॥ এক ॥মুহম্মদ ইব্ন কাসিমের শ্রান্ত সৈনিকরা অর্ধরাত্রি পর্যন্ত আহতদের সেবা শুশ্রুষা এবং শহীদগণের দাফন-কাফনে ব্যস্ত থাকে। রণক্ষেত্রের চতুর্দিক থেকে আহত শত্রু সৈন্যের চীকার শােনা যাচ্ছিল। শহীদগণের জানাযার নামায শেষ করে মুসলিম বাহিনরি সতর বৎসর বয়স্ক সেনাপতি নিজের পিঠে পানির মশক নিয়ে আহত ও আর্ত শত্রু সৈন্যের পিপাসা নিবারণ করতে অগ্রসর হলেন- যদিও কয়েক রাত পর্যন্ত বিশ্রামের অভাবে তার শরীর ক্লান্তিতে অবসন্ন ছিল এবং তার বাহু সারাদিন তলােয়ার ও বর্শা চালিয়ে অবশ হয়ে পড়েছিল। যুদ্ধের সময় যে নয়নে দৃঢ়তা ও ক্রোধের বহ্নি জ্বলছিল, পতিত ও আর্ত শত্রুর জন্য সে নয়নে এখন ক্ষমা দয়ার অশ্রু বইছিল। যে হস্তের অসি শক্রর মস্তকে বজ্বের ন্যায় পতিত হচ্ছিল, এখন সে হস্তই তাদের ক্ষতে মলম লাগাতে ব্যস্ত ছিল।
মুহম্মদ ইবন কাসিমের সৈন্যরাও ক্লান্তিতে অবসন্ন ছিল। কিন্তু তাদের তরুণ ও প্রিয় সেনাপতির অনুসরণে তারা এক স্বর্গীয় আনন্দ অনুভব করছিল। তারা আহত শত্রু সৈন্যদের তুলে এনে কিল্লার সামনে সারি সারি শুইয়ে দিল।
পর্বত পার্শ্ব থেকে কার কাতর কণ্ঠ মুহম্মদ ইব্ন কাসিমের কানে এল। মশাল হাতে তিনি সেদিকে অগ্রসর হলেন। সাঈদ, যুবায়র, সাআদ, নাসিরুদ্দীন এবং কয়েকজন সেনাপতি তাঁর সঙ্গে ছিলেন। মশালের আলােকে কয়েকটি মৃতদেহের মাঝখানে বর্ম পরিহিত এক যুবককে তিনি দেখতে পেলেন। বর্মের উপর রক্তের কয়েকটি চিহ্ন ছিল। পাজরে একটি তীর বিদ্ধ ছিল। তার ডান হাত থেকে অসির হাতল খুলে গিয়েছিল। কিন্তু বাম হাতে তখনাে সিন্ধুর পতাকা শক্ত করে ধরে রেখেছিল। মুহম্মদ ইবন কাসিম মশাল অন্যের হাতে দিয়ে মাটিতে হাঁটু পেতে বসে তাকে তুলে ধরলেন এবং পানি খাওয়ালেন। কয়েক ঢােক পানি খেয়ে যুবক চোখ খুলল। মুহম্মদ ইবন কাসিম ও তার সঙ্গীদের মনােযােগ দিয়ে দেখে উভয় হাতে পতাকাটি শক্ত করে ধরে নিল। | নাসিরুদ্দীন যুবায়রকে বললেন- যুবায়র, আপনি একে চিনলেন না? যুবায়র অগ্রসর হয়ে আহত যুবককে দেখে বললেন- ওহাে, এ যে ভীম সিংহ।
ভীম সিংহ চোখ খুলে ম্লান হাসি হেসে বললেন- আপনাদের বিজয় মুবারক। | মুহম্মদ ইবন কাসিমের অনুরােধে যুবায়র ভীম সিংহের কথার আরবী তরজমা করে তাঁকে শােনালেন। শুনে তিনি বললেন- আমি আশ্চর্য হচ্ছি এরূপ বীর সেনাপতি থাকা সত্ত্বেও সিন্ধুবাহিনী রণক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গেল কেন। যুবায়র আপনি ওকে সাহায্য
১৭৪
মুহম্মদ ইবন কাসিম
করুন, আমি ওর তীরে টেনে বের করছি। | যুবায়র অগ্রসর হয়ে ভীম সিংহকে ধরলেন। মুহম্মদ ইবন কাসিম তীরের দিকে হাত বাড়ালেন। কিন্তু ভীম সিংহ পতাকা ফেলে তাঁর হাত ধরে ফেললেন। | মুহম্মদ ইব্ন কাসিম নাসিরুদ্দীনকে ইশারা করলেন। তিনি ভীম সিংহের উভয় হাত ধরে রাখলেন। মুহম্মদ ইবন কাসিম তীর টেনে ফেলে দিলেন এবং তার বর্ম খুলে ফেলার আদেশ দিলেন।
ভীম সিংহের ক্ষত গভীর ছিল না। কিন্তু অত্যধিক রক্তক্ষয়ে তিনি দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর ক্ষতস্তান ওষুধ দিয়ে পট্টি বেঁধে মুহম্মদ ইবন কাসিম তাকে দূর্গের ভেতর নিয়ে যেতে আদেশ দিলেন। তিনি নিজে অন্যান্য আহতদের সেবায় মনােযােগী হলেন।
॥ দুই ॥
যুহরা তার ক্ষতকে আমল দিল না। অন্যান্য দিনের মত সে প্রত্যুষে উঠে নাহীদের সাথে ফজরের নামায পড়তে দাড়িয়ে গেল। নামায শেষ করে বিছানায় শুতে শুতে যুহরা বলল- হায়, আমার ক্ষত যদি গুরুতর হত, তাহলে তােমার সেবা শুশ্রুষা উপভােগ করতে পারতাম।
মুচকি হেসে নাহীদ বলল, তুমি আমার সেবার কল্পনা করছ, না খালিদের?
যুহরার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেল। দরজায় টোকা মেরে নাসিরুদ্দীন বললেন ভেতরে আসতে পারি? | নাহীদ উঠে অন্য ঘরে যেতে যেতে বলল- নাও, এবার উঠে বস। নইলে-নইলে কি হবে?
নাহীদ বলল- নইলে হয়ত তােমার বিয়ে দেবল বিজয় পর্যন্ত স্থগিত হয়ে যাবে।
যুহরার বুক দুরু দুরু করতে লাগল। সে উঠে নাহীদের কাপড় টেনে বলল- নাহীদ, নাহীদ আপা, সত্য বলতে, ব্যাপার কি?
| নাহীদ কাপড় ছাড়িয়ে বলল- পাগলী, তােমার ভাই বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে ছেড়ে দাও।
| না, যতক্ষণ তুমি আমাকে পরিষ্কার করে খুলে না বলবে, আমি তােমাকে ছাড়ব না। ভাই, একটু দাঁড়ান। আমি নাহীদ আপার সাথে একটা কথা বলছি। হাঁ, এখন বল।
নাহীদ বলল- আচ্ছা, বলছি শােন। রাত্রে ময়দান থেকে ফিরবার সময় সা'আদ তােমার বিষয় জিজ্ঞেস করেছিল। আমি তাকে সব কথা বলেছি। তােমার মনের অবস্থা আগেও তার কাছে গােপন ছিল না। তােমার মনে থাকতে পারে, যখন আমরা কিল্লায় প্রবেশ করেছিলাম, সে তােমার ভাইকে ধরে একদিকে নিয়ে গিয়েছিল ...।
১৭৫
সর্ব সহায়
১৭৫ তাহলে সে ভাইকে কি বলেছে?
