ভালোবাসার অন্য গল্প

168 3 0
                                    

এক

ফাল্গুনের শেষ বিকেলের রোদেলা জোছনায় ছাদটা ভেসে গেলে এমন কমলারঙা সমুদ্রে সাঁতার কাটতে মেয়েটার বেশ লাগে। দুটো হাত পাখনার মতো মেলে দিয়ে অমন গলে পরা সোনালি আভায় স্নান করে রোজ। এক ডুবসাঁতারে পার হয়ে যেতে চায়  মহাসাগরীয় দূরত্ব।
সাততলা ফ্ল্যাটবাড়িটার ছাদ থেকে মেয়েটা নীচের রাস্তাটায় অবিরাম গাড়ি চলাচল দেখে, মানুষ দেখে, ব্যস্ততা দেখে। এই সময়টুকু ওর ভারী প্রিয়, একান্ত নিজস্ব সময়। এই সময়টা নিয়ম করে মেয়েটা কোনো একজনের কথা ভাবে।

তখন অন্য কোনো টাইমজোনে কেউ কি মেয়েটার কথাই ভাবে?

বুকের মধ্যে সমস্ত রূপকথাদের ছুঁমন্তরে চুপ করিয়ে দিয়ে অনেক দূরে চলে যেতে ইচ্ছে হয় মেয়েটার।
মেয়েটা এখনো বুঝে উঠতে পারে না, যুগ-যুগান্ত ধরে ঠিক কি আঁকড়ে ধরে বসে আছে। অথচ ওকে কেউ অবুঝ বলতে পারবে না।

মেয়েটা জানে না এখনো ভূমধ্যসাগরের বেলাভূমি ছুঁয়ে ছুঁয়ে কোনো ছেলে একটা নাম না জানা শহরের মেয়ের জন্য জলপাই পাতা জমায় কিনা!
জানে না পূর্ব উপকূল ছুঁয়ে অতলান্তিকের ঢেউ এসে কতবার ওর নাম মুছে দিয়ে গেছে! তবুও ওর আদিগন্ত প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে অ্যালবাট্রস হতে ইচ্ছে হয় কখনো কখনো।

মেয়েটা কোনো পরিযায়ী পাখি নয়। দিনশেষে রোজ ও শুধু ওই ঘরটাতেই ফিরতে চায়। হোক না সেটা পুরোনো একটা শহরের পুরনো একটা ঘরের দেওয়াল, সাড়ে সাত বছর রঙ পড়েনি তাতে। যে শহরে এখনো টাইমকলের জলে বালতি নিয়ে লাইন দেয় শৈশব। যেখানে দিন কেটে যায় ছোটো ছোটো অদ্ভুত মুগ্ধতায়। নতুন লাল বেনারসীর স্বপ্নটা তবু ভীষণ যত্নে তোলা থাকে আলমারির ছাদে। মেয়েটা জানে ওরকম ছাদের নীচে লাল-নীল-সবুজ কাগজের রাঙতা মোড়া ভালোবাসা থাকে। ভীষণ যত্নে তাদের নামে চিঠি পাঠায় রোজ বিকেলে-ওই ঘর আর ওই ছাদের খোঁজে।

একদিন ওই ছাদের নীচে একটা ভালোবাসার শহর গড়বে সমস্ত না-হওয়া প্রেমেরা, হয়তো মেয়েটা জানে।

দুই

রোজ বিকেলে কলেজ থেকে ফিরে গিটারটা নিয়ে ছাদে উঠে টুংটাং করা মহুলের অভ্যেস হয়ে গেছে। বছর দেড়েক হল শিলিগুড়ি থেকে কলকাতার কলেজে পড়তে এসেছে মহুল। কলকাতা শহরটাকে খুব একটা অপছন্দ হয়নি ওর। আসলে ও এই কয়েকদিনেই দেখতে পেয়ে গেছে এই ভীষণ সেজে থাকা শহরটার বুকের মধ্যে ঘুমিয়ে আছে একটা চূড়ান্ত অগোছালো কেউ-ঠিক মহুলের মতো।

