পুরানো কষ্ট

1.7K 67 5
                                    

 আবন্তি যখন থেকে বুঝতে শিখেছে তখন থেকে কেবল একটা জিনিসই দেখে এসেছে । ও বাবা আর মা কেবল একে অন্যের সাথে ঝগড়াই করে আসছে । দুজনের কোন কিছুই দুজনের পছন্দ নয় । কথায় একে অন্যকে খোচা দেওয়া মাঝে মাঝে তো গায়ে হাত তোলা ! এই দুইজনের ঝগড়াতে কারো লক্ষ্যই থাকলো না যে তাদের একটা মেয়ে আছে এবং সে অনাদরে বড় হচ্ছে !

আবন্তির বাবা পেশায় পাইলট ছিল । লম্বা সময়ে জন্য বাসা থেকে দুরে থাকতো । তবে কাজ শেষে যখনই বাসায় আসতো তখনই ঝগড়া শুরু হত । আবন্তি কেবল দুরে দাড়িয়ে দেখতো সব ! তারপর আরেকটু বড় হতেই যখন অনেক কিছু বুঝতে শিখলো তখন সে তার মায়ের ব্যাপারে আরেকটা ভয়ংকর জিনিস জানতে পারলো । সেটা জানার পর থেকে মা আর নিজের প্রতি এক রকম ঘৃণা জন্মাতে শুরু করে । সাথে সাথে এই জিনিসটাও বুঝতে শুরু করে যে তার বাবা কেন অন্য বাবাদের মত তাকে আদর করে না !

সব কিছু জানার পর আস্তে আস্তে নিজেকে সবার কাছ থেকে কেমন দুরে সরিয়ে রাখা শুরু করলো । আবন্তির যখন ১৭ বছর বয়স তখন তার বাবা আর মায়ের ডিভোর্স হয়ে যায় । তার মা তাকে তার কাছে রাখতে চেয়েছিলো আবন্তি নিজে রাজি হয় নি । শেষে এমন একটা ব্যবস্থা ঠিক হল যে আবন্তি থাকবে একা । ওর দেখা শুনা করার জন্য আবন্তির এক দুঃসম্পর্কের খালা এসে থাকতে লাগলো । আর আবন্তির খরচ ওর বাবা আর মা দুজন দিবে । আবন্তির মনে হয়েছিলো যে এমন ব্যবস্থায় ওর বাবা আর মা দুজনেই যেন একটু হাফ ছেড়ে বেঁচেছিল । যেদিন ওর বাবা চলে যাবে সেদিন আবন্তি ওর বাবাকে ডেকে বলল
-তুমি চাইলে অবশ্য আমার দায় দায়িত্ব নাও নিতে পারো ! তোমার তো দায় নেই ।
আবন্তির বাবা কেবল হাসলো । তারপর বলল
-তোর মা কি করেছে সেটা তার দায় । তবে আমার কিছু দায় তো আছেই । হয়তো ওমন করে কোন দিন দেখতে পারবো না তবে তুইতো মেয়েই আমার নাকি !

তারপর থেকে আবন্তি একাই আছে । প্রথম প্রথম খারাপ লাগলোও ও শান্তিতে ছিল । প্রতিদিনকার সেই ঝগড়া তো আর তাকে দেখতে হত না । মায়ের ঐ ব্যাপার গুলোও ওকে দেখতে হত না । ইউনিভার্সিটিতে ওঠার পর ওর সেই খালা কাকে যেন বিয়ে করে চলে গেল । ব্যাস তারপর থেকে আবন্তির আর কোন পিছু টান নেই । একা একাই তারপর থেকে থেকে এসেছে । কাউকে নিজের জীবনের সাথে জড়ায় নি । শুনেছিলো ওর বাবা আর মা নাকি ভালবেসে বিয়ে করেছিল । এই যদি হয় ভালবাসার বিয়ের ফলাফল তাহলে সেই ভালবাসায় আবন্তি নিজেকে কোন ভাবেই জড়াতে চায় নি ।

কিন্তু গত কিছু দিনে আসলে সব কিছু ওলট পালট হয়ে গেল । স্যাম ওকে এমন একটা অদ্ভুদ ভাবে ওর মা বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল । আবন্তির সব থেকে অবাক লাগলো যে যেরকম পরিস্থিতিতে ওকে পরিচয় করিয়ে দিল সেই ব্যপারটা ওনারা খুবই স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছে এটা দেখে । এটা স্বাধারনত স্বাভাবিক ভাবে নেওয়ার কোন বিষয় না । তার ছেলে ফ্ল্যাটে অন্য একটা মেয়ে রয়েছে এটা তাদের কাছে স্বাভাবিক কিভাবে হয় আবন্তি প্রথমে বুঝতে পারে নি ।

প্রথম সপ্তাহে কিছু না হলেও পরের সপ্তাহের প্রথম দিনেই আরেকটা ঘটনা ঘটলো । ক্লাশ শেষে বের হচ্ছিলো তখনই একজন ক্লার্ক এসে বলল যে ওকে প্রো-ভিসি ম্যাডাম ডাকছে । আবন্তি জানতো এমন ডাক ওর আসবেই ।
প্রো-ভিসির ফরিদা পারভিনের রুমে ঢুকতেই সেদিনের সেই হাস্যোজ্জল মহিলাকে দেখতে পেল আবন্তি ! ওর দিকে তাকিয়ে আছে হাসি মুখে ।
-তুমি এই ইউনিভার্সিটিতে পড় ? গাধাটা আমাকে গতকালকে বলেছে এই কথা !