এই যে- খালিদের সাথে তােমার বিয়ে দেওয়া হােক। আপা সত্যি বল। তুমি রহস্য করছ? পাগলী। আমি রহস্য করছি না। তােমার ভাই এখুনি আমার কথার সত্যতা সমর্থন করবেন।
যুহরার চোখে আনন্দাশ্রুতে পূর্ণ হল। নাহীদ বলল- হায়, হায়, তুমি তাে কাছে। আমার ভাইকে বুঝি তােমার পছন্দ হয় না?
মুচকি হেসে সে বলল- না! তাহলে আমি নিজেই তােমার ভাইকে বলছি তিনি যেন তােমাকে এ বিয়েতে বাধ্য করেন। বলব? একথা বলে নাহীদ দুষ্টু হাসি হেসে দরজার দিকে অগ্রসর হল। কিন্তু যুহরা এগিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল।
আমার বােন, আমার আপা। চোখ মুছতে মুছতে সে বলল। নাহীদ বলল- তা'হলে খালিদের সাথে বিয়েতে তােমার মত আছে।
যুহরা তার দিকে তাকাল। মুচকি হেসে তাকে অন্য কামরার দিকে ধাক্কা দিয়ে বলল- যাও, তুমি বড় দুষ্ট।
নাসিরুদ্দীন বাইরে থেকে বললেন- যুহরা, তােমার কথা শেষ হবে কখন?
সে বিছানায় বসে জবাব দিল- আসুন ভাই। বােন নাহীদ অন্য ঘরে চলে গেছেন।
॥ তিন ॥
নাসিরুদ্দীন ভেতরে প্রবেশ করে জিজ্ঞেস করলেন- তােমার ক্ষতের অবস্থা কেমন?
সে উত্তর দিল- ভাই সে সামান্য আঁচড় মাত্র ছিল। আমি সম্পূর্ণ ভাল আছি। নাসিরুদ্দীন তার কাছে চৌকির উপর বসলেন। যুহরার হৃদয় দুরু দুরু করতে লাগলাে।
কিছুক্ষণ ভেবে নাসিরুদ্দীন বললেন- যুহরা, খালিদ এক বীর বালক। আমার ইচ্ছা তার সাথে তােমার বিয়ে হােক। এ সম্বন্ধে তােমার পছন্দ হয়?
উত্তর দেয়ার পরিবর্তে যুহরা উভয় হাতের মধ্যে মুখ লুকাল। কিছুক্ষণ ভেবে নাসিরুদ্দীন বললেন- আমার ইচ্ছা ছিল সিন্ধু বিজয়রে পর খুব ধুমধামের সাথে বিয়ে হবে। কিন্তু মুসলমানরা এসব প্রথা পছন্দ করে না। তা ছাড়া সিন্ধুর সঙ্গে চূড়ান্ত যুদ্ধ এখনাে বাকী। যােদ্ধার জীবনের কোন ভরসা নেই। আমার সাধ যে আমি নিজের হাতে তােমাকে খালিদের হাতে তুলে দেব। নাহীদ তােমাকে খুব ভালবাসে। সে তােমার যত্ন করবে। আমি অধিকতর নিশ্চিন্ত মনে ইসলামের সেবা
১৭৬
মুহম্মদ ইবন কাসিম
করতে পারব। যুহরা, আমার বর্তমান নিঃস্ব অবস্থায় নেক দু’আ ছাড়া আর কিছুই তােমার জন্য নেই। কিন্তু বিশ্বের সমস্ত ঐশ্বর্য যদি আমার থাকত, তােমার জন্য উৎসর্গ করে দিতাম।
যুহরা ভাইয়া, ভাইয়া বলে ফোঁপাতে ফোঁপাতে নাসিরুদ্দীনের কোলে মাথা রেখে বলল- আমার কিছুর প্রয়ােজন নেই।
সস্নেহে তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে তিনি আবার বললেন- যুহুরা, আমার ইচ্ছা আজ রাত্রেই তােমার বিয়ে হয়ে যাক। সৈন্য বাহিনী এখানে আরাে দু'চার দিন থাকবে। কিন্তু দেবল থেকে রাজ-সৈন্যের আগমণ বার্তা পেলে হয়ত হঠাৎ আমাদের যাত্রা করতে হবে। সা'আদ মুহম্মদ ইব্ন কাসিমের কাছে কথা পেড়েছিলেন। তিনি বিশেষ আনন্দিত। সা'আদ খালিদকেও জিজ্ঞেস করেছে। হাঁ, বােন নাহীদকেও অভিনন্দন জানাও। প্রধান সেনাপতি নিজেই তার ভাইকে ডেকে তার মত নিয়েছেন। তিনি নিজেই তােমাদের উভয়ের বিয়ে পড়াবেন।
বাইরে থেকে সাআদ নাসিরুদ্দীনকে ডাকায় তিনি বের হয়ে গেলেন।
যুহূরা উঠে সামনের ঘরের দরজা খুলতে খুলতে বলল- নাহীদ, নাহীদ, শুনেছ? আজ তােমার বিয়ে!
| আমার বিয়ে? লজ্জা ও আনন্দে নাহীদের মুখে এক ঝলক রক্ত খেলে গেল।
হাঁ নাহীদ, তােমার বিয়ে। এখন বলতে যুবায়র ভাইকে তােমার পছন্দ হয় কি না? বল না। আমি তাকে এখুনি ডেকে বলে দিচ্ছি তিনি যেন অন্য কনে খুঁজে নেন।
নাহীদ বলল- যুহরা, তুমি বড় দুই।
খালিদ বারান্দা থেকে অন্য ঘরের দরজায় টোকা দিয়ে নাহীদকে ডাকল। যুহরা হেসে বলল- নাহীদ শিগগীর যাও, নইলে তােমার বিয়ে সিন্ধু বিজয় পর্যন্ত স্থগিত হয়ে যাবে। আমি রহস্য করছি না। তােমার ভাই এখুনি আমার কথার সমর্থন করবেন। | সস্নেহ দৃষ্টিতে নাহীদ যুহরার দিকে তাকাতে তাকাতে অন্য ঘরে প্রবেশ করল। তার হৃদয় আনন্দে নাছিল। তার পা কাঁপছিল।
॥ চার ॥ | সন্ধ্যার সময় কিন্নর এক প্রশস্ত ঘরে সৈন্য বাহিনীর সেনাপতিগণ যুবায়র ও খালিদকে তাদের বিবাহােপলক্ষ্যে অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন। নাহীদ ও যুহরা এক ঘরে বসে কথাবার্তা বলছিল। নাহীদ বলল- যুহরা, বিয়ের সময় তােমার কণ্ঠ এরূপ মূক হয়েছিল কেন?
নাহীদ, আমি জানি না। তুমি জান, আমার আশা ছিল না সমস্ত ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি ঘটে যাবে। আমার কান শা শা করছিল। আমি কোথায় তাও আমার মনে
সর্বাহায়
১৭৭
ছিল না। তাই যদি মুহম্মদ ইব্ন কাসিম ছাড়া অন্য কেউ বিয়ে পড়াতেন, তা হলে হয়ত আমি এতটা বিচলিত হতাম না। তার চেহারায় কী শৌর্য এবং তার কণ্ঠস্বর কী গুরুগম্ভীর। সত্য বলতে কি তিনি মানুষ নন, দেবতা। আমরা দেবতার ভয় করতে শিখেছি। নাহীদ, তুমি আমার কাছে না থাকলে হয়ত আমার মুখ মােটেই খুলত না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন- খালিদকে তুমি গ্রহণ করছ? আর আমি লজ্জায় মাটিতে যেন মিশে যাচ্ছি। নাহীদ, আমার এখনাে বিশ্বাস হচ্ছে না, তােমার ভাইয়ের সাথে সত্যি সত্যি আমার বিয়ে হয়ে গেছে। কখনাে কখনাে আমার মনে হয় আমি স্বপ্ন দেখছি। আচ্ছা, তােমার বিয়ে তােমার কাছে স্বপ্ন বলে মনে হয় নাকি?
