মায়ার উদ্বেগ

1 1 0
                                    

॥ এক ॥

তিন সপ্তাহ পর। ভগ্ন কিল্লার এক ঘরে নাহীদ বিছানায় শায়িত। ব্রাহ্মণাবাদ থেকে বিশ ক্রোশ দূরে এক বনের মধ্যে এই কিল্লা অবস্থিত। এক সময় গংগু ও তার সাথীদের আড্ডা ছিল। কয়েকদিন হয় গংগু ও তার সাথীরা সে জীর্ণ কিল্লাকে আবাদ করেছিল। | নাহীদের ঘা ও জ্বর দেখে গংগু বিশেষ উদ্বিগ্ন ছিল। সে এরূপ স্থানে আশ্রয় নিয়েছিল যেখানে নাহীদ আরােগ্য লাভ না করা পর্যন্ত নির্বিঘ্নে থাকা যায়। লুটতরাজ না করার প্রতিজ্ঞা সে পূর্বেই করেছিল। বিশেষ কারণে তার নিজের ও সাথীদের জন্য ঘােড়া ও সাজসজ্জার প্রয়ােজন ছিল। তার জাহাজ ডুবে যাবার পর মাত্র চারটি মূল্যবান হীরক তার কাছে ছিল। গুজরাটী ব্যবসায়ীর বেশে, সে ব্রাহ্মণবাদে গেল। মাত্র দু'টি হীরক বিক্রয় করে সে যা টাকা পেল তার ও সাথীদের ঘােড়া, তলােয়ার ও খাদ্য সগ্রহের জন্য তাই যথেষ্ট ছিল।
দেবলের আশে পাশে নিরাপদ আশ্রয় পেলে গংগু অবশ্য সেখানেই আশ্রয় গ্রহণ করত। কিন্তু সেরূপ আশ্রয় স্থান সে পেল না। তা ছাড়া তার বিশ্বাস ছিল যে বন্দীদেরকে ব্রাহ্মণাবাদ বা আরবারে রাজার সামনে নিশ্চয় পেশ করা হবে। গংগু ও তার সাথীরা কয়েকদিন যাবত দেবল ও ব্রাহ্মণবাদের মধ্যস্থ সমস্ত রাস্তায় কড়া পাহারা দিচ্ছিল। গংগুর উদ্দেশ্য সম্বন্ধে খালিদের সমস্ত সন্দেহ দূর হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মায়াদেবীকে সে তখনও ঘরের শত্রু মনে করছিল। মায়াদেবী দিন রাত্রি নাহীদের সেবা শুশ্রুষা করে গংগুর কাছে নিজের সাফাই কতকটা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছিল। নাহীদের সন্দেহও দূর হয়েছিল। কিন্তু তার কোন কথা খালিদের কাছে গ্রাহ্য হয় না। সে যেন তার অস্তিত্বই অস্বীকার করত। নাহীদের শুশ্রুষার জন্য মায়া তার কাছে বসততা। খালিদের সামনেই নাহীদের ঘা ধুয়ে মলম লাগাতে ও পঠি বেঁধে দিত। তাকে ঔষধ দিত। তার মাথা টিপে দিত এবং খালিদের মনোেযােগ আকর্ষণ করার জন্য নিজের অজ্ঞাতসারেই বারবার বলত- আপনার বােন এখন বেশ ভাল আছেন। ঘা শিগগিরই শুকিয়ে যাবে।... বােন নাহীদ এখন সুস্থ আছেন। আপনি উদ্বিগ্ন হবেন না.... আল্লাহ আপনার সাহায্য করবেন।
কিন্তু খালিদের পক্ষ থেকে কোন জবাব না পেয়ে সে মনে করত যে তার জন্য খালিদের চোখ কান বন্ধ হয়ে গেছে।
