আমি ঝাপটিয়ে মামুনের পেছনের গেন্জি শক্ত করে ধরলাম। আমার হাত পা মৃগী রোগির মত কাপছে। আমি যাব না, কখনোই যাব না।
আমি মামুনের পেছনে ফুপিয়ে কান্না করতে লাগলাম। মামুন আমাকে দিয়ে দেওয়ার জন্য আমার হাত ধরল। আমি আরো শক্ত করে মামুন কে ধরলাম। আমি যাবো না। শুধু এই কথা জপতে লাগলাম কাদতে কাদতে। তারপর আমাকে টানতে না পেরে মামুন ফারান কে বলল
...... আপনি সামনে যান আমি ওকে নিয়ে আসতেছি।
..... কেন? না এখন। ওয়েট আমি সাহায্য করতেছি।
এবার মামুন বাধা দিল।
...... দেখতেছেন না ও কান্না করতেছে। আপনার ভালো লাগতেছে ওকে কান্না করতে দেখে? আমি বুঝিয়ে নিয়ে আসছি।
এবার ফারান নিজে নিজে কিছু ভাবল। তারপর আমার দিকে তাকাল। আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম।
..... ঠিক আছে নিয়ে আস।
ফারান চলে যেতেই মামুন একটা হেচকা টানে পেছন থেকে সামনে আনল। আমি তাড়াতাড়ি ওর পায়ে পড়লাম।
.... আমি ওর সাথে যাবো না। আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে দিয়েন না।।
আমি পা ধরে কাদতে লাগলাম। আর মামুন দু হাত দিয়ে উপরে তুলল।
..... বেকুব কোথাকার!! মাথায় বুদ্ধি সুদ্ধি নাই কেন তোমার? তুমি আসলে গাধী টিচার।।
আমি ওর দিকে হা করে তাকায় থাকালাম। কারন ও কি বলতেছে তা আমি বুঝতে ছিলাম না। সে আবার বলল
..... তোমার কি মনে হয়? আমি না দিলে ফারান তোমাকে নিত না? অবশ্যই নিত। তাতে তোমার ক্ষতি বেশি হত।
..... মানে??
..... মানে বোঝার দরকার নাই। এদিকে আস।
এই বলে আমাকে হাত ধরে ওদের বাগানের পিছনে নিয়ে যেতে লাগল। আমি কোনো কথা বললাম না। বাগানের শেষ দিকে একটা গলির মত। ওই খান দিয়ে রাস্তা একটা দেখা যাচ্ছে। তারপর মামুন বলল
..... এদিক দিয়ে তুমি ছোট রাস্তায় উঠবা। তাহলে তোমার যেখানে ইচ্ছা ওই খানে যেতে পারবা।
..... ফারান যদি আসে???
..... ওইটা আমি সামাল দিব। তুমি যাও।
আমি যেতে গিয়ে আবার পিছন ফিরে আসলাম।
...... কি হয়ছে? আবার আসছ কেন?
..... আপনি যান নাই কেন বেড়াতে??