আবন্তি কি বলবে বুঝতে পারলো না । খানিকটা অপ্রস্তুত ভাবে হাসলো ।

-দেখি মা মমনি এদিকে এসো আরেকটু । ঐদিন তো তোমাকে ঠিক মত দেখতেই পারি নি ।

তারপর নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো । কতদিন পরে কেউ এমন ভাবে আদর করে ওকে জড়িয়ে ধরেছে আবন্তি মনে করতে পারলো না । বুকের মাঝে কেমন একটা অদ্ভুদ অনুভুতি হল ওর ।

-শোনা আর কোন কাজ নেই তো তোমার ?
-জি না !
-ওকে চল তাহলে । আজকে মা মেয়ে মিলে শপিং করি । জানো একা একা কেনা কাটা করে মজা নেই । আমি যখনই মার্কেটে যাই বারবার মনে হয় আমার একটা মেয়ে থাকলে আজকে কত ভাল হত । আল্লাহ এই জন্যই তোমাকে পাঠিয়েছে ।
-না মানে ....
-কোন মানে টানে না । আজকে তোমাকে ছাড়ছি না ।

একপ্রকার জোর করেই ওকে গাড়িতে তুলে নিল । তারপর বাকিটা সময় এই মার্কেট ঐ মার্কেটে দুজনে ঘুরতে লাগলো । প্রথম প্রথম আবন্তির খানিকটা অস্বস্তি লাগলেও একটা সময় আবিস্কার করে ওর ভাল লাগছে পাশে মহিলাকে ! বিশেষ করে তার এই সত্যিকারে আন্তরিকতা দেখে ।

একেবারে সন্ধ্যার সময় যখন ওদের কেনাকাটা শেষ হল তখন আবন্তি লক্ষ্য করলো যা কেনা কাটা হয়েছে তার বেশির ভাগই ওর জন্য । আবন্তি প্রথম প্রথম খুব মানা করছিলো বারবার বলছি আন্টি লাগবে না কিন্তু ফরিদা পারভিন কিছুতেই শুনেন নি ।

প্রথমে আবন্তি যখন ম্যাডাম বলে ডাকলো তখন সে একটা ধকমও দিয়েছিলো । বলেছিলো যে ইউণিভার্সিটিতে আমি তোমার ম্যাডাম কিন্তু এখানে তোমার হবু শ্বাশুড়ি । এটা মনে রাখো ।

তারপরেই সেই কথাটা বলল সে । কেনা কাটা শেষে দুজন একটা ফার্ট ফুডের বসেছে খাওয়ার জন্য । খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে তখনই ফরিদা পারভিন বলল
-মা তোমাকে একটা কথা বলবো ?
-বলুন ! অনুমুতি কেন চাইছেন ?
-তুমি আমার ছেলেটাকে ছেড়ে যাবে না তো ?
-মানে কি বলছেন ?
-আসলে আমার ছেলেটা মানুষের সাথে ঠিকঠাক মত মিশতে পারে না । এই জন্যই ওর এমন কেউ ছিল না । কিন্তু যাকে একবার ভালবাসে তাকে জান প্রান দিয়ে ভালবাসে ! ও কি তোমাকে প্রিয়ার কথা বলেছে ?
-প্রিয়া ? না তো !
-এই প্রিয়ার জন্যই আসলে ও আর কাউকে বিয়ে করতে চাইছিলো না । ও যখন কলেজে পড়তো তখন একটা মেয়েকে খুব পছন্দ করেছিলো । সব কিছু ঠিকঠাক চলছিলো তখনই মেয়েটার বিয়ের কথা বার্তা শুরু হয় । স্যাম আমাদের কে বলেও ছিল বিয়ের ব্যাপারে কিন্তু তখন সবে মাত্র ও কলেজে পড়ে কিভাবে বিয়ের জন্য হ্যা বলি বল ? তারপর থেকে মেয়েটার মানে প্রিয়ার বিয়ে হয়ে যায় । তারপর থেকে ও আরও বেশি গম্ভীর হয়ে যায় । ও আর কাউকে ভালবাসে নি । বিয়েও করতে চায় নি । আমরা শত বলেও রাজি করাতে পারছিলাম না । একটা সময় আমার আর ওর বাবার দুজনেরই দোষী মনে হত । বারবার মনে হত আমরা যখন তখন রাজি হয়ে যেতাম তাহলে আজকে আমার ছেলেটা এমন হত না ! তারপর ও যখন বলল তোমার কথা, আমরা দুজন যে কি পরিমান খুশি হয়েছিলাম তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না । আমরা কিছুতেই আর এই সুযোগ হাত ছাড়া করতে চাই না । তুমি যা চাইবে যেমন করে চাইবে তাই হবে কেবল আমার ছেলেটাকে ছেড়ে যেও না প্লিজ !

আবন্তি কি বলবে খুজে পায় নি । তবে ওর একটু যে খারাপ লাগে নি সেটা বলবে না । 

Incidents happenOnde histórias criam vida. Descubra agora