলো না। কুহুদের বাড়ি আর কলরবদের বাড়ির ছাদ পাশাপাশি। লাফ দিয়ে সহজেই যাওয়া যায়। কিন্তু দুটোতেই রেলিং দেওয়া। কিন্তু কলরব ঝুঁকে একটুখানি দেখে নিল তারপর ভেবে দেখলো ইজিলি যেতে পারবে সে। ...কুহুর বেজায় মন খারাপ। বুক চিরে শুধু দীর্ঘশ্বাস বের হচ্ছে। মন ভালো নেই তাই ভাবলো ছাদে যেয়ে দাঁড়াবে। বারান্দায় এখন দাঁড়ানো যাবে না। রাস্তায় দুনিয়ার মানুষ। ছাদের পিছন দিকটায় দাঁড়ালে কেউ কিছুই দেখতে পায় না। বাড়ির পিছন দিকটায় শুধু কাঁঠাল গাছ আর আম গাছ। বাড়িঘর তেমন নেই আর রাস্তাটাও কাঁচা তাই মানুষজন চলাচল করে না। চাঁদ দেখতে কুহু যে বরাবরি পছন্দ করে তা কবরী জানেন তাই কুহু মাকে বলেই ছাদে চলে এলো। পিছন দিকটায় দাঁড়িয়ে আছে। হালকা শীত পড়েছে। গায়ে চাদর জড়িয়ে চাঁদ দেখছে কুহু। হঠাৎ কুহুর চোখের সামনে কেউ হাত দিয়ে তুড়ি বাজালো। কুহু ভয় পেল একটু। তাই আস্তে করে বলল,- ইয়া আল্লাহ্!তারপর বিস্ময় নিয়ে পাশে তাকাতেই দেখলো কলরব দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি করে বুকে ফুঁ দিলো সে। কলরব ফিসফিসিয়ে বলল,- তোমার ভয় হয় না?কলরবের কথায় কুহু আবারো বুকে ফু্ঁ দিল। তারপর বলল,- আজব!কলরব হাসলো তবে জোরে হাসলো না। পাছে কেউ শুনে ফেলে আবার। কুহু কলরবের হাসির দিকে তাকিয়ে আছে। কি অদ্ভুত মায়া লাগছে কুহুর। কলরবের হাসিতে কিছু আছে কি? এতো ভালো লাগে কেনো? আগে তো কখনোই ভালো লাগেনি। মানুষ কি হারিয়ে যাওয়া জিনিষকেই ভালোবাসে? কলরব ওর হবে না জেনেছে বলেই কি আজ কলরবকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে? কলরবের চওড়া হাসি দেখে কুহুর ইচ্ছে করছে কলরবের গাল ছুঁয়ে বলতে,- তুমি কি সত্যি আমায় ছেড়ে দিবে?কথাটা ভাবতেই কুহুর চোখজোড়া ভিজে উঠলো। কলরবের থেকে চোখ ফিরিয়ে নিল সে। যে মানুষটা তার হবার নয় তাকে নিয়ে ভাবছে কেনো সে? কলরব তার হবার নয় ভাবতেই কুহুর প্রতিটা শিরা উপশিরায় বেদনা ছেয়ে গেল। খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে তার। কুহুর চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। দ্রুত গতিতে কুহু পা চালালো চলে যাওয়ার জন্য। কলরব জায়গা থেকে নড়লো না। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। কুহু কিছুটা দূর যেতেই কলরব সামান্য জোরে বলল,- কুহু তুমি কি চাচ্ছো আমি তোমার হাত ধরি?কুহু কলরবের কথায় থমকে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ ভাবলো কলরব আসলে কি বলতে চেয়েছে তারপর পিছন ফিরে তাকালো। কুহুকে ফিরতে দেখেই কলরব কিছুটা এগিয়ে গেল কুহুর দিক। তারপর বলল,- আমি জানতে চাইছি তুমি কি নিজ ইচ্ছায় আমাকে কথা বলার একটুখানি সুযোগ দিবে নাকি চলে যেতে চাইবে? চলে যেতে চাইলেও যেতে দিব না। তোমার হাত ধরে আটকাবো তোমাকে। কলরবের কথা শেষ হতেই কুহু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। কিন্তু কলরবের কথা শুনে প্রথমে ভয়ে কুহুর গায়ের সবকটা পশম দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কলরব আবার নিজের জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো, রেলিং ঘেঁষে। কুহু আস্তে করে বলল,- আমার আপনার সাথে কোনো কথা নেই।- কুহু! প্লিজ।- কুহু নীচের দিকে তাকিয়ে রইল। অনেক্ষণ! অনেক, অনেক, অনেকক্ষণ। তারপর কিছু একটা বলতে চাইলো কিন্তু বলতে পারলো না। সব কথা যেন গলায় এসে আটকে রইলো। কলরব আকুতির স্বরে বলল,- কুহু! তুমি কি অন্য কাউকে পছন্দ করো?কুহুর এবার কান্না চলে এলো। নীচের দিকে তাকিয়ে বলল,- নাহ্! কিন্তু...তারপর আর বলতে পারলো, গলা দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না।কলরব উৎসুক হয়ে বলল,- কিন্তু??কুহু এবার মুখ তুলে চাইলো। কলরবের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কলরবকে উদ্দেশ্য করে বলল,- কিন্তু যাকে ভালোবাসি সে অন্যকাউকে পছন্দ করে।কথাটা বলেই কুহু ঝড়ের গতিতে দৌড়ে চলে গেল। কলরবও কুহুর পিছন পিছন আসলো। তারপর পথ আটকে সামনে দাঁড়িয়ে বলল,- তা তুমি কাকে ভালোবাসো ফুলটুশী?কুহু এবার আগুন ঝরানো চোখে কলরবের দিকে তাকালো। যেন পারলে চোখ দিয়েই কলরবকে ভষ্ম করে দেয়। কলরব একটুখানি কেশে বলল,- তোমার কি আমাকে মেরে ফেলার ইচ্ছা?- হ্যাঁ তাই, মেরে ফেলতে চাই।কলরব মাথার চুল চুলকে বলল,- তোমাকে না কাঁদলে একটুও ভালো লাগে না। আমার মনে হয় তুমি যাকে ভালোবাসো সে তোমার এরকম কাঁদুনে মুখ পছন্দ করে না। সে পছন্দ করে নাকের ডগায় রাগ লেগে থাকা মেয়েটাকে। যে রেগে গেলে চোখে চোখ রেখেও দারুণ মিথ্যে বলতে পারে। রেগে গেলে তার চোখগুলো ছোট ছোট করে মিষ্টি কণ্ঠে ঝাল ঝাল কথা বলে মেয়েটা। তুমি যাকে ভালোবাসো সে পছন্দ করে ভীতসন্ত্রস্ত এক হরিণীকে। যে কিনা তোমার ভালোবাসার মানুষটাকে দেখলেই ভয় পায়। চিনো নাকি তাকে?? আমি কিন্তু ঠিকই তোমার ভালোবাসার মানুষটাকে চিনেছি। ফুলটুশী তুমি কি আমার ভালোবাসার মানুষটা চিনেছো?- একদম আমাকে ফুলটুশী ডাকবেন না আপনি। কলরব অবাক হয়ে বলল,- কেনো? - কেনো মানে কি? আমি আপনাকে ফোন দিয়েছিলাম না?- হুম দিয়েছিলে তো। আমি বিজি ছিলাম তাই...- দেখুন সেটা সমস্যা না। সমস্যা হল সে নাম্বারটা আপনার জানার কথা না। নতুন নাম্বার আমার। পিহু ছাড়া কেউ জানে না। তাহলে চিনলেন কীভাবে আমি? আমি তো কথাও বলিনি যে বলবেন কণ্ঠস্বর শুনে চিনেছেন। যাকে তাকে ঢং করে ফুলটুশী বলে বেড়ানো আপনার অভ্যাস। মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করে বেড়ান তাই না? কলরব কুহুর কথা শুনে হেসে দিল। সেই গগনবিহারী হাসি। কুহু মুগ্ধ হয়ে কলরবের হাসি দেখছে। তাড়াতাড়ি করে নিজের চেহারায় আবার রাগী লুক নিয়ে এলো কুহু। কলরবের হাসি দেখে কিছুতেই গলবে না সে। কলরব হাসতে হাসতেই বলল,- আই লাইক ইট ফুলটুশী! রিয়ালি আই লাইক ইট! এন্ড আই লাভ ইউ ফুলটুশী। লাভ ইউ!কুহু মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নিল।কলরব ফিসফিস করে বলল,- তোমাকে অনেক ভালোবাসি ফুলটুশী। তাই তোমার নিরবতাও আমি চিনি। কুহু কলরবের দিকে তাকিয়ে বলল,- হুহ! বললেই হলো।- না বললেও অনেক সময় হয় না। আবার কিছু কথা না বললেও বুঝা যায়। যেমন তুমি কিন্তু বলোনি তুমি আমাকে ভালোবাসো তাও বুঝে নিয়েছি। কি বলো ভালোবাসো না?কুহু কলরবের চোখে চোখ রেখে বলল,- নাহ্ বাসি না।- তাহলে তো মরণ ছাড়া আমার আর উপায় নেই। এক কাজ করো ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দাও আমাকে। তাও তো মরার আগে তোমার হাতের ছোঁয়া পাবো। কুহু দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বলল,- ফাজিল!কলরব আহ্লাদি হয়ে কুহুর দিকে কিছুটা ঝুঁকে বলল,- ফাজিল + ফুলটুশী দারুণ জমবে। কুহু দুই পা পিছনে সরে বলল,- জমে গেছে।তারপর এক দৌড়ে সিঁড়িঘরে যেয়ে দরজা আটকে দিল। আর কলরব হাসতে লাগলো সেই গগনবিহারী হাসি।চলবে...#একটুখানি- লামইয়া চৌধুরী।পর্বঃ ৫১কূজনকে দেখছে কলরব। ঘুমিয়ে একাকার হয়ে আছে কূজন। কাঁথা জড়িয়ে আরামসে ঘুমাচ্ছে। কলরব কূজনের পাশে বসেই কূজনের কপালে হাত রেখে দেখলো জ্বর আছে কিনা। টেম্পারেচার নরমাল আছে দেখতে পেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। মনে মনে বলল,- ভাই আমাকে ক্ষমা করে দিস। কুহু তো কোনো ট্রফি না যে দিয়ে দিব তোকে। সে একটা মানুষ। নিজস্ব একটা স্বপ্ন আছে, আছে ভালোবাসা, ঘর বাঁধার স্বপ্ন। বিশ্বাস কর যদি কুহু আমাকে ভালো না বাসতো, তোকে ভালোবাসতো তাহলে নিজের বুকে পাথর চেপে হলেও তোকে আর কুহুকে এক করে দিতাম। বিশ্বাস কর ভাই যদি এমনো হতো কুহু আমাদের দুজন থেকে কাউকেই ভালোবাসে না তাহলেও আমি কুহুকে ভুলে যেতাম। তোকে কষ্ট দিতে চাই না ভাই। কিন্তু কুহুর মুখের হাসি আমার কাছে খুব বেশি ইম্পর্টেন্ট। মেয়েটাকে কষ্ট দিতে পারবো না। তোর মনে আছে কিনা জানি না নানার বাড়িতে ছোটবেলায় গ্রীষ্মের ছুটিতে বেড়াতে গিয়ে আমরা ক্রিকেট খেলতাম। তোর টিম বরাবরি হারতো। তুই হাসি মুখে আমার টিমের জয়জয়কার করতি। কোনোদিন মন খারাপ করতে দেখিনি তোকে। কিন্তু আমি ঠিকই জানতাম তোর খারাপ লাগতো। তাই এক দুইবার নিজ থেকে হেরে যেতাম। তখন তোর মুখে বিজয়ীর হাসি দেখে শান্তি লাগতো, খুব বেশি শান্তি লাগতো। আজো তুই ছোটবেলার মতোই আছিস। এখনো জীবননামক খেলায় আমার মতন সেলফিশ ভাইটির জন্য হাসিমুখে সব সহ্য করছিস। বিশ্বাস কর কূজন আমারো কষ্ট হচ্ছে। তুই এখনো ছোটবেলার মতোই রয়ে গেছিস। শুদ্ধতম, মহত্তম, নির্মল হৃদয় নিয়ে আজো কল্পনায় রয়ে গেলি। কিন্তু আমি তো আর ছোটবেলাটির মতন নেই। বাস্তবতা দেখেছি, বাস্তবতা শিখেছি, দুদিনের পৃথিবীতে স্বার্থপর হতে শিখেছি। কুহুর জন্য স্বার্থপর আমি। একমাত্র কুহুর খুশির জন্য। কুহু তো কোনো খেলনা নয় যে দুই ভাই একে অপরের জন্য তাকে ত্যাগ করবো। ক্রিকেট নামক খেলায় আমি ইচ্ছে করে হারতে পারি কারণ এতে ব্যাটবলের কোনো কষ্ট হবে না। কিন্তু কুহু নামক ভালোবাসার খেলায় এমন করলে আমাদের দুজনেরই ভালোবাসার মানুষটা কষ্ট পাবে, আমাদের কুহু কষ্ট পাবে। তা আমি নিজ চোখে দেখতে পারবো না। চাঁদের আলোয় কুহুর চোখের এক ফোঁটা গড়িয়ে পড়া জল দেখেই আমি নীল হয়ে যাচ্ছিলাম ভাই। আমি নিজের বুকের হাহাকারের দাপটের সাথে পেরে উঠলেও কুহুর কান্নার দাপট আমাকে ভেঙে চুরচুর করে দিবে। কুহুর আত্মসম্মান এর সামনে তোর প্রতি আমার আদর, স্নেহ হেরে গেল ভাই। ক্ষমা করে দিস। তবে আজ না বুঝলেও একদিন বুঝবি তিনটি জীবন নষ্ট হওয়া থেকে একজন কষ্ট পাওয়া ভালো। তোর কষ্টের নাও যে সুখের তীরে ঠেকবেই কূজন ঠেকবেই। কথাগুলো মনে মনে বলেই কলরব বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। কূজনের জন্য খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে। কালকেই কূজনকে পাঠিয়ে দিতে হবে। এখানে থাকলে অনেক বেশি কষ্ট পাবে কূজন। ছেলেটা এতো কষ্ট সহ্য করেও আজ জানতে চেয়েছে জ্বরের ঘোরে উল্টাপাল্টা কিছু বলেনি তো। কলরব ইচ্ছে করেই মুখ খুলেনি। বুঝতে দেয়নি কিছুই। কলরব চায় না কূজন শুধু শুধু অস্বস্তিতে পড়ুক। ...- সুরভী ভাবি কেমন আছেন?- আমি তোর ভাবি হলাম কবে?- গার্লফ্রেন্ড ছিলি নাকি? মনে পড়ছে না তো।- এক থাপ্পর দিয়ে তোর আক্কেল দাঁত সহ সব দাঁত ফেলে দিব।- তুই জানিস কি করে যে আমার আক্কেল দাঁত উঠেছে?- তোর কোন খবরটা জানি না। তুই যে তোর ফুলটুশীর উপরও রেগে আছিস তাও জানি।- শালা রঞ্জুটা তোকে সব খবর পাস করে তাই না?- ঐ রঞ্জু তোর শালা হলো কবে? তুই শালা। বান্ধবীর জামাইর শালা নিজে আর উল্টা আরো বান্ধবীর জামাইকে শালা বলে ঝাড়ি মারে। আসছে আমার মহাপুরুষ কলরব। রঞ্জুকে সম্মান দিয়ে কথা বলবি তোর দুলাভাই হয়।- আমি তোদের বদদোয়া দিলাম তোদের বাচ্চা হবে না। তোদের বাচ্চাকাচ্চা হলেও আমার ঝামেলা লাগবে। তুই বলবি আমি ওদের মামা। রঞ্জু বলবে চাচা। কপাল! কপাল! তোরে দুইটা কেন একটা আরেকটাকে বিয়ে করলি। নাহ্ পেলাম ভাবি নাহ্ পেলাম দুলাভাই। ব্যাচমেটকে বিয়ে করে তোরা দুজনই আমাদের মতন বন্ধুবান্ধবকে চিপায় ফেলেছিস। - আমার কোনো দোষ নেই। ঐ শালা রঞ্জুই আমাকে ফুসলিয়ে বিয়ে করেছে।সুরভীর কথা শুনে কলরব হাসতে হাসতে শোয়া থেকে উঠে বসলো। তারপর বলল,- কে কাকে ফুসলিয়েছে তা ইবনাত কলরব ভালোভাবেই জানে।- কিরে বেশ ফুরফুরে মেজাজের মনে হচ্ছে। ফুলটুশী কি এমন করলো যে রাগ চলে গেছে? - ঐ মেয়ে কিছুই করতে পারে না। যা করার আমিই করিরে দোস্ত।সুরভী মজা করে বলল,- কি কি করিস তুই?- রঞ্জু তোর সাথে যা যা করে সব করি।- যাহ্ ফাজিল।- ও আমি কিছু বললে ফাজিল আর উনি ভালো মানুষ।- হয়েছে এবার বন্ধ করুন আর দয়া করে ছবি পাঠান তো ফুলটুশীর।- মোবাইলে তো ছবি নেই। একটা ওয়াশ করা ছবি আছে।- ঐটাই তুলে পাঠা। দেখতে হবে আমার কোন মেয়ে তোর মন কেঁড়েছে? কিসের তৈরী সে? কতো মেয়ে তোর পিছন পিছন ঘুরলো পাত্তা দিলি না। এমনকি আমি যদি রঞ্জু হাদারামটাকে পছন্দ না করতাম তাহলে আমিও তোর পিছন পিছন ঘুরতাম। সুরভীর কথা শোনে কলরব গগনবিহারী হাসি হাসতে লাগলো। সুরভী বিরক্ত হয়ে বলল,- ছাগলের মতন একদম হাসবি না।কলরব হাসি থামিয়ে বলল,- শোন আমার ফুলটুশী দেখতে পুরাই ডেজার্ট মাগাড় ডেঞ্জারাস। সেই রাগ মেয়ের। পান থেকে চুন খসতেই চোখ দিয়ে আগুন ঝরায়। তবে মজার কথা হলো আমাকে খুব ভয় পায়। একদম বোকাসোকা কিছুই বুঝে না। অনেক বেশি হেল্পফুল। সত্যি বলতে মেয়েটা খুব সাধারণ। তার মাঝেও কেমন যেন একটা অসাধারণ। কুহুকে প্রথম যখন দেখি আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতোই লেগেছে। খুব বেশি সুন্দরী মনে হয়নি। প্রায় প্রতিদিনই তো কথা হতো। তবে কুহুর যে জিনিসটা প্রথম থেকে ভালো লাগে সেটা হলো হেল্প করার মন মানসিকতা। কুহু পুরাই ভালোমানুষ টাইপ। যেমন ধর গতকাল বিকেলে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। রাস্তায় একটা কলার খোসা পড়ে ছিল। কুহুর বোন পিহু সেটা টপকিয়ে চলে যায়। আর ইরিন কথা বলতে বলতে সেটায় পা দিয়ে পড়ে যেতে নেয়। কুহু ধরে ফেলে। ইরিন খোসাটাকে পা দিয়ে সরিয়ে চলে আসে। কিন্তু কুহু খোসাটা হাত দিয়ে তুলে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসে। এটাই ওর মাঝের সবচেয়ে বড় স্পেশালিটি। মানুষ হিসেবে সেরা মানুষটাকেই আমি ভালোবেসেছি সুরভী। কুহু যখন বেড়াতে যায় ওর ফুফির বাড়িতে তখন আমি পুরাই অস্হির হয়ে পড়েছিলাম। কেমন যেন পাগল পাগল লাগতো নিজেকে। তখন প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম কুহুকে ভালোবাসি। এরপর থেকে ওকে খুব বেশি খেয়াল করে দেখেছি। দেখি ওর সবটাই কেমন যেন সৌন্দর্য্যে ঘেরা।- বাব্বাহ্ আমাদের ইবনাত কলরব তো পুরা হাবুডাবু খাচ্ছে, নাহ্ প্রেমে পুরা ডুবে গেছে। - ঐ শেষ হয়নি এখনো বাকি আছে। আমার কুহু অনেক সুন্দর করে কথা বলে। কথা বলার সময় কেমন যেন অভিধানের কঠিন কঠিন শব্দগুলো ব্যবহার করে। খুব বেশি শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলে। আবৃতিতে সবার থেকে এগিয়ে। মোটকথা কুহুর মাঝে প্রথম দেখায় বা এমনিতে কিছু পাবি না। কিন্তু একবার যখন ওকে বুঝতে চেষ্টা করবি অসাধারণ রকমের মুগ্ধ হবি। ধীরে ধীরে এই মেয়ে সবাইকে নেশাগ্রস্ত বানিয়ে ফেলে। এমনিতে তোর মনে হবে আমি শুধু শুধু কুহুর জন্য পাগল কিন্তু তুই যখন কুহুর সাথে মিশবি নিজেও ওর ভক্ত হয়ে যাবি। খুব খুব মিষ্টি একটা মেয়ে। বিশেষভাবে ওর রাগটা যা মিষ্টি বলার বাইরে। ফুলটুশী যখন যখন রেগে যায় আমি তখন তখন নতুন করে ওর প্রেমে পড়ি।- মিস্টার ডার্ক হেন্ডসাম আপনি এতো বিশ্লেষণ করেন? রঞ্জুর সাথে সংসার করি কিন্তু আদৌ তাকে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে আমি কেমন সে বলতে পারে না। শুধু বলে অনেক সুন্দর। কিন্তু তুই কি সুন্দর করে বলিস। তোর কথা শোনেই আমি অলরেডি মুগ্ধ হয়ে গেছি কুহুর প্রতি। - সত্যি বলছি মিলিয়ে নিস। আমি আগে ভাবতাম আমিই বোধহয় সাফারার এখন দেখি আমি একা না। কুহুকে অনেকেই পছন্দ করে। কথাটা বলেই কলরবের কূজনের জন্য প্রচন্ড মন খারাপ হয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুরভীকে বলল,- সুরভী পরে কথা বলছি। মাত্র ঘুম থেকে উঠেছি। - বাই রঞ্জুর শালা।- তুই পারিস বটে।...কূজন ইরিনের দিকে কাগজ বাড়িয়ে দিতেই ইরিন বলল,- কি এটা?- দেখো সোনার হরিণ।ইরিন কাগজটা হাতে নিয়ে দেখলো ওর আঁকা কূজনের পেইন্টিং। সে হেসে বলল,- থেঙ্ক ইউ ভাইয়া।- সোনার হরিণ মোস্ট ওয়েলকাম কিন্তু তুমি কি আমাকে আর আগের মতন পছন্দ করো না?- কেনো করবো না?- কারণ তুমি বলেছিলে তুমি যাদের ভালোবাসো ওদের পেইন্টিংগুলো তুমি ওদের দাও না। তাহলে আমাকে দিয়ে দিলে কেনো?ইরিন অপরাধীর মতন হেসে বলল,- আসলে ভাইয়া তোমার উপর খুব রেগেছিলাম তাই।- রাগ ভাঙার পরও ফিরিয়ে নিতে চাওনি।- আসলে চাচ্ছিলাম কিন্তু কেমন যেন খারাপ লাগছিলো। শুধু শুধু আঙ্কেলের জন্য আমি তোমাকে ভুল বুঝলাম।কূজন হেসে বলল,- ইটস্ ওকে সোনার হরিণ।ইরিন হেসে বলল,- তোমাকে একটা জিনিস দেখাই?- দেখি দেখাও। ইরিন নিজের ড্রয়িং খাতাটা খুলে কূজনের সামনে রেখে বলল,- দেখো।কূজন দেখলো ইরিন সেইম আরেকটা পেইন্টিং বানিয়েছে। কূজন হেসে বলল,- তুমি অনেক লক্ষী সোনার হরিণ। চলবে....#একটুখানি- লামইয়া চৌধুরী।পর্বঃ ৫১কূজনকে দেখছে কলরব। ঘুমিয়ে একাকার হয়ে আছে কূজন। কাঁথা জড়িয়ে আরামসে ঘুমাচ্ছে। কলরব কূজনের পাশে বসেই কূজনের কপালে হাত রেখে দেখলো জ্বর আছে কিনা। টেম্পারেচার নরমাল আছে দেখতে পেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। মনে মনে বলল,- ভাই আমাকে ক্ষমা করে দিস। কুহু তো কোনো ট্রফি না যে দিয়ে দিব তোকে। সে একটা মানুষ। নিজস্ব একটা স্বপ্ন আছে, আছে ভালোবাসা, ঘর বাঁধার স্বপ্ন। বিশ্বাস কর যদি কুহু আমাকে ভালো না বাসতো, তোকে ভালোবাসতো তাহলে নিজের বুকে পাথর চেপে হলেও তোকে আর কুহুকে এক করে দিতাম। বিশ্বাস কর ভাই যদি এমনো হতো কুহু আমাদের দুজন থেকে কাউকেই ভালোবাসে না তাহলেও আমি কুহুকে ভুলে যেতাম। তোকে কষ্ট দিতে চাই না ভাই। কিন্তু কুহুর মুখের হাসি আমার কাছে খুব বেশি ইম্পর্টেন্ট। মেয়েটাকে কষ্ট দিতে পারবো না। তোর মনে আছে কিনা জানি না নানার বাড়িতে ছোটবেলায় গ্রীষ্মের ছুটিতে বেড়াতে গিয়ে আমরা ক্রিকেট খেলতাম। তোর টিম বরাবরি হারতো। তুই হাসি মুখে আমার টিমের জয়জয়কার করতি। কোনোদিন মন খারাপ করতে দেখিনি তোকে। কিন্তু আমি ঠিকই জানতাম তোর খারাপ লাগতো। তাই এক দুইবার নিজ থেকে হেরে যেতাম। তখন তোর মুখে বিজয়ীর হাসি দেখে শান্তি লাগতো, খুব বেশি শান্তি লাগতো। আজো তুই ছোটবেলার মতোই আছিস। এখনো জীবননামক খেলায় আমার মতন সেলফিশ ভাইটির জন্য হাসিমুখে সব সহ্য করছিস। বিশ্বাস কর কূজন আমারো কষ্ট হচ্ছে। তুই এখনো ছোটবেলার মতোই রয়ে গেছিস। শুদ্ধতম, মহত্তম, নির্মল হৃদয় নিয়ে আজো কল্পনায় রয়ে গেলি। কিন্তু আমি তো আর ছোটবেলাটির মতন নেই। বাস্তবতা দেখেছি, বাস্তবতা শিখেছি, দুদিনের পৃথিবীতে স্বার্থপর হতে শিখেছি। কুহুর জন্য স্বার্থপর আমি। একমাত্র কুহুর খুশির জন্য। কুহু তো কোনো খেলনা নয় যে দুই ভাই একে অপরের জন্য তাকে ত্যাগ করবো। ক্রিকেট নামক খেলায় আমি ইচ্ছে করে হারতে পারি কারণ এতে ব্যাটবলের কোনো কষ্ট হবে না। কিন্তু কুহু নামক ভালোবাসার খেলায় এমন করলে আমাদের দুজনেরই ভালোবাসার মানুষটা কষ্ট পাবে, আমাদের কুহু কষ্ট পাবে। তা আমি নিজ চোখে দেখতে পারবো না। চাঁদের আলোয় কুহুর চোখের এক ফোঁটা গড়িয়ে পড়া জল দেখেই আমি নীল হয়ে যাচ্ছিলাম ভাই। আমি নিজের বুকের হাহাকারের দাপটের সাথে পেরে উঠলেও কুহুর কান্নার দাপট আমাকে ভেঙে চুরচুর করে দিবে। কুহুর আত্মসম্মান এর সামনে তোর প্রতি আমার আদর, স্নেহ হেরে গেল ভাই। ক্ষমা করে দিস। তবে আজ না বুঝলেও একদিন বুঝবি তিনটি জীবন নষ্ট হওয়া থেকে একজন কষ্ট পাওয়া ভালো। তোর কষ্টের নাও যে সুখের তীরে ঠেকবেই কূজন ঠেকবেই। কথাগুলো মনে মনে বলেই কলরব বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। কূজনের জন্য খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে। কালকেই কূজনকে পাঠিয়ে দিতে হবে। এখানে থাকলে অনেক বেশি কষ্ট পাবে কূজন। ছেলেটা এতো কষ্ট সহ্য করেও আজ জানতে চেয়েছে জ্বরের ঘোরে উল্টাপাল্টা কিছু বলেনি তো। কলরব ইচ্ছে করেই মুখ খুলেনি। বুঝতে দেয়নি কিছুই। কলরব চায় না কূজন শুধু শুধু অস্বস্তিতে পড়ুক। ...- সুরভী ভাবি কেমন আছেন?- আমি তোর ভাবি হলাম কবে?- গার্লফ্রেন্ড ছিলি নাকি? মনে পড়ছে না তো।- এক থাপ্পর দিয়ে তোর আক্কেল দাঁত সহ সব দাঁত ফেলে দিব।- তুই জানিস কি করে যে আমার আক্কেল দাঁত উঠেছে?- তোর কোন খবরটা জানি না। তুই যে তোর ফুলটুশীর উপরও রেগে আছিস তাও জানি।- শালা রঞ্জুটা তোকে সব খবর পাস করে তাই না?- ঐ রঞ্জু তোর শালা হলো কবে? তুই শালা। বান্ধবীর জামাইর শালা নিজে আর উল্টা আরো বান্ধবীর জামাইকে শালা বলে ঝাড়ি মারে। আসছে আমার মহাপুরুষ কলরব। রঞ্জুকে সম্মান দিয়ে কথা বলবি তোর দুলাভাই হয়।- আমি তোদের বদদোয়া দিলাম তোদের বাচ্চা হবে না। তোদের বাচ্চাকাচ্চা হলেও আমার ঝামেলা লাগবে। তুই বলবি আমি ওদের মামা। রঞ্জু বলবে চাচা। কপাল! কপাল! তোরে দুইটা কেন একটা আরেকটাকে বিয়ে করলি। নাহ্ পেলাম ভাবি নাহ্ পেলাম দুলাভাই। ব্যাচমেটকে বিয়ে করে তোরা দুজনই আমাদের মতন বন্ধুবান্ধবকে চিপায় ফেলেছিস। - আমার কোনো দোষ নেই। ঐ শালা রঞ্জুই আমাকে ফুসলিয়ে বিয়ে করেছে।সুরভীর কথা শুনে কলরব হাসতে হাসতে শোয়া থেকে উঠে বসলো। তারপর বলল,- কে কাকে ফুসলিয়েছে তা ইবনাত কলরব ভালোভাবেই জানে।- কিরে বেশ ফুরফুরে মেজাজের মনে হচ্ছে। ফুলটুশী কি এমন করলো যে রাগ চলে গেছে? - ঐ মেয়ে কিছুই করতে পারে না। যা করার আমিই করিরে দোস্ত।সুরভী মজা করে বলল,- কি কি করিস তুই?- রঞ্জু তোর সাথে যা যা করে সব করি।- যাহ্ ফাজিল।- ও আমি কিছু বললে ফাজিল আর উনি ভালো মানুষ।- হয়েছে এবার বন্ধ করুন আর দয়া করে ছবি পাঠান তো ফুলটুশীর।- মোবাইলে তো ছবি নেই। একটা ওয়াশ করা ছবি আছে।- ঐটাই তুলে পাঠা। দেখতে হবে আমার কোন মেয়ে তোর মন কেঁড়েছে? কিসের তৈরী সে? কতো মেয়ে তোর পিছন পিছন ঘুরলো পাত্তা দিলি না। এমনকি আমি যদি রঞ্জু হাদারামটাকে পছন্দ না করতাম তাহলে আমিও তোর পিছন পিছন ঘুরতাম। সুরভীর কথা শোনে কলরব গগনবিহারী হাসি হাসতে লাগলো। সুরভী বিরক্ত হয়ে বলল,- ছাগলের মতন একদম হাসবি না।কলরব হাসি থামিয়ে বলল,- শোন আমার ফুলটুশী দেখতে পুরাই ডেজার্ট মাগাড় ডেঞ্জারাস। সেই রাগ মেয়ের। পান থেকে চুন খসতেই চোখ দিয়ে আগুন ঝরায়। তবে মজার কথা হলো আমাকে খুব ভয় পায়। একদম বোকাসোকা কিছুই বুঝে না। অনেক বেশি হেল্পফুল। সত্যি বলতে মেয়েটা খুব সাধারণ। তার মাঝেও কেমন যেন একটা অসাধারণ। কুহুকে প্রথম যখন দেখি আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতোই লেগেছে। খুব বেশি সুন্দরী মনে হয়নি। প্রায় প্রতিদিনই তো কথা হতো। তবে কুহুর যে জিনিসটা প্রথম থেকে ভালো লাগে সেটা হলো হেল্প করার মন মানসিকতা। কুহু পুরাই ভালোমানুষ টাইপ। যেমন ধর গতকাল বিকেলে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। রাস্তায় একটা কলার খোসা পড়ে ছিল। কুহুর বোন পিহু সেটা টপকিয়ে চলে যায়। আর ইরিন কথা বলতে বলতে সেটায় পা দিয়ে পড়ে যেতে নেয়। কুহু ধরে ফেলে। ইরিন খোসাটাকে পা দিয়ে সরিয়ে চলে আসে। কিন্তু কুহু খোসাটা হাত দিয়ে তুলে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসে। এটাই ওর মাঝের সবচেয়ে বড় স্পেশালিটি। মানুষ হিসেবে সেরা মানুষটাকেই আমি ভালোবেসেছি সুরভী। কুহু যখন বেড়াতে যায় ওর ফুফির বাড়িতে তখন আমি পুরাই অস্হির হয়ে পড়েছিলাম। কেমন যেন পাগল পাগল লাগতো নিজেকে। তখন প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম কুহুকে ভালোবাসি। এরপর থেকে ওকে খুব বেশি খেয়াল করে দেখেছি। দেখি ওর সবটাই কেমন যেন সৌন্দর্য্যে ঘেরা।- বাব্বাহ্ আমাদের ইবনাত কলরব তো পুরা হাবুডাবু খাচ্ছে, নাহ্ প্রেমে পুরা ডুবে গেছে। - ঐ শেষ হয়নি এখনো বাকি আছে। আমার কুহু অনেক সুন্দর করে কথা বলে। কথা বলার সময় কেমন যেন অভিধানের কঠিন কঠিন শব্দগুলো ব্যবহার করে। খুব বেশি শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলে। আবৃতিতে সবার থেকে এগিয়ে। মোটকথা কুহুর মাঝে প্রথম দেখায় বা এমনিতে কিছু পাবি না। কিন্তু একবার যখন ওকে বুঝতে চেষ্টা করবি অসাধারণ রকমের মুগ্ধ হবি। ধীরে ধীরে এই মেয়ে সবাইকে নেশাগ্রস্ত বানিয়ে ফেলে। এমনিতে তোর মনে হবে আমি শুধু শুধু কুহুর জন্য পাগল কিন্তু তুই যখন কুহুর সাথে মিশবি নিজেও ওর ভক্ত হয়ে যাবি। খুব খুব মিষ্টি একটা মেয়ে। বিশেষভাবে ওর রাগটা যা মিষ্টি বলার বাইরে। ফুলটুশী যখন যখন রেগে যায় আমি তখন তখন নতুন করে ওর প্রেমে পড়ি।- মিস্টার ডার্ক হেন্ডসাম আপনি এতো বিশ্লেষণ করেন? রঞ্জুর সাথে সংসার করি কিন্তু আদৌ তাকে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে আমি কেমন সে বলতে পারে না। শুধু বলে অনেক সুন্দর। কিন্তু তুই কি সুন্দর করে বলিস। তোর কথা শোনেই আমি অলরেডি মুগ্ধ হয়ে গেছি কুহুর প্রতি। - সত্যি বলছি মিলিয়ে নিস। আমি আগে ভাবতাম আমিই বোধহয় সাফারার এখন দেখি আমি একা না। কুহুকে অনেকেই পছন্দ করে। কথাটা বলেই কলরবের কূজনের জন্য প্রচন্ড মন খারাপ হয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুরভীকে বলল,- সুরভী পরে কথা বলছি। মাত্র ঘুম থেকে উঠেছি। - বাই রঞ্জুর শালা।- তুই পারিস বটে।...কূজন ইরিনের দিকে কাগজ বাড়িয়ে দিতেই ইরিন বলল,- কি এটা?- দেখো সোনার হরিণ।ইরিন কাগজটা হাতে নিয়ে দেখলো ওর আঁকা কূজনের পেইন্টিং। সে হেসে বলল,- থেঙ্ক ইউ ভাইয়া।- সোনার হরিণ মোস্ট ওয়েলকাম কিন্তু তুমি কি আমাকে আর আগের মতন পছন্দ করো না?- কেনো করবো না?- কারণ তুমি বলেছিলে তুমি যাদের ভালোবাসো ওদের পেইন্টিংগুলো তুমি ওদের দাও না। তাহলে আমাকে দিয়ে দিলে কেনো?ইরিন অপরাধীর মতন হেসে বলল,- আসলে ভাইয়া তোমার উপর খুব রেগেছিলাম তাই।- রাগ ভাঙার পরও ফিরিয়ে নিতে চাওনি।- আসলে চাচ্ছিলাম কিন্তু কেমন যেন খারাপ লাগছিলো। শুধু শুধু আঙ্কেলের জন্য আমি তোমাকে ভুল বুঝলাম।কূজন হেসে বলল,- ইটস্ ওকে সোনার হরিণ।ইরিন হেসে বলল,- তোমাকে একটা জিনিস দেখাই?- দেখি দেখাও। ইরিন নিজের ড্রয়িং খাতাটা খুলে কূজনের সামনে রেখে বলল,- দেখো।কূজন দেখলো ইরিন সেইম আরেকটা পেইন্টিং বানিয়েছে। কূজন হেসে বলল,- তুমি অনেক লক্ষী সোনার হরিণ। চলবে....#একটুখানি--- লামইয়া চৌধুরী।পর্বঃ৫২- তুমি যে এসেছো আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।কলরবের কথায় কুহু হাসলো। বেশ জোরেই হাসলো। কলরব কুহুর হাসির শব্দ মন দিয়ে শুনছে। কুহু যতক্ষণ হাসলো কলরব ঠিক ততক্ষণ কুহুর দিকে পলকহীনভাবে তাকিয়ে রইলো। কুহু হাসি থামিয়ে আস্তে করে বলল,- উফ্ আমার এই রাক্ষসী হাসিটা নিয়ে আর পারি না। কেউ যদি শুনে ফেলে তাহলে কি হবে বলুন তো?- কি আর হবে? ভাববে কোকিলের ডাক কুহু থেকে আমার ফুলটুশীর হাসির শব্দ বেশি সুন্দর। মানুষ শুনলে সমস্যা হবে না তবে কোকিল শুনতে পেলে হিংসায় মরে যাবে।কলরবের কথা শোনে কুহু আবারো হাসতে লাগলো। কলরব আবারো মন দিয়ে কুহুর হাসির শব্দ শুনছে। কুহু কোনোরকম হাসি থামিয়ে বলল,- আপনি প্লিজ চুপ করুন তো নাহয় কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।- কেনো হবে?- এই তো আমার হাসির শব্দ শুনে যে কেউ এসে পড়বে। তারপর দেখবে রাতের অন্ধকারে আমরা ছাদের পিছন দিকটায় বসে আছি। আমাদের তখন কেউ নিশ্চয় পূজো করবে না।কলরব কুহুর আরেকটু কাছাকাছি এগিয়ে বসে বলল,- তাহলে আসলে কেনো ফুলটুশী?কুহু বলল,- চাঁদ দেখতে এসেছি।কলরব গগণবিহারী হাসি হেসে বলল,- ইটস্ অমানিষা কুহু!কলরবের কথা শুনে কুহুর চেহারা পুরোনো কাগজের মতো বিবর্ণ হয়ে গেল। কুণ্ঠিত গলায় বলল,- আপনাকে এই কয়েকদিন না দেখতে পেয়ে হাপিয়ে উঠেছিলাম। সপ্তাহের এই পাঁচটা দিনে আমার অবস্হা নাজেহাল হয়ে পড়ে।ইরিনকে যে সময়ে পড়াতে যাই আপনি অফিসে থাকেন। আর শুক্র, শনি ছাড়াও বিকেলে ছাদে আসতে পারেন না। ফোনে কথা বলেও পোষায় না আমার। আপনাকে কাছ থেকে দেখতে ইচ্ছে করে। তাই আজ যখন আপনি বললেন ছাদে দাঁড়িয়ে কফি খাচ্ছেন মন মানেনি আমার। উদভ্রান্তের মতন ছুটে এসেছি।কুহুর জবাব শুনে কলরবের বুকের মধ্যে ছ্যাঁৎ করে উঠলো। আচ্ছন্ন গলায় বলল,- ফুলটুশী তোমার ভয় করছে না?কুহু বিরক্তির শব্দ করে বলল,- আমি ভূতে বিশ্বাসী না। তাছাড়া অন্ধকারও ভয় পাই না।- আমি আমার কথা বলছি কুহু।- নাহ্ আপনি ফাজিল হলেও ভদ্র ফাজিল তাই ভয় হয়না।কলরব বিড়বিড় করে বলল,- ভদ্র ফাজিল বাহ্!তারপর ভৎসনার সুরে বলল,- আমি মোটেও ভদ্র না। আমার চিন্তাধারা খুব বেশি পরিমাণে অভদ্র। যেমন ধরো আমার এই মুহূর্তে তোমার সাথে ঘেঁষে বসতে ইচ্ছে করছে। তোমার হাতে হাত রাখতে ইচ্ছে করছে। আরো অনেককিছু ইচ্ছে করছে বললে রেগে যাবে। তারপর হুটহাট আমাদের বিয়েটা ভেঙে দিবে। এই ভয়ে চিন্তাগুলো জব্দ করে রেখেছি।