- তা ঠিক , মেয়েছেলের বিয়ে তাড়াতাড়ি হওয়াই ভালো।তাও তো শর্মিষ্ঠার তেইশ হয়ে গেছে। পারফেক্ট বয়স।
- তেইশ হবে সামনের মাসে।
- তবে? এখন চাকরি করব , বাকরি করব বিয়ের তো একটা বয়স আছে। বিয়ের পর পড়তে অসুবিধা কোথায়? এই চাকরি করে করে তো ঐ মিতালিদির মেয়েটার বিয়েই হল না। বড় চাকরি, দেখতেও সুন্দর । কিন্তু এখন বয়স অনেক। কত দিন আগে শুনলাম ত্রিশ পেরিয়ে গেছে। এই জন্য বিয়েটা সময় থাকতে দেওয়াই ভালো।
- হুমম্ । এবার বিয়েটা দিয়ে দেব দিদি। পড়া তো প্রায় শেষের দিকে। এবার ঘর সংসার করুক। সুখে থাকুক।আর কী চাইব!
- কোনটা ঠিক করলি? মেদিনীপুরের ছেলেটিকে বেশ ভালোই লাগল। খারাপ নয়।
- দেখি। আসলে কাছাকাছি হলে ভালো হত। একমাত্র মেয়ে ।
কথা হচ্ছিল শর্মিষ্ঠার মা আর বড় মাসির।
শর্মিষ্ঠা বছর তেইশের হয়ে গেছে। এর থেকে বেশি নাকি বাঙালী মেয়ের বাপের বাড়িতে থাকা উচিত নয়। তাই এবার শর্মিষ্ঠার বিয়ে দেবার জন্য বড়মাসি আদাজল খেয়ে লেগে পড়েছে এবার।
ঘরে অর্ঘকে ঢুকতে দেখে শর্মিষ্ঠার মা বন্দনাদেবী উঠে দাঁড়িয়ে বললেন - আয়। শর্মিষ্ঠা এখন নেই।
- ও। ঠিক আছে আমি...
- দাঁড়া দাঁড়া এসছিস যখন বোস। ও এখুনি এল বলে। আমি তোকে ডাকব ভেবেছিলাম, ভালোই হল এলি দেখ না শর্মির জন্য কোন পাত্রটা ভালো হবে? দিদি অনেকগুলো ভালো সম্বন্ধ এনেছে। আয় দেখ। তুই তো ওর পছন্দ জানিস। কোনটা ভালো হতে পারে বলত? কাছাকাছি চাইছি। কিন্তু তেমন কাছে হচ্ছে না।সব দূরে। চাইলেও ঘনঘন দেখা হবে না।অর্ঘর মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। বন্দনাদেবী আনন্দের আতিশয্যে খেয়াল করল না অর্ঘর মুখটা।
অর্ঘ আর শর্মি সেই ছেলেবেলার বন্ধু। অর্ঘরা যখন এ পাড়াতে বাড়ি করে তখন শর্মি থ্রি আর অর্ঘ ফাইভ । দুটো বাড়ির পরেই শর্মিদের বাড়ি। কাছাকাছি আর অর্ঘর বয়সী কেউ না থাকাতে একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল দুজনের মধ্যে। যেটা আজও আছে। তবে সেইরকম না।অনেক বেশি মজবুত।
ঝগড়া , খুনসুটি, একসাথে স্কুল যাওয়া , প্রোজেক্ট , পড়া দেখানো, পুতুলের বিয়ে , ঘুড়ি ওড়ানো, বনভোজন সবেতেই অর্ঘর সাথী শর্মি।
আরও বন্ধু দুজনেরই আছে কিন্তু ওরা একে অপরের জন্যই । সব কথা বলা থেকে কী করবে। প্রথম কলেজে উঠে শর্মির কাকে কাকে ভালো লেগেছিল, কজন প্রপোজ করেছিল সব জানে অর্ঘ। একমাত্র অর্ঘই।
ছোটো থেকে দুজনকে এইভাবেই দেখছে। বরং এভাবে না দেখলেই ভালো লাগে না কারো। ছোটোবেলার বন্ধুত্ব বলে কথা।
কিন্তু সম্পর্কটা এখন কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, অর্ঘর মনের ভেতর কী আছে , কী চাইছে তা কেউ জানেনি। ছোটোবেলার স্নেহ , শাসন, ভালোবাসা আজ প্রেমে রূপান্তরিত হয়েছে।
অর্ঘ শর্মিকে ভালোবাসে ফেলেছে। আর এটা ও হঠাৎ বুঝেছে। হঠাৎ করে কলেজে ওঠার পর বাকি বন্ধুদের প্রেম- প্রপোজাল সব দেখে ও ফিল করে শর্মির প্রতি ওর ভালোলাগাটা। কিন্তু তখন বলেনি। আরেকটু বড় হোক, পরিণত হোক, এখন তো ছোটো এই করে লাজুক, সল্পভাষী অর্ঘ বলাটা পেন্ডিং রেখেছে।
