এই সময়ে..

42 6 4
                                    

জানালাটা খুলে দিলাম। জানালার সাথে লাগোয়াপ্রায় বেলগাছটিতে এখন ফুল ফোটার সময়। তাই শত শত মৌমাছি ঘিরে রয়েছে বিশালাকারের বেল গাছটাকে। জানালা খুলে দেওয়ায় মৌমাছিরা কিন্তু ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ছে না। ফুলের মধু ফেলে তারা অন্য কোথাও কেন যাবে? মৌমাছিও তার নিজ স্বার্থটা বোঝে। দৃষ্টিটা একটু অন্যদিকে ঘোরালাম। দেখছি রাস্তায় মানুষের সংখ্যা কম না। তিনজন লোক মুখের কাছে মুখ নিয়ে কথা বলছে। মাস্ক পরা নামমাত্র। এইতো, দুটো মোটরসাইকেল গেল। ছেলেগুলো গাদাগাদি করে বসেছে। মুখে মাস্কও নেই মনে হলো। নীল অটোটাতে মানুষের বসা দেখে দম আটকে আসছে। আবার মুদির দোকানটায় মানুষও নেহাৎ কম বসেনি। এরা এতো অবুঝ কেন?
দুর্নিবার গতিতে ছড়াচ্ছে কোভিড-১৯।লকডাউনের মধ্যেও মানুষ সামাজিক দূরত্ব মানছে না।যাদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকে তারা যথাযথভাবে নিজেকে প্রোটেক্ট করে বেরোতেই পারে। কিন্তু এরা তো রীতিমতো আড্ডা দিতে বসেছে।

আপা, কি করছিস?

পেছনে ঘুরে দেখলাম আমার ছোটবোন নিশা। আমার থেকে পাঁচ বছরের ছোট। এবার ক্লাস সেভেনে।

আমি বললাম, দেখতে পাচ্ছিস না বসে আছি। চার চোখ দিয়েও ইদানীং কম দেখিস।

চশমাটা ঠিক করতে করতে নিশা বলল, আবার তুই জানালাটা খুলেছিস। দেখছিস না কত মৌমাছি। ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লে কি হবে?

এ পর্যন্ত একটাও তো ঢোকেনি। অযথা চেঁচাস না। মাথা ধরে যায়।

নিশা আমার দিকে রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে জানালার গ্লাসটা টেনে লাগিয়ে দিল। মুখটা খানিকটা অ্যাঞ্জেলিনা জোলির মতো সুচালো করে বলল, মনে হচ্ছে বেলগাছটা বাংলাদেশ আর গিজগিজে মৌমাছিগুলো পাকিস্তানি সৈন্য।

আমি রাগী রাগী মুখ করে বললাম, তোর কাজ হলো সব কিছুর মধ্যে থেকে অসৌন্দর্য খুঁজে বের করা। কি সুন্দর মধু আহরণ আর পরাগায়ণ পর্ব চলছে, তুই তার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের নির্মমতা নিয়ে আসছিস! কোনো কোনো মানুষ অসুন্দর জিনিস নিয়েই বেঁচে থাকে।তার চারপাশে হাজারটা সুন্দর জিনিস থাকলেও, সে তার মাঝে থেকে খুঁত খুঁজে বের করে। আবার কেউ কেউ অসুন্দর কেও সুন্দর মনে করে। তাদের চারপাশে হাজারটা অসুন্দর জিনিস থাকলেও মনে হয় জীবনটা সৌন্দর্যে ভরপুর।

নিশা বিরক্তের সাথে বলল, যেমন?

শরৎচন্দ্রের "শ্রীকান্ত" পড়েছিস? ওখানে গল্পের এক পর্যায়ে লেখককে চাকরীর জন্য বার্মায় যেতে হয়। লেখক পানিপথে জাহাজে করে বার্মায় যাচ্ছিলেন। রাত্রিবেলা ভীষণ ঝড় ওঠে। এমন ঝড় যে সবাই ধরেই নিয়েছিল যে, জাহাজটা ডুবে যাবে। যেখানে জাহাজের কেবিনে সবাই গাদাগাদি করে বসে দৈত্যের ন্যায় ঝড়ের হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রার্থনা করছে , সেখানে ওই ভয়ানক সময়ে জাহাজের ডেকে ছিলেন একমাত্র লেখক। তিনি ভাবলেন, মারাই যখন যাচ্ছি তখন প্রকৃতির অজানা রূপ দেখেই মরব।

তিনি কি মারা গিয়েছিলেন?

না, জাহাজটা শেষ পর্যন্ত অবশ্য ডুবে যায়নি। লেখকসহ সবাই বেঁচে গেছিলেন।

নিশা চোখ সরু করে বলল,অসুন্দর কে সুন্দর করে দেখা কি ভালো ?

না তা অবশ্য না। তবে এ শ্রেনীর লোকেরা সাধারণত কবি-সাহিত্যিক হয়।

আলতু-ফালতু কথা বলবি না তো। নিজেকে কি মনে করিস ? উইলিয়াম শেক্সপিয়ার ?

আমি হাসলাম। নিশা মুখ ঝামটা মেরে চলে গেল।

আজকের পত্রিকাটা হাতে নিলাম। ধাইধাই করে বাড়ছে কোভিড১৯ এর সংক্রমন। এমনই পুচকি ভাইরাস যে চোখে দেখা যায় না, নড়াচড়া করার ক্ষমতাই নেই অথচ মানুষ মেরে সাফ করে দিচ্ছে। ভাবলাম সার্স, মার্স এগুলোও তো একধরনের করোনা ভাইরাস। প্রায় দশ বছর মত পার হয়ে গেলেও এখনও এর টীকা বা প্রতিষেধক বের হয় নি। কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রেও কি এরকমটা ঘটার সম্ভবনা একদমই নেই ? যদিও বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা উঠেপড়ে লেগেছে এই মরণঘাতী ভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরিতে। আশা করছি এই দুর্যোগ কেটে যাবে। ভাবতে ভাবতেই একটা খবরে চোখ আটকে গেল। "'করোনা ভাইরাসের ভয়ে শেরপুরে বৃদ্ধা মাকে জঙ্গলে ফেলে এসেছে সন্তানরা"'
চোখটা কেন জানি ভিজে উঠল। নিজের অজান্তেই গুনগুন করে গেয়ে উঠলাম,
"একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না......"

                                                   (সমাপ্ত)

এই সময়ে..Where stories live. Discover now