--- তাহলে! আমরা হেরেই গেলাম? রঞ্জা? কিছু বলছিস না কেন? প্রায় কেঁদে ফেলেন অরুণেশ। পাশে, তাঁর হাত খামচে ধরা তীর্ণা।
--- তুমি একটু সমিরদার সঙ্গে কথা বলে দেখো না? ওগো? অসহায় তাকিয়ে থাকেন তীর্ণা। স্বামী আর একমাত্র মেয়ের শুকনো মুখগুলো তাঁকে বড়ো বাজে। আঘাত করে প্রাণে।রঞ্জা ঠোঁট কামড়ায়। চোখের জল চাপে। কিছুতেই কান্নাকাটি করা চলবে না। চারপাশে লোক। কতো পরিচিত-অপরিচিত মুখ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। সবাইকে মনেও পড়ে না। সেই একবার-দু'বার দেখেছিল বিয়ের বা রিসেপশনের দিন। তাও তো নকশা করে ওর চশমা কেড়ে নিয়েছিলেন সাজাতে আসা ননদ-জা-মাসিশাশুড়িরা। হাই মাইনাস পাওয়ারের চশমা চোখ থেকে সরে যাওয়ায় কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না ও। লেন্স পরা ছিল না; কেউ আগে থেকে বলেইনি। খালি একের পর এক অতিথিকে সামনে নিয়ে এসে বলে গেছে, ইনি অমুক, ইনি তমুক; নতুন বৌমা, একে প্রণাম করো, তাকে প্রণাম করো। আর ভারী শাড়ি গয়না ফুল সামলে বারবার ঝুঁকতে হয়েছে তাকে। যেমন আজকেও নত হতে হলো। ডিভোর্স কনটেস্ট করেও হেরে গেল রঞ্জা।
--- আর কথা বলে কী হবে! সমিরকাকু তো বললেনই, কিছু করার নেই।
চেষ্টা সত্যিই করেছিলেন সমির আনোয়ার হক। চার পুরুষের দুঁদে উকিল তিনি কিন্তু এই কেসটায় আশা একেবারে ছিল না। একে তো স্বামী-স্ত্রী শেষ পাঁচ বছর একসঙ্গে থাকেনি; তায় মেয়েটি স্বীকৃত বাইপোলার ডিজর্ডারের রোগী। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, ইনফিডেলিটি, ক্রুয়েল্টি, মেন্টাল ডিজর্ডার, ডেজার্শন -- কোনো চার্জ আনতেই বাকি রাখেনি অপরপক্ষ। তাও তো, ভাগ্যিস, কোনো ইস্যু নেই। সন্তান থাকলে তার কাস্টডি রাখা চাপ হতো রঞ্জার পক্ষে।
তাদের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো না; অরুণেশ রিটায়ার করার পরই তীর্ণার হৃদযন্ত্রের নানান গোলযোগ ধরা পড়ে। কোনও অজ্ঞাত কারণে অরুণেশ কখনো মেডিক্লেইম ইত্যাদি করাননি। তাঁর ধারণা ছিল, স্বাস্থ্যবীমা করালেই নানারকম রোগবালাই এসে তাঁদের চেপে ধরবে। অথচ হলো ঠিক উলটোটা; গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের টাকায় কেনা বাড়ি বন্ধক রেখে প্রথমবার তীর্ণার চিকিৎসা করাতে হলো, স্টেন্ট বসল। সাধ্যাতীত খরচ করলেন একমাত্র কন্যার বিয়েতেও। সুপ্রতিষ্ঠিত ডাক্তারের একমাত্র পুত্র, সুদর্শন ইঞ্জিনিয়ার রুদ্রকে পছন্দ করলেন নিজের উচ্চশিক্ষিতা, ইন্ট্রোভার্ট মেয়ের জন্য। যে বিয়ে দেড় বছরও টিঁকলো না।
অরুণেশের বাল্যবন্ধু না হলে হকসাহেব এই কেস হয়তো নিতেনই না। রঞ্জাদের হাতে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ কিছু ছিল না। ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স, মেন্টাল টর্চার -- কিছুই প্রমাণ করা যায়নি। কোনোওক্রমে একটা বোঝাপড়ায় আসতে পেরেছেন। সেটা কেবলমাত্র রুদ্রের প্রাইভেসী ফাঁস করে দেবার ভয় দেখিয়ে। ওরা রঞ্জাকে সোনাদানা জিনিসপত্র যা দিয়েছিল সেগুলো ফেরত দিতে হবে; আর নিঃশর্ত ডিভোর্স হবে, রঞ্জা কখনো অ্যালিমনি চাইবে না -- এই কড়ারে শেষপর্যন্ত রাজি হয়েছে রুদ্ররা।
একটা ট্যাক্সি বুক করে চোখে আঁচল দেওয়া তীর্ণাকে ধরে ধরে গাড়িতে বসায় রঞ্জা। অরুণেশও কেমন যেন জবুথবু হয়ে গেছেন। উকিলকাকুর অ্যাসিস্টান্ট দাঁড়িয়ে ছিল ওদের জন্য। সে বলে দেয়, সামনের মাসে বারো তারিখে ডেট পড়েছে। ওদের জিনিসপত্র ফেরত দিয়ে পেপারস ফাইনাল করতে হবে। নিজে গাড়িতে উঠতে উঠতে দেখে একটু দূরে রুদ্রদের বিশালাকৃতি কালো এসইউভি। তার সামনে নাহোক দশজনের জটলা। দশজনের মধ্যেও একবারেই চোখ চলে যায় দীর্ঘদেহী সুপুরুষ রুদ্রের প্রতি। আর, তার পাশের জনের দিকেও। রঞ্জার দৃষ্টি অনুভব করেই হয়তো, ওরা ফিরে তাকায়। নিজেদের মধ্যে গভীর দৃষ্টি-বিনিময় করে, অল্প হাসে। অপর জন হাত নাড়ে রঞ্জার উদ্দেশে। রঞ্জা মাথা নামিয়ে নেয়; গাড়িতে উঠে পড়ে, ড্রাইভারকে বলে, চলুন।