শর্মিকে কয়েক লাখবার এই পাঁচ বছরে ভালোবাসি বলা হয়ে গেছে। শর্মিও রাজি। বিয়ে, সংসার। কিন্তু ।দেয়ার ইজ এ লিটিল কিন্তু ।সব স্বপ্ন। বাস্তবে শর্মির সাথে কথা বলে , গল্প করে , শর্মি রাগ করলে ভাঙায় এইভাবেই কাটছে দিন।
তবে একটা পার্থক্য এখন অর্ঘ শর্মিকে অল্প লজ্জাও পায়। ফিউচারের ওয়াইফ।
কিন্তু আজ দেখা করতে এসে এই। আন্টি বসে আছে এক ঝুড়ি সম্বন্ধ নিয়ে ।
অর্ঘ সুপাত্র। সব দিক দিয়েই । সুদর্শন, সুপুরুষ । ভালো ঘর, শিক্ষিত পরিবার। নিজেদের অফিসেই কাজ করে।বিত্তবান ।কিন্তু অর্ঘ আর শর্মির বিয়ে হতে পারে এটা কেউ ভাবেইনি। ওদের বন্ধুরাও না।
একা অর্ঘই ভেবেছে। কিন্তু বলার কিছুই নেই। সংযমী , অভিমানী অর্ঘ বসে বসে নিজের স্বপ্নের বউ-এর জন্য পাত্র বাছতে লাগল। আলোচনা করল কে ভালো, কে কাছে , কার ঘর ভালো , কে শিক্ষিত, আচার ব্যবহার সব।
কাছাকাছি হলে ভালো হত - এর উত্তরে অর্ঘ বলল আমার থেকে কাছে পাবে না আন্টি।আর এদের থেকে আমি কমও তো নই।আর শর্মিকে তো আমি ছোটোবেলা থেকে চিনি।তোমরাও আমাকে চেনো। আমি শর্মিকে বিয়ে করতে চাই।তুমি রাজি?
কিন্তু সবই স্বপ্ন।
স্বপ্ন ভাঙতেই আসছি বলে বেরিয়ে গেল।যতই শক্ত মনের হোক, নিজের ভালোবাসার জন্য পাত্র বাছা খুব কঠিন।
নিজের রুমে এসে বসল অর্ঘ। সত্যিই কি শর্মির বিয়ে হয়ে যাবে? এ জিনিসটা এখনও কেমন যেন অর্ঘ বুঝতে পারছে না। ছোটোবেলার অভ্যাস ।শর্মি অন্য কারও হবে এটা মানতে ভালোই কষ্ট হচ্ছে।
কত স্মৃতি শর্মির সাথে! শর্মি যখন মামাবাড়ি বা দেশের বাড়ি বা অন্য কোথাও যেত ভালো লাগত না অর্ঘর।সব ফাঁকা লাগত।আবার নিজেও যখন যেত একই।ভালো লাগত না।
এই বাড়িতেও শর্মি কতবার থেকেছে।একই সাবজেক্ট হওয়াতে কতবার পরীক্ষার আগে দায়িত্ব নিয়ে পড়ানোর কাজটা অর্ঘই করেছে। তখন কত গল্প করেছে সারারাত!
শর্মির যা ছবি অর্ঘর কাছে আছে তা শর্মিরও নেই।কত টুকিটাকি জিনিস, সাথে কত কিছু সব আজও একইভাবে রাখা। সব ছেড়ে শর্মি ওর একান্ত আপন শর্মি চলে যাবে? আর সারারাত গল্প করা হবে না! আর শর্মির ওপর জোর থাকবে না! ঠান্ডা লেগে অর্ঘর জ্বর এলে দেখতে আসবে না!
এগুলো সত্যিই । শর্মি এমন করে জড়িয়ে গেছে যে চলে গেলে অর্ঘকে শেকড় শুদ্ধ উপড়ে যাবে।
একা ব্যালকনিতে বসে মন খারাপ করছিল, কষ্ট পাচ্ছিল অর্ঘ।
শর্মির সাথে দেখাও করেনি। পাত্র দেখেই চলে এসেছে।
এরপর পাকাদেখা , বিয়ের আগের খুনসুটি, বিয়ে!
হঠাৎ অর্ঘ সিদ্ধান্ত নিল শর্মির বিয়ের সময় ও এখানে থাকবে না।যাই হয়ে যাক কিছু একটা বলে পালাতেই হবে। চোখের সামনে শর্মি ওর শর্মি অন্য কারও হবে এটা মানতে পারবে না অর্ঘ।যতই কষ্ট হোক শেষ দেখাটা করবে না।যে যাই বলুক , শর্মি যতই রাগ-অভিমান করুক ও-ও তো মানুষ। চলে যাবে ওই কটা দিন। আর আন্টি যতই বলুক ও একটা পাকা দেখাতেও যাবে না।
- হোই।
শর্মির ডাকে সম্বিৎ ফেরে।
- তুমি?