নাহীদ, মুকি হাসল। যুহরা উভয় বাহু দিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরল। নাহীদ তার ভ্রমর-কৃষ্ণ কেশগুচ্ছ নিয়ে খেলতে লাগল। হঠাৎ তার কি কথা মনে হল এবং সে তার কণ্ঠ হতে মুক্তার মালা খুলে যুহরার গলায় পরিয়ে দিল।
যুহরা বলল- না, না এটা তােমার গলায় বেশী শােভা পায়। নাহীদ বলল- আমার আর একটা আছে। আমাকে খালিদ দিয়ে গেছে। একথা বলে স্বীয় হীরার আংটি খুলে যুহরার প্রতিবাদ সত্ত্বেও তার আঙ্গুলে পরিয়ে দিল। পরে বলল দেখ, আমাকে খুশী করতে চাইলে এ আংটি খুললা না।
যুহরা একটু যেন নিষ্প্রভ হয়ে গেল এবং নাহীদের দিকে তাকিয়ে রইল।
নাহীদ বলল- যুহরা তুমি বিষন্ন হলে কেন? অলংকার আমার ভাল লাগে না। কিন্তু তােমাদের দেশেতাে অলংকার পরবার প্রথা রয়েছে।
যুহরা বলল- কিন্তু আমাদের দেশে ভাবী ননদের কাছ থেকে উপহার গ্রহণ করে না; বরং দান করে। আমি বাড়ী থেকে এত দূরে...
নাহীদ বাধা দিয়ে বলল- পাগলী, ভাবী তাে তুমি আজ হলে। কিন্তু এর আগে অনেকদিন পর্যন্ত তুমি আমার ছােট বােন ছিলে তাে। | যুহরা বলল- নাহীদ, সিন্ধু বিজয়রে পর ভাইয়ের ইচ্ছা তিনি কাঠিয়াওয়াড়ে গিয়ে ইসলাম প্রচার করবেন। আমারও ইচ্ছা কিছুদিনের জন্যে আমি সেখানে যাই। হায়, তুমিও যদি কিছুদিনের জন্য আমাদের সাথে যেতে পারতে। আমাদের বাড়ী সমুদ্র তটে একটি ছােট দূর্গের মধ্যে। তার তিন দিকে প্রশস্ত আম বাগান। মাঝখান দিয়ে একটি নদী প্রবাহিত। সেই নদীর তীরে আম গাছে আমি দোনায় দুতাম। বর্ষাকালে নদীর স্রোত প্রখর হত। সখীদের সাথে আমি তাতে স্নান করতাম। বৃষ্টিতে আমরা আম পেড়ে খেতাম। মধুর মত মিষ্টি আম। বাগানের পেছনে একটি সুন্দর দীঘি ছিল। আমরা পানিতে নেমে কানামাছি খেলতাম। পদ্মফুল ছিড়ে পরস্পরকে ছুঁড়ে মারতাম। নাহীদ, আমি তােমাকে নিশ্চয় সেখানে নিয়ে যাব।
নাহীদ জবাব দিল- আল্লাহ আমাদের জয় দিন। সম্ভবতঃ সিন্ধুর পরে আমাদের বাহিনী তােমাদের দেশের দিকে অগ্রসর হবে।
১
মুহম্মদ ইবন কাসিম
যুহরা বলল- আল্লাহ সে দিন শীঘ্র আনুন। আমি নিজের হাতে ইসলামের পতাকা সে দূর্গের উপর উত্তোলন করব। নাহীদ, আমি বিস্মিত হচ্ছি আমার মনে এরূপ বৈপ্লবিক পরিবর্তন কি করে এলাে। আমি অজুদের ভীষণ ঘৃণা করতাম। একদিন আমি সখীদের সাথে দীঘিতে স্নান করতে যাই। সেখানে এক অহং বালক স্নান করছিল। আমরা প্রস্তর নিক্ষেপ করে করে তাকে অচেতন করে ফেলি। আর একদিন এক নীচ জাতীয় পথিক আমাদের জাতীয় বাগানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। সে মাটিতে পড়া কয়েকটি আম কুড়িয়ে নেয়। আমাদের চাকর তাকে অষ্ট প্রহর পর্যন্ত এক গাছের সাথে বেঁধে রাখে। আমি কতবার সেখান দিয়ে যাতায়াত করেছি। অথচ আশ্চর্যের বিষয় তাকে বুভুক্ষু ও তৃষ্ণার্ত দেখেও তার প্রতি আমার কিছুমাত্র দয়া হয়নি। এখন আমি সেখানে ফিরে গেলে আশ-পাশের বস্তিবাসী সমস্ত অচ্ছুৎদের দাওয়াত দেব আমাদের বাগানে এসে আম খাবার জন্য। আমাদের নদীতে স্নান করতে এবং আমাদের কুপের ঠান্ডা সুস্বাদু পানি পান করতে। তাদের সবচেয়ে বড় দুঃখ ছিল আমাদের মন্দিরে এসে আমাদের দেবতাদের পূজা করতে পারত না।
আমি এখন ঘােষণা করে দেব মুসলমান এদেশে এরূপ প্রার্থনা মন্দির স্থাপন করবার জন্য এসেছে, যেখানে যে কোন অস্পৃশ্য ব্রাহ্মণের সঙ্গে, এমন কি তার পুরােভাগেও দাঁড়াতে পারে।
নাহীদ বলল- আল্লাহ তােমার আশা পূর্ণ করুন।
॥ পাঁচ ॥
সমস্ত বাহিনীর জন্য কিল্লা অপরিসর প্রতিপন্ন হওয়ায় মুহম্মদ ইব্ন কাসিম অর্ধেক সৈন্যের জন্য বাইরে তাবু খাটিয়ে দিলেন। নিজ বাহিনীর আহতদের মত তিনি ভীম সিংহের সৈন্যের আহতদেরকেও তাঁবুতে আশ্রয় দিলেন। স্বীয় বাহিনীর চিকিৎসক এবং অস্ত্রোপচারকদের আদেশ দিলেন। তারা যেন আহত শত্রু- সৈন্যের চিকিৎসায় শৈথল্য
করেন। মুহম্মদ ইবন কাসিম নিজেও চিকিৎসা শাস্ত্রে এবং অস্ত্রোপচারে যথেষ্ট নৈপূণ্যের অধিকারী ছিলেন। প্রভাত ও সন্ধ্যায় তিনি আহতদের তাঁবুতে গিয়ে তাদের খোজ খবর নিতেন। পৃথকভাবে প্রত্যেকের অবস্থা জিজ্ঞেস করতেন, তাদের সাস্তৃতা দিতেন। আহত সৈন্যের সাথে কথা বলার জন্য তিনি সা’আদকে দোভাষী হিসেবে নিয়ে যেতেন। কাউকে ক্লান্ত ও বিষন্ন দেখলে বলতেন- তুমি শীঘ্রই ভাল হয়ে যাবে। মনে করাে না তােমাদের আমরা বন্দী করেছি। ভাল হয়ে যেখানে চাও তােমরা যেতে পারবে।
কৃতজ্ঞ নয়নে তাঁর দিকে চেয়ে তারা বলত- ভগবানের দোহাই, আমাদের আর লজ্জা দেবেন না। আপনাকে এত কষ্ট দেয়ার আমাদের কোন অধিকার নেই। আপনি বিশ্রাম
তিনি জবাব দিতেন- এটা আমার কর্তব্য।
সর্বসহ
১৭
ভীম সিংহ সম্বন্ধে মুহম্মদ ই কাসিমের গভীর উৎসুক্য ছিল। তিনি নিজে দু’বেলা তার ক্ষত দেখতেন এবং নিজ হাতে ঔষধ লাগাতেন। নাসিরুদ্দীন এবং যুবায়র সর্ব প্রকারে তার চিত্তবিনােদন করতেন। ভীম সিংহ প্রথমে ভেবেছিলেন এ সদ্ব্যবহার তার সঙ্গীদের ফুসলিয়ে নেয়ার জন্য মুসলমানদের একটি চাল। কিন্তু তিন চার দিন পরেই তিনি অনুভব করলেন এটা লােক দেখানাে কৃত্রিম দয়া নয়। বরং মুহম্মদ ই কাসিম
