ছেলেটার নাম ছিল ঋতুরাজ-ছিপছিপে চেহারা,ভাসা-ভাসা দুটো চোখ, ভারী সুন্দর আবৃত্তি করত। ছেলেটিকে আমার মন্দ লাগত না-কিন্তু বহুবার নিষ্পলক তার দিকে তাকিয়ে থেকেও কথা হয়ে ওঠেনি। কোনো এক অক্টোবরের সন্ধ্যায় টিপটিপ বৃষ্টি মধ্যে দেখেছিলাম তাকে, একদল বন্ধুর মধ্যমণি হয়ে বসে-মন্ত্রমুগ্ধ আমি শুনছিলাম স্বরের ওঠানামা-
"বৃষ্টি নামল যখন আমি উঠোন-পানে একা,
দৌড়ে গিয়ে ভেবেছিলাম তোমার পাব দেখা।
হয়ত মেঘে-বৃষ্টিতে বা শিউলিগাছের তলে
আজানু কেশ ভিজিয়ে নিচ্ছো আকাশছেঁচা জলে।
কিন্তু তুমি নেই বাহিরে - অন্তরে মেঘ করে,
ভারি ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঝরে!"
এরকম কোনোকিছু আমি তার আগে কখনো শুনিনি-কোনোদিনও না।
" আমি তখন নবম শ্রেণী, আমি তখন শাড়ি"-কিন্তু আমাদের আলাপ আর হল না, দিতি বলল-"জানিস, ঋতুরাজ না শ্রী কে ভালোবাসে।" পয়লাবার ফাল্গুন এসে চলে গেল- ক্যালেন্ডারের পাতায় তখন ঘোর আশ্বিন।ঋতুরাজ দেব যেদিন শ্রীময়ী চক্রবর্তীকে কাঁপা হাতে লেখা চিঠিটা দিয়ে উঠতে পেরেছিল সেদিন ছিল মাধ্যমিকের রেজাল্ট। দু'জনই দুরন্ত রেজাল্টের পর-যদিও একজন সায়েন্স আরেকজন আর্টস নেবে ঠিক করেছিল-তবু ওদের প্রেমটা হতে পারত। শ্রী শুধু ভীষণ কঠিন গলায় বলেছিল-'তোকে আমি শুধু বন্ধু ভেবেছি', মে মাসের গরমেও শীত লেগেছিল ঋতুর। প্রথমবার বসন্তের প্রত্যাশায় কারো কাছে হাত পেতেছিল-দু'হাত ভর্তি প্রত্যাখ্যান ন নিয়ে, সেই সন্ধ্যায় উজাড় করেছিল নিজের কাছেই-
"আমিই কেবল বসে রইলাম ভিজে এক-সা কাপড় জামায়।"দাদার বন্ধু রেহানদার সাথে শ্রীর আলাপ ইদের ঠিক আগের সন্ধ্যায়। দাদার কাছে এসেছিল রেহানদা। জুনের বৃষ্টিভেজা দিন-রেহানদার কাছে ছাতা ছিল না। মা বলেছিল-'একটু বসে যাও রেহান'। ঘন নীল চোখের ছেলেটাকে দেখে সেই প্রথম ভালোলাগা এসেছিল শ্রীর জীবনে। বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর আর দৃপ্ত বাংলা উচ্চারণে সেই সন্ধ্যায় ভেসে যাচ্ছিল শ্রী।
কিন্তু বড্ড ক্ষণস্থায়ী স্বপ্নের মতো ছিল সেদিনের সবকিছু- পরদিন সন্ধ্যায় রেহানদাদের বাড়িতে দাদার নেমন্তন্ন ছিল আর ফার্ষ্ট ইয়ারের শ্রী বুঝেছিল ঠিক পাশটিতে থেকেও সব বসন্তকে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় না, আর তাই কিছু কিছু বসন্তকে আষাঢ়ের কাছে ছেড়ে ফিরে আসাই ভালো।