সিন্ধু নদীর মােহনা থেকে এ স্থান পর্যন্ত নৌকায় দীর্ঘ পথ আসার সময়ও খালিদের একই অবস্থা ছিল। সমুদ্রের পানির মতই নদীর পানি ছিল। প্রতি প্রভাতে একই সূর্য উদিত হত এবং প্রতি সন্ধ্যায় একই চাঁদ ও তারার মেলা বসত আকাশে। কিন্তু খালিদের অবহেলা ও তাচ্ছিল্য প্রকৃতির সমস্ত সুষমা তার কাছে নিরর্থক করে দিয়েছিল। খালিদ যদি তার মুচকি হাসির জবাবে একটু হাসি ফিরিয়ে দিত। সে যদি একবার মাত্র জিজ্ঞেস করত- মায়া তুমি কেমন আছ? যদি মায়ার চোখের অবাধ্য অশ্রু মুছবার জন্য তার হাত একটু মাত্র প্রস্তুতির ইঙ্গিত দিত তাহলে ভাইয়ের বিচ্ছেদ ব্যথা সত্ত্বেও সে একথা ভেবে খুশী হতে পারত যে, বিধাতা দেবলের থেকে তার ও খালিদের পথ পৃথক করেনি। জাহাজে থাকবার সময় সে অনেক সময় ভাবত খালিদের সাথে তার সহযাত্ৰা যেন শেষ
হয়। ঝড় এসে তাদের জাহাজের যাত্রাপথ যেন এমনি ফিরিয়ে দেয় যাতে করে সে খালিদের সাথে এমন এক দ্বীপে পৌছে যেতে পারে সেখানে স্বচ্ছ পরিষ্কার পানির স্রোতস্বিনী প্রবাহিত। ঝর্ণার জল প্রেমের গান গায়। কুঞ্জে কুঞ্জে চির বসন্ত বিরাজমান থাকে। ফুলের সৌরভে বাতাস মােহিত থাকে। গভীর সরােবরে সুরম্য মৃণাল প্রস্ফুটিত হয়।
দেবল বন্দরের প্রথম দৃশ্য দেখার পর তার স্বপ্নমাখা মধুর জগত বিধ্বস্ত হয়। কিন্তু জাহাজের পরিবর্তে বিধাতা যখন তাকে খালিদের সাথে একই নৌকার আরােহী করে দেয় তখন আবার নতুন করে স্বপ্নের জগত গড়তে থাকে। কিন্তু দেবলের ঘটনা এক জীবন্ত নব-যুবককে প্রস্তর মূর্তিতে পরিণত করেছিল। প্রেম ও মমতাপ্রার্থী দৃষ্টির বিনিময়ে খালিদের চোখে ঘৃণা ও তাচ্ছিল্য ছাড়া কিছু দেখা যেত না।
এদের মধ্যে একমাত্র নাহীদই বিশ্বাস করত দেবলের ঘটনার সাথে মায়াদেবীর কোন সম্পর্ক নেই। নারীর তীক্ষ্ণ ও সূক্ষ্ম অনুভূতি ছাড়া সে মায়ার মানসিক দ্বন্দের আঁচ পেয়েছিল। সুযােগ পেলেই সে খালিদের সামনে মায়ার পবিত্রতা, চরিত্র-মাধুর্য, লজ্জা, আন্তরিকতা ও অপরাধহীনতার উল্লেখ করত। খালিদ আলােচনার বিষয় পরিবর্তন করতে চেষ্টা করত। নাহীদ বলত- খালিদ তােমার হৃদয় বড় কঠোর। তুমি দেখছ না মায়ার সুন্দর লালিম চেহারা দু’প্রহরের ফুলের মত ম্লান হয়ে গেছে। তার ভাই খারাপ হতে পারে। কিন্তু আমার মন সাক্ষ্য দিচ্ছে মায়া সম্পূর্ণ নিরপরাধ। সে তােমাকেই তার শেষ আশ্রয়স্থল মনে করে। তুমি তাকে সান্ত্বনা দিতে পার। সে এ পর্যন্ত বলেছে যে তার ভাই ষড়যন্ত্রে সত্যসত্যই জড়িত থাকলে সে তার কাছে ফিরে যাবার চেয়ে মৃত্যুবরণ করা শ্রেয় মনে করবে। সে জবাব দিত- দুপুর বেলায় আমি প্রদীপের প্রয়ােজন দেখছি না। আমি যা দেখেছি
তারপর এ বালিকা সম্বন্ধে মত পরিবর্তন করা আমার সাধ্যের অতীত।
 