এবং তাঁর সহযােগীদের স্বভাবই সাধারণ লােকের চেয়ে পৃথক।
তার নিজের ক্ষত বিশেষ গুরুতর ছিল না। তবে অধিকতর রক্তক্ষয় বশতঃ শরীর দুর্বল ছিল। মুহম্মদ ইবন কাসিমের চিকিৎসা এবং যুবায়র ও নাসিরুদ্দীনের সেবা ৩ষায় চতুর্থ দিনেই তিনি চলাফেরা করার শক্তি অর্জন করলেন।
পঞ্চম দিন এশার নামাযের পর মুহম্মদ ইবন কাসিম সা'আদকে সঙ্গে নিয়ে যথারীতি আহতদের তাঁবুতে ঘুরছিলেন। ভীম সিংহের তাঁবুতে এসে দেখেন তিনি বিছানায় শুয়ে স্বপ্নে বিড়বিড় করছেন, না না। আমাকে আবার তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে পাঠাবেন না। তিনি মানুষ নন, দেবতা। আপনি বন্দীদের ছেড়ে দিন। তিনি আপনার অপরাধ মাফ করে দেবেন। না, না। আমি যাব না। রাজার পাপের শাস্তি প্রজা কেন ভােগ করবে? আমি মৃত্যুকে ডরাই না। কিন্তু আমার প্রাণ বিজর্সন দিয়ে তুমি সমাগত বিপদ এড়াতে পারবে না।
অত্যাচারী! কাপুরুষ! হায় ভগবান ....
ভীম সিংহ শিউরে উঠে চোখ খুললেন এবং বিস্ময়ের সাথে সা'আদ ও মুহম্মদ ইন কাসিমের দিকে তাকাতে লাগলেন। মুহম্মদ ইব্ন কাসিম বললেন- মনে হচ্ছে তুমি এক ভয়ানক স্বপ্ন দেখছিলে।
ভীম সিংহ চিন্তায় পড়ে গেলেন। তাঁর কপালের স্বেদ বিন্দু প্রকাশ করছিল স্বপ্নের মধ্যে তিনি ভীষণ মানসিক সংঘাতে লিপ্ত ছিলেন।
মুহম্মদ ইবন কাসিম অগ্রসর হয়ে তাঁর নাড়ী পরীক্ষা করে বললেন- তােমার শরীর সম্পূর্ণ ভাল আছে। ক্ষতে কোন বেদনা নেই তাে?
বিষন্ন মান হেসে তিনি উত্তর দিলেন না। | মুহম্মদ ইবন কাসিম বললেন- আমার বাহিনী কাল রাতে এখান থেকে যাত্রা করবে। দুঃখের বিষয় কোন কারণ বশতঃ এখানে আমরা বেশী দিন থাকতে পারছি না। নচেৎ আমি আরাে কিছুদিন তােমার সেবা-শুশ্রুষা করতাম। যা হােক, আমি এখানে পাচশত সৈন্য রেখে যাচ্ছি। তারা তােমার যত্ন করবে। তােমার বাহিনীর আহত সৈন্যদের মধ্যে যারা সুস্থ হয়ে উঠেছে তারা আগামী কাল স্ব স্ব গৃহে ফিরে যাবার অনুমতি পাবে। তুমি যতদিন অশ্বারােহরণ করতে সক্ষম না হও, ততদিন এখানেই থাকো।
ভীম সিংহ বললেন- এর অর্থ আপনি সমস্ত বন্দীদের মুক্তি দেবেন?
১৮০
মুহম্মদ ইবন কাসিম
| মুহম্মদ ইবন কাসিম জবাব দিলেন- মানুষকে বন্দী করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। বরং তাদেরকে স্বেচ্ছাচারী শাসন হতে মুক্তি দিয়ে এমন এক শাসন ব্যবস্থার সাথে আমরা পরিচিত করাতে চাই, যার মূলনীতি মানুষের সাম্য। আমাদেরকে বিদেশী হানাদার মনে করে তােমার সৈন্যরা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসেছিল। তাদের জানা ছিল
আমাদের যুদ্ধ মাতৃভূমির নামে নয় বা জাতির নামে নয়। আমরা সিন্ধুর উপর আরব প্রতিপত্তি চাই না। আমরা ভূ-পৃষ্ঠের সমস্ত মানব জাতির কল্যাণের জন্য এক বিশ্বব্যাপী বিপ্লব চাই। এমন বিপ্লব, যা উৎপীড়িতদের শির উচ্চ রাখবার জন্য অত্যাচারীর অস্ত্র কেড়ে নেবে। আমাদের যুদ্ধ রাজা-মহারাজার যুদ্ধ নয়। বরং রাজার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের যুদ্ধ। আমাদের উদ্দেশ্য এ নয় যে, আমরা সিন্ধু-রাজের মুকুট নিয়ে নিজের মাথায় পরবাে। আমরা প্রমাণ করতে চাই মুকুট ও সিংহাসনের মালিক হয়ে নিজের আইন প্রবর্তন করার অধিকার কোন লােকেরই নেই। মুকুট ও সিংহাসন স্বার্থপর লােকের তৈরি প্রতিমা মাত্র। যে আইন এসব প্রতিমার মাহাত্ম্য চিরস্থায়ী করার জন্য তৈরী, তা চিরকাল মানব গােষ্ঠীকে দ্বিধা বিভক্ত করে রাখবে- অত্যাচারী এবং অত্যাচারিত, মজলুম। তােমরা এদেরকে রাজা ও প্রজা বলে থাক। সিন্ধুর রাজা আমাদের জাহাজ লুট করে আমাদের নারী ও শিশুদের বন্দী করেছে এ জন্যই যে সে মনে করে মুকুট ও সিংহাসনের মালিক হয়ে প্রত্যেক মানুষের উপর তার অত্যাচার করার অধিকার আছে। সে এখন আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, কারণ তার অত্যাচারের অস্ত্র হৃত হওয়ার আশংকা আছে। এসব সৈন্য আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসেছে এ জন্য যে, অত্যচারের সহায়তা করার প্রতিদান তারা পায়। মানুষ ভারবাহী পশুকে যেভাবে ব্যবহার করে, এ বেচারাদেরকে, সেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। স্বেচ্ছাচারী শাসনের দরুণ জীবিকা অর্জনের পথ সংকীর্ণ। তাই তারা এরূপ কাজ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে অত্যাচারের সহায়তা করতে গিয়ে এরা নিজেদের প্রাণ পর্যন্ত বিক্রয় করতে প্রস্তুত। যে বিপ্লবের বিরুদ্ধে এরা বাধা সৃষ্টি করছে,
তারা জানে না যে তাতেই তাদের কল্যাণ নিহিত আছে। আমাদের সম্বন্ধে এদেরকে ভয়। দেখানাে হয়েছে। এখন বিজয়ের পরে না আমি অত্যাচারিত হতে চাই, না এদেরকে অত্যাচারিত করতে চাই। | ভীম সিংহ বললেন- আপনি কি বিশ্বাস করেন এরা ফিরে গিয়ে সৈন্য বাহিনীতে আবার যােগ দেবেন না?