.... কোথায় যাবো?? শপিং এ? ওরা শপিং এ গেছে।
...... ঠিক আছে।
এই বলে আমি ছোট গলির মুখে হাটতে লাগলাম। বাড়ির দিকে গেলাম না। কেননা ওই দিকে মারোয়া দের বাড়ির গেইট পড়ে। তাই ভয়ে ওই দিকে গেলাম না। অনু দের বাড়ির দিকে হাটা শুরু করলাম। চোখের পানি গালে শুকিয়ে দাগ হয়ে আছে। অনু দের বাড়িতে গিয়ে প্রথমে ভালো করে মুখ ধুয়ে নিলাম। কিন্তু ভলো করে পড়াতে পারলাম না। কিছুতে মন বসছে না। অনু ও বার বার জিজ্ঞেস করতেছিল কি হয়ছিল। আমি শুধু বলছিলাম কিছু না। অনুর আম্মু ও বলতে লাগল কি হয়ছে আমার। আমি কিছু বলতে পারলাম না। বেড়িয়ে আসলাম অনু দের ঘর থেকে। ওই দিকে ঝুম ঝুম বৃষ্টি ও শুরু হয়ছে। ছাতা মাথায় বাড়ির দিকে আসছিলাম। পুরা রাস্তা নির্জন হয়েছিল। অবশ্য বৃষ্টি হলে এরকম নির্জন হয়ে থাকে। সামনে দিকে তাকালাম। সাদা আলো নজরে এলো। বৃষ্টির জন্য ভালো করে কিছু নজরে আসছে না। আরেকটু এগিয়ে যেতেই দেখলাম এটা একটা কার। বেশ দামি বোঝাই যাচ্ছে। আমি থমকে দাড়ালাম। এরকম রাস্তার মাঝখানে চালু অবস্থায় কেন রাখা হয়ছে কারটা?? কিছুক্ষন পর গাড়ির দরজা খুলে কেউ একজন বেড়িয়ে এলো। আমার বুকটা দুরু করতে লাগল। আয়াতুল কুরসি পড়তে লাগলাম। যা ভাবছি তা যেন না হয়। লোকটা আমার কিছু দুর এসে থেমে গেল। এবার লোকটা কে দেখে চিনতে পারলাম। স্বয়ং যমরাজ দাড়িয়ে আমার সামনে। আমি ছাতার ডাট শক্ত করে ধরলাম। আর ঢোক গিলতে লাগলাম। ভয়ে আমার চেহরা পাংশু হয়ে গেল। মুখ থেকে মনে হল রক্ত সরে যাচ্ছে। যে কেউ আমার চেহরা দেখলে বুঝতে পারবে। এবার ফারান এগুতে লাগলো। আমি কাঠ হয়ে দাড়িয়ে রইলাম। আমার পা অবশ হয়ে গিয়েছিল। আমার মাথায় জোরে চিৎকার হচ্ছিল পালাও পালাও। কিন্তু আমার মন বলছিল একটু দাড়াও।
ফারান আমার দু হাত দুরত্বে দাড়াল। ওর চেহারা শুকনো হয়ে আছে। এই বৃষ্টিতেও বোঝাই যাচ্ছে চোখের নিচে কালি জমেছে। বৃষ্টি তে ওর পুরা শরীর ভিজে যাচ্ছিল। চুলচুল গুলো এলো মেলো হয়ে কপালে লেপ্টে রইল। বার বার শুধু ফারান চুলগুলোকে পিছনে নিয়ে যাচ্ছিল। আর বুকের দুটো বেতাম খোলা। সাদা শার্ট এর হাতা হাফ গোটানো। মোট কথায় অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল ফারান কে।
ফারানের কথায় আমার হুশ আসল। ছি ছি আমি কি করতেছি!! আমি এতক্ষন ফারানকে দেখছিলাম!! তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে ফেললাম। ও শুকনো হেসে বলল
...... যতক্ষণ খুশি দেখতে পারো আমাকে। কারন আমার উপর শুধু তোমার হক।
এবার চোখ তুলে বললাম
...... কেন এসেছেন এখানে?? চলে যান আর আমাকে একটু শান্তি দেন।
...... মোহিনী!! এমন করে বলো না। আমি তোমাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি।
...... কিন্তু আমি আপনাকে ঘৃনা করি। চলে যান এখান থেকে।
..... মোহিনী তুমি যা চাইবে তাই দিব। যা চাইবে।। তোমাকে আমি খুব সুখে রাখব। প্লিজ মোহিনী!!
....... যা চাইবো তা দেবেন!!
ফারানের চেহেরাই খুশির ঝিলিক দেখা গেল। তাড়াতাড়ি সে বলে উঠল
..... হ্যা! যা চাইবে সব দেব মোহিনী। সব কিছু। শুধু একবার বলো কি লাগবে তোমার??
