আমি যখন বেবি কনসিভ করি, আমার বয়স ২১বছর। এই একুশ বছরের আগের জীবনটায় আমি অন্য একটা মানুষ ছিলাম। গর্ভধারণের পর একুশ বছরের আমি নতুন করে জন্ম নিলাম।
সেই জন্মে আমি মেয়ে থেকে মা হয়ে গেলাম।মা হবার জার্নি শরীর খারাপ হওয়া দিয়ে শুরু হলো। প্রচন্ড বমি। কিচ্ছু খেতে পারি না। সবকিছু থেকে গন্ধ পাই। পেট পাঁক দিয়ে বমি পাওয়া গন্ধ! আশেপাশে কারো বাড়িতে ভাতের হাঁড়িতে বলক আসলে আমি গন্ধ পেয়ে বলে দিতে পারি। কেউ ধনেপাতা কেটে আমার কাছে আসলেই বুঝতে পারি। চানাচুরে গন্ধ, টিভিতে রান্না হলে সেই গন্ধ, গায়ের কাপড়ের ডিটারজেন্টের গন্ধ, কলমের কালি থেকে গন্ধ। এই পৃথিবী আমার কাছে হয়ে গেলো গন্ধওয়ালা বমির পৃথিবী। অবস্থা এত খারাপ হয়ে গেলো যে, খাওয়া দাওয়া বন্ধ হয়ে মরি মরি। হাসাপাতালে ভর্তি করে স্যালাইন দেওয়া হলো।
পাঁচমাসের সময় থেকে শুরু হলো নতুন সমস্যা, সবকিছু ভুলে যাই। বাথরুমে গেলে কল খুলে চলে আসি। আলমারির চাবি চালের ড্রামে, চা বানালে চিনি দিতে ভুলে যাই, মাছের পুটলা কাপড়ের ড্রয়ারে, ভেজা কাপড় শুকাতে দিতে ভুলে যাই, ভাত চুলায় দিয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি, ইফতারে বসলে আযানের আগেই কিছু না কিছু খেয়ে ফেলেছি, সব জিনিসপত্র এলোমেলো রাখছি ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমার তিনি আমার এই অবস্থার নাম দিলেন "অগ্নিপরীক্ষা"।সাতমাসে শুরু হলো নতুন অগ্নিপরীক্ষা। প্রস্রাবের সমস্যা। মাঝে মাঝে প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আবার মাঝে মাঝে প্রস্রাব বেগ পাবার আগেই লিক করে যাচ্ছে। (সোজা বাংলায় কাপড়ে পরছে)। এর সাথে হাত পায়ে পানি এসে ফুলে ঢোল। কোনো জামা গায়ে হয় না, কোনো জুতোই পায়ে ঢুকে না। শরীর এত ভারী হয়ে গেলো যে একা একা বসতে পারি না, উঠতে পারি না। সারারাত প্রস্রাবজনিত ঝামেলায় জেগে থাকি। ডক্টরের দেওয়া ডেটের পঁচিশ দিন আগে আমার শরীর খারাপ হয়ে গেলো। জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে যেতে হলো।
আমার মনে আছে, হাসপাতালে ভর্তি হবার সময় আমি একটা ইয়া মোটা ম্যাক্সি আর খালি পায়ে গিয়েছিলাম। নার্সরা আমায় দেখে ফিসফাসে বলেছিলো, এই রোগী তো বাঁচবে না। মুখটাও ফুলে গেছে। বাচ্চা ঠিক আছে কিনা কে জানে?
আমি জানি, সেই সময়টায় আমি পরম করুণাময়ের কাছে আমার জীবনের বিনিময়ে আমার সন্তানের জীবন চেয়েছিলাম। মনে মনে বলছিলাম, আল্লাহ আপনার এত সুন্দর পৃথিবী আর ওরা দেখবে না। আমার দেখা শেষ। আপনি ওদের দেখার সুযোগ করে দিন।
সিজারিয়ান সেকশানের সময় আমি অস্পষ্ট স্বরে বলেছিলাম, আমার খুব শ্বাসবন্ধ হয়ে আসছে ডাক্তার। আমি মরে যাচ্ছি। ডাক্তার সেডিল দিয়ে আমায় ঘুম পারাবার বৃথা চেষ্টা করলেন।
এর মধ্যে আমার মেয়েটার জন্মের পর শুরু হলো প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট! অক্সিজেন দিতে হলো। কম ওজনের বাচ্চা ছিলো কিনা। ছেলেটা সকাল সাড়ে সাতটায় হয়ে সন্ধ্যা আটটা পর্যন্ত পায়খানা করেনি। এই যে শুরু হলো বাচ্চাদের নিয়ে টেনশন…. এখনো চলছে।
বেবিদের নিয়ে হসপিটাল ছাড়ার সময় ডক্টর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
---মা হয়ে কেমন লাগছে?
আমি জবাবে বলেছিলাম,
---খুব টেনশান লাগছে।
---একটুও ভালো লাগছে না? একটু আনন্দ?
---লাগছে। পেটটা খুব পাতলা পাতলা লাগছে।সেই থেকে অন্যজীবন শুরু হলো আমার…. যে জীবনে আমার বলে কিছু নেই। আমার জীবনের সবকিছুর কারণ এখন সন্তানেরা।
এখন পর্যন্ত বেঁচে আছি, এই সন্তানের জন্য! করুণাময়ের কাছে হাত তুললে, ওদের কথা প্রথমে চলে আসে। আমার মা আমার জন্য কি করেছে, আমি হয়তো তা গুছিয়ে লিখতে পারবো না। এটা লিখে তুলে ধরবার বস্তু নয়ও। কিন্তু এটুকু আমি নিশ্চিত করে জানি এই পৃথিবীর প্রতিটা মা একেকটা আলাদা পৃথিবী। যে পৃথিবীতে তাঁর দুশ্চিন্তা, তাঁর যুদ্ধ, তাঁর ভাবনায় আর কোনো পৃথিবী টেক্কা দিতে পারে না। মা হবার কি যে শক্তি আর আনন্দ তা শুধু মা'ই জানে।খুব বেশি ভালো থাকুক এই পৃথিবীর সকল মা তাদের সন্তানের পৃথিবীতে।
প্রতিটি দিন হোক সকল সন্তানের জন্য মা-দিবস!বিঃদ্রঃ আমার মা আমাকে এখনো মারে।
আমি কেন প্রেম করে অতিব তাড়াতাড়ি বিয়ে করে পড়াশোনার ক্ষতি করেছিলাম সেইটা নিয়ে এখনো খোঁটা দেয়। তবে এই নিয়ে মা'কে আমি কখনোই স্যরি বলিনা।
শুধু বলি, আই লাভ ইউ টু মা...#তৃধা_আনিকা