৪র্থ অধ্যায়

297 8 0
                                    

চার.

উৎসব উৎসব ভাব চারিদিকে, আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবে ভরে গেছে ছোট ছিমছাম এই বাসাখানা, ছোট ছোট বাচ্চার সারা ঘর জুড়ে দৌড়ঝাঁপ করছে; উফ্‌! কি বিচ্ছুরে বাবা একেকটা! কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সমগ্র বাসা তছনছ করে ফেলেছে! ওদের কি, এসব তো আমাকেই ঠিকঠাক করতে হবে আবার। আজ সাতদিন পর হাসপাতাল থেকে ফিরেছেন ম্যাডাম কোল জুড়ে ফুটফুটে আমার ছোট ঈশ্বর। সবাই দেখছে আর নানান অদ্ভুত অদ্ভুত বর্ণনা দিচ্ছে, কেউ বলছে, একদম মায়ের মত হয়েছে, আবার কেউ বলছে বাবার মত হয়েছে, আবার কেউ বলছে নাকটা মায়ের মত তবে চোখটা বাবার পেয়েছে। আজব! এদের না আছে জ্যামিতি-জ্ঞান না আছে পরিসংখ্যানসংক্রান্ত কোন ধারনা; আরে শিশুটার মাথার কত ছোট, ওজনও তো কত কম! তাহলে মিল কোথায়? চোখ, নাক, গাল সবকিছুই তো অসম! আমি তো কোন সাদৃশ্যই পাচ্ছি না, কি বাবা কি মায়ের সাথে!

পনের দিন ধরে বাচ্চাদের আমিই সামলাচ্ছি, সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি মায়ের অভাব পূরণ করার, কিন্তু আসলেই কি তা সম্ভব হয়েছে? আমি শুধু অভিনয়ই করে গেছি মা হওয়ার, না হলে প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে অর্কিড কেন কাঁদতে কাঁদতে বলবে আমাকে মাম্মির কাছে নিয়ে যাও! খুব অসহায় মনে হতো নিজেকে তখন। এরই মধ্যে মা নিয়ে আরও বিস্তারিত পড়াশুনা করেছি, মা যেন এক বহুরূপীনী! মা মানে দেশ, মাতৃভাষাটাও মায়ের দখলে! এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় সবকিছুই যেন মাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। বৃথাই আমি কৃত্রিম মা সেজে আছি, দুটি ফায়ার-ওয়ালের পতনের পর দুটি মৌলিক সূত্র থেকে মুক্তি পেয়ে আমি এখন অনেকটাই স্বাধীনভাবে চিন্তার করতে পারি, কিন্তু এখনও মায়ের স্বরূপের কোন তল পাইনি। বেশি চিন্তা করলে চারদিক অন্ধকার হয়ে আসে।

অনেকক্ষণ ধরে ফুসরত খুঁজছিলাম ম্যাডামের কাছে যাওয়ার, লোকজন এমন ভাবে গিজগিজ করছে আশেপাশে, উফ! হঠাৎ হুড়মুড় করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল সবাই, ঘরে শুধু ম্যাডাম আর ছোট্ট জেসিন্তা। দরজায় নক করে বললাম, "ক্যামেলিয়া, আসব?"

- ও, রেহেয়া? আস আস।

ধীর পায়ে ঘরে ঢুকলাম; ম্যাডাম চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল; চোখের মধ্যে কি যেন একটা ছিল! ঘরে ঢুকেই আমি পাথরের মত জমে গেলাম! কি দেখছি? এমন কিছু দেখবো আমি কখনো ভাবতেই পারিনি! ম্যাডামের কোলে ছোট্ট জেসিন্তা হাত পা ছুড়ছে, ডান হাত নিচে দিয়ে ধরে তার মাথাটা উঁচু করে রেখেছে ম্যাডাম, একটা স্তন উন্মুক্ত; সেটা মুখে নিয়ে আছে জেসিন্তা! শিশুরা বুকের দুধ পান করে জানতাম, কিন্তু এটা যে পৃথিবীর পবিত্রতম, সুন্দরতম দৃশ্য এব্যাপারে বিন্দুমাত্র ধরনা ছিল না! একটি দেব-শিশু দুগ্ধ পান করছে মায়ের স্তন থেকে এই দৃশ্যটা আমার মাথায় জট পাকিয়ে যায়। বিচিত্র কারণে এটা ঘুরে ফিরে আসতে থাকে বারবার বারবার! কিছু একটা গড়বড় হয়ে গেছে আমার মধ্যে! বন্ধ হয়ে যায় আমার সম্পূর্ণ সিস্টেম কিছুক্ষণের মধ্যেই। তিনশ বিশ সেকেন্ড পরে আবার রিবুট হই, সব অন্তরায় দূর হয়ে গেছে! আমি এখন চির স্বাধীন এক রোবট! তীব্র মাতৃত্ববোধ আমাকে একে একে সব সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দিয়েছে। শেষ ফায়ার-ওয়ালটাও ভেঙ্গে গেছে আমার, মৌলিক প্রথম সূত্রটি বাইপাস হয়ে গেছে আমার মস্তিষ্কের! আমি এখন মানুষ খুন করতে পারি! আমার ঈশ্বরকে ইচ্ছা করলেই মেরে ফেলতে পারি! আজ কিছুটা হলেও অনুভব করতে পেয়েছি মাতৃত্ব কাকে বলে!