 
 
মায়ার বেগ
॥ দুই ॥
উক্ত জীর্ণ কিল্লায় কিছুদিন থাকার পর নাহীদ চলতে ফিরতে সমর্থ হয়ে উঠল। কিন্তু তীরের ঘা সম্পূর্ণ তখনাে সারেনি। খালিদ মাঝে মাঝে অশ্বারােহী দলের সাথে ঘুরে বেড়াত।
এক সন্ধ্যায় চারদিক থেকে প্রহরীদের সমস্ত দল ফিরে এল। কিন্তু খালিদ ও তার চারজন সাথী ফিরল না। মাগরিবের নামাযের পর নাহীদ ভাইয়ের মঙ্গলের জন্য দু'আ করছিল। গং কয়েকজন সাথীকে খালিদের খোঁজে পাঠিয়ে নিজে এক উঁচু গাছে আরােহণ করে পথ দেখছিল। মায়া কিল্লা থেকে বের হয়ে ঘন গাছের ভেতরে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পরে দূর থেকে ঘােড়র ক্ষুরের শব্দ শােনা গেল। তার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। সে দ্রুতপদে অগ্রসর হতে লাগল। তার আঁচল এক কাটার ঝাড়ে বিধে গেল। সে কাটা ছাড়াতে চেষ্টা করছিল। পেছন থেকে খালিদ ও তার সঙ্গীরা এসে পড়ল। খালিদ ঘােড় থামিয়ে জিজ্ঞেস করল- আমার বােন কেমন আছে?
কথাগুলাে মায়ার কানের ভেতর দিয়ে মরমে পশিল। সে খালিদের দিকে তাকিয়ে। রইল। কাঁটার ঝােপের যে শাখাগুলাে অত কষ্টে সে ছাড়িয়েছিল তার হাত থেকে খসে আবার কাপড়ে লেগে গেল।
খালিদ আবার বলল- বল, আমার বােন ঠিক আছে তাে? মায়া চমকে উঠে জবাব দিল- তিনি সম্পূর্ণ ভাল আছেন। আপনি বড় দেরী করে ফেলেছেন।
তুমি এখানে কি করছ?
আমি?- কিছু না। এ কথা বলে মায়া আবার কাপড় থেকে কাঁটা ছাড়াতে লাগল। কিন্তু তার চোখ ছিল খালিদের উপর নিবদ্ধ। খালিদ ঘােড়া থেকে নেমে পড়ল। তার সাথীরা বাঁকা চোখে পরস্পরের দিকে চেয়ে মৃদু হেসে চলে গেল। মায়ার শ্বাস দ্রুত বইছিল। তার চোখ থেকে কৃতজ্ঞতার অশ্রু উথলে উঠল। নিজের কম্পিত হাত সে খালিদের হাতে রাখল।
| তাড়াতাড়ি শাখাটি ধরতে গিয়ে একটি তীক্ষ্ণ কাটা তার আঙ্গুলে বিধে গেল। শাখাটি হাত থেকে ছুটে আবার কাপড়ে লেগে গেল। কাটার বেদনা সত্ত্বেও মায়া হেসে দিল। কৃতজ্ঞতার অশ্রু-ভেজা তার হাস্যময় চেহারা শিশির ভেজা গােলাপের চেয়েও মনােহর দেখাচ্ছিল। খালিদ তার দিকে চেয়ে চোখ নত করে নিল। সে বলল- দেখি, আমি কাঁটাটা বের করে দিচ্ছি।
কিছু না বলে মায়া তার হাত বাড়িয়ে দিল। কাঁটা বের করে পালিদ আবার ডাল ছাড়াতে গেলে গেল। সে জিজ্ঞেস করল- তুমি এখানে কেন এসেছিলে? | মায়া জবাব দিল- কিল্লায় গরম লাগছিল। তাই আমি একটু হাওয়া খেতে বের হয়েছিলাম।
 
 
 