...... আপনার কাছ থেকে মুক্তি দেন। আমি আপনাকে দেখতে চাইনা। ঘৃনা হয় আমার। চলে যান এখান থেকে।
...... মোহিনী!!! ♥
ওর শরীর কেপে উঠল এ কথায়। আমি নিজে অনুভব করলাম। ও বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছিল। কথা বলতে পারছিলনা কতক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে বলল
..... এই একটা জিনিস আমি তোমাকে দিতে পারি না মোহিনী। এটা ছাড়া বাকি যা চাইবে তা দেব মোহিনী।
...... আমি আপনার কোন কিছু চাই না। দয়া করে আমাকে শান্তি দেন।
...... মোহিনী আমার কথা শোন
...... আপনি যদি আর আমার সামনে আসেন তাহলে আমি বিষ খাব। আর এটার জন্য আপনি দায়ী থাকবেন।।
..... মোহিনী!!! আর সাথে সাথে ঠাস করে একটা শব্দ হলো।
ফারান কথাটা সহ্য করতে পারল না। এমন জোরে আমাকে থাপ্পড় মারল মনে হল যেন কানে তালা লেগে গেছে।আমি শিউর ওর হাতের পাচঁ আঙ্গুলের দাগ আমার গালে বসে গেছে। আমি কথা বলতে পারলাম না। ফারান দু হাতে নিজের চুল চিরতে লাগল। আর এদিক ওদিতক হাটতে লাগল। আমার মনে হল এখন চলে যাওয়া উচিত। আমি হাটা শুরু করলাম। আর ফারান অমনি ডাক দিল।
..... মোহিনী
পিছন ফিরে ফারান কে বললাম
..... আমি কারো মোহিনী হতে চাই না। কখনোই না।
এই বলে যাব কিন্তু ফারান অদ্ভুদ কাণ্ড করে বসল। সে আমার সামনে হাটু গেড়ে বসে গেলো এবং হাত দুটো প্রসারিত করে দিল। তারপর বলল
..... Faran loves mohini forever ever and ever. please accept me my love!!! I will never hurt you please!!
এই কথা শুনে অতি পাষানেরও হৃদয় গলে যাবে। ওর পুরো শরীর কাপছিল। হয়তো বৃষ্টিতে এক নাগারে ভিজছিল তাই। ওর চোখ দিয়ে নিশ্চয় পানি জড়ছিল। এত ঠান্ডায় ওর কাপুনি দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। এত বড়লোকের ছেলে। নিশ্চয় বৃষ্টিতে ভেজার অভ্যাস নেই। চোখ বন্ধ করে আছে সে। আমি জানি না কি হচ্ছিল আমার। আমার পা আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওর দিকে হেটে যাচ্ছিল। ওর সামনে ছাতা নিয়ে দাড়ালাম। কি করছিলাম, কেন করছিলাম আমি নিজেও জানি না। ওর দিকে ছাতাটা একটু করে বাড়িয়ে দিলাম যাতে মাথায় বৃষ্টি না পড়ে। এরপর ধীরে ধীরে ওর কপালের চুল গুলো সরিয়ে দিতে লাগলাম। কপালে আমার হাতের স্পর্শ পেয়ে ও চোখ খুলে তাকাল। কপাল থেকে আমার হাতটা ধরে আলতো করে চুমু দিয়ে আমাকে ঝাপিয়ে জড়িয়ে ধরল। আর পুরা পিটে পাগলের মত হাত বুলাচ্ছিল। আমি ঠিকমত নিশ্বাস নিতে পারছিলাম না। এমন শক্ত করে ধরে ছিল সে আমাকে। ওর পুরো শরীর বরফের মত ঠান্ডা হয়েছিল। আমি জানি না এই মুহুর্তে আমার কি করা উচিত। ভালো করছি না খারাপ করছি। ফারান শুধু জড়িয়ে ধরে ক্ষান্ত ছিল না। আমার গলা ঘাড়ে চুমু দিতে শুরু করল। এটা পাপ। আমি তাকে সরিয়ে দিলাম। ও আমার দিকে বলল
..... আই অ্যাম স্যরি। আসলে আমি'''''''''
আমি দুই পা পিছু হটলাম। আমার ছাতা কোথায় উড়ে গেছে আমি জানি না। তখন দূর থেকে কে যেন ডাক দিল আমাকে। আমার নাম ধরে। এক বার দুই বার তিন বারের সময় বুঝতে পারলাম এটা আব্বু। সাথে রিফাতও রয়েছে। ব্যাপার কি? কি হয়ছে? এরা আমাকে খুজতে বের হয়ছে নিশ্চই। আব্বু আমাকে আবার ডাক দিল। আমি দৌড়ে আব্বু কে জড়িয়ে ধরলাম। রিফাত জিজ্ঞেস করল
..... আপু ওই লোকটা কে চিনিস?