ফার্ষ্ট ইয়ারের গোল্ড মেডেলিস্ট আর মেডিক্যাল কলেজে ব্যান্ডের লিড গিটারিস্ট রেহান উদ্দিন কেন মাঝে মাঝেই উদাস হয়ে যেত সেটা ওর বন্ধুরাও হাজার চেষ্টায় ধরে উঠতে পারত না। হয়তো অন্তর্মুখী ছেলের খেয়াল কিংবা মাত্র একবছর বয়সে মাকে হারানোর কষ্ট ধরে নিয়ে কেউ বিশেষ ভাবতো না আর। রেহান কাউকে বোঝাতে পারেনি যে মাকে কোনোদিন দেখেইনি ও, তার কথা এক্কেবারে মনে পড়ে না ওর। শুধু জিনিয়াদিও যে ওকে এভাবে ফাঁকি দেবে সেটা ও কোনোদিন বুঝতে পারেনি। সেই ক্লাস এইট থেকে পড়াতো ওকে কিন্তু কবে যে সব কিছুর ভরসা হয়ে উঠেছিল জিনিয়দি নিজেই বোঝেনি রেহান। পাতার পর পাতা কবিতা কিংবা ক্যানভাসে রঙ তুলিতে জিনিয়াদি ধরা পড়তে শুরু করেছিল সবে যখন-সদ্য ডাক্তারীতে সুযোগ পেয়েছে তখন রেহান। হঠাৎ একটা শীতের বিকেলে চলে গেল জিনিয়াদি- কেউ জানে না সেদিন সন্ধ্যায় শ্মশানে গিয়েছিল রেহান, মনকেমন হাওয়া আর শিশির মেখে বহুক্ষণ গঙ্গার ধারে বসে ছিল। যতক্ষণ না ভালোবাসার শেষ বিন্দুটা অবধি তারা হয়ে জ্বলছিল আকাশে।
জিনিয়া জানত সময় ফুরিয়ে আসছে। রক্তে বাসা বেঁধেছে মারণরোগ। আর নিস্তার নেই। তাই বসন্তকে আটকে রেখেছিল দুয়ারেই- চিরকাল। কি লাভ কাউকে যন্ত্রণা দিয়ে। তার চেয়ে সব ব্যথা থাকুক একান্ত ওরই।
জিনিয়াদি ভালোবাসতো মহুলদাকে আর মহুলদা আমাকে। একদিন ভীষণ হেসে হেসে জিনিয়াদি বলছিল- 'জানিস পাগলি, মহুলটা তোকে বড্ড ভালোবাসে'-অথচ জিনিয়াদির ছিল চোখভর্তি জল। কোনো যন্ত্রণাটা ওকে বেশি বিঁধছিল জানি না, কিন্তু এই চোখে জল, মুখে হাসি আমার বড্ড চেনা লেগেছিল-
কোনো একদিন ঋতুর জন্য আমিও এভাবেই...
একটা হেমন্তের বিকেলে আমার হাতদুটো নিজের শীর্ণ হাতদুটোতে চেপে ধরে বলেছিল-'কথা দে মহুলকে দেখবি'।মহুলদা সাড়ে তিনবার হোঁচট খেয়ে অবশেষে গতকাল বলতে পেরেছে আমাকে ভালোবাসে। উত্তরটা আমি দিইনি কাল। আজ পয়লা ফাল্গুন। আজ দেবো ভাবছি।
কাল থেকে খালি ফিক ফিক করে হেসে ফেলছি মাঝে মাঝে। ঋতুর কথা আমি কি এখনো ভাবছি? বুঝতে পারছি না, কিন্তু এটুকু বুঝছি আর হয়তো 'না' বলা যাবে না।
"অভিমান আমার ওষ্ঠে এনে দেয় স্মিত হাস্য
আমি এমনভাবে পা ফেলি যেন মাটির বুকেও
আঘাত না লাগে
আমার তো কারুকে দুঃখ দেবার কথা নয়"
সে যাই হোক-সবচেয়ে বড়ো কথা হল আজ ভালোবাসার দিন, আজ পয়লাবার ফাগুনের একলা থেকে দোকলা হওয়ার দিন।Valentine Day Special story ❤
ভালোবেসে ভালো থাকুন।
YOU ARE READING
অন্তহীন
Short Storyজীবন সমান্তরালে চলতে চলতে হঠাত্ মিলিয়ে দেয়, কখনো বা মিলনের প্রত্যাশাতেই কেটে যায় সময়। ছোট্ট একগুচ্ছ গল্প। একটু অন্যস্বাদের ভালোবাসার গল্প লেখার ব্যর্থ প্রচেষ্টা। ● সূচিপত্র ♡ চুয়ান্ন সেকেন্ড ♡ ম্যাজিক অপেক্ষা ♡ অসম্ভব ভালোবাসার গল্প ♡ শুভারম্ভ ♡...