মুহম্মদ ইবন কাসিম
সে মনে মনে বলল- সত্যি কি তুমি আমার আগমনের কারণ বােঝনি। আমি সারা জীবন কাকাবৃত থাকি আর তুমি কাঁটা ছাড়াতে থাক- তাহলে কতই না ভাল হয়।
খালিদ জবাব দিল- কিন্তু এখন ত গাছের নিচে বেশী গুমট।
মায়া তটস্থ হয়ে খালিদের দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ ভেবে বলল- আমি নদীর দিকে যাচ্ছিলাম।
কিন্তু নদী তাে উল্টা দিকে।
আমি সে দিকেই যাচ্ছিলাম। কিন্তু.... কিন্তু কি?
ঘােড়ার পদ শব্দ শুনে এদিকে ফিরে আসি। আজ আপনি অনেক দেরী করেছেন। আমি... খুব উৎকণ্ঠিত ছিলাম। | আমি তােমার ব্যস্ততার কারণ বুঝতে পারছি না। আমি যুবায়র এবং অন্যান্য। সাথীদের মত বন্দী হলে তুমি নিশ্চিত হতে। কিন্তু তুমি বিশ্বাস কর আমি এখনাে বন্দী হয়েই আছি। তােমার ভাইয়ের মত আমি নিজের বােনকে ফেলে চলে যেতে পারি না।
মায়ার মনে দারুণ আঘাত লাগল। সে কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অপলক দৃষ্টিতে সে খালিদের দিকে চেয়ে রইল। তার চোখ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে গেল। বাষ্প অশ্রুধারায় পরিণত হল। চোখের পাতা ছাড়িয়ে উথলে উঠল। মুক্তার ন্যায় দু'ফোঁটা অশ্রু গাল বেয়ে ওষ্ঠে পতিত হল। মায়া তাড়াতাড়ি ঘােমটায় মুখ লুকাল।
চল, দেরী হয়ে যাচ্ছে। খালিদের কণ্ঠস্বর শুনে মায়া চমকে উঠল। কাটা থেকে তার কাপড় মুক্ত হয়েছিল। খালিদ ঘােড়ার লাগাম ধরে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিল। মায়া বলল আপনি যান। আমি পরে আসছি। কিন্তু শেষবারের মত আমি আপনাকে শুধু বলতে চাই যে আমি নিরপরাধ। আমার ভাই যদি এ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থেকেও থাকেন তবু পরের পাপের শাস্তি আমাকে দেওয়া অন্যায়।
খালিদ জবাব দিলাে- আমি তােমাকে শাস্তি দিতে চাই না। শীঘ্র তােমাকে তােমার ভাইয়ের কাছে পৌছিয়ে দেয়া হবে। সেও খুব দূরে নয়, এখান থেকে প্রায় চার ক্রোশ দূরে এক টিলার উপর তাঁবু ফেলেছে। রাজার কাছ থেকে পুরস্কার পাবার আশায় সে বন্দীদের ব্রাহ্মণাবাদ নিয়ে যাচ্ছে। তার সাথে দেবলের শাসনকর্তাও আছে। কাল তারা ব্ৰহ্মণাবাদে পৌছে যাবে। হয়ত আজ রাত্রেই তােমার ভাইয়ের কাছে আমাদের প্রস্তাব পৌছে যাবে। সে যদি বন্দীদের মুক্তি দিতে রাযী হয়, তবে তােমাকে তার কাছে পৌছে দেয়া হবে। আমি প্রথম থেকেই তােমাকে এখানে রাখার বিপক্ষে ছিলাম। কোন অসহায় নারীর উপর হাত ভােলা আমাদের নীতি বিরুদ্ধ। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পার।
আমার ভাই বন্দীদের নিয়ে যাচ্ছেন, এ কথা আপনাকে কে বলেছে? প্রতাপ রায়ের সাথে তিনিও বন্দীর মত যাচ্ছেন- এটা কি সম্ভব নয়।
 
 
 
মায়ার উদ্বেগ
আমি আজ নিজ চোখে দেখে এসেছি। সে এক বাদামী রঙের ঘােড়ায় সওয়ার ছিল। অন্য বন্দীরা গরুর গাড়িতে শৃংখলাবদ্ধ ছিল।
চল, ত
ছে। গংও আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আপনি এগােন। আমি এখুনি আসছি।
॥ তিন ৷ | খালিদ ঘােড়ার লাগাম ধরে হেঁটে কিল্লার দরজায় পৌছল। গংগু বাইরে তার
অপেক্ষায় ছিল।
মৃদু হেসে গংগু জিজ্ঞেস করল- খালিদ, মায়াকে কোথায় রেখে এলে? খালিদ অবহেলা ভরে উত্তর দিল- সে আসছে।
রাত হয়ে গেছে। তুমি তাকে সঙ্গে কেন নিয়ে এলে না? আপনি নিয়ে আসুন। সে বলছিল আপনি যান, আমি এখুনি আসছি।
গংগু মৃদু হেসে বলল- নারী প্রকৃতি অতি অদ্ভুত। সে লুকিয়ে লুকিয়ে তােমার পথ দেখবে। তােমার জন্য কাঁটার বনে ঢুকবে। কিন্তু তুমি তার দিকে ঝোক অমনি বন্য হরিণীর ন্যায় দৌড়ে পালাবে।
| খালিদ জবাব দিল- আমার হৃদয়ে কাব্যের স্থান নেই। এখন আপনি বলুন আমাকে কি করতে হবে। দেবলের কাফিলার খবর আপনি নিশ্চয় শুনেছেন।
হাঁ, শুনেছি। তাদের সাথে দু'শ’ সশস্ত্র সৈন্য রয়েছে। মুষ্টিমেয় লােক নিয়ে আমরা তাদের আক্রমণ করতে পারি না। আমি জয়রামকে এখনে আনবার ব্যবস্থা ভেবে রেখেছি।
| দেখছি সে মেয়েটির কথায় ভুলে নাহীদ জয়রাম সম্বন্ধে তার ধারণা বদলে ফেলেছে। আপনিও অভিভূত হচ্ছেন।
মৃদু হেসে গংগু বলল- বৎস, তুমি আমার চেয়ে বেশী প্রভাবান্বিত হয়েছ। যা হােক, আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে মায়া সম্পূর্ণ নির্দোষ।
তা সত্ত্বেও আপনি জয়রাম ও মায়াকে হত্যা করার ভয় দেখাতে চান। তােমার সঙ্গীদের মুক্ত করবার আর কোন উপায় নেই। কিন্তু জয়রাম যদি রাজাকে সন্তুষ্ট করার জন্য বােনকে বলি দেয় তবে?
আমার সে আশংকা নেই। কিন্তু জয়রাম যদি এতই নীচ প্রমাণিত হয়, তবে মায়ার মত মেয়েকে এরূপ যালিম ভাইয়ের হাত থেকে রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য। সে নিজেও জয়রামের চেয়ে তােমার আশ্রয় বেশী পছন্দ করবে। কয়েকদিনের মধ্যেই তােমার বােন ভ্রমণ করতে সমর্থ হবে। তখন তােমাদের মকরণের সীমায় পৌছিয়ে দেব।
 