কুহু অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে লাজুকভাবে হাসলো। তারপর কলরবের দিকে না তাকিয়েই বলল,- সাধে কি আর ভদ্র ফাজিল বলি।কলরব আহ্লাদ করে বলল,- জানো আমি তো আমাদের কয়টা ছেলেমেয়ে হবে, কি নাম রাখবো সব ঠিক করে ফেলেছি।কুহু কলরবের কথা শোনে হা হয়ে রইলো। তারপর লজ্জা পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো আর বলল,- আমি আসছি আম্মু পরে বকা দিবে।কলরব কিছু বলল না। চুপ করে কুহুর লজ্জা দেখলো। কুহু কিছুক্ষণ জবাবের অপেক্ষা করে চলে গেল। কুহু চলে যাওয়ার পরো কলরব বেশ কিছুক্ষণ কুহুদের ছাদে বসে রইলো। তারপর যখন উঠে দাঁড়ালো চলে যাওয়ার জন্য তখন দেখলো কুহু আবার ফিরে আসছে। কলরব কুহুকে হেঁটে আসতে দেখে আনমনে হাসলো। কারণ সে যেন কুহু আসবে বলেই বসে ছিল। কুহু এসেই কলরবের মুখোমুখি দাঁড়ালো। পায়ের পাতায় ভর দিয়ে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে কলরবের টিশার্ট খামচে ধরলো কুহু। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,"ভালোবাসি ভালোবেসে যাব বহুদূর,তোমারে না দেখিলে কেঁদে উঠে বুক।তোমার উফ্ বলা লাগে মধুর,তোমার কষ্টে ভিজুক চিবুক।"কলরব এতোটাই অবাক হয়েছে যে চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেছে। যতক্ষণে চোখের পলক পড়লো ততোক্ষণে কুহু দৌড়ে পালিয়েছে। কলরব আনমনেই নিজের টিশার্টে একবার হাত বুলালো তারপর নাক ডুবিয়ে ঘ্রাণ নিলো যে জায়গাটায় কুহু খামচে ধরেছিল। কলরব মুচকি হেসে নিজেদের ছাদের দিকে পা বাড়ালো। রেলিং পার হয়ে যাওয়ার সময় পড়ে যেতে নিলো সে। সামলে নিলো নিজেকে তারপর হেসে বলল,- কলরব এই তো শুরু। এই একটুখানিতেই তোর এই অবস্হা হলে বাকি জীবন পার করবি কীভাবে?বাসায় যেয়েই কলরব মোবাইল হাতে নিয়ে কুহুকে ফোন করলো। কুহু ফোন ধরছে না তাই কলরব মেসেজ পাঠালো।" তুমি আমাকে তুমি করে বললে?"কুহু রিপ্লাই করেছে,- জ্বি না মিস্টার ইবনাত কলরব। ঐটা কবিতার ছন্দ ছিল।- যাই ছিল আমাকে শেষ করে ফেলেছে। ফুলটুশী তুমি প্লিজ এই আপনি বলাটা ছাড়ো।- কেনো আগে তো হুশ ছিল না? এখন কেনো? - আসলেই আমি কেমন যেন ভুলো মনের হয়ে গেছি। সারাক্ষাণ খালি তুমি আর তুমি। আমি যে এবার বিসিএস এর রিটেনও টপকাতে পারবো না আমি শিউর। এখন আমার তোমার মতন একটা টিচার লাগবে।কুহু কলরবের মেসেজ পড়ে হাসতে হাসতে পিহুর উপর গড়াগড়ি খাচ্ছে। পিহু বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। তারপরো ধাক্কিয়ে কুহুকে সরাতে পারছে না। নিরুপায় হয়ে বসে রইলো পিহু। কুহু মেসেজের রিপ্লাই করলো,- আমি কিন্তু বেশ রাগী টিচার। ইরিনকে জিজ্ঞাসা করে দেখবেন?- তা তো জানি। তারপরো আমার তোমাকে চাই।- সকাল সন্ধ্যা বকা খেতে রাজি??- হুম আলবাদ রাজি। শুধু রাতে একটুখানি আদর খাওয়ালে চলবে।কলরবের মেসেজ পড়ে কুহু লজ্জা পেল। পিহু এবার বোনের উপর হেসে গড়াগড়ি খেলো। পিহু কুহুর হাত থেকে মোবাইল নিয়ে লিখলো,- দেওয়া যাবে না।- তোমার দেওয়া লাগবে না। আমি হলাম ডাকাতসর্দার। ডাকাতি করতে জানি।পিহু আর কথা বাড়ালো না। মোবাইল কুহুর হাতে দিয়ে মুচকি হাসতে হাসতে চলে গেল।কুহু লজ্জায় আর একটা মেসেজও করলো না। চুপচাপ মোবাইল নিয়ে বসে রইলো। কলরব একের পর এক মেসেজ দিয়েই যাচ্ছে। রিপ্লাই না পেয়ে কল দিচ্ছে। কুহু কয়েকবার ফোন কেটে দিল। কল কেটে দেওয়ায় কলরব মেসেজ দিল,- ফুলটুশী! তুমি রাগ করেছো? সরি কান ধরেছি। ভুল হয়ে গেছে আর কোনোদিন বলবো না। প্লিজ রাগ করো না। ফোন ধরছো না কেনো? প্লিজ অন্তত রিপ্লাই দাও।কুহু কলরবের এই মেসেজ দেখে মাথায় হাত দিয়ে বলল,- এই ছেলে নিশ্চিত বিসিএস এ ফেইল। ছাগলটা এটাও বুঝে না যে আমি রাগ করিনি লজ্জা পাচ্ছি। কলরব একের পর এক সরি লিখে মেসেজ করেই যাচ্ছে। কুহু হতাশ হয়ে রিপ্লাই লিখলো,- আপনি জীবনেও ক্যাডার হতে পারবেন না। ছাগল একটা। এখন ঘুমিয়ে পড়ুন। আগামীকাল সকালে না আপনার ঢাকা যাওয়ার কথা? দেরি করছেন কেনো? ডিনার করে ঘুমিয়ে পড়ুন।মেসেজটা সেন্ড করে কুহুর মন খারাপ হয়ে গেল। পনেরো দিন কলরবকে দেখতে পাবে না সে। কলরবেরও মেসেজটা দেখে মন খারাপ হলো। কুহুকে লিখলো,- ফুলটুশী কাল সকাল সাতটায় একবার ছাদে এসো। যাওয়ার আগে তোমার সাথে একবার দেখা করে যেতে চাই।- আসবো!...কুহুর ছাদে যাওয়ার কথা সকাল সাতটায়। কুহু ছয়টার দিকেই ছাদে চলে এলো। কলরবকে দেখার জন্য মন ভীষণ ছটফট করছিল। পারে না রাতে এসেই দাঁড়িয়ে থাকে। ছাদে এসেই সিঁড়িঘরের সাইড দিয়ে পিছন দিকটায় চলে গেল। এখন ওরা আর দুই ছাদে দাঁড়িয়ে কথা বলে না। এখানে এসে পাশাপাশি বসে কথা বলে। পিছনদিকটায় যেতেই কুহু দারুণ রকমের অবাক হলো। কলরব পিলারের সাথে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। কুহু ভেবে পেল না কলরব এতো সকালে এখানে কেনো? আরো তো এক ঘণ্টা বাকি। কলরবের মুখোমুখি বসে আস্তে করে ডাকলো,- শুনছেন?কলরব চোখ বন্ধ রেখেই বলল,- আমার নামটা পছন্দ হয় না?কুহু সরে কলরবের পাশে বসে বলল,- খুব পছন্দ হয়, নাম ধরে ডাকতেও ইচ্ছে হয়। কলরব চোখ খুলে তাকালো। তারপর কুহুর দিকে ফিরে বসে বলল,- তাহলে ডাকো না কেনো?- ডাকবো। বিয়ের দিন থেকে তুমি করে বলবো আর নাম ধরেও ডাকবো।- ধন্যবাদ ফুলটুশী।কলরব কথা বলতে বলতে পিছন থেকে একটা মাঝারী সাইজের বেতের ঝুড়ি বের করে কুহুর সামনে রাখলো।কুহু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ঝুড়িটার দিকে। ঝুড়ি ভর্তি নানান রঙের রেশমি চুড়ি রাখা। কুহুকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে কলরব বলল,- এগুলো কিন্তু তোমার জন্য না।কলরবের কথা শুনে কুহু আগের চেয়েও বেশি অবাক হলো। অবাকের চেয়ে বেশি রাগ হলো কুহুর। রাগে মনে মনে নিজের হাত কামড়াতে লাগলো। চোখ ভর্তি মেঘ গুলোর মাঝে ঢুকাঢুকি শুরু হয়ে গেল। কুহু যখন রাগ প্রকাশ করতে পারে না তখন কুহুর কান্না চলে আসে। এখনো কান্না চলে আসছে কুহুর। কোনোরকম আটকে রাখলো চোখে। কলরব কুহুর অবস্হা দেখে তাড়াতাড়ি করে বলল,- বোকা মেয়ে কাঁদছো কেনো? আমি বলতে চেয়েছিলাম এগুলো আমার ফুলটুশীর জন্য।কলরবের কথা শুনে কুহুর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। তারপর নিজের মাথায় নিজে টুকা দিয়ে বলল,- পুরাই গাধী আমি।কলরব গগণবিহারী হাসি হেসে বলল,- তা ভুল বলোনি।কুহুও কলরবের সাথে তাল মিলিয়ে হাসলো। তারপর বলল,- আপনার চুড়ি পছন্দ?কলরব ডানে বায়ে মাথা নেড়ে বলল,- নাহ্ আমার লিপস্টিক পছন্দ।কুহু কলরবের দিকে রাগী লুক দিয়ে বলল,- আস্ত ফাজিল আপনি।- দেখলে তুমি কিন্তু অতোটাও বোকা না ফুলটুশী।কুহু ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,- ফাজিলদের ইনট্যানশন সব মেয়েরাই বুঝে।কলরব কান ধরে বলল,- সরি বাবা ঐটা মজা করে বলেছিলাম। আমার আসলে আয়না পছন্দ। দাঁড়াও তোমার জন্য একটা ছেট আয়না এনেছি।কলরব পকেটে থেকে একটা ছোট আয়না বের করলো। কাঠের ফ্রেমে বাঁধাই করা ছোট আয়না। - হাত বাড়াও।কুহু হাত বাড়িয়ে দিতেই কলরব কুহুর হাতে আয়নাটা রেখে বলল,- আয়নাটায় যখন তুমি নিজেকে দেখবে মনে করবে আমার চোখ দিয়ে দেখছো।কুহু মুচকি হেসে বলল,- আচ্ছা জনাব।- আরে তোমাকে তো আমাদের ছেলেমেয়েদের নামগুলোই বলা হয়নি।কুহু লজ্জা পেয়ে বলল,- প্লিজ চুপ করুন।কলরব হাত নেড়ে বলল,- আহা শুনোই না। আমাদের একটা ছেলে হবে। আর দুইটা মেয়ে হবে। মেয়েগুলো যমজ হলে ভালো হয়। না হলেও সমস্যা নেই। কুহু লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। দৌড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু চলে গেলে কলরবকে মন ভরে দেখা হবে না। তাই জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। চেহারায় ঈষৎ লালচে ভাব চলে এসেছে কুহুর। কলরব সেটা দেখে আরো মজা পাচ্ছে আর নিজের কথা চালিয়ে যাচ্ছে।- ফুলটুশী আমাদের ছেলেটার নাম হবে কুহুরব। কুহু আর কলরব মিলিয়ে। সুন্দর না? আর মেয়ে দুইটার নাম হবে কিচির আর মিচির।পছন্দ হয়েছে তো? পছন্দ না হলেও আমি এগুলো রাখবো। বহু কষ্ট করে এই নামগুলো খুঁজে বের করেছি। প্রথমে তো আয়না, দর্পণ,আরশি এসব আসছিল মনে। পরে ঐগুলো কেমন যেন পুরোনো পুরোনো মনে হচ্ছিলো তাই বাদ দিয়ে দিয়েছি। আসলে হয়েছে কি আমি না তোমার সাথে সাথে আয়না থুক্কু আয়না বললে আবার রেগে যাবে। আমি ড্রেসিংটেবিলের প্রেমে পড়েছি। তাই বলে কি ছেলেমেয়ের নাম ড্রেসিংটেবিল রাখবো নাকি?কুহু নীচের দিকে তাকিয়ে কলরবের কথাগুলো কোনোভাবে গিলছিল। কিন্তু কলরবের কথা যেন ফুরায় না। তাই বাধ্য হয়ে কথা ঘুরানোর জন্য বলল,- আপনার না সকাল সাতটায় আসার কথা ছিল?- আমি তো সেই ফজরের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে সোজা এখানে এসে পড়েছি। ও হ্যাঁ বাসায় গিয়েছিলাম এগুলো নিয়ে আসতে। তোমারো তো আরো পরে আসার কথা ছিল। এতো তাড়াতাড়ি যে?- চাঁদ দেখতে এসেছি।কুহু কথাটা বলেই হেসে দিল। কুহু হাসছে, শব্দ করে হাসছে আর কলরব মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে কুহুর দিকে। কলরব কুহুর হাসির শব্দের সাথে সাথে বলল,- ফুলটুশী সবসময় এমন হাসিখুশি থাকবে। তোমার হাসিতেই বোধহয় আমার বুকের পাঁজর হাসে। আর তোমার কান্নায় অন্তরাত্মা পর্যন্ত কাঁদে। কোনোদিন তোমার চোখের পানি দেখতে চাই না। তোমার কষ্ট আমার মোটেও সহ্য হয় না আর হবেও না। দেখো না তোমার জন্য কাঁচের চুড়ি আনিনি পাছে কোনোদিন হাত কেটে ফেলো। কুহু কলরবের শেষ কথাটা শুনে কেঁদে দিল। চোখে অশ্রধারা বইতে লাগলো তার। কিন্তু চেহারায় এক অনাবিল উচ্ছাস। কাঁদতে কাঁদতেই বলল,- এতো ভালোবাসেন আমায়?কলরব উত্তর দিলো না। শুধু তাকিয়ে রইলো কুহুর দিকে।...কুহু ছাদে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। কলরব বাইকে বসে কুহুর দিকে একবার তাকালো। তারপর হাত নেড়ে হেসে বলল,- আল্লাহ হাফেয ফুলটুশী!কুহুর গলা ধরে এলো। কাঁপা গলায় কলরবকে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে বলল,- খোদা হাফে৫৩:-কুহুকে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখে পিহু সবগুলো চুড়ি এনে কুহুর সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখলো। তারপর কুহুকে বলল,- কিরে মন খারাপ? তুই যে এতো প্রেম জানিস আমি ভাবতেও পারিনি। এই পঁচিশ দিনে তুই কলরব ভাইয়ের সাথে যে হারে প্রেম করেছিস মানুষ পাঁচ বছরেও বোধহয় এতো করে না। কুহু পিহুর কথা শুনে ম্লান হাসলো। পিহু কুহুর গালে আস্তে করে চড় কষিয়ে বলল,- এই বল তো আমি বড় না তুই বড়?কুহু ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,- আপ্পি তুমি বড়।পিহু কুহুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,- আমার ছোট বোনটা বলো তো আপ্পি তোমার থেকে কত বছরের বড়?কুহু নাক লাগিয়ে বলল,- সাত বছরের কিন্তু তাহলে আপি তোমার আগে আমার বিয়ে কেনো? তোমাকে কেউ বিয়ে করে না কেনো?এটুকু বলার পরই দুইবোন একসাথে হেসে ফেললো। কুহুর যখনই মন খারাপ হয় পিহু এমন করে। পিহুর ধারণা চুপচাপ বসে থাকা পিহুর কাজ। কুহু তো সবসময় কথা বলে যাবে।মাঝে মাঝে রেগে যাবে আবার রাগটাও এক নিমিষে ভুলে যাবে। পিহু মনে করতো কুহু পৃথিবীতে একটা কাজেই এসেছে, শুধু পিহুকে জ্বালাতন করার জন্য। এই কয়দিনে পিহু একটা জিনিশ খেয়াল করে দেখেছে কুহুকে জুড়েই পিহুর সব কথা বলা। কুহুর সাথে পিহু এক ঘণ্টায় যে কথা বলে পিহু তা সারাদিনেও কারো সাথে বলতে পারে না। পিহু পড়তে বসলে আগে যখন কুহু কথা বলতো পিহু বিরক্ত হতো। কিন্তু এই কয়দিনে কুহু একবারো পিহুকে বিরক্ত করেনি। আর সেটাই পিহু মিস করছে। সারাদিন কলরবকে নিয়েই পড়েছিল কুহু। রাতে তো পিহু,কুহু দুজনই পড়া নিয়ে থাকে।সকালে তো স্কুলে চলে যায় নতুন চাকুরী। দুপুরে বাসায় এসেও কলরবের সাথে কথায় লেগে যায়। ঐ সময়ে কলরবের লাঞ্চ টাইম তাই কুহু কথা বলায় ব্যস্ত থাকে। তিনটা, সাড়ে তিনটায় ইরিনকে পড়াতে যায়। এসে আবার একা একা ছাদে দাঁড়িয়ে থাকে তাও বাস্কেটবল হাতে। যেদিনগুলোতে কলরব বিকেলে ছাদে থাকে কুহু তখন আবার বাস্কেটবল নিয়ে যায় না। কুহুর ধারণা কলরব জানে না কলরবের বাস্কেটবলটা কুহুর কাছে কিন্তু পিহুর ধারণা কলরব অবশ্যই বুঝতে পেরেছে। কুহু সেটা কোনোভাবেই মানতে চায় না। কুহুর কথা হলো কলরব জানলে অবশ্যই তাকে জিজ্ঞাসা করতো। পিহু আর কথা বাড়ায় না। কুহুর হাতে বাস্কেটবল দেখে পিহুর সেই হাসি পায়। কুহু নেটে সার্চ দিয়ে বাস্কেটবল শিখার একটুখানি ট্রাই করেছিল কিন্তু কিছুই পারেনি। পিহুকে হাসতে দেখলে কুহু ভাব দেখিয়ে বলে,- এতো ঢং মারিস কেনো? আমাকে পারতে হবে না। কলরব বলেছে আমাকে শিখাবে। বিয়ের পর আমি মাস্ট বি বাস্কেটবল খেলা শিখবো। আই জাস্ট লাভ বাস্কেটবল। আর সে এও বলেছে..পিহু কুহুকে শুধরে দিয়ে বলে,- ইউ জাস্ট লাভ কলরব! আর কি বলেছে তোর কলরব?কুহু তখন লাজুকভাবে হেসে বলে,- কলরব বলেছে বাস্কেটবল টিম গঠন করবে।পিহু হাত নেড়ে বলে,- আমি বাবা তোর টিমে নেই। আমি খেললে কলরব ভাইয়ের টিমে খেলবো। তোর মতন ভেবলির টিমে খেললে হেরে যাওয়ার তকমা নিয়ে ঘুরতে হবে। তুই বরং তোর বকবকুনে ইরিনকে নিয়ে টিম গঠন করিস। আমি কলরব ভাইয়ের টিমে থাকবো। অবশ্য বাস্কেটবল তো আমিও খেলতে জানি না।কুহু মাথায় হাত দিয়ে পিহুর সব কথা শোনার পর বলে,- তোর শেষ হয়েছে?পিহু মাথা উপর নীচ করে বলে,- হয়েছে এবার আপনার পালা।- কলরব বলেছে আমাদের বাস্কেটবল টিম গঠন করবে। - তোদের মানে?- কলরব,আমি,কুহুরব আর কিচির - মিচির। পাঁচজনের বাস্কেটবল টিম..পিহু কুহুর কথা শেষ হতেই হাসতে হাসতে বলল,- কলরব ভাই তোর প্রেমে পড়ে পাগল হয়ে গেছে। এই ছেলে সাঁতার জানে তো? নয়তো ডুবে মরবে তো।কুহু পিহুর কথায় হাসলো। কুহুর হাসি দেখে পিহু বলল,- কিরে মন ভালো হয়েছে?- হুম।- তাহলে চল চুড়িগুলো তোকে পরিয়ে দেই।- তুই পরবি?- নাহ্ তুই পরর।- আরে ভাব ধরিস না। আমি আগে সবগুলো ট্রাই করবো এক এক করে তারপরই তোকে দিব।- ঢং।- ভাগ্যিস হাতের মাপ এক।আর তুইও তো কলরবের মৌটুশী!- হুম কলরব ভাইতো দুদিন আমার জন্য ফ্রেঞ্চ ফ্রাই পাঠালো। - তুই যে রাক্ষসী তোর এটিএম কার্ড বুঝতে পেরেছে।- যাক ভাইয়া ঢাকায় যাওয়ায় তুই যে হারে দুঃখ পেলি একটু হলেও কমলো। কি বলিস? - হুম কলরব ফুলটুশীর জন্য মৌটুশীকে রেখে গেছে তাহলে।- ভাইয়া আসলে কল দিয়েছিল। আমাকে বলল নিশ্চয় তোর মন খারাপ হবে তাই চুড়ির হাট নিয়ে বসতে।- সত্যি পাগল একটা।- আসলেই।- কিন্তু আমি একটা কথা ভাবছিলাম পিহুন।- কি?- কূজন এখনো এখানে কেনো? ওর নিশ্চয় এসব চোখে পড়ে। কূজনেরও তো কষ্ট হয়।পিহু বিরক্ত হয়ে বলল,- একদম ভালো মানুষী দেখাবি না। কূজনকে কি তুই কষ্ট দিচ্ছিস নাকি? এমন তো না যে তুই উনার সাথে প্রেম করে উনার ভাইকে বিয়ে করে ইচ্ছে করে উনাকে ছ্যাঁকাকুমার বানিয়েছিস। - তারপরো পিহু..- চুপ থাক! আমার তো মনে হয় এই ছেলে ভেজাল লাগাতে বসে আছে। নয়তো নিজের পছন্দের মেয়েকে অন্যের সাথে দেখতে কারোরই মন চায় না। তাহলে কূজন এখানে পড়ে আছে কেনো? ঘাপলা আছে।- ধুর কিসব বলিস তুই? কূজন খুবই ভালো একটা মানুষ।- তোর কাছে ভালো না কে বল তো?- হয়তো বিয়ে এটেন্ড করার পর যাবে।- এটাই মেইন সমস্যা গাধী। সে তো বিলেত থাকে না যে এটেন্ড করে পরে যাবে। বিয়ের আগ পর্যন্ত থাকছে দেখিস বড় ধরনের ঝামেলা লাগবে।- এই চুপ কর। আল্লাহ না করুন।- না করলেই ভালো।- দেখ কূজন মোটেও এমন না।- তোকে বুঝানো অসম্ভব আপুণি। বাদ দে এই কথা। চল বরং চুরিগুলে ট্রাই করি। কলরব ভাইয়ের চয়েজ অসাধারণ। তবে বুঝে পাই না উনি তোকে কীভাবে চুজ করলো? সিরিয়াসলি একটা গাধীকে...- ফাজিল তোর একদিন কি আমার একদিন। আমারো একদিন দিন আসবে বলে রাখলাম। তখন আমিও মজা নিব।- নিতে পারলি নিস।- দেখা যাবে।...ইরিনের পরীক্ষা শেষ তাই সে এখন বিন্দাস হয়ে ঘুরছে। সারাদিন কূজনের সাথে কথায় মেতে থাকে। কূজন চুপচাপ বসে থাকে। অর্ধেক শোনে অর্ধেক শোনে না। শুধু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আর হু হা করে। ইরিনের কথার যেন ইতি ঘটে না। একথা ওকথা বলেই চলে। ইরিন থাকলে তাও একটুখানি হাল্কা থাকে কূজন। ইরিন টিভি দেখতে বা বান্ধবীদের সাথে গেলে কূজনের আরো বেশি খারাপ লাগে। কেমন যেন মনে হয় সব খালি খালি। কুহুর কথা আরে বেশি মনে পড়ে তখন। দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না কূজনের। এখান থেকে চলে যাওয়াটাই ভালো ছিল। কিন্তু কূজন যায়নি। কূজনের ধারণা সে এখান থেকে চলে গেলেই বাবা কিছু একটা করবে। কুহু সেইফ তা কূজন জানে। কূজনের বাবা আর যাই করুক কুহুকে কিছু করবে না। কিন্তু কলরবকে হাতে পেলে ছাড়বেন না তিনি। এই মুহুর্তে কলরব আবার ঢাকা গেল। কূজনের তাই এখন টেনশন আরো বেড়ে গেছে। একবার ভাবলো সেও যেতে পারতো ঢাকা। কেনো গেল না কলরবের সাথে? কূজন কোনোভাবেই চায়না কলরবের কোনো ক্ষতি হোক। কিন্তু তার বাবার প্রতি তার বিশ্বাস নেই। বাবা এমন চুপচাপ বসে আছে কেনো? কূজনকে কিছুই বোঝাচ্ছে না এতেই কূজনের ভয়টা বেড়েছে। এভাবে ঝিম ধরে বসে থাকার মানে কি? কিছু বড় ধরনের ঘটনা ঘটাবে কি? কূজন আকাশ পাতাল ভাবছিল তখনি ইরিন এসে কূজনের পাশে বসে বলল,- ভাইয়া কি এতো ভাবো তুমি?- হুম কিছু বলেছো সোনার হরিণ?- বললাম কি এতো ভাবো?কূজন হেসে বলল,- কিছু না সোনার হরিণ।-কলরব ভাই ঠিকঠাক ভাবে পৌঁছেছে?- হুম মাত্র কথা হলো। তবে ভাইয়া অনেক টায়ার্ড। অনেক আগেই পৌঁছেছে তারপর সোজা অফিস করে এখন চাচার বাসায় যাচ্ছে।- ওহ জার্নি করেছে তাই টায়ার্ড হওয়াটাই স্বাভাবিক।ইরিন খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলল,- কিন্তু ভাবীর সাথে রাত জেগে কথা বলতে ভাইয়া আবার জীবনেও টায়ার্ড হয় না। তুমি তো ঘুমিয়ে থাকো। ভাইয়া গেস্টরুমে বসে বসে অর্ধেক রাত পর্যন্ত কথা বলতে থাকে। তুমি ভাইয়ার রুমে থাকো তাই হয়তো নিজের রুমে বসে কথা বলতে আনইজি ফিল করে। জানো একদিন কি হয়েছে? আমি পড়ছিলাম রাত জেগে। উচ্চতর গণিত পরীক্ষা ছিল আমার। পানির পিপাসায় পানি খেতে রুম থেকে বেরিয়েছিলাম। দেখি ভাইয়া ফোনে কথা বলছে আর কফি বানাচ্ছে। আমার যা মজা লেগেছিল বলার বাইরে। এক্সাম না থাকলে মাস্ট বি দাঁড়িয়ে শুনতাম। বাট আফসোস!ইরিনের কথা শোনে কূজনের বুক জোড়ে দীর্ঘশ্বাস খেলা করতে লাগলো। কিন্তু বের করতে পারলো না। ইরিন ভাবে কূজন ঘুমায়। কিন্তু কূজনও কলরবের মতোই রাত জাগে। ঘুম মোটেও আসে না তার। বরং চোখ বন্ধ করলে কুহুর চেহারা ভেসে উঠে। বউ সাজা কুহুকে কতোবার যে কূজন চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পেয়েছে তা অগণিত। শুধু শুধু চোখগুলো এতো বিট্রে করে কেনো ওর সাথে? কুহু তো ওর বউ হবে না তাহলে কেনো সে কুহুকে দেখে? কেনো সে বারবার কলরবের কুহুকে দেখে? কলরবও রাত জাগে কিন্তু কলরবের সাথে রাত জাগে কুহু। আর কূজনের সঙ্গে কেউ রাত জাগে না। কূজন যেন নিজেই রাতেদের সঙ্গে জেগে থাকে।চলবে...#একটুখানি--- লামইয়া চৌধুরী।পর্বঃ ৫৪কুহুর লাস্ট পিরিয়ডে কোনো ক্লাস ছিল না। তাই টিচার্স রুমে বসে সমরেশ মজুমদারের একটা বই পড়ছে। মন দিয়ে পড়ছে না কেমন যেন ভাসা ভাসা পড়ে যাচ্ছে। চোখ বুলানো যাকে বলে আরকি। বই পড়তে পড়তে অস্হির দৃষ্টিতে বারবার দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখছে কুহু। সময় পৌনে বারোটা। কলরব ফোন দিবে দুইটার দিকে। তাই কুহু আবার পড়ায় মনোযোগ দিল। উত্তরাধিকার পড়ছে সে। বইটা যখন প্রায় শেষের দিকে তখনই স্কুল ছুটির ঘণ্টা পড়লো। কুহু বইটা বন্ধ করে ভ্যানিটি ব্যাগে রেখে দিল। তারপর পা বাড়ালো স্কুল গেইটের দিকে। স্কুল ছুটি হয়েছে তাই বাচ্চাদের হুরোহুরি শুরু হয়েছে। অভিভাবকরাও স্কুল গেইট দিয়ে ভিতরে ঢুকছে। সবমিলিয়ে দারুণ রকমের জটলা বেঁধেছে। কুহু ভিড় ঢেলেই গেইট পর্যন্ত গিয়েছে। এর মাঝেই পিছন থেকে ডাক শুনে কুহু পিছনে তাকালো। কে ডেকেছে কুহু এতো ভিড়ের মাঝে বুঝতে পারলো না। তবে মেয়েলি কণ্ঠের ডাক শুনেছে। কুহু চোখ ঘুরিয়ে বারবার খুঁজছে তাকে কে ডেকেছে কিন্তু বুঝে উঠতে পারছে না। এর মাঝেই শাখা সিঁদুর পরিহিতা একজন মহিলা এসে কুহুর সামনে দাঁড়িয়ে বলল,- আরিজা মেডাম নমস্কার !কুহু হাসি মুখে বলল,- আপনি ডেকেছিলেন আপু?- জ্বি মেডাম আমি ডেকেছি।- ভালো আছেন আপনি?- জ্বি মেডাম ভালো। আপনার সঙ্গে এমনিতে একটুখানি পরিচিত হতে এলাম আরকি। কুহু হেসে বলল,- ওহ্ তা বাইরে যেয়ে কথা বলি? এখানে অনেক ধাক্কাধাক্কি তো তাই বলছিলাম আরকি।- জ্বি মেডাম চলুন বরং বাইরে দাঁড়িয়েই কথা বলি। ঐদিকটা কিছুটা নিরিবিলি।কুহু ভিড় ঢেলে স্কুলের বাইরে যেয়ে পুকুরের দিকটায় দাঁড়ালো। কুহু তখন খেয়াল করলো মহিলার শাড়ির আঁচল ঘেঁষে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কুহুকে নিজের দিকে তাকাতে দেখে মেয়েটা মায়ের পিছনে আড়াল হয়ে দাঁড়ালো। কুহু বাচ্চা মেয়েটার দিক থেকে চোখ সরিয়ে মেয়েটার মায়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর হেসে বলল,- জ্বি আপু কি বলতে চান বলুন।- মেডাম আমার মেয়ে দীপাবলি। আপনি ওর ক্লাস টিচার?- আপু দীপাবলি কি কেজিতে পড়ে? শাপলা শাখায়?- জ্বি মেডাম।- তাহলে আমিই দীপাবলির ক্লাস টিচার। কেনো আপু কোনো সমস্যা হয়েছে কি?দীপাবলির মা হেসে বলল,- নাহ্ মেডাম তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। তবে আপনার ছাত্রী নিজেই সমস্যাদের ভাণ্ডার। যাহ্ দুষ্ট বলার বাইরে। এই মেয়েকে কোনোভাবেই কন্ট্রোল করতে পারি না। একটা কথাও শুনে না আমার খুব জ্বালায়।কুহু হালকা হেসে বলল,- এই বয়সী বাচ্চারা একটু আধটু দুষ্টামি তো করবেই।দীপাবলির মা কুহুকে বাধা দিয়ে বলল,- আরে মেডাম চিনেননি এখনো। ভগবান ভাগ্যিস এই মেয়েকে ছেলে করে পাঠায়নি নয়তো আমার মাথা খেয়ে ফেলতো।দীপাবলির মায়ের কথা শোনে কুহু হাসতে লাগলো। প্রচণ্ড রকমের হাসি হেসে কুহু বলল,- আপু আপনার কথায় হাসতে হাসতে আমার পেট ব্যাথা হয়ে যাচ্ছে। আর এই যে মিস দীপাবলি তুমি এতো দুষ্টামি করো কেনো? দীপাবলি কুহুর কথা শুনে মায়ের পিছনে দাঁড়িয়ে পুরোপুরি আড়াল হয়ে গেল। দীপাবলির মা দীপাবলির হাত ধরে টেনে কুহুর সামনাসামনি দাঁড় করিয়ে বলল,- মেডাম আপনার ছাত্রী নাকি পরপর তিনদিন হোমওয়ার্ক করেনি তাই আপনি বকা দিয়েছিলেন। এরপর থেকে এখন সবসময় আমাকে বলতেও হয় না নিজেই বসে আপনার হোম ওয়ার্ক সেড়ে ফেলে। শুধু আপনার সাবজেক্টটাই করে কিন্তু বাকিগুলো একটাও করতে চায় না। তাই আপনি একটুখানি বকা দিয়ে দিন তো।কুহু আবার হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতে দীপাবলির গাল টেনে বলল,- তুমি কি জানো মেডামের তোমার নামটা যে অনেক পছন্দ হয়েছে?দীপাবলি কিছু বলল না লাজুকভাবে হাসলো। কিন্তু চোখে মুখে ঠিকই ভয় কাজ করছে ওর। কুহু দীপাবলিকে এতো ভয় পেতে দেখে অট্টহাসিতে ভেঙে পড়লো আর বলতে লাগলো,- শুনো দীপাবলি! তোমার নামটা যেমন আমার পছন্দের তুমি কি চাওনা তুমিও ঠিক আমার কাছে এমনি পছন্দের হও? দীপাবলির মা কুহুকে থামিয়ে বলল,- আরিজা মেডাম এই মেয়েকে এতো সোহাগ দিবেন না। পরে আপনার মাথায় চড়ে বসবে। আগে যেমন ধমক দিয়েছিলেন এমনি দিবেন।কুহু হাসতে হাসতে বলল,- আরে আপু কি যে বলেন না....কুহু হেসে কথা বলতে বলতে হঠাৎ কুহুর চোখ যায় বাচ্চাদের ভীড়ের মাঝে এক সাইড হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কূজনের দিকে। সাথে সাথে কুহুর ঠোঁটের হাসি বিলীন হয়ে গেল। কুহু তাড়াতাড়ি সেখান থেকে চোখ ফিরিয়ে দীপাবলির মায়ের সাথে কথা বলায় লেগে গেল। কুহু কোনোভাবেই চায় না কুহুর আবার যেখানে সেখানে কূজনকে দেখার অভ্যাসটা দেখা দিক। বেশ তো ছিল এই কয়দিন। একবারো কূজনকে কল্পনা করেনি সে। তাহলে আবার কেনো শুরু হলো এসব? তীব্র অস্বস্তিতে কুহু তাড়াতাড়ি দীপাবলির মায়ের সঙ্গে কথা বলা শেষ করলো। তারপর পা বাড়ালো সামনের দিকে। অন্যদিন স্কুল গেইটের সামনে থেকেই রিকশা নেয় কিন্তু আজ দ্রুত গতিতে হাঁটা শুরু করলো। এখানে দাঁড়িয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করতে গেলে বারবার কূজনকে দেখতে হবে। কথাটা ভাবতেই কুহু ঘামতে শুরু করলো। যদিও গরম নেই আর শীতটাও তেমনভাবে পড়েনি। রাত হলে হালকা চাদর জড়ালেই চলে। খুব আরামের একটা আমেজ পাওয়া যায়। আর দুপুরেও না গরম থাকে না শীত থাকে। কিন্তু এই অবস্হায়ও কুহু ঘামতে লাগলো। কুহু কলরবকে ছেড়ে আবার কূজন নিয়ে মেতে উঠছে ভাবতেই কুহুর শরীরের সবগুলো লোম খাঁড়া হয়ে গেল। কুহু ঝড়ের গতিতে হেঁটে চলছে। খুব দ্রুত পা ফেলছে সে। পালাতে চাইছে এখানে থেকে। হঠাৎ কুহু শুনতে পেল,- কুহু শুনছেন? আপনার সঙ্গে কথা ছিল। একটুখানি শুনবেন কি?কুহু আরো দ্রুত পা চালাতে আরম্ভ করলো।কোনোভাবেই সে কূজন নামক মায়াজালে নিজেকে আটকা পড়তে দিবে না। কুহুর দ্রুত চলা দেখে কূজনও পিছন থেকে দ্রুত পা চালালো। সে কিছুটা দৌড়ে এসে কুহুর পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো আর আকুতির স্বরে বলল,- কুহু প্লিজ একবার শুনবেন কি? কুহু অবাক হয়ে পাশে তাকাতেই দেখে কূজন কাতর চোখে কুহুর দিকে তাকিয়ে আছে। কুহুর এবার সত্যি মনে হচ্ছে কূজন কল্পনা নয় হয়তোবা সে সত্যি কিছু বলতে চাচ্ছে। কিন্তু কি বলবে সে? আর কি এমন কথা যে এখানে এসে পড়েছে সে? কুহু শিউর হওয়ার জন্য নিজের হাতে চিমটি কাটলো। কুহু বুঝলো সে স্বপ্ন দেখছে না কিন্তু কূজনকে তো সে আগে জেগে জেগে প্রায় দেখতো। তাই আবার হাঁটা শুরু করলো কুহু। কুহুর সাথে সাথে কূজনও হাঁটতে লাগলো। আবারো আকুল হয়ে বলল,- কুহু প্লিজ একটাবার তো আমাকে কথা বলার সুযোগ দিন। প্লিজ! কুহু প্লিজ!কুহু কিছু বলল না তাকালোও না কূজনের দিকে।কূজন অস্হির হয়ে বলল,- প্লিজ কুহু একটাবার আমাকে বলতে সুযোগ দিন। প্লিজ কুহু আর্নেস্ট রিকুয়েস্ট, কুহু প্লিজ।কুহু বিরক্ত হয়ে কূজনের দিকে তাকিয়ে বলল,- কথা বলতে চান আমার সঙ্গে?- জ্বি প্লিজ একটু বুঝার চেষ্টা করুন..কুহু কূজনকে থামিয়ে বলল,- তাহলে ঐখানে বেলুন বিক্রি করছে। আপনি দুইটা বেলুন কিনে এনে যেকোনো দুইটা বাচ্চাকে দিন।কুহুর কথা শেষ করতে দেরি হয়নি তার আগেই কূজন দৌড়ে চলে গেল বেলুন কিনতে। সবগুলো বেলুন একসাথে কিনে নিল সে তারপর সবগুলো একটা বাচ্চা মেয়ের হাতে দিয়ে বলল,- তুমি দুইটা রেখে বাকিগুলো তোমার বন্ধুদের দিয়ে দাও মামণি।এরপর কূজন কুহুর দিকে পা বাড়ায়। কি মনে করে যেন পিছন ফিরে তাকিয়ে মেয়েটাকে বলে,- আমি যদি তোমার বন্ধু হই তাহলে তুমি কি আমাকে একটা বেলুন দিবে?মেয়েটা কূজনের কথায় হা হয়ে রইলো কিন্তু হাত বাড়িয়ে ঠিকই একটা বেলুন দিলো। কূজন সেটা নিল না। কূজন মেয়েটার হাত থেকে অন্য একটা নীল রঙের হার্ট শেইপ বেলুন নিলো তারপর হেসে বলল,- থেঙ্ক ইউ বন্ধু!- থেঙ্ক ইউ সুইট ভাইয়া।কূজন মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কুহুর কাছে চলে এলো। কুহুর দিকে বেলুনটা এগিয়ে দিয়ে বলল,- কুহু আমি আপনাকে ভালোবাসি।কুহু কূজনের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে রইলো। তারপর রাগে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বেলুন হাতে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছোট ছেলের কাছে যেয়ে বলল,- তোমাকে বেলুনটা কে কিনে দিয়েছে?ছেলেটা হাত দিয়ে কূজনকে দেখিয়ে বলল,- চশমা পড়া ভাইয়া কিনে দিয়েছে।কুহুর এবার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে এলো। কি হচ্ছে কি এসব? প্রথমে শিউর হওয়ার জন্য কূজনকে বেলুন কিনে বাচ্চাদের দিতে বলল যাতে করে কুহু বুঝতে পারে কূজন বাস্তবেই ওর সাথে কথা বলতে চাইছে নাকি এটা শুধুমাত্র কল্পনা। যখন দেখলো কূজন সত্যি সত্যি বেলুন কিনে বাচ্চাদের দিল তখন শিউর হয়েছিল যে কূজন সত্যি এখানে এসেছে। কিন্তু ভালোবাসার কথা বলায় কুহু নিজের উপর বেশ রেগে গিয়েছিল কারণ ভেবেছিল কূজন সত্যি সত্যি তো আর ভাইয়ের হবু বউকে ভালোবাসি বলবে না। চলবে...