- তুমি চলে এলে। মা বলল এসেছিলে। নেই দেখে চলে গেছ।তাই এলাম। বই খাতাও এনেছি। বুঝিয়ে দাও। কিছুতেই মাথাতে ঢুকছে না। বড় কঠিন। ফেল না করি! কই?
- হ্যাঁ?
- বোস। বোঝাবে না ?
- শর্মি তোমার বিয়ে?
- সত্যিই মা আমার বিয়ে নিয়ে ক্ষেপেছে। বিয়ে না করলে হবে না।সকাল সন্ধ্যা একটাই জপ বিয়ে।আজ আবার মাসি এক ঝুড়ি সম্বন্ধ এনেছে। এবার সবাই বিয়ে দিয়েই ছাড়বে। নইলে মুক্তি নেই।বোস।অমন দাঁড়িয়ে কেন?
- হ্যাঁ । শর্মি তোমার এখন বিয়ে করতে আপত্তি নেই।
- সত্যি বলতে না। এতটুকু না। বেশ কত গিফ্ট পাব , শাড়ি গয়না , কত বড় অনুষ্ঠান। মায়ের বকানি থেকে মুক্তি। আমি অলক্ষ্মী বলার বদলে আমি যে কত ভালো মেয়ে, লক্ষ্মী মেয়ে এইসব বলবে। ঘর অগোছালো করলে এই কদিন বকবে না। যা বলব বানিয়ে দেবে। সবচেয়ে বড় কথা বিয়ের পর বাড়ি গেলে জামাই-এর সাথে আমাকেও চৌষট্টি ব্যঞ্জন খাওয়াবে। আমি তো খুব এক্সাইটেড। মা তো বলল তিন মাসের মধ্যেই বিয়ে।এক মাস পরীক্ষা, তারপর কেনাকাটি , আয়োজন তো তিন মাস।
অর্ঘর খুব জোর একটা ধাক্কা সামলে আস্তে আস্তে বলল - সব কিছু খুব সোজা মনে হয়।তাই না ?
- মানে?
- বিয়ে ব্যাপারটা এত সহজ নয়। অনেক জটিল ব্যাপার। কত দায়িত্ব, কত বৃহত্তর জীবন। শাড়ি গয়না এসব আর বিয়ে এক নয়। এইজন্য কেউ বিয়ে করে না।
- তা জানি।
- তবে ?
- আরে , অসুবিধার কী আছে? যেমন ছোটোবেলা থেকে সব দায়িত্ব সামলে এসেছে তেমনিই সামলাবে। আমি শাড়ি গয়না নিয়ে ভাবলেও বিরাট কোনো ক্ষতি হবে না। এবার বুঝিয়ে দাও। এক মাস পর পরীক্ষা ।
- মানে?
- মানে এক মাস পর পরীক্ষা । চ্যাপ্টা....
- না না, তার আগে কী বললে? আমার দায়িত্ব মানে?
- বাঃ! মেয়ে বলে সব দায়িত্ব আমার? মেয়েদের অর্ধেক, ছেলেদের অর্ধেক। কিন্তু যেহেতু আমি অত পারব না তাই পঁচাত্তর আর পঁচিশ।পরে শিখে যাব।
- শর্মি!
শর্মিষ্ঠা কিছুক্ষণ চুপ করে অন্যদিকে চেয়ে রইল। অর্ঘ উত্তরের জন্য অধৈর্য হতে লাগল।
তারপর অর্ঘের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় বলল - আমি ভেবেছিলাম তুমি বলবে আগে। কিন্তু বললেই না। মেয়েরা কি আগে বলে? তা তোমার হেলদোল নেই।এরকম করলে অন্য কাউকে বিয়ে করতে হবে।
- তুমি এরকম কিছু ভাব আমি কোনোদিন .....
- তোমাকে আলাদা করে বলতে হবে এটা আমি কোনোদিন ভাবিনি।
- আন্টি আঙ্কেল?
- মা? আমাকে পাত্রের কথা বলতেই আমি তোমার কথা বলেছি। যে তোমাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করব না । মা বলল এত ভালো কথা আমি নাকি কোনোদিন বলিনি। মা বলল আজকেই আন্টির সাথে কথা বলবে।আশা করি আন্টি অরাজি হবেন না।
- তা হবে না। কিন্তু ....
- কিন্তু ছাড়। আগে বোঝাও। ফেল করলে তো বিয়ে হবে না। ফেল করার জন্য দুঃখ হবে তো।
বর্ষার মেঘ কেটে শরতের আলোর মত হাসিতে ঝলমল করতে করতে অর্ঘ বলল - এত জটিল জিনিস বুঝে গেলে , সেখানে এইটা তো কিছুই না।-: সমাপ্ত :-