 
 
মুহম্মদ ইবন কাসিম
কিন্তু আমাদের সঙ্গীদের বিপদে ফেলে রেখে আমরা কি করে চলে যাব? তা হতে পারে না।
| তােমরা ফিরে গিয়েই আরবদের বেশী সাহায্য করতে পারবে। আরবদের সাথে সাথে লংকার নাবিকদের বন্দী রাখার কারণ বােধ হয় এই যে জাহাজ লুষ্ঠিত হবার খবর সিন্ধুর বাইরে না যায়। এ খবর পেলে তােমাদের জাতভাইরা চুপ করে সহ্য করবেন না। কিন্তু নাহীদ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তােমরা যেতে পার না। জয়রাম আমাদের কবলে
পড়লে সম্ভবতঃ আমরা যুবায়রকে মুক্ত করতে সক্ষম হব।
তা সম্ভব হলে খুবই ভাল হয়। আমি আরবে কাউকে চিনি না। বসরা দামেশকে হয়ত লােকেরা আমার কথায় কান দেবে, কি দেবে না। কিন্তু যুবায়র সেখানের বহু লােককে চেনেন। সে কথা যাক, আজ রাতে আমার জিম্মায় কি কাজ তাতে বলেন নি।
গংগু জবাব দিলাে- তুমি বিশ্রাম কর। কিন্তু মায়াদেবী এখনাে ফিরল না ত। হয়ত অন্য পথে সে কিল্লায় পৌছে গেছে।
আমি এখনি খবর নিচ্ছি- বলে খালিদ দৌড়ে কিরায় প্রবেশ করল। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে সে গংগুকে খবর দিল- মায়া ভেতরে পৌছেনি।।
গংগু জিজ্ঞেস করল- তুমি তাকে কত দূরে ছেড়ে এসেছিলে? ঐ ঝােপগুলাের পেছনে প্রায় একশ’ কদম দূরে।
তুমি তাকে কোন কঠিন কথা বলেনি তাে? | কিন্তু আমার প্রত্যেক কথায় অশ্রু ফেলা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তবে হ্যা, আমার একটা ভুল হয়ে গিয়েছে।
সেটা কি? আমি তাকে বলে ফেলেছি তার ভাই এখান থেকে চার ক্রোশ দূরে আছে। রাত্রে এই বন অতিক্রম করা স্ত্রীলােকের কাজ নয়। একথা বলে গংগু নিজের সঙ্গীদের ডাক দিল। তাদের মায়াকে খোজার আদেশ দিয়ে খালিদকে বলল- আমার মনে হয় সে এখনাে সে কাঁটা ঝােপের সাথে কথা বলছে। তুমি সে দিকে যাও। আমি নদীর দিকে যাচ্ছি। তার উপর আমার কোন সন্দেহ নেই। তবে নৈরাশ্যে মেয়েরা অনেক বিপরীত কাজ করে বসে। আমি যাই। নদীর পারে আমাদের নৌকা যাতে তার ধ্বংসের
কারণ না হয়ে উঠে।
॥ চার ॥ | খালিদ চলে যাবার পর মায়া কিছুক্ষণ সেই কাঁটা ঝােপের কাছে দাঁড়িয়ে রইল। যে কাঁটা তাকে টেনে খালিদের হাত পর্যন্ত পৌঁছিয়েছিল। সে তার কাছে সৌরভময় ফুলের মত মধুর ছিল। সে কয় মুহূর্ত খালিদ তার নিকটে ছিল সে কল্পনায় সে মধুর মুহূর্তগুলাে উপভােগ করছিল। খালিদের কণ্ঠস্বর তখনাে তার কানে গুঞ্জরণ করছিল। পর পর সে
 
