.
কিছুক্ষন চেষ্টা করার পর চোখ ঠিক হল। এর পরই মারোয়াদের ঘরে পৌছলাম। দেখলাম মারোয়া প্রথম থেকেই পড়াতে বসা। ও পড়ছে। আমার খুব পছন্দ হল ওকে। ও দেখতে খুব ফরসা। ঘরের সবাই খুব ফরসা। কিন্তু মারোয়া কিছুটা ব্যাতিক্রম। ওকে দেখতে অনেকটা কোরিয়ান মেয়েদের মতো। পার্থক্য শুধু চোখে। ওর চেহেরায় কোরিয়ান একটা মডেল দেখেছিলাম। থাক সে কথা। ওকে পড়াচ্ছিলাম এমন সময় দরজায় দড়াম করে একটা শব্দ হল। শব্দে আমার বুকটা ছ্যাত করে উঠল। সাথে সাথে বুকে থু থু দিলাম। কিন্তু মারোয়ার তেমন ভয় পেয়েছে বলে মনে হল না। স্বাভাবিক ভাবে পড়ছে। মারোয়া কে জিজ্ঞাস করলাম
----- কি হলো? কিসের শব্দ এটা?
মারোয়া বলল
----- ভাইয়া আসছে।
------ এত জোরে দরজা কেন খুলছে? আস্তে খুলতে পারেনা।
----- দরজায় একটু সমস্যা আছে তাই ভাইয়া আর আস্তে ঠেলা দেয় না। জোরে ধাক্কা মারে। তাই এত শব্দ।
ঘরে মারোয়ার ভাই ঢুকলো। আমি সরাসরি না থাকিয়ে আড় চোখে তাকালাম। তাকিয়েই আমার মাথায় হাত পড়ল। এ- এ তো মামুন! মামুন যে মারোয়ার ভাই হবে সেটা আমি বিন্দু মাত্রও ভাবি নি। আমি বরাবরই কখনো মামুনের দিকে কখনো তাকায় নি। কারন ওর চোখের দিকে কখনো তাকাতে পারতাম না। ছোটবেলা থেকেই একই এরিয়ায় হওয়ায় প্রায় সময় তাকে দেখতাম। যখনই দেখতাম চোখ নামিয়ে ফেলতাম। কারন ছেলেদের চেহারার মাঝে সৌন্দর্য্যের সাথে গাম্ভীর্য্য যোগ হলে তার দিকে সরাসরি তাকানো যায় না।। চোখ নামিয়ে ফেলতে হয়।
.
মামুন অন্য ঘরে ঢুকে গেলে তারপর নিশ্বাস নিতে পারলাম।
মামুন ছেলেটা অসম্ভব সুন্দর। আর তার গাম্ভীর্য কে ভয়ানকও বলা যায়। ছেলে মানুষের এত সুন্দর হওয়া অপরাধ। ও আমার চেয়ে দু বছরের বড়। যখন রাস্তা দিয়ে হেটে যায় তখন পুরা রাস্তা থমকে যায় এক পলকের জন্য। সবাই এক বার হলেও তাকায় ওর দিকে। ওর সাথে রাস্তায় দেখা হলে আমি মাথা নিচু করে পাশ কাটিয়ে চলে আসি। কারন ওর দিকে আমি তাকাতে পারিনা। যেমন সূর্যের দিকে কেউ তাকাতে পারে না ঠিক তেমনি।। ও কখনো আমাকে খেয়াল করেছে কিনা কে জানে?
.
ভাবনায় ছেদ পড়ল মামুন আবার আসাতে। তবে এবার খালি গায়ে। তার উপর খাটো প্যান্ট। ওর ফরসা শরীর পুরাটা দেখা যাচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে ফেললাম। আমার হাটু সহ কাঁপতে শুরু করল। কাপা কাপা গলায় মারোয়া কে বললাম
------ তো..তো..তোমা..মার ভাইইই খা..খালি গায়ে কে..কেন?