মুহম্মদ ইবন কাসিম জবাব দিলেন- ফিরে গিয়ে এদের কার্যপন্থা কি হবে তা আমি নিশ্চয় করে বলতে পারি না। কিন্তু এদের পক্ষ থেকে আমার কোন ভয় নেই। আমি আল্লাহর অনুগ্রহের উপর নির্ভর করছি। উচ্চ আদর্শের জন্য যারা যুদ্ধ করে, তাদের শক্তি বাড়তেই থাকে, কমে না। এর পূর্বে কয়েক জাতিই, স্ব স্ব রাজার পক্ষে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। কিন্তু এখন তারা অনুভব করেছে যে, আমাদের শাসন প্রণালী উন্নত ধরণের, তখন তারা আমাদের সাথে যুক্ত হয়েছে। তােমার সৈন্যদের মধ্যে
সর্ব সহায়
১৮১
যাদেরকে আল্লাহ ভাল-মন্দ বিচারশক্তি দিয়েছেন, তারা ফিরে গিয়ে নিশ্চয় অত্যাচারের তরণীকে নিমজ্জন হতে রক্ষা করতে চেষ্টা করবে না। যারা দ্বিতীয়বার আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে সাহস করবে, আরাে দু'একটি যুদ্ধের পরেই তাদের বিশ্বাস হবে আমাদের তলােয়ার ভােলা হবার নয়।
ভীম সিংহ বললেন- আপনি মুকুট ও সিংহাসনের শত্রু। মানুষের উপর মানুষের প্রভুত্বে বিশ্বাসী নন। কিন্তু শাসন ব্যবস্থা না থাকলে দেশে শান্তি থাকবে কি করে? | মুহম্মদ ইবন কাসিম জবাব দিলেন- স্বেচ্ছাচারের দন্ড অত্যাচারিতের কণ্ঠ চেপে রাখলে তার অর্থ এ নয় যে, দেশে শান্তি বিরাজিত। আমি আগেই বলেছি আমরা দুনিয়ার মানুষের গড়া আইন চাই না। আল্লাহর আইন প্রবর্তন করতে চাই।
ভীম সিংহ বললেন- আইন যারই হােক, তাকে প্রতিষ্ঠিত করবে মানুষেই। তাদেরকে রাজা বাদশা না বললেও তারা শাসনকর্তা নিশ্চয় হবেন। পৃথিবীতে যতদিন আইন ভংগকারী লােক থাকবে, ততদিন শক্তির দন্ড ব্যতীত আইন রক্ষা সম্ভব হবে না। | মুহম্মদ ইবন কাসিম বললেন- এ কথা সত্য। কিন্তু এ আইনের প্রথম আবশ্যকতা এই যে, প্রতিষ্ঠাতাগণ সদাচারী ব্যক্তি হবেন। আমরা যতদিন সৎ থাকব, ততদিন আল্লাহর আইন রক্ষার ভার আমাদের উপর থাকবে। কাল যদি তােমার জাতি সদাচারী হয়, তাহলে সে আইন রক্ষার দায়িত্ব তারাই গ্রহণ করবে। কিন্তু শক্তির দন্ড তার নিজস্ব
র্যাদা রক্ষার জন্য নয়, বরং আইন রক্ষার জন্য মাত্র ব্যবহারের অনুমতি থাকবে। মুসলমানের হাকিম এবং অন্য জাতির রাজার মধ্যে পার্থক্য এই যে, তিনি শক্তির দণ্ড অত্যচারীর বিরুদ্ধে অত্যাচারিতের সাহায্যে ব্যবহার করেন; এবং রাজারা তা শুধু নিজেদের প্রতিপত্তি স্থায়ী রাখার জন্য ব্যাবহার করেন।
কিছুক্ষণ ভেবে ভীম সিংহ জিজ্ঞেস করলেন- তবে আমাকেও এসব লােকের সাথে ফিরে যাবার অনুমতি দেওয়া হবে?
আমি পূর্বেই বােধ হয় বলেছি যে সুস্থ হওয়ার পর তুমি যখনই যেতে চাইবে যেতে পারবে।
ভীম সিংহ বললেন- আমি এখন ভ্রমণ করতে পারব। যদি আপনি অনুমতি দেন, তবে আমি কালই যাত্রা করব।
এখনাে তােমার ক্ষত সম্পূর্ণ শুকায়নি। তবুও যদি তুমি কাল যেতে চাও আমি বাধা দেব না।
ভীম সিংহ কিছুক্ষণ ভেবে বললেন- আপনি বােধ হয় জানেন না, আমি সিন্ধুর সেনাপতির পুত্র। ফিরে গিয়ে আমার সৈন্য বাহিনীতে যােগদান আপনার পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে। তাই আমি ফিরে গিয়ে আবার সৈন্য বাহিনীতে যােগ দেব না, আমাকে ছাড়বার আগে যদি এরূপ প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিতে চান, তবে সে শর্তে আমি যেতে রাযী নই।
মুহম্মদ ইবন কাসিম
আমি তােমাকে এরূপ প্রতিজ্ঞা করতে বলিনি। হাঁ, তােমাকে আমি শুধু একটি কথা বলব- তুমি রাজা দাহিকে এ খবরটি পৌছিয়ে দেবে যে, আরব আর বেশী দূরে নয়। যদি আরব বন্দীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করা হয়, তবে তার পক্ষে ভাল হবে না। | ভীম সিংহ উত্তর দিলেন- আমি প্রতিজ্ঞা করছি এবং আমি আশা করছি আমাদের আহত সৈন্যদের সাথে আপনার ব্যবহারের কথা জানতে পারলে তিনিও নিশ্চয় নরম হবেন। | আমি উপকারের প্রতিদান চাই না। আমি শুধু চাই তুমি তার চোখ থেকে অহংকারের পর্দা সরিয়ে দাও এবং তাকে বলে দাও সে এক আগ্নেগিরি পার্শ্বে দন্ডায়মান রয়েছে। হাঁ, আমাদের এ বাক্যালাপের মধ্যে হয়ত আমি কোন কড়া কথা বলে ফেলেছি। যদি আমার কোন কথায় তােমার মনে আঘাত লেগে থাকে, তবে একজন মানুষ হিসেবে তুমি আমাকে ক্ষমা কর।
মুহম্মদ ইবন কাসিম একথা বলে তাঁবুর বাইরে চলে গেলেন। ভীম সিংহ বারবার মনে মনে বলতে লাগলেন- তুমি মানুষ নও, দেবতা।
শুক তারা ॥ এক ॥ | কয়েকদিন পরে মুহম্মদ ইবন কাসিমের বাহিনী দেবল থেকে কয়েক ক্রোশ দূরে তাবু ফেলেছিল। রাত্রির তৃতীয় যামে উঠে মুহম্মদ ইবন কাসিম তাহাজ্জুদের নামায পড়লেন এবং যুবায়রকে সাথে নিয়ে শিবিরের চতুর্দিকে একবার ঘুরে এলেন। সমস্ত দিনের ক্লান্ত সৈন্য গভীর ন্দ্রিায় মগ্ন ছিল। প্রহরীরা নিজ নিজ স্থানে সতর্ক হয়ে দন্ডায়মান ছিল। সমুদ্ৰাগত আর্দ্র বায়ুতে কয়েক ঘন্টা ঘুমিয়ে মুহম্মদ ইবন কাসিম স্বীয় অঙ্গ-প্রত্যংগে শৈথিল্য অনুভব করছিলেন। তিনি যুবায়রকে বললেন- আসুন, আমরা এই টিলার উপরে উঠি। দেখি, কে আগে চড়তে পারে। হুশিয়ার, এক-দুই-তিন।
উভয়ে দৌড়ে টিলার শিখরের কাছে পৌছলেন। মুহম্মদ ইবন কাসিম যুবায়রের কয়েক পদ আগে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু উপর থেকে প্রহরী হাঁক দিল- থাম, কে?
