রাজা দাহিরের শেষ পরাজয়

0 1 0
                                    

॥ এক ॥

কয়েকদিনের মধ্যে রাজা কাকা তার অবশিষ্ট সৈন্য সজ্জিত করে মুহম্মদ ইবুন কাসিমের সাথে যােগ দিলেন। মুহম্মদ ইব্‌ন কাসিম এখান থেকে ব্রাহ্মণাবাদ যাত্রা করলেন। ব্রাহ্মণবাদের কয়েক ক্রোশ দূরে নদীর তীরে তাবু ফেললেন। নদী পার হওয়ার প্রস্তুতিতে কয়েকদিন কেটে গেল। এ কাজে সা'আদ (গং) তাঁর বিশেষ সাহায্যে এল। তার সংগীরা নদীর তীরে অনেক দূর পর্যন্ত মৎস্যজীবীদের বস্তীতে সিন্ধুর ত্রাণকর্তার আগমন বাণী পৌছিয়ে দিল এবং কয়েকদিনের মধ্যে কয়েকজন মাল্লা নিজেদের নৌকাসহ মুহম্মদ ইবন কাসিমকে সাহায্য করতে এসে উপস্থিত হলাে। কিন্তু নদী পার হওয়ার আগে মুহম্মদ ইবন কাসিমের ঘােড়ার মধ্যে এক রােগের প্রাদুর্ভাব হল এবং কয়েকদিনের মধ্যে অনেকগুলাে ঘােড়া মরে গেল। হাজ্জাজ ইবন ইউসুফ খবর পেয়েই বসরা থেকে দুই হাজার উটের উপর সিরকা বােঝাই করে পাঠিয়ে দিলেন। এ সিরকা উক্ত রােগের পক্ষে বিশেষ উপকারী প্রমাণিত হলাে।
৭১৩ খৃষ্টাব্দের জুন মাসে বিনা বাধায় মুহম্মদ ইব্‌ন কাসিম সিন্ধু পার হলেন। রাজা দাহির প্রায় দু'শাে হাতী ছাড়া তার বাহিনীতে পঞ্চাশ হাজার অশ্বারােহী এবং কয়েক দল পদাতিক যােগ করে নিয়েছিলেন। জুন মাসের শেষ দিকে নদীর স্রোত প্রবল ছিল। তিনি আশা করেন নি মুহম্মদ ইবন কাসিম এত তাড়াতাড়ি নদী পার হবেন। স্বীয় বাহিনীকে তিনি তৎক্ষণাৎ অগ্রসর হবার হুকুম দিলেন। এবং মুহম্মদ ইব্‌ন কাসিমের শিবির থেকে প্রায় দু’ক্রোশ দূরে ছাউনি ফেললেন।
কয়েকদিন উভয় দলের ভ্রাম্যমাণ দলের মধ্যে সংঘর্ষ চলল। অবশেষে এক সন্ধ্যায় মুহম্মদ ই কাসিম এক চূড়ান্ত যুদ্ধ করার সংকল্প গ্রহণ করলেন। রাত্রে ইশার নামাযের পর মশালের আলােতে তিনি স্ত্রীর নামে নিম্ন চিঠিখানি লিখে দূতের হাতে দিয়ে দিলেন।
জীবন-সংগিনী, আল্লাহ তােমাকে মুজাহিদের স্ত্রীর যােগ্য সংকল্প ও সাহস প্রদান করুন। কাল প্রভাতে শক্রর অসংখ্য সৈন্যের বিরুদ্ধে এক চূড়ান্ত যুদ্ধ করতে যাচ্ছি। এ চিঠি তােমার হাতে পৌছবার আগেই সিন্ধুর ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যাবে। আমার মন বলছে আল্লাহ আমাকে জয়ী করবেন। আমার সৈন্যদের নিয়ে আমি গৌরব বােধ করি। যেসব আরব মাতার স্তন্য এদের শিরায় রক্ত হয়ে প্রবাহিত হচ্ছে তাদের নিয়ে আমি আরাে বেশী গর্ব বােধ করি, যাঁরা শৈশবে এদেরকে ঘুম পাড়ানি গানের সাথে বদর ও হুনায়নের কাহিনী শুনিয়েছেন। আমি সেসব পত্নীদের নিয়ে গর্ব বােধ করছি যাদের কর্তব্যবােধ তাদের পতিদের জন্য যােদ্ধার জীবন ও শহীদের মৃত্যু কামনা করতে শিখিয়েছে। যাদের প্রেম তাদের পায়ের শিকল হওয়ার পরিবর্তে তাদেরকে জগৎ জয়ের পাঠ শিক্ষা দিয়েছে।
 
