রাত

333 9 4
                                    

"বাবা, ওটা কি চাঁদ?" ছোট্ট মেয়ে বাবাকে প্রশ্ন করল।
"হ্যাঁ, মা, ওটা চাঁদ।" বাবা উত্তর দিল।
"এত ঘোলা কেন?"
"খুব কুয়াশা তো, তাই ঘোলা দেখাচ্ছে।"
মেয়েটি বাবার হাত ধরে হাঁটছে। রাস্তা সুনসান।
"মামণি, তোমার কি শীত লাগছে?" বাবা জানতে চাইল।
"না, একটুও না।"
মরা জোছনায় দু'জনে পিচঢালা রাস্তায় হাঁটতে লাগল। চারপাশটা নিস্তব্ধ, নিশ্চুপ। আকাশের একখণ্ড চাঁদ ছাড়া আজ যেন আর কেউ নেই।
"বাবা, রাস্তায় কেউ নেই কেন? সবাই কোথায় গেছে?"
"সবাই ঘুমুচ্ছে।"
"ঘুমুচ্ছে কেন?"
"সবাই দিনের বেলা অনেক কাজ করেছে তো, তাই এখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমুচ্ছে।"
"বাসায় গিয়ে আমরাও ঘুমাব, তাইনা বাবা?"
"হ্যাঁ, মা।"
"বাবা, বাসা আর কতদূর?"
"এই তো প্রায় এসে গেছি। আর কিছুক্ষণ।"
কুয়াশা বাড়তে লাগল। ঠাণ্ডা বাতাসও বইছে। চাঁদটাকে আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। ঘন কুয়াশা আকাশের সব তারা ঢেকে দিয়েছে। দূরে কোথাও শিশুর কান্নার শব্দ ভেসে এল।
"বাবা, বাচ্চাটা কাঁদছে কেন?"
"জানিনারে, মা।"
"বাচ্চাটার মনে কি অনেক দুঃখ?"
বাবা হেসে ফেললেন। "তুমি যখন ছোট ছিলে, তখন এভাবেই কাঁদতে।"
"আমি কাঁদতাম!" মেয়েটি অবাক হয়ে জানতে চাইল।
"হ্যাঁ।"
"আমি কিন্তু এখন কাঁদিনা। আমি অনেক বড় হয়ে গেছি, তাইনা বাবা?"
"হ্যাঁ, মা।"
"বাবা, আমি শাড়ি পরব কবে?"
"আরো বড় হলে।"
"কত বড়? আম্মুর মতো?"
"হ্যাঁ।"
"তুমি আমাকে একটা লালশাড়ি কিনে দিও।"
"আচ্ছা, কিনে দিব।"
"একটা না, দুইটা লাল শাড়ি।"
"আচ্ছা।"
"বাবা, আমার পুতুলটার না বিয়ে হতে গেছে। কালকে তুমি আরেকটা পুতুল নিয়ে এসো।"
"আচ্ছা, নিয়ে আসব।"
মেয়েটি কিছুক্ষণ চুপ রইল। কী যেন ভাবল। তারপর বলল,
"বাবা, তুমি আম্মুর জন্য একটা লাল লিপস্টিক নিয়ে এসো। আগেরটা আমি হারিয়ে ফেলেছি। আম্মু জানেনা।"
"ঠিকাছে, নিয়ে আসব।"
"বাবা, আম্মু কি রাগ করবে?"
"না, মা, রাগ করবেনা। মিষ্টি মেয়ের উপর কি কেউ রাগ করতে পারে?"
ঠাণ্ডা ক্রমশ বাড়তে লাগল। মেয়ে জিজ্ঞেস করল, "বাবা, বাসায় কখন পৌঁছব?"
"এই তো, মা, আর পাঁচ মিনিট।"
কাছেপিঠে কোথাও একটা নিশাচর পাখি ডেকে উঠল। মেয়েটা বাবার হাত শক্ত করে ধরল।
"বাবা, কালকে আমাকে আইসক্রিম কিনে দিও। আম্মু আমাকে আইসক্রিম খেতে দেয়না। তুমি আমাকে আইসক্রিম কিনে দিবা?"
"অবশ্যই দিব।"
"আম্মু কিছু বুঝেনা। তুমি আম্মুকে বকে দিও।"
"হুম।" বাবা গম্ভীর হয়ে গেলেন। মেয়ে বলল, "বাবা, শীত লাগছে।"
"আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর, মা, বাসায় গিয়ে কম্বলের নিচে শুলেই শীত পালাবে।"
"আচ্ছা, বাবা, আম্মুর কি শীত লাগছেনা?"
"হ্যাঁ, লাগছে।"
"শীতে নিশ্চয় কষ্ট পাচ্ছে অনেক।"
"মনে হয়।"
"তাহলে তুমি আম্মুকে স্যুয়েটার ছাড়া শুইয়ে দিয়ে এসেছ কেন?"
"ও কিছুনা। তোমার আম্মু অনেক বড় তো, শীত কম লাগে।"
"বাবা, একলা একটা গর্তে থাকতে আম্মুর ভয় লাগছেনা?"
বাবা জবাব দিলেননা। মেয়ে বলল, "বাবা, তুমি তো গর্ত ভরাট করে দিয়ে এসেছ। আম্মু এখন শ্বাস নিবে কীভাবে?" আমরা কি ফিরে গিয়ে গর্ত খুলে দিয়ে আসব?"
বাবা কিছুটা থতমত খেলেন। বললেন, "না, মা, তোমার আম্মু কিছুদিন পরেই ফিরে আসবে।"
"কবে আসবে?" মেয়ে জানতে চাইল।
বাবা উত্তর দিলেননা। সব প্রশ্নের উত্তর থাকেনা।
"বাবা, আম্মুর পেট দিয়ে রক্ত পড়ছিল কেন? আমরা আম্মুর চিকিৎসা করাবনা?"
"হ্যাঁ, মা, করাব।"
মেয়েটা চুপ করে আবার কী যেন ভাবল। বলল, "বাবা, তুমি একটা ছুরি ভুলে গর্তে ফেলে এসেছ। আমরা কি মাটি খুঁড়ে ছুরিটা নিয়ে আসব?"
বাবা চমকে গেলেন। বললেন, "না।"
ঘন কুয়াশা ভেদ করে ঝিঁঝি পোকার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। শিশিরের কণা মাথার চুল ভিজিয়ে দিচ্ছে। করুণ সুরে কোনো কুকুর ডেকে উঠল। মেয়েটা বাবার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল, "বাবা, ওটা কী?"
"ওটা কিছুনা। একটা কুকুর।"
"আমার ভয় করছে।"
"ভয় কীসের, আমি আছিনা?" বলে বাবা মেয়েকে কোলে তুলে নিলেন। মেয়ের মাথাটা বুকের মধ্যে রেখে পথ হাঁটতে লাগলেন। খুনী বাবার বুকের মধ্যে মেয়েটা খুঁজে পেল পরম নির্ভরতা।
  
(সমাপ্ত)



লেখক: রাসেল মাহমুদ
ঠিকানা: বাসাবো, ঢাকা।
মোবাইল: ০১৭৪৪-১০৫৩৫২

লেখকের অনুমতি ছাড়া এই গল্প কোথাও ছাপানো যাবেনা। গল্পটির অডিও, ভিডিও, প্রতিরূপ সৃষ্টি এবং নকল না করার জন্য লেখকের তরফ থেকে অনুরোধ করা যাচ্ছে।

রাতWhere stories live. Discover now