#চড়ুই_সংসার
২
________
সেজ্যোতির বাড়ি থেকে ফেরার পর মা'য়ের জেরার মুখে পড়তে হলো। মা ভারী অবাক গলায় শুধলেন,
-- এতগুলো বই কোথায় পেলি তুই? টাকা কে দিলো তোকে?
সচরাচর আব্বা-মায়ের থেকে কিছু লুকাইনা আমি । আজ তো সিরিয়াস ব্যাপার। তাই এ ব্যাপারটা লুকাতে পারলাম না। সত্যি বলে দিলাম। সেজ্যোতি যে কোচিং-এ ভর্তি হওয়ার জন্য টাকা দিয়েছে তা-ও বললাম। সব শুনে মা নিষ্প্রাণ গলায় বললেন,
-- টিউশন করিয়ে ক'টা টাকা আর উঠবে! গ্রামেগঞ্জে মানুষ মাস্টারদের তেমন টাকা কি আর দেয়! দিলে তো তোর আব্বার এত অভাব থাকতোনা৷ কিছু না ভেবেই এতগুলো টাকা নিয়ে নিলি ওর থেকে। আসলেই ফেরত দিতে পারবি তো!
মায়ের কথা শুনে আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। অযৌক্তিক কথা তো নয়। এগারো হাজার টাকা ফেরত দেয়াও মুখের কথা নয়। টিউশন করিয়ে ক'টা টাকাই বা পাবো আমি! তাছাড়া টিউশন এখনও পাইনি। পাবো কি না তাও জানিনা। বেশ
দোটানায় পড়ে গেলাম এবার।
রাত কাটলো এসব উল্টোপাল্টা চিন্তায়। একবার ভাবলাম নাহ্ ভর্তি হই, সুযোগ যখন এত সহজে এসেছে তখন তাকে হাতছাড়া করা ঠিক হবেনা। আবার ভাবি দু'টো দিন কি অপেক্ষা করবো? সেজ্যোতি স্টুডেন্ট খুঁজে এনে দিক তারপর না-হয় ভর্তি হলাম!
এই করে করে সারাটা রাত নির্ঘুম কাটলো। ভোরবেলার দিকে একটু তন্দ্রাভাব এসেছে ঐ মুহুর্তে মায়ের চাপা কান্নার শব্দ কানে এলো। চট করে উঠে বসলাম আমি। বাতি না জ্বালিয়ে অনেকটা নিঃশব্দে দরজা খুলে পা টিপে টিপে আব্বা-মায়ের ঘরের দিকে গেলাম। আচ্ছা আব্বা-মা'কে না জানিয়ে তাদের ঘরে আঁড়ি পাতা কি খারাপ কাজ? তীব্র সংশয়ে ফিরে আসতে মন চাইলো। কিন্তু পা দু'টো যেন আমার কথা শুনবে না কোনোমতে। একটুও নড়াতে পারলাম না দু’টোকে। সংশয়,অপরাধবোধ নিয়ে পুতুলের মত দাঁড়িয়ে রইলাম দরজার বাইরে।
ভাসা ভাসা কিছু কথা কানে এলো। আব্বা কাতর স্বরে বলছেন,
-- এরকম দুর্দিন এসে যাবে কখনো ভাবিনি বুঝলে প্রতীকের মা। ছেলেমেয়ে গুলোর পড়ালেখার প্রতি এত ঝোঁক অথচ ওদের প্রয়োজনীয় খাতাপত্র এনে দিতে পারিনা৷ এই সময় প্রজ্ঞাটা যদি ইউনিভার্সিটিতে পড়তো তাহলে এত চিন্তা করতে হতো না আমাদের। ও টিউশন করিয়ে নিজের খরচ নিজেই চালাতে পারতো, প্রতীকের মত।
-- প্রতীক নিজের খরচ নিজে চালায়! কাকে বুঝ দেন আপনি? পরিবারের কথা ভাবে ও? একে তো সরকারিতে চান্স পাইলোনা। বেসরকারিতে ভর্তি হয়ে স্রেফ বখে গেল। আপনি আমার কথা ধরতেছেন না৷ খোঁজ নিয়ে দেখেন ওর সম্পর্কে।