 
 

মুহম্মদ ইবন কাসিম
আমার দৃঢ় বিশ্বাস যতদিন এসব মুজাহিদের শিরায় এক বিন্দু রক্ত থাকবে ততদিন এরা ইসলামের পতাকাকে নত হতে দেবে না।
তােমার ও মায়ের বিরহে আমি এখনাে কাতর হই নি। কিন্তু তােমার স্মৃতিকে আমি ভুলি নি। আমার সাথে যে হাজার হাজার তরুণ আল্লাহর পথে ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতার সাথে স্ব স্ব খ্রী, মাতা ও অন্যান্য আত্মীয়ের বিচ্ছেদ হাসিমুখে সহ্য করেছে তাদের দিকে যখন আমি তাকাই তখন একথা ভেবে আনন্দ পাই যে আমিও তাদের একজন। বিগত কয়েকটি যুদ্ধ যে-সব যুবক শহীদ হয়েছেন তাদের কারাে কারাে মা আমাকে চিঠি লিখে জানতে চেয়েছেন যে তাদের সন্তানেরা তাে পালাতে গিয়ে মারা যায়নি। আমি যদি শহীদ হই, আমার বিশ্বাস আমার মাও আমাদের সংগীদেরকে এরূপ প্রশ্নই করবেন।
| আমি তােমার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে যতদিন বিধবা নারী ও য়াতীম শিশুরা মুক্তি না পায় ততদিন আমার গতি শিথিল হতে দেব না। এ প্রতিজ্ঞা আমি পালন করব। তুমিও প্রতিজ্ঞা করেছিলে যে আমি শহীদ হলে তুমি অবর্ষণ করবে না। তােমার প্রতিজ্ঞা তুমি পালন করাে। আম্মাজানকে আমার সশ্রদ্ধ সালাম জানাবে। আমি তাকে পৃথক পত্র দিচ্ছি।
তােমার
মুহ । মাতার নামে আর একখানা চিঠি লিখে মুহম্মদ ইবন কাসিম রণক্ষেত্রের না দেখতে মগ্ন হয়ে গেলেন।
॥ দুই ॥
ফজরের নামাযের পর মুসলিম সৈন্য অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান হলে মুহম্মদ ইবন কাসিম ঘােড়ায় চড়ে এক তেজোময় বক্তৃতা করেন ঃ
“আল্লাহ ও রসূলের সৈনিকগণ, আজ তােমাদের বীরত্ব, তােমাদের ঈমান ও তােমাদের আত্মােৎসর্গের পরীক্ষার দিন। শত্রুর সংখ্যা দেখে ভীত হয়াে না। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে অধর্ম ও ইসলামের সমস্ত বিগত যুদ্ধেই অসত্যের পতাকাধারীর সংখ্যা সত্যের পূজারীদের তুলনায় বেশী ছিল। সত্য সাধকগণ প্রমাণ করে দেখিয়েছে যে, তাদের সৈন্যের শক্তি সংখ্যায় নয় বরং ঈমানের দৃঢ়তা ও লক্ষ্যের উচ্চতায় সন্নিহিত। আমাদের যুদ্ধ কোন জাতির বিরুদ্ধে নয়। বরং পৃথিবীর যে সব উদ্ধত লােক জগতে অশান্তির সৃষ্টি করে, তাদের সকলের বিরুদ্ধে। আমরা ভূ-পৃষ্ঠে আমাদের শাসন নয় বরং আল্লাহর শাসন প্রবর্তন করতে চাই। আমরা নিজেদের নিরাপত্তা এবং সংগে সংগে পৃথিবীর সমস্ত লােকের নিরাপত্তা চাই। আল্লাহর দুনিয়ায় নিরাপত্তার একমাত্র পন্থা ইসলাম। এ সে ধর্ম যা প্রভু-ভৃত্য, গৌর-কৃষ্ণ এবং আরব-অনারবের পার্থক্য পৃথিবী হতে মুছে দেয়। আমাদের বাপ-দাদা, এই উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করেছিলেন। আল্লাহ তাদের মুষ্টিমেয় দলের সম্মুখে পৃথিবীর বৃহত্তম শক্তি ও প্রতিপত্তির অধিকারী সম্রাটের মস্তক নত করে দিয়েছেন।
 
 
 
রাজা দাহিরের শেষ পরাজয়
১৯৯
আরব অশ্বারােহী, নিজের ভাগ্যের উপর তােমাদের গৌরব বােধ করা উচিত যে আল্লাহ তার ধর্ম প্রচারের জন্য তােমাকে নির্বাচন করেছেন। আল্লাহর পথে তােমার মন-প্রাণ সমর্পণ করেছ এবং আল্লাহ তােমাদেরকে পৃথিবী ও আকাশের সমস্ত নিয়ামত প্রদানে কৃতার্থ করেছেন। সেদিনের কথা স্মরণ কর যখন আল্লাহ তার তিনশত তেরজন অস্ত্র রসদবিহীন সেবককে শ্রেষ্ঠতম অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এক সহস্রের অধিক সৈন্যের উপর জয়ী করেছিলেন। কাদিসিয়া, রমূক এবং আজনাদায়নের রণক্ষেত্রে সত্যের পক্ষে এক তরবারীর বিরুদ্ধে অসত্যের পক্ষে দশ বা ততােধিক অসি কোষমুক্ত হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ সর্বদাই সত্যকে জয়ী করেছেন। আজও আল্লাহ তােমাদের সাহায্য করবেন। কিন্তু মনে রেখাে বিধির বিধান অপরিবর্তনীয়। আল্লাহ কেবল তাদেরই সাহায্য করেন যারা নিজেদের সহায়। নিজের কর্তব্য পালন না করে তােমরা আল্লাহর আশীষের যােগ্য হতে পারবে না। বিধাতার স্নেহহস্ত শুধু তারই প্রতি প্রসারিত হয়, যে তীর বর্ষণের মাঝখানে বুক পেতে দিতে পারে, যারা নিজের লাশ দ্বারা পরিখা পূর্ণ করতে পারে। বিধাতার অফুরন্ত দান কেবল সে-সব জাতির জন্য যাদের ইতিহাসের প্রতি পৃষ্ঠা
শহীদের রক্ত রঞ্জিত।
মনে রেখাে, বণী ইসরাঈলও আল্লাহর প্রিয় জাতি ছিল। কিন্তু তারা যখন সত্যের পথে জিহাদ করার দায়িত্ব আল্লাহর ও রসূলের উপর চাপিয়ে দিয়ে বিশ্রাম উপভােগ শুরু করে দিল, বিধাতা তাদের পরিত্যাগ করলেন। কাজেই যে ভূ-খন্ডে তাদের প্রতিপত্তির ধ্বজা এক সময়ে উভীন ছিল আজ সেখানে তারা আশ্রয় পাচ্ছে না। আল্লাহ যেন কখনাে সেদিন না দেখান যখন তােমাদের জীবন থেকে জিহাদের নির্ধারণ বিলীন হয়ে যাবে।
আমার বন্ধু ও শ্রদ্ধেয়গণ, তােমাদের জন্য আজ এক কঠিন পরীক্ষার দিন। বদর ও হুনায়নের মুজাহিদগণের আদর্শ আজ তােমাদের অনুসরণ করতে হবে। কাদিসিয়া এবং য়ারমূকের শহীদদের পদচিহ্ন লক্ষ্য করে তােমাদের চলতে হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আজকের দিনে বিজয় লাভের জন্য আল্লাহ যে বীর সৈন্য বাহিনীকে নির্বাচন করেছেন, সে তােমাদেরই। আমি জোর করে বলতে পারি, সত্যের তরবারীর সামনে সিন্ধুর লৌহ রােম ও ইরানের লৌহের চেয়ে দৃঢ়তর প্রমাণিত হবে না। অত্যাচারী কখনাে বীর হয়
। কিন্তু আমি তােমাদের আর একবার সাবধান করে দিচ্ছি যে, সত্যের পথকে অধর্মের কন্টকমুক্ত করতে গিয়ে সর্বদা মনে রাখবে কোন নির্দোষ চারা বা কুসুমিত পুষ্পকে যেন পিষে না ফেল। পতিত শত্রুকে কখনাে আঘাত করবে না। নারী, শিশু ও বৃদ্ধের উপর তােমাদের হাত ওঠেনা যেন। আমি জানি সিন্ধু-রাজ আরব নারী ও শিশুদের সাথে দুর্ব্যবহার করেছে। কিন্তু প্রতিশোধ কামনার জন্য সর্বদাই দয়ার স্থান রয়েছে। শত্রুকে পরাজিত করে প্রমাণ কর যে আমাদের সম্মানবােধ আল্লাহর জন্য এবং আমাদের অসি আল্লাহর অসি। কিন্তু শত্ৰু পরাজয় মেনে তােমার আশ্রয় চাইলে তাকে বুকে তুলে আলিঙ্গন কর এবং বল যে ইসলামের আশীষ-দ্বার সকলের জন্যই মুক্ত।
তােমরা জান মক্কার কাফিরগণ হযরত মুহম্মদকে (সঃ) যত নির্যাতন করেছিল,
 
 
 
২০০
মুহম্মদ ইব্‌ন কাসিম পৃথিবীর অন্য কোন লােককে ততটা নির্যাতন সইতে হয় নি। অত্যাচারীর তুণে এমন তীর ছিল না যার দ্বারা তাঁর পবিত্র দেহকে বিক্ষত করতে চেষ্টা করা হয় নি। বিশ্বের আশীষ সেই মহামানবের চোখের সামনে তার ভক্তদের বুকের উপর উত্তপ্ত পাথর চাপা দেওয়া হত। তিনি মক্কা ছেড়ে যখন মদীনায় হিজরত করেন, তখনাে অত্যাচারী। তাকে রেহাই দেয়নি। মদীনার কয়েকটি যুদ্ধে তাঁর অনেক ভক্ত প্রাণ হারান। কিন্তু মক্কা বিজয়ের পর তিনি শত্রুদের সাথে যে ব্যবহার করেন, তার নির্দশন পৃথিবীর ইতিহাসে পাওয়া যায় না। তার সেই সদ্ব্যবহারের ফলে প্রবলতম শত্রু তাঁর ঘনিষ্ঠতম ভতে পরিণত হয়। যেসব দেশ পূর্বে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল, তাদের প্রত্যেকের বাসিন্দারা আজ তুর্কিস্তান ও আফ্রিকায় ইসলামের জয়ের জন্য আমাদের সাথে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছে। কে বলতে পারে যে সিন্ধুর দেশ এবং সমস্ত ভারতবর্ষ একদিন ইরান, শাম ও মিসরের মত সত্যধর্মের জয়ের জন্য আমাদের সাথে মিলিত হবে না। বন্ধুগণ, আজ আমাদের গন্তব্যস্থান ব্রাহ্মণাবাদ। এসাে আমরা বিজয়ের জন্য দু'আ করি। | একথা বলে মুহম্মদ ইব্‌ন কাসিম হাত তুলে দু’আ করলেন- প্রভু, পুরস্কার ও তিরস্কারের মালিক, আমরা তােমার ধর্মের জয় চাই। আমাদের মনে পূর্ব পুরুষদের মতাে আমাদের মনেও উৎসাহ জাগাও। হে বিশ্বভুবনের পালক, কিয়ামতের দিন আমাদের মাতৃকূলকে সজ্জিত কর না। আমাদেরকে গাযীর জীবন ও শহীদের মৃত্যু প্রদান কর।” | সন্ধ্যায় সিন্ধুর বাহিনী রাজা দাহিরসহ ত্রিশ হাজার মৃতদেহ রণক্ষেত্রে ফেলে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। বেলা তিন প্রহরের দিকে তাদের যে সব দল পরাজয় অনিবার্য বলে বুঝতে পারল, তারা আরাের যাত্রা করল। রাজা দাহিরের মৃত্যুতে বাকী সৈন্য সাহস হারিয়ে ব্রাহ্মণবাদের দিকে ধাবিত হল।
কিছুদূর পশ্চাদ্ধাবন করার পর মুসলিম বাহিনী শিবিরে ফিরে আসে। এ যুদ্ধে মুসলিম হতাহতের সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে তিন হাজার। সৈন্যরা রণক্ষেত্র হতে আহতদের তুলে এনে সারি সারি শুইয়ে দিচ্ছিল। মুহম্মদ ইবন কাসিম অস্ত্রোপচারকদের সাথে সাথে তাদের ক্ষতে ঔষধ প্রয়ােগে ব্যস্ত ছিলেন। যুবায়র একজন আহত সৈনিককে কাঁধে নিয়ে
হাদ ইবন কাসিমের কাছে পৌছলেন। তাকে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে মুহম্মদ ইবুন কাসিমকে বললেন, আপনি একে একটু দেখুন। এ ভীষণভাবে আহত হয়েছে।
মুহম্মদ ইবন কাসিম তাড়াতাড়ি আহত সৈনিকের কাছে গিয়ে বললেন- কে, সা'আদ?
সা’আদের চেহারা রক্তে রঞ্জিত ছিল। মুহম্মদ ইবন কাসিম কাপড় দিয়ে তার মুখ মুছতে চেষ্টা করলে সে তার হাত চেপে ধরে ওষ্ঠে মৃদু হাসি টেনে বলল- এখন আর এর কোন প্রয়ােজন নেই। আমি শেষবারের মত আপনাকে দেখতে চেয়েছিলাম মাত্র।
| যুবায়র ও মুহম্মদ ইবন কাসিম এদিক ওদিক তাকাতে লাগলেন। একটু দূরে খালিদ আহতদের পানি খাওয়াচ্ছিল। যুবায়র তাকে ডাকলেন। সে ছুটে সা'আদের কাছে এল। ‘চাচা, তুমি ...'তার মুখ থেকে আচম্বিতে বের হয়ে পড়ল।
 
 
 
রাজা দাহিরের শেষ পরাজয়
২০১
সাআদ তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। খালিদ উভয় হাতে সে হাত ধরে বসে পড়ল।
মৃত্যুতে আর আমার ভয় নেই। কিন্তু আমি ভীষণ পাপী। আপনি বিশ্বাস করেন যে আল্লাহ আমাকে মাফ করে দেবেন?
মুহম্মদ ইবন কাসিম বলেন- শহীদের রক্ত সমস্ত পাপ ধুয়ে তাকে নিস্পাপ করে দেয়। | সা'আদ খালিদের দিকে তাকিয়ে দুর্বল কণ্ঠে বলল- বৎস, যুহরার যত্ন কর। আর যুবায়র, তােমাকে নাহীদ সম্বন্ধে কিছু বলা দরকার মনে করি না।
কিছুক্ষণ পর্যন্ত সে পরপর এদের দিকে তাকাতে লাগল। পরে মুহম্মদ ইবন কাসিমের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। ক্রমে তার চক্ষের জ্যোতি ক্ষীণ হয়ে এল। অতি কষ্টে কয়েকটি শ্বাস নেবার পর সে খালিদ ও মুহম্মদ ইব্‌ন কাসিমের হাত ছেড়ে দিল। ইতিমধ্যে সাআদের আরাে কয়েকজন বন্ধু এসে তার পাশে জমা হল। মুহম্মদ ইব্‌ন কাসিম তার নাড়ীতে হাত রেখে ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন (আমরা আল্লাহর সৃষ্ট জীব এবং তাঁরই কাছে ফিরে যাই) বলে উঠলেন। তিনি স্বহস্তে সা'আদের চক্ষু বন্ধ করে দিলেন।
মুহম্মদ ইবন কাসিম ওঠে আবার আহতদের সেবায় মনযােগ দিতে যাচ্ছিলেন এমন সময় এক অশ্বারােহী সামনে এক আহত ব্যক্তিকে বহন করে তার কাছে এসে পৌছল। মুহম্মদ ইব্‌ন কাসিম তাকে দেখেই বলে উঠলেন- ভীম সিংহ, তুমি? .... এ কে?
এক সৈনিক আহত ব্যক্তিকে ঘােড়া থেকে নামিয়ে নীচে শুইয়ে দিল। ভীম সিংহ ঘােড়া হ'তে নামতে নামতে বললেন- খালিদ, তােমার পিতাকে দেখ।
খালিদ মাথা নত করে সাআদের কাছে বসেছিল। সে চমকে পিছনে তাকাল। আহত ব্যক্তিকে দেখেই সে মৃদু চীৎকার দিয়ে ছুটে এসে তার মস্তক কোলে তুলে নিল। আব্বা, আমার আব্বা'।
আহত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে সে ভীম সিংহকে জিজ্ঞেস করল- আপনি একে কোথা থেকে নিয়ে এলেন? ইনি কি করে আহত হলেন? | ভীম সিংহ বললেন- আমি, আমার বাবা আর ইনি আরাের বন্দীশালা থেকে এক সামরিক কর্মচারীর দয়ায় ফেরার হয়েছিলাম। পিতাজীর নিষেধ সত্ত্বেও ইনি একদল সৈন্যকে আক্রমণ করেন। বাধ্য হয়ে আমিও পিতাজী এর সহায়তা করি। এক শরাঘাতে পিতাজী ঘােড়া থেকে পড়ে গিয়ে হাতীর পায়ের নীচে পিষ্ট হয়ে নিহত হন। - একথা বলে তিনি নীরব হলেন এবং তার নয়ন হতে অশ্রু ঝরতে লাগল। কিছুক্ষণ পর তিনি নিজকে সামলাবার চেষ্টা করতে করতে বললেন- ইনি বেপরােয়াভাবে অগ্রসর হতে থাকেন। পাচ ছ’জন সৈনিককে হত্যা করার পর ইনি আহত হয়ে ঘােড়া থেকে পড়ে যান। এর শেষ ইচ্ছা ছিল নিজের পুত্রকে দেখবার। আপনি ওকে ভাল করে দেখুন। বােধ হয় এখনাে জীবিত আছেন।
| মুহম্মদ ইবন কাসিম কয়েকজন সিপাহীর প্রতি ইশারা করে বললেন তােমরা এর
 
 
 
মুহমদ ইবন কাসিম
সাথে গিয়ে এর পিতাজীর মৃতদেহ তুলে নিয়ে এস।
তিনি নিজে আবুল হাসানের দিকে মনযােগ দিলেন। তার নাড়ীর উপর হাত রেখে বললেন-ইনি অচেতন হয়েছেন। পানি আন।
এক সৈনিক এক গ্লাস পানি এনে দিল। মুহম্মদ ইব্‌ন কাসিম আবুল হাসানের মুখ তুলে তাকে কয়েক ঢােক পানি খাইয়ে দিলেন। আবুল হাসানের চেতনা ফিরে এল এবং তিনি চোখ খুললেন। কিন্তু খালিদকে চিনতে পেরেই কিছুক্ষণের জন্য আবার অচেতন হয়ে পড়লেন। পুনরায় তার চেতনা ফিরে এলে মুহম্মদ ইব্‌ন কাসিম তার ক্ষতে ওষুধ লাগিয়ে দিলেন।
খালিদকে আবুল হাসান প্রথম প্রশ্ন করলে- তােমার মা কোথায়? তিনি- তিনি’- খালিদ ঘাবড়িয়ে গিয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল।
আবুল হাসান বিষন্ন হাসি হেসে বললেন- বক্স, ভয় পেয়াে না। আমি বুঝেছি। তিনি জীবিত নেই। নাহীদ কোথায়?
সে দেলে আছে। তাহলে তােমার স্ত্রীও সেখানেই হবে। হায়, আমি মৃত্যুর পূর্বে যদি তাদের দেখতে পেতাম। কিন্তু তারা রয়েছে অনেক দূরে। আর আমার জীবন মাত্র কয়েক ঘন্টা বাকী আছে।
মুহম্মদ ইব্‌ন কাসিম সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বললেন- আপনি চিন্তা করবেন না। আমি এখুনি তাদের ডেকে পাঠাচ্ছি। আল্লাহর ইচ্ছায় ডাকের ঘােড়ায় তারা পরশু এখানে পৌছে যাবে।
আবুল হাসান কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে মুহম্মদ ইব্‌ন কাসিমের দিকে তাকিয়ে বললেন ধন্যবাদ, কিন্তু হয়ত আমি পরশু পর্যন্ত জীবিত থাকব না।
মুহম্মদ ই কাসিম বললেন- আপনার ক্ষত খুব বেশী বিপজ্জনক নয়। আপনাদের সাক্ষাৎ যদি বিধাতার অভীষ্ট হয়, তাহলে তা অবশ্যই ঘটবে।
চতুর্থ দিন সূর্যোদয়ের কিছুক্ষণ পরে আবুল হাসানের শয্যাপার্শ্বে মুহম্মদ ইন কাসিম, খালিদ এবং যুবায়র ছাড়া নাহীদ এবং যুহরাও উপস্থিত ছিল। নাহীদ ও যুহরা পূর্বদিন সন্ধ্যায় এখানে পৌছে। পথের ক্লান্তিতে অবসন্ন হওয়া সত্ত্বেও তারা খালিদ ও যুবারের মত সমস্ত রাত্রি জেগে আবুল হাসানের সেবা শুশ্রুষা করে।
| স্বাসকষ্টের একটু আগে নাহীদ ও যুহরার মত খালিদের চোখেও অশ্রু দেখে আবুল হাসান বললেন- বৎস, আমি এর চেয়ে শ্রেয় মৃত্যু কামনা করতে পারতাম না। মৃত্যু উপলক্ষ্যে অশ্রু বর্ষণ একটা পার্থিক প্রথা। কিন্তু শহীদের মৃত্যুতে এ প্রথা পালন করা শাহাদতকে পরিহাস করা মাত্র। এরূপ অশ্রুসজল চোখে আমার দিকে তাকিও না। আমি অকে ঘৃণা করি। জীবনের কঠোর গন্তব্যপথে মুসলমানের মূলধন অশ্রু নয়-রক্ত।
খালিদ চোখ মুছে বলল- আব্বাজান, আমাকে মাফ করুন। দুপুরের সময় আবুল হাসান শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

মুহাম্মদ বিন কাশিমDonde viven las historias. Descúbrelo ahora