মারোয়া আমার দিকে না তাকিয়ে উত্তর দিল
----- ভাইয়া এখন গোসল করবে তাই। এই সময় ভাইয়া গোসল করে।
খাইছে কপাল! প্রতিদিন যদি খালি গায়ে ওকে দেখি তাহলে আমি হার্ট এট্টাক করব।
ইয়া আল্লাহ আমি কি ভাবতেছি এগুলা? এগুলা পাপ। জোর করে মনটা মারোয়ার দিকে আনলাম। কোন রকম পড়া শেষ করে আমি তাড়াতাড়ি বাড়িতে চলে আসলাম। বাড়িতে এসেই শরীর টাকে বিছানাই এলিয়ে দিলাম। মনে মনে ভাবতে লাগলাম এভাবে তো চলতে পারেনা। ওই সময় আমি আর যেতে পারব না। আমার মারোয়া দের ওই খানে যাওয়ার সময় বদলাতে হবে। অনেক ভেবে চিন্তে সকালের সময় টা ঠিক করলাম। এটা ঠিক হবে। ফোন করে মারোয়ার মা কে এই কথা বলে দিলাম। অামার কথা শুনে আম্মু এসে বলতে লাগল
----- কিরে খারাপ লাগতেছে নাকি? শুয়ে পড়লি কেন? দুপুরে খেতে আসিস নি কেন? না খেলে শরীর খারাপ হবেনা তো কি হবে? উঠ আর দুইটা খেয়ে নে
আমি মার দিকে তাকিয়ে
-----ভাত আছে?
----- আছে। কিছুক্ষন আগে তোর আব্বু চাল এনে দিছিল।
আমি উঠে বসলাম। গিয়ে দেখলাম ভাত রান্না হয়ছে ঠিক কিন্তু দুপুরের ভাতের ডেকচির ঢাকনা উল্টিয়ে দেখলাম। এখনো অল্প ভাত রয়ে গেছে। অথচ আমার মতে ভাত থাকার কথা না। তার মানে.....
আমি জোরে ডাক দিলাম
----- আম্মু.. আম্মু... তুমি ভাত খাওনাই কেন?
----- তুই খাসনি কেন?
----- আমি তো কাজে ব্যস্ত ছিলাম তাই।
----- তুই না খাইলে আমি কিভাবে খাব বল?
আমার মা টা এতো পাগল কেন? নাকি মায়েরা এরকম পাগলই হয়! আমি হাত ধরে নিয়ে গেলাম। একসাথে খেতে বসলাম। রিফাত চলে আসলে সেও বসে গেল খেতে। আব্বু ও কি দিতে এসেছিল। সেও খেতে বসল। কারোই পেট ভরল না কিন্তু মনটা ভরে গেল। শুধু একজনের অভাব। আমার বোনের। সে ও যে তেমন সুখি নাই। অনু দের টাকা দেওয়ার কথা। ওটা পেলে যা কিনে দেওয়ার দেব।
এসব ভাবতে ভাবতে দু চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে এল।
এভাবে বেশ কিছু দিন কেটে গেল। মামুনের মুখোমুখি আমাকে হতে হয় না। সকালে গিয়ে মারোয়া কে পড়ায় অাসি তখন ও ঘুমে কাতর থাকে। আর রিফাত একটা পার্ট টাইম জব পাইছে। আমি মানা করেছিলাম ওর পড়ার কথা ভেবে। কিন্তু ও মানতে নারাজ। সাথে একটা টিউশনি নিল। এজন্য আমাদের দারিদ্র্যতা কিছুটা দুর হয়ছে। আমিও আরেকটা টিউশনি নিসি। বলতে গেলে আমার জীবন টা এখন নরমাল হয়েছে। টেনশন ফ্রী জীবন। ভালো করে পড়তেছি। সামনের পরীক্ষার জন্য। তবে নিয়মিত বেলী ফুল খোঁপায় লাগানো আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। ওইটা লাগায়। আর চোখ নাচুনি টা বন্ধ হয় নি। ওই টা চলতে লাগল। আমি এবার আর পাত্তা দিই না। আমার এই নরমাল জীবনে একটা ছোট্ট ঘটনা ঘটল। মারোয়ার আম্মুর ভাইয়ের ছেলের বিয়ে সামনের সপ্তাহে। ছেলেটা বিদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে এসেছে। সাথে বাবার ব্যবসা ও পেয়েছে। আর যার সাথে বিয়ে হবে সেও এক এমপির মেয়ে। এত বড় লোকের এলাহি কাণ্ড। ওই খানে যাবে মারোয়া রা। মারোয়ার আম্মু যেতে বললেন আমাকে তাদের সাথে। আমি মানা করে দিলাম। আমি গিয়ে ওদের সাথে এডজাস্ট করতে পারব না। তাছাড়া আমার কোনো ভালো কাপর চোপর নাই। ওই খানে গেলে আমাকে খ্যাত লাগবে সবার মাঝে। কিন্তু বাধ সাধল