পর্বঃ৫৫কুহুর হাত পা জমে ঠাণ্ডা হয়ে গেল। ভ্রু কুঁচকে চোখ ছোট ছোট করে কূজনের দিকে তাকিয়ে আছে সে। অপরদিকে কূজন কুহুকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে একনাগাড়ে দেখে যাচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্যও চোখ সরাচ্ছে না সে।কূজনের তাকানো দেখে মনে হচ্ছে জীবনেও সে কোনো মেয়েকে দেখেনি। শুধু মেয়ে কেনো আদৌ সে কোনো মানুষ দেখেছি কিনা সন্দেহ আছে। নয়তো সে কোনো আফসারা দেখছে, হুরপরী জাতীয় কিছু। কূজনের এমন করে তাকানো দেখে কুহুর খুব বেশি রাগ উঠছে কিন্তু প্রকাশ করতে পারছে না। মুঠোবন্দি করে রাগ কমানোর চেষ্টা করছে। এখন যদি কুহু রাগটা দেখাতে না পারে তাহলে সে নিশ্চিত কেঁদে দিবে। কুহু এখন মোটেও রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে চাচ্ছে না। এসব কাজ করে ঢঙ্গী মেয়েরা যারা এটেনশন সিকার। কুহু মোটেও সেরকম নয়। আর রাগটাও প্রকাশ করতে পারছে না কুহু। কূজন যেভাবে কিউট মার্কা হাসি দিয়ে রেখেছে ফেরেশতা ফেরেশতা মনে হচ্ছে কুহুর কাছে। কূজনকে নিজের কাছে এতোটা ভালো মানুষ মনে হওয়াতে কুহু মনে মনে নিজেকে হাজারটা গালি দিল। আশ্চর্য কূজনের মতন এমন একটা নম্র ভদ্র ছেলে এমন কথা বলতে পারে কুহু ভাবতে পারছে না। আসলেই কি কূজন এগুলো বলেছে? কুহুর এখনো নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না। যদি বলে থাকে তাহলে কুহু শিউর কূজন মেন্টালি সিক।কি বলল এসব? কুহুর কথাগুলো মনে হতেই কান ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগলো। "কুহু কি হয়েছে না করেছেন? প্রপোজ করলে এমন হাজারবার রিজেক্ট হতেই হয়। তারপরো আমি আপনাকে ভালোবাসি আর আপনাকে নিজের করে পেতে চাই। বিয়ে ঠিক হয়েছে নো প্রবলেম। বিয়ে তো আর হয়নি। আপনি যদি বিবাহিত হতেন, বাচ্চার মা হতেন তাহলেও আমি আপনাকে ভালোবেসে পেতে চাইতাম। আর ভাইয়ের ফিওন্সে তাতে আমার কিছুই যায় আসে না।এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার। আমি ভাইয়ের কথা, পরিবারের কথা অনেক বেশি চিন্তা করে দেখেছি। এই বিশ পঁচিশ দিন নিজের মনের সঙ্গে, নিজের ভাঙা হৃদয় নিয়ে তুমুল ঝড়ঝাপটা পার করেছি আমি। কিন্তু আপনার ভালোবাসার কাছে এসব কিছুই না। ইনহিউমেন যাকে বলে আমি ঠিক ততোটাই চেষ্টা করেছি আপনাকে ভুলার কিন্তু পারিনি। রাতের পর রাত জেগেছি আপনাকে ভেবে। নিজেকে কিরকম অনল দহনে পুড়েছি তা আমার আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। যতবার আপনাকে আর কলরব ভাইকে একসাথে দেখেছি নিজেকে শেষ করে দিতে মন চেয়েছে কিন্তু তারপরো সবার কথা ভেবে নিজেকে সামলে নিয়েছি। আপনি বলতে পারেন তাহলে এতোদিন কেনো চুপ করে ছিলাম? আমি বলব তিন চারদিন হয়েছে কলরব ভাই ঢাকা গিয়েছে। তাই এখন আর আপনাদের একসাথে দেখতে হচ্ছে না। কি যে শান্তি লাগছে বলে বুঝানোর নয়। আমি এতেই বুঝেছি কুহু যে স্যাক্রিফাইস করা আর করবো ভাবা এক নয়। আমি আপনাকে হারাতে পারবো না। পৃথিবী উল্টে যাক আমি শুধু আপনার হাত ধরতে চাই আর কিছু চাই না। "কুহু মনে মনে কথাগুলো পুনরায় আওড়িয়ে নিল। তারপর কাঁপা স্বরে বলল,- প্লিজ আপনি বুঝার চেষ্টা করুন। আমি কলরবকেই বিয়ে করতে চাই। কূজন নাছোড়বান্দার মতো বলল,- কিন্তু আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই কুহু। ট্রাস্ট মি আমাকে একটুও ভালোবাসতে হবে না আপনার। শুধু পাশে থাকলেই চলবে। আমার একার ভালেবাসাই আমাদের জন্য যথেষ্ট।কুহু কূজনের কথা শেষ হবার আগেই হাঁটতে লাগলো। কূজন কুহুর সাথে চলতে চলতে বলল,- কুহু আমাকে শুধু একটুখানি সুযোগ দিন আমি একদম আপনার মনের মতন হয়ে যাব। আপনি যেমন চাইবেন ঠিক তেমন হয়ে যাব। কলরব ভাইয়ের কার্বনকপি হয়ে আপনার সামনে দাঁড়াবো আমি।কূজনের এমন অস্বাভাবিক কথা শোনে কুহুর এবার প্রচন্ড মায়া হলো। কুহু থমকে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বলল,- দেখুন কূজন আপনাকে আমার জন্য নিজেকে বদলাতে হবে না। আপনি যেমন আছেন ঠিক তেমনি থাকুন। কলরব একটুও আমার মনের মতন না। কিন্তু ভালোবাসি কলরবকে, সে আমার হবু বর কূজন। ভালোবাসা জিনিসটা মনের মতন কিনা সেসব বিবেচনা করে হয় না। শুধু হয়ে যায়। কূজন নিরাশ হয়ে বলল,- আমাকে ভালোবাসতে হবে না আপনার শুধু...কুহু এবার রাগে চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো। কূজনের এমন আচরণে কূজনকে বাকি কথাটুকুর বলার সুযোগ দিল না কুহু। খালি রিকশা পেয়ে উঠে পড়লো সে। কূজনের জায়গায় এখানে কলরব হলে কুহু হয়তো চড় পর্যন্ত দিয়ে দিত কিন্তু কূজন দেখে কোনোরকম পাশ কাটিয়ে চলে এসেছে সে। কুহুর রিকশার সাথে সাথে কূজনও কিছুদূর হেঁটে চলল তারপর গতি বাড়ায় রিকশার সাথে আর তাল মিলাতে পারলো না, পিছনে পড়ে গেল কূজন। ...পিহু গোসল সেড়ে টাওয়াল দিয়ে চুল বেঁধে বের হতেই দেখলো কুহু গ্লাসে পানি ঢালছে। কুহুর হাত ভীষণভাবে কাঁপছে। জগের পানি গ্লাসে কিছু পড়ছে বাকিগুলো ফ্লোরে পড়ে ফ্লোর পানিতে একাকার হয়ে যাচ্ছে। পিহু এগিয়ে এসে কুহুর হাত থেকে জগ আর গ্লাসটা নিয়ে গ্লাসে পানি ঢাললো। তারপর কুহুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,- নে!কুহু একটানে সবটুকু পানি শেষ করে বিছানায় ধপ করে বসে পড়লো। পিহু চিন্তিত সুরে বলল,- আবার কি হয়েছে?কুহুর ঠোঁট কাঁপছে কোনোভাবেই কিছু বলতে পারছে না। চুপচাপ হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বসে আছে সে। পিহু জবাব না পেয়ে কুহুকে বলল,- কি হলো এমন করছিস কেনো?কুহু হাতের ইশারায় পিহুকে কাছে ডাকলো। পিহু এগিয়ে এসে বোনের পাশে বসে বলল,- বল কি হয়েছে?কুহু কাঁপা স্বরে বলল,- কূজন আমার পিছু নিয়েছে।পিহু চোখ বড় বড় করে বলল,- তারপর?কুহু স্কার্ফের পিন খুলতে খুলতে বলল,- আমাকে ভালোবাসে বলল। আমাকে নাকি বিয়ে করতে চায়। এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ বলল। আরো কিসব হাবিজাবি.. মনে হয় কূজন পাগল হয়ে গিয়েছে। অপ্রকৃতস্হের মতন বারবার উল্টাপাল্টা কথা বলেছে সে।পিহু কুহুর কথা শোনে হা হয়ে রইলো। পিহুর বড় বড় চোখগুলো যেন কোটর ছেড়ে বের হয়ে আসছে। পিহু ঢোক গিলে বলল,- বিশ্বাস কর আপুণি আমি চিঠিটা দিয়েছি। আমাকে আবার শুধু শুধু বকাঝকা করিস না।কুহু পিহুকে আশ্বস্ত করে বলল,- ধুর! তোকে বকবো কেনো? তুই যে চিঠি দিয়েছিস কূজনও বলেছে। পিহু নিজের দুইগালে হাত রেখে বলল,- তাহলে?কুহু বিরক্তির শব্দ করে বলল,- কূজন বলল এই চিঠি কেনো আমি যদি মুখে মুখেও হাজারবার ওকে না বলি তবুও সে আমার পিছু ছাড়বে না।পিহু মাথায় হাত দিয়ে বলল,- দেখেছিস আমি বলেছিলাম না অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ। এখন দেখ তোর ভালো মানুষটা কেমন গিরগিটি। যেই কলরব ভাই চলে গেল তোর পিছে লাগলো। কলরব ভাই ছিল বলে সাহস করে উঠতে পারেনি। যেই কলরব ভাই.. কুহু পিহুকে থামিয়ে বলল,- হয়তো তুই ঠিক তবুও..পিহু চোখে মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,- তবুও কি?কুহু একটুখানি ভেবে বলল,- আমার মনে হয় কূজনের অন্য কোনো সমস্যা আছে। তুই যদি দেখতিস কি নাছোড়বান্দার মতন আমার পিছে পড়ে ছিল সে। যতবার বলি কলরবকে ভালোবাসি, কলরবকে বিয়ে করতে চাই, আমি এঙ্গগেজড্ সে ততেবারি কিসব প্রলাপ বকেছে। পিহু কুহুর দিকে হতাশ হয়ে তাকালো। তারপর নিজের কপালে নিজে চাপড় দিতে দিতে বলল,- আল্লাহ তুমি কি এই গাধীটাকে একটুখানি বুদ্ধিও দাওনি? আর মিস কুহু আপনি কই ছিলেন যখন আল্লাহ বুদ্ধি বেটেছিলেন? ঘুমিয়ে ছিলেন নাকি? আর আপনার মধ্যে এতো ভালোমানুষী আসে কোথা থেকে? এগুলো তো ভালোমানুষী না। এসব হলো নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা। আমার কথা শোন এখনি কলরব ভাইকে ফোন দিয়ে সবটুকু জানা। পরে কি হবে না হবে তা দেখা যাবে।কুহু আৎকে উঠে বলল,- কি বলিস কি পিহুন? আমি কি ওদের দুই ভাইয়ের মাঝে ঝগড়া লাগাবো নাকি? আমি কখনোই এসব...পিহু কুহুর কথা শেষ হওয়ার আগেই বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,- তোর মতন উঁজবুক নিয়ে মহাবিপদ। তুই মর! আল্লাহ রওয়াস্তে মর!কুহু পিহুর কথা শোনে হা হয়ে রইলো আর পিহু হনহন করতে করতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো।চলবে...পর্বঃ৫৬কলরব কুহুদের বাসার ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। কুহুর আসার কথা এখনো আসেনি। কলরব কেমন উশখুশ করছে। বারবার সিঁড়িঘরে উঁকি দিচ্ছে কিন্তু কুহুর দেখা মিলছে না। কলরব ফোন দেওয়ার জন্য পকেট থেকে মোবাইল বের করলো কিন্তু মোবাইল বন্ধ হয়ে আছে, চার্জ একদমই নেই। কলরব তাই বাসায় যাওয়ার জন্য রেলিং পার করে নিজেদের ছাদে ফিরে এলো। তাড়াতাড়ি মোবাইলে চার্জ দিতে হবে। কুহুকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে সে। কুহুকে এতোদিন পর দেখতে পাবে মনে হতেই কলরবের চেহারা খুশিতে ঝলমল করতে লাগলো। কলরব আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকালো। বাঁকা একটা চাঁদ পুরো আকাশ জুরে খিলখিল করে হাসছে। কলরবের মনে হলো এটা যেন কুহুর ঠোঁটের হাসি। আর আকাশটা হলো কলরবের মন। কুহু যেখানে বিজয়িনীর মতন চড়ে বেড়ায়। কুহুর কথা ভাবতে ভাবতেই কলরব একবার কুহুদের ছাদে তাকালো। কলরবের মনে হলো হয়তো কুহু এসেছে। কলরবের মন বলছে কুহু আসবে। কলরব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কুহুকে খুঁজতে লাগলো। কলরবের কেনো যেন মনে হচ্ছে কুহু আছে। আশেপাশেই কোথাও অন্ধকারে মিশে আছে। কিন্তু চারিদিকে তো চাঁদের আলো আছেই। কলরব আনমনে হাসলো। কুহুর সামনে এই চাঁদের আলো ম্লান। কলরব আবার প্যাণ্টের পকেট হাঁতড়াতে লাগলো। পকেটে টর্চ লাইট পেয়েও গেল সে। কলরব টর্চ জ্বেলে ছাদের দিকে তাক করে ধরলো। আলো ফেলতেই কুহু সাথে সাথে হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেললো আর কলরব বিবশ হয়ে কুহুর দিকে তাকিয়ে রইলো। চোখ ফিরাতে পারছে না সে। নিঃশ্বাসের কলরবগুলোও যেন কুহুর মাদকতায় স্পন্দন পাচ্ছে। কলরব শ্বাসরুদ্ধকর অবস্হায় কুহুর দিকে তাকিয়ে আছে। কলরব তাড়াতাড়ি করে টর্চ সরালো। কুহুও এবার চেহারার সামনে থেকে হাত সরালো। কলরবের কাছে চাঁদের আলোয় কুহুকে আরো বেশি মোহনীয় লাগছে। সাদা সিল্কের শাড়ি, হাত ভর্তি লাল চুড়ি আর কোমড়ের নীচ পর্যন্ত প্রায় হাঁটু ছুঁই ছুঁই খোলা চুল। সাথে কলরবের মায়ের দেয়া টিকলিটাও পড়েছে কুহু। অসহ্যরকমের সুন্দর লাগছে কুহুকে। বাতাসে চুলগুলো উড়ে এসে চোখে মুখে পড়ছে কুহুর। কলরব একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কুহুর দিকে।তার ইচ্ছে হচ্ছে হাত দিয়ে কুহুর চুলগুলো সরিয়ে দিতে।উত্তেরজনায় কলরবের চেহারায় ইষৎ লাল আভা ফুটে উঠেছে। সব আবেগ যেন গলায় এসে আটকে আছে কলরবের। কিছু একটা বলতে চাইছে কুহুকে কিন্তু কুহুর চোখ ধাঁধানো রূপে কলরব বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। কলরব মোহগ্রস্তের মতন কুহুর দিকে চেয়ে আছে। কুহু কলরবের অবস্হা দেখে উচ্চস্বরে হেসে বলল,- আমাকে কি পরী মনে হচ্ছে নাকি? এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো?কলরব কুহুর কথার সাথে তাল মিলিয়ে মাথা ঝাঁকালো তারপর কাঁপা স্বরে বলল,- তাই তো পরী মনে হচ্ছে একদম।কুহু খিলখিল করে হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতেই হেঁটে চলল। কলরবের কোনো হুঁশ জ্ঞান নেই। সে যেন একটা বিবশ মন নিয়ে দেহের সঙ্গে পেরে উঠছে না। কুহু ঘাড় ঘুরিয়ে কলরবের উদ্দেশ্যে বলল,- পরীকে একবার ছুঁয়ে দেখবেন না? পরী কিন্তু উড়াল দিবে।কলরব ফিসফিসিয়ে বলল,- "মন ছুঁয়েছি কোটি বার,প্রতিচ্ছবি একবারচোখের ছোঁয়া বারংবারতুমি যে শুধুই আমার"কুহু মুচকি হেসে বলল,- আপনি কবি হলেন কবে?কলরব বুঝলো না কুহু কীভাবে শুনে ফেললো। তার যতদূর মনে পরে সে তো ফিসফিসিয়ে বলেছিল কথাটা। তাহলে কুহু শুনলো কি করে?? ঐশী শক্তি?হয়তো ভালোবাসার ক্ষমতা।নাকি কলরবের হৃদস্পন্দন এতোটাই বেড়ে গেছে যে আশেপাশের সবকিছু সে নিঃশব্দের তালিকায় ফেলছে? কলরব ভেবে পেল না। কলরব আর ভাবলোও না শুধু বলল,- যবে থেকে তোমাকে ভালোবেসেছি।কুহু কলরবের কথায় এবার আর হাসলো না বরং শান্ত স্বরে বলল,- তোমাকে অনেক ভালোবাসি কলরব। অনেক বেশি! তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না, মরে যাব। তোমাকে ভালোবেসে মরে যাবে তোমার কুহু। তারপরো কুহু শুধু কলরবের হয়েই থাকবে। কুহুরবকে কেউ আলাদা করতে পারবে না কেউ না।কলরব অবাক হয়ে কুহুর কথা শুনছে। কলরব এতোটাই অবাক হয়েছে যে কুহু যে এক নিমিষেই দৌড়ে ছাদের পিছন দিকটায় চলে গেছে সেটা কলরব বুঝতেই পারেনি। যখনই হুঁশ ফিরলো কলরবও রেলিং টপকে এসে কুহুর পিছনে দৌড়ে এলো।সিঁড়িঘর পেরিয়ে পিছন দিকটায় আসতেই দেখলো কুহু রেলিং এর উপর উঠে দাঁড়িয়ে আছে। কলরব আতঙ্কে গলা দিয়ে কোনো কথা বের করতে পারছে না। মনে প্রাণে চেষ্টা করছে কুহুকে থামতে বলতে কিন্তু কিছুতেই শব্দরা প্রাণ ফিরে পাচ্ছে না। কলরব হাজার চেষ্টায়ও যখন কিছু বলতে পারলো না সে কুহুর হাত আকঁড়ে ধরলো। এতোটাই জোরে আঁকড়ে ধরলো যে কুহুর হাতের চুড়িগুলো বাঁকা হয়ে কুহুর হাতের সাথে সেঁটে গেল আর ব্যাথায় কুঁকড়ে কুহু আস্তে করে বলল,- উফ্! তোমার দেয়া ক্ষতকেও ভালোবাসি কলরব। ভালো থেকো কলরব,মাঝে মাঝে চাঁদের দিকে চেয়ে আমার জন্য দূর থেকে দু ফোঁটা চোখের জল ফেলো। আমি বহুদূর থেকেও আমার ভালোবাসার জানান দিব তোমায়।কুহু এতটুকু বলেই কলরবের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল। কলরব কুহুর সাথে পেরে উঠলো না। কুহুর মাঝে আজ অজানা এক দিব্যশক্তি কাজ করছে। সেই শক্তির সাথে কলরব হেরে গেছে। কলরবের সামনেই কুহু ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়লো। কাঁচা রাস্তায় সারি সারি গাছের মাঝে কুহুর নিথর দেহ পরে রইলো। কলরব চিৎকার করতে চাইছে কিন্তু তাও পারছে না। হাত পা অচল হয়ে আসছে ওর। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। পুরোপুরি অচল হওয়ার আগেই কলরব কুহুদের সিঁড়িঘর দিয়ে দৌড়ে নামলো। তারপর মেইন গেইট খুলে বাড়ির পিছন দিকের গলির দিকে দৌড় দিলো। কলরব শ্বাস ফেলতে পারছে না, দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর, চোখ উপচে বেদনা পড়ছে। কলরব তারপরো পা চালিয়ে যাচ্ছে। এটুকু রাস্তা আজ বহুদূর মনে হচ্ছে। দূর থেকেই কলরব দেখলো কুহু রাস্তায় পরে আছে, সাদা শাড়ির আঁচল রক্তে মাখামাখি। কলরব রক্ত দেখে আৎকে উঠলো। কুহু বলে চিৎকার করে উঠলো। কুহুর কাছে যেয়েই রাস্তায় বসে পড়লে সে। পাশে তাকিয়ে দেখলো কূজন ভাবলেশহীনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন একটা ডামি। কলরব কূজন থেকে চোখ সরিয়ে কুহুর রক্তে মাখামাখি দেহের দিকে তাকালো। কুহুর দিকে এগিয়ে এসে কুহুর গাল ছুঁয়ে উদভ্রান্তের মতো বলতে লাগলো,- কুহু! তোমার কিছু হয়নি। উঠো তো। এই বোকা মেয়ে তাকাও না একবার। আমাকে এতো কষ্ট দিচ্ছো কেনো? আমি কি করেছি কুহু? কি এমন ভুল করেছি?কলরব কুহুর মাথা তুলে বুকের সঙ্গে চেপে ধরলো। আষ্টেপৃষ্ঠে কুহুকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। আর বিরতিহীনভাবে বলতে লাগলো,- ফুলটুশী তুমি এমন কেনো করলে? তুমি আমাকে কষ্ট দিয়ে খুব বেশি মজা পাও তাই না? আর কতো কষ্ট দিবে আমায়? তোমার কিছু হবে না কুহু, কিছু হবে না। কিছু হবে না শুনতে পাচ্ছো না বোকা? একবার চোখ মেলে তাকাতে পারো না? কুহু! এই কুহু!কলরব ঘামতে লাগলো, প্রচণ্ডরকমের ঘামা ঘামলো সে। হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে এলো তার। শরীরের সবকটা পশম কাঁটা দিয়ে উঠলো। চোখ খুলে নিজেকে আবিষ্কার করলো বিছানায়। চারপাশে তাকিয়ে চোখ বুলাতেই বুঝলো সে এখন চাচার বাসায়। কলরব চট করে বিছানা ছেড়ে দাঁড়ালো তারপর মোবাইল কোথায় রেখেছে খুঁজতে লাগলো। পুরো ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজে শেষে মোবাইল পেল বালিশের নিচে। মোবাইল হাতে নিতেই দেখলো বেটারি ডাউন। কলরবের রিতীমতো হাত পা কাঁপতে শুরু করলো। সারা শরীর জুরে একটা ঠাণ্ডা হাওয়া বয়ে গেল। পাসওয়ার্ড দিয়ে মোবাইল ওপেন করার সাথে সাথেই মোবাইল বন্ধ হয়ে গেল। কলরব দৌড়ে ব্যাগ থেকে চার্জার বের করে মোবাইল চার্জে দিয়ে কুহুর নাম্বারে ডায়াল করলো। একবার,দুবার,তিনবারের মাথায় কুহু ওপাশ থেকে বলল,- ঘুমোচ্ছি কলরব! পরে ফোন করুন প্লিজ। প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা আমার।কুহুর কণ্ঠ শোনেই কলরব হাপ ছেড়ে বাঁচলো। শান্তির এক নিঃশ্বাস ফেলে কুহুকে বলল,- এখন ঘুমাও ফুলটুশী আমি রাখছি, পরে কথা বলবো।- আচ্ছা ফোন রাখলাম।কুহুর সাথে কথা শেষ হতেই কলরব বিছানায় বসলো। তারপর শরীর এলিয়ে দিলো বিছানায়। চলবে.....(৫৭)কুহুর আজ ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেল। গতকাল দুপুর থেকেই প্রচন্ড রকমের মাথা ব্যাথা ছিল তাই সারা দুপুর ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে আবার একচোট ঘুমিয়েছে সে। সন্ধ্যার পর যাও একটু পড়তে বসেছিল কূজনের বলা কথাগুলো মনে হতেই নিমিষেই মন বিষিয়ে উঠেছিল। তাই মন ভালো করার জন্য ছাদে গিয়েছিল।পিহুকেও বলেছিল সাথে যেতে, পিহুর পড়া আছে তাই যায়নি। ভেবেছিল পিহু সাথে থাকলে কিছু গল্পগুজব করবে। একা একা ছাদে যেতে গতকাল কেনো যেন একটুও ভালো লাগছিল না কুহুর কিন্তু ঘরে থাকতেও ইচ্ছে করছিল না। পিহুর না শোনে নিরুপায় হয়ে একাই ছাদে গেল সে। ছাদে পা রাখতেই মন আরো খারাপ হয়ে গেল। কলরবকে দেখার ইচ্ছাটা কুহুর মনে তীব্র আকার ধারণ করলো। কুহুর হঠাৎ মনে হলো ভিডিও কল দিলেই তো হয়। কুহু নিজেই নিজের সাথে বলল,- ফুলটুশী মেডাম আপনি তো দেখি দিন দিন বুদ্ধিমতী হয়ে যাচ্ছেন। বাহ্ সব আপনার কলরবের কেলমা।তারপর একা একাই অট্টহাসি হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতে বলল,- এতো রাক্ষসী হাসি তুই হাসিস কীভাবে কুহু??- আমি ভালোবাসি তাই।কুহু অবাক হয়ে পিছন ফিরতেই দেখলো কূজন দাঁড়িয়ে আছে। কূজনকে দেখে কুহুর এবার খুব বেশি রাগ হলো। কুহু কূজনকে কিছু বলল না কিন্তু চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই কূজন নরম সুরে বলল,- কুহু লাভ হবে না। সিঁড়িঘরের গেইটে তালা দেওয়া আর..কূজনের কথা শেষ না হতেই কুহু আতঙ্কে কূজন থেকে অনেকখানি দূরে সরে দাঁড়ালো। তারপর কাঁপা স্বরে বলল,- আর??কূজন পকেট থেকে চাবি বের করে কুহুর সামনে তুলে ধরলো। কূজনের হাতি চাবি দেখেই কুহুর হাত পা ভয়ে জমে গেল। এই শীতের মাঝেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করলো। এই প্রথম কূজনকে কুহুর কাছে ভয়ংকর মনে হচ্ছে। কুহু ভয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,- প্লিজ তালাটা খুলে দিন।কূজন কিছু বললো না। চুপচাপ চাবিটা প্যান্টের পকেটে রেখে দিল। কূজনকে পকেটে চাবি রেখে দিতে দেখে কুহু আর এক মিনিটও দাঁড়ালো না। দৌড়ে গিয়ে সিঁড়িঘরের দরজা ধাক্কাতে লাগলো। ভয়ের চোটে মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের করতে পারছে না। শুধু নিরলসভাবে একটানা দরজা ধাক্কাতে লাগলো। কূজন ধীর পায়ে এসে কুহুর পিছনে দাঁড়িয়ে বলল,- ভয় পাচ্ছো কেনো কুহু?কূজন এই প্রথম কুহুকে তুমি করে বলল। কুহুর তাতে ভয় আরো দ্বিগুণ হলো। কুহু পুরোপুরি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। কাঁদতে কাঁদতেই বলল,- প্লিজ কূজন আমাকে যেতে দিন। আপনার পায়ে পড়ি কূজন তারপরো আমাকে যেতে দিন। কুহু চোখের পলকেই দরজা ছেড়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে কূজনের পা ধরার জন্য বসে পড়লো। কূজন দুপা পিছিয়ে বলল,- কুহু তোমাকে তো পায়ে পড়তে বলিনি। তুমি কি জানো তোমাকে কাঁদলে কতোটা সুন্দর লাগে? তোমার কান্না দেখেই তোমার প্রেমে পড়েছিলাম আর তাই চেয়েছিলাম জীবনে যখনি তুমি কাঁদবে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদবে আর তুমি কিনা আমার পায়ে পড়ছো।কুহু দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে কাঁদছে আর বলছে,- প্লিজ কূজন আমাকে যেতে দিন। কূজন কুহুর মুখোমুখি বসে বলল,- যেতে দিব তো শুধু...কুহু সাথে সাথে দাঁড়িয়ে পড়লো। তারপর কঠিন গলায় জিজ্ঞাসা করলো,- শুধু কি?কূজন কুহুর দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে বলল,- আমি একটা গান শুনাবো তোমায়। তুমি আমার পাশে বসে গানটা শুনবে আর আমি একসাথে দুইটা চাঁদ দেখবো। কুহুর কূজনকে কেমন যেন বদ্ধ পাগল মনে হচ্ছে। কুহু আরো বেশি ভয় পেল। কুহু আবার দরজা ধাক্কাতে শুরু করলো। সাথে চিৎকার করে বলছে,- কেউ আছেন প্লিজ সাহায্য করুন। হেল্প মি! কেউ আছেন?? আব্বু! আছো? আব্বু!কূজন নরম স্বরে বলল,- আঙ্কেল নেই। মাত্র দেখলাম মসজিদে গেলেন নামাজ পড়তে। কূজনের কথা শোনে কুহু কূজনের প্রতি ঘৃণা ভরা দৃষ্টি নিয়ে এক পলক তাকালো তারপর পুরো দমে চিৎকার করে মা আর পিহুকে ডাকতে লাগলো। বাড়িওয়ালা আঙ্কেলকেও ডাকতে লাগলো। কূজন ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,- কুহু বোকার মতন কাজ করছো কেনো? নিজের বদনামি নিজেই করতে চাচ্ছো? সবাইকে ডেকে জড়ো করলে তোমার নামেই মানুষ কুৎসা রটাবে। এর চেয়ে বরং আমার পাশে বসে গানটা শুনে ফেলো। প্রমিজ করছি তোমাকে যেতে দিব আর আটকে রাখবো না।আমি এতোটাও খারাপ গাই না যে তোমাকে পালিয়ে যেতে হবে। কুহু একটু সময় নিল ভাবার জন্য। তারপর ভেবে দেখলো কূজন ঠিক বলছে। এভাবে মানুষ জড়ো করে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার কোনো মানেই হয় না। বহু কষ্টে সাহস সঞ্চয় করে বলল,- প্লিজ তাড়াতাড়ি শুরু করুন।কূজন কুহুর কথা শোনে মিষ্টি করে হাসলো। তারপর বলল,- চলো পিছন দিকটায় যাই। আমি ঐখানে গিটার রেখে এসেছি।কুহু ডানে বায়ে মাথা নেড়ে বলল,- এখানে নিয়ে আসুন গিটার।কূজন কুহুর অশ্রুসজল চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে আহাজারি করে বলল,- কলরব ভাইয়ের সাথে তো দিব্যি সেখানে বসে থাকতে পারো কিন্তু আমাকে এক ফোঁটাও বিশ্বাস করতে পারো না, তাইনা কুহু?কুহু কিছু বলল না। চুপ থেকে নিজ সিদ্ধান্তে অটল রইলো। কূজনও কুহুকে জোর করলো না। চলে গেল গিটার আনতে। কুহু মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো। কোনোরকম এখানে থেকে যেতে পারলেই বাঁচে সে। কূজন খুব দ্রুত গিটার নিয়ে চলে এলো। কুহুকে উদ্দেশ্য করে বলল,- বসো।কুহু কথা বাড়ালো না, কূজনের কথামতো চুপচাপ দরজা ঘেঁষে বসে পড়লো। কূজন কুহুর মুখোমুখি বসে গান ধরলো,"আমি নামের বসন্তে তুমি কুহু,তুমি নামের সাগরিকায় আমি ঢেউ,বুঝলো না বুঝলো না বুঝলো না কেউ,তুমিও বুঝলে না কুহু, বুঝলো নারে কেউ।আমি নামের আকাশে তুমি পূর্ণিমা।তুমি নামের অমানিষায় আমি অন্ধকার।এই মন এই গিটার ঐ চাঁদটাও তোমার।কুহু তুমি শুধুই আমার, শুধুই যে আমার।আমি নামের শরতে তুমি কাশবন।তোমায় ভালোবাসে এই কূজন।কুহু কভু চেয়েছো কি এই নয়নে?ভালোবাসা লুকিয়ে অশ্রুর গহীনে?জানালার কাঁচ ছোঁয়া বৃষ্টি তুমি এই হৃদয়ের খিল,এই আকাশ সাক্ষী, সাক্ষী এই নিখিল।আমি নামক বারান্দায় তুমি সাজানো ফুল,ভালোবাসাটাই কি ছিল এই অভাগার ভুল?বুঝলো না বুঝলো নারে বুঝলো নারে কেউ,সাগরিকা তুমি, আমি সেই সাগরের ঢেউ।"কূজনের গান শেষ হতেই কুহু চট করে উঠে দাঁড়িয়ে মিনতির সুরে বলল,- প্লিজ এখন তো যেতে দিন।কূজনও আকুতির স্বরে বলল,- আরেকটু বসো না প্লিজ।কুহু অসহায় চোখে কূজনের দিকে তাকিয়ে রইলো। কূজন কুহুর চোখের ভাষা বুঝলো। পকেট থেকে চাবি বের করে কুহুর দিকে বাড়িয়ে দিল। কুহু অতি দ্রুত চাবিটা হাতে নিয়ে তালা খুলে তালা চাবি দুটোই ছাদে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে নেমে এলো। এসে কাউকে কিছুই বললো না। এমনকি পিহুকেও না। আসলে কুহু কিছু খুলে বলার মতন অবস্হায় ছিল না। জীবনেও সে এতো ভয় পাইনি যা সে গতকাল রাতে পেয়েছে। বাসায় এসে থরথর করে কাঁপছিল। এখনো কম্বল গায়ে দেয়ার মতন শীত পড়েনি তাই কম্বল নামানো ছিল না। কিন্তু গতকাল কুহু এতোটাই কাঁপছিল যে আলমারি থেকে কম্বল নামিয়ে গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়েছিল সে। মাথা ব্যাথায় কুহুর ইচ্ছে করছিল হাতুড়ি দিয়ে মাথাটা দু টুকরো করে ফেলতে। বহু কষ্টে ঘুমিয়েছিল সে। অথচ মাঝরাতে কলরব ফোন করায় ঘুম ভেভে গিয়েছিল কুহুর। মাথা ব্যাথার চোটে কলরবকে ফোন রাখতে বলে আবার ঘুমিয়ে পড়ে কুহু আর সেই ঘুম ভাঙলো এতো দেরি করে। কোনোরকম ফ্রেশ হয়েই কুহু স্কুলে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো। ভাগ্য ভালো ছিল তাই তাড়াতাড়ি রিকশাও পেয়ে গেল। রিকশায় উঠেই কলরবকে ফোন করলো। কলরব প্রায় সাথে সাথেই ফোন ধরলো যেন কুহুর ফোনের অপেক্ষাতেই মোবাইল হাতে নিয়ে বসেছিল। - হ্যালো! ফুলটুশী মাথা ব্যাথা কমেছে?- কমেছে। আসলে সরি! কাল দুপুরেও আপনার কল রিসিভ করিনি আবার রাতেও কথা বলতে নিষেধ করে দিয়েছি। প্রচন্ড মাথা ব্যাথা ছিল। কাল সারাদিন ঘুমিয়ে কাটিয়েছি।- হুম একবার বলেছিলে অসুস্হ হলে তুমি ঘুমিয়ে থাকতে পছন্দ করো যাতে যন্ত্রনা টের পাওয়া না যায়।কুহু অবাক হয়ে বলল,- ঠিক বলেছেন কিন্তু আপানকে কখন বললাম?- মনে করে দেখো বলেছিলে।কুহু মনে করতে পারলো না। কলরব আবার বলল,- ফুলটুশী তোমার ব্রেন খুব ডাল।কুহু হেসে বলল,- কলরব ইবনাত মশাইয়েরটা যে খুব বেশি শার্প তাই হয়তো। আল্লাহ আসলে ব্যালেন্স করে দিয়েছে।কলরব কুহুর কথায় গগনবিহারী হাসি হাসতে লাগলো। কুহু ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বিভোর হয়ে কলরবের হাসির শব্দ শুনতে লাগলো। রাঁধা যেমন শ্রীকৃষ্ণের বাঁশির সুরে পাগল হয়ে যেতো, কুহুও তেমনি কলরবের হাসিতে মাতোয়ারা। দুটো ভালোবাসার মানুষ যখন একে অন্যকে জুড়ে থাকে তখন পৃথিবীর অধরা সুখগুলোও যেন নিজে এসে ধরা দেয়, হাতছানি দিয়ে ডাকে। কুহুকেও যেন কলরব নামের সুখপাখি হাতছানি দিয়ে ডাকছে। কলরবের হাসির শব্দ কুহুর সব চিন্তা, গ্লানি চোখের পলকে মুছে দিল।চলবে...(৫৮)পর্বঃ৫৮স্কুলে আসার আগ পর্যন্ত কুহু কলরবের সাথে একটানা কথা বলেই চলল। স্কুল গেইটের সামনে রিকশা থামতেই কুহু ফোন রেখে ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়ল। স্কুলের ভিতর যাওয়ার আগে দারোয়ানকে একশো টাকার একটা নোট দিয়ে বলল কিছু একটা দোকান থেকে কিনে আনতে। আসার সময় কিছু খেয়ে আসেনি। প্রথম পিরিয়ডেই ক্লাস ছিল তাই দারোয়ানকে বলে এসেছে টিচার্স রুমে টিফিন রেখে দিতে। দ্বিতীয় পিরিয়ডে ফ্রি তখন খেয়ে নিবে। ক্লাসে এসে রুল কল করেই সবার হোম ওয়ার্ক দেখতে চাইলো। কুহু কি মনে করে যেন দীপাবলির খাতাটা সবার আগে দেখলো। কুহু যখন দীপাবলির খাতা দেখছিল তখন খেয়াল করলো দীপাবলি মুখ গুমঁড়া করে রেখেছে। কুহু তাই জিজ্ঞাসা করল,- মা বকা দিয়েছে বুঝি?দীপাবলি ডানে বায়ে মাথা নেড়ে বলল,- মা বকা দেয়নি মেডাম।- তাহলে?- আমি আপনার প্রিয় না তাইনা? শুধু আমার নামটাই আপনার পছন্দের।কুহু হেসে বলল,- তুমিও আমার অনেক প্রিয় কিন্তু শুধু আমার প্রিয় হলেই তো হবে না সব স্যার মেডামদের প্রিয় হতে হবে।- হুম।- নাও তোমাকে স্টার দিয়ে দিলাম। দীপাবলি খাতা নিতে নিতে বলল,- আচ্ছা মেডাম ঐ ভাইয়াটা আমাকে পছন্দ করে না তাইনা?- কোন ভাইয়া?- ঐ যে গতকাল যে সব্বাইকে বেলুন দিয়েছিল...কুহুর চট করে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। তাই বলল,- দীপাবলি তুমি বেশি কথা বলো।দীপাবলি গাল ফুলিয়ে বলল,- মাও আমাকে গতকাল এটাই বলে বকা দিয়েছিল। আমি যখন এশার কাছে বেলুন চাইলাম সে আমাকে দিলো না। বাকি সবাইকে দিয়েছে। আমি নাকি ঝগড়াটে তাই আমাকে দিবে না। আর ঐ ভালো ভাইয়াটাও তো আমার হাতে বেলুনগুলো না দিয়ে সবগুলো এশার হাতে দিয়ে দিয়েছিল। কুহু মনে মনে বলল,- আমিও এই বাচ্চা মেয়েটার মতোই ঐ পশুটাকে এরকম ভালো মানুষ ভাবতাম। আসলেই মানুষ চিনতে বড্ড বেশি ভুল করি আমি।