মুহম্মদ ইবন কাসিম থেমে জবাব দিলেন- মুহম্মদ ইব্ন কাসিম।
প্রহরীর কণ্ঠস্বর চিনতে পেরে বলল- প্রধান সেনাপতি, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমরা কর্তব্যের প্রতি উদাসীন নই। ততক্ষণে যুবায়র মুহম্মদ ইবন কাসিমের সঙ্গে মিলিত হলেন। মুহম্মদ ইবন কাসিম সমুদ্রের নির্মল হাওয়ায় কয়েকটি গভীর শ্বাস নিলেন এবং চারদিকে দৃষ্টিপাত করলেন। কৃষ্ণা দ্বিতীয়বার চন্দ্রলােকে নক্ষত্রগুলাে নিষ্প্রভ হয়ে গিয়েছিল। উড়ন্ত জোনাকীর আলাে ভােরের প্রদীপের মত মনে হচ্ছিল। চন্দ্রালােকে নীল সমুদ্রের জলরাশি উজ্জ্বল দর্পণের ন্যায় চৰ্চ করছিল। পূর্বাকাশে শুকতারা দেখা দিল। মুহম্মদ ইবন কাসিম বললেন- যুবায়র দেখুন, এ নক্ষত্রটি দেখছেন, এর গুরুত্ব কত বেশী অথচ এর জীবন কত ক্ষণস্থায়ী। প্রতি উষায় পৃথিবীকে সূর্যের আগমন বার্তা দিয়েই সে অপসৃত হয়। অন্য সূর্যের মুখ থেকে অন্ধকারে অবগুণ্ঠন সরিয়ে নিজের মুখ ঢেকে নেয়। তা সত্ত্বেও এ নক্ষত্রটির যে গুরুত্ব রয়েছে, অন্য তারকার তা নেই। অন্যান্য তারকার মত এও যদি সারা রাত্রি চমকাতাে, তা হলে আমাদের চোখে এর মর্যাদা এত উচ্চ হতাে না। প্রতি রাতে আকাশে আমরা কোটি কোটি তারকা দেখতে পাই। কিন্তু এ শুকতারাটি আমাদের মনযােগ আকর্ষণ করে সবচেয়ে বেশী। সাধারণ নক্ষত্রের জীবন-মৃত্যু আমাদের পক্ষে বিশেষ কোন অর্থ জ্ঞাপক নয়। ঠিক সে সব লােকের মত, যারা কয়েক বছর দুনিয়ায় উদ্দেশ্যহীন জীবন যাপন করে মরে যায়, যারা শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত জীবনকে আঁকড়ে থাকতে চায় অথচ পৃথিবীকে স্বীয় জীবন-মৃত্যুর উদ্দেশ্য বুঝতে অক্ষম। যুবায়র, এ নক্ষত্রটির ক্ষণিক জীবনের প্রতি হিংসা হয়। এ জীবন যেমনি ক্ষণিক, তার উদ্দেশ্য তেমনি উচ্চ। সে যেন দুনিয়াকে ডেকে
১৮
মুহম্মদ ইবন কাসিম
বলছে, আমার ক্ষণিক জীবনের জন্য দুঃখ করাে না। বিধাতা আমাকে সূর্যের আগমনী ঘােষণা করতেই পাঠিয়েছেন। আমার কর্তব্য সম্পন্ন করে আমি যাচ্ছি। হায়, আমি যদি শুকতারার মতই এদেশে ইসলামের আগমনী ঘােষণা করতে পারতাম।
যুবায়র মুহম্মদ ইবন কাসিমের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। তাঁর চেহারায় শিশুর সারল্য, চন্দ্রের সৌন্দর্য, সূর্যের গৌরব এবং শুকতারার সুষমা একত্রিত হয়ে এক অপূর্ব শােভা সৃষ্টি করেছিল।
কয়েক গজ দূরে এক প্রহরী হাক দিল- থামাে, কে? নীচের দিক থেকে জবাব এল- আমি সা'আদ।
মুহম্মদ ইব্ন কাসিম কয়েক পদ অগ্রসর হয়ে সা'আদকে সিন্ধী পােশাকে টিলায় আরােহণ করতে দেখে প্রহরীকে ডেকে বললেন- ওকে আমার কাছে আসতে দাও।
সা'আদ টিলায় চড়ে শিবিরের দিকে নামতে চাইল। কিন্তু প্রহরী তার পথরােধ করল। মুহম্মদ ইবন কাসিমের দিকে দেখিয়ে বলল- আগে ওদিকে যাও।
সাআদ বেপরােয়াভাবে জবাব দিল- না, আমি প্রধান সেনাপতির সাথে দেখা করার আগে অন্য কারাে সাথে কথা বলতে পারব না।
মুহম্মদ ইবন কাসিম ডেকে বললেন- সাআদ, আমি এখানে। সাআদ চম্কে মুহম্মদ ইব্ন কাসিমের দিকে তাকাল এবং অগ্রসর হল। মুহম্মদ ইবন কাসিম বললেন- বল, কি খবর এনেছ? সাআদ জবাব দিল- দেবল-রক্ষী সৈন্যের সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশ হাজার। আমার মনে হয়, সিন্ধুর অন্যান্য শহর থেকে আরাে সাহায্যের প্রতীক্ষায় তারা কিল্লায় থেকে যুদ্ধ করতে চেষ্টা করবে।
মুহম্মদ ইবন কাসিম বললেন- আমি যদি এখানে আরাে দু'তিন দিন থাকি, তাহলে শহর থেকে বের হয়ে আমাদের উপর তাদের আক্রমণ করার সম্ভাবনা আছে কি?