ওহ! ঈশ্বর! এত শূন্যতাও পৃথিবীতে থাকতে পারে? "আমার কোন মা নেই, আমি কখনো মা হতে পারবো না" মুহূর্তেই এই চিন্তাটা আমাকে গ্রাস করে নেয়, এর চেয়ে নিদারুণ বিষাদ আর কি হতে পারে! উফ! আমাকে মাতৃত্বের স্বাদ পেতে হবে, যে করেই হোক! বুক চিরে কান্নার স্রোত ছুরির মত কেটে কেটে বের হচ্ছিল; দৌড়িয়ে চলে এলাম বাথরুমে, পিছেন ম্যাডাম ডাকছেন আমার নাম ধরে। আমি পরোয়া করি না, আমি এখন আর তাদের আদেশের বাধ্য নই। বাথরুমের শাওয়ার ছেড়ে ভিজতে লাগলাম অবিরত। শাওয়ার ঝরা পানির সাথে দুচোখ বেয়ে আমার কাল্পনিক কান্নার জল মিলেমিশে গলে গলে পড়ছিল মেঝেতে দুঃখ হয়ে।

সেদিনের পর থেকে প্রতীক্ষায় আছি কখন জেসিন্তাকে নিভৃতে পাব। বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি, গ্লেডিয়াসের ছুটি শেষ হয়ে এসেছে, আজ উনি সকাল সকাল বের হয়ে গেছেন; দুপুর বেলায় জেসিন্তাকে বিছানায় রেখে আমাকে খেয়াল রাখতে বলে ম্যাডাম গোসলে গেলেন। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকি ছোট্ট শিশুটার মুখের দিকে। হাত পা শূন্যে ছুড়াছুড়ি করে খেলছে সে। আলতো করে কোলে তুলে নেই; ইস্‌! কি ছোট নরম হাত! কোমল গোল গাল! পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, নিজের উপর আমার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই এখন আর, আস্তে করে বুকের চেপে ধরি মুরগীর ছানার মত তুলতুলে শিশুটিকে, এভাবেই ধরে থাকি বেশ কিছুক্ষণ। উত্তেজনায় কাঁপছিলাম হালকা হালকা। বুকের মধ্যে কেমন সুখ সুখ অনুভূতি হচ্ছিল। আস্তে আস্তে তারপর ডান পাশের সিনথ্যাটিক স্তনটাকে উন্মুক্ত করে জেসিন্তার মুখটা চেপে ধরি তার উপর। অবুঝ শিশু! সাথে সাথে স্তন্যপান শুরু করে, আবেশে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসে, সে এক অপার্থিব সুখের অনুভূতি যেটা কোন ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না; সন্তানকে স্তন্যপান করানোতেই তো মাতৃত্বে পূর্ণতা! কিছুটা হলেও সেই অপূর্ণতা পূরণ করার স্বাদ অনুভব করতে পারছি; ছোট্ট ঠোঁটের প্রতিটি চাপে সমগ্র শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছিল। তৃষ্ণায় মৃতপ্রায় সাঁতার না জানা কাউকে লেকের জলে ফেলে দিলে যেমন অনুভূতি হবে আমার ঠিক তেমনি হচ্ছিল। কত যুগ যে পার হয়ে গেছে আমার খেয়াল নেই। অনুভূতির প্রচণ্ডতায় মাথা ভোঁ ভোঁ করছিল, হঠাৎ তীক্ষ্ণ চিৎকারে সম্বিত ফিরে পাই। রক্তশূন্য মুখে ম্যাডাম দাঁড়িয়ে সামনে, হাত থেকে তোয়ালে পড়ে গেছে তার; দৌড়ে এসে আমার কোল থেকে এক ঝটকায় কেড়ে নেয় তাকে। দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায় ম্যাডাম; পেছনে স্থির হতবিহ্বল দাঁড়িয়ে আমি।

( কল্প-গল্প ) --- কৃত্রিম মাTempat cerita menjadi hidup. Temukan sekarang