কুহু দীপাবলির গালে হাত রেখে বলল,- ঠিক আছে আমি তোমাকে কিনে দিব।দীপাবলি খুশি হয়ে বলল,- আমার বন্ধুদেরও কিনে দিতে হবে মেডাম। এশা আমার বন্ধুদেরও দেয়নি।কুহু বলল,- ঠিক আছে দিব।..কুহু কোনোরকম ক্লাসে শুধু আজ বসে ছিল। ভালোভাবে কিছুই পড়াতে পারেনি। বারবার মনে শুধু একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছিলো। কলরবকে কি সবটা বলে দেয়া উচিৎ? এই প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে ভাবতেই আজ আর তেমন কিছু পড়ানো হয়নি। টিচার্স রুমে বসেও এই এক কথাই ভেবে যাচ্ছে। খাবারের প্যাকেট খুলেওনি এখন পর্যন্ত। বেশ ক্ষুধা লেগেছে কিন্তু খেতে ইচ্ছে করছে না। গতরাতেও না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল। গতরাতের কথা মনে পড়তেই কুহু শিউরে উঠলো। কুহু যদি ইরিনদের বয়সী হতো তাহলে ভয়ের চোটে ছাদেই হার্ট অ্যাটাক করে মারা যেতো। এমনিতেও কম ভয় পায়নি। কুহু মনে মনে তওবা করেছে আর কোনোদিন ছাদে যাবে না সে। অন্তত কলরব না আসা অব্দি তো নাই। জীবনের শিক্ষা হয়েছে কুহুর। ভাবতেই হাতপা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। কূজন যে কতোটা ডেস্পারেট হয়ে গেছে কুহু তা ভালোভাবেই বুঝতে পারছে। গতরাতে কূজনের মাথায় খারাপ কিছু আসেনি দেখে যে সে ভবিষতেও এমন কিছু করবে না তা তো নয়। বরং দিন দিন কূজন আরো পাগল আর মরিয়া হয়ে উঠবে। এসব ভাবতে পর্যন্ত কুহুর গা গুলিয়ে উঠছে। তাড়াতাড়ি এসব চিন্তা ফেলে কুহু নাস্তার প্যাকেট খুলতে শুরু করলো। ...কূজন ঘড়িতে সময় দেখছে। আর কিছুক্ষণ পরই স্কুলের ছুটি হবে। এখন সে রিকশায় বসে আছে। পায়ে আজ স্নিকারস পরেনি, সো পড়েছে সাথে ফর্মাল প্যান্টশার্ট। কলরব অফিসে যেমন করে যায় ঠিক তেমন। শুধু সানগ্লাসটা পরেনি কারণ কূজনের পক্ষে সানগ্লাস পরে হাঁটা অসম্ভব। চশমা ছাড়া খালি চোখে হাঁটতে গেলেই পড়ে যাই পড়ে যাই অবস্হা আর সেখানে যদি সানগ্লাস পরে তাহলে নির্ঘাত গাড়ির নীচে চাপা পড়বে। কূজন ব্যস্ত ভঙ্গিতে আবারো ঘড়ির দিকে তাকালো তারপর রিকশাচালককে দ্রুত চালানোর জন্য তাড়া দিলো। কূজনের আজ মনেই ছিল না বৃহস্পতিবারে স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি হয়। ভাগ্যিস ইরিনের বকবকানিতে মনে পড়ে। তারপর তাড়াতাড়ি করে রেডি হয়ে রওনা দিল। অন্যদিন হলে রেডি হওয়া নিয়ে কোনো ঝামেলা পোহাতে হতো না। কিন্তু কূজন কলরবের মতন এক গাদা কাপড় শপিং করে নিয়ে এসেছে তারপর খুব বেশ সময় নিয়ে শার্ট চুজ করেছে সে। অবশ্য ইরিন সাহায্য না করলে আরো বেশি দেরি হয়ে যেত। রিকশাচালকের কথায় কূজনের ভাবনায় ছেদ পড়লো। - আইয়া পড়ছি তো এহন নামেন না কেন? রাস্তায় তো পাগল কইরা লাইছিলেন।কূজন ওয়ালেট থেকে চকচকে পাঁচশো টাকার নোট বের করে রিকশাচালকের হাতে ধরিয়ে বলল,- রেখে দিন ফেরত দেয়া লাগবে না।রিকশাচালক এর মলিন আর বিরক্তভরা চাহনি হঠাৎ খুশিতে চকচক করতে লাগলো। হাত বাড়িয়ে টাকা নিয়ে বলল,- ভাইজান আফনে বড় ভালা মানুষ।কূজন রিকশা থেকে নামতে নামতে বলল,- এটা আপনার ভুল ধারণা। আমি বড্ড বেশি খারাপ মানুষ, বড্ড বেশি!রিকশাচালক কূজনের কথায় থ হয়ে রইল। কূজন তা উপেক্ষা করে স্কুল গেইটের কাছে এগিয়ে গেল।..কুহু গেইট থেকে বের হয়ে রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ খেয়াল করলো কূজন কুহুর দিকে হেঁটে আসছে। কূজনকে আজ পুরা অন্যরকম লাগছে। কুহু কূজনের এই পরিবর্তনের কারণ খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছে। কুহুর রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে। কুহু মনে মনে বলল,- এখন যদি এই পাগল এসে উল্টাপাল্টা কিছু বলে তাহলে আজ কুরুক্ষেত্র সৃষ্টি করে ফেলব। কূজন হেঁটে এসে কুহুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,- কেমন আছো কুহু? গানটা কেমন হয়েছে বললে না যে?আমি নিজে লিখেছি, সুরটাও...কূজনের কথা শেষ হবার আগেই কুহুর কলিগ কলি এসে বলল,- আরিজা মেডাম ইনিই কি আপনার তিনি? আমায় তো বলেছিলেন ট্রেনিং থেকে ফিরেননি এখনো। কি ব্যাপার ভাইয়া সারপ্রাইজ দিতে চলে এলেন নাকি?কুহু কূজনের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালো। কুহু আসলে কূজনকে খুব কঠিন কিছু শুনানোর জন্য কথা গুছিয়ে নিচ্ছিল এর মাঝেই কলি এসে হাজির তাও আবার কিসব বলল। কুহুর ভয়ঙ্কর ধরনের মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। তবে সেটা চেপে গিয়ে বলল,- না কলি উনি আমার হবু দেবর। কলরব উনাকে পাঠিয়েছে আমাকে একটা জিনিস দেওয়ার জন্য। কলি আগ্রহ নিয়ে বলল,- কি দেখি তো।কুহু পড়লো মহাবিপদে। সে তো কূজনকে হিট দিয়েই কথাটা বলেছিল। এখন কোথা থেকে কি দেখাবে বুঝতে পারছে না। কলি তো উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে কিন্তু কুহু কি দেখাবে তাই ভেবে পাচ্ছে না। হঠাৎ কুহুর কলরবের দেয়া আয়নাটার কথা মনে পড়লো। কুহু আয়নাটা সাথেই রাখে সবসময়। ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে আয়নাটা খুলে কলিকে দেখিয়ে বলল,- কলরব এটা পাঠিয়েছে আমার জন্য। তারপর হাসিমুখে কূজনের দিকে তাকিয়ে বলল,- ধন্যবাদ ভাইয়া কষ্ট করে এখানে এসেছেন। তবে ধন্যবাদটা না দিলেও পারতাম হাজার হোক আমি আপনার ভাবি হই। দেবর হিসেবে ছোটখাটো কাজ তো করতেই পারেন, তাইনা? তবুও কলরবের ভাই আপনি তাই সৌজন্যতা দেখানোও আমার কর্তব্য। কুহু এতটুকু বলেই ব্যঙ্গের হাসি হাসলো। কলি বলল,- ভাইয়া এক্সট্রিমলি সরি আমি আসলে বুঝিনি।কলির কথা কূজনের কানে গেল না। কূজন এখনো কুহুর বলা কথাগুলো হজম করে উঠতে পারছে না। কুহু এমনভাবে বলল কীভাবে সেটা ভেবে কূলকিনারা করতে পারছে না সে, কোনোভাবেই না।চলবে...পর্বঃ৫৯,৬০কুহুর মনে এক পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে। কূজনকে উচিত শিক্ষা দিয়েছে সে। এমন ছ্যাঁচড়া ছেলেদের এভাবেই সাইজ করতে হয়। গতকাল রাতে কুহুকে ছাদে আটকে রেখে কূজন জঘন্য অপরাধ করেছে। সেই অপরাধের তুলনায় এরকম দু চারটে কথা শোনানো যেতেই পারে। তবে কুহু বেশ ভদ্রভাবেই কথাগুলো বলেছে আর খারাপ কিছুই বলেনি। যা সত্যি তাই বলেছে। কুহু তো কূজনের ভাবিই। কুহুর মন বেশ ফুরফুরে হয়ে এসেছে। গতরাতের শাস্তি সে কূজনকে দিয়েছে। যদিও পিহু শুনলে বলবে এটা কোনো শাস্তি হলো? কিন্তু কুহু জানে এর চেয়ে বড় শাস্তি কূজনের জন্য আর হতেই পারে না। ভালোবাসার মানুষের কাছে দেবর, ভাবি, শ্যালিকা,দুলাভাই এসকল শব্দ শুনতে বেশ ভয়ংকর মনে হবে নিশ্চই। কুহু মনে মনে একবার ভাবলো আচ্ছা কলরব যদি ওকে ভাবি ডাকে তাহলে ওর কেমন লাগবে? ভাবতেই কুহুর মন বিতৃষ্ণায় ভরে গেল। কুহু এবার নিশ্চিত যে কূজনের লজ্জা থাকলে আর কোনোদিন কুহুর পিছনে পড়বে না। তবে মনের মধ্যে একটা খটকা রয়েই গেল। কূজন যদি এতে করে ক্ষেপে যায়,তাহলে? সে তো আরো বেশি ডেস্পারেট হয়ে যাবে। কুহুর সত্যি সত্যি এবার খুব বেশি ভয় করতে লাগলো। কুহু মনে মনে বলল,- বিয়েটা করে গেলে কি হতো? উনি আছেন উনার চাকুরী নিয়ে। বউ গেলে তখন চাকুরী দিয়ে কি করবে তা আমি দেখে নিব। কুহু নিজেকে শুধরে নিয়ে বলল,- ধুর কিসব বলছি। বউ আবার কোথায় যাবে। বরং বর এসে হাজির হবে। কিন্তু কবে? দিন যায় না কেনো? এই কূজনের জ্বালায় কুহু অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। পিহুর কথা মতন কলরবকে সব বলে দেয়া উচিত নয়কি? অবশ্যই বলে দেয়া উচিত। কারণ পিহু যা বলে সবসময় তাই ঠিক হয়। পিহু তো বলেছিলই কূজন আসলে কুজন। কিন্তু কুহুই ওর ভালোমানুষী চেহারা দেখে ভিতরে ভিতরে আরো পুড়ছিল। কিন্তু সব তো খোলাসা হয়েই গেল। কলরবকে সবটা বলতেই হবে নয়তো বড় ধরনের কোনো বিপদ দেখা দিবে সামনে। কিন্তু কলরব যদি ভুল বুঝে কুহুকে তাহলে কি হবে? নাহ্ কলরব কখনোই কুহুকে ভুল বুঝবে না। ভালোবাসে সে কুহুকে, এতোটাই বেশি ভালোবাসে যে কুহুর কথা চিন্তা করে সে কাঁচের চুড়িই আনেনি। কতো তফাৎ দুইটা মানুষের মাঝে। একজন ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে ঘুরে বেরিয়েছে এতোদিন আর এই আলো ঝলমলে মুখশ্রীর আড়ালে থাকা ভয়ংকর মানুষটাকেই কুহু পার্ফেক্ট একটা মানুষ ভাবতো। অথচ কলরবকে প্রথম থেকেই কুহুর কাছে গায়ে পড়া স্বভাবের মনে হয়েছে। কুহুর মাথায় হঠাৎ চিন্তা আসলো আচ্ছা আমি যদি কূজনকে চুজ করে নিতাম তাহলে কলরব কিরকম আচরণ করতো? কলরবও কি কূজনের মতন এভাবে পিছে পড়ে থাকতো? কুহুর ধারণা অবশ্যই থাকতো। পরক্ষণেই কুহুর মনে হলো নাহ্ কলরব এমন করতেই পারতো না। কলরব সবসময়ই কুহুর ভালো লাগাটাকে প্রায়োরিটি দিয়েছে। কুহু কোনটা বললে রেগে যাবে, কোনটায় অস্বস্তি হবে, কোনটা বললে কেঁদে দিবে সবটার দিকেই সে খেয়াল রাখে। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে কুহু রাগ করলে তা ভাঙানোর জন্য হাজারটা পায়তারা করে। কলরবের কাছে সবচেয়ে বেশি ইম্পর্টেন্ট হলে কুহুর ভালো থাকা। কুহু একয়দিনে খুব ভালো বুঝে গেছে যে কলরব কুহুর জন্য সবদিক দিয়েই পার্ফেক্ট। তাছাড়া মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং এর কারণে হোক আর যেই কারণেই হোক না কেনো রেস্টুরেন্টে কলরব কুহুর ইচ্ছের প্রাধান্য দিয়ে বলে দিয়েছিল কুহুর সাথে বিয়েটা ভেঙ্গে দিবে। কুহু একটুও ভুল সিদ্ধান্ত নেয়নি। বরং কূজনকে চুজ করলে সে ভুল করতো। কলরব কেমন যেন সবসময় কুহুকে বুঝে যায়। কুহুর কিছু বলতেই হয়না। এমনকি অনেক সময় দেখা যায় কলরব একটা কথা বললে কুহু বুঝতে পারে হ্যাঁ আমি তো আসলে এমনটাই চাচ্ছিলাম। কুহুর মনে হচ্ছে যদি কূজন নামক বালাইটা না থাকতো কুহু হতো পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। এতো কিছু ভাবতে ভাবতে কখন যে রিকশা বাসার কাছে পৌঁছে গেছে খেয়ালই করেনি। রিকশা ভাড়া মিটিয়ে গেইটে ঢুকতেই কূজনও এসে আবার হাজির হলো। কূজনকে বাসার গেইটে ঢুকতে দেখে কুহু কঠিন দৃষ্টি ছুঁড়ে দিল। কড়া করে অনেকগুলো কথা শুনাতে মন চাইছে কিন্তু এখানে এতো কথা বললে আশেপাশের মানুষজন শুনে ফেলবে। কুহু নিজের ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রেখে সিঁড়ি বেয়ে তরতরিয়ে উঠতে লাগলো। কূজনও কুহুর পিছন পিছন উঠতে লাগলো আর বলল,- কুহু আমার কথা শুনো বলছি। কুহু দাঁড়াও। আমি তোমার দেবর নই কুহু। আমি তোমার কি সেটা সময়ই বলে দিবে।কূজনের শেষের কথাটা কেমন যেন ছিল। কুহু ভয়ার্ত দৃষ্টিতে পিছন ফিরে তাকালো। তারপর আবার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলো। কূজন কুহুকে থামতে বলছে কিন্তু কুহু আরো দ্রুত চলছে। তিনতলা বেয়ে উপরে উঠতে কুহুর মনে হচ্ছে শতজনম লাগছে। পা যেন চলছেই না, পথও যেন শেষ হয় না। কূজন পিছন থেকে কুহুর হাত ধরে টেনে দাঁড় করাতেই কুহু চট করেই অপর হাত দিয়ে কূজনের গালে কষিয়ে চড় দিল। কূজন তারপরো হাত ছাড়লো না। কুহু যখন হাত ছাড়ানোর চেষ্টায় ব্যস্ত কূজন তখন একনাগাড়ে বলতে লাগলো,- মিস কুহু আরিজা তোমাকে যে আমার বউ হতেই হবে। তোমাকে অন্য কেউ বিয়ে করতে পারবে না।কুহু রেগে গিয়ে বলল,- হাত ছাড়ুন বলছি। বড়লোক বাপের বখে যাওয়া ছেলেরা আপনার মতন কুলাঙ্গারই হয়। - কেমন বীরপুরুষ তা বুঝতে চেয়ো না কুহু।কুহু চিৎকার করতে চাইছে কিন্তু এটা করা মোটেও ঠিক হবে না। তাই কূজন যে হাতে কুহুর হাত ধরে রেখেছে সে হাতে নিজের অন্য হাত দিয়ে জোরে চিমটি কাটলো। এই কাজটা কুহু বেশ ভালো পারে। কূজন প্রথমে ছাড়লো না কিন্তু কুহু এতো জোরে চিমটি দিয়ে ধরে রেখেছে কূজনকে বাধ্য হয়ে ছাড়তে হয়েছে। কূজন হাত ছাড়তেই কুহু বলল,- আপনার আর কলরবের মাঝে আকাশ পাতাল পার্থক্য। কূজনের জবাবের অপেক্ষা না করেই কুহু চলে গেল। এবার আর কূজন পিছু নিলো না, কুহুর গমনপথের দিকে শুধু চেয়ে রইলো। ..কুহু বাসায় ঢুকেই হন্তদন্ত হয়ে কলরবকে কল করতে করতে বেডরুমে ঢুকলো। একবার রিং হতেই কলরব ফোন রিসিভ করলো। কুহুর ফোন রিসিভ করতে কলরব কখনোই দেরি করে না, পাছে ফুলটুশি আবার না রেগে যায়। কলরব ফোন ধরতেই কুহু বলল,- কলরব আপনি কি কখনো অবিশ্বাস করে আমার হাত ছেড়ে দিবেন?কলরব মজা করে বলল,- কিসব কথা বলছো বুঝতে পারছি না তো। কোনো উপন্যাস বা মুভির ডায়ালগ নাকি?কুহু কলরবের মজা করায় মন দিল না। সল এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে হরহরিয়ে কলরবকে সব কথা বলে দিল। কূজনের ডায়েরি দেওয়া থেকে শুরু করে একটু আগের ঘটনা পর্যন্ত পুরোটাই বলল। ছাদে আটকে রাখার কথাটা বলার সময় কুহু কেঁদে দিল।কলরব তখন ধমকে বলল,- তোমাকে না বলেছি একদম কান্নাকাটি করবে না। তোমাকে কাঁদতে দেখলে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।কুহুর কান্না কমার চেয়ে আরো বেশি বেড়ে গেল। কান্না জড়ানো কণ্ঠেই বলল,- কূজন আজকে আমার পথও আটকেছিল। জোর করে হাত ধরে রেখেছিল। আমি কোনোভাবেই আসতে পারছিলাম না পরে..কলরব বাকিটুকু আর শুনলো না। কুহুকে ভরসা দিয়ে বলল,- আমি আগামীকালই চলে আসছি কুহু। তুমি একদম চিন্তা করো না। আর এভাবে কাঁদছো কেনো? কূজন জোর করে তোমার হাত ধরে আটকে রেখেছিল তুমি তো আর নিজে সেধে যেয়ে ওর হাতে হাত রেখে বসে থাকোনি তাই তোমাকে ভুল বুঝার কোনো প্রশ্নই আসে না। তোমার জন্য যা করার আমি তা করবো সো চিন্তা বাদ দাও। রিল্যাক্স মুডে থাকো।কুহু চোখের পানি মুছে বলল,- শুনোন কূজনের সঙ্গে প্লিজ লাগতে যাবেন না। কূজনের বাবা অনেক পাওয়ারফুল। তাছাড়া কূজন আজ কেমন যেন হুমকির সুরে কথা বলল। আমার অনেক ভয় করছে। - ধুর বোকা মেয়ে বাদ দাও এসব। আমি আছি না? তাহলে ফুলটুশীর কোনো চিন্তাই নেই। ফুলটুশীর চোখের জল আমি থাকতে কখনো ঝরতে দিব না।কলরব একটু থেমে বলল,- আচ্ছা কুহু তুমি কি কখনো ফুলটুশিকে হিংসে করো? জেলাসি টাইপের কিছু?কুহু হেসে বলল,- মাঝে মাঝে।কলরব ঠিক বুঝতে পারছে কুহুর চোখের কোণায় জল আর ঠোঁটের কোণায় এখন হাসির রেখা। এই হাসিটাকে আরো বিস্তীর্ণ করতে কলরব বলল,- আচ্ছা আমি তো সবসময় কতোই বলি আমার তোমার এটা ভালো লাগে, ওটা ভালো লাগে কিন্তু তুমি তো কখনো বলোনি আমার কোন বিষয়টা তোমার ভালো লাগে।কুহু এক মিনিট ভাবলো তারপর বলল,- তেমন কিছুই আমার ভালো লাগে না। তবে ফুলটুশী গগনবিহারী হাসিটা শুনতে ব্যাকুল হয়ে থাকে। কুহুর কথা শুনে কলরব নিজের গগনবিহারী হাসি হাসতে লাগলো আর কুহুর এতেই মন পুরোদমে ভালো হয়ে গেল।চলবে...::#একটুখানি--- লামইয়া চৌধুরী।পর্বঃ৬০"আমার চোখ থেকে জলেদের যে যোজন যোজন দূরত্ব বাড়ছে তার দোষের ভার তুমি ছাড়া আর কে নিবে?""ঝিকিমিকি সূর্যটা চন্দ্রের প্রেমে যে অবিরত পুড়ছে তা এই আমি ছাড়া আর কে বুঝবে?"এতটুকু লিখেই কূজন ডায়েরি বন্ধ করে রাখলো। চোখের চশমাটা খুলে শার্টের কোণা দিয়ে মুছে পরিষ্কার করলো। কূজনের চোখ বারবার ঝাপসা হয়ে আসছে। কুহুর কথাটা কানে বাজছে, বুকেও বিঁধছে। কলরব আর কূজনের মাঝে আসলেই আকাশ পাতাল পার্থক্য। কূজন কখনোই কলরবের মতন হতে পারবে না। কূজনের হঠাৎ মরে যেতে ইচ্ছে হলো। অপমানে আয়নার সামনে দাঁড়ানোর মতন সাহস খুঁজে পাচ্ছে না। ভালোবাসার মানুষটার কাছে আজ সে চরম অপমান হয়েছে। বুকের পাঁজর বেদনা সহ্য করতে করতে ক্লান্ত হয়ে আছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। কুহুর যে চোখে কূজন ভালোবাসা খুঁজে বেড়ায় সে চোখজোড়ায় আজ শুধু ঘৃণা। কূজন তবুও কুহুর পিছু ছাড়বে না। ভালোবাসার কাছে এই ঘৃণাকে সে পাত্তা দিবে না। আরো শক্ত হতে হবে তাকে। কুহুকে নিজের করে পেতেই হবে। এই বুকের খাঁচায় কুহুকে বন্দি করে রাখবে, ভালোবাসার গান শুনাবে সে। কুহুর প্রেমের ডাক শোনার জন্য কূজন আকুল হয়ে আছে। কিন্তু কুহু কি কখনো বুঝবে? কুহুর মনে কখনো কি কূজন জায়গা করে নিতে পারবে না? কুহুর ঘৃণা নিয়েই কি কূজনকে মরতে হবে? আর ভাবতে পারলো না। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। ডায়েরিটা বালিশের নীচে রেখে বালিশে মুখ গুঁজলো। হঠাৎ করে কূজনের মনে হলো জীবনটা এমন কেনো? সত্যিকার ভালোবাসাগুলো কেনো এভাবে হেরে যায়? বেদনাই কি ভালোবাসা? এ জীবনে ভালোবাসা বলতে কিছু নেই যা আছে তা হলো বেদনা। প্রেমিক বলতেও এই ধরায় কেউ নেই, যারা আছে তারা হলো কষ্টের কুণ্ডলী। এই পৃথিবীতে কোনো প্রেয়সীও নেই, আছে শুধু বাধ ভাঙা কান্না। প্রচন্ড রকমের কষ্ট হচ্ছে কূজনের যা কখনোই বুঝানো সম্ভব না। দীর্ঘশ্বাস সঙ্গী করে বিছানায় শরীর এলিয়ে শুয়ে আছে কূজন। ইরিন রুমে উঁকি দিয়ে কূজনকে শুয়ে থাকতে দেখে রুমের দরজায় নক করলো। কূজন ঘাড় ঘুরিয়ে ইরিনকে দেখতে পেল। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,- কিছু বলবে সোনার হরিণ?ইরিন বাইরে দাঁড়িয়ে থেকেই বলল,- আঙ্কেল এসেছেন, তোমার সাথে দেখা করার জন্য।বাবার কথা শুনে কূজন ধরফরিয়ে উঠলো। তারপর বলল,- কখন এসেছে?- এই মাত্র।কূজন তাড়াতাড়ি করে হন্তদন্ত হয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ড্রয়িংরুমে যেয়ে বাবাকে না পেয়ে কূজন বেশ অবাক হলো। ইরিন এসে বলল,- ভাইয়া আঙ্কেল আমার রুমে।কূজন ইরিনের রুমের দিকে পা বাড়ালো। ঠিক তখনই হাসনাদ সাহেব রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। বাবাকে দেখেই কূজন জড়িয়ে ধরলো। হাসনাদ সাহেব বললেন,- কেমন আছো প্রিন্স?- ভালো বাবা,তুমি?- আমিও ভালো। হঠাৎ তোমার সাথে দেখা করতে ইচ্ছে হলো তাই চলে এলাম।কূজন খুশি হয়ে বলল,- বেশ করেছো বাবা।হাসনাদ সাহেব কূজনের কাঁধে হাত রেখে বললেন,- চলো তো একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি।- চলো বাবা।হাসনাদ সাহেব আর কূজন বাইরে বেরিয়ে গাড়িতে এসে বসেছে। হাসনাদ সাহেব ড্রাইভার শামসুকে বাইরে যেয়ে দাঁড়াতে বললেন।শামসু চলে যেতেই নরম সুরে বললেন,- কূজন তুমি কি জানো তুমি যে তোমার মায়ের চোখের মণি, আমার আদরের একমাত্র প্রিন্স?কূজন কিছু বলল না চুপ করে রইল। হাসনাদ সাহেব একটু থেমে আবার বলা শুরু করলেন,- শুনো তুমি কুহুর পিছন পিছন ঘুরা বন্ধ করে দাও।বাবার কথা শুনে কূজন স্তব্ধ হয়ে গেল। কি বলছে কি বাবা? কূজন ভেবেছিল ওর বাবা নিশ্চই এতে খুশি হবে কিন্তু এমন কেনো বলল মিলাতে পারলো না। কূজনকে স্তব্ধ হয়ে থাকতে দেখে হাসনাদ সাহেব বললেন,- কূজন তুমি কোথায় থাকো,কি করো না করো সব আমার জানা আছে। যেদিন থেকে কুহু কলরবের বিয়ে ঠিক হয়েছে সেদিন থেকেই আমি তোমাকে নজরে নজরে রাখছি। কেনো করছো এমন? কুহুর চোখের ঘৃণার বাণ তোমাকে তিলে তিলে মেরে ফেলবে।কূজন শান্ত স্বরে বলল,- বাবা আমি যেকোনো মূল্যে কুহুকে বিয়ে করতে চাই।হাসনাদ সাহেব ভরসা দিয়ে বললেন,- এক সপ্তাহ সময় দাও বাবা কুহু তোমারি হবে। শুধু শুধু ওর কাছে তুমি নিজে খারাপ সেজো না। তাহলে কোনোদিনও ভালোবাসা পাবে না। কুহুকে পাইয়ে দেয়ার দায়িত্ব আমার উপর ছেড়ে দাও। - না বাবা কুহুকে আমি নিজের ভালোবাসার জোরে পেতে চাই। - এটাকে কি ভালোবাসা বলে কূজন? তুমি কয়েকদিন ধরে যা করছো তাকে জোর খাটানো বলে, ভালোবাসা না। জোর করে যেহেতু কুহুকে পেতে হবে তাহলে সে জোরটা তুমি না করে আমি করি। দেখো কূজন মেয়েরা পাগলের মতন যেমন করে ভালোবাসতে জানে তেমনি পাগলের মতন ঘৃণাও করতে জানে। তুমি কি চাও, কুহু তোমাকে ঘৃণা করুক? আমি বলি কি কুহুর তোমার প্রতি ভালোবাসা না থাকলেও চলবে তবে ঘৃণা থাকলে চলবে না। সংসার ভালোবাসা ছাড়াও করা যায় কিন্তু ঘৃণাকে সঙ্গী করে কখনো সংসার করা যায় না। আমাকে আর তোমার মাকেই দেখো। আমরা খুবই সুখী দাম্পত্যজীবন কাটাচ্ছি অথচ আমাদের মাঝে ভালোবাসা ছিল না। আমি কথা দিচ্ছি কুহুর বিয়ে তোমার সাথেই হবে। তবে তুমি কুহুর সাথে জুরাজুরি করা বন্ধ করে দাও নয়তো বিয়ের পরও কুহু কোনোদিন তোমাকে মেনে নিবে না।কূজন বাবার সব কথা শুনে বলল,- বাবা আমার বিশ্বাস আছে আমি কুহুকে জয় করতে পারবো সো তুমি প্লিজ এসবের মধ্যে এসো না। ইটস আর্নেস্ট রিকুয়েস্ট।হাসনাদ সাহেব কিছু বললেন না। কূজন বাবার জবাবের অপেক্ষা করে জবাব না পেয়ে বলল,- বাবা আমি আসছি, পরে কথা হবে। তবে বলে রাখছি কুহু আর আমার মাঝে আমি কোনো ইন্টারফেয়ার চাই না।হাসনাদ সাহেব ছেলের কথা শুনে চমকে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন।...কুহু রান্নাঘরে রুটি বেলছিল। পিহু দৌড়ে এসে ফোন দিয়ে বলল তোর ব্যাংক আর আমার এটিএম কার্ড ফোন দিয়েছে।কুহু বলল,- তাড়াতাড়ি ধরে আমার কানের সাথে চেপে ধর।পিহু ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,- ইশ্ আমার আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই নাকি?- প্লিজ পিহুন প্লিজ। দেখছিস না রুটি বেলছি, এখন রুটি বেলা বাদ দিয়ে কথায় লাগলে আম্মু এসে বকবক করবে। - আমার পড়া আছে।- প্লিজ পিহুন তুই এতো পাথর কেনো?- আমি এমনি।- প্লিজ প্লিজ বেশিক্ষণ না পাঁচ মিনিট তারপর রেখে দিব। কাজ শেষ করে আবার কথা বলবো।- স্পিকার দেই তাহলেই হলো।- ধুর গাধী!পিহু হতাশ হয়ে বলল,- গাধী আবার অন্যকে গাধী বলতে আসে।- তাহলে ইয়ার ফোনটা এনে দে।- দিচ্ছি! এটা ভালো আইডিয়া। প্রেমে পড়ে তোর উন্নতি হচ্ছে।কুহু বিরক্ত হয়ে বলল,- এখন তোর পড়া নষ্ট হয় না?তাড়াতাড়ি যা!পিহু ইয়ার ফোন কুহুর কানে গুঁজে দিয়ে চলে গেল। কুহু হ্যালো বলতেই কলরব বলল,- ফুলটুশী সরি! সরি! সরি! সরি! সরি! সরি!...এতোবার সরি শুনে কুহু হতভম্ব হয়ে গেল। তারপর বলল,- কি হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছি না।- শুনো না অফিস থেকে না খুব বেশি চাপ তাই আসতে পারছি না। তুমি প্লিজ রাগ করো না। অনেক ট্রাই করেছি কিন্তু ম্যানেজ করতে পারছি না। তারপরো তুমি বললে চাকুরী ছেড়ে চলে আসবো।কুহু বিরক্তির আওয়াজ করে বলল,- চাকুরী ছাড়বেন কেনো? আশ্চর্য তো! পরে খাওয়াবেন কি আমায়? আর কুহুরব, কিচিরমিচির ওদের পালবেন কি করে?কথাটা বলেই কুহু জ্বিহ্ব কাটলো। কি বলে ফেললো সে। এখন কলরব প্রতিনিয়ত এটা নিয়ে মজা করবে। ধুর ছাই!কলরব কুহুর কথা শুনে হাসতে লাগলো। কলরবের হাসি শুনে কুহুর আজ ভালো লাগছে না বরং মেজাজ খারাপ হচ্ছে। এভাবে হাসার কি আছে? কিন্তু কলরবকে কিছু বলল না। একটু সময় নিয়ে ভাবলো কলরবের উপর এই হাসির ঝালটা মিটাতে হবে কিন্তু হাসা নিয়ে কিছু বলা যাবে না। কিছু বললে আরো বেশি করে হাসবে তারচেয়ে অন্য কথা বলে রাগ দেখাবে। আসতে পারলো না এ নিয়ে অবশ্য কথা শুনাতেই পারে কিন্তু এটা নিয়ে কিছু বলা উচিত হবে না। বেচারা কতোবার সরি বলল। সরির কথা মনে হতেই কুহু মনে মনে হাসলো। তারপর ভাব ধরে বলল,- আমি কি বাঘ না ভাল্লুক যে এতোবার সরি বললেন?আপনার কান্ড দেখে মনে হয় আমি আপনাকে টর্চার করি।কলরব গগনবিহারী হাসি হাসতে হাসতেই বলল,- ফুলটুশী বাঘিনী হবে আর ভাল্লুক এর ফিমেল ভার্শন...কলরবের কথা শেষ না হতেই কুহু রেগে বলল,- আপনি আমাকে নিয়ে এমন ইয়ার্কি মশকারা করেন কেনো? যা বলি তাতেই হাসাহাসি। এসব একদম ভালো লাগো না। আমাকে আর কোনোদিন ফোন দিবেন না। যদি আমার নাম্বারে আপনার কল আসে তাহলে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে আপনাকে ফেলে দিব।কুহুর বলা শেষ হতেই কলরব বলল,- ফুলটুশী মিসডকল আসলে হবে তো?কুহু আরো বেশি রেগে বলল,- একদম ফাজলামি করবেন না, ফাজিল কোথাকার।- ফাজিল বলছো আবার ফাজলামি করতে নিষেধ করছো এটা কেমন হলো না? ফাজিল যদি ফাজলামি না করে তাহলে....কলরব পুরো কথা শেষ করবার আগেই কুহু কল কেটে দিয়েছে। কুহু কল কেটে দিয়ে বিশ্বজয়ীর হাসি হেসে বলল,- এবার মিস্টার ইবনাত কলরব কাজে লেগে যাও। ফুলটুশীর রাগ ভাঙাও এখন। হুহ! এবার বুঝো কতো হাসিতে কতো প্যারা!কলরব অলরেডি মিশনে নেমেও পড়েছে। একের পর এক কল দিয়ে যাচ্ছে আর কুহু তা দেখে গুণগুণ করে গাইছে," রাগ করো না করো না ওগো ঝরনা বিবি.... "চলবে...পর্বঃ৬১,৬২কুহুর কলেজে আজ ক্লাস ছিল তাই স্কুলে যেতে পারবে না,ছুটি নিয়েছে সে। কিন্তু শরীরটা ভালো না তাই মা কলেজে যেতে দেয়নি। তাছাড়া মাও বড় খালার বাসায় যাবে বাসা খালি তাই যেতে নিষেধ করলো। পিহু,বাবা কেউ নেই। কুহু ভালোই করেছে না যেয়ে। গেলেও মনে হয়না বেশি একটা সুবিধা করতে পারতো। মাথায় প্রচন্ডরকমের যন্ত্রণা হচ্ছে। দিনরাত শুধু কুহুর মাথায় একটাই প্রশ্ন ঘুরে। কলরবকে সে পাবে তো? নাকি হারিয়ে ফেলবে? বুকের মাঝে কেমন যেন একটা অনুভূতি হয়। এই অনুভূতি কাউকে বুঝানো সম্ভব না। কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। খালি কলরবকে নিয়ে ভয় হয়। কলরবকে দুএকবার বলেছেও। কলরব প্রতিবারই কুহুর এরকম কথা শুনে কিছুক্ষণ অভিভূত হয়ে থাকে তারপর বলে,- ফুলটুশী ফাজিল ছেলেটাকে এতো ভালোবাসে? আমার তো বিশ্বাসই হয় না।কুহু তখন ঝাঁঝালো কণ্ঠে জবাব দেয়,- বিশ্বাস হয়না কেনো? আমি কি ভালোবাসতে জানি না নাকি?কলরব তখন হাসতে থাকে। কলরবের হাসির শব্দে কুহু আর রেগে থাকতে পারে না। এই তো সেদিন কুহু যে মেকি রাগ দেখিয়েছিল কলরবের অবস্হা তাতে দারুণ খারাপ হয়েছিল। আর তা দেখে কুহুর যা হাসি পেয়েছিল বলার বাইরে। বহু কষ্টে একদিন পার করেছিল কলরব। এরপর একের পর এক ইমোশনাল মেসেজিং।" ফুলটুশীর সাথে কথা না বলতে পেরে ফাজিল ছেলের দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে গাছ গাছ মনে হচ্ছে আমার। উদ্ভিদ যেমন কার্বনডাইঅক্সাইড ছাড়া বাঁচতে পারে না তেমনি আমিও কুহু ছাড়া বাঁচতে পারি না"কুহু এই মেসেজ পড়ে হাসতে হাসতে বাড়িঘর মাথায় তুলেছিল। এমনকি পিহুও অনেক হেসেছিল। দুইবোনের কি গড়াগড়ি। কুহ হাসি থামতেই কল করেছিল কলরবকে। কলরব ফোন ধরতেই বলেছিল,- এই আপনি অক্সিজেনও তো বলতে পারতেন? এতো ছাগল কেনো আপনি?- আরে আমি ফরেস্ট্রিতে পড়েছি তো তাই বনজঙ্গল এসবের প্রতি টান অনুভব করি। এজন্য বললাম আরকি। আর আসল কথা হলো কুহু 'ক' দিয়ে কার্বনডাইঅক্সাইড ও 'ক' দিয়ে।কুহু সেদিন একথা শুনে হাসিররাজ্যে তুমুল বেগে ঝড় তুলেছিল। এখনও একথাগুলো ভাবতেই কুহুর হাসি পেতে লাগলো। একা একা বসেই কুহু হাসছে। এমন সময় মোবাইলের স্ক্রিনে কলরবের নাম ভেসে উঠতেই কুহুর খুশি দ্বিগুণ হয়ে গেল। কুহু অতিদ্রুত ফোন রিসিভ করে কলরবের সাথে কথায় মেতে উঠলো। ঘণ্টাখানেক ধরে দুজন কথা বলছে। কলিংবেল এর শব্দ শুনতে পেয়ে কুহু বলল,- কে যেন এসেছে পরে কথা বলছি।- ঠিক আছে এখন রাখছি।কুহু মোবাইল রেখে উঠে গেল কে এলো দেখতে। দরজা খুলেই কুহু দেখলো কূজন দাঁড়িয়ে আছে। কূজনকে দেখে কুহু সাথে সাথে দরজা বন্ধ করে দিল। ভয়ে কুহুর হাত পা কাঁপতে লাগলো। বাসায় কেউ নেই তাই কূজন বাসা পর্যন্ত এসে পড়লো? ভয়ের চোটে রুমের দিকে পা বাড়ালো কুহু। এখনি কলরবকে জানাতে হবে। মোবাইলের জন্য রুমের দিকে পা বাড়াতেই কুহু দরজা ধাক্কানোর শব্দ শুনতে পেল। কূজন ব্যাকুল হয়ে বলছে,- কুহু প্লিজ দরজাটা খুলো। আই এম রিয়ালি সরি! আমি ঐসময় ইচ্ছে করে তোমার হাত ধরিনি। তোমাকে থামাতে হঠাৎ করেই ধরেছিলাম। আমার ঐরকম কোনো ইন্টেনশন ছিল না। আমি সত্যি দুঃখিত। কুহু আর কোনোদিন এমন কাজ হবে না। কুহু শান্ত স্বরে জবাব দিল,- তাহলে আমি হাত ছাড়তে বলার পরও কেনো ছাড়েননি? একটা কথা বললেই হলো নাকি? আপনি যে কেমন জানা হয়ে গেছে।- ভালো যে বাসি তা কেনো জানতে চাও না, কুহু?কুহু কোনো উত্তর দিল না। দাঁতে দাঁতে চেপে হনহন করে রুমে এলো। বুকশেলফের বইগুলো একেকটা হাঁতড়ে খুঁজতে লাগলো। কূজনের দেওয়া বইটা পেয়েই হাতে নিয়ে প্রায় দৌড়ে গেল। দরজার নব ঘুরিয়ে দরজা খুলে কূজনের মুখোমুখি দাঁড়ালো। কুহুকে দেখতে পেয়েই কূজন হাতে থাকা লাল গোলাপগুলো কুহুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে হাসি মুখে বলল,- কুহু সত্যি সরি। কুহু কূজনের হাত থেকে গোলাপগুলো নিয়ে বইটা কূজনের মুখের উপর ছুঁড়ে মারলো। ডেল কার্নেগির সমগ্র বেশ মোটা আর ভারি। কূজনের চোখে লেগেছে,চশমাটাও খুলে পড়ে গেছে। কপালে হাত দিয়ে কুহুর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে সে।