 
 
মায়ার উদ্বেগ
যেন চুমুক দিয়ে বিষ ও মধুপান করছিল। তার হৃদয়ে খালিদ সম্বন্ধে পরস্পর বিরােধী ধারণার সংঘর্ষ বেঁধেছিল। সে কখনাে তাকে ঘৃণা ও ক্রোধের মূর্তি, কখনাে বা দয়া ও প্রেমের দেবতা রূপে কল্পনা করছিল। কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার পর তার মনে এক অহ্য বেদনা অনুভব করল। ঝােপ থেকে একটা শাখা ভেঙ্গে চাদের আলােয় সে বৃক্ষ ও ঝােপ এড়িয়ে নদীর দিকে অগ্রসর হল।
নদীর তীরে একটি নৌকা বাঁধা ছিল। যে নৌকায় তারা সমুদ্র থেকে এখানে পৌছেছিল। যাতে ভ্রমণ করার সময় সে প্রহরের পর প্রহর আসমানের তারার সাথে নীরব বাক্য বিনিময় করেছে। নৌকার উপর এক ধারে বসে সে নিচে পা ঝুলিয়ে দিল। পানির স্রোত তার পায়ে লাগছিল। আশ-পাশের বন থেকে শৃগাল ও বাঘের শব্দ আসছিল। মায়া নিজের মনেই প্রশ্ন করে- যদি এখন একটা বাঘ এদিক এসে পড়ে তবে? সে নিজেই জবাব দেয়- বাঘ এসে পড়লে আমি পালাবার চেষ্টা করবাে না। আমি নৌকা থেকে নেমে তার সামনে দাঁড়াব। ভােরে যখন তিনি আমার লাশ দেখবেন, তখন তার কি অবস্থা হবে? তিনি বলবেন- মায়া, তুমি কেন এদিকে এসেছিলে? আমি তােমার সাথে রহস্য করেছিলাম। আমি জানতাম তুমি নিরপরাধ। মায়া তুমি আমাকে মাফ কর। আমি তােমাকে চিনতে ভুল করেছি। না, না, তিনি হয়ত তা বলবেন না। তিনি বলবেন সে পাগলী ছিল, উন্মাদ ছিল। হাঁ, সত্যি তাে আমি পাগলী। তার হৃদয়ে আমার জন্য এতটুকু স্থান নেই। তিনি কাঁটা থেকে আমার কাপড় ছাড়াচ্ছিলেন, আর আমি ভাবছিলাম দুনিয়ার রাজত্ব পেয়ে গেছি। কিন্তু আমি নদীর তীরে বালির সৌধ বানাচ্ছিলাম। তার হৃদয় পাথরের। তিনি যালিম। কারাে উপর তার বিশ্বাস নেই। আর থাকবেই বা কি করে? আমার ভাই এদের সাথে খুব দুর্ব্যবহার করেছেন। হায়, তিনি যদি আমার ভাই
হতেন। হায়, জাহাজেই যদি তিনি আমাকে বলে দিতেন তিনি এঁদেরকে প্রতারণা করবেন, তাহলে আমি লুকিয়ে লুকিয়ে খালিদের দিতে তাকাতাম না। এখন তিনি আমাকে ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দেবেন। এই যদি পরিনাম হবে তবে বিধাতা কেন আমাকে তার জাহাজে পৌছিয়েছিলেন? আবার যখন দেবলে তার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে যাচ্ছিলাম, বিধাতা কেন আবার এখানে নিয়ে এলেন? তাঁর ঘৃণা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত আমি তাকে কেন প্রেমপূর্ণ চোখে দেখছি? নৈরাশ্যের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কেন আমি আশার প্রদীপ জ্বালাচ্ছি? হাঁ, আমি বাধ্য ছিলাম। আমার স্বাধীন ইচ্ছার অস্তিত্ব ছিল না। আমি এখনাে অসহায়। আমর কেউ নেই। আমার কেউ নেই। আমি ভগবানকে ডেকেছি। তিনি রােজ পাঁচবার যে আল্লাহর ইবাদত করেন তাকেও ডেকেছি। কিন্তু অশ্রু ও দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আমার ভাগ্যে কিছুই নেই। অশ্রু আর দীর্ঘশ্বাস। হায়, আমার যদি জন্মই না হত। হায়, সমুদ্রের ঢেউ যদি আমাকে দয়া না করত! | দুহাতে মাথা লুকিয়ে মায়া বহুক্ষণ ফুপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল। কে তার কাঁধে সস্নেহে হাত রেখে ডাকল- মায়া। সে চম্‌কে ঈষৎ চিৎকার দিয়ে উঠল। পেছনে তাকিয়ে দেখল- গংগু তার কাছে দন্ডায়মান! সে বলল- মা, তুমি ভয় পেয়েছ? এখন এখানে কি
কই।
 