সা'আদ উত্তর দিল- এরূপ কোন সংকেত পাওয়া যাচ্ছে না। লাসূবেলার পার্বত্য দুর্গ জয় হওয়ার পর অসমতল ভূমিতে যুদ্ধ করা শত্রুপক্ষ সুবিধাজনক মনে করছে না।
মুহম্মদ ইব্ন কাসিম বললেন- তাহলে অবিলম্বেই আমাদের অগ্রসর হওয়া উচিত।
॥ দুই ॥
পাঁচদিন হয় দেবল অবরােধ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে মুহম্মদ ইব্ন কাসিমের সৈন্য ‘বাবা’র সাহায্যে কয়েকবার শহরের প্রাচীরে উঠবার চেষ্টা করেছে কিন্তু সফল হয়নি। কাঠের দাবা প্রাচীরের কাছে পৌছতেই রাজসৈন্য তার উপর জ্বলন্ত তেল ঢেলে দিত। কাজেই অগ্নিশিখার সম্মুখে মুসলিম সৈন্য আর অগ্রসর হতে পারে না। মুহম্মদ ইন কাসিম সঙ্গে একটি বৃহৎ (মিজানীক) (ক্ষেপণ যন্ত্র) এনেছিলেন। সেটা টানতে পাঁচশত লােক লাগত। তার নাম বিয়ের কনে (আরূস)। নামটি বেশ প্রসিদ্ধি লাভ করে। পার্বত্য পথের অসমতার দরুণ বিয়ের কনেকে সমুদ্র পথে দেবলের কাছে
ক তারা
১৮৫
এনে তীরে নামানাে হয়। অবরােধের পঞ্চম দিন মুহম্মদ ইব্ন কাসিমের সৈন্যরা তাকে ঠেলে নগর-প্রকারের সম্মুখে উপস্থিত করে। এর আগে কয়েকটি ছােট ছােট মিজানীক’ এর আক্রমণে প্রাচীরের কয়েক স্থান দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। নগররক্ষীদল ‘বিয়ের কনের অসাধারণ প্রকান্ড অবয়ব ও দৃঢ়তা উপলব্ধি করে ভীত হয়ে গেল। সন্ধ্যার পূর্বেই বিয়ের কনের সাহায্যে কয়েকটি ভারী পাথর শহরে নিক্ষিপ্ত হল। রাজা অনুভব করলেন দেবলের শক্ত প্রাচীরও এ ভয়ংকর যন্ত্রের সামনে বেশীদিন টিকবে না। | ষষ্ঠ দিন প্রভাত হতে না হতেই মুহম্মদ ইবন কাসিম ‘বিয়ের কনের সাহায্যে শহরের উপর প্রস্তর নিক্ষেপ শুরু করলেন। শহরের মাঝখানে একটি উচ্চ গুম্বজের উপর লাল নিশান উড়ছিল। মন্দির চূড়ার উচ্চতার দরুণ এ নিশানটি অন্যান্য নিশানের তুলনায় সর্বোচ্চ স্থাপিত ছিল। মুহম্মদ ইব্ন কাসিম এ পতাকার গুরুত্ব অনুভব করলেন। কথিত আছে দেবলের শাসনকর্তা দ্বারা উৎপীড়িত এক ব্রাহ্মণ শহর থেকে পালিয়ে এসে মুহম্মদ ইন কাসিমকে জানিয়ে দেন উক্ত পতাকা পতিত না হওয়া পর্যন্ত শহরবাসীর মনােবল অক্ষুন্ন থাকবে।
| ‘
মিজানীক ব্যবহারের মুহম্মদ ইবন কাসিম অসাধারণ নৈপুণ্যের অধিকারী ছিলেন। তিনি বিয়ের কনের গতিমুখ ঠিক করে সৈন্যদের প্রস্তর নিক্ষেপের হুকুম দিলেন। ভারী প্রস্তুরাঘাতে মন্দির চূড়ান্ত চূর্ণ হতে এবং সঙ্গে সঙ্গে লাল পতাকা পতিত হতে লাগল।
মন্দির-চূড়া ধ্বংস হয়ে রক্তনিশান পতিত হওয়ায় রাজার কুসংস্কারাচ্ছন্ন সৈন্যদের সাহস নষ্ট হয়ে গেল। তা সত্ত্বেও তারা সন্ধ্যা পর্যন্ত মুসমিল বাহিনীকে দুর্গের কাছে ভিড়তে দিল না। গােধুলির অন্ধকারে প্রাচীরের তীরন্দাদের রক্ষণকার্য শিথিল হয়ে গেল। মুহম্মদ ইবন কাসিম এক চূড়ান্ত আক্রমণের আদেশ দিলেন। তাঁর সৈন্যগণ ‘আল্লাহু আকবর’ রবে ‘দাবা', রুজু সিঁড়ি এর ফাদের সাহায্যে দুর্গ-প্রাকারে আরােহণ
করতে লাগল।
রাজ-সৈন্য রাত তৃতীয় প্রহর পর্যন্ত বাধা দিল। কিন্তু ইতিমধ্যে মুসলমানদের শত শত সৈন্য দুর্গ-প্রাকারের উপর উঠে পড়েছিল। মনজানীক' এর প্রস্তর নিক্ষেপের দরুণ দুর্গ-প্রাচীর এক স্থানে রাজা দাহির অবস্থা সংগীন দেখে শহরের পূর্ব দরজা খুলে দিলেন। হাতীর সাহায্যে রাস্তা পরিষ্কার করে সৈন্যরা বাইরে বের হয়ে গেল। মুসলমান সৈন্য নগর-প্রাচীরের চারদিকে বিভক্ত থাকায় দরজায় বিশেষ কার্যকরী বাধা দিতে পারল না। পূর্ব ফটকের কাছে হাতী তাদের অবরােধ ভেঙ্গে বের হয়ে গেল এবং হাতীর পিছনে রাজা ত্রিশ হাজার সৈন্য যুদ্ধ করতে করতে বের হয়ে গেল। মুহম্মদ ইবন কাসিমের সৈন্য চারদিক থেকে ঘিরে এসে দরজায় আবার প্রচন্ড আক্রমণ করে দিল এবং বাকী সৈন্যের বহির্গমনের পথে প্রবল বাধা সৃষ্টি করল। রাজভক্তির চেয়ে তাদের মনে স্ব স্ব পরিণামের ভয় ছিল বেশী। তারা রাস্তা পরিষ্কার করার জন্য কয়েকবার প্রবল আক্রমণ করল। কিন্তু মুসলমানগণ মুহূর্তের মধ্যেই দরজার সামনে মৃতদেহের স্তুপ গড়ে তুলল। রাজসৈন্য সাহস হারিয়ে পিছনে সরতে লাগল। মুসলমান সৈন্য এক প্রবল স্রোতের মত
১৮৬
মুহম্মদ ইব্ন কাসিম
শহরের ভেতরে প্রবেশ করল।
ইতিমধ্যে অন্য পথেও কয়েকটি ছােট ছােট দল নগর-প্রাচীরের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল।
রাজার অবশিষ্ট সৈন্য চতুর্দিক থেকে আল্লাহু আকবর ধ্বনি শুনে আত্মসমর্পণ করল।
॥ তিন ॥ | মুহম্মদ ইব্ন কাসিম স্বীয় সৈন্যসহ দেবলের শাসনকর্তার প্রাসাদে ফজরের নামায পড়লেন। সূর্যোদয়ের সময় দেবলের ভীত নগরবাসীগণ ছাদের উপর দাঁড়িয়ে বিজয়ী বাহিনীর সতের বছর বয়স্ক সেনাপতির শােভাযাত্রা দেখছিল। বেলা দুর্গ বিজয়ের পর মুহম্মদ ইবন কাসিম যে সব বন্দীকে মুক্তি দিয়েছিলেন এবং যে সব আহতদের সেবা শুশ্রুষা করেছিলেন তারা জনাধারণকে ভারতে এক নতুন দেবতার আগমনী সংবাদ পূর্বেই জ্ঞাপন করেছিল। তার বয়সের অল্পতা, বীরত্ব এবং দয়ামায়া সম্বন্ধে এবং সব কাহিনী প্রচারিত হয়েছিল স্বেচ্ছাচারী শাসনে উৎপীড়িত জনসাধারণ যার সত্যতা গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিল না। গত কয়েক দিন রাজসৈন্য দেশবাসীকে যথেষ্ট উৎপীড়ন করেছে। রাজসৈন্য দেবলে পৌছবার পর থেকে তারা আপন ঘরে পরবাসী হয়ে পড়েছিল। সৈন্যরা রাত্রে মত্তাবস্থায় লােকের ঘরে প্রবেশ করে লুটপাট ও ব্যভিচার চালিয়ে যেত। প্রভাতে লজ্জা-সংকোচে দেবীরা ছিন্ন বস্ত্র ও বিস্ত কেশ নিয়ে বাজারে ভ্রাম্যমান রাজকর্মচারীদের কাছে উৎপীড়নের করুণ কাহিনী বর্ণনা করত। কিন্তু উত্তরে লজ্জাজনক এক উচ্চ হাসি ব্যতীত অন্য প্রতিকার তারা পেত না।