কুহু রক্তচক্ষু নিয়ে কঠিন গলায় শাসিয়ে বলল,- আপনার কি বিবেক বলতে কিছু নেই? শুধু হৃদয় আছে তাইনা? কুৎসিত আর অসুস্হ একটা হৃদয়। আমি যে আপনাকে ভালোবাসি না তা কেনো বুঝতে পারছেন না? আপনি যদি আজ আমাকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসতেন তাহলে আদৌ এসব হেরেসমেন্ট করতেন না। আমাকে শান্তিতে থাকতে দিন প্লিজ। আর এসব ফুল নিয়ে যান এখান থেকে।-:কুহু আমি যে তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না।কুহু আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলো না। গোলাপগুলো ফেলে দিয়ে পা দিয়ে মাড়িয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। একটু পর কলরব এর ফোন আসতেই কুহু সবটা খুলে বলল। কলরব কিছুসময় চুপ করে থেকে বলল,- কি বলবো বুঝতে পারছি না। আসলে কূজন এরকম শুরু করবে তাও বাসা পর্যন্ত এসে পড়বে ভাবতে পারিনি। মাও ফোন করে কান্নাকাটি করছে।কুহু বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলল,- মা কান্না করছে মানে? মা কি জানে নাকি এসব?- নাহ্ তা জানে না তবে কূজনের কপাল ফুলে গেছে, চোখ মুখ সব লাল হয়ে আছে। মাথা ব্যাথায় ছটফট করছে তাই মা কান্নাকাটি শুরু করেছে।কুহুর কিছু ভালো লাগছে না। কি হচ্ছে কি এসব? ওর জীবনটা তো কতো সহজ সুন্দর ছিল। বড় কোনো এক্সপেকটেশনও ছিল না। ছোট ছোট বিষয়ে সুখ খুঁজে পেত। হঠাৎ করে সব গুলিয়ে যাচ্ছে কেনো? এ কোন চুরাবালিতে পা আটকেছে তার? দীর্ঘশ্বাস ফেলে কুহু বলল,- এখন রাখছি ভালো লাগছে না কথা বলতে।কলরব আর কথা বাড়ালো না। ফোন রাখতেই কুহুকে একরাশ অনুশোচনা ঘ্রাস করলো। কূজন তো একটা পাগল তা কুহু বুঝেই নিয়েছে তারপরো ওকে এভাবে হার্ট করা ঠিক হয়নি। এভাবে এতো অভদ্র আচরণ কীভাবে করতে পারলো কুহু নিজেই বুঝতে পারছে না। বইটা নরমালি দিলেই পারতো। এভাবে মুখের উপর ছুঁড়ে দেয়ায় কুহুর এখন খারাপ লাগছে। কলরব বলল চোখ, মুখ, কপাল সব ফুলে গেছে। অপরাধবোধ কাজ করতে লাগলো কুহুর। কূজন খারাপ তাই বলে কি তারো খারাপ হতে হবে নাকি? এসব ভাবতে ভাবতেই ইরিনকে কল করলো কুহু। - হ্যালো! ইরিন কেমন আছো?- আরে ভাবি বলো না আর। কেমন আছি জানি না। ভাইয়াও নেই তাই ভালো লাগে না। তোমাদের বিয়েটা যে কবে হবে আল্লাহ্ মালুম! তার উপর মা বাসায় আবার কান্নাকাটি শুরু করেছে। কোথায় এক্সাম শেষ হলো চিল করবো তা না করে..- কেনো মা কাঁদছে কেনো?- কূজন ভাইয়া একটু আগে বাসা থেকে বেরুলো। তারপর এখন বাসায় ফিরলো কপাল ফোলে ফেঁপে অবস্হা খারাপ,চোখও লাল টকটকে হয়ে আছে। চশমাটাও ছিল না সাথে। আমি তখন বাইরে ছিলাম। দোকানে গিয়েছিলাম। আসার সময় দেখি ভাইয়া আসছে মাঝ রাস্তায় রিকশার নীচে পড়ছিল। কোনোরকম সামলেছে। কুহু অস্হির হয়ে বলল,- কিছু হয়নি তো? - কনুইয়ের দিকটা না ছিঁলে গেছে। মা এটা দেখেনি অবশ্য। এটা দেখলে তো আরো কান্নাকাটি শুরু করবে। আমারি তো কান্না পাচ্ছে আর মা তো কাঁদবেই।ইরিনের কথাগুলো শুনে কুহুর নিজেকে মেরে ফেলতে মন চাইছে। সে খুব ভালো করেই জানে সামনে খুব বড়রকমের ঝামেলা হতে যাচ্ছে। এই ঝামেলায় কলরবের কিছু হয়ে যাবে না তো? আর কূজনই যদি নিজের কোনো ক্ষতি করে বসে তাহলে কুহু নিজেকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবে না। ইরিনকে সান্ত্বনার কয়েকটা কথা শুনিয়ে কুহু কি যেন মনে করে বাসার সদর দরজা খুললো। দরজা খুলে নীচে তাকাতেই দেখতে পেল ফুলগুলো পড়ে আছে। চশমাটাও নীচেই অবহেলায় পড়ে আছে কিন্তু বইটা নেই। কুহুর মায়া হলো খুব। সে একজন আধা পাগল মানুষ এর সাথে এমন ব্যবহার করলো। এতো রাগ যে সে কোথা থেকে পেয়েছে বুঝে পায় না। কুহু নীচে ঝুঁকে চশমাটা তুললো। কি ভেবে যেন আবার ছুঁড়ে ফেলে দিল। চলবে...:::#একটুখানি--- লামইয়া চৌধুরী।পর্বঃ৬২কুহু জিদ ধরেছে কলরবকে ঢাকা থেকে আসতেই হবে এবং হাতে একদিন সময় দিয়েছে। কলরব বারবার বুঝানোর চেষ্টা করেছে আসা সম্ভব না। কিন্তু কুহু মানতে নারাজ। কলরব হয় আসবে নয়তো এখানেই সব শেষ। কুহু থেকে কি চাকুরী বেশি ইম্পর্টেন্ট নাকি? এই এক কথার জবাবে কলরব প্রতিবার এক কথাই বলেছে। "চাকুরীটাও ইম্পর্টেন্ট। সব কাজ ধীরে সুস্হে করতে হয়। তাড়াহুড়া করে শুধু লস হয় লাভের খাতা শূণ্য পড়ে থাকে। কলরবের জীবনে তো শুধু কুহু না আরো কিছু মানুষ আছে। একজন সন্তান একজন ভাই হিসেবেও তাঁর কর্তব্য কম কিছু নয় বরং বেশি। সব ভেবে চিন্তে কাজ করতে হয়।"কুহু যখন কলরবকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে,- কূজনকে নিয়ে আপনার কি কিছুই বলার নেই?কলরব ধীর গলায় জবাব দিয়েছে,- কূজনের বয়স কম, বাস্তবতা কি জানে না। বাবার ছায়াতলে মানুষ হওয়া একটা ছেলে। যে চাইলেই সব কিছু পেয়ে এসেছে। কোনোদিন পায়নি এমন কিছুই তার স্মৃতিতে নেই তাই মানতে কষ্ট হচ্ছে। সময় দাও সব ঠিক হয়ে যাবে। কুহু কাঁটা কাঁটা গলায় তখন বলে,- কি সময় দিব ঐ পাগলকে? আমাকে জ্বালিয়ে মারছে। সব পেয়ে গেছে মানে কি আমাকেও পেয়ে যাবে নাকি? আমি কি এতোটাই স্বস্তা? কূজনের বাবা কি আমায় কিনে নিতে পারবে নাকি?- কুহু এভাবে রেগে যাচ্ছো কেনো? আমি এমন বলিনি শুধু বলতে চেয়েছি কূজন অবুঝ, জিদ চেপেছে মনে।- আমি কম বুঝিয়েছি আপনার ভাইকে? যথেষ্ট ভালোভাবে উনাকে বুঝাতে চেষ্টা করেছি। আর কি করতে পারি আমি? আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে মনে হয়না এতটাও করতো। - কুহু জানি তো। তোমাকে আমার থেকে বেশি আর কে চিনতে পারে বলো? - দেখুন এসব শুনতে ভালো লাগছে না। আমি জানতে চাই আপনি কূজনকে কিছু বলছেন না কেনো? কোনো স্টেপ কি আদৌ নিয়েছেন?- আমি কূজনকে বুঝিয়েছি।- রাজপুত্তুর কি বলল?- কিছুই বলেনি চুপ করেছিল।- বাহ্ ভালো তো। দুই ভাই তো দেখছি নিজেদের মাঝে ঠিকই আছে। মাঝখান থেকে আমি পিষে মরছি। আমাকে কি মানুষ মনে হয় না? আপনাদের সাজানো পুতুল আমি? এই আপনার ভালোবাসা? মুখে বড় বড় কথা আর কাজের বেলায় পালিয়ে বেড়ানো। - কুহু আমি কি ইচ্ছে করে করছি নাকি?- কিসের ইচ্ছা অনিচ্ছা বুঝাতে চাচ্ছেন? বাংলাদেশে কেনো পৃথিবীতে এমন কোনো কাজ নেই যা টাকার বদলে করানো যায় না। অফিসের লোকদের ম্যানেজ করা কি এতোটাই কঠিন? - তা ঠিক বলেছো আমি দেখি কি করা যায়।কলরবের কি করা যায় কথাটা কানে আসতেই কুহু মোবাইল কান থেকে সরিয়ে ছুঁড়ে ফেলল। দেয়ালের সঙ্গে লেগে মোবাইল দু টুকরো হয়ে পড়ে রইলো মেঝেতে। রাগে নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হলো কুহুর। কবরী শব্দ শুনে পাশের রুম থেকে দৌড়ে মেয়ের রুমে এলেন। মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলেন,- কি হলো কিসের শব্দ হলো?- আম্মু দয়া করে তুমি এখান থেকে যাও।- কি হয়েছে কুহু,এমন করছিস কেনো?- আম্মু তুমি যাবে কিনা বলো।- হুম যাচ্ছি।কবরী যাওয়ার সময় ভাঙা মোবাইলটা দেখলেন। যা বুঝার বুঝে নিয়েছেন তিনি। কবরী চলে যেতেই কুহু উঠে ড্রেসিংটেবিল এর কাছে গেল। কলরবের দেওয়া চুড়িগুলো খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। কুহ আলনা থেকে টেনে নিজের একটা উড়না হাতে নিল। তারপর সবগুলো চুড়ি উড়নায় নিয়ে বেঁধে রুম ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো। কুহু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল কলরব না আসা অব্দি ছাদে পাও মাড়াবে না। কিন্তু সে কথা এক সাইডে রেখে ছাদে উঠে এলো সে। ধীর পায়ে এসে রেলিং এর পাশে দাঁড়ালো, যেদিকটায় কলরবদের ছাদ সেদিকটায়। তারপর উড়নাটা সহ চুড়িগুলো কলরবদের ছাদে ছুঁড়ে ফেলল। উড়নার গিঁট দেওয়ার সময় রাগে কুহুর হাত পা কাঁপছিল তাই ভালোভাবে গিঁট দিতে পারেনি। ছুঁড়ে ফেলতেই চুড়িগুলো সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছাদের অনেকখানি জায়গা দখল করলো। কুহু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেটা দেখলো। অনেক অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। কুহুর দৃষ্টি আজ আকাশ পানে হলেও চোখের জলগুলো চিবুক পেড়িয়ে টপটপ করে নীচে পড়ছে। কষ্টের পায়রা বুকের মাঝে বন্দি করে দূর আকাশের ডানামেলা পাখিদের মতন হতে চাইতে মন ব্যাকুল হয়ে আছে। সূর্যটা ধীরে ধীরে ঢলে পড়ছে। কুহু তাকিয়ে আছে, একদৃষ্টিতে। মাঝে মাঝে পলক ফেলছে সাথে কষ্টের ফোয়ারাও নামছে। অনেকটা সময় এভাবে কাটানোর পর কুহু মনে মনে বলল,- আকাশের মতন এমন একটা ছাদ চেয়েছিলাম যেটার নীচে তুমি আর আমি একসাথে থাকবো। একটাই ঘর,একটাই ছাদ, দুজনের ছোট্ট সংসার। কিন্তু তুমি তা হতে দিলে না।দীর্ঘশ্বাস ফেলে কুহু চোখের পানি মুছে ফেলে তারপর বাসায় ফিরে আসে। বেডরুমের দরজা বন্ধ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে আছে সে। মা, বাবা, পিহু বহুবার ডেকেছে। কুহু উত্তরও দিয়েছে কিন্তু শুধু একটা কথাই বলেছে,- আমাকে একা থাকতে দাও।পিহু দরজা ধাক্কিয়ে জিজ্ঞাসাও করেছে কলরবের সাথে কিছু হয়েছে কিনা। কুহু প্রতিত্তুরে জানান দিয়েছে,- কলরবকে যদি এ বাসার কেউ ফোন করে তাহলে কুহুর মরামুখ দেখবে।একথা শুনে বাসার কেউ ভয়ে আর কিছুই জানায়নি। কুহি রাতে কিছুই খায়নি। সবাই অনেক ডেকেছে কিন্তু কুহু নড়লোও না। ক্ষুধা নেই বলে চলে যেতে বলল। কিন্তু কবরী গেলেন না। একনাগাড়ে কুহুকে ডেকেই চললেন। তৈয়ব সাহেবও যোগ দিলেন। শেষে না পেরে কুহু উঠে গিয়ে রাতের খাবার খেয়ে নিল। বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে খেলো,কথাও বলল। কেউ জিজ্ঞাসা না করার পরও নিজ থেকে বলল কলরবের সাথে ঝগড়া হয়েছিল এখন ঠিক হয়ে গেছে। তারপর নিজ থেকেই আবার জিজ্ঞাসা করলো,"কেউ কলরবকে ফোন দিয়েছে কিনা"। কেউ দেয়নি জানতে পেরে আশ্বস্ত হলো। কুহু এর শেষটা দেখতে চায়। কলরবকে কিছুতেই এভাবে ফ্যামিলি থেকে চাপ দিয়ে আনবে না। কিন্তু কলরবেরর সাথে কোনো কথাও বলবে না। বেশিই ভালোবেসে ফেলেছিল সে। এতো ভালোবাসা ঠিক হয়নি। পিহুর মতন ভালোবাসায় অবিশ্বাসীদের কখনোই এতো যন্ত্রণা নেই যতোটা আছে কুহুর মতন প্রেমেজর্জরিতদের। কুহু খুব স্বাভাবিক আচরণ করছে যদিও ভিতরে ভিতরে কুহুর প্রতিটা শিরা উপশিরাও কাঁদছে। খাওয়া দাওয়ার পর কিছুক্ষণ বই নিয়েও বসেছে। কিছুটা পড়েছেও কিন্তু পুরোটা সময় ধরে শুধু কলরবের অবহেলাগুলো মনে পড়েছে আর ভিতরে ভিতরে পুড়ে মরেছে সে। কুহু শুতে যেতেই পিহু মোবাইল নিয়ে এসে বলল,- কলরব ভাই ফোন করেছে তোর মোবাইলে কল ঢুকছে না নাকি।কুহু কথা বাড়ালো না মোবাইলটা হাতে নিয়ে কানে ধরলো। পিহু চলে যেতেই কুহু লাইন না কেটেই মোবাইল বালিশের পাশে রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। ইচ্ছে করেই ঘুমিয়ে পড়েছে যাতে কলরবের সাথে কোনো কথা না বলতে হয়। কলরব কুহুর কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে কল কেটে আবার কল করলো। কিন্তু কল রিসিভ করা হচ্ছে না তাই নিরুপায় হয়ে কুহুর মায়ের মোবাইলে কল করলো। কবরী মোবাইল নিয়ে এসে দেখলেন কুহু ঘুমোচ্ছে। কুহুকে ডাক দিতে নিলে কলরব নিষেধ করে দেয়। ঘুমোচ্ছে ঘুমাক বলে ফোন রেখে দেয়।চলবে...পর্বঃ৬৩,৬৪মাঝরাতের দিকে কুহুর আবার ঘুম ভেঙেছিল। কতক্ষণ এপাশ ওপাশ ফিরে কাঁদতে কাঁদতে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছিলো চুড়িগুলোর জন্য। কলরব কতো শখ করে দিয়েছে। কিছুক্ষণ এসব ভেবে নিজেই মনস্হির করলো যা করেছে ঠিকই করেছে। দরকার নেই এসব আদিক্ষেতার। যে সিচুয়েশনটায় পাশে থাকা জরুরি সেময়ই কলরব পালিয়ে বেরাচ্ছে। দরকার নেই এমন মানুষের দেওয়া উপহার কাছে রাখার। সে কি চাকুরী ছাড়তে বলেছিল? তা তো বলেনি, বলেছে ছুটি নিয়ে আসতে, বিয়েটা হয়ে যাওয়ার পর আবার চলে গেলেই তো পারতো। এতো ঘটা করে বিয়ের দরকার নেই কুহুর। শুধু কলরবকে দরকার কিন্তু কলরবই তো বুঝতে পারছে না। এগুলো ভাবতে ভাবতে আর কাঁদতে কাঁদতে কুহুর একটু চোখ লাগতেই এলার্ম এর শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। হাত বাড়িয়ে এলার্ম বন্ধ করে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলো তারপর উঠে ফ্রেশ হয়ে পিহুকে ডেকে তুললো। পিহু উঠতে চাইলো না কুহু জোর করে উঠিয়ে নামাজ পড়তে বলল। এই শীতের সময় পিহু সকালে উঠতেই চায় না তবে কুহু প্রতিদিনই টেনেটুনে বিছানা থেকে নামায় তারপর ধাক্কিয়ে ওয়াশরুমে পাঠায়। আজও তাই করলো। পিহুকে ফ্রেশ হতে পাঠিয়ে নামাজ সেড়ে নিলো তারপর চুপচাপ কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো। কবরী এসে কুহুকে শুয়ে থাকতে দেখে বললেন,- কিরে পিহু উঠে গেল আর তুই উঠলি না যে?- আমি নামাজ পড়ে মাত্রই বিছানায় এলাম। কবরী মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,- এখন আর শুয়ে থাকতে হবে না উঠে পড়।- মা আমার উঠতে ইচ্ছা করছে না।কবরী কুহুকে টেনে বসালেন। কুহু বিরক্ত হয়ে বলল,- আশ্চর্য আম্মু একদিন শুয়ে থাকলে কি হবে?কবরী হেসে বললেন,- কলরব যে এসে বসে আছে।কুহু মায়ের কথা শুনে হা হয়ে গেল। কুহুর মা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন,- আমার মেয়ের কি তেজরে বাবা! আমি এখনো পারলাম না তোর বাবাকে দিয়ে মতের বিরুদ্ধে একটা কাজ করাতে আর আমার মেয়েতো বিয়ের আগেই বরের মন কেঁড়ে নিয়ে বসে আছে। কি ছোটখাটো ঝগড়া হয়েছে না কি হয়েছে রাতের মধ্যেই এসে হাজির। অন্য যেকোনো সময় হলে কুহু লজ্জা পেত কিন্তু এখন লজ্জা পাচ্ছে না বরং রাগ হচ্ছে খুব। মায়ের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে কুহু আবার শুয়ে পড়লো। কবরী বিস্ময়ভরা কণ্ঠ নিয়ে বললেন,- শুয়ে পড়লি যে? কুহু শান্ত স্বরে বলল,- তুমি আনিয়েছো তাইনা?- আরে না আমি তো ফোনই করিনি। তুই যা বললি তারপর কি আর সাহস আছে নাকি?কুহু কিছু বলল না কাঁথা দিয়ে মুখ ঢেকে চুপচাপ শুয়ে রইলো। কবরী আর কথা বাড়ালেন না। মেয়েকে কষিয়ে দুইটা থাপ্পর দিতে ইচ্ছে করছে কিন্তু দিলেন না। এখন নাস্তার ব্যবস্হা করা উচিত। ছেলেটার অবস্হা হয়েছে দেখার মতন। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। চোখজোড়া ঘুমে ভেঙে আসছে। কলরবকে দেখেই কবরীর খুব মায়া হলো। কুহুর উপর প্রচন্ডভাবে ক্ষিপ্ত তিনি। কি হয়েছে না হয়েছে না জানলেও কবরীর ধারণা কুহু শুধু শুধুই এতো রাগ দেখাচ্ছে। কলরবকে জিজ্ঞাসাও করেছেন কিন্তু কলরব মুখ খুলেনি বরং কথা ঘুরিয়ে নিয়েছে। কবরীও আর বেশি প্রশ্ন করেননি এমনিতে নিজের মেয়ের কর্মকাণ্ডে তিনি লজ্জিত। কুহুর ভাবনা ছেড়ে কবরী রান্নাঘরে কলরবের জন্য খাবার রেডি করতে লাগলেন। পিহু ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো কুহু শুয়ে আছে। কুহুকে ঘাঁটালো না সে। বইখাতা নিয়ে ডাইনিংরুমে চলে এলো পিহু। নামজটা সেড়েই পড়তে বসবে। ড্রয়িংরুমে লাইট জ্বলতে দেখে পিহু মনে করলো বাবা বোধহয় নিভাতে ভুলে গেছে। লাইটের সুইচ অফ করতে ড্রয়িংরুমে যেতেই পিহু কলরবকে দেখলো। ক্লান্ত ভঙ্গিতে সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে সে। পিহুকে ভীষণভাবে অবাক হতে দেখে কলরব হেসে বলল,- কি খবর মৌটুশী?- জ্বি ভাইয়া ভালো, আপনি?কলরব হেসে বলল,- তোমাকে কানে কানে একটা কথা বলি।পিহুর বিস্ময়ভরা চাহনী দেখে কলরব গগনবিহারী হাসি হেসে বলল,- আরে কথার কথা বলেছি আরকি কিন্তু কথাটা সিক্রেট কাউকে বলো না কিন্তু।পিহু অবুঝের মতন বলল,- কি?কলরব সোফা ছেড়ে উঠে এসে পিহুর সামনে দাঁড়ালো তারপর নীচু গলায় বলল,- ফুলটুশী অনেক ক্ষেপেছে। কীভাবে ভালো থাকি বলো তো? ফুলটুশীর সাথে কথা বলতে না পারলে ভালো থাকা কাকে বলে আমি তাও ভুলে যাই।পিহু কলরবের কথায় ম্লান হেসে বলল,- আপুণির রাগ যেমন বেশি আবার মনটাও বেশি নরম। অনেস্টলি একটা কথা বলি আমি যদি আমার বোনের জায়গায় থাকতাম তাহলে আপনার ভাইকে প্রতিবেশীদের দিয়ে মার খাওয়াতাম। ও তো অনেক সহ্য করেছে ইভেন প্রথমে আপনাকে জানাতেও চায়নি পাছে আবার না আপনাদের দুই ভাইয়ের মাঝে প্রব্লেম ক্রিয়েট হয়। পরে নিরুপায় হয়ে জানিয়েছে।কলরব পিহুর কথায় তাল না মিলিয়ে বলল,- আচ্ছা কোমল বললে বেশি ভালো হতো না?পিহু কণ্ঠে হতাশা মিশিয়ে বলল,- আপুণির সঙ্গে থেকে থেকে আপনিও আপুণির মতন হয়ে যাচ্ছেন।কলরব হেসে বলল,- আগে একটা প্রেম করো তারপর বুঝবে।পিহু দুই পাশে হাত নাড়িয়ে বলল,- ওরে বাবা আমি এসব ছঙ করতে পারবো না কখনো।কলরব কিছু বলল না শুধু হাসলো। তারপর বলল,- তা আমার মেডাম কোথায়?- শুয়ে আছে।- ও তো এসময়ে ঘুমায় না শরীর খারাপ না তো আবার?- নাহ্ হয়তো আপনি এসেছেন শুনেছে তাই জিদ করে শুয়ে আছে।- হয়তো! আচ্ছা আমি কি তোমাদের রুমে যেতে পারি? আঙ্কেল আন্টি কিছু বলবেন না তো?পিহু একটু ভেবে বলল,- আম্মু রান্নাঘরে টের পাবে না আর আব্বু তো মসজিদে। - মৌটুশী তুমি মাইন্ড করবে না তো?- নাহ্ দুলাভাইয়ের কোনো কথায় মাইন্ড করা মোটেও ঠিক না।- হুম শ্যালিকার কোনো কাজেও মাইন্ড করা ঠিক না।- ভাইয়া বুঝলাম না।- আমার বাস্কেটবলটা তোমাদের কাছে তাইনা?পিহু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো তারপর ইনিবিনিয়ে কিছু একটা বলতে যাবে তখন কলরব বলল,- মৌটুশী আমি কিন্তু জানতাম। - মজা করে নিয়েছিলাম।- আরে চাপ নিচ্ছো কেনো আমিও মজা করেই বলেছি।পিহু লজ্জায় আর কথা না বাড়িয়ে বলল,- চলুন আপুণির সাথে দেখা করবেন।- হ্যাঁ চলো, মেডামের রাগ ভাঙাতে হবে।কলরব কুহুপিহুর বেডরুমের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পিহুকে বলল,- আগে ফুলটুশীকে জানান দাও আমি আসছি।- আপুণি তো জানেই।- নাহ্ আমি বলতে চাচ্ছি ও তো শুয়ে আছে ওকে বলো আমি কথা বলতে আসছি।পিহু বুঝতে পারলো বিষয়টা। কলরবকে রুমের বাইরে দাঁড় করিয়েই পিহু কুহুকে ডাকলো।- আপুণি উঠ না।- ভালো লাগছে না আমার। - ভালো লাগার মানুষ এসে গেছে।- একদম দালালি করবি না, কয় টাকা খেয়েছিস?- নারে টাকা খাইনি ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেয়েছিলাম। কুহু মুখ থেকে কাঁথা সরিয়ে পিহুর দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। পিহু কুহুর দৃষ্টি উপেক্ষা করে বলল,- কলরব ভাই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে।- আমি কোনো কলরবকে চিনি না।কলরব দরজায় দাঁড়িয়ে সব শুনছিল তাই জবাব দিল,- ভিতরে আসি তারপর চিনে নিও।কলরবের কন্ঠ শুনে কুহু হুড়মুড় করে উঠে বসলো। পায়ের কাছে উড়না পড়ে আছে। তাড়াতাড়ি শরীরে জড়িয়ে পিহুকে বলল,- উনি যেন এখানে না আসেন। এটা তো অফিস না, রাস্তা ভুলে এলেন নাকি?কলরব কুহুকে উঠে বসতে দেখে দরজা ঠেলে ভিতরে চলে এলো। পিহু বলল,- আমি আসছি আর আপুণি আস্তে চিৎকার করিস আম্মু কিন্তু জানে না।কুহু দাঁতে দাঁত চেপে বলল,- আস্তে চিৎকার কীভাবে করে?কলরব পিহুকে তাড়া দিয়ে বলল,- মৌটুশী আস্তে চিৎকার পড়ে বুঝিয়ো এখন যাও তাড়াতাড়ি কথা বলতে হবে আমাদের।কুহু প্রতিবাদী সুরে বলল,- কিসের কথা আমাদের? পিহু কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। উনাকে বল চলে যেতে।পিহু কুহুর কথায় কান না দিয়ে চলে যেতেই কলরব চেয়ার টেনে বিছানার পাশে বসলো। তারপর বেশ রস মিশিয়ে বলল,- কলরবকে চিনো না ফুলটুশী?কুহু কলরবের দিকে তাকিয়ে বলল,- না।- আচ্ছা আমি চিনিয়ে দিচ্ছি। কিচিরমিচিরকে চিনো? ওদের আব্বু। কুহুরব.....- একদম অশ্লীল কথা বলবেন না।- অশ্লীল কথা কই বললাম?- কোনো কথাই বলবেন না আপনি বরং অফিসের বস,কলিগদের ফোন দিয়ে কথা বলুন। - আহা ফুলটুশী চলে এলাম তো।- কেনো এসেছেন জানি তো আম্মু আব্বু ফোন করিয়ে আনিয়েছে তাইনা?কলরব পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে কুহুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,- চেক করো!- মোবাইলটা কিন্তু ভেঙে ফেলবো। - কেনো? - কল হিস্ট্রি ডিলিট করে...- আরে বাবা তোমার বিশ্বাস না হলে একটু পর কল হিস্ট্রির কাগজ তুলে চেক করে নিও। কুহু এবার একটু শান্ত হলো। কুহুর চেহারার পরিবর্তন দেখে কলরব বলল,- ফুলটুশীর কি রাগ পড়েছে?কুহু কোনো কথা বলল না। কুহুর কাছে জবাব না পেয়ে কলরব আবারো একই প্রশ্ন করলো। কুহু এবার চুপ না থেকে কলরবকে পাল্টা প্রশ্ন করলো,- আচ্ছা একটা মেয়েকে জোর করে ছাদে আটকে রাখাটা কি খুব বেশি সাধারণ বিষয়? পিছু নেওয়া, পথ আটকে দাঁড়িয়ে থাকা,বাসা পর্যন্ত চলে আসা, জোর করে হাত ধরে রাখা এগুলো খুব সাধারণ না? হয়তো সাধারণ কিন্তু আমার কাছে এগুলো ভয়ঙ্কর মনে হয়। এরকম পরিস্হিতিতে কোনোদিনও পড়িনি। কাউকে যে বলবো তাও পারছি না। আম্মু,আব্বুকেও বলছিনা কারণ আমি চাচ্ছিলাম না কোনো ভেজাল লাগুক। আপনাকে বলেছিলাম শুধু। ভেবেছি আপনি তাড়াতাড়ি সব ঠিক করে দিবেন। আমি কিরকম ভয়ে ভয়ে দিন কাটাচ্ছি এটা কখনোই বুঝবেন না। কোথায় ভাইকে বুঝাবেন তা না করে আমাকে বুঝাচ্ছেন। আপনি তো কি সুন্দর চাকুরী চাকুরী করছেন আর এদিক দিয়ে আমার জান যায় যায় অবস্হা। কুহু কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে দিলো। কলরব অনুনয় করে বলল,- কুহু তুমি প্লিজ কেঁদো না। তোমাকে কাঁদতে দেখলে বড্ড বেশি যন্ত্রণা হয়।কুহু কান্না না থামিয়েই বলল,- কেনো আসলেন এখন? না আসতেন। কূজনের অত্যাচারে মরে যাওয়ার পর আসতেন। আমি কূজনকে কম বুঝিয়েছিলাম? ভালোবাসা কি জোর করে হয়? উনাকে নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবেন না কতোটা ডেস্পারেট। - কুহু এখন সব ঠিক হয়ে যাবে। দেখো আমি কিন্তু বাসায়ও যাইনি সরাসরি এখানে চলে এসেছি।- কিছু ঠিক হবার দরকার নেই। আপনি ঢাকা যাবেন নাকি বাসায় যাবেন যান। - ফুলটুশী আমি তো তোমার কথায় এসেই পড়লাম।- আর আসা লাগবে না।কুহু কথাটা বলেই বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর দরজা খুলতে নিতেই কলরব পিছন থেকে দরজায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কুহু দরজা টেনেও খুলতে পারলো না। কুহু বিরক্ত হয়ে কলরবের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই কলরব বলল,- তোমাকে না বললাম কেঁদো না। তোমাকে কাঁদতে দেখলে অনেক বেশি কষ্ট হয়। এখন কিন্তু তোমাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হচ্ছে। পরে আমাকে কিন্তু কোনো দোষ দিবে না।- একদম ঢং করবেন না। মিথ্যাবাদী, ফাঁকিবাজ লোক কোথাকার! এখন কীভাবে চলে এলেন? চলে আসাটা না অসম্ভব?- আরে ফুলটুশী বহু কষ্টে চাচা,মামার জোর খাটিয়ে এসেছি।- চাকুরীটা গেছে না আছে?- আছে সুরভীর খালু হেল্প করেছে তাই আসতে পেরেছি।কুহু ভয়ার্ত দৃষ্টি নিয়ে বলল,- সুরভীটা কে?কুহুর এমন ভয় পাওয়া দেখে কলরব গগণবিহারী হাসি হেসে বলল,- আরে আমার ব্যাচমেট। তাছাড়া ও ম্যারেড আমার বন্ধু রঞ্জুর উয়াইফ।কুহু সামান্য কেশে বলল,- এতে এতো হাসার কি আছে?কলরব আহ্লাদী স্বরে বলল,- নাহ্ নেই তবে প্রেম জাগার আছে গো!কুহু এবার আস্তে করে বলল,- আপনি আজকেই ঢাকা চলে যাবেন আমার সমস্যা নেই।- হায় খোদা এখনো ফুলটুশীর রাগ ভাঙলো না?- ভেঙেছে! আপনার গগণবিহারী হাসি দেখেই ভেঙে গেছে।- তাহলে চলে যেতে বলছো যে?- নাহ্ মানে আজকেই বিয়েটা সেড়ে ফেলুন তারপর আপনি ঢাকা ব্যাক করুন সমস্যা নেই। পারলে আমাকেও সাথে নিয়ে চলুন আর না নিতে পারলেও কোনো সমস্যা নেই। আপনার বউ হতে পারলেই হলো। আমার সব টেনশন কমে যাবে। - আরে নাহ্ ম্যানেজ করেই এসেছি সমস্যা নেই।কুহু নাছোড়বান্দার মতন বলল,- প্লিজ কলরব এতো ঘটা করে বিয়ের দরকার নেই। পরে বড্ড বেশি দেরি না হয়ে যায়! আমার খুব ভয় হচ্ছে কলরব। কূজন আমাদের বিয়েটা কোনোভাবেই হতে দিবে না। প্লিজ কলরব কিছু একটা করুন। কলরব কুহুর দিকে আরো এগিয়ে এসে বলল,- কিছু একটা না অনেক কিছুই করতে ইচ্ছে হচ্ছে।কুহু কলরবকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলল,- সবসময় ফাজলামি ভালো লাগে না।কলরব বলল,- তুমি একটু আগে আমাকে তিনবার কলরব বললে।কলরবের কথায় কুহু পাত্তা না দিয়েই বলল,- বললে বলেছি এখন প্লিজ বলুন বিয়েটা তাড়াতাড়ি করবেন নাকি?- এতো তাড়াহুড়া কিসের তোমার?- কেনো জানেন না?- আচ্ছা বাবা দেখি কি করা যায়।- একদম দেখি কি করা যায় এমন কথা বলবেন না। শুনলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। - ইশ্ ফুলটুশীর নাকের ডগায় রাগ ঝরে ঝরে পড়ে। এত্তো রাগ?কুহু দরজা ঢেলে বের হতে হতে বলল,- কত্তো রাগ জানেনও না। - কোথায় যাচ্ছো?- চুড়ি আনতে যাচ্ছি।কলরব অবাক হয়ে বলল,- মানে?কুহু অপরাধীর মতন বলল,- বেশি রাগ উঠে গিয়েছিল তাই আপনার দেওয়া চুড়িগুলো ফেলে দিয়েছিলাম।- কিহ্?কুহু অসহায়ের মতন কলরবের দিকে তাকিয়ে থাকলো। কুহুর চোখজোড়ায় পানি টলমল করতে দেখে কলরব বলল,- এই বোকা মেয়ে আমি রাগ করিনি। - আমি এখনি নিয়ে আসছি। আপনাদের ছাদে ফেলেছিলাম। সেগুলো সেখানেই থাকবে। কেউ তো আর নিতে আসবে না। আপনি প্লিজ রাগ করবেন না।কলরব হেসে বলল,- আমার কি ফুলটুশীর মতন এতো রাগ আছে নাকি? ওগুলো আর আনা লাগবে না আমি নতুন কিনে দিব।- নাহ্ লাগবে।- বললাম তো লাগবে না। পুরোনো জিনিসের দিকে ফিরে তাকাতে নেই। আমার ফুলটুশীর জন্য নতুন এনে দিব।- নাহ্ আমার নতুন কিছু লাগবে না কিন্তু ঐ চুড়িগুলোই লাগবে।- তুমি আমার কোনো কথা শুনো না কুহু।- আচ্ছা বাবা ঐগুলোও লাগবে না। আমার না কিছুই লাগবে না শুধু মিসেস ইবনাত কলরব হতে পারলেই চলবে।কুহুর কথায় কলরব আর কুহু দুজনেই একসাথে হাসতে লাগলো। কবরী তা দেখে শান্তি পেলেন। কুহুর এরকম রাগের কারণেই কুহুকে নির্ভেজাল কূজনের কাছে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। যাতে সংসারে চলতে কষ্ট না হয় কিন্তু আজ কলরবকে দেখে মনে হলো কলরব কুহু আর তার পরিবারের মাঝে সবসময় ব্যালেন্স রেখে চলতে পারবে,ভবিষতে তেমন কোনো সমস্যা নেই। চলবে...::#একটুখানি--- লামইয়া চৌধুরী।পর্বঃ৬৪কলরব কুহুর কথায় সত্যি সত্যি দুদিনের মাঝে বিয়ের ব্যবস্হা করলো। কবরী আর তৈয়ব সাহেবের মাথায় যেন বাজ পড়লো। কি থেকে কি করবে না করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। সাহরা তো বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই প্ল্যানিং করা শুরু করে দিয়েছিলেন তাই বেশি বেগ পেতে হচ্ছে না। কিন্তু কুহুর মা বাবা ভেবেছিলেন কলরব ফিরে এলে তারপর সব আয়োজন করবে। কলরবের ফিরে আসার পরও হাতে সপ্তাখানেক এর সময় ছিল কিন্তু হঠাৎ করে কলরব ফিরে এসে দুদিন এর মাঝে বিয়ের প্রস্তুতি নিতে বলল। তৈয়ব সাহেব মানতে চাইলেন না কিন্তু কবরী রাজি করিয়ে ফেলেছে। কলরব কুহুদের বাসা থেকে ফিরেই সাহরাকে বুঝিয়ে ম্যানেজ করে নিয়েছে। আর সাহরা রাজি করিয়েছে কবরীকে। তারপর শপিং শুরু করে দিয়েছে। পরের দিন হলুদ আর এরপরই বিয়ে। তৈয়ব সাহেবের মন বেজায় খারাপ। খুব ধুমধাম করে বড় মেয়ের বিয়ে দিবে ভেবেছিলেন কিন্তু তা আর হলো কোথায়। তারপরো মনকে মানিয়ে নিয়েছেন। মেয়ে চোখের সামনেই থাকবে আর কলরবকে তো তিনি প্রথম থেকেই খুব বেশি পছন্দ করেন। কলরব যেহেতু চাচ্ছে তাই আর বেশি জোর খাটালেন না। ইরিনের তো উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। শপিং এর সময় কুহু যেতে চায়নি কিন্তু সাহরা জোর করে সাথে নিয়েছেন। কুহু আবার পিহুকে ছাড়া যাবে না তাই পিহুও সাথে গেল। কলরবকে বলতে হয়নি সে নিজ থেকে সেধেই সাথে গিয়েছে। সাহরা কূজনকে সাথে নিতে চেয়েছিলেন কিন্তু কূজন আসেনি, কলরবও বেশি কিছু বলেনি। কুহুর খুব শখ ছিল বিয়েতে লাল বেনারসি পরবে কিন্ত কলরব চাচ্ছিল মেরুন লেহেঙ্গা তাই কুহু লেহেঙ্গাই নিলো। কলরব আবার মশকারা করে বলেছেও,- ফুলটুশী! তোমার ইচ্ছাটা তোমার ননদিনীর উপর চাপিয়ে দিয়ো।ইরিন রাগত স্বরে বলেছে,- কেনো আমাকেই সবসময় খোঁচাও তুমি? পিহু আপুকে পাও না?কলরব গগণবিহারী হাসি হেসে বলে,- মৌটুশী! কি বলো তোমারটা আমি চয়েজ করতে পারলে কেমন হতো?