 
 
মুহমদ ইবন্ কাসিম
চোখ মুছতে মুছতে সে জবাব দিল- কিছু না।
তুমি কাঁদছ? কী হয়েছে? | মায়া নীরব রইল। গংগু আবার জিজ্ঞেস করল- এমন সময় এরূপ নিঝুম নির্জন স্থানে তােমার ভয় করে না? চারদিক থেকে বাঘের ডাক শােনা যাচ্ছে। চল, আমার সাথে।
মায়া বলল- আমি আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই। কি কথা? আপনি সত্যি কি আমাকে আমার ভাইয়ের কাছে পাঠাবার সিদ্ধান্ত করেছেন? গংগু জবাব দেয়- আমি নিজের সিদ্ধান্ত করার আগে তােমার সিদ্ধান্ত শুনতে চাই। ভগবানের দোহাই, আমাকে তার কাছে পাঠাবেন না। কিন্তু কেন?
আমি এমন ভাইয়ের কাছে যেতে চাই না, যে আমার মাতৃদুগ্ধের সম্মান রাখেনি। তুমি একথা মনে থেকে বলছ, না শুধু আমাকে বােকা বানাবার জন্য? হায়, আপনাকে যদি আমার হৃদয় দেখাতে পারতাম। কিন্তু জয়রামকে ঘৃণা করার কারণ কি?
আমি খালিদের কাছে তার সম্বন্ধে শুনেছি। তার শঠতা সম্বন্ধে এখন আর আমার সন্দেহ নেই। কিন্তু এটা কি সম্ভব নয় যে, আমরা তােমাকে তােমার ভাইয়ের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে যুবায়র ও তাঁর সঙ্গীদের মুক্ত করতে পারব?
জয়রাম যদি একবার প্রতারণা করে থাকে তবে সুযােগ পেলে সে আবার প্রতারণা করবে। সে যেন কোন রকমে জানতে না পারে যে আমি আপনাদের সাথে আছি। নইলে রাজার সৈন্যদের সাহায্যে সে জঙ্গলের প্রতি কোণ চষে বেড়াবে। নাহীদ এখনাে ভাল করে চলতে ফিরতে পারে না। তাকে রক্ষা করা আপনাদের পক্ষে দুষ্কর হবে।
| মা, তুমি নিশ্চিন্ত হও। তােমাকে আমাদের হাতে দেখে জয়রাম সব শঠতা ভুলে যাবে। এর পেিরও যদি তার পক্ষ থেকে কোন ভয়ের কারণ দেখা যায়, তা হলে নাহীদের জন্য আমি আর একটি নিরাপদ স্থান ঠিক করে রেখেছি।
তা হলে এর অর্থ এই যে, সে যদি বন্দীদের আপনাদের হাতে সমর্পণ করে তাহলে আপনি আমাকে তার হাতে সােপর্দ করবেন।
মা, সে তােমার ভাই। তার কাছে যেতে ভয় পাচ্ছ কেন? দুনিয়ায় আমার কেউ নেই। স্বার্থের জন্য ভাই আমাকে বলি দিতে চেয়েছেন- তাই আমি আপনার হাতে এসে পড়েছি। এখন আপনি আমাকে কন্যা বলেও স্বার্থের জন্য তার কাছে ফিরে পাঠাতে চাচ্ছেন। আমার ভাইয়ের সিদ্ধান্তের ন্যায় আপনার সিদ্ধান্তও আমাকে ভাগ্যলিপি বলে মেনে নিতে হবে। হায়, আমার ভাগ্য যদি আমার হাতে থাকত। হায়, পৃথিবীতে আমার নিজের পথ নিজেই খুঁজে নেবার অধিকার যদি থাকত। কিন্তু আমার ইচ্ছা অনিচ্ছার কোন অর্থ নেই। আমি ঝড়ের মুখে তৃণের মত। বায়ুর গতি
যেদিকে ইচ্ছা নিয়ে যায়। আমার থাকা না থাকা সমান।
