সব ছেলেরাই বাবা হওয়ার জন্য আকুল হয়ে থাকে। তবে সৌরভের আকুলতা যেন বেশিই মনে হতো আমার কাছে। তবে এই মাত্রাটা আরো বেড়ে যায় যেদিন আমার চাচী শাশুড়ি বেড়াতে এসে আমাকে ডাক্তার দেখাতে বললেন।
সৌরভ সেদিন আমাকে একরকম জোর করেই ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গেলো। এরজন্য আমার সঙ্গে কথা কাটাকাটি ও কম করেনি। ডাক্তারের কাছ থেকে এসেই ক্ষান্ত হয়নি, আমাকে মানত রাখতেও বলেছে। আমি এসবে বিশ্বাস করিনি কখনো, কিন্তু ওর রাগান্বিত চেহারা দেখে কিছু বলতে পারিনি।
তারপর থেকে আমি একেবারে চুপ হয়ে গেছিলাম। ওর সাথে দরকার না পড়লে কথা বলতাম না। আমার কি মা হতে ইচ্ছা করেনা? ওর কাণ্ড দেখলে মনে হয় যেন আমি ওর সন্তানের মা হতে চাইনা।দেখতে দেখতে চার বছর পেরিয়ে গেলো। ডাক্তার দেখিয়েছি অনেক জায়গায়, কিন্তু কোন কিছুতেই কাজ হয়নি। দিনদিন সৌরভের অত্যাচার আরো বেড়ে গেলো। সারাদিন না আমার ফোন রিসিভ করতো, না ভালো করে কথা বলতো আমার সাথে। রাতে আমি কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে যেতাম, আর ও বিছানায় শুয়েই ঘুম, কোন হুশ থাকতো না ওর।
আমার আর সহ্য হচ্ছিলো না। চেপে রাখতে না পেরে মামাতো বোনকে সব বলি। আপু কিছুদিন মায়ের বাসায় এসে থাকতে বলে। রাতে সৌরভ বাসায় এলে, ওকে আমার ইচ্ছার কথা জানাই।
ও প্রথমে আপত্তি করলেও আম্মার সাথে কথা বলে আমাকে যাওয়ার অনুমতি দেয়।অনেকদিন পর বাড়িতে ফিরে এলাম। এখানকার সবকিছু আমার চেনা, কিন্তু এই চার বছরে অনেক কিছু বদলে গেছে। নিজের ঘরে ঢুকেই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকি। মা এসে আমার মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। অনেকদিন পর একটু শান্তির ঘুম হলো আমার।
বাড়ি এসেছি দুদিন হলো। এরমধ্যে সৌরভকে একশ বারের উপর কল দিয়েছি, ও রিসিভ করেনি। আজকে আবার ফোনটাও বন্ধ পাচ্ছি। টেনশনে আমার তখন নাজেহাল অবস্থা। পরে আম্মার নাম্বারে কয়েকবার কল দেওয়ার পর আম্মা রিসিভ করলো। আম্মার কাছে যা শুনলাম তাতে আমি আর এক মুহূর্ত ও বাড়িতে থাকতে পারিনি। ওইদিনই রাতের ট্রেনে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেই।
ঢাকায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল। প্রতিবার সৌরভই স্টেশন এ আসতো আমাকে নিতে।এবার আর এতকিছু ভাববার সময় নেই। তাড়াতাড়ি করে বাসায় গেলাম।
গিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার জীবনের মোড়টাই ঘুরে গেলো।
সৌরভ একটা মেয়েকে বাসায় এনে তুলেছে। ওই মেয়েটাকে নাকি ও বিয়ে করবে। আমার সব শুনে মাথায় রক্ত উঠে গেলো। আমি ওকে হাত ধরে টেনে আমাদের রুমে টেনে নিয়ে গেলাম।
আমিঃ এসব নোংরামির মানে কি?
- কিসের নোংরামি? আমি সায়মাকে নিয়ে এসেছি মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য।
- তুমি নাকি ওকে বিয়ে করবে? এসব কি শুনছি আমি?
- হ্যাঁ, বিয়ে তো করতেই হবে আমার। তোমার জন্য আর কতকাল অপেক্ষা করব আমি? চার বছর হয়ে গেলো, একটা বাচ্চা দিতে পারলে না আমাকে।
- আমি কি কম চেষ্টা করেছি তার জন্য? তাই বলে তুমি আমার সাথে...
- আহ, থামো তো। এত প্যানপ্যানানি ভালো লাগছে না।
আমি না পেরে কষে একটা চড় লাগালাম ওর গালে। ও একদৃষ্টে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে কিছু না বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
আমি চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম। হঠাৎ করে আমার বুকে ব্যথা করতে লাগলো, মাথা ঘুরে উঠলো। কোনরকমভাবে ব্যাগের কাছে গিয়ে ইনহেলারটা খুঁজতে থাকি। কিন্তু খুঁজেই পেলাম না। সৌরভকে জোরে ডাক দিয়েই জ্ঞান হারালাম।জ্ঞান ফিরে দেখি সৌরভ আমার হাত শক্ত করে ধরে বসে আছে, ওর চোখ লাল। আমার বুঝতে অনেকটা সময় লাগলো। ও কি তাহলে কান্না করেছে আমার জন্য?
সৌরভঃ এখন কেমন লাগছে?
আমিঃ ভালোবাসো আমাকে?
- থাক এসব কথা। বিশ্রাম নাও। বলেই সৌরভ উঠতে গেলে আমি ওর হাত টেনে ধরি। ওর হাতটা আমার দু হাতের মাঝে নিয়ে বলি,
আমিঃ আমি উত্তরটা জানি। যাইই করোনা কেন তুমি, আমি তোমাকে ছেড়ে যাবোনা।
সৌরভ আমার পাশে বসে আমার হাত ওর বুকের মাঝে চেপে ধরে বললো,
- পারবে আমাকে অন্য মেয়ের পাশে দেখতে?
আমি কান্না করে দিলাম। ও আমার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললো,
- হ্যাঁ, একমাত্র তোমাকেই ভালোবাসি আমি। সেজন্যই চাই তুমি যেন আর কষ্ট না পাও। আমাকে ছাড়লে তুমি অনেক ভালো থাকবে।
- এসব কেন বলছো? আমি তো তোমাকে নিয়ে কখনো আফসোস করিনি। আমার বেঁচে থাকার জন্য তোমার ভালোবাসাই যথেষ্ট ছিলো, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। আর কিছু জানিনা আমি।ও আমার কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছিলো, মনের মধ্যে অনেক কষ্ট চেপে রেখেছে।
চলবে........