পিহু উত্তরে শুধু হাসলো বেশি কিছু বললো না। সবার সাথে কথা বলে তার এতো অভ্যাস নেই। কিন্তু যার সাথে বলে তার আবার কান শেষ করে ফেলে। কলরব এর পছন্দেই সব কেনাকাটা হয়েছে। তবে কলরবের শেরওয়ানি আবার ইরিন পছন্দ করে নিয়েছে। কূজনের জন্যও ইরিন একটা শেরওয়ানি নিয়েছে। কলরবকে পেয়ে কুহু কূজনের কথা প্রায় ভুলেই গেছে। কুহুর জন্য নতুন গহনা গড়ে ফেলেছিলেন তাই সাহরাকে আর গহনা নিয়ে টেনশন করতে হয়নি। কুহুর মাও বিয়ে ঠিক হওয়ার পরই এ কাজ সেড়ে ফেলেছিলেন। তাই ঝামেলা কিছুটা হলেও কম ছিল। হাসনাদ সাহেব না এলেও জাহরা হলুদের দিন এসে পড়েছেন। হাসনাদ সাহেবকে ইফতেখার সাহেব অনেক বলার পরও আসেননি তবে পিড়াপিড়ির জ্বালায় বলেছেন বিয়ের দিন আসবেন, বিজনেসের কাজে ব্যস্ত তাই হলুদে অাসতে পারবেন না। কলরবদের ছাদে কলরবের হলুদ এর অনুষ্ঠান হচ্ছে, বেশ ধুমধাম করেই হচ্ছে। আত্মীয়পরিজন, ব্বন্ধু-বান্ধব,পাড়া প্রতিবেশী সবার উপস্হিতিতে কলরবদের বাড়ি মুখোরিত। ইরিন,সাহরা এমনকি কূজনের গানেও হলুদ সন্ধ্যা মেতে উঠেছে। সোনার হরিণের আবদারের কাছে কূজনকে হেরে অনিচ্ছা থাকা স্বত্বেও গান গাইতে হয়েছে। অন্য দিকে কুহুর হলুদ হচ্ছে খুব সাধারণভাবে। ছাদে হলুদের অনুষ্ঠান করতে কুহুর সম্মতি ছিল না। বাসায় খুব সাধারণভাবেই কুহুর গায়ে হলুদ সম্পন্ন হয়েছে। সুরভী,ইরিন, রঞ্জু, কলরবদের বাড়ি থেকে কুহুর জন্য গায়ে হলুদের তত্ত্ব নিয়ে এসেছিল। সাহরা আর ইরিনের জোরাজুরিতে কূজনকেও আসতে হয়েছে। কূজনকে দেখেই কুহুর চেহারা মলিন হয়ে গিয়েছিল। কূজন যতক্ষণ ছিল কুহু আর পিহু দুজনই আতঙ্কে ছিল। কুহু পিহুকে একবারের জন্যও কাছ ছাড়া হতে দেয়নি আর পিহুও বোনের গা ঘেঁষেই বসে ছিল। মেয়েরা সবাই হলুদ ছোঁয়ানোর পর সুরভী সবার আগে কূজনকে আর রঞ্জুকে নিয়ে এলো। কুহুকে হলুদ ছোঁয়ানোর কথা বলতেই কুহু নীচু স্বরে স্পষ্ট ভাষায় বলল,- সুরভী আপু মনে কিছু করবেন না। ভুল হলে দয়া করে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আসলে ধর্ম সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে আসেনি বরং পরিশুদ্ধ করতে এসেছে। অনেকে বলে হলুদের অনুষ্ঠান হিন্দু সংস্কৃতি তবে আমি বলি কি এটা হলো বাঙালি সংস্কৃতি। আরবীদেরও বিয়ে নিয়ে কিছু সংস্কৃতি আছে। যেমন ধরুন ওয়ালিমা অনেকটা বউভাতের মতন তবে সেখানে নববধূ নিজ হাতে রান্না করে সব মানুষকে খাওয়ায়। আবার বিয়ের আগে মেয়ে তার পরিবার সহ তার হবু বরের পুরো বাড়ি দেখে আসে এরকম অনেক কিছুই আছে। এগুলো কিন্তু ইসলামের রীতি নয় আরবদেশের রীতি। তবে ইসলাম এখানে কিছু পরিশুদ্ধ নিয়ম বেঁধে দিয়েছে যেমন মেয়ে একা হবু বরের বাড়ি যেতে পারবে না মারহাম সহ যেতে পারবে। তাই আমি মনে করি আমি একজন বাঙালি তাই আমার বিয়েটাও বাঙালী রীতিতেই হোক। আমি কিন্তু অনেকের মতন বলবো না হলুদ আমাদের ধর্মে নেই বা নিষিদ্ধ তবে ধর্ম মেনে মারহাম ব্যতীত অন্য কাউকে হলুদ ছোঁয়াতে দিব না। আমি আমার কাজিনদেরও দেইনি। আমরা হয়তো অনেক কিছুই মেনে চলি না তবে যা মানতে পারি তাই বা কম কিসে? আপু আপনি কি আমার কথায় রাগ করেছেন?সুরভী ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলেছে,- তুমি আসলেই অন্যরকম, কলরব ঠিকই বলেছিল।কুহুর কথাগুলো শুনে বাড়ির মালিকের বউ কুহুর মাকে গিয়ে বললেন,- ভাবী আমার ছেলেগুলো এখনো উপযুক্ত হয়নি নয়তো কখনো আপনার মেয়েকে হাত ছাড়া করতাম না। যাক বড়টা না হোক ভাগ্যে যদি ছোটজনকেও পাই।কবরী ভিতরে ভিতরে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলেন কিন্তু সামনাসামনি হেসে কথাটা উড়িয়ে দিলেন। মেয়ের মায়েরা কোনো এক অজানা কারণেই কেনো যেন মেয়ের জন্য বিয়ের সমন্ধ আসলে খুশি হয়ে যান, সে বিয়ে দিক আর না দিক। এটা যেন সব মেয়ের মায়েদের রক্তে মিশে আছে। কবরীও এর ব্যতিক্রম নন। সুরভী তো কুহুদের বাসা থেকে যেয়েই কলরবকে বলল,- বাব্বা দোস্ত তোর ফুলটুশীর যে এতো রাগ বুঝাই যায় না। কি সুন্দর করে কথা বলে! কলরব মুচকি হেসে বলল,- ফুলটুশী সবার সাথে রাগ দেখায় না যাদের খুব বেশি ভালোবাসে শুধু তাদের সাথে দেখায়।- দোস্ত তুই না ঠিক বলেছিলি কুহুকে প্রথম দেখায় আহামরি মনে হয়নি। কিন্তু কুহু যখন কথা বলল তখন তাকে সত্যি আহামরি মনে হয়েছে। আসলেই তোর ফুলটুশী ভারী মিষ্টি। দেখতেও কিন্তু বেশ। - ঝালও বটে।সুরভী কলরবের কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে করে বলল,- দোস্ত টেস্ট করেছিলি নাকি?- নারে করিনি। মন খালি আঁকুপাঁকু করে কিন্তু ঐ যে ফুলটুশী হলো ফুলটুশী তাই স্পর্ধা দেখাতে পারি না।- আহারে আমি তোকে বীরপুরুষ ভাবতাম।কলরব কলার নাচিয়ে বলে,- নিজেকে যেভাবে গুটিয়ে রাখি তাতে শতভাগ বীরপুরুষ আমি।সুরভী হেসে বলে,- কথার তেজ তোর কোনেকালেই কমেনিরে ভাই।সুরভীর কথায় কলরব গগনবিহারী হাসি হাসে, সুরভীও সে হাসিতে যোগ দেয়। ...ব্যস্ততার কারণে কুহু মোবাইল পিহুর কাছে দিয়ে রেখেছে। তাছাড়া বিয়ে বাড়িতে মোবাইল জিনিসটা মোটেও সেইফ না। তাই পিহুর কাছে গচ্ছিত রেখেছে। আগের মোবাইল ভেঙে ফেলেছে শুনে কলরবই নতুন মোবাইল কিনে দিয়েছে। কুহু নিতে চায়নি কিন্তু কলরব গগণবিহারী হাসি হেসে বলেছে,- তোমার বিয়ের উপহার ফুলটুশী।কুহু কলরবেরর কথায় অনেক্ষণ হেসেছিল তারপর আর না করেনি নিয়ে নিয়েছে। কলরবই তো! অন্য কেউ তো আর না। পিহু মোবাইলে গেমস খেলে চার্জ শেষ করে ফেলেছে তাই মোবাইল চার্জে দিলো। চার্জারের পিন মোবাইলের সাথে কানেক্ট করতেই আননোউন নাম্বার থেকে একটা মেসেজ এলো। পিহু মেসেজ পড়ে হতবাক হয়ে আছে। কূজনের মেসেজ। শুধু এক লাইনই লিখেছ। " কুহু তুমি বউবেশে ঐ বাড়িতে পা রাখবে আর আমার লাশ বেরুবে"চলবে....পর্বঃ ৬৫,৬৬মেসেজটা পড়েই পিহুর হাত পা কাঁপা শুরু করলো। কাঁপা হাতেই মেসেজটা ডিলিট করে দিয়ে নাম্বারটা ব্লক লিস্টে ফেললো। তারপর মোবাইল চার্জার পিন থেকে খুলে ফেললো। চার্জ না দিয়েই মোবাইল ওয়ারড্রবের ড্রয়ারে কাপড়ের ভাঁজে রেখে দিলো। এই শীতের রাতেও পিহুর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগলো। হাতের উল্টোপিঠে ঘাম মুছে পিহু এক গ্লাস পানি খেলো তারপর বসে ভাবতে লাগলো। কুহুকে একদম জানানো যাবে না। কুহুর কানে কথাটা পৌঁছুলে নিশ্চয় অঘটন ঘটবে। পিহু ভাবছে কলরবকে জানানো দরকার কিন্তু কলরবকে জানালে কলরব যদি কূজনের কথা ভেবে বিয়ে ভেঙে দেয়? নাহ্ কলরব এমনটা তো কখনোই করবে না আবার করতেও পারে। মানুষের মন আর আকাশের রঙ! অবশ্য কলরবকে পিহুর কাছে খুব স্ট্রং ক্যারেকটারের মনে হয়। কিন্তু ঝড় এলে বড় গাছটায় কিন্তু ভেঙে পড়ে, ছোট গাছগুলো টলতে টলতেও টিকে রয়। উঁহু পিহু কখনোই এ রিস্ক নিবে না। কলরব বিয়ে ভেঙে দিলে কুহু পাগল হয়ে যাবে। আর কুহুকেও জানাবে না সে। জানালে আবার কি থেকে কি করে তার ঠিক নেই পরে আবার নিজেই পস্তাবে। পিহু সিদ্ধান্ত নিলো কুহু কিংবা কলরব কাউকেই কিছু জানাবে না। কিন্তু কূজন যদি সত্যি এরকম স্টেপ নেয় তাহলে তো ভয়ংকর পরিস্হিতির স্বীকার হতে হবে সবাইকে। কূজন শুধু শুধু কুহুকে ম্যানেজ করার জন্য ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করছে না তো? নাকি সত্যি মনে এমন কোনো ভাবনা আছে? থাকতে পারাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কূজন তো প্রেমে ছন্নছাড়া হয়ে আছে। পিহুর কাছে মনে হচ্ছে মহাবিপদের শুরু মাত্র,সামনে বহু কিছু বাকি। এই জন্য পিহু প্রেম ভালোবাসা নামক নেশা থেকে দূরে থাকে। তাছাড়া পৃথিবীতে প্রেম, ভালোবাসা এগুলো আছে বলে পিহুর মনে হয়না। জাস্ট কয়েকদিনের আর্কষণ বৈকি আর কিছুই নয়। এই যে কুহু কলরব একে অন্যের জন্য পাগল এগুলো হলো তীব্র আর্কষণের ফলাফল। কূজনও কুহুকে পাওয়ার জিদ ধরেছে। মরীচীকার পিছনে ছুটার নামই প্রেম। কবরীর ডাকে পিহুর ভাবনায় ছেদ পড়লো। - হুম মা বলো।- কিরে এ ঘরে কি করছিস? কুহুর কাছে যা। পরে যখন দূরে চলে যাবে তখন কেঁদে কেটেও খুঁজে পাবি না।পিহু মুখ ভেঙচিয়ে বলল,- শখ কতো তোমার মেয়েকে কোন দুঃখে মিস করতে যাব?- যখন করবি তখন ঠিকই বুঝবি।- আপুণি তো বান্ধবীদের সাথে তাই আসলাম। আপুণির বান্ধবীদের মাঝে বসে থাকতে বোরিং লাগে। - তারপরো যা। কুহুকে তো চিনিস মেয়েটা কতো কোমল হৃদয়ের।পিহু যেতে যেতে বলল,- এই কোমলতাই কাল হয়ে দাঁড়াবে একদিন।কবরী হেসে বললেন,- নারে দেখিস মেয়েটা সত্যি ভালো থাকবে। যার মন এতো ভালো তার জন্য উপরওয়ালা আছে। পিহু কথা বাড়ালো না। কুহুর কাছে যেয়ে বসলো। কুহুর গুটিকয়েক বান্ধবী আছে তবে বেস্টফ্রেন্ড টাইপ এর তেমন কেউ নেই। পিহুর ওদের কথা শুনতে খুব বেশি বোরিং লাগলেও কুহুর পাশে বসে আছে। কেনো যেন কুহুর দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছে। লাবণ্যতা আর কোমলতা চেহারা জুড়ে ঝেঁকে বসে আছে। চোখ জোড়ায়ও কেমন যেন নির্মলতা, গভীর ভালোবাসা ধরা দেয়। পিহু কুহুকে দেখছে আর ভাবছে "কুহুর কপালে সুখ সইবে তো? পিহুর কেনো যেন মনে হয় ভালো মানুষগুলো পৃথিবীতে বেশিদিন সুখী হয়ে থাকতে পারে না। পৃথিবী বড়ই স্বার্থপর। পৃথিবী ভালো মানুষগুলোকে একা করে দিয়ে নিজে সেই মানুষগুলোর নিসঙ্গতায় সঙ্গী হয়। পৃথিবী যে নিসঙ্গতা পছন্দ করে! "কুহু বান্ধবীদের সাথে কথা বলতে বলতেই পিহুকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখলো। পিহুকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কুহু চোখের ইশারায় কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করলো। পিহুও ইশারায় কিছু হয়নি বললো। কিন্তু কুহু পিহুকে জড়িয়ে ধরলো তারপর হঠাৎ করেই কাঁদতে লাগলো। পিহু হেসে বলল,- শুধু শুধু কাঁদছিস কেনো? ভাব দেখে মনে হচ্ছে বহুদূর চলে যাচ্ছিস। পাশের বাড়িতেই তো পড়ে থাকবি। দূরে বিয়ে হলে আমার জ্বালা কমতো। পিহুর কথা শুনে কুহুর কান্না আরো বেড়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতেই যেন কিসব বলল। কান্নার চোটে কুহুর বান্ধবীরা পুরো কথা ক্লিয়ারলি বুঝেনি কিন্তু পিহু ঠিকই বুঝে নিয়েছে। ছোটবেলায় পিহু বোনের বিয়ের ছুটি চেয়ে দরখাস্ত,বোনের বিয়েতে বান্ধবীকে দাওয়াত দিয়ে চিঠি এসব পড়ার সময় ইচ্ছে করে জোরে জোরে পড়তো। চিৎকার করে পড়া যাকে বলে। পাশের ফ্ল্যাট থেকেও শোনা যেত। কুহু লজ্জায় আর রাগে পিহুকে অনেক বকতো কিন্তু পিহু নিজের কাজ চালিয়েই যেত,কুহুর কথায় কান দিতো না। একদিন কুহু স্যারের কাছে পড়ছিল আর পিহু ভিতরের রুমে বসে বসে ইচ্ছে করে উচ্চস্বরে এই দরখাস্ত আওড়াচ্ছিল। কুহু লজ্জায়, রাগে মরে যাচ্ছিল। স্যার চলে যাওয়ার পর পিহুকে মেরেও ছিল,পিহুও পাল্টা আক্রমণ করেছিল। কিন্তু তারপরো সে এই কাজ ছাড়েনি। এখনো মাঝে মাঝে এমন করে। পিহু এর মাধ্যমে এক পৈশাচিক আনন্দ পায়। কুহু এই কথাগুলোই বলল। পিহুর এবার কান্না এসে গেল। পিহুও ফুৃঁপিয়ে কাঁদলো। পিহুকে কাঁদতে দেখে কুহু বলল,- এই মেয়ে একদম কাঁদবি না। কাঁদলে মনে হয় তুই মেকাপ করে এসেছিস। পিহু কুহুর কথা শোনে হেসে ফেললো। কুহুর বান্ধবীরা চেয়েছিল কুহুকে তাদের সঙ্গে রাখতে কিন্তু কুহু থাকলো না,সে পিহুর সাথে ঘুমোবে। রাতে কুহু পিহুকে জাপটে ধরে ঘুমিয়েছে। পিহু হাজার ধাক্কিয়েও সরাতে পারেনি। কুহুর এক কথা,- "আজকে তোকে জড়িয়ে ঘুমাবো। তোর যতোই দম বন্ধ হয়ে আসুক আর বিরক্ত লাগুক।"পিহুও নিরুপায় হয়ে মেনে নিলো। কিন্তু কুহুকে কয়েকশতো কথাও শুনিয়ে দিয়েছে। কুহুর অবশ্য এ কথাগুলোতে কখনোই রাগ হতো না আজো হয়নি। পিহু ভয়ে ভয়ে ছিল রাতে আবার না কুহু মোবাইল চেয়ে বসে। কিন্তু কুহু মোবাইল চাইলো না। কলরবেরর সাথে তো কথা বলার জন্য সারাজীবন পড়েই আছে কিন্তু পিহুকে খুব বেশি মিস করবে সে। তাই পিহুর সাথেই আজ রাতে গল্প করবে। কলরবকে অবশ্য কুহু একবার বলেছিল যে বিয়ের আগের রাতটা কুহু তার বেস্ট ফ্রেন্ডের পিহুর সাথেই কথা বলে পার করবে। এজন্য হয়তো কলরবও আর ফোন দেয়নি।চলবে...:::#একটুখানি--- লামইয়া চৌধুরী।পর্বঃ৬৬কলরব অনেকক্ষণ ধরে কুহুর সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে। গতকাল রাতে ফোন দেয়নি। কুহু বলেছিল পিহুর সাথে সারারাত গল্পগুজব করবে। তাই আর ফোন করেনি। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠেই কুহুকে একের পর এক কল দিয়ে যাচ্ছে। বিছানা ছেড়েও উঠেনি কলরব। কুহুর ফোন বন্ধ পেয়ে কলরব পিহুর ফোনে কল করলো। কুহুকে ফোনে পাচ্ছে না কেনো জানতে চাইলে পিহু বলল,- আপুণির মোবাইলে চার্জ নেই আর ফোন কোথায় রেখেছি খুঁজে পাচ্ছি না।হয়তো মা রেখেছে। মা তো এখন ব্যস্ত তাই জিজ্ঞাসাও করতে পারছি না। - সমস্যা নেই মৌটুশী। কিন্তু তোমার মোবাইলটা ফুলটুশীকে দাও তো। - আচ্ছা ভাইয়া দিচ্ছি কিন্তু মনে হয়না আপুণির বান্ধবীদের জ্বালায় কথা বলতে পারবেন।কলরব হেসে বলল,- দেখি পারি কিনা।পিহু কুহুকে ফোন ধরিয়ে চলে এলো। - হ্যালো! ফুলটুশী কি অবস্হা?- জ্বি ভালো।- আমি কেমন আছি জিজ্ঞাসা করলে না?- খারাপ থাকার কোনো কারণ আছে কি?- অবশ্যই আছে।কুহু আতঙ্কিত গলায় বলল,- কেনো কি হয়েছে আবার?- জানো না আমার তো মরি মরি অবস্হা! - ওহ্ এখন ঐ ডায়ালগটা মারবেন তাইনা?- কোন ডায়ালাগ??- ওই যে পুরুষ মানুষ দুই প্রকার। জীবিত আর বিবাহিত।কলরব কুহুর কথায় গগণবিহারী হাসি হেসে বলল,- নাহ্ আমি আসলে বলতে চাচ্ছিলাম তোমার সাথে কাল রাতে কথা বলিনি যে তাই।কুহু লাউড দিয়ে কথা বলছে। বান্ধবীরা আসলে কাজটা করেছে। ওরা শুনবে কলরব কি বলে। কলরবের কথা শুনে কুহুর বান্ধবীরা সব মুখ চেপে হাসছে।কুহুরও মজা লাগছে। কিন্তু কি বলে কথা কন্টিনিউ করবে ভেবে পাচ্ছে না। কুহুকে চুপ থাকতে দেখে কলরব বলল,- তোমার বান্ধবীরা তো আমাদের কথা শুনছেই তাই ওদের সাথেও কথা বলি, কি বলো ফুলটুশী? তুমি আবার রাগ করবে না তো?কুহুর বান্ধবী নীরা কুহুর হাত থেকে খপ করে মোবাইল নিয়ে বলল,- এতো ভয় পান কেনো?কলরব বলল,- নাকের ডগায় রাগ যে? পরে রেগে গেলে আমার ফুলশয্যার বারোটা বাজবে।- তাই তো বলি।- আরে শ্যালিকারা আমি তো আগে ভাবতাম বিয়ের পর ঝগড়া হলে আমি দরজা বন্ধ করে বসে থাকবো। ফুলটুশী আমার রাগ ভাঙাবে কিন্তু এখন দেখছি আমার ইচ্ছা আর পূরণ হচ্ছে না। ফুলটুশী মজার মজার রান্না করে আমার রাগ ভাঙাবে তো দূরের কথা উল্টো আমারি রাগ ভাঙাতে হবে। - কীভাবে রাগ ভাঙাবেন বলুন দেখি।- বলা যাবে না।- কেনো?- উঁহু বলবো না।- আচ্ছা বলা লাগবে না কিন্তু ফুলশয্যা নিয়ে কি প্ল্যান বলে ফেলুন।কুহু নীরার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালো তারপর বলল,- এখন রাখছি।নীরা বলল,- না না তোর ভালো না লাগলে নেই আমরা কথা বলছি তো।কলরব হেসে বলল,- আচ্ছা রাখি।নীরা বলল,- এই না বউকে এতো ভয় পেতে নেই। আমরা আপনার সাথে আছি তো সমস্যা নেই।কলরব কুহুকে উদ্দেশ্য করে বলল,- ফুলটুশী বলেই ফেলি। ওরাও তো তোমারি বান্ধবী। ওদেরও হয়তো তোমার মতোই নাগের ডগায় রাগ। না বললে যদি রাগ করে তোমাকে বাজে করে সাজিয়ে দেয় তখন কি করবো বলো?নীরা বলল,- হুম আমাদের নাকের ডগায় রাগ না থাকলেও রাগ তো আছেই ঠিক না? এখন বলে ফেলুন তো??- কলরব কেশে বলল,"যেমন আছ তেমনি এসো, আর কোরো না সাজ।বেণী নাহয় এলিয়ে রবে, সিঁথি নাহয় বাঁকা হবে,নাই-বা হল পত্রলেখায় সকল কারুকাজ।আঁচল যদি শিথিল থাকে নাইকো তাহে লাজ।যেমন আছ তেমনি এসো, আর করো না সাজ।"এইটুকু শুনাবো ফুলটুশীকে।নীরা কুহুকে চিমটি কেটে বলল,- তোর রবীন্দ্রনাথ!কুহু লজ্জা পেয়ে বলল,- রবীন্দ্রনাথ না ছাই!তারপর নীরার হাত থেকে মোবাইল নিয়ে কল কেটে দিলো। নীরা বলল,- তোর কলরব দেখি বেশিই স্মার্ট।কুহু লাজুকভাবে বলল,- সবসময় বেশি বুঝে। আমাকে বলতেই হয় না কিছু।কুহু কথা বলতে বলতেই দেখলো পিহুর মোবাইলে মেসেজ এলো। কুহু মেসেজ ওপেন করে পড়লো," কুহু! তুমি নতুন রঙে জীবন রাঙাও।আর ক্ষণে ক্ষণে আমায় পুড়াও।জীবন্ত লাশ হয়ে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই শ্রেয়।কূজন!"মেসেজ দেখে কুহুর হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে এলো। মাথা ঘুরতে লাগলো। নীরাকে বলল,- একটু পানি খাওয়া তো।- হুম আনছি কিন্তু তুই এভাবে কাঁপছিস কেনো?আরেকজন বলল,- ফুলশয্যার কথা শুনেই ভয় পেয়ে গেছে।হাসির রোল পড়লো ঘরে কিন্তু কুহুর ভয়ে গলা শুকিয়ে গেলো। কোনোমতে বলল,- বড্ড পিপাসা পেয়েছেরে।নীরা বলল,- আচ্ছা আনছি।কুহু মেসেজটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখজোড়ায় একরাশ ভয়। এর মাঝেই এই নাম্বার থেকে আবার কল এলো। কুহু রুম ছেড়ে বারান্দায় চলে এলো। সবাইকে বলেছে কলিগ ফোন করেছে নয়তো আসতে পারছিল না। কলরবের ফোন ভেবে আটকে রেখেছিল। কুহু বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোন রিসিভ করলো। কাঁপা গলায় বলল,- হ্যালো!কূজন ফোনের ওপাশ থেকে বলল,- যাক তোমাকে পেয়েছি। ফোন বন্ধ করে রেখেছিলে তো তাই ভাবলাম মরার আগে তোমার সাথে শেষবারের মতন কথাও বলতে পারবো ন।কুহুর মুখ দিয়ে কোনো কথা আসছে না। তবুও বহু কষ্টে বলল,- কি বলছেন এসব?- কেনো জানো না? আজই তো আমার জীবনের সবচেয়ে বড়দিন। এদিনটায় মরবো বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আচ্ছা আমি না চেয়েছিলাম ছাদ থেকে লাফ দিতে কিন্তু বেঁচে যাওয়ার চান্স আছে। বিষ খেলেও বেঁচে যেতে পারি। তাই ভাবলাম ফাঁসি দিয়ে মারা যাব। কূজনের কথা শুনে কুহুর হাঁটু ভেঙে আসলো। পা গুলোতে শক্তি পাচ্ছে না যেন। ধপ করে বসে পড়লো কুহু। কূজন আরো বলল,- আমি কিন্তু সত্যি বলছি কুহু। তিন সত্যির পরো যে সত্যি থাকে জানো তো? কুহু এবার কেঁদে দিলো। কাঁদতে কাঁদতেই বলল,- আপনি না আমায় ভালোবাসেন? - হুম বাসিতো তাই তো মরে যাব।- প্লিজ চুপ করুন কূজন। এরকম কথা বলবেন না। যদি সত্যি ভালোবাসেন তাহলে আমার জন্য বাঁচুন।- তুমি অন্য কারো বুকে মাথা রাখবে, জীবনের গল্প গুলো তাকেই শুনাবে আমি সেটা সহ্য করতে পারবো না কুহু। বিশ্বাস করো কুহু আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না। আমার বুকের ভিতর যে কিরকম কষ্ট হচ্ছ তা তুমি বুঝবে না কুহু। আমি চাইলেই কলরব ভাইকে মেরে ফেলতে পারি কিন্তু ভাই তো আমার।কলরবকে মেরে ফেলার কথা বলার সময় কূজনের গলা ধরে এসেছিল। কুহু সেটা শুনে আকুতির স্বরে বলল,- প্লিজ ওকে কিছু করবেন না।- আরে না ভাই হয় আমার। ভাইকে কীভাবে মেরে ফেলি বলো? কিন্তু অনুভূতি গুলোকেও যে মারতে পারছি না। আমার প্রতিটা নিঃশ্বাস তোমার জন্য গুঁমড়ে কাঁদে। এই বুকের মাঝে এতো বেশি যণ্ত্রনা যে আর নিতে পারছি না কুহু। একদিকে ভাই,অন্যদিকে তুমি। তাই বলছি নিজেকেই মেরে ফেলি সবচেয়ে ভালো হবে।কুহু বলল,- প্লিজ এমন করবেন না।- তুমি কলরব ভাইকে বিয়ে করো না প্লিজ। আমি সহ্য করতে পারবো না।কুহু ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। তারপর বলল,- আমি কলরবকে ছাড়া বাঁচবো না। আপনি কেনো জোর করছেন?- আমি জোর করিনি কুহু মিনতি করছি। জোর করতে চাইলে কবেই তোমাকে জোর করে বিয়ে করতে পারতাম। - ইমোশনাল ব্লেকমেইল করছেন।- নাহ্ আমি শুধু জানান দিচ্ছি এই কূ্জন কুহুকে কতো ভালোবাসে। শুনুন আমার আগের ডায়রিটা যেটায় কবিতা লিখেছিলাম সেটা পুড়িয়ে ফেলেছিলাম। আরো দুইটা আছে যেগুলোতে কবিতা নেই কিন্তু শুধু তোমাকে নিয়েই অনেক লেখা। ওগুলো তোমার আর ভাইয়ের বিয়ের উপহার। বাবা মা হয়তো তোমাকে খুব দামি কিছু গিফ্ট করবে কিন্তু আমার পক্ষ থেকে আমার অনুভূতিগুলোই দিব। আমার কাছে এগুলোর চেয়ে দামি কিছুই আর নেই। আমার লাগেজে রেখে যাব পরে নিয়ে নিও। আমায় তো আর ভালোবাসবে না কখনো কিন্তু মাঝে মাঝে ডায়েরীর পাতায় চোখ বুলিয়ো। বহুদূর থেকে আমি এতেই সুখ খুঁজে নিব। কিন্তু জীবদ্দশায় তোমাকে অন্য কারোর হতে দেখতে পারবো না।- প্লিজ একটু শান্ত হোন।- নাহ্ আমি অনেক চেয়েছি কিন্তু পারছি না নিজের সঙ্গে। বেঁচে থাকলে হয়তো তোমার আর ভাইয়ের ক্ষতি করবার ইচ্ছা জাগতে পারে। আমি না আসলেই কেমন পাগলের মতন হয়ে গেছি। বিশ্বাস করো অনেক লড়াই করেছি নিজের সাথে কিন্তু তোমাকে ছাড়া বাঁচা অসম্ভব। রাখছি জানালার পাশের কুহু! ভালো থেকো আর মাঝে মাঝে আমায় নাহোক আমার অনুভূতিগুলোকে ভালোবেসো।কুহু কিছু বলতে পারলো না। এর আগেই কূজন ফোন বন্ধ করে দিলো। কুহু মোবাইল হাতে নিয়েই কাঁদতে লাগলো। চুল টানতে লাগলো তারপর নিজের গালেও কয়েকটা চড় দিলো। চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। নীরা পানি নিয়ে এসে কুহুকে এই অবস্হায় দেখে পিহুকে ডেকে নিয়ে এলো। তারপর দুজন মিলে কুহুকে স্বান্তনা দিতে লাগলো। কবরীও এসে মেয়েকে বুঝাচ্ছেন এটাই মেয়েদের জীবন,আর কিছু পেতে হলে কিছু ছাড়তেই হয়। ভালোবাসার ঘর বাঁধতে স্নেহের বন্ধন হৃদয়ে নিয়েই দূরে চলে যেতে হয়। আর কুহু তো কাছেই থাকবে। যখন ইচ্ছা চলে আসতে পারবে। কুহুকে এসব বুঝিয়ে সবাই চুপ করালো। তারপর পার্লারে পাঠাতে চাইতেই কুহু গেল না। কুহু কাঁদতে কাঁদতে আধা মরা হয়ে আছে। পার্লারে যাওয়ার মতন কোনো মানসিকতাই নেই। তাই কবরী পার্লার থেকে বিউটিশিয়ান বাসা নিয়ে এলেন। কুহু সাজতে চাইলো না জোর করে সাজালো। সাজানো শেষ হতেই বিউটিশিয়ানকে নিয়ে পিহু বাইরে গেল। কুহুর বান্ধবীরাও সবাই সাজতে ব্যস্ত। কুহু দরজা বন্ধ করে একে একে সব গহনা খুলে ফেললো। তারপর সব আলমারিতে রেখে আলমারি থেকে ব্যাগ নামালো। কিছু কাপড় চোপড় নিলো, আর কুহুর কাছে যা টাকা ছিল নিয়ে নিলো। ইরিন,কোচিং আর স্কুল এর বেতন জমিয়ে কুহুর কাছে বেশ ভালো অঙ্কের টাকা আছে। এছাড়া সবসময় যে কানের দুল জোড়া পড়তো সাথে নিয়ে নিলো। পিহু রুমের দরজা ধাক্কা দিতেই দেখলো ভিতর থেকে আটকানো। তাই কুহুকে ডাকলো। কুহু দরজা খুলেই পিহুকে টেনে ভিতরে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। পিহু কুহুকে দেখে বলল,- কিরে সব গহনা খুলে ফেলেছিস যে? সারাদিনই কিন্তু এই ভারি জিনিসগুলো পরে রাখতে হবে। কীভাবে পরে থাকবি এগুলো?কুহু বলল,- তুই খেয়েছিস?- নাহ্ এতো তাড়াতাড়ি নাকি?- আচ্ছা আমার না ক্ষিধে পেয়েছে একটু খাবার নিয়ে আয় তো।পিহু খাবার নিয়ে আসতেই কুহু নিজ হাতে মেখে পিহুকে খাইয়ে দিলো। পিহু খেতে চাইলো না কিন্তু কুহু খাওয়ালো নিজেও দুই এক লুকমা মুখি দিলো। খাওয়া শেষ হতেই কুহু বলল,- আমি চলে যাচ্ছি পিহু।- হুম তা তো জানি আবার প্লিজ কান্না কাটি শুরু করিস না।কুহু পিহুকে আঙুলের ইশারায় ব্যাগটা দেখালো তারপর সব বলল। পিহু সাথে সাথে ঝাড়ি দিয়ে বলল,- তোর আসলে নিজেই ঠিক নেই। কয়েকদিন কলরব কলরব করে পাগল ছিলি আবার আজকে কূজন কূজন শুরু হয়েছে। এতো কারখানা করে ঢাকা থেকে ডেকে আনলি, দুদিনে বিয়ের ব্যবস্থা করলি আর এখন কূজনের হাত ধরে পালিয়ে যাচ্ছিস।কুহু শান্ত স্বরে বলল,- আমি কারোর সাথে পালিয়ে যাচ্ছি না, সবার থেকে পালিয়ে যাচ্ছি।- গাধামী করিস না আপুণি। কূজন মরলে মরুক তোর কি?কুহু কিছু বললো না। ওড়না দিয়ে পিহুর হাত মুখ সব বাঁধলো। পিহু হঠাৎ করে কিছুই বুঝতে পারলো না। যখন বুঝলো ততক্ষণে কুহু পিহুকে টেনে বাথরুমে নিয়ে আরো আঁটসাঁট করে বাঁধলো। তারপর পিহুর সারা মুখে চুমু দিয়ে বলল,- সরি! পিহুন। সোনা বোন আমার আমি যেখানে যাওয়ার সেখানে যেয়েই সবাইকে ইনফরম করে দিব। তারপর তুই ছাড়া পেয়ে যাবি। আর এর আগে জানাজানি হয়ে গেলেও সবাই তোকে খু্ঁজে বের করবে। আর খাইয়ে দিয়ে গেলাম কতক্ষণ থাকতে হয় তাই। আসলে কিছু করার নেই। পিহু কিছু বলার চেষ্টা করছে কিন্তু মুখ বাঁধা তাই বলতে পারছে না। কুহু ইচ্ছে করে মুখের বাঁধন খুলছে না কারণ সে জানে পিহুর কথা শুনলে আর যেতে পারবে না সে। পিহুর চোখ দিয়ে অজস্র পানি ঝরছে। কুহু পিহুর চোখের পানি মুছে দিয়েই বাথরুমের দরজা আটকে বেরিয়ে পড়লো। তারপর ব্যাগ হাতে বেরুতে যেয়েও থমকে দাঁড়ালো। আলমারি খুলে রেখে যাওয়া গহনাগুলো থেকে কলরবের মায়ের দেয়া টিকলি আর নিজের মায়ের দেয়া বালা জোড়া নিয়ে নিলো। টিকলি আর বালা জোড়া পরে দরজা খুলে বেরুতেই কুহুর ভাই সঞ্জুর বউ বললেন,- ননদিনী কিসের ব্যাগ? আর গহনা খুলে ফেলেছো যে?কুহু হেসে বলল,- ভাবী আমার স্কুল এর কলিগরা এসেছে। ওদের এগিয়ে আনতে যাচ্ছি।- উমা তুমি কেনো যাবে? দাঁড়াও আমি সঞ্জুকে বলছি।- ভাইয়া কেটারিং এর কাজে ব্যস্ত তাছাড়া আমি পিহুকেই পাঠিয়েছিলাম কিন্তু ও আসলে এই ব্যাগটা নিতে ভুলে গেছে।- কি এটায়?- পরীক্ষার খাতা। কিছু দেখা শেষ কিন্তু বিয়ের পর কয়েকদিন তো ছুটিতে থাকবো তাই যা সবগুলো দেখতে পারবো না। কিছু দেখেছি আর কিছু বাকি। পিহু নিতে ভুলে গেছে ভালোই হলো। আমি যেগুলো দেখা হয়নি সেগুলো আলাদা করে বুঝিয়ে দিতে পারবো যে এগুলো দেখতে হবে আর এগুলো না।- সিরিয়াল মেন্টেন করে দেখোনি কেনো?- আসলে ভুল করেছি।- ওরা আসলেও তো দিতে পারতে।- নাহ্ যাকে দিবো সে বিয়েতে আসতে পারবে না। উনার আবার নিকটাত্মীয়র বিয়ে এখানে শুধু খাতাটা নিতেই এলেন আর তাই ভিতরেও আসতে চাইছেন না।- ওহ্ তাহলে যাও দিয়ে দাও।- হুম গলির ভিতর বোধহয় এসেও গেছে আমি যাই। আর গহনাগুলো পরে আমি নীচে যাব না ভয় করে তাই খুলে রেখেছি। আমি আসলে আমাকে পরিয়ে দিও।কুহু ভাবীকে এ কথা বলে বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছে। কবরী আর তৈয়ব সাহেব কাজে ব্যস্ত তাই ওদের মুখোমুখি হতে হয়নি। কুহু বাসা থেকে বেরিয়ে বাড়ির পিছন দিকের কাঁচা রাস্তা দিয়ে চলে এসেছে। গলির রাস্তায় যায়নি। পিছন দিকের রাস্তায় মানুষের চলাচল নেই কিন্তু কুহু রাস্তাটা চিনে। দুই বোন শর্টকাটের জন্য এই রাস্তা দিয়ে প্রায় যায়,হেঁটে যেতে হয় আরকি, রিকশা নেই তেমন একটা। কুহু হেঁটে হেঁটেই রাস্তাটা পেরুলো তারপর মেইন রাস্তায় উঠে রেলস্টেশনে যাওয়ার জন্য রিকশা ঠিক করে উঠে পড়লো।চলবে....পর্বঃ৬৭কুহু স্টেশনে নেমে খোঁজ নিলো চিটাগাং এর ট্রেন কয়টায়। ভাগ্য ভালো ছিল তাই টিকিট পেয়ে গেল কিন্তু স্ট্যান্ডিং। কুহু ভাবছে কীভাবে এতদূর দাঁড়িয়ে যাবে। দাঁড়িয়ে যাওয়ার শক্তি তার অবশিষ্ট নেই। তাছাড়া একটা মেয়ে বধূবেশে সারা রাস্তা দাঁড়িয়ে যাবে উদ্ভট দেখায়। কুহু অবশ্য গায়ে চাদর জড়িয়ে রেখেছে তারপরো ওর সাজ দেখলেই মানুষ বুঝে ফেলবে। কুহু মনে মনে ভেবে নিলো কেউ কিছু প্রশ্ন করলে বলবে সে থিয়েটার করে। কুহু নিজেই বুঝতে পারছে না ও এতোসব কীভাবে করছে, বানিয়ে বানিয়ে হাজারটা মিথ্যেও বলছে। এতো মিথ্যা কথা সে তার এতো বছরের জীবনেও মনে হয় বলেনি। ভাবিকে কিরকম ধোকা দিয়ে এসেছে সে। আল্লাহ্ ক্ষমা করবে তো? নাকি এর শাস্তি পেতে হবে তাকে? কুহুকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। দুই লাইন হওয়ায় এখন ট্রেন অনেকটাই ঠিক সময়ে পৌঁছায়। ভাগ্যিস কুহু সময় মতো ডিসিশন নিয়েছে। একটু পর এলেও এ ট্রেনটা পেতো না সে। তখন আবার বাসে যেতে হতো। এমনিতেই কুহু বাস জার্নি করতে পারে না,বমি হয় তার উপর আজ কুহুর শরীর চলছে না। কোনোরকম ধাক্কিয়ে চলছে। ট্রেনে উঠতেই কুহু ব্ল্যাকে সিট সহ টিকিট পেয়ে গেল। কুহু মনে মনে আল্লাহকে হাজারবার ধন্যবাদ জানালো। কুহুর আজকের সিটটাও জানালার পাশের সিট। জানালার পাশে বসেই কুহু দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কূজনের বলা জানালার পাশের কুহু কথাটা মনে পড়লো। কুহুর কাছে কূজনের সাথে দেখা হওয়ার দিনটা আজ বিভৎস এক স্মৃতি। সেদিনের এই একটুখানি পরিচয়ে কূজন কুহুর জীবন লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। সেদিন বোধহয় কূজনকে হেল্প না করলেই ভালো হতো। কুহুকে আজ এতো কষ্টের মাঝে থাকতে হতো না। কুহুর জীবনটাও সাধারণ নিয়মেই চলতো। কুহুর দৃষ্টি স্টেশনের প্লাটফর্মের দিকে। ট্রেনটা প্লাটফর্ম ছেড়ে ধীরে ধীরে সামনে এগুচ্ছে আর কুহু চেয়ে ভাবছে সেও নিজের নিজেকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু মা ঠিক বলে কিছু পেতে হলে কিছু ছাড়তে হয়। ট্রেন এই স্টেশনে পড়ে থাকলে সামনের স্টেশনে পৌঁছুতে পারবে না। কুহুও তাই আজ ছেড়ে চলছে। এসব থেকে বহুদূরে চলে যাবে সে। এসব ভাবতে ভাবতেই কুহু ব্যাগ থেকে পার্স বের করে মোবাইল বের করলো। আসার সময় কুহু নিজের মোবাইলটা খুঁজে পায়নি তাই পিহুরটা নিয়ে এসেছে। আফসোস হতে লাগলো মোবাইলটার জন্য, কলরব দিয়েছিল। কলরবের কথা মনে পড়তেই কুহুর চোখ জোড়া ভিজে উঠলো। দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে অঝরে কাঁদতে লাগলো। ট্রেনের নিচে পড়ে মরতে পারলে বোধহয় শান্তি পেতো। বুকের ভিতর এক নিদারুণ কষ্ট এসে হানা দিচ্ছে। কান্নার দাপটে কুহু কোলাতে পারছে না। কাঁদতে কাঁদতেই কুহু পার্স থেকে কলরবের দেওয়া আয়নাটা বের করলো। আয়নাটায় হাত বুলিয়ে চেহারার সামনে ধরলো তারপর বলল,- আমি একদম কাঁদবো না, কলরব একদম না। কাঁদলে তো তোমার ফুলটুশীকে তোমার কাছে ভালো লাগে না তাই কাঁদবো না।