আমি পিছন ফিরে ফারানের দিকে তাকিয়ে বললাম
..... না।
..... জানোস এ কি করছে??
আমি অবাক হয়ে বললাম
..... কি করছে??
আব্বু এবার বলে উঠল
.... চুপ রিফাত। একটা থাপ্পর দিব ধরে।আগে ঘরে চল।
.... আব্বু বল না কি হয়ছে??
আব্বু দাত কিড়মিড়িয়ে বলল
...... আগে ঘরে চল
আমি ভয়ে আব্বুর সাথে চলে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ফারান ডাক দিল
..... মোহিনী তুমি কোথাও যাবে না।
এবার আব্বু গিয়ে ওকে একটা থাপ্পর দিয়ে বলল
..... আমার মেয়ে আমি যেখানে খুশি নিয়ে যাব।
...... ভাল হবে না বলছি এটা।
এবার রিফাত বলে উঠল
..... কি করবি তুই বল??
এই অপমান টা নিশ্চই ফারানের সহ্য হল না। সে দু হাতে রিফাত কে ধরে জোরে ধাক্কা দিল। সেখানে সে রিফাত এলোপাতারি ঘুষি মারতে লাগল। আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম। কোনো মতে আমার ভাই কে ছাড়ানোর চেষ্টা করছিলাম। ওর নাক মুখ দিয়ে রক্ত জড়ছিল। আমি আর আব্বু ফারানকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছিলাম। শেষ পর্যন্ত আমার ভাই কে ছাড়ল সে। আমি তাড়াতাড়ি আমার ভাই কে দেখতে লাগলাম। ও নড়ছেনা। ফারানের হুশ ফিরে এলো নিশ্চই। সে আমার কাছে মাফ চাইতে লাগল
..... মোহিনী আমি বুঝতে পারিনি। আমি কখন ওকে'''''''''''
এবার আমি রাগ থামাতে পারলাম না।
..... তুমি মরে যাওনা কেন। চলে যাও এখান থেকে। তোমার এই মুখ আমি দেখতে চাই নানা।
...... মোহিনী তুমি দেখেছো ও আমাকে কি রকম অপমান'''''''''
এবার আমি উঠে ওকে ধাক্কা দিতে দিতে বললাম
..... যাও এখান থেকে। এখনি যাও।
...... মোহিনী!
...... চলে যাও। এবার যদি না যাও তাহলে আমার মরা মুখ দেখবে।
এই কথায় কাজ হল। ধীরে ধীরে ফারান গাড়িতে উঠে চলে গেল।
আমি হাউমাউ করে কান্না শুরু করলাম। আব্বু ততক্ষণে রিফাত কে টেনে তুলেছে আমিও ধরলাম। এরপএরপর ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। কিছুক্ষন পর রিফাতের হুশ ফিরলে বাড়িতে নিয়ে আসলাম। ইতোমধ্যে ফারানের কল্যানে আমি এলাকায় ফেমাস হয়ে গেলাম। কেননা মারোয়ার দের বাড়ি থেকে আমি পালিয়ে যাওয়ায় ফারান আমাকে খুজতে চিরুনি তল্লাশি চালিয়ে ছিল। আমাদের ঘরেঘরেও আসছিল। দলে দলে মহিলারা আসতে লাগল। কেউ মজা দেখার জন্য, কেউ পরামর্শ দেওয়ার জন্য, কেউবা বলার জন্য আগেই আমি বলেছিলাম মেয়ে মানুষ এত পড়ালেখা করে কি কবে। এখন বিয়ে দিবে কেমনে? ফকিরও বিয়ে করবেনা তোমার মাইয়া কে। আড়ালে অনেকে হাসাহাসিও শুরু করল। আম্মু কাদতে লাগল আর আব্বু চুপচাপ বাইরে চলে গেল। আমার এত হাসি খুশি ফ্যামিলি!! কি থেকে কি হয়ে গেল?? আমার কান্না ছাড়া আর গতি রইল না।
.
(চলবে)
.
দয়া করে লাইক আর কমেন্ট করবেন।। কেমন লাগল জানাবেন।। আপনাদের সাড়া পেলে পরবর্তীতে সম্পুর্ন দিয়ে দিব।।