দুপুরবেলা বারবাড়ির উঠোনের ধানগোলার ওধারে খেলছিল তানি। এখন ইশকুল টিশকুল নেই। অন্য সময় হলে গাঁয়ের মেয়েরা সবাই দুপুরে আসত ভীড় করে। এখন তার উপায় নেই। দাদাজান বলে দিয়েছে, কারওর আসা চলবে না, কেউ বেরোবে না। এমনকি আব্বাজানও না। আব্বাজান তো কলকাতায় ডাক্তারি করে — তাই আব্বাজানেরও বাড়ি আসা বারণ — বলেছে দাদাজান। তানির তাই মন খারাপ থাকে। কিন্তু এর জন্য দাদাজান দায়ী নয়। দায়ী ওই সাংঘাতিক অসুখ। করোনা। আব্বাজান হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরলে দাদাজান আর দাদি-আম্মার অসুখ হতে পারে। হতে পারে তানি আর বাবানেরও। তানি তো তবু বড়ো হয়েছে, সাত পেরিয়ে আট বছর বয়স হলো। ইশকুল খোলা থাকলে এখন ক্লাস থ্রি। বাবান তো এখনও তিন-বছরও নয়।
আজকাল তানির সব খেলার নামই করোনা-ভাইরাস দিয়ে। আজ খেলল করোনা-ভাইরাসদের ইশকুল। ক্লাসসুদ্ধ ছাত্র সবাই করোনা-ভাইরাস। তানি প্রথমে শেখাল, কী করে মানুষকে জ্বালাতন না করে নিজেদের মতো বাঁচা যায়। তারপরে পরীক্ষা নিল। খুব খারাপ ছাত্র সবাই। কেউ পাশ করল না। খালি মানুষ মারতে চায়! আশ্চর্য!
তারপরে হোম-ওয়ার্ক দিল। বলল, সবাই কাল পর্যন্ত পুকুরে ডুবে থাকবে। গভীরে। শুধু গ্রামের এঁদো পচা পুকুরটায়। যেটাতে মাছ-টাছ নেই, কেউ সাঁতার কাটে না, যেটাতে মশা হয় বলে পঞ্চায়েত থেকে বছরে দু’বার ব্লিচিং পাউডার দিয়ে যায়। আব্বা বলেছে ব্লিচিং দিলে মরে যায়। ভিডিও পাঠিয়েছে, ব্লিচিং-এর ধোঁয়া দিয়ে হাসপাতাল সাফ করা হচ্ছে। সেটা তানি পড়ায়নি। ওরা শিখে গেলে পুকুরে যাবে না — তানির অতটা বুদ্ধি আছে।
তারপরে মা’র ডাক শুনে বিকেলের জলখাবার খেতে দৌড়ল। মনে হলো দৌড়তে দৌড়তেও ‘করোনা হয়েএএএছে’ বলে চেঁচাতে হবে। যেমন মনে হওয়া, তেমন কাজ। ধানের গোলার পেছন থেকে বেরিয়ে, ঢেঁকিঘরের সামনে দিয়ে, গোয়ালঘর পেরিয়ে, ভেতরের বাড়ির উঠোনে ঢুকে, ‘করোনা হয়েএএএছে’ বলে চেঁচাতে চেঁচাতে যেমন রান্নাঘরের দাওয়ার দিকে দৌড়েছে, ওমনি মনে হয়েছে, এই খেলাটার আর একটা ধাপ থাকলে ভালো হয়। দৌড়তে দৌড়তে না চেঁচিয়ে দৌড়বে চুপ করে, আর একটু পরে পরে, এক পায়ে দাঁড়িয়ে “করোনা হয়েএএএছে’ বলে চেঁচিয়ে আবার দৌড়বে।
প্রায় পৌঁছে গেছে রান্নাঘরের দাওয়ায়, এমন সময়ে প্রথম বার থেমে ‘করোনা হয়েএএএছে’ বলে চেঁচাতে গিয়েই বিপদে পড়ল। প্রাণপণ ছুটতে ছুটতে হঠাৎ থামলে কী হয়, সেটা জানত না তানি। তা-ও আবার এক পায়ে! হুমড়ি খেয়ে পড়ল সামনের দিকে। আর তক্ষুনি রান্নাঘরের পাশের খাবার ঘর থেকে ছুট্টে বেরিয়েছে ভাই। টলোমলো পায়ে নিয়ে আসছে দিদির জন্য মুড়ির বাটি। “দিদি, মুই-ই-ই! দিদি, মুই-ই-ই!” সিঁড়ির ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে তানির চোখে অন্ধকার, দিদিকে পড়তে দেখে বাবানও ভয় পেয়ে উল্টোদিকে দৌড়তে গিয়ে দাওয়ার ওপরে থ্যাপাস, বাটি থেকে সব মুড়ি বাবানের মাথায় আর গায়ে, আর তারপরে দুই ভাইবোনের পরিত্রাহী কান্না।
সব্বাই ছুটে এল, দাদি-আম্মা ধরল বাবানকে, আম্মিজান ধরল তানিকে, জল দেওয়া হলো, মুখ মুছিয়ে দেওয়া হলো, চোখের জল শুকিয়ে দেওয়া হলো — ঠিক তখনই চাচি এসে বলল, “এই দেখ, আব্বা ফোন করেছে...”
ভিডিওতে আব্বাজান! কাজ সেরে হাসপাতাল থেকে ফিরেছে। আব্বাকে দেখে তানির কান্না থেমে গেল। বাবানও — বাবা বাবা, বলে ঝাঁপিয়ে পড়ল দাদির কোল থেকে।
ভাইবোন কিছুক্ষণ বাবার সঙ্গে গল্প শেষ করে যখন আম্মির সঙ্গে খাটে শুয়ে রয়েছে, বাইরে থেকে দাদাজানের গলা খাঁকরানির শব্দ এল।
আম্মি বলল, “আসুন, আব্বা,” বলে উঠে বসল। ঘোমটা টেনে দিল মাথায়।
দাদাজান ঢুকে দরজার পাল্লার দিকে তাকিয়ে বলল, “তানি, মা আমার, তুমি পড়ে যাবার আগে কী বলছিলে? করোনা হয়েছে... করোনা হয়েছে... কার হয়েছে করোনা? গাঁয়ের কারও?”
তানি খুব গম্ভীর হয়ে বলল, “না, দাদাজান, গাঁয়ের কারওর না। সারা পৃথিবীর করোনা হয়েছে।”
দাদাজান নিশ্চিন্ত হয়ে নমাজ পড়তে গেল বাইরের ঘরে।
মে, ২০২০