হায় ভালবাসি

91 3 2
                                    

১.
"ছেলেটা কে আমার কোন কারন ছাড়াই ভাল লাগে জানো!" শুভ্রার মুখে আজকে  তৃতীয় বারের মতন এই এক কথা শুনে বিরক্ত লাগলেও মুখ টা হাসি হাসি রাখলেন রেবেকা। মেয়েকে বিয়ে দাওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি। বিভিন্ন ভাবে মেয়ে যে বুঝিয়ে শুনিয়ে বিয়ে টা দিতে পারলে হয়। মেয়েটা তার বড্ড খেয়ালি। এমন খেয়ালি একটা মেয়ে কিভাবে এত চোখ ধাঁধানো রেজাল্ট করে পরীক্ষায় সেটা হয়ত খোদাই জানেন! এই খেয়ালি মেয়ের মাথায় একেক সময় একেক টা জিনিস ভর করে, কোন কিছুতেই তার মন পুরোপুরি বসে না। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা যাকে দেন, তাকে বোধহয় পুরোপুরিভাবে সব ই দেন। মেয়েটা তার অসম্ভব গুনী। কোন কিছুই খুব মনোযোগ দিয়ে শেখেনি যদিও রেবেকা চেষ্টা করে গেছেন ছোটবেলা থেকেই। তবুও সে সব ই পারে, পারে বলতে অসম্ভব ভাল পারে। ছবি আকে সুন্দর, গান গায় আরো সুন্দর, এমনকি নাচ ও মাঝে মাঝে যখন করে তখন কেউ হয়ত বুঝতেই পারবে না যে দুই বছর শিখেই সে মাঝখান থেকে ছেড়ে দিয়েছিলো। এরকম মেয়ে যার, তার মায়ের মেয়ে কে নিয়ে খুব চিন্তা হওয়ার কথা না। কিন্তু রেবেকার মেয়ে কে নিয়ে দুশ্চিন্তা এর শেষ নেই, যদিও এই দুশ্চিন্তা তিনি মনে মনে রাখেন। তার খুবই গোপন একটা ভয় যে তার মেয়ের কখনো বিয়ে হবে না। এই ধারনা টা যে একেবারে অমূলক তাও বলা যায় না। তার মেয়েটা হয়ত খেয়ালি কিন্তু সে খুব ভাল করেই জানে যে সে সুন্দর এবং সে মানুষকে খুব সহজে মুগ্ধ করতে পারে। একারনে মেয়েটার ভেতর একটা কেমন যেন অহংবোধ কাজ করে বলে রেবেকার মনে হয়। যদিও সেই অহংবোধ টা বাইরে প্রকাশ পায় না। এমন একটা মেয়ের মা হওয়া কষ্টের। তাদের কে বেধে রাখা যায় না। রেবেকার মাঝে মাঝেই মনে হয় এরচেয়ে তার যদি মোটামুটি চেহারার মোটামুটি বুদ্ধির একজন মেয়ে হত, তাহলে বোধহয় জীবন টা সহজ হত। এতদিনে মেয়ে কে বিয়ে দিয়ে তিনি ঝাড়া হাত পা হতে পারতেন। রেবেকার বিয়ে নিয়ে তাড়াহুড়া করার আরেক টা কারন হল মেয়েটা স্কলারশিপ নিয়ে বাইরে চলে যাবে। খুব ভাল একটা ইউনিভারসিটি তে মাস্টার্স করতে যাবে। এরকম একটা অবস্থায় মেয়েকে বিয়ে না দিয়ে একা বিদেশে পাঠানোর কথা মনে হলেই রেবেকার দম বন্ধ হয়ে আসে। এই মেয়ে কে একা বিদেশে পাঠালে সে কি আদৌ দেশে ফিরবে? আদৌ কি তার বিয়ে হবে? এসব হিসাব নিকাশ তার মনে সবসময় ই চলে। কিন্তু তিনি এসব মেয়েকে বুঝতে দেন না, কারন বুঝতে দিলেই মেয়েটা রেগে যাবে। আর রেগে গেলেই মেয়েটা ঘর বন্ধ করে বসে থাকবে। বাড়িতে অশান্তি। কি দরকার। মা হওয়া কি যে যন্ত্রনা। কতদিক যে ভাবতে হয়! এর মধ্যে একটা ভাল সংবাদ হল শুভ্রার খুব ভাল একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। ছেলে ঢাকা ভার্সিটি এর টিচার। লম্বা, দেখতেও খারাপ না, ফ্যামিলি শিক্ষিত। তারা নিশ্চয় তার শিক্ষিত মেয়ের কদর করতে জানবে। আর ছেলের নিজের খুবই আগ্রহ। শুভ্রাকে তার খুবই পছন্দ। যদিও শুভ্রার ছেলে টাকে একটুও পছন্দ না। মায়ের পীড়াপীড়ি তেই সে রাজি হয়েছিল ছেলের সাথে দেখা করতে। সেই দেখা টা কেমন গেল সেটা জানতেই রেবেকা শুভ্রার ঘরে এসেছিলেন। শুভ্রা ঘর অন্ধকার করে গান শুনছিল। গমগমে গলায় কোন এক ছেলে গান গাচ্ছিল "একা বাচতে শেখো প্রিয়.." একা বাচার কি আছে! দেখা হওয়ার ঘটনা টা জানতে চাইলেন রেবেকা "ছেলেটা তোকে কি বললো?"