কিছুক্ষণ ভেবে গংগু বলল- সিদ্ধান্তের ভার তােমার উপর ছেড়ে দিলে তুমি কি করবে?
কিছু আশান্বিত হয়ে মায়া উত্তর দিলাে। আমি মুক্তির চেয়ে আপনার কাছে বন্দী থাকা শ্রেয় মনে করব।
তা কেন? আমি নাহীদকে অসুস্থ অবস্থায় ছেড়ে যেতে চাই না। মায়া, আমি একটি প্রশ্ন করছি। সত্য বল, খালিদকে তুমি ভালবাস? মায়া দৃষ্টি নত করে নিল।
সে আবার বলল- মায়া, আমার প্রশ্নের জবাব দাও। মায়া বলল- কিন্তু একথা আপনি কেন জিজ্ঞাসা করছেন?
এই জন্য যে হয়তাে এ প্রশ্নের উত্তর শােনার পর আমি তােমার জন্য অপেক্ষাকৃত ভাল সিদ্ধান্ত করতে পারবাে।
আমি জানি না। শুধু এটুকু জানি যে, আমি তাকে ছাড়া বেঁচে থাকতে পারব না।
তুমি এটাও জান যে তােমার উপর তার সন্দেহ এখনাে দূর হয়নি। সমুদ্রের উপলখন্ডের চেয়েও তার হৃদয়ে কঠিনতর। তােমাকে আমি কন্যা ডেকেছি। আজ থেকে তােমার সুখই আমার সুখ, আর তােমার দুঃখ আমার দুঃখ। আমি চাই না কোনদিন তাকে আপন করার আশার উপর তুমি সবকিছু উৎসর্গ কর। এটাও সম্ভব যে সারা জীবন তােমার সদিচ্ছা সম্বন্ধে তার মনে বিশ্বাস জাগবে না। তােমার সম্বন্ধে তার ধারণা দূর করতে তােমাকে মহৎ আত্মােৎসর্গ করতে হবে। আমি যে কোন বলিদানের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু সারা জীবন তার বিচ্ছেদ আমার সহ্য হবে না।
ভাইয়ের চিন্তা তাে তােমাকে কষ্ট দেবে না?
রাজার উচ্ছিষ্ট খাবার পর সে আর আমার ভাই রয়নি, তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।
গংগু বলল- আমি তাকে কোন উপায়ে এখানে আনতে চাই। তার মুখ দেখে তােমার হৃদয় গলে যাবে নাতাে? স্বীয় উস্কারকদের সাথে সে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তার বিচারের ভার তােমার উপর দিলে তুমি তার সাথে কিরূপ ব্যবহার করবে?
শঠ, প্রতারক ও কাপুরুষের যােগ্য শাস্তিই দেব।
 
গংগু বলল- মায়া, তুমি চিন্তা করে উত্তর দাও। এ এক কঠোর পরীক্ষা। হয়তাে তােমার ভাইকে তােমার সামনে এনে আমি তােমারই হাতে বিচারের তরবারী দেব।
আমি ভেবেছি। আমি তাকে দয়ার অযােগ্য মনে করি।
গংও কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু ঝোপের পেছন থেকে খালিদের স্বর শােনা গেল মায়া, মায়া, তুমি কোথায়?
গংগু মায়াকে বলল- তুমি নৌকায় লুকিয়ে থাক। যতক্ষণ আমি না ডাকি ততক্ষণ বাইরে আসবে না।
কিছু না ভেবেই মায়া তার আদেশ পালন করল।
গংগু নৌকা থেকে নেমে তীরে দাঁড়াল। খালিদ আবার ডাক দিলাে। গংগু বলল- খালিদ, আমি এদিকে আছি।

মুহাম্মদ বিন কাশিমOnde histórias criam vida. Descubra agora