ম্যাজিক অপেক্ষা

230 6 0
                                    

রোজ বিকেলেই হেমন্ত চুঁইয়ে পড়ে ইরার ঘরে, নভেম্বরের ঘুমঘুমসন্ধ্যে, হিমভেজা পোশাকে ধীর পায়ে এসে চুপ করে দাঁড়ায় পর্দার আড়ালে। যে কাকটা জখম ডানা নিয়ে রোজই যায় খাবারের খোঁজে, তারও ফেরার সময় হয়।

এইসময়টা খুব ঘনঘন জল খাই আমি- গলার কাছে দলা পাকানো কান্নাগুলো জল দিয়ে গিলে নেওয়ার অভ্যাস আমার অনেকদিনের।

বোতলের জলটা তলানিতে এসে ঠেকলে আমি পাঁচ নম্বর পাঁচু মিত্র লেনের একটা কালচে বাদামি দরজা ঠেলে, পাকানো সিড়ি ধরে ঠিক আঠারো ধাপ উঠে থমকে যাই। তারপর ফিরে যাই ভেবেও শুকিয়ে কাঠ গলাটায় একটা অসম্ভব জ্বালা নিয়ে পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকি।

খোলা কেমিস্ট্রি খাতায় তখন রাইমার-টিম্যান খোঁজ করছেন স্যালিসাইলিক অ্যাসিডের।
ইরা মুখ তুলে হাসে, 'সবকটা পেরেছি পিলুদা।'
আর আমার বুকটা গর্বে আর একটু চওড়া হয়।
এগারো বাই তিনের বি, পাঁচু মিত্র লেনের বাসিন্দা পিলু সাহার আর ছাত্রীর এহেন সাফল্যে কিই বা হওয়ার থাকতে পারে!

আমি এম.এসসি ফার্ষ্ট ইয়ার, ইরা সবে টুয়েলভ!

সেই কবে একটা বোকা মেয়ের গল্প শুনেছিলাম- সে নাকি ঢেউয়ের মাথায় ফেনা হয়ে ঘুরে বেড়ায় আজও। এরকম রাজকুমারী পিলুদের জন্য ভুল করেও থাকে না কখ্খনো সে আমি জানি। তাই আমারই একটা বোকা রাজকুমার হতে ইচ্ছে হয় খুব।

যে ছেলেটা আজ আদিগন্ত সমুদ্রের বুকে নীল তিমি হয়ে ঘুরে বেড়ায়, সেও কি কোনোদিন বিষাদ রঙে ফুটেছিল!

তবু আমি পলেস্তরা খসা দেয়ালে, বিরাট কোহলির পোষ্টারে বেঁচে থাকি-বেঁচে থাকি শ্রীজাতর কবিতায়-বেঁচে থাকি কেমিস্ট্রি বইয়ের পাতায়।

আর বেঁচে থাকি গানে-
'তুমি তাকাওনি আমার দিকে, তাই ধূসর বিকেল।'

ইরা আমার দিকে তাকায়, তবু আমার আকাশ ধূসরই হয়ে থাকে চিরকাল।

আমার আর তুতলে উঠে বলা হয়না 'ভালোবাসি,' হলুদ রঙ  ইরার খুব অপছন্দ-আবার সবচেয়ে ভালো শার্টটাই হলুদ রঙা। এক কেমিস্ট্রি বইয়ের পাতা ছাড়া ইরাকে কত দূরদিগন্তের তারা লাগে।

এটা তো আসলে একটা কখনো না জমা গল্প, তাই আমি পরপর তিনটে সিগারেট খেয়ে ফেললেও ম্যাজিক হয় না কখনো।

তারপর আরেকটা বিকেল আসে, ইরা রনবীর কপূরের ওপর ক্রাশ খায়-আর পিলু সাহা, ইরাকে ভালোবেসে যায়। পিলু সাহার গলা শুকিয়ে যায়, খাবি খেতে খেতে কার্বনিল কেমিস্ট্রি শেষ করে কোনোমতে।
সে ক্লাসে টপ করে কিন্তু ইরার সামনে ফ্লপ করে।
তারপর দপ দপ করে জ্বলতে জ্বলতে নিভে যায়।

আমি তিনের বি এর পলেস্তরা খসা ঘরে ফিরে যাই- বাবা কারখানা থেকে ফেরে- দুটো পটলভাজা দিয়ে তিনটে রুটি গলঃধারন করে বাসনগুলো মেজে ফেলি, তারপর ছাদে গিয়ে দিনের চতুর্থ সিগারেট ধরাই-ফিরে এসে কেমিস্ট্রি বই খুলে বসি।
চারপাশ হঠাত্ কেমন ম্যাজিক ম্যাজিক হয়ে যেতে লাগে-গল্পের রসায়ন জমতে থাকে নিজের মতো।

আর আমার মতো পিলু সাহারা এখনো ভালোবেসে জন্মান্তরের অপেক্ষা করে যায়!

অন্তহীনNơi câu chuyện tồn tại. Hãy khám phá bây giờ