আর এর জবাবেই চোখ বন্ধ করে শুভ্রা জবাব দিল "ছেলেটা কে আমার কোন কারন ছাড়াই ভাল লাগে জানো!" পরপর তিনবার। রেবেকা জানেন এটা সেই ছেলে না। অন্য একজন ছেলে। এই ছেলের জন্য শুভ্রা পাগল হয়ে আছে এই খবর তিনি জানেন। শুভ্রার অস্থিরতা দেখে ওর খুব কাছের বান্ধবী শান্তার কাছ থেকে রেবেকা খবর নিয়েছেন। ছেলের সাথে শুভ্রার পরিচয় ফেসবুকে। ছেলে টা শুভ্রাকে পছন্দ করে না বলে শুভ্রার ধারনা। ছেলেটা ও অসম্ভব মেধাবী, ভার্সিটি এর ফার্স্ট। চমৎকার গান গায়। দেখতে ও তেমন ই চমৎকার। ছেলের বাবা বাংলাদেশের কয়েকজন ধনী ব্যবসায়ী দের মধ্যে একজন, এই খোজ টা অবশ্য রেবেকা কে শান্তা দেয় নি। তিনি খোজ লাগিয়েছিলেন ছেলের ব্যাকগ্রাউন্ড জানার জন্য। এসব খোজ জেনে রেবেকার কষ্ট লাগছিল মেয়ের জন্য। মেয়ে তো আর জানে না, পৃথিবী এর নিয়ম। যদিও শুভ্রার বাবা বাংলাদেশ সরকারের খুব উঁচু পদের একজন কর্মকর্তা ছিলেন, ওদের টাকা পয়সার পরিমান ছেলের বাবার তুলনায় কিছুই না। আর এমন ব্যবসায়ী এর সন্তান এর বিয়ে টাও ব্যবসায়ী অথবা অমন বড়লোক বাড়িতেই হওয়ার কথা। এই সহজ সত্য টা রেবেকা জানেন। এজন্য তার ওই ছেলের প্রতি কোন আগ্রহ নেই। আর শুভ্রার বাবা ও ব্যবসায়ীর বাড়িতে মেয়েকে দিতে রাজি হবেন না। মেয়েকে সরকারী বড় কর্মকর্তা এর লেভেলেই দিতে চান তিনি। এ ব্যাপারে রেবেকা এর সাথে প্রায় ই আলোচনা করেন তিনি। মেয়েকে কিছু বলেন না, মেয়েকে তারা দুইজন ই ভয় পান। যদিও মেয়ে রেগে গেলে হইচই কিছুই করে না, একা একা ঘর বন্ধ করে থাকে। তারা এই ঘর বন্ধ করে থাকা টাকেই ভয় করেন। মেয়ের কষ্ট মেয়ের বাবা বা মা কেউ ই সহ্য করতে পারেন না। একটাই মেয়ে তাদের, বড় আদরের।
"কার কথা বলছিস?" রেবেকা বলবেন না বলবেন না করেও বলে ফেললেন।
শুভ্রা চোখ খুলে রেবেকার দিকে তাকালো সরাসরি। শুভ্রার চোখ কঠিন, যেন এখনি ঝগড়া করবে। সেই চোখ মায়ের দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই কোমল হয়ে গেল। "গান টা তোমার কেমন লাগলো মা?"
"ভাল।"
"ছেলেটার গানের গলা কেমন?"
"ভালো।"
"কেমন ভালো? আমার চেয়েও?"
"হ্যা।"
শুভ্রা জোরে জোরে হাসলো।
"খুশি হচ্ছিস কেন এত?"
"তুমি যে সত্যি কথা বলেছো এটা ভাল লাগছে।" শুভ্রা হাসতে হাসতে বললো।
"মোটেই সত্যি বলি নি। তোর গানের চেয়ে অন্য কারো গানের গলাই আমার বেশি ভালো লাগে না। আমার তোকেই বেশি ভালো লাগে।"
"মা তুমি কি জানো তুমি যখন বললে আমার তোকেই বেশি ভাললাগে এই কথা টা তুমি যত মমতা নিয়ে বলেছো, এইরকম না হলেও এর কাছাকাছি মমতা নিয়ে আমি একজনের কথা চিন্তা করি?"
"হ্যা জানি। কিন্তু সে কি তোর কথা তেমন মমতা নিয়ে চিন্তা করে?" 
"না।"
"তাহলে তুই এত মমতা নিয়ে বসে আছিস কেন?"
"সেটাই তো ভাবছি।"
"তুই কি ঢাকা ভার্সিটি এর টিচার ছেলে টাকে বিয়ে করবি?"
"তুমি বললে করবো।"
"ছেলে টা ভালো। বিয়ে টা করলে তুই ভাল থাকবি। যেই ছেলের তোর প্রতি মমতা নেই, তার জন্য বসে থাকবি কেন? তুই কি ফেলনা? তোর মত মেয়ের জন্য ছেলেরা লাইন ধরে থাকে, আর সেই ছেলে তোকে.."
"থাক মা। আর বলো না। মন টা এমনিতেই ভাল না। আর মন খারাপ করতে চাচ্ছি না।"
রেবেকার মেয়ের দিকে তাকিয়ে মন খারাপ হয়ে গেল। একটাই মেয়ে তার, তার কষ্ট সহ্য করা কঠিন। রেবেকার আবার মনে হল মেয়ের মা হওয়া খুব কঠিন।

আমার তোমাকে কখনো পাওয়ার কথা ছিল না! Where stories live. Discover now