ঘাসফুল
লেখাঃ মারুফা সুলতানা
পর্বঃ ৬
সন্ধ্যার পর কোচিং থেকে ফিরে কাপড় পাল্টে বইখাতা আর ছোটো টিফিনবক্স ভর্তি ওরিও নিয়ে তাওহীদের দরজায় নক করলো মিষ্টি। তাওহীদ ভাইয়ার কাছে ম্যাথ শেখা এই কয়দিনে মিষ্টির রুটিন হয়ে গেছে। কারণ পড়ানোর সময় তাওহীদ যাই বোঝায় সবই মিষ্টি খুব ভালো ক্যাচ করে নেয়। কিন্তু যত সমস্যা শুরু হয় হোমওয়ার্ক দিলে। সামনে সামনে করতে পারলেও কোনো সমস্যা ছিল না যদি এডমিশনের সময় তাওহীদ কে ওর মুখের সামনে বসে থাকার পারমিশন দিত। ব্যাপারটা তাওহীদ ভাইয়ার কাছেই অফেন্সিভ লাগছিল যে তার বোঝানো মিষ্টি ভুলে যাচ্ছে। তাই তাওহীদ ভাইয়া পণ করেছেন মিষ্টিকে তিনি বোঝাবেন ও আবার সেটা মনে রাখাবেনও, যে করেই হোক। অগত্যা রোজ সন্ধ্যায় হাজিরা দিতে আসতে হয় মিষ্টিকে।মিষ্টির নিজের বিরক্ত ধরে যায় বারবার ভুলতে ভুলতে, সারাজীবন এই মাথা নিয়ে পার করে এসেছে সে। কিন্তু তাওহীদ ভাইয়ার বিরক্তি, ক্লান্তি কিছুই আসে না। তার ধৈর্য্য দেখে মিষ্টিও আজকাল বিষাক্ত সাবজেক্ট টাকে পছন্দ করার চেষ্টা করে।সে জানে সায়েন্স নিয়ে পড়তে গেলে সারাটা জীবন তার নিজের ওপর বিরক্তি নিয়ে কাটাতে হবে। সায়েন্স, আর্টস দুই ফ্যাকাল্টিতে পরীক্ষা দেবার জন্য প্রিপারেশন নিচ্ছে সে। পরিশ্রম ও করছে দ্বিগুণ। খাওয়া, গোসল আর রাস্তায় যেটুকু সময় যায় সেটুকু বাদে সারাদিনই বইখাতা সঙ্গী করে বসে থাকে সে। এমনকি রাতে যে দুই তিন ঘণ্টা নিজেকে ঘুমাতে দেয় সেই ঘুমের মধ্যেও মিষ্টি নানান ভঙ্গিতে পড়ে। মতিচুরের লাড্ডু খেতে খেতে পড়ে, রসমালাই এর ভেতর ডুবে ডুবে পড়ে, আইসক্রিমের পাহাড়ে বসে পড়ে। উহু! ভাবতে ভাবতেই জিভে জল চলে এলো মিষ্টির।
“দরজা খোলা আছে, ভেতরে এসো।”ভেতর থেকে তাওহীদ ভাইয়ার ক্ষীণ গলা শোনা গেলো ।তাওহীদ ভাইয়ার রুমটা প্রথম দেখে কারো মনে হবেনা এটা কোনো ছেলে মানুষের রুম। এমন না যে তাওহীদ ভাইয়া বিছানায় গোলাপি বেডশিট বা দরজা জানালায় গোলাপি পর্দা ঝুলিয়ে রেখেছে। বা এমন না যে তার ওয়াল গুলো লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিওর পোস্টারে ভরা। তবু তাওহীদ ভাইয়ার রুমটা আর দশটা ছেলের রুম থেকে আলাদা। দশটা না হোক, অন্তত তিন-চারটা ছেলের রুম থেকে আলাদা। মিষ্টির বাবা একজন ছেলে মানুষ, মিষ্টির ভাই একজন ছেলে মানুষ। আর তাদের কারও রুম মিষ্টি সারাজীবনে এত গোছানো দেখেনি। মিষ্টি নিজের রুমই তো এত গোছানো না। তাই এই রুমে এলেই কিছু না কিছু অগোছালো করার জন্য হাতটা নিশপিশ করে মিষ্টির। পুরো রুম জুড়ে দুইটা জিনিসের ছড়াছড়ি। বই আর মেডেল। না ছড়াছড়ি না, গোছাগুছি। রুমের একটা দেয়ালের পুরোটা জুড়ে ফ্লোর টু সিলিং বুকশেলফ। প্রথম তাক থেকে শুরু প্রতিটা বই অ্যালফাবেটিক অর্ডারে সাজানো, একেকটা অক্ষরবিরতিতে দুইটা করে মেডেল রাখা। কম করে হলেও পঞ্চাশটা হবে। মিষ্টি সারাজীবনে তিনটা ট্রফি পেয়েছে। প্রথমটা প্রাইমারি স্কুল থেকে বিদায়ের সময়, দ্বিতীয়টা হাইস্কুলের বিদায় অনুষ্ঠানে, তৃতীয়টা ধারণা করাই যায়, কলেজের বিদায় অনুষ্ঠানে। তাই মেডেলগুলোকে মুখ ভেঙিয়ে মিষ্টি এবার তাওহীদ ভাইয়ার দিকে মনোযোগ দিলো।