আর ঠিক ওই লালচে চুলের মেয়েটার মতো। পশ্চিমের সাততলা ফ্ল্যাটটার ছাদে রোজ এই সময়ে  মহুল মেয়েটাকে দেখে। ওর পিচরঙা ত্বকে পিছলে যায় রাঙা রোদ, লালচে-বাদামী চুলগুলো ঢেউ তোলে শহুরে বাতাসে। আর মহুলের বুকেও-আরো একবার! রোজ।

মেয়েটার নাম মহুল জানে না। কি আশ্চর্য! জানার ইচ্ছেও হয়নি কখনো। মহুল তো এটাও জানে না মেয়েটা কখনো আদৌ ওকে খেয়াল করেছে কিনা।
ও শুধু দেখে রোজ রাতে একটা করে নতুন কবিতা জন্মায় ওই মেয়েটার জন্য।
ওই বিকেলগুলোকে ফ্রিজশটে স্থির করে জমিয়ে রাখে বুকের ভেতর। হালকা নীল কুর্তির ওপর সাদা সুতোর নকশা , চোখের ওপর চলে আসা অবাধ্য চুলগুলোকে ডানহাতে সরিয়ে দেওয়া- এই সমস্ত কিছু মহুলের ইচ্ছে হয় যুগযুগান্ত ধরে চোখে ধরে রাখতে।

তিন

পাশের ফ্ল্যাটটার ছাদে রোজ বিকেলেই ছেলেটাকে দেখে মেয়েটা। শুধু তাই নয়, ও এটাও জানে ছেলেটার নাম মহুল। শিলিগুড়ি থেকে কলকাতার একটা নামী কলেজে ফিজিক্স অনার্স পড়তে এসেছে। শুধু তাই নয় ছেলেটা খুব ভালো গানও করে। এসবই বাবা একদিন মাকে বলছিল, তখন মেয়েটা শুনেছে।
খেয়াল করে দেখেছে এরকম হারিয়ে হারিয়ে থাকা ছেলেটা কেমন লুকিয়ে লুকিয়ে ওকে দেখে! ছেলেটার চোখদুটো কেমন যেন-যেন কবি না হয়ে এ ছেলে যায় না। অথচ ছেলেটা নাকি ফিজিক্সের টপার। মেয়েটা জানে ছেলেটাকে ওর খুব একটা খারাপ লাগে না, কিন্তু এটাও বুঝতে পারে না রাংতা মোড়া ভালোবাসার খবর ছেলেটা কখনো শুনেছে কিনা। জানে কিনা অতলান্তিকের গভীরতা আর অ্যালবাট্রসের ডানার কথা।

অতঃপর

ছেলেটা এখন স্বপ্ন দেখে সমস্ত ফাল্গুনের পলাশের শেষে একবার কখনো চোখাচোখি হবে। সেইবার মুখ ফুটে কেউ প্রথম বলবে ''একটু দাঁড়ানো যাবে?"
দুজনেরই জানা নেই কি সম্বোধন ঠিক হবে, জানা নেই এরপর ঠিক কোন কথাটা বলতে হবে!
তারা শুধু জানে, আরো একটা ভালোবাসার গল্পকে ব্যর্থ করা যাবে না। কিছুতেই!

আর ততদিন অপেক্ষা করতে করতে মেয়েটা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ছেলেটা রোজ গিটারটা নিয়ে বসে আবার। মেয়েটার চোখের কোলের শিশিরবিন্দুটা মুক্তোর মতো টলটল করে।
ছেলেটা জানে মেয়েটার চোখে চোখ পড়লেই বুঝি চলে যেতে হবে ওকে। আর মেয়েটাও ভাবে ওরদিকে চোখ মেললেই আর নেই সে। তাই শেষ বিকেলের সূর্যও এসে থমকে দাঁড়ায় ওদের ছাদের কিনারায়।
আরো কিছুক্ষণ ভরে থাক ভালোবাসায়-এই ছাদ, এই ঘর,এই পৃথিবী আর সমস্ত গোধূলি।

অন্তহীনWhere stories live. Discover now