মারোয়া। অামাকে যেতেই হবে। ওর জোড়াজুড়ি দেখে ওর আম্মু আরেক বার বলল। এবারও আমি মানা করে দিলাম। কিন্তু মারোয়া মন খারাপ করে ফেলল। আমার কিছু করার ছিলনা। চলে আসার সময় মারোয়া কে মন খারাপ করতে মানা করলাম। তারপর মারোয়ার আম্মু কে ডেকে সব বুঝায় বললাম যে আমার ভালো কাপড় চোপড় নাই, তার উপর আব্বু দিবে না, তার উপর আমি এডজাস্ট করতে পারব না। মারোয়ার আম্মু মানলেন। আর তখন আমি বিদায় নিয়ে চলে আসলাম। মারোয়ারা পরশু যাবে বিয়েতে। একটু আগেই। আমি ঘরে আম্মু আব্বু দুজনকে বললাম। আব্বু রাজি হলেও আম্মু রাজি হল না। শুধু বলল গিয়ে কি করবে ওখানে? ঠিক তাই।।
কিন্তু আসল সমস্যা সৃষ্টি হল একদিন পরেই। মারোয়া কিছুতেই যাবেনা আমাকে ছাড়া। তাই বাধ্য হয়ে মারোয়ার মাকে আমাকে ফোন সকালে। বলতে গেলে সকাল না ভোর। সকাল ছয়টায় ফোন দিয়ে আমাকে আসতে বললেন। আমি অবাক হয়ে গেলাম। মারোয়া দের ওখানে যাওয়ার কথা সাতটাই। কিন্তু ছয়টায় কেন ফোন করছে? আর আজকে যাওয়ার কথা সিলেট। বিয়েতে আর কি! আজকে আমার ছুটি ছিল। যাই হোক চোখ ঢলতে ঢলতে রেডি হয়ে গেলাম। মারোয়া দের ওখানে গিয়ে আমার হা হওয়ার পালা।
.
সবাই এত সুন্দর করে সাজছে যে বলার মত না। মারোয়ার আম্মু কে তিন সন্তানের মত লাগছে না। আর মুক্তা কে তো আকাশ থেকে নেমে আসা কোন পরী। সবার তো খুশি থাকার কথা। কিন্তু সবার চেহেরায় বিষাদের ছায়া কেন? মুক্তা কে জিজ্ঞেস করতেই বলল
---- মারোয়া আপনাকে ছাড়া কোথাও যাবেনা অথচ দেরি হয়ে যাচ্ছে।
এবার আমার অবাক হওয়ার । মারোয়া আমাকে ছাড়া যাবে না কেন? ওর সাথে আমার অতটা ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় নি। মাত্র ১০/১৫ দিন হচ্ছে ওকে পড়াচ্ছি। আর এই কয়দিনেই মেয়েটা আমাকে এতটা আপন করে নিল! আমি মারোয়া কে জিজ্ঞেস করলাম
------ কিরে মারোয়া! কি হয়ছে? যাচ্ছো না কেন? দেখ না সবাই কত কষ্ট পাচ্ছে!
----- তো আপনি আমাকে কষ্ট দিচ্ছেন কেন?? আমার কষ্ট হচ্ছেনা?
আমি ওর কথা শুনে হা করে গেলাম। শেষ পর্যন্ত আমাকে রাজি হতে হল। মারোয়া খুশিতে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আম্মুকে ফোন করে জানালাম। আম্মু গাইগুই করছিল। উনি চাচ্ছিলেন না। তার পরও রাজি হলেন। মারোয়ার আম্মু আমাকে মুক্তার একটা একটা গাউন বের করে দিলেন। খুব সুন্দর গাউন টা। আমি রেডি হলাম ওদের ঘরেই। স্কুল এবং টিউশনি থেকে কয়েকদিনের জন্য ছুটি নিলাম। যখন ড্রেসটা পড়ে বের হলাম সবাই বলল তোমাকে দেখতে ভালো লাগছে। কিন্তু মারোয়া খুশিতে হাত তালি দিয়ে বলল আপনাকে ফ্রোজেন এর পুতুল এর মত লাগছে। আমি শুনে শুধু হাসলাম। কিন্তু মামুন যখন ঘরে ঢুকল তখন আমার দম আটকে গেল।নেভী ব্লু পাঠান পাঞ্জাবী তে মামুনের দিকে চোখ আটকে গেল। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। যেন তীর বিধল একটা! গহীন হৃদয়ে!!
.
চোখ নামিয়ে ফেললাম। গাড়ী রিজার্ভ করা হয়েছিল। আমি আর মারোয়া পিছনের সিটে, মুক্তা আর মারোয়ার আম্মু মাঝখানের সিটে। ড্রাইভারের সাথে মামুন বসল। যখন গাড়িতে উঠে বসলাম তখন আমার বাম চোখের পাতাটা আবার নাচতে শুরু করল। এবারও পাত্তা দিলাম না। এরপর গাড়ি রওনা হল সিলেটের উদ্দেশ্যে।(চলবে)