কুহু দুহাত দিয়ে নিজের চোখের পানি মুছে আয়নাটা সযত্নে পার্সে রেখে দিল। এরপর মুখস্হ একটা নাম্বার মোবাইলে ডায়াল করলো। দুবার বাজতেই ওপাশ থেকে মোবাইল রিসিভ করা হলো। - হ্যালো! আসসালামু আলাইকুম কে বলছেন?কুহু বলল,- এটা কি সোনালী আপুর নাম্বার?- জ্বি আপনি কে বলছেন?- বুবু আমি কুহু।- আরে কুহু এটা তো তোর নাম্বার না।- হুম আমার বোনের নাম্বার।আমি না চলে আসছি বুবু।- শ্বশুরবাড়িতে এসেই বুবুকে ফোন দিলি মনটা খুশি হয়ে গেল। ভাগ্যিস আমার কথা মনে আছে নয়তো কেরাত বেত জুটতো তোর কপালে।- আমি তোমার কাছেই চলে আসছি বুবু। - ওমা ঘুরতে আসছিস? চিটাগাং তো ঘুরারই জায়গা। ভালো করছিস তা কলরব এর অফিস ম্যানেজ করে আসিস কিন্তু। তুই তো আবার আমার রাগী ছানাপাখি।- আমি বাসা থেকে পালিয়ে এসেছি বুবু,বিয়ের আসর থেকে।- কি বলছিস কি?কুহু সবটা খুলে বলল। কুহুর কাছ থেকে সব শুনে বলল,- এমন ভুল কেউ করে নাকি?- বুবু তুমি প্লিজ এমন বলো না। আমি এছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না। বেশি দিন না তোমার বাসায় কয়েকটা দিন থাকবো তারপর পরিস্হিতি ঠাণ্ডা হওয়ার পর যা করার করবো। আচ্ছা তুমি এলে না যে বিয়েতে? তাহলে আমার এতো কষ্ট করে পালাতে হতো না, তুমি হেল্প করতে।- আরে আমার ছোট ছানাটার যে জ্বর তাই আসতে পারিনি তুই আবার আমার সাথে রাগ দেখাতে আসবি না তাহলে কেরাত বেতের বারির চোটে অবস্হা খারাপ হয়ে যাবে।কুহু হাসতে চাইলেও হাসতে পারলো না। অন্যসময় একথা শুনেই কুহু এমন রাক্ষসী হাসি হাসতো শিউর পাশের বগিতেও হালকা পাতলা হাসির শব্দ শুনা যেত। আজ আর সেই হাসি আসছে না। কুহু কথা শেষ করে মোবাইল রেখে দিলো। জানলায় মাথা ঠেকিয়ে ভাবছে এই সোনালী আপুর সাথেও তো পরিচয় এই হেল্প করা নিয়েই এমনকি রেল স্টেশনেই দেখা হয়েছিল। সোনালী আপুর মোবাইল আর পার্স ওয়েটিংরুমে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল। পার্সে বেশ ভালো টাকা ছিল। পরে কুহুর চোখে সেটা পড়তেই কুহু মোবাইল আর পার্স ফিরিয়ে দিয়েছিল। সোনালী আপুকে খুঁজতে খুঁজতে কুহু নিজের ট্রেনই মিস করেছিল। সাথে পিহু ছিল কুহুকে ইচ্ছে মতন বকেছিল সে। পরে বাসে করে যেতে হয়েছে তাদের। সারারাস্তা পিহুর কথা শুনতে শুনতে আর বমি করতে করতো গিয়েছিল। বিয়ের দাওয়াত ছিল কিন্তু অসুস্হ হয়ে যাওয়ায় মজা করতে পারেনি। কিন্তু এতোকিছুর পর ভালো যেটা সেটা হলো উনার সঙ্গে একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। নিয়মিত যোগাযোগও হয়। বিয়ের দাওয়াত দিয়েছিল কিন্তু সোনালী আপু আসতে পারেননি। পিহু ঠিক কথা বললেও সবসময় সে ঠিক না। কূজনকে হেল্প করতে যেয়ে কুহু যেমন ফেসেঁছে ঠিক তেমনি সোনালী আপুকে হেল্প করে নতুন একটা কাছের মানুষও পেয়েছে। সবসময় কোমলতা খারাপ না কিন্তু কখনো কখনো তা কন্টকময় পথের সিঁড়িও বটে।- ফুলটুশী!- হুম।- চলে এলে যে?কুহু কিছু বলল না। চুপ করে চোখ বন্ধ করে রইলো। কলরব আবার বলল,- ফুলটুশী উঠো না? চোখ খুলো!কুহু ঘুম ঘুম চোখে চোখ মেললো। চোখ খুলেই দেখলো কলরবকে। কুহুর সামনের সিটে বসে আছে। রয়েল ব্লু রঙের মাঝে গোল্ডেন কাজ করা শেরওয়ানী সাথে গোল্ডেন পাগড়ী। পাগড়ীতে খুব সুন্দর একটা ব্রোঞ্জ। কলরবকে দেখেই চোখ জুড়িয়ে গেল কুহুর। কুহুর কাছে কলরবকে খুব বেশি সুন্দর লাগছে। কুহু নানান কথা ভাবতে ভাবতে ট্রেনের জানালার সাথে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কলরবকে দেখে কুহু ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল,- শুনেছিলাম বউ সাজে মেয়েদের দেখে নাকি মানুষ চোখ ফেরাতে পারে না। আজ দেখলাম বর সাজে কোনো ছেলের থেকেও যে চোখ সরানো যায় না। তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে কলরব।- কুহু! প্লিজ জানালার পাশের সিটটায় একটু বসতে দিবে?কুহু ধড়মড় করে জানালা থেকে মাথা উঠিয়ে চারিদিকে চোখ বুলালো। কূজনকে দেখেই কুহু আরো চেপে বসলো। তাড়াতাড়ি করতে যেয়ে কুহুর মাথা জানালায় বারি খেতে নিতেই কলরব হাত দিয়ে কুহুর মাথা সরিয়ে দিলো। কূজনের দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে কুহু। কুহুর বুকের ভিতর ঢিপঢিপ আওয়াজ হতে লাগলো। চোখ সরিয়ে সামনের সিটে মুখোমুখি হয়ে বসে থাকা কলরবকে দেখলো। কুহু ভেবেছিল কুহু ঘুমের ঘোরে কলরবকে স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু কলরব যে সত্যি বসে আছে তা দেখে কুহুর হাত পা কাঁপতে লাগলো। একবার কলরবের দিকে একবার কূজনের দিকে তাকাচ্ছে সে। কুহুর চোখ জোড়ায় একরাশ ভয় এসে গ্রাস করেছে। কুহু বাইরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বুঝলো ট্রেনটা চলন্ত। ঢোক গিলে সে কলরবের দিকে তাকালো। তারপর বলল,- আপনারা এখানে?কলরব বলল,- তুমি এখানে যে? তোমার তো এখন আমার বাসায় থাকার কথা ছিল।কুহু কূজনের দিকে আবারো ভয়ার্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকালো। কুহুকে তাকাতে দেখে কূজন বলল,- জানালার পাশে ছাড়া আমার বসে অভ্যাস নেই, কাইন্ডলি?কুহুর শরীরের কাঁপুনী আরো বাড়তে লাগলো কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না।কূজন উত্তরের আশায় কুহুর দিকে চেয়ে আছে কিন্তু কুহু কলরবের দিকে চেয়ে আছে। কলরব উঠে দাঁড়িয়ে বলল,- কূজন! তুই নাহয় এখানে বস। এটাও জানালার পাশের সিট।কূজন কলরবের সিটে বসে বলল,- ধন্যবাদ ভাই।কলরব কুহুর পাশে বসলো। তারপর বলল,- কুহু তুমি পালিয়ে এলে কেনো?কুহু কোনো উত্তর দিচ্ছে না, চুপ করে নতমুখ নিয়ে বসে আছে। কুহু কোনো উত্তর দিচ্ছে না বলে কলরব কুহুকে ধমকে উঠলো। কড়া গলায় বলল,- কথা বলছো না কেনো? জবাব দাও বলছি। একদম মুখ খেটে বসে থাকবে না।কুহু কলরবের ধমক শুনে আৎকে উঠলো। অসহায় দৃষ্টিতে কলরবের দিকে তাকিয়ে রইলো। কুহুকে এভাবে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে কলরবের মেজাজ আরো চাউড় হলো। কুহুকে আরো কঠিন স্বরে বলল,- তুমি কি জানো তুমি যে পাগল? আস্ত একটা গাধী তুমি। এখন আবার দেখছি বয়রা আর বোবাও। কি আশ্চর্য কোনো কথার জবাব দিচ্ছো না কেনো?কলরবের ধমক শুনে কুহু বলল,- আমি পাগল নাকি আপনার ভাই পাগল? আমাকে এভাবে ধমকাচ্ছেন কেনো? আমি কি করেছি?কুহু কথা বলতে বলতে কেঁদে দিলো। চোখ থেকে একের পর এক পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। কুহুকে কাঁদতে দেখে কলরব অপ্রস্তুত হয়ে গেল। অস্হির হয়ে বলল,- কেঁদোনা প্লিজ!কুহু কান্না থামালো না বরং চোখ থেকে আরো বেশি পানি ঝরাতে লাগলো। কলরব কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলল,- সামনে একটা স্টেশন আছে ট্রেন থামবে সেখানে আমরা নেমে পড়বো।কুহু বলল,- না আপনারা নেমে পড়ুন আমি নামবো না।- কেনো আমাদের দুই ভাইকে পিছন পিছন ঘুরিয়ে এখন নতুন নাগর পেয়ে গেছো? কলরবের কথা শুনে কুহু স্তব্ধ হয়ে গেল। কলরব আরো বলল,- এটাই যেহেতু মনে ছিল তো এতো প্যাচাল পারলে কেনো?কুহু অবাক হয়ে বলল,- কলরব এসব কি বলছেন?- কি বলছি মানে তুমি চলে এলে কেনো তাহলে? আর কোথায় যাচ্ছো তুমি?- আমি তো চট্টগ্রাম যাচ্ছি,হালিশহর। সেখানে আমার এক বড় আপু আছে।- আমাকে ঢাকা থেকে এতো প্রেশার দিয়ে এনে দুই দিনের মাঝে সব ঠিক করে এখন তুমি কেনো পালাচ্ছো? আনসার মি কুহু।কুহু কিছুটা রেগে গেল এবার। রাগতস্বরেই বলল,- কেনো জানেন না? আপনার এই ভাই আমাকে থ্রেট দিয়েছে।- কি থ্রেট দিয়েছে?কুহু এবার প্রচন্ডরকমের চিৎকার করে বলল,- কি থ্রেট দিয়েছে তাকেই প্রশ্ন করুন। আপনার গুনধর ভাই তো এখানেই আছে,জানালার পাশে। যতসব ঢং!কুহুকে এভাবে চিৎকার করতে দেখে কলরব বলল,- আস্তে কথা বলো। আশেপাশের মানুষ তাকিয়ে আছে।কুহু চারিদিকে তাকিয়ে দেখলো মানুষ সত্যি তাকিয়ে আছে। লজ্জায় কুহুর মাথা কাটা যাচ্ছে। এভাবে মানুষ কথা বলে নাকি? কুহু তাই চুপ করে ফেললো। কলরব বলল,- সামনের স্টেশনে আমরা নেমে যাব তারপর আবার ফেণী ব্যাক করবো।কুহু বলল,- না আমি ফেণী যাব না, আর কোনো বিয়েও হবে না।- তোমার মোবাইলে একটা মেসেজ এসেছে চেক করো তো।কুহু রাগে লাল হয়ে বলল,- করবো না।কলরব কুহুর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,- তুমি যদি এখন ভালোই ভালোই আমার সাথে না এসো তাহলে আমি কিন্তু বাধ্য হবো..কুহু ভ্রু কু্ঁচকে কলরবের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।কলরব গলার স্বর আরো নীচু করে ফিসফিস করে বলল,- তোমার লেহেঙ্গার টপসের ফিঁতাটা খুলে ফেলবো। কলরবের কথা শুনে কুহু দূরে ছিটকে গেল। লজ্জায় আর রাগে কুহু মুখ তুলে তাকাতেই পারছে না। কলরব কুহুকে আর ঘাঁটালো না। বাদামওয়ালাকে বলল বাদাম দিতে। কূজন আর কুহুর জন্যও নিলো। কূজনকে বাড়িয়ে দিতেই কূজন চুপচাপ নিয়ে নিলো এমনকি কুহুও নিলো কিন্তু হাতে নিয়েই বাদামগুলো ফেলে দিলো। কলরব কিছুই বলল না, মন দিয়ে বাদাম খেলো। স্টেশনে ট্রেন থামতেই কলরব বলল,- কূজন! তুই যা নেমে তোদের ড্রাইভারকে বল চলে আসতে। তাহলে তাড়াতাড়ি যেতে পারবো আমরা। - আচ্ছা ভাই আমি নামছি।কূজন চলে যেতেই কলরব কুহুকে বলল,- চলো ফুলটুশী।- আমি যাব না।কলরব কিছু না বলে কুহুর পিছনে হাত নিতেই কুহু ধরমর করে উঠে দাঁড়ালো। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বলল,- ফাজলামির একটা সীমা থাকা দরকার।কলরব সিট ছেড়ে দাঁড়িয়ে কুহুর ব্যাগটা নিয়ে বলল,- চলো!কুহু কিছু বলল না কলরবের সাথে নেমে এলো। প্লাটফর্মে নেমে কলরব কূজনেকে খুঁজতে লাগলো। এতো ভিড়ের মাঝে খুঁজে পেলো না। ট্রেন স্টেশন ছাড়তেই স্টেশনের ভিড় কমে গেল। কূজনকেও দেখতে পেলো। কূজন কলরব আর কুহুকে দেখতে পেয়ে ওদের কাছে এলো। - কিরে কতোক্ষণ লাগবে?- এক ঘণ্টা সর্বোচ্চ।- ভালোই হলো এই সময়ে সবটা ক্লিয়ার করে নিতে পারবো। কূজন কিছু বলল না। নিরবতা ভেঙে কলরব বলল,- ফুলটুশী! তোমার সাথেই কথাটা।কুহু অন্যদিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে। কুহুর কলরবকে এই মুহূর্তে মেরে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। কথার কোনো শ্রী নেই এই ছেলের। ফালতু ছেলে এক নাম্বারের। কলরব কুহুর সামনে দাঁড়িয়ে বলল,- ভালোবাসো?কুহু কলরবের চোখে চোখ রেখে বলল,- না বাসি না।- আচ্ছা কাকে ভালোবাসো না আমাকে নাকি কূজনকে?- শুনুন আমি জীবনে একজনকেই ভালোবেসেছি আর সে মানুষটা আপনি।- একটু আগে যে বললে বাসো না?- ওইটা তো এমনি বলেছি।- নাহ্ এমনি এমনি বলোনি সত্যিটাই বলেছো।- নাহ্ কলরব আমি আপনাকেই ভালোবাসি। এভাবে বলবেন না প্লিজ।- কুহু! যদি ভালোবাসতে তাহলে পালিয়ে আসতে না।- কূজন বলেছে মরে যাবে তাই চলে এসেছি। আর আমি তো উনার সাথে আসিনি। তাহলে এমন প্রশ্ন কেনো করছেন?- কূজন মরুক কিংবা বাঁচুক তাতে তোমার কি? তুমি তো ওকে কোনো আশা দাওনি। তাহলে ওর জন্য এতো চিন্তা কিসের তোমার?- কি বলছেন এসব? একটা মানুষ আমার জন্য মরতে বসবে আর আমি বুঝি সুখের সংসার সাজাবো? আমি কি এতোটাই স্বার্থপর?- বাহ্ কূজনের কথা ভেবেছো কিন্তু আমার কথা ভেবেছো কি? তুমি যে আমায় ধোকা দিলে আমিও তো সুইসাইড করতে পারি,পারি না?কুহু কাতর হয়ে বলল,- এগুলো কি বলছেন? আপনারা দুইজন আমাকে পেয়েছেন কি? আমাকে একেকজন অপশন দিয়ে বলছেন একটা অপশন আমাকে চুজ করো। দ্বিতীয় অপশন নয়তো মরে যাব। কলরব কুহুকে থামিয়ে দিয়ে বলল,- আমার কথা নাইবা ভাবলে নিজের পরিবারের কথা ভেবেছো? মানুষ তো এখন তোমার বাবা মায়ের মুখে চুনকালি দিবে। আমার পরিবারের কথা তো বাদই দিলাম। নিজের বোনটার কথাও ভাবোনি। হাত,পা বেঁধে বাথরুমে আটকে দিয়ে পালিয়ে এসেছো। দুদিন পর যখন মেয়েটার বিয়ের বয়স হবে তখন সবাই বলবে ওর বড় বোন যে কান্ড ঘটিয়েছিল সেও একই কাজ করবে। কার কথা ভেবেছো তুমি?- আমি না এসব ভেবে দেখিনি। যা মাথায় এসেছে তাই করেছি। এসব কথা তখন ভাববার সময়ই ছিল না। কলরব তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,- শুধু কূজনের কথা ভাবতেই সময় ছিল। কূজন ভালোবেসেছিল আমি কি বাসিনি? - কলরব এমন করে বলছেন কেনো আমি তো কূজনকে ভালোবাসি না। - আলবাত বাসো! নয়তো এতগুলো মানুষের চিন্তা ছেড়ে শুধু ওর চিন্তা করতে না।কুহু কলরবের কথা শুনে অঝরে কাঁদতে লাগলো। ফু্ঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতেই বলল,- আমি শপথ করে বলছি আমার আর কূজনের মাঝে এরকম কিছুই নেই। আমি আপনাকে নিয়েই স্বপ্ন দেখেছিলাম আর আপনাকেই ভালোবাসি। আপনি তো জানেন আমি অতোশতো বুঝি না। যখন যা ভালো মনে হয় তাই করি।- হুম এটাই সমস্যা। হঠাৎ করে তোমার আমাকে ভালো মনে হলো আর সেটাতেই ভালোবাসি ভালোবাসি বলতে লাগলে। আদৌ ভালোবাসো কিনা মনের খোঁজ নাওনি। আমাকে তো তুমি প্রথম থেকেই অপছন্দ করতে। আমি সেধে সেধে তোমার পিছনে পড়ে থাকতাম। পরে ভেবেছি সত্যি ভালোবাসো কিন্তু ভুল ছিল আমার। তুমি শুধু আমার সাথে টাইমপাস করেছো।কুহু ধীর গলায় বলল,- কলরব!- এটাই সত্যি কুহু। তুমি আমাকে কখনোই ভালোবাসোনি। আমাকে নিয়ে খেলেছো।কুহু ব্যাকুল হয়ে বলল,- আপনি যদি বলেন আমি এখন ট্রেনের নিচে চাপা পড়তেও রাজি। আপনাকে কতোটা ভালোবাসি বলে বুঝাতে পারবো না। আপনার জন্য সব করতে পারবো।- দেখাই যাচ্ছে!- আপনি আমাকে বিশ্বাস করছেন না কেনো?- শুনো তুমি মনে করে দেখো প্রথম থেকেই তুমি কূজনকে পছন্দ করতে আর আমার জন্য মনে ছিল শুধু তিক্ততা। তোমার চাহনীতেই বুঝা যেত তুমি আমাকে ফালতু একটা ছেলে ভাবতে।- হ্যা্ঁ সত্যি কিন্তু এখন তো আপনাকে এমন মনে করি না। আপনাকে সবচেয়ে ভালো মানুষ মনে হয়। - শুনো বাস্তবতা মেনে নিতে শিখো। তুমি জাস্ট আমার প্রতি এটরাকটেড ছিলে। তুমি আর আমি বিপরীত মেরুর মানুষ তাই আমার প্রতি একটা আকর্ষণ ছিল তোমার। আর এটাকে ভালোবাসা বলে চালিয়ে দিয়েছো। আসলে তুমি না জানো ভালোবাসা কি আর না ভালোবাসতে জানো।কুহু এবার কলরবকে কিছু না বলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কূজনের দিকে তাকালো। অফ হোয়াইট এর মাঝে সোনালী কাজ করা একটা শেরওয়ানীর সাথে মেরুন রঙের পাগড়ী পরে আছে কুহু। কুহু কূজনের দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,- এবার খুশি? আমার কলরবের কাছে আমাকে দোষী বানিয়ে মনের স্বাধ মিটেছে?কূজন অপরাধীর মতন মাথানত করে দাঁড়িয়ে আছে। আর কুহু এক নাগাড়ে বলেই চলছে,- আমি নাকি ভালোবাসতেই জানি না। নিদারুণ সত্য কথা এটা। আচ্ছা এতোই যেহেতু মরার ইচ্ছা ছিল আপনার তাহলে মরে গেলেই পারতেন। আমাকে ঢাক ঢোল পিটিয়ে জানানোর দরকার ছিল না । মরে যেতেন, আমাকে একটু বাঁচতে দিতেন। আচ্ছা আপনার না মরার শখ যান তাহলে এখন মরুন আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবো। কুহু আঙ্গুল দিয়ে ইশারায় রেললাইন দেখিয়ে বলল,- যান শুয়ে পড়ুন সেখানে। দেখবো মরতে পারেন কিনা? আমার তো মনে হয়না আপনি সত্যি সুইসাইড এটেম্প নিতেন। আপনি তো বর সেজে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করবেন ভেবেছিলেন কিন্তু ভুল ধারণা আপনার। আমি মরে যাব তারপরো কলরবকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবো না। আমি তো আপনাকে বাঁচানোর জন্য এমন করেছিলাম। মানবতা দেখিয়েছিলাম কিন্তু এখন দেখছি আপনি একটা অমানুষ। বাহ্ কি সাজ। কুহু কথা বলতে বলতেই হাত দিয়ে কূজনের পাগড়ী ফেলে দিয়ে পাগড়ীটায় পা দিয়ে লাথি দিলো সাথে সাথেই কলরব কুহুর গালে কষিয়ে চড় বসালো। কুহু কিংবা কূজন কেউ এটার জন্য প্রস্তুত ছিল না। কূজন হা হয়ে রইলো আর কুহু গালে হাত দিয়ে নতমুখে দাঁড়িয়ে রইলো। কলরব এতোটাই জোরে মেরেছে যে কুহুর মাথা ঘুরাচ্ছে। কান সহ ব্যাথা করছে,গাল জ্বলছে অনবরত। কুহুর সব কান্না যেন গলায় আটকে গলা ব্যাথা করছে। কুহু মনে করতে পারছে না লাস্ট ওর মা কিংবা বাবা ওকে কবে মেরেছিল। কুহু আশেপাশে তাকিয়েই দেখলো অনেকেই দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে। কুহু জোরে নিঃশ্বাস ফেললো সাথে কয়েক ফোঁটা চোখের জলও পড়লো। অশ্রুভেজা চোখে কলরবের চোখে চোখ রেখে বলল,- আমার গায়ে হাত তোলার অধিকার কে দিয়েছে আপনাকে? এতো বড় স্পর্ধা কোথায় পেয়েছেন?অপমানে,লজ্জায়,রাগে কুহুর দম বন্ধ হয়ে আসছে। মুখ দিয়ে আর কথা বের করতে পারছে না, কানে প্রচণ্ডরকমের ব্যাথা করছে। রাগে কাঁপছে সে কিন্তু কলরবকে কিছু বলতেও পারছে না। হাত দিয়ে কলরবের বুকে বার বার ধাক্কা দিয়ে কুহু কিছু বলতে চাচ্ছে কিন্তু চোখ দিয়ে পানি ঝরানো ছাড়া সে কিছুই করতে পারছে না। বাকশক্তি যেন লুপ পেয়ে গেছে। কুহুর ধাক্কা দেওয়ার চোটে কলরব পিছিয়ে যাচ্ছে বারবার কিন্তু কুহুর রাগ আরো বাড়ছে। রাগে কি থেকে কি করে ফেলবে কুহুর মাথায় আসছে না। কুহুর মাথাও ঘোরাচ্ছে, পায়ের জোর হারিয়ে ফেলছে, দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটুকুও নিঃশেষ হয়ে এলো। ধপ করে সেখানেই বসে পড়লো। তারপর দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলো। চিৎকার করে কাঁদছে কুহু, আশেপাশের সব ভুলে গেল সে। কে কি ভাবছে,কে কি বলছে সেদিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। কলরব কুহুর অবস্হা দেখে দোকান থেকে একটা পানির বোতল নিয়ে এলো। কুহুর পাশে হাঁটু মুড়ে বসে বলল,- পানিটা খাও।কুহু কলরবের কথা শুনে ওর দিকে আগুন ঝরা দৃষ্টি নিয়ে তাকালো। কলরবকে আবার ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে কুহু উঠতে চাইলো কিন্তু দাঁড়ানোর শক্তি পাচ্ছে না। তাই বসে বসেই কাঁদতে লাগলো। একসময় শামসু গাড়ি থেকে পানি এনে দিতেই কুহু পানি খেলো। পানি খেয়ে যেন কিছুটা শক্তি ফিরে পেল। তারপর দাঁড়িয়ে কলরব আর কূজনকে উদ্দেশ্য করে বলল,- আপনারা দুজনের একজনও আসলে ভালোবাসতে জানেন না। একজন আমার সুখের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালেন আর আরেকজন আমাকে অপমান করেছেন, আমার ভালোবাসাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। আমার কথার উপর বিশ্বাসই নেই। এতটুকু বলে কুহু একটু শান্ত হলো।কুহু থামতেই কলরব বলল,- হয়েছে এখন? তাহলে চলো আজ তো তোমার বিয়ে।- আমি আপনার মতন এতো নীচু মন মানসিকতার মানুষকে কখনোই বিয়ে করবো না। আপনার থেকে তো আপনার পাগল ভাইও ভালো। আমি ভালোবাসিনা বলার পরও হাজারবার আমার পিছন পিছন ঘুরেছে আর আপনাকে ভালোবাসি বলার পরও বলছেন আমি নাকি টাইমপাস করেছি। আমাকে কি এমন মেয়ে মনে হয়? আপনার থেকে এই সাইকোটাও ভালো।- হুম ওর সাথেই তোমার বিয়ে হবে। তুমি আসলে ওকেই যে ভালোবাসো তা আবারো প্রমাণিত হলো। মানুষ রেগে গেলে সত্যটাই বলে। আমি যে তোমার কাছে ভালো না তুমি আবারো বললে।- ঠিকই তো বলেছি। যে বিয়ের আগেই এভাবে গায়ে হাত তুলতে পারে তাও মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে সে কি ভালো নাকি? আর কিসব বললেন না কোন নাগরের কাছে যাচ্ছি ছিঃ! শেইম অন ইউ মিস্টার ইবনাত কলরব।- হুম যাকে নিয়ে গর্ব করতে পারবে তার হাতেই তুলে দিচ্ছি তোমাকে। - আপনি তুলে দেওয়ার কে? আমি নিজেই উনাকে বিয়ে করবো। উনি জানেন আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি তারপরো আমাকে ভালোবেসে মরতে বসেছিলেন। উনি তো এও বলেছেন আমি যদি বিবাহিত হতাম বাচ্চাকাচ্চার মা হতাম তাহলেও আমাকেই চাইতেন। আর দেখুন কোথায় আপনি আমি কার কাছে যাচ্ছি জিজ্ঞাসা করছেন। আমি নাকি দুই ভাইকে একসাথে....- চলো কুহু সবাই জানার আগেই বাসায় পৌঁছুতে হবে। মানুষজন জানে না। - হুম যাবই তো আর আপনার চোখের সামনে কূজনকে বিয়ে করবো। ওর সাথে থাকলে অনেক বেশি ভালো লাইফও লিড করতে পারবো,লাক্জারিয়াস লাইফ যাকে বলে। আপনার মতন ফালতু মন মানসিকতার ছেলেকে ভালোবেসে ভুল করেছি,চরম ভুল। এর চেয়ে কূজনের বাবার টাকা দেখে কূজনকে বিয়ে করে নেওয়াই ভালো ছিল।- তোমাকে আটকেছে কে?এখনো সুযোগ আছে।- হুম তাই করবো। - চলো।...কুহুকে দেখেই কুহুর মা কুহুর দিকে তেড়ে এলেন এরপর এলোপাথাড়ি কানে গালে একের পর এক থাপ্পর দিতে লাগলেন। কুহুর বাবা অসহায়ের মতন কুহুর দিকে তাকিয়ে আছে, পিহু নির্বাক। কুহুর মায়ের মারের চোটে কুহুর দম বন্ধ হয়ে আসছে, কান,গাল একাধারে জ্বলছে, কুহু ফু্ঁপিয়ে কেঁদেই চলেছে কিন্তু কুহুর মা যেন থামার নামই নিচ্ছে না। সাহরা বাধা দিতে যেতেই বলল,- আপনাদের মতন সুকপাল না আমার। চরিত্রহীন মেয়ে পেটে ধরেছি। কুহুর মায়ের হাত ধরে কলরবথামিয়ে বলল,- আন্টি কুহু অবুঝ, নিজেই জানে না কি করে আর কি ভাবে।- কিসের অবুঝ সে? এই মেয়ে নিজেই বলেছিল তোমাকে বিয়ে করতে চায় আর এখন পালাচ্ছে। - ভালেবাসার উপর জোর খাটানো চলে না,মনের উপরও মানুষের নিয়ন্ত্রণ নেই। কলরব কুহুর মাকে শান্ত করে নিজের মতন করে পরিস্হিতি সামাল দিলো। এমনকি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কুহু কূজনের বিয়েও দিলো। কুহুকে কবুল বলার জন্য বলতেই কুহু একজর কলরবের দিকে তাকালো তারপর চোখ বন্ধ করে দম আটকে কবুল বলল। হাসনাদ সাহেব এসে দেখলেন ছেলের বিয়ে হয়ে গেছে। অবাক হলেন প্রচন্ডরকমের। একটা ঘোরের মাঝেই কুহুকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার সবকিছু ব্যবস্হা করলেন। কুহু চলে যাওয়ার সময় কুহুর মা কিংবা বাবা কুহুকে বিদায়ও দেয়নি। সাহরা,ইফতেখার সাহেব,ইরিন কলরব, সঞ্জু অন্যরা সবাই মিলে কুহুকে বিদায় দিলো। পিহু অবশ্য রাগ করে থাকতে পারেনি। পিহু বোনকে জড়িয়ে দু ফোঁটা চোখের জলও ফেলেছে। পিহুকে আর ইরিনকে জড়িয়ে কুহু অনেক অনেক কাঁদলো। ইরিনও কুহুকে জড়িয়ে পাগলের মতন কেঁদেছে আর বলেছে,- ভালো থেকো ভাবী আমাকে কিন্তু ভুলে যেও না।কুহু এর কোনো উত্তরই দিতে পারেনি কিন্তু যাওয়ার সময় সাহরাকে বলে গেছে,- মা আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। কুহু টিকলিটা খুলে সাহরাকে দিয়ে দিলো কিন্তু সাহরা সেটা কুহুকে ফিরিয়ে দিয়ে বলেছে,- কূজনও আমার আরেক ছেলে। রেখে দাও তাহলে আর কোনো রাগ থাকবে না।কলরবের দিকে একরাশ ঘৃণা নিয়ে কুহু তাকাতেই কলরব এগিয়ে এসে হাসি মুখে কূজনের হাতে হাত রেখে কূজনের হাত দিয়ে কুহুর গালে হাত রেখে বলল,- ফুলটুশী জীবনে অনেক অনেক বেশি সুখী হও।তারপর আবারে হেসে বলল,- সরি! আসলেই তোমার উপর আমার কোনো অধিকার ছিল না তাই হাত তুলাটা ঠিক হয়নি। ফুলটুশী আমার উপর রেগে থেকো না।কুহু কূজনের হাত সরিয়ে কলরবের চোখে চোখ রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলল,"অনেকদিন দেখা হবে নাতারপর একদিন দেখা হবে।দু'জনেই দু'জনকে বলবো,'অনেকদিন দেখা হয়নি'।এইভাবে যাবে দিনের পর দিনবৎসরের পর বৎসর।তারপর একদিন হয়ত জানা যাবেবা হয়ত জানা যাবে না,যে তোমার সঙ্গে আমারঅথবাআমার সঙ্গে তোমারআর দেখা হবে না।"কলরব বলল,- খুব সুন্দর আবৃতি করো তুমি। যতদূর মনে পড়ে তারাপদ রায়ের লিখা।কুহু কাঁদতে কাঁদতেই বলল,- তুমি আমার কথা বিশ্বাস করলে না কলরব, বিশ্বাস করলে না। যে মেয়ে ভালোবাসতে জানে সেরকম মেয়েকে খুঁজে বিয়ে করে নিও,সুখের সংসার সাজিয়ো তার সাথে। কুহু কথাগুলো বলতে বলতে রাস্তায় বসে কাঁদছিল। কলরব ইরিনকে ডেকে বলল,- তোর ভাবীকে তুলে গাড়িতে বসিয়ে আয়।চলবে...- অন্তিম পর্ব/ পর্বঃ৬৮কলরব চেয়ে আছে। একদৃষ্টিতে কুুহুর চলে যাওয়া দেখছে। চোখের পলকও ফেলছে না। যতক্ষণ গাড়িটা দেখা গেল ঠিক ততোক্ষণ কলরব একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। গাড়িটা গলির বাঁকে হারিয়ে যেতেই কলরব দীর্ঘশ্বাস ফেললো। পিছন থেকে কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে ফিরে তাকালো। সুরভীর দিকে তাকাতেই সুরভী বলল,- কলরব কেনো করলি এমন? নিজের ভালোবাসাকে অন্য কারোর হতে দিলি কি করে?কলরব হাসিমুখে বলল,- ভালোবাসার মানুষের ঠোঁটে চুমু খাওয়াটাই ভালোবাসার স্বার্থকতা না। ভালোবাসার মানুষের ঠোঁটের কোণের হাসিটাকে টিকিয়ে রাখাই ভালোবাসা। যে হাসিটার প্রেমে পড়েছি সে হাসিটাকে বিলীন হতে দিব নারে।কলরবের কথা শুনে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রঞ্জু কলরবকে জড়িয়ে ধরলো, চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু ঝরাচ্ছে রঞ্জু। কলরব রঞ্জুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,- আরে বলদ কাঁদচ্ছিস কেনো? কুহু ভালো থাকবে এটাই আমার চাওয়া। ফুলটুশী যে কখনো আমার সাথে বিয়ে হলে সুখী হতে পারতো না। কলরবের কথা শুনে এবার সুরভীও কলরবকে জড়িয়ে ধরলো কিন্তু কাঁদলো না অস্ফুট গলায় বলল,- উই লাভ ইউ কলরব! জাস্ট লাভ ইউ।...হাসনাদ সাহেব জাহরাকে গাড়িতে বসে অপেক্ষা করতে বলে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন সাহরার দিকে। সাহরা ল্যাম্পপোস্টে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। হাসনাদ সাহেব সাহরার পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,- আপনাকে একটা কথা বলতে এসেছি।সাহরা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন,- জ্বি বলুন।- এতোদিন জীবনে একটা আফসোস ছিল আপনাকে না পাওয়ার আফসোস। সত্যি কথা বলতে জাহরাকে নিয়ে সুখে আছি কিন্তু মাঝে মাঝে যখন গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যায় আজো ইচ্ছে জাগে পাশ ফিরে আপনাকে দেখার।হাসনাদ সাহেব এতটুকু বলেই ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। একটু থেমেই আবার বললেন,- কিন্তু এই মূহুর্তে জীবনে নতুন একটা আফসোস যোগ হলো। ইশ্ কলরব যদি আমার ছেলে হতো আর আমি যদি কলরবের মতন প্রেমিক হতে পারতাম। সাহরা কিছু বললেন না চুপ করে রইলেন। হাসনাদ সাহেব আবারো বললেন,- আমি মনে করি আমি পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো বাবা, স্বামী হিসেবেও ফেয়ার থাকার চেষ্টা করেছি কিন্তু প্রেমিক হিসেবে খুবই স্বার্থপর একজন মানুষ। বারবার চেয়েছি আপনি যেন আপনার সিদ্ধান্তে জীবনে চলতে গিয়ে পঁচতান, আফসোস করেন আমাকে রিজেক্ট করার জন্য কিন্তু আজ কলরব শিখালো ভালোবেসে খাঁচায় বন্দি করে লাভ নেই বরং ভালোবাসাকে আকাশে ডানা মেলার জন্য উড়িয়ে দিতে হয়। ত্যাগেই সর্বসুখ কিনা জানি না কিন্তু ত্যাগ আর ভালোবাসার মাঝে একটা গভীর সম্পর্ক আছে। ইফতেখার সাহেবকে নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। মাঝে মাঝে মনে হতো উনি কি আসলেই আপনাকে না পেলে অন্য কাউকে বিয়ে করতেন না? আজ উত্তরটা পেয়ে গেছি। আল্লাহ্ আপনাকে ভালো রাখুন আর আমার আজ থেকে আপনার প্রতি কোনো রাগ বা অভিমান যাই বলুন সেটাও নেই। আমার প্রতিও প্লিজ রাখবেন না। হাসনাদ সাহেব সাহরার সাথে কথা বলে হাতের ইশারায় কলরবকে ডাকলেন। কলরব তখন সঞ্জুর সাথে কথা বলছিল। হাসনাদ সাহেবকে ডাকতে দেখে কলরব এগিয়ে গেল। কলরব এগিয়ে যেতেই হাসনাদ সাহেব কলরবকে বুকের সাথে চেপে শক্ত করে ধরলেন। তারপর পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন,- আম প্রাউড অফ ইউ মাই সান! প্রাউড অফ ইউ! আফসোস হচ্ছে আমি কেনো তোমার মতন সন্তানের বাবা হতে পারলাম না। কলরব গগণবিহারী হাসি হেসে বলল,- আঙ্কেল আমিও আপনার ছেলে আঙ্কেল। দোয়া করবেন আমার জন্য। হাসনাদ সাহেবের চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি টপটপ করে কলরবের শেরওয়ানিতে পড়লো। কলরব হাসি মুখে হাসনাদ সাহেবকে এগিয়ে গাড়ি পর্যন্ত দিয়ে এলেন। জাহরা গাড়িতে বসেই কলরবকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। কষ্টে উনার বুক ফেটে যাচ্ছে। জাহরা জীবনে খুব কমই কেঁদেছেন আর আজ যেভাবে কাঁদছেন কখনো এভাবে কেঁদেছেন বলে মনে করতে পারছেন না। কলরব বারবার থামাতে চেষ্টা করছে কিন্তু জাহরা থামছেনই না। কাঁদছেন আর বলছেন,- তোমাদের নানার বাড়িতে বেড়াতে যেয়ে একবার তুমি দুষ্টামি করে শোকেজের কাঁচ ভেঙে ফেলেছিলে। আপা তোমাকে মারতে তেড়ে যেতেই আমার পিছনে এসে লুকিয়েছিলে। আজ বাবা কি করে তুমি এই কষ্ট থেকে লুকিয়ে আমার বুকে লুকাবে? কি করে বাবা?