-- ছিঃ প্রতীকের মা কি বলছো এসব! ছেলে আমার লাখে একটা৷ ওর মত ভদ্র-নম্র, মেধাবী ছেলে এই এলাকায় আর একটা খুঁজে পাবানা।
-- আমাদের আগের প্রতীক আর নেই আপনি বুঝতে পারতেছেন না কেন? ফুলতির ভাই ঢাকায় চাকরি করে।এই ঈদে বাড়ি এসে বলছে প্রতীকরে ও নেশা করতে দেখছে একদিন। শহরে গিয়ে ও নিজেরে হারায় ফেলছে প্রতীকের আব্বা। আমাদের মান-সম্মান, টাকাপয়সা সব নষ্ট করতেছে।
এ পর্যায়ে ধমকে উঠলেন আব্বা,
-- তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে প্রতীকের মা। পরের ছেলের কথা শুনে নিজের ছেলেরে ভুল বুঝতেছ? কেউ যদি ভুল করেও এ কথা শোনে ছিঃ ছাঃ করবে।
-- সন্তানপ্রীতিতে পাগল হয়ে গেছেন আপনি। ও যদি ঠিক থাকতো তাহলে এই দেড় বছরে বাড়ি আসলো না কেন একবারও? মোবাইল তুলে কথা বলারও সময় নাই ওর! শুধুমাত্র টাকার দরকার হলে কল দেয়। চোখে ঠুলি পরে বসে আছেন আপনি। সত্যকে সত্য বলে মানতে চাইতেছেন না। আপনার এক সন্তানের প্রতি অন্ধত্বের কারণে বাকি সন্তানগুলা কষ্ট পাইতেছে। ছোটো দুইটার বয়স হইছে রাত জেগে এত কষ্ট করে পড়াশোনা করার? নাই ভালো খাবারদাবার, নাই কিছু। এরকম চলতে থাকলে কোনদিন যে অসুস্থ হয়ে পড়ে আমার বাচ্চাগুলা। আর প্রজ্ঞা! কোচিং কোচিং করে কালকে সন্ধ্যায় মানুষের থেকে টাকা ধার করে আনছে পড়ার জন্য।
-- বলো কি!
আঁতকে উঠলেন আব্বা।
-- কই এ কথা তো আমাকে আগে বলোনাই।
-- আমি কিন্তু আপনাকে বলে দিতেছি প্রজ্ঞাকে বাইরে পাঠাবোনা আমি। ওকে এইখানেই ভালো একটা ডিগ্রি কলেজে ভর্তি করায় দেন। মেয়েমানুষের এমনিতে বিপদের শেষ নাই। তারউপর এক সন্তান নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর আরেকজন ঐ লাইনে যাক আমি চাইনা। কালকে ওরে কিছু বলতে পারিনাই কিন্তু আপনাকে বলতেছি। নিষেধ করে দিবেন ওকে। সেজ্যোতির টাকা যেন ফিরায় দিয়া আসে। আর বইগুলা থাক। এবার হাতে টাকা আসলে বইয়ের টাকা দিয়া দিয়েন।
-- মেয়েটার মন ভেঙে যাবে।
-- আপনি নিজে একথা শুনে দুঃখ পান নাই? জীবনে অনেক খারাপ সময় আসছে। না খেয়ে থাকছি তবুও কারো সামনে হাত পাতি নাই। সেই আমাদের মেয়ে এখন পড়ার জন্য মানুষের কাছে টাকা ধার নিবে! কত লজ্জার কথা।
-- আমাদের মত নিম্নমধ্যবিত্তদের অত লাজ-শরম থাকতে নাই প্রতীকের মা।
-- আর কথা বাড়াইয়েন না আপনি। প্রজ্ঞারে আমি যাইতে দিবো না মানে দিবো না । কেন ডিগ্রি কলেজ থেকে পাশ করে মানুষ ভালোকিছু করেনা?
-- করে কিন্তু কম। মেয়েরে এই সময় দমায় রাখলে স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে দেবে।
-- যে স্বপ্ন ছোঁয়ার সামর্থ্য আমাদের নাই সে স্বপ্ন দেখবোই বা কেন!