প্রজাপতিটা আজকেও জানালার পাশে বসে আছে। অপেক্ষায়, একটি হাসির শব্দ শুনবে। ধীরে ধীরে ডানা মেলছে সে, তার কাছে যেন মনে হচ্ছে যে ডানা মেললে হাসির শব্দ সে শুনবে। ধিরে ধিরে ডানা মেলছে সে।
বিগত দুই মাস ধরে প্রতিদিন জানালার কাচে সকালে একরকম বলতে গেলে সে বাড়ি খায়। আমরা যাকে বলি হুমড়ি খেয়ে পড়া। তার পরে সে পাখা ঝাপটায়, মাঝে মাঝে জানালার কাচের এদিক থেকে ওদিকে যায়। কিছুক্ষন পর পরই সে হাসির শব্দ শুনে। সে আর মজা পায়। যতক্ষন পারে লাফিয়ে বেড়ায়। হাসিটা তার কাছে কিরকম মায়াবী লাগে। মনে হয় যেন এক পরী হাসছে। জানালা দিয়ে পরীটাকে দেখার চেস্টা করে সে, কিন্তু বিধাতার নিয়তি, সে এত দূর দেখতে পারে না। তবুও সে অনুভব করে, হাসি শুনে তার প্রিয় পরীটিকে অনুভব করার চেস্টা করে সে। পারে না, তার সেই ক্ষমতা নাই, বিধাতা তাকে প্রজাপতি করেছে, মানব নয়, তবু সে তার মনের ক্যানভাসে আকার চেস্টা করে।
আজ কেন জানি কোন সাড়া শব্দ আসছে নাহ। কেন জানি নিরব, নিশ্চুপ সব। প্রজাপতিটার ভালো লাগছে না, সে আরও দ্রুত ডানা ঝাপটাচ্ছে, এদিক অদিক উড়াউড়ি করছে, সে এখনো শুনছে না সেই হাসি। তার কাছে কেন জানি সব এলোমেলো মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে জানালাটা সে ভেঙ্গে ফেলবে, সে কোন শব্দ শুনছে না। মাঝে মাঝে জানালার একপাশ খুলা থাকতো তো, প্রজাপতিটা যদিও ঢুকতো না, জানালায় উড়লে সে হাসি শুনে, তাই জানালায় উড়া উড়ি করে বেড়াতো। আজ খুব ইচ্ছা হচ্ছে, জানালা টা খুলা থাকলে আজ সে ঢুকতো। তার শরীরের শক্তি ধিরে ধিরে ক্ষয় হচ্ছে, কিন্তু সে হাল ছাডছে না, সে হাসিটি এখনো শুনতে পায় নাই।
জানালার ওপাশে, কেবিনের বেডে পরীটির লাশ টি পড়ে আছে। নিরব, নিথর, ১০ বছরের ফুটফুটে পরী, পুতুল নিয়ে খেলতে খেলতে তার শরীর নিয়ে ক্যান্সার খেলা করা শুরু করছিলো কেউ বুঝে উঠতে পারে নাই। যখন বুঝে উঠতে পারে, তখন সময় আর তেমন হাতে ছিলো নাহ। দুই মাস ধরে তাকে হসপিটালের এই কেবিনে রাখা হয়। পরীকে বাচানোর জন্য এই হসপিটালের ডাক্তাররা হেন কিছু নাই যে করে নাই, পরীটা যে তাদের সবার আদরের ছিলো! পরী আর যাই হোক, প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে যেতো। তার শরীরে শক্তি ছিলো না দাড়ানোর, ক্যান্সার তার শরীর থেকে সকল শক্তি দুমড়ে দিয়েছিলো, লাবন্যমাখা মুখটার দিকে তাকানো যেতো না, শরীর যেন বিছানার সাথে লাগিয়ে গিয়েছিলো। সকালেই উঠে যেতো সে, কোন মিস হতো নাহ। কারন একটা প্রজাপতি সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জানালায় উড়া উড়ি করে বেড়াতো, আর পরীটা হাসতো, তার শরীরের মদ্ধ্যে ক্যান্সারের সাথে লড়াই করতে করতে যতটুকু শক্তি বাকি ছিলো, তার সবটুকু ব্যয় করে খিলখিলায়ে হেসে উঠতো। সে হাসতো, আর তার পরিচর্যাকারী নার্সের চোখ দিয়ে এক দুই ফোটা করে পানি পরতো। আগলে রাখার চেস্টা করতো সে চোখের পানিগুলাকে, যখন পারতো না, বের হয়ে আসতো করিডোরে, অঝর নয়নে কানতো সে, বেধে রাখতে পারতো না। মাঝে মাঝে ওয়ার্ড বয়টার চোখ দিয়েও পানি বয়ে যেতো। ছেলেরা মনে হয় একটু বেশী শক্ত হয়, তাই মনে হয় ওর চোখ দিয়ে কম পানি পড়তো। ওর হাসিটা যেন সবার কানে এসে বাজতো “আমি লড়াই করছি, ক্যান্সার আমার হাসি কাড়তে পারে নাই এখনো”। মাঝে মাঝে নার্স জানালার এক পাত খুলে দিতো, যেন প্রজাপতি টা ভিতরে আসতে পারে, কিন্তু প্রজাপতি টা আসতো না, বাইরেই লাফা লাফি করতো, আর পরীটা ও হাসতো।
আজ পরী সাদা কাপড়ে মুড়ে আছে, ক্যান্সার তাকে পরাজিত করতে সক্ষম হইছে। আর তার হাসি নেই। করিডোরে তার মা মুর্ছা যাচ্ছে, বাবা বসে আছে, নার্স দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে, তার হাত কাপছে। ওয়ার্ডবয় টা সকাল থেকে কোথায় যেন পালিয়েছে, কেউ দেখে নাই তাকে, তত্তাবধায়ক ডাক্তার তার কেবিনে মাথা নিচু করে নিজের পরাজয় মেনে বসে আছে, আর চিন্তা করছে, ক্যান্সার টাকে কি ওই পরীর শরীর থেকে আমার শরীরে নিয়ে আনা যেত না?
এম্বুলেন্স চলে এসেছে, পরীর পরাজিত দেহটাকে নিয়ে যাবে।
প্রজাপতি টি তার জীবনে শেষ দিন পর্যন্ত ওই জানালায় হাসির শব্দ শুনার জন্য অপেক্ষায় ছিলো।
YOU ARE READING
পরী আর এক প্রজাপতি
Short Storyপরী ও প্রজাপতি মুলত বেশ কয়েকটি ছোট গল্পের সমাহার। মুলত মানব মনের ভিতরের অনুভুতিকে তুলে ধরা হয়েছে এই গল্প গুলোতে।