- আরে খালামণি তুমিও মায়ের মতন কাঁদতে বসলে? এভাবে কেঁদো না। মাগরিবের আজান পড়ছে তাড়াতাড়ি পৌঁছুতে হবে না? ছেলে আর ছেলের বউকে বরণ করতে হবে তো।জাহরা আরো বেশি কাঁদতে লাগলেন। কলরব অনেক বুঝিয়ে জাহরাকে থামালেন তারপর ওদের বিদায় দিয়ে বাসায় ফিরে এলো কলরব। নিজের রুমে এসে আস্তে করে দরজা আটকালো। মাথা থেকে পাগড়ীটা খুলে ওয়ারড্রবের উপর রাখলো। ওয়ারড্রবের চেস্ট ড্রয়ার খুলে সেখান থেকে কুহুর ওড়নাটা হাতে নিলো। তারপর কলরবের কাঁপড়ের ভাঁজে থাকা চুড়িগুলোয় হাত বুলিয়ে বলল,- ফুলটুশী তোমাকে নিজ হাতে পড়ানো হলো না, তোমার হাতে হাতও রাখা হলো না। ওয়ারড্রব থেকে একটা টিশার্ট আর জিন্স প্যান্ট বের করে চেঞ্জ করে নিলো। তারপর বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শরীর এলিয়ে দিলো। চোখ বন্ধ করে হাতড়ে কুহুর ওড়নাটা খুঁজতে লাগলো,পেয়েও গেল। ওড়নাটা হাতে নিয়ে চোখ মেলল সে। নাক ডুবিয়ে ঘ্রাণ নিয়ে অস্ফুট স্বরে বলল,- ফুলটুশী আই ডু লাভ ইউ। আমার নাইবা হলে তারপরো আমি চাই তুমি জীবনে অনেক বেশি সুখী হও। কলরব ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে ধীরে ধীরে একটার পর একটা চোখের জল বিসর্জন দিতে লাগলো। কলরবের প্রতিটা অশ্রু কুহুর ওড়নায় যেন তীব্র বর্ষণ করছে। যে মানুষগুলো মন খুলে হাসতে পারে,নিজের হাসির শব্দ ধ্বনি প্রতিধ্বনি করে অন্যের মুখে খুশির ঝিলিক বয়ে আনতে পারে তাঁরা বোধহয় এভাবেই নিরবে কাঁদে। বালিশ ভিজে যায় কিন্তু কান্নাদের আত্মচিৎকার কেউ শুনে না। কলরবের বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা হচ্ছে না কিন্তু নামাজের ওয়াক্ত চলে যাচ্ছে। তাই নিজের শরীর আর মনের সঙ্গে লড়াই করে উঠলো। ওযূ করে ঘরেই নামাজ পড়ে নিলো। মসজিদে যাওয়ার মতন শক্তি যোগাড় করতে পারেনি সে। নামাজ শেষে শরীরে আর মনে একটু জোর পেল। কুহুর ওড়নাটা সাথে করে নিয়ে ছাদে চলে এলো কলরব। রেলিং এর উপর ওড়নাটা রেখে বলল,- থেঙ্ক ইউ সো মাচ ফুলটুশী। থেঙ্ক ইউ। ভাগ্যিস সেদিন নাকের ডগার রাগটা ঝারতে চুড়িসহ ওড়না গুলো ফেলে দিয়েছিলে। নাহয় এই সৌভাগ্যটুকু আল্লাহ্ আমার কপালে রাখতো না।কলরব অবাক হয়ে খেয়াল করলো আজও জোছনা। বাহ্ জোছনা আছে,চাঁদও আছে নেই শুধু ফুলটুশী। কলরব দুদিকে মাথা নাড়লো তারপর নিজের মনকে শুধরে নিয়ে বলল,- উঁহু ফুলটুশী তো ঠিকই আছে আমার হৃদয়ের ঘোলাটে চাঁদ হয়ে, বুকের মাঝে আটকে থাকা দীর্ঘশ্বাস হয়ে।কলরব এসব ভাবতে ভাবতেই পকেট থেকে মোবাইল বের করে সবচেয়ে প্রিয় গানটা প্লে করলো,।"এই রাত তোমার আমারঐ চাঁদ তোমার আমারশুধু দুজনেরএই রাত শুধু যে গানেরএই ক্ষণ এ দুটি প্রাণেরকুহু কূজনের।"কলরব কুহু কূজনের শুনতে পেতেই মোবাইলটা ছু্ঁড়ে ফেলে দিলো। ছাদের রেলিং টপকে মোবাইলটা চুড়চুড় হয়ে রাস্তায় পড়ে রইলো। কলরবের হঠাৎ করে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, হাত পা কাঁপছে অনবরত, দম আটকে আছে আর চোখের সামনে কুহুর হাসিমুখটা ভাসছে। চোখজোড়ায় অস্বাভাবিক জ্বালা করছে। কলরবের খুব খুব বেশি পছন্দের গান এটা। কলরবের ইচ্ছা ছিল বিয়ের রাতে কুহুকে নিয়ে ছাদে দাঁড়িয়ে এই গানটা শুনবে। আমাবস্যার রাত হলেও কলরব কুহুকে নিয়ে সারারাত ছাদেই দাঁড়িয়ে থাকতো। পাশে কুহুর মতন চাঁদ থাকলে আকাশের চাঁদের কোনো প্রয়োজন হতো না কলরবের। কতো কতো প্ল্যান ছিল। কুহুর জন্য নিজ হাতে কফি বানিয়ে নিয়ে আসবে তারপর দুজন একই মগে চুমুক দিয়ে কফির স্বাদ নিবে। কুহুকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে কুহুর চুলে উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলবে। কুহুর নাকের নাক ঘঁষে বলবে,- নাকের ডগায় এতো রাগ কেনো ?কুহুর কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে মুগ্ধদৃষ্টিতে কুহুর মনকাড়া জোড়াভ্রুগুলোর দিকে চেয়ে থাকবে। আরো কতো কি! কলরব কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই আর্তনাদ করে বলল,- আল্লাহু্ তুমি যদি আমার জীবনে বসন্ত নাই আসতে দিলে তাহলে কুহুকে কেনো আসতে দিলে জীবনে? কেনো আল্লাহ্ কেনো?কলরবকে পিছন থেকে হঠাৎ কেউ জড়িয়ে ধরলো। কলরব ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো ইরিন। কলরব ইরিনকে টেনে এনে বুকের মাঝে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। ইরিন গলা খুলে গান ধরলো," তুমি আছো আমি আছি তাইঅনুভবে তোমারে যে পাইশুধু দুজনেরএই রাত শুধু যে গানেরএই ক্ষণ এদুটি প্রাণেরকুহু কূজনের।"এতোটুকু গেয়ে ইরিন আর গাইতে পারলো না, অঝরে কাঁদতে লাগলো।ইরিনের কান্নায় কলরবের টিশার্ট ভিজে একাকার হতে লাগলো।ইরিন কাঁদতে কাঁদতে বলল,- ভাইয়া ইউ আর দ্যা বেস্ট টিচার ইন দ্যা গ্যালাক্সি। ভাবীকে যা বুঝিয়েছো ভাবী তাই বুঝেছে।কলরব হালকা হেসে বলল,- টিচার নারে চিটার। তোর ভাবীর সাথে চিট করেছি আমি ওর দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছি,ওকে ফাঁদে ফেলে জালে আটকেছি।- ভাইয়া এমনটা তুমি কেনো করলে? আমার ভাবীকে কেনো দূরে ঠেলে দিলে? ভাবীর ভালোবাসাকে অপমান করেছো তুমি। আর কেনোই বা আমার হবু ভাবীকে ভাবী হতে দিলে না? কলরব ইরিনকে বুক থেকে সরিয়ে বলল,- তোর হবু ভাবী তোর ভাবী হয়েছে ঠিকই শুধু হবু ভাবীর বরটা চেঞ্জ হয়ে গেছে। - ভাইয়া কেনো করলে এমন? ভাবীকে এতো কষ্ট দিলে কেনো?- হ্যাঁ অনেক অপমান করেছি ফুলটুশীকে,ওর চরিত্র নিয়ে কথা বলেছি এমনকি গায়ে হাত পর্যন্ত তুলেছি কিন্তু আমি নিরুপায়রে। যে আকাশে ফুলটুশী আমার সাথে তারা গুণতো সে আকাশে যে মেঘ জমে গেছে। ইরিন তীক্ষ্ণ গলায় বলল,- ভাবীকে আর যাই করো না কেনো ভাবীর ভালোবাসা নিয়ে প্রশ্ন তোলা তোমার মোটেও ঠিক হয়নি। ভাবী কি তোমায় সত্যি ভালোবাসেনি?- ইয়েস শি ডু লাভ মি ইরিন। শি ডু লাভ মি। কুহু শুধুই আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু ওর রাতগুলো কেঁড়ে নিয়ে আমি কি করে শান্তির ঘুম দিব? কেনোই বা কষ্টঘেরা ছাদের নীচে বেঁচে কুহু ধীরে ধীরে কু্ঁড়ে কুঁড়ে মরবে? তারচেয়ে সুখের বারান্দায় তাকে ঢেলে দিয়েছি। - ভাবীর মনে তুমি কি কষ্ট দিয়েছো তুমি নিজেও বুঝতে পারবে না। আমি একটা মেয়ে তাই বুঝি।- এই মৃত্যুপথযাত্রীর যে আর কিছুই করার ছিল না।কলরব নীচে পড়ে থাকা রিপোর্টগুলো ইরিনের হাতে দিয়ে বলল,- আমার মেয়াদ তো সর্বোচ্চ আর দেড়মাস ইরিন। কুহুকে বিয়ে করে ওকে সারাজীবনের জন্য বিধবা করতে চাইনা। আমার ফুলটুশী ভালো থাকুক এটাই চাই। ইরিন রিপোর্টগুলো ছু্ঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল,- তা তো জানি ভাইয়া তাই তো তোমার কথা মতো সব কাজ করেছি, কূজন ভাইয়া মা,বাবা সবাই তো আমরা তুমি যা বলেছো তাই করেছি। কিন্তু তুমি আর যাই করো ভাবীকে এভাবে অপমান না করলে পারতে। ভাবীর মা,বাবা, বোন সবাই এখন ভাবীকে দোষারূপ করছে।- ওরা যখন সত্যিটা জানবে তখন আর ভুল বুঝবে না।আর কুহু অনেক জেদী মেয়ে ইরিন আর আমাকেও পাগলের মতন ভালোবাসে। আমার ক্যান্সারের কথা শুনেও সে আমাকেই বিয়ে করতো আর সারাজীবন একা একাই কাটাতো। কখনো আমাকে ভুলে নতুন কাউকে নিয়ে বাঁচতে পারতো না।- এখন বাঁচতে পারবে? আমার তো মনে হয়না। তারপরো শুধু তোমার শেষ ইচ্ছা বলে সবাই মেনে নিয়েছি। আমরা তো চাইনি তোমার সাথে বিয়ে হোক। ঢাকা যাওয়ার পর যেদিনই জেনেছো তোমার লাং ক্যানসার সেদিনই তো মা বাবা ভাবীদের বাসায় সবটা বলে বিয়েটা ভেঙে দিতে চেয়েছিল কিন্তু তুমি দাওনি বলেছো কুহুকে আমি স্বপ্ন দেখিয়েছি এখন কুহুর স্বপ্ন সত্যি করতে না পারলেও দুঃস্বপ্ন হতে চাই না। - ওকে সুখী করার দায়িত্ব আমি কূজনকে দিয়েছি ইরিন। তোর কূজন ভাইয়া যে আমার থেকেও বেশি ভালো,অনেক বেশি ভালো মানুষ। দেখিস কুহুর সব কষ্ট ভুলিয়ে দিবে,কুহু একদিন আমাকে সত্যি ভুলে যাবে। - উঁহু কখনো ভুলবে না। ভালোবাসার পাশাপাশি ঘৃণা করবে তোমাকে। কূজন ভাইয়ার সঙ্গে লাশ হয়ে বেঁচে থাকবে।- তাও বেঁচে থাকবে তো। আমাকে যাতে ঘৃণা করে এজন্যই এতো কিছু করলাম। আমার চেয়ে বেশি আমার ফুলটুশীকে কেউ চিনে না। আমি ওর প্রতিটা দুর্বলতা খুব ভালো করে চিনি। কোথায় আঘাত করলে সে কি রিএক্ট করবে তাও জানি। আমি এরকমটা না করলে কুহু কোনোদিনই কূজনকে বিয়ে করতো না। ইরিন ভাইকে আবার জড়িয়ে ধরে বলল,- এতো ভালোবাসো আমার ভাবিকে?কলরব ডানে বায়ে মাথা নেড়ে বলল,- উঁহুম একটুখানি।- ভাইয়া তুমি চলে গেলে আমাদের কি হবে?- কিছু হবে না। মা বাবার জন্য তুই আছিস। ওদের সামলাতে হবে।ইরিন কাঁদতে কাঁদতে বলল,- আর আমি ভাই পাবো কোথায়?- বোকা মেয়ে তোর কূজন ভাইয়া আছে না? তুই তো সোনার হরিণ ওর।ইরিন কষ্টে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে চলে যায়। ইরিন বেশ কয়েকদিন যাবত এমন কষ্ট পেতে পেতে এখন আর টিকতে পারছে না। আজ বিকেলে এতো বেশি কষ্ট হয়েছিল যে হাসনাদ সাহেবকেও ইরিন সব বলে দিয়েছে। ইরিন রুমের দরজা বন্ধ করে আর্ট খাতা খুলে যে পৃষ্ঠায় কুহু আর কলরবের বিয়ের ছবি এঁকেছিল সেটায় মাথা গুঁজে কাঁদছে আর সাহরা আর ইফতেখার সাহেব একজন আরেকজনকে আঁকড়ে ধরে। পিহু কাঁদছে পিহুদের ছাদের কোণায় বসে। কুহুর কথা মনে পড়তেই পিহু আর ঘরে থাকতে পারছিল না। শতো ভয় ভুলে সে ছাদে এসেছিল। কুহু বলতো ছাদে এলে মন ভালো হয়ে যায় হালকা লাগে নিজেকে। তাই কুহুর ট্রিকস মেনে মন ভালো করতে এসেছিল। কিন্তু এখন মন ভালো হওয়ার বদলে ভীষণভাবে খারাপ হয়ে গেছে। পিহু এতো কান্না কোনোদিন করেনি। অঝরে কাঁদছে সে। পিহু কখনোই কোনোকিছুতে এতো কাঁদে না। খারাপ পরিস্হিতিতেও সে নির্লিপ্ত থাকে। কিন্তু আজ নিজেকে সামলাতে পারছে না। ইরিনের ছুঁড়ে দেয়া রিপোর্টগুলো হাতে নিয়ে পিহু বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। কলরবের লাং ক্যান্সার। স্মল সেল কার্সিনোমা অব লাং। দুই মাসের মধ্যে নিশ্চিত মৃত্যু। প্রথমে ইরিন আর কলরবের কথোপকথন শুনে পিহু হতভম্ব হয়েছিল আর যখন রিপোর্ট গুলো দেখলো চোখের জল সব বাধা ভেঙে গাল বেয়ে পড়ছে। পিহু বারবার চোখ মুছেও কিছুতেই পানি আটকে রাখতে পারছে না,কিছুক্ষণ পর পর চোখ আর গাল দুটোই ভিজে উঠছে। কলরব জানে না পিহু যে পাশের ছাদে দাঁড়িয়ে সব শুনেছে। ইরিন চলে যেতেই কলরব কুহুর ওড়নাটা নিয়ে হাতের সাথে প্যাঁচিয়ে বাঁধলো তারপর পা বাড়ালো সিঁড়িঘরের দিকে।পিহু ভয় পাবে তাই সাথে টর্চ নিয়ে এসেছিল। কলরবদের ছাদে পিহু টর্চ মেরে বলল,- দুলাভাই দাঁড়ান।কলরব অবাক হয়ে পিছনে ফিরতেই দেখলো পিহু ভেজা চোখজোড়া নিয়ে কলরবের দিকে তাকিয়ে আছে। কলরব হেসে বলল,- মৌটুশী তুমি এখানে? তোমার তো ভূতে ভয়।- ভালোবাসতে আরো ভয়।- তুমি আন্টিকে সবটা খুলে বলো। আর ফুলটুশীর কোনো দোষ নেই। আমি ইচ্ছে করে ওকে রাগিয়ে দিয়েছিলাম।পিহু ফুঁপিয়ে কেঁদে বলল,- বাঁচার কি কোনোই চান্স নেই?কলরব গগনবিহারী হাসি হাসলো তারপর বলল,- বাঁচতে যে আমারো ইচ্ছে করে কিন্তু উপরওয়ালার সে ইচ্ছে নেই।- গাধীটা সত্যি একজন খুব বেশি ভালো মানুষকে ভালোবেসেছিল। - আহা মৌটুশী তুমি এভাবে কাঁদলে তো চলবে না। তোমাকে আগের মতন স্ট্রং থাকতে হবে। ফুলটুশীকে যে সামলাতে হবে।- আসলেই ভাইয়া আমি ভালোবেসে এতো ছং করতে পারবো না কখনো।কলরব ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলল,- দোয়া করি তুমি যেন ডাক্তার হতে পারো। এই রোগীটা হয়তো কোনোদিনও তোমার চিকিৎসা পাবে না তার আগেই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমাবে।পিহু দাঁড়িয়ে ছিল। কলরবের কথা শুনে ছাদে বসে কাঁদতে লাগলো। কলরব পিহুকে আরো বলল,- আমার বাস্কেটবলটা কিন্তু তোমাকেই দিয়ে গেলাম। পিহু মুখ তুলে বলল,- আপনি যদি আমার আপন ভাই হতেন তাহলে আপনাকে জড়িয়ে ধরে একটু কাঁদতাম। কলরব বলল,- ইশ্ আমি যদি সত্যি তোমার দুলাভাই হতে পারতাম!কথাটা বলেই কলরব ঝড়ের গতিতে সিঁড়ি বেয়ে রাস্তায় নেমে এলো। পিহু সেখানে বসে কাঁদতে কাঁদতে বলল,- আপুণি আমারি এতো কষ্ট হচ্ছে তুই শুনলে তো মরেই যাবি।...কলরব রাস্তায় নেমেই বসে বসে হাঁটুতে হাত ভাঁজ করে মাথা গুঁজে কাঁদতে লাগলো। চিৎকার করে কাঁদছে কলরব। পকেট থেকে কুহুর ছবিটা বের করে বুকে চেপে ধরে চিৎকার করে বলল,- কেনো তোমাকে নিজের করে পেলাম না? কেনো? কলরব চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে উঠে দাঁড়ালো তারপর হাতে বেঁধে রাখা কুহুর ওড়নাটা দিয়ে চোখ মুছে গলির রাস্তায় এলোমেলো পা ফেলতে ফেলতে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। এখন আর চিৎকার করে না কাঁদলেও চোখ দিয়ে পানি অনবরত পড়ছেই। কলরব থামাচ্ছে না। এ যে অনেক দিনের জমানো কষ্ট,আজ আর চেপে রাখবে না। জলকে ভয় পেতে নেই, জল থেকে মানুষের উৎপত্তি, পৃথিবীর চারভাগের তিন ভাগই জল। ভালোবাসা কি জানতে চাইলে কলরব নির্দ্বিধায় বলবে,"ভালোবাসার অপর নাম উত্তপ্ত দুটি হৃদপিণ্ড আর অশ্রুভেজা দুটি নয়ন"তাই কলরব আর কান্না থামাচ্ছে না। অবিরত কাঁদছে আর হাতে পেঁচিয়ে বেঁধে রাখা ওড়নাটা দিয়ে বারংবার চোখ মুছে যাচ্ছে। হঠাৎ করে কেউ ওড়নাটায় টান দিয়ে ধরতেই কলরব থমকে গেল। পাশে তাকিয়ে দেখলো মণ্টি দাঁড়িয়ে আছে।কলরব তাকাতেই মণ্টি বলল,- আমি সত্যি বড় হয়ে তোমার মতন হবো।কলরব ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,- তুই আজো কি টাঙ্কির চিপায় দাঁড়িয়ে ছিলি নাকি?মণ্টি কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,- হ্যাঁ।- পেকে গিয়েছিস।- তুমি এখন কোথায় যাচ্ছো?- এই তো আমার আর কি? কয়দিন আর বাঁচবো একটু প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নিতে যাচ্ছি। - আমিও আসি তোমার সাথে?- আচ্ছা চল।মণ্টি আর কলরব পাশাপাশি হাঁটছে। গলির মোড়ের মুদি দোকানদার তিতাস কলরবকে দেখে দোকান ছেড়ে ছুটে এলো।কলরব তিতাসকে বলল,- কি ব্যাপার মামা কি অবস্হা?- হিরো তুমি তৈয়ব সাহেবের মাইয়াটারে বিয়া করলা না কেন?কলরব হেসে বলল,- "চুপচাপ গুম হওয়া রং,এও যে ভালোবাসার ঢং!"তিতাস কিছু বুঝলো না, কলরব এগিয়ে চলল নিজের পথে। মণ্টিও সাথে আসছে। দুজন হাঁটতে হাঁটতে রেলস্টেশন এসে পড়েছে। তারপর প্লাটফর্ম ছেড়ে রেললাইনে হাঁটতে লাগলো। চারিদিকে কতো মানুষ যারা শীতের রাতে গরম কাপড় ছাড়াই গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। শীতে কাঁপছে থরথর করে। কলরবের কাছে একসময় এই মানুষগুলোকে খুব বেশি অসহায় মনে হতো কিন্তু আজ ওদের সুখী মনে হচ্ছে আর নিজেকে নিঃস্ব। ওদের থরথর করে কাঁপুনী দেখে কলরব মণ্টিকে বলল,- মণ্টি জানিস ওরা যে শীতে কষ্ট পেয়ে কাঁদছে তা বুঝা যাচ্ছে কিন্তু আমি যে কষ্ট পাচ্ছি, বুকের ভিতর যে ভূমিকম্পন হচ্ছে তা দৃশ্যমান না।মণ্টি কি বলবে ভেবে পেল না। কলরব রেললাইনের পাতের উপর হাঁটতে লাগলো। মণ্টিও কলরবের অনুসরণ করে অপর পাতটায় উঠে হাঁটতে লাগলো। লাল আলো জ্বলতে দেখে কলরব বলল,- মণ্টি আমার লাইফেরও রেড সিগনাল জ্বলে উঠেছে। কলরবের আজ কূজনের বলা কয়েকটা লাইন মনে পড়ছে। কলরব দুদিকে দু হাত ছড়িয়ে চাঁদটার দিকে মুখ তুলে তাকালো। কলরব বুঝতে পারছে না চাঁদটা ঘোলাটে নাকি তার চোখ জোড়া ঝাপসা। রহস্য উন্মোচনে মন না দিয়ে কুহুর মতন আবৃতি করে কলরব বলার চেষ্টা করলো,"জোছনা কুড়াইয়ো না বন্ধু!চোক্ষে ধইরা রাখো।স্বপন দেইখো মোরে লইয়া!ছুঁইতে নাহি চাইয়ো।"...কুহু চারিদিকে চোখ বুলিয়ে পুরো রুমটা একবার দেখলো। চারিদিকে আভিজাত্যের ছোঁয়া। গাড়িটা যখন কূজন কুটিরে ঢুকেছিল কুহুর তখন মনে হয়েছিল একটা ছোটখাটো স্বর্গ নিজের চোখে দেখছে। এতো আলিশান বাড়ি সে বাস্তবে কখনো দেখেনি,টিভিতে দেখেছিল। লনটা দেখে কুহুর চোখ জোড়া বিস্ময়ে পলক ফেলতে পারছিল না। আর এখন কূজনের রুম দেখে বিশ্বাসই করতে পারছে না এই ঘরটা এখন তার। কুহু দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাত বাড়িয়ে টেনে বেডের কয়েকটা ফুল ছিঁড়লো। তারপর বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,- আমার এসব কিচ্ছু চাই না শুধু কলরবকে চাই। কিচ্ছু চাই না। বলতে বলতে বেড সাইড টেবিলে থাকা সব জিনিশ হাত দিয়ে ঠেলে ফেলে দিলো। ল্যাম্পশ্যাডটা ভেঙে মেঝেতে পড়ে রইলো। কূজনের ছবি থাকা ফ্রেমটাও পড়ে গেল মেঝেতে। কুহু চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে নিজের সারা শরীরে খামচাতে লাগলো,গালে এলোপাথাড়ি মারতে লাগলো। নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরে অস্বাভাবিকভাবে কাঁদতে লাগলো। সারাদিন কাঁদতে কাঁদতে কুহুর গলা ভেঙে গেছে। ভাঙা গলায় একলা বসে বসে বলছে,- আমি দেখে নিব কলরব। তুমি কোন ফুলটুশীকে বিয়ে করো দেখে নিব। ওই মেয়ের কাছ থেকে আমাকে ভালোবাসা শিখতে হবে। তারপর কূজনকে ফাঁসিয়ে আমি মরে যাব। ও আমার লাইফটা শেষ করে দিয়েছে ওকে আমি ছাড়বো না। ওকে ফাঁসিতে ঝুলাবোই নয়তো আমার নাম কুহু আরিজা না। নাহ্ নয়তো আমি মিসেস রবিন ইবনে হাসনাদ না। কুহু বিছানার বালিশ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পাগলের মতন বলছে,- নাহ্ আমাকে তো মরলে চলবে না। আমি যতোই মরে কূজনকে মৃত্যুর জন্য দায়ী করে দিয়ে যাই না কেনো কূজনের বাবা টাকার জোরে কূজনকে বাঁচিয়ে ফেলবে। আমি মরবো না কিন্তু বেঁচে থেকে ওকে তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলব। কূজনের বাবা তো টাকার জোরে সব করতে পারবে এমনকি আমার কলরবকে মেরেও ফেলতো। তাই মরলে চলবে না। কূজনকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করো দিব,ওকে আমি আমার চাকর বানাবো। মুহূর্তেরও বিন্দু বিন্দু ভাগে তাকে জানান দিব আমি শুধু কলরবকে ভালোবাসি। তখন বুঝবে ভালোবাসায় কতো কষ্ট। আমি নাকি ভালোবাসতে জানি না। ভালোবাসা শুধু ওরা দুইভাই জানে। একটা পাগল মরে যাবে তাই ওকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম আর কিছুই না কলরব। আমি তো শুধু তোমাকেই ভালোবাসি তুমি বুঝো না কেনো? কে বলেছে আমি তোমার কথা চিন্তা করিনি? কূজন যদি মরে যেত তখন কূজনের বাবা তোমাকে কখনো ছাড়তো না কলরব কখনো না। তোমাকে জানাইনি কারণ তুমি আমার কথা হেসেই উড়িয়ে দিতে। পরিস্হিতি ঠাণ্ডা হলে, আমি ভেবেছিলাম আমরা লুকিয় বিয়ে করে ফেলবো কলরব। কূজনের অগোচরে তাহলে কূজনেরও কিছু হলো না আর আমরাও এক হলাম। কি থেকে হয়ে গেল? তুমি আমাকে বিশ্বাস করলে না কলরব? আমাকে নিজের ভাইয়ের হাতে তুলে দিলে। এখন তোমার ভাই আমাকে খুবলে খুবলে খাবে, আমার উপর জোর খাটাবে কিন্তু বলে রাখলাম আমার মন কখনোই পাবে না। আমি এজীবনে শুধু তোমাকেই ভালোবেসেছিলাম, কোনো টাইমপাস ছিল না। কুহুর কান্না আর চিৎকার এ বাড়ির প্রতিটা মানুষ শুনতে পাচ্ছে। কথাগুলো অস্পষ্ট কিন্তু চিৎকারগুলো হৃদয়বিদারক। কূজন লিভিংরুমে বসে আছে। সোফার সাথে হেলান দিয়ে কলরবের বলা কথাগুলো বারবার মনে মনে আওড়াচ্ছে।কুহুর কান্না আর চিৎকারগুলো কলরবের বুকে তীরের মতো বিঁধছে। কলরবের কথা গুলো তাই আরো বেশি করে আওড়াতে লাগলো।"আমার সাজিয়ে দেওয়া পুতুলটা তোকে দিয়ে গেলাম ওর দায়িত্ব তোর। আমার ফুলটুশীর চোখ থেকে কখনো যেন নোনা জলের ফোঁয়ারা না নামে। ফুলটুশীকে তো আমি সুখী করতে পারলাম না সে যেন তোর বুকে মাথা রেখে প্রশান্তি খু্ঁজে পায়।কূজন প্রতিত্তোরে বলেছিল,- ভাই তোমার ফুলটুশীকে তোমার মতো করে আর কেউ ভালোবাসতে পারবে না। - তুই তোর মতো করে ভালোবাসবি। তুই ফুলটুশীর জগৎ জুড়ে আঁকড়ে ধরে থাকবি। ওকে এখান থেকে বহুদূর নিয়ে যাবি, তাড়াতাড়ি পাসপোর্ট, ভিসা ব্যবস্হা করে ফেলবি। আমার লাশ যেন ফুলটুশীকে দেখতে না হয়। মেয়েটা তাহলে মরে যাবে। কূজন কলরবের কথায় হাউমাউ করে কেঁদে দিয়েছিল। কলরব কূজনকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল,- তুই ভেঙে পড়লে কুহুর কি হবে?- ভাই তুমি কুহুকে বিয়ে করে নাও। যখন তুমি থাকবে না তখন আমি ওর হাত ধরবো,পাশে থাকবো।- ফুলটুশীকে এখনো চিনিসনি। সে কখনো তোকে পাশে দাঁড়াতে দিবে না। আমি বেঁচে থাকা অবস্হায় ওকে তোর করে দিয়ে যাব। এখনো ফুলটুশীকে চিনলি না!- ভাই প্রমিজ তোমার ফুলটুশীকে আমি ভালো রাখার চেষ্ট করবো। কখনো ওর হাত ছাঁড়বো না।- শোন এইবারের জন্য ক্ষমা করলাম কিন্তু আর কোনোদিন কুহুকে ফুলটুশী ডাকবি না।- ভাই আমি তোমার ফুলটুশী বলেছিলাম।- বলিস নারে বুকের মাঝে অসহ্য যন্ত্রণা হয়। ওকে শুধু আমিই ফুলটুশী ডাকবো আর কেউ না।- মনে থাকবে ভাই।- আরেকটা কথা রাখবি?- বলো।- আমার হয়ে ফুলটুশীকে একটা গান গেয়ে শুনাবি?- অবশ্যই শুনাবো। হাসনাদ সাহেব কূজনকে ঝাঁকুনি দিতেই কূজন বাস্তবে ফিরে এলো। হাসনাদ সাহেব বললেন,- কূজন যাও কুহুকে সামলাও মেয়েটা কষ্টে শেষ হয়ে যাচ্ছে। কূজন শেরওয়ানীর হাতায় চোখ মুছে চশমা পরে বেডরুমের দিকে এগুলো। দরজা খোলার শব্দ পেয়েই কুহু কলরবের আয়নাটা ব্যাগে রাখলো। কূজনকে দেখা মাত্রই কুহু চিৎকার বন্ধ করে জড়োসড়ো হয়ে বসে রইলো। কূজন মেঝেতে পড়ে থাকা বালিশ ভাঙ্গা ল্যাম্পশ্যাড দেখে এগিয়ে গিয়ে ফটোফ্রেমটা তুললো। ফ্রেমটা ভাঙেনি তাই জায়গায় রেখে তারপর গ্লাসে পানি ঢেলে কুহুর দিকে গ্লাসটা এগিয়ে দিলো। কুহু নিলো না কূজন পাশে বসে কুহুকে জোর করে পানিটা খাওয়ালো। কুহুর রাগে সারা শরীর জ্বলতে লাগলো। চোখ রাঙিয়ে কূজনের দিকে তাকাতেই কূজন বলল,- কুহু চলো বারান্দায় বসি। সামনেই ফুলের বাগান মাতাল করা গন্ধ আসে। তোমার ভালো লাগবে।কুহু জায়গা থেকে নড়লো না। কূজন বলল,- তোমার নিশ্চয় এখন আমার সাথে বিছানায় থাকার চেয়ে বারান্দার দোলনায় বসে থাকতে বেশি ভালো লাগবে।কুহু নিঃশব্দে উঠে কূজনের আগেই বারান্দায় চলে এলো। খোলা বারান্দা খুব সুন্দর! কুহু রেলিং এ হাত রেখে দূরে তাকিয়ে রইলো। কূজন কুহুর পাশে দাঁড়িয়ে বলল,- কুহু চাঁদের আলোয় তোমাকে অনেক মোহনীয় লাগছে।কুহু নির্লিপ্ত। কূজন বলল,- আমি যদি তোমার হাত ধরি তুমি কি সেদিনের মতো রাগ করবে?কুহু তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। কূজন কুহুর পিছনে দাঁড়িয়ে কুহুর দুইহাতে হাত রেখে কুহুর মাথায় চিবুক রাখলো। কুহুর ইচ্ছে হলো কূজনকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিতে কিন্তু চাপা নিঃশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছুই করলো না। কূজন রেলিং থেকে কুহুর হাত সরিয়ে এনে কুহুর হাতসহ কোমর পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। কূজনের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস অনুভব করতেই কুহু অস্ফুট স্বরে বলল,- আমি ভালোবাসতে জানি না তাই আমার কাছে থেকে ভালোবাসা পেতে চাইবেন না।কূজন মুচকি হেসে বলল,- তুমি সবাইকে খুব বেশি ভালোবাসো। আর আমি আগেও বলেছি,এখনো বলছি আর ভবিষতেও বলবো আমার একার ভালোবাসা আমাদের দুজনের জন্য যথেষ্ট।কুহু কূজনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো তারপর ঘুরে বলল,- আমি কলরবকে ভালোবাসি।কূজন কুহুকে বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,- একটা গান শুনাবো তোমাকে।- ছাড়ুন আমাকে আমি কোনো গান শুনতে চাইনা।কূজন ছাড়ার বদলে কুহুকে আঁকড়ে ধরলো। কুহু কূজনের সঙ্গে হাজার জাপটাজাপটি করেও নিজেকে কূজনের বাহুডোর থেকে ছাড়াতে না পেরে ক্লান্ত হয়ে নেতিয়ে পড়লো। অনেক্ষণ পর বলল,- কলরব আমাকে বিশ্বাস করলো না কেনো? ওকে আমি সত্যি ভালোবেসেছি। এই জীবনে আমি শুধু কলরবকেই মন দিয়েছি। আমি ওর মায়া ভরা মুখটা ভুলবো কি করে?যে ছেলেটার হাসির মাঝে কষ্ট লুকাতাম তাকে ছাড়া কীভাবে বাঁচবো আমি?কূজন কুহুর কথার পৃষ্ঠে বলল,- একটা গান শুনাই। কূজন গান ধরলো,"তুমি আয়না দেখো নাতুমি আয়না দেখো নাতুমি আমায় খুঁজো নাআয়নায় আমায় খুঁজো নাতুমি সইতে পারবে নাতুমি রইতে পারবে নাকিছু বলার থাকবে না কিছু করার থাকবে নাঐ আয়নায় যদি খুঁজে ফেরো তুমি আমাকেতবে পুড়তে পুড়তে পুড়েই ফেলবে তুমি তোমাকে"কুহু হঠাৎ করে কূজনকে আঁকড়ে ধরে অঝরে কাঁদতে লাগলো। কুহুর চোখের সামনে বারবার কলরবের হাসিমাখা মুখটা ভেসে উঠছে। কূজনের গান ছাপিয়েও কলরবের গগণবিহারী হাসিটা কানে আসছে। কুহুর নিঃশ্বাস ফেলতেও কষ্ট হচ্ছে। কূজন কুহুকে জড়িয়ে ধরেই পিছন দিকে যেতে লাগলো আর একাধারে কিন্নর কণ্ঠে গাইতে লাগলো,"তুমি আয়না দেখো নাতুমি আয়না দেখে নাতুমি আমায় খুঁজো নাআমাকে খুঁজলে পাবে না।"কূজন পিছোতে পিছোতে দোলনায় বসলো। কুহুকে টেনে নিজের কোলে বসালে। কুহু ধাক্কা দিয়ে উঠে গেল। কিন্তু কূজন নাছোড়বান্দা। কুহুকে জোর করে কোলে বসালো আর গেয়ে চলল,"একটার পরে একটা পুড়ছে আমার প্রিয় সুখ।ধোয়া এখন হচ্ছে আপনপুড়ছে রে এই বুকতুমি আর ভেবো না আর খোঁজনা এই আমাকেআমি এখন নষ্ট বড় তোমার অভাবেঐ আয়না দেখে অবাক হবেভাঙবে বোকা ঘুমআমি হঠাৎ করে ঘুমিয়ে যাবভাঙবে না সেই ঘুমআমার হারিয়ে যাওয়া ফুরিয়ে যাওয়া কাঁদাবে তোমায় খুবতোমার ঘুম হারানোর অসুখ হবে পুড়ে যাবে সব সুখ।তুমি আয়না দেখো নাতুমি আয়না দেখো নাতুমি আমায় খুঁজো নাআয়নায় আমায় খুঁজো নাতুমি সইতে পারবে নাতুমি রইতে পারবে নাকিছু বলার থাকবে না কিছু করার থাকবে না"কূজন গান শেষ করতেই দেখলো কুহু ঘুমিয়ে পড়েছে। সারাদিন এতো ধকল যাওয়ায় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। কূজন ধীরে ধীরে কুহুর হিজাব খুলে একে একে সব গয়নাগুলো খুলে রাখলো। চুলের খোপাটাও খুলে দিলো।কুহুর চুল গুলো পিঠ জোরে ছড়িয়ে পড়তেই কূজন বলল,- ওহ্ মাই গড! কুহুর চুলে হাত দিতেই কূজনের মনে হলো যেন কূজন আর নিজের মাঝেই নেই। কুহুকে ঘুম থেকে না জাগিয়ে পাঁজাকোলা করে রুমে নিয়ে এসে শুইয়ে দিল। কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে কুহুর জোড়াভ্রুগুলোর সন্ধিস্হানে আলতো করে চুমু দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,- তোমাকে ভালেবাসার অধিকার পাইনি কিন্তু দায়িত্ব পেয়েছি। কূজন সাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে মলম বের করে কুহুর হাতে লাগিয়ে দিচ্ছে আর বলছে,- কুহু তুমি এভাবে নিজের ক্ষতি কেনো করছো? তোমার প্রতিটা কষ্টের জন্য আমাকে জবাবদিহি করতে হবে। তোমার কান্না দেখে ভালোবেসেছিলাম জানতাম না সত্যি সত্যি কখনো যে বিধির খেলায় আমাকে এই কান্না মুছার দায়িত্ব নিতে হবে।মলম লাগানোর সময় কুহুর হাতের মেহেদীতে ইংরেজী অক্ষরে' 'কে' লিখা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।মলম লাগিয়ে কূজন লাইট অফ করে কুহুর পাশে শুয়ে পড়লো। ঘুমন্ত কুহুকে কূজনের কাছে ডিম লাইটের আলোয় অপ্সরী মনে হচ্ছে। কূজন কিছুক্ষণ একনাগাড়ে কুহুকে দেখার পর কুহুর দিকে ঝুঁকে কুহুর বুকে মাথা রাখলো। কুহু ঘুমের মাঝে কূজনকে সরাতে চাইলো। কূজন মাথা উঠালো না। কুহুর প্রতিটা স্পন্দন কূজন গুনছে। কূজন জানে সে কুহুর বুকে মাথা রেখে জীবন কাটাতে পারবে কিন্তু কুহুর হৃদপিণ্ডের ধুঁকপুকানিটা যে বারংবার কুহুরব কুহুরব বলে ধুঁকপুঁক করছে। কূজনের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে কুহুর বুক ভিজতে লাগলো। কুহুর হুঁশ নেই কুহু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কূজন ফিসফিস করে বলল,"তোমার প্রভাতফেরীর শুভ সকাল,রাতের খোলা জানালা,বিকেলের পড়ন্ত রোদ,কালবৈশাখী ঝড়,সবটাই কি আমি?নাকি শুধু ঠিক দুপুরের নির্জনতা?বালিশ ভিজানো ঢুঁকড়ে কাঁদা?"কখনো এই প্রশ্নটা তোমাকে করবো না কুহু,কখনো না! তোমাকে শুধু একটুখানি হাসাতে পারলেই চলবে আমার। তোমায় একটুখানি সুখী করতে পারলেই আমি হবো পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ,সবচেয়ে সুখী।♥সমাপ্ত♥