স্বজাতীয় সৈন্যের এ ব্যবহার দেখার পর দেবলবাসীগণ মুহম্মদ ইবন কাসিমের দয়া ও ক্ষমা সম্বন্ধে বহু কাহিনী শােনা সত্ত্বেও বিজয়ী সৈন্যের কাছে সদ্ব্যবহার আশা করতে ভরসা পাচ্ছিল না। কিন্তু মুহম্মদ ইবন কাসিমের সৈন্য যখন নিজেদের প্রধান সেনাপতির মতই সংযত নত দৃষ্টি নিয়ে দেবলের একটি বাজার অতিক্রম করল তখন নগরবাসীর সন্দেহ ক্রমে ক্রমে দূর হতে লাগল। তখন পুরুষদের সাথে নারীরাও মিছিল দেখার জন্য ছাদে উঠে ভিড় করে দাঁড়াল। শহর পরিক্রম করে মুহম্মদ ইব্ন কাসিম যখন পুনরায় প্রাসাদের কাছে এসে পৌছলেন, এক অভিন্ন যৌবনা বালিকা ছুটে এসে তার ঘােড়র লাগাম ধরে দাঁড়াল। নিজের ঠোট কামড়িয়ে ধরে মিনতিপূর্ণ দৃষ্টিতে সে মুহম্মদ ইবন কাসিমের দিকে তাকাতে লাগল। তার করবী বিস্ত, কমনীয় চেহারায় নখের আঁচড় এবং দুঃখ ও ক্রোধে চক্ষু রক্তবর্ণ ছিল। মুহম্মদ ইবুন কাসিমের চোখে মনে হল যেন একটি কমনীয় গােলাপ ফুলকে কোন নির্দয় হস্ত রগড়ে পিষে দিয়েছে।
তিনি দোভাষীর সাহায্যে তাকে বললেন- মহাশয়া, এ যদি আমার কোন সৈনিকের কাজ হয় তাহলে আপনার চোখের সামনেই আমি তাকে কতল করে ফেলব।
বালিকা মাথা নেড়ে অস্বীকার করল। তার ওষ্ঠ কম্পিত এবং চোখ থেকে অশ্রুধারা
গুক তারা
১৮৭
ফেটে পড়ছিল।
এক সম্ভ্রান্ত বৃদ্ধ অগ্রসর হয়ে করফেড়ে বললাে- অন্নদাতা, যে সব বালিকা বর্বর রাজ-সৈন্যের দ্বারা ধর্ষিতা হয়েছে এ তাদেরই একজন। আপনার কাছে সুবিচার প্রার্থনা করতে এসেছে।
উক্ত বৃদ্ধের কথা তরজমা করতে গিয়ে নাসিরুদ্দীন মুহম্মদ ইবন কাসিমকে জানালেন যে, বৃদ্ধটি দেবলের পুরােহিত। | মুহম্মদ ইবন কাসিম জবাব দিলেন- আপনি আমার সামনে করজোড়ে দাঁড়াবেন না। এ বালিকার প্রতি যে অত্যাচার করা হয়েছে তার প্রতিকার করা হবে আমার প্রথম কর্তব্য। রাজার বারাে হাজার সৈন্য আমাদের হাতে বন্দী হয়েছে। আপনি একে তাদের কাছে নিয়ে যান। তাদের কেউ অপরাধী হলে তাকে আমি আপনাদের হাতে সমর্পণ করব। নইলে এদেশের শেষ সীমা পর্যন্ত পশ্চাদ্ধাবন করে অপরাধীকে ধরে আনব।
বালিকা বলল দেবলের শাসনকর্তাই আমার উৎপীড়ক। পরশুদিন সে আমার পিতাকে বন্দী করে এবং আমাকে ...। এ পর্যন্ত বলে তার কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে যায়। নয়ন হতে আবার অশ্রু উথলে ওঠে। মুহম্মদ ইব্ন কাসিম তার এক সেনাপতিকে ডেকে বললেন, আমি দেবলের সমস্ত বন্দীদের মুক্তি দিচ্ছি। তুমি বন্দীশালার দরজা খুলে দাও।
॥ চার ॥
পরদিন দেবলের বৃহত্তম মন্দিরের পুরােহিত পূজারীদের কাছে প্রচার করছিল এক তরুণ আরবের রূপ ধরে ভগবানের নব অবতারের আবির্ভাব হয়েছে। দেবলের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাস্কর দেবলের ত্রাণকর্তার প্রতি ভক্তি ও প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নগরের শ্রেষ্ঠ মন্দিরের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য উক্ত তরুণ সেনাপতি প্রস্তরমূর্তি খােদাইয়ের কাজ আরম্ভ করেছিল। যুদ্ধে নিহতদের উত্তরাধিকারীদের জন্য মুহম্মদ ইব্ন কাসিম যােগ্য ভাতা মনযুর করেন। নাসিরুদ্দীনকে তিনি দেবলের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। যে মন্দিরটি মিজানীক’ দ্বারা প্রস্তরঘাতে চূর্ণ হয়েছিল তার মেরামতের জন্য মােটা টাকা প্রদান করেন।
| দশদিন পরে তিনি নীরূনের দিকে যাত্রা করেন। ইতিমধ্যে তাঁর সদ্ব্যবহারে দেবলবাসী মুগ্ধ হয়ে যায়। যুদ্ধের অসি-ক্ষতও শুকিয়ে আসছিল। তিনি অধিকাংশ নগরবাসীর হৃদয় জয় করতে সম্পূর্ণ সক্ষম হন। দেবল থেকে বিদায় নেয়ার সময় হাজার হাজার নরনারী ও বৃদ্ধ কৃতজ্ঞতার অশ্রুজলে তাকে বিদায় দেয়। দেবলের পাঁচ হাজার সৈন্য তার সৈন্য বাহিনীতে ইতিমধ্যেই যোগ দিয়েছিল। | বিদায়ের পূর্বে মুহম্মদ ইবন কাসিম যুবায়র, খালিদ ও যুহরাকে নাসিরুদ্দীনের সাথে দেবলে অবস্থান করার অনুমতি প্রদান করেন। কিন্তু শহরের প্রাসাদে বিলাসী জীবন যাপনের পরিবর্তে রণক্ষেত্রে কষ্টের জীবনকেই তারা বেশী পছন্দ করেন। তবুও মুহম্মদ ইবন কাসিমের সাথে একমত হয়ে যুবায়র ও খালিদ, নাহীদ ও যুহরাকে দেবলে রেখে গেলেন।
ESTÁS LEYENDO
মুহাম্মদ বিন কাশিম
Ficción históricaলেখকঃ নসীম হিজাজী সার সংক্ষেপঃ ৭১২ শতাব্দী৷ লংকা রাজ কর্তৃক বাগদাদ খলিফার নিকট প্রেরিত উপঢৌকন লুন্ঠন করল দেবল রাজের জলদস্যু বাহিনী৷ বন্দী হলেন এক আরব তরুণী, ইতিহাসে তার নাম এসেছে নাহিদ নামে৷ বন্দি অবস্থায় লিখলেন এক অবিস্মরণীয় চিঠি যা